চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ঝুঁকি

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ঝুঁকি

কল্লোল মোস্তফা

চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান ছাড়াই জিটুজি পদ্ধতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বন্দর ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তির আলোচনা চলছে। এই লেখায় এই উদ্যোগ পর্যালোচনা করে জাতীয় স্বার্থের জন্য ঝুঁকির দিকগুলো উন্মোচন করা হয়েছে।

এই উদ্যোগটি প্রথমে নিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের মার্চে। বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা সেই সময়ই এর বিরোধিতা করেছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের সেই সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। ২০২৪-এর ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভায় প্রকল্পের টাইমলাইন ঠিক করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাকমতো এগোলে দর-কষাকষি করে নভেম্বরে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কনসেশন চুক্তি হবে। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারা কনটেইনার ওঠানামার মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে এবং বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনার প্রতি অর্থ প্রদান করবে। তবে এখনো স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি যে, ডিপি ওয়ার্ল্ড কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে, এই বিনিয়োগের ফলে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের উন্নয়ন ঘটবে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের মধ্যে আয় কী অনুপাতে ভাগাভাগি হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো নিউমুরিং টার্মিনাল, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলরত একটি ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যত কনটেইনার ওঠানামা করা হয়, তার ৪৪ শতাংশই হয় এই টার্মিনালের মাধ্যমে, বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয়ও হয় এই টার্মিনাল থেকে। ১৭ বছর ধরে এ রকম লাভজনকভাবে চলতে থাকা একটি টার্মিনাল কেন বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দিতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

কেউ কেউ বিভিন্ন দেশের বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনা করে দেখাচ্ছেন যে, চট্টগ্রাম বন্দর কত অদক্ষ। তাদের বক্তব্য অনুসারে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করলেই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো: একটা দেশের বন্দরের পারফরম্যান্স কি শুধু অপারেটরের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে নাকি বন্দরের চ্যানেলের গভীরতা, টার্মিনাল ও জেটির সংখ্যা, ইয়ার্ডের জায়গা, কাস্টমস ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতি ঘণ্টায় ক্রেন মুভের সঙ্গে অপারেটরের দক্ষতার সম্পর্ক থাকলেও অন্যান্য বিষয় যেমন: জাহাজের অপেক্ষার সময়, বার্থে অবস্থানকাল, কনটেইনার ডুয়েল টাইম, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ, বার্থ অকুপেন্সি ইত্যাদি সবকিছু বন্দরের সার্বিক অবকাঠামো, চ্যানেলের গভীরতা, জেটির সংখ্যা, কাস্টমস ব্যবস্থাপনা, রেল-সড়ক যোগাযোগ, বন্দরের ইয়ার্ড ইত্যাদি নানা কিছুর ওপর নির্ভর করে। কাজেই শুধু বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এ রকম ধরে নেওয়া সঠিক নয়।

অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল পলিপ্রবণ। নিয়মিত ড্রেজিং করলে বন্দর চ্যানেলে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটার গভীরতা পাওয়া যায়। ভাটার সময় গভীরতা নেমে আসে ছয়-সাত মিটারে। এ নাব্য সীমাবদ্ধতায় বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ সংকট ছাড়াও কাস্টমসে জটিলতা এবং দেশের অর্থনৈতিক হাবগুলোর সঙ্গে দুর্বল সংযোগের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারছে না।

ডিপি ওয়ার্ল্ডকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দিলে তারা কি বন্দর চ্যানেলের গভীরতা ও প্রশস্ততার যে সমস্যা কিংবা কাস্টমস ও কানেকটিভিটির যে দুর্বলতা সেসবও সমাধান করে ফেলবে? সিঙ্গাপুর বন্দরে জাহাজের অনুমোদিত ড্রাফট বা গভীরতা (জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে) ১৬ মিটার পর্যন্ত। শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে তা ১৮ মিটার। ভিয়েতনামের সায়গন বন্দরে সাড়ে ১১ মিটার পর্যন্ত। অন্যদিকে দেশটির কাই মেপ বন্দর বর্তমানে বিশ্বের বৃহৎ কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাযোগ্য একটি গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে ১৬ থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে। আর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সাড়ে ৯ মিটার এবং যা কেবল জোয়ারের সময়ই পাওয়া যায়।  আসলে বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়ার যৌক্তিকতা তৈরি করার জন্যই উদ্দেশ্যমূলকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেশি গভীর ও প্রশস্ত চ্যানেলের বিভিন্ন বিদেশি বন্দরের সঙ্গে তুলনা করে হাইপ তৈরি করা হচ্ছে।

তা ছাড়া বন্দর পরিচালনার ভার কাকে দেওয়া হবে বা না হবে তা শুধু কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না। একটি দেশের বন্দর হলো কৌশলগত সম্পদ, যার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। যে ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ দেয়নি।

ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ দেয়নি।

আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই কোম্পানিটি ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা পিঅ্যান্ডও নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে—এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ড ওই বন্দরগুলোর পরিচালনার ভার পোর্ট আমেরিকা নামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, যা আজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল অপারেটর।

২০১৮ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কসকো শিপিং যখন হংকংভিত্তিক ওরিয়েন্ট ওভারসিজ লিমিটেড অধিগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের শর্তের কারণে ওরিয়েন্ট ওভারসিজ তাদের মালিকানাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ কনটেইনার টার্মিনাল তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ কনটেইনার টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ যেন চীনের হাতে না যায়, সে জন্যই এই শর্ত।

এ রকম আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে পানামা খালের দু-প্রান্তের প্রধান দুই বন্দর (বালবোয়া ও ক্রিস্টোবাল) পরিচালনা করছে হংকংভিত্তিক কোম্পানি সিকে হাচিসন। ট্রাম্পের অভিযোগ হলো: এতে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ কার্যত চীনের হাতে চলে গেছে। এর ফলে সৃষ্ট চাপের কারণে সিকে হাচিসন বন্দর পরিচালনার অংশীদারত্ব মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরকের কাছে বিক্রির ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করলেও চীনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও কর্তৃত্বকে আর দশটা সাধারণ বিনিয়োগের মতো দেখা হয় না। বিদেশি কোম্পানির মালিকানা নানা কারণে পরিবর্তন হতে পারে। মালিকানা পরিবর্তন হলে বন্দর পরিচালনার কর্তৃত্ব কার হাতে গিয়ে পড়ে তা নিয়েও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যেভাবে মালিকানা পরিবর্তন প্রভাবিত করতে পারে, অন্য দেশের পক্ষে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচনার প্রয়োজন।

বিদেশি কোম্পানির মালিকানা নানা কারণে পরিবর্তন হতে পারে। মালিকানা পরিবর্তন হলে বন্দর পরিচালনার কর্তৃত্ব কার হাতে গিয়ে পড়ে তা নিয়েও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা থাকে।

বন্দর ব্যবস্থাপনার ভার বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া কেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তা বোঝার জন্য পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতির একটি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সৃষ্ট টানাপোড়েনের ঘটনাটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। জিবুতির অবস্থান কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ— লোহিত সাগর ও গালফ অব এডেন-এর মধ্যবর্তী স্থানে, সুয়েজ খালের নিকটে—যেটি বিশ্বের ব্যস্ততম সামুদ্রিক পথগুলোর একটি। জিবুতি বন্দর শুধু জিবুতি নয়, ভূমিবেষ্টিত প্রতিবেশী ইথিওপিয়ার জন্যও প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে কাজ করে। এই ভূরাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং বন্দর ব্যবস্থাপনা বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে জিবুতি সরকার রাজধানী শহরের পাশেই ডোরালে নামে একটি নতুন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিল জিবুতির ইতিহাসে প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) প্রকল্প।

২০০৬ সালে, সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে একটি ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি সই করে জিবুতি সরকার, যার আওতায় ২০০৯ সালে চালু হয় ডোরালে কনটেইনার টার্মিনাল (ডিসিটি)। কিন্তু ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, জিবুতি সরকার ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে এই চুক্তি বাতিল করে। জিবুতি সরকার দাবি করে, চুক্তিটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং চুক্তির নানা অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্যই সরকার এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।

চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, চুক্তি কার্যকর থাকা অবস্থায় জিবুতি সরকার দেশের অন্য কোনো বন্দরের জন্য চুক্তি করতে পারবে না। এমনকি সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডার হয়েও ডিপি ওয়ার্ল্ড অধিকাংশ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা পায়, যার মাধ্যমে তারা বন্দরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল নাগাদ ডিসিটি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৭ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছিল, যদিও ব্যবসার পরিবেশ ছিল অনুকূল। জিবুতি সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি না দেওয়ায় দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পরে আরব আমিরাতের মালিকানাধীন ডিপি ওয়ার্ল্ড সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা বন্দর ইথিওপিয়াকে তুলনামূলক কম খরচে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়, যা জিবুতির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে।১০

চুক্তি বাতিল করার আগে জিবুতি সরকার দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চেষ্টা করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির সমস্যাগুলোর সমাধান করতে। এমনকি ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। প্রথমে তারা সম্মতি দিলেও পরে একটি নতুন শর্ত জুড়ে দেয়—জিবুতি যেন ভবিষ্যতে আর কোনো নতুন বন্দর উন্নয়ন করতে না পারে। এই শর্ত জিবুতির সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ হওয়ায় তা সরকার প্রত্যাখ্যান করে এবং একপর্যায়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে।১১

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে লন্ডনের একটি আদালত জিবুতি সরকারকে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গের জন্য ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে বলে। পরবর্তী সময়ে জরিমানাসহ এই অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩৩ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিপূরণ, রয়্যালটি ও আইনি খরচ।১২ জিবুতির এই দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, বন্দরের মতো কৌশলগত জাতীয় সম্পদ দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে কী ধরনের আইনগত, আর্থিক এবং ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

তা ছাড়া বাংলাদেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও উৎসাহজনক নয়। দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল’কে (আরএসজিটিআই) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২৪ সালের জুনে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল তৈরি করে। কথা ছিল ২৪ কোটি মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আগামী ২২ বছর আরএসজিটিআই টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। বিনিময়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ রাজস্ব পাবে বছরে ৩০০ কোটি টাকা।১৩

সম্প্রতি সমকালে প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, ১০ মাসেও প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাবে টার্মিনালটি পুরোদমে কার্যকর হয়নি। প্রত্যাশার মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে এই টার্মিনালটি। দৈনিক ২০ ফুট দীর্ঘ ১ হাজার ৩৬৯ কনটেইনার পরিচালনা করার সক্ষমতা থাকলেও এই টার্মিনালে হ্যান্ডলিং হচ্ছে মাত্র ১৭০-১৮০ কনটেইনার।১৪ শুধু তাই নয়, পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে কনটেইনারপ্রতি আয়ও হচ্ছে তুলনামূলক কম। পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দরের কনটেইনারপ্রতি আয় হচ্ছে ১৮ ডলার। অন্যদিকে নিউমুরিং টার্মিনাল থেকে বন্দরের বিদ্যমান আয় কনটেইনার প্রতি ৪৭ ডলার। পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য বন্দরের বিনিয়োগ কেবল জেটি নির্মাণে আর নিউমুরিংয়ের জন্য বিনিয়োগ জেটির পাশাপাশি যন্ত্রপাতিতেও।১৫ নিউমুরিং টার্মিনালে যেহেতু বন্দর কর্তৃপক্ষের বিনিয়োগ পতেঙ্গা টার্মিনালের চেয়ে বেশি, তাই সেখান থেকে দর-কষাকষির মাধ্যমে আয় হয়তো পতেঙ্গার তুলনায় বেশি হবে। তারপরও সেটা বিদ্যমান আয়ের চেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তা ছাড়া ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বিদেশি কোম্পানিকে বন্দরের টার্মিনাল ইজারা দেওয়া হলে কনটেইনার চার্জ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যা ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস করবে। উদাহরণস্বরূপ, UNCTAD-এর একটি প্রতিবেদনমতে, অস্ট্রেলিয়ায় ডিপি ওয়ার্ল্ড তার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে একতরফাভাবে অবকাঠামোগত সারচার্জ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়—মেলবোর্ন বন্দরে ২০১৭ সালে কনটেইনারপ্রতি সারচার্জ ৩.৪৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫.৩০ ডলার, যা ২০০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি। ব্রিসবেন ও সিডনিতেও একই রকম বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়, যা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।১৬

বিদেশি কোম্পানিকে বন্দরের টার্মিনাল ইজারা দেওয়া হলে কনটেইনার চার্জ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যা ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস করবে। উদাহরণস্বরূপ, UNCTAD-এর একটি প্রতিবেদনমতে, অস্ট্রেলিয়ায় ডিপি ওয়ার্ল্ড তার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে একতরফাভাবে অবকাঠামোগত সারচার্জ নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়

ডিপি ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়ায় ২০২১ সালেও টার্মিনাল একসেস চার্জ বৃদ্ধি করেছিল।১৭ ২০২৩ সালে তারা মেলবোর্ন বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের ঘনঘন ফি বৃদ্ধির বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গ্রায়াম স্যামুয়েল বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ কনটেইনার পোর্ট বেসরকারিকরণ করার ফলে বন্দর ব্যবহারের খরচ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় অবকাঠামো ও বাণিজ্যমন্ত্রীদের উচিত এই ফি বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা।১৮ ডিপি ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে বছর বছর বন্দর ব্যবহারে নানা ধরনের ফি বৃদ্ধি করেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে একই ঘটনা ঘটবে না তার কী নিশ্চয়তা? সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পণ্যের আমদানি-রপ্তানি খরচ বৃদ্ধি পাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে।

এনসিটিতে বর্তমানে প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান রয়েছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়া হলে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো বিদ্যমান কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দর শ্রমিকদের চাকরি খাওয়ার ব্যাপারে কুখ্যাত। যেমন: ডিপি ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৯ সালে সিডনি ও মেলবোর্ন বন্দরে ১০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই করে। ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড ব্যবসার ক্ষতি এবং অস্ট্রেলিয়ার মেরিটাইম ইউনিয়নের ছাড় না দেওয়ার মনোভাবকে দায়ী করে।১৯

যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালের মার্চে, ডিপি ওয়ার্ল্ডের মালিকানাধীন পিঅ্যান্ডও ফেরি প্রায় ৮০০ জন স্থায়ী কর্মীকে কোনো নোটিশ ছাড়াই ছাঁটাই করে এবং তাদের জায়গায় সস্তায় আউটসোর্স কর্মী নিয়োগ করে।২০ এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই ডিপি ওয়ার্ল্ড ৮৮৪ মিলিয়ন ডলারের রেকর্ড প্রফিট ঘোষণা করে, যা ছিল আগের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি।২১ এই ঘটনা সে সময় ইংল্যান্ডে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল৷ ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়া হলে বিদ্যমান শ্রমিকের কতজনের চাকরি থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

কাজেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার তুলে দিলেই যে লাভজনক হবে ও দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিঙ্গাপুরের বন্দর পরিচালনার সুনাম সুবিদিত। সেখানকার বন্দরগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পিএসএ করপোরেশন ও জুরং পোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে। আসলে সবকিছু নির্ভর করে মূলত রাষ্ট্রের গভর্নেন্স বা তদারকির ওপর। যথাযথ তদারকি না থাকলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। আবার ঠিকঠাক তদারকি করা হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকেও ভালো ফল আদায় করা যায়। বিশ্বের অন্য যেসব উন্নত দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, সেসব দেশের তদারকি ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। 

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার তুলে দিলেই যে লাভজনক হবে ও দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিঙ্গাপুরের বন্দর পরিচালনার সুনাম সুবিদিত। সেখানকার বন্দরগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পিএসএ করপোরেশন ও জুরং পোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে। আসলে সবকিছু নির্ভর করে মূলত রাষ্ট্রের গভর্নেন্স বা তদারকির ওপর।

কাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব, ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করলে ইতোমধ্যেই লাভজনকভাবে চলতে থাকা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের উচিত হবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি ও নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া।

কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, লেখক ও গবেষক। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com

তথ্যসূত্র

১। নিউমুরিংয়ে সবই আছে, তবু কেন বিদেশিদের হাতে যাচ্ছে, প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

২। ভেড়ে না বড় জাহাজ, চট্টগ্রাম বন্দর কলম্বো-সিঙ্গাপুর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, বণিক বার্তা, ২১ মে ২০২৫

৩। ভেড়ে না বড় জাহাজ, চট্টগ্রাম বন্দর কলম্বো-সিঙ্গাপুর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, বণিক বার্তা, ২১ মে ২০২৫

৪। Dubai firm abandons US ports plan, Aljazeera, 10 March 2006

৫। US security concerns force Cosco-owned Orient Overseas to sell Long Beach port in California, south china morning post, 30 Apr 2019

৬। এবার পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ট্রাম্পের কৌশলগত বিজয়, প্রথম আলো, ৬ মার্চ ২০২৫

৭। Djibouti seizes control of Dubai-run Doraleh port, Aljazeera, Feb 24 2018

৮। Doraleh Container Terminal, Djibouti, Public Private Partnership Resource Center, World Bank, No date

৯ । DJIBOUTI Government ends DP World’s contract of DORALEH Container Terminal, Africa Logistics Network, February 26, 2018

১০। Djibouti seizes control of Dubai-run Doraleh port, Aljazeera, Feb 24 2018

১১। DJIBOUTI Government ends DP World’s contract of DORALEH Container Terminal, Africa Logistics Network, February 26, 2018

১২। Djibouti Ordered To Pay $533M In Compensation In Container Terminal Dispute With Dubai, Forbes, Apr 04, 2019

১৩। আয় বাড়বে বছরে ৩০০ কোটি টাকা, সমকাল, ১৪ জুন ২০২৪

১৪। প্রত্যাশার মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং, সমকাল, ১১ মে ২০২৫

১৫। নিউমুরিংয়ে সবই আছে, তবু কেন বিদেশিদের হাতে যাচ্ছে, প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

১৬। Review of Maritime Transport 2019, UNCTAD, Jan 31 2020, page 52

১৭। DP World Australia increases terminal access charges, The DCN, March 15, 2021

১৮। DP World’s 52pc fee rise at Port of Melbourne labelled ‘exorbitant’, Financial Review, Nov 2, 2023

১৯। DP World cuts 10pc of workforce, blames ‘dogged’ MUA, Financial Review, July 18, 2019

২০। P&O Ferries sacks all 800 crew members across entire fleet, The Guardian, March 17 2022

২১। P&O Ferries owner reports record-breaking profits after mass sacking, The Guardian, Aug 18, 2022

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •