বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা কোথায়?

বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির পথে বাধা কোথায়?

খোকন দাস

সর্বজনকথা আয়োজিত ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনারে উপস্থাপিত বক্তব্যের অনুলিখন।

গত জুলাইয়ের পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতি প্রসঙ্গ ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। এখানে বিস্তৃত বলার সুযোগ নাই, শুধু কয়েকটা বিষয় সংক্ষেপে বলতে চাই। প্রথমে আমার ছোটবেলার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার গ্রামটা হিন্দু-অধ্যুষিত। তার মাঝখানে একটা প্রাইমারি স্কুল। রাস্তার দুই পাশে বাড়ি। স্কুলে ছোট একটা মাঠ। আমরা খেলছিলাম বিকালে। বেশ কিছু লোক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য একটা সভা করছিলেন। এক বন্ধুসহ আমাকে ডেকে বললেন: সামনে ইলেকশন, আমরা ক্যাম্পেইন করতে আসছি, তোমরা একটু বক্তব্য রাখো। আমার বন্ধু হারুন বক্তব্য রাখল। আমি বললাম, গত ইলেকশনে আমরা দেখেছি যে রাস্তার এদিকে একটা দাগ দেয়, ওদিকে একটা দাগ দেয়। বলা হয়, এই দাগের মধ্যে হিন্দুরা আজ আসবা না। দাগ দিয়ে দিলে তো আর আলোচনার দরকার নাই। আপনারা দাগ দিয়ে দিয়েন। বলার পর তাদের সবার চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল। একজন বললেন, ও তো বাচ্চামানুষ, ঠিকই বলেছে। আমরা তো আসলেই দাগ দিয়ে দিই। গতবারও দাগ দিছি যে ওরা যেন না আসে।

গত ইলেকশনে আমরা দেখেছি যে রাস্তার এদিকে একটা দাগ দেয়, ওদিকে একটা দাগ দেয়। বলা হয়, এই দাগের মধ্যে হিন্দুরা আজ আসবা না। দাগ দিয়ে দিলে তো আর আলোচনার দরকার নাই। আপনারা দাগ দিয়ে দিয়েন। বলার পর তাদের সবার চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল।

এরপর জাতীয় ইলেকশন হলো, আমরা আরও উপরের ক্লাসে উঠলাম, তখন দেখলাম যে আর দাগ না, লাল পতাকা দিয়ে দেয়। যে রাস্তার এদিকে একটা লাল পতাকা, ওইদিকে একটা লাল পতাকা। এপারে আসবা না। আজকের দিনটা আসবা না। তখন আমাদের বাড়ির বয়স্ক কাকা-জ্যাঠা এরা সবাই মিলে কী করত – ওইদিন পুকুরে মাছ ধরত, একটা পিকনিকের মতো ব্যাপার ছিল।

একটা জাতীয় ইলেকশনে আমার কাকা, আমার কাকাকে সবাই চিনতেন, উনি তখনকার সময়ে বিএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। ওনারা কয়েকজন গেলেন ভোট দিতে। ওনার সামনে এলে সাধারণত কেউ কথা বলে না। এতটা সম্মান করত। কিন্তু ভোটের দিন চিত্রটা পালটে গেল। ওনাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল এই বলে যে, ‘তোমরা তো নৌকায় ভোট দিবা। তাহলে দেওয়ার দরকার নাই।’ এরপর থেকে উনি আজ পর্যন্ত কোনো ভোট দেননি।

যারা ক্ষমতায় যায় এবং ক্ষমতায় যেতে চায়, তারা হিন্দু ইস্যু তৈরি করে। আওয়ামী লীগ মনে করে যে হিন্দুরা হচ্ছে তাদের ভোটব্যাংক। আরেকটা অংশ হিসাব করে, হিন্দুরা যদি ভোট দেয় তাহলে তো ৫/৭/৮ শতাংশ আওয়ামী লীগ এমনিই এগিয়ে থাকে। তাহলে তাকে ঠেকাতে হবে। ভোটের পর যারা হেরে যায় তারা মার দেয়, আবার কেউ জিতে গেলে সে-ও মার দেয়। অতএব এই-যে ক্ষমতার পরিবর্তন, এর সঙ্গে মাইনরিটি হিসেবে হিন্দুদের মার খাওয়া একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে।

এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমাদের যে অভিজ্ঞতা, প্রায় ৯০ শতাংশ ‍মুসলিম অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বেড়ে ওঠার কারণে অসাম্প্রদায়িক যে পরিবেশ এখানে গড়ে উঠেছে তার কারণেই এখানে সংখ্যালঘুরা বা অন্য ধর্মের মানুষরা টিকে আছে। সমস্যা পলিটিক্যাল। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে ইন্ডিয়া একটা বড় ব্যাপার। এখানে একটা বিষয় খুব প্রচলিত যে হিন্দু মানেই হলো ভারতপ্রীতি এবং তারা থাকে এখানে কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে ওখানে (ভারতে)। কিন্তু হিন্দু, ভারত এবং আওয়ামী লীগ–এগুলোর একটা জটিল রসায়ন আছে। গত ১৫ বছরে আমরা দেখলাম, আমাদের দেশের ওপর ভারতের হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্য। আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তার জন্য দোষ পড়ে হিন্দুদের ঘাড়ে।

গত ১৫ বছরে আমরা দেখলাম, আমাদের দেশের ওপর ভারতের হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্য। আমাদের এখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তার জন্য দোষ পড়ে হিন্দুদের ঘাড়ে।

যেমন: গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের স্বার্থকেন্দ্রিক চুক্তিগুলো করেছে। অন্যদিকে ভারতীয় শাসকরা পুঁজির আধিপত্যের সমর্থনে হিন্দুত্ববাদী জোয়ার তুলতে চায়। এখানে হিন্দুদের মধ্যে কিছু লোককে তারা হিন্দুত্ববাদী জাগরণের মধ্যে নিতে চায়। গত ১৫ বছরে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে। গুলশানে বিরাট আকারে দুর্গাপূজা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে। আরেকদিকে সরকারি হিসাবই বলছে যে এখানে হিন্দুরা কমে যাচ্ছে। দুর্গাপূজা করতে না চাইলেও জোর করে করানো হচ্ছে। কেন? দেখাচ্ছে ইন্ডিয়াকে যে আমাদের এখানে খুব শান্তি। আবার পূজার আগে আগে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলছেন যে হামলা হতে পারে। তারা বোঝাচ্ছে যে আওয়ামী লীগ যদি না থাকে তাহলে হামলা হবে, জঙ্গি হবে, এই সমস্ত ঘটনা ঘটবে। তারমানে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে এখানে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতকে ডিল করার ক্ষেত্রে হিন্দুদের ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ভারতও উল্টোদিক থেকে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হিন্দুদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।

হিন্দুধর্মের বেসিকই হচ্ছে বহুত্ববাদ। এখন সেখানে জোর করে শ্রীরাম তার মাথার মধ্যে গেড়ে বসানো হচ্ছে – একত্ববাদ হতে হবে, শ্রীরাম হতে হবে। এবং শ্রীরামের স্লোগান দিয়েই সেখানে অনেক মুসলমানের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমাদের এখানেও কিছু লোক এই স্লোগানটা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে জমি দখল। এই দখলগুলোর সঙ্গে কারা যুক্ত? গত আমলে এখানে যে র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তার নাম শোনা যায় হিন্দুদের জমি দখল করেছেন। তারপর বিভিন্ন বড় বড় ক্ষমতাসীন ব্যক্তি এই জমিগুলো দখল করেন।

আরেকটা বিষয় মিডিয়ার ভূমিকা। যেমন: খবরের শিরোনাম দেখলাম, ‘ডিবি কার্যালয়ে হিন্দু অফিসার খুব রূঢ় আচরণ করেছেন।’ এটা কীভাবে লিখতে পারে? ‘হিন্দু’ অফিসার কেন? একজন না হয় করল, বাকি যেসব অফিসার রয়েছে, আয়নাঘর, এগুলো করা হলো – এগুলো কারা করল? তাদেরকে কে নিয়ন্ত্রণ করল? তাদেরকে কে নির্দেশ দিল? হতে পারে, সে কিছু বাড়াবাড়ি করতেও পারে। আবার যে মুসলিম সে-ও হয়তো মনে করতে পারে যে সে হিন্দু বলেই আমার ওপর অত্যাচার বেশি করছে, সেটা ভিন্ন আলোচনা, ভিন্ন দিক। কিন্তু একটা পত্রিকায় যখন এভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তখন সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা তৈরি করে।

আরেকটা বড় দিক আছে। যেমন ধরেন, গত ১৫ বা পুরা ৫৩ বছরে এই কমিউনিটির পক্ষে নিজস্ব কোনো সংগঠন নাই, তার কোনো লিডারশিপ গড়ে উঠে নাই। আমরা যারা বাম ঘরানার, তারা নিজেদের সেক্যুলার অবস্থান বজায় রাখার জন্য তার কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তারা কথা বলতে চান না। তারা মনে করেন আমি এই কমিউনিটির কথা বললে কমিউনাল হয়ে যাব। অন্যদিকে হিন্দু কমিউনিটি তাদের হয়ে কথা বলার জন্য যাদের বাছাই করেছেন তারা তাদের কথা বলেননি। তারা শাসকদের কথা বলেছেন। এবং এ কারণেই এই গোষ্ঠীটা বিপন্ন। তাদের কোনো কণ্ঠস্বর নাই। তাদের কোনো নেতৃত্ব নাই।

ইন্ডিয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের হিন্দু কমিউনিটির বহু লোক, আমি নিজেও টকশোতে এটা নিয়ে কথা বলেছি, কথা বলেছেন। আমাদের আরেকজন বললেন যে, এক ইঞ্চি জমিও যদি ভারত নেয় তার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমাদের আমরা ওই এক ইঞ্চিও ভেঙে দিব। আমাকে অনেকেই ভিডিও পাঠিয়ে বলেছে যে ওনাকে চেনেন? সন্দেহ হচ্ছে যে একজন হিন্দু এই ভাষায়ও কথা বলতে পারে! এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি বলি চিনি, উনি আমাদের লোক। তারপর আশ্বস্ত হলেন যে হ্যাঁ বলা যায়, হিন্দুরা এ রকম বলতে পারে।

হিন্দুরা কথা বলবেই – মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে প্রচুর হিন্দু রক্ত দিয়েছে। হিন্দুর রক্ত, মুসলিমের রক্ত এখানে আলাদা করার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু সে জোর দিয়ে বলতে পারছে না যে এইটা আমার দেশ। আমি নির্যাতিত হচ্ছি–এইটা বলতে পারছে না। কেন? তার নেতৃত্ব গড়ে উঠে নাই। এবং যাদের ওপর সে ভার দিয়েছে তার কথা বলার জন্য, তারা কিন্তু তার কথা বলে নাই। তারা আখের গুছিয়েছে এবং শাসকদের পক্ষে চলে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে প্রচুর হিন্দু রক্ত দিয়েছে। হিন্দুর রক্ত, মুসলিমের রক্ত এখানে আলাদা করার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু সে জোর দিয়ে বলতে পারছে না যে এইটা আমার দেশ। আমি নির্যাতিত হচ্ছি–এইটা বলতে পারছে না। কেন? তার নেতৃত্ব গড়ে উঠে নাই। এবং যাদের ওপর সে ভার দিয়েছে তার কথা বলার জন্য, তারা কিন্তু তার কথা বলে নাই। তারা আখের গুছিয়েছে এবং শাসকদের পক্ষে চলে গেছে।

এখন দরকার হচ্ছে যে হিন্দু কমিউনিটির তার নেতৃত্ব তৈরি করা। এবং নিজের কথা বলা যে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলছি। ড. ইউনূস বললেন যে আপনারা হিন্দু হয়ে আমাদের কাছে আসবেন না। আপনারা নাগরিক হয়ে আসবেন। কথাটা শুনতে খুব সুন্দর, কিন্তু এর ভেতরে সমস্যা আছে। হিন্দুরা যখন আসবে তখন কী দাবি নিয়ে আসবে? সে বলবে সম্পত্তির অধিকারের কথা, আমার জায়গা দখল হয়ে গেছে, আমার নিরাপত্তার কথা–এই দাবিগুলো কী? এগুলো গণতান্ত্রিক দাবি। তাহলে এগুলো সে কীভাবে বলবে? সে হিন্দু হয়েই তো বলবে। কিন্তু এমনভাবে বলা হচ্ছে যে আপনি হিন্দু হয়ে আসবেন না। আপনি নাগরিক হয়ে আসেন। তো নাগরিক হিসেবে একটা কমিউনিটি যখন আক্রান্ত হয় তার কণ্ঠস্বর তো সেই হিসেবেই তুলতে হবে।

আমাদের এখানে বহু গণতান্ত্রিক মানুষ আছেন, সংগঠন আছে, তারাও বলেন। একটা দেশ কতটুকু গণতান্ত্রিক? একটা দল কতটুকু গণতান্ত্রিক? সেটার কতগুলো মাপকাঠি আছে। সেই দেশের নারীরা কতটুকু নিরাপদ? সেই দেশের সংখ্যালঘু বা অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠী এবং অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয়ের মানুষ কতটুকু নিরাপদ? এ দেশের হিন্দুরা বা অন্যান্য জাতির মানুষেরা কতটুকু নিরাপদ–সেটা নির্ভর করে সে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটুকু আছে তার ওপর। আমাদের দলগুলোর মধ্যে যদি এই গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে এবং দলগুলোর যদি সমস্ত মানুষকে ধারণ করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকে এবং তাদের নেতৃত্ব যদি তৈরি না হয়; তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রস্তুত হতে হবে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন দরকার এবং সবচেয়ে শেষ কথা হচ্ছে আমাদের এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে, কোনোভাবেই সেটা থেকে আমাদের বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এটাই একমাত্র সমাধান। আমরা সেই লড়াইয়ে আছি, থাকব–এটা বলেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।

অনুলিখন: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

খোকন দাস: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্র নেতা

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •