সরকারের জুলাই নারী দিবস উদযাপন নিয়ে চারটি প্রতিক্রিয়া

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কিন্তু এ উপলক্ষে সরকার যেভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে ব্যয়বহুল, অসংলগ্ন আয়োজন করছে তা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সক্রিয় অংশীদারদের মধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এখানে ফেসবুক থেকে চারজনের প্রতিক্রিয়া যুক্ত করা হলো। এগুলো থেকে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বছরে নারীর অবস্থা ও লড়াইএর চিত্র পাওয়া যাবে।
জনস্বার্থে সতর্কীকরণ: প্রতিরোধের সরকারীকরণ চলছে…
সায়দিয়া গুলরুখ
১৪ই জুলাই অন্তবর্তীকালীন সরকার জুলাই নারী দিবস উদযাপন করেছে। নারীর প্রতিরোধ উদযাপনের এই আয়োজন আরও আগের থেকেই অনেক বন্ধুরা বর্জন করেছে। তবুও গেলাম।
নিউ এইজ থেকে শহীদ মিনার যাওয়ার পথে পদে পদে ’২৪-এর জুলাইয়ের ডেজাভু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের প্রবেশাধিকার নেই। আশেপাশের সকল রাস্তায় দম আটকানো জ্যাম। অফিস ফেরত ঢাকাবাসী গালি দিচ্ছে। অথবা বেজার মুখে হাঁটা দিয়েছে। তাদের অনুসরণ করে আমরাও হাঁটছি। গণতন্ত্র তোরণে পুলিশ এবং শিক্ষাথীরা আইডি কার্ড চেক করছে। আবারও ডেজাভু। দোয়েল চত্বর, শাহবাগ একই ঘটনা। বাকবিতন্ডা করে, পরিশীলিত/সফট ব্যাটাগিরি উপেক্ষা করে ব্যারিকেড ডিঙানো মাত্রই পেলাম শূন্য ক্যাম্পাস। এতিমের মতন মোড়ে মোড়ে পড়ে থাকা বড় স্ক্রীনে জুলাই কন্যাদের সাহসের বন্দনা চলছে। মঞ্চে নারী কণ্ঠে জুলাইয়ের স্লোগান পারফর্ম করা হচ্ছিল, জাঁকজমকপূর্ণ-সরকারি উদযাপনে শ্লোগান তার পারপাস হারিয়ে কর্কশ চিৎকারের মতন শোনাচ্ছে, সেখানে প্রতিরোধের ব্যঞ্জনা অনুভব করি নাই।
গণতন্ত্র তোরণে পুলিশ এবং শিক্ষাথীরা আইডি কার্ড চেক করছে। আবারও ডেজাভু। দোয়েল চত্বর, শাহবাগ একই ঘটনা। বাকবিতন্ডা করে, পরিশীলিত/সফট ব্যাটাগিরি উপেক্ষা করে ব্যারিকেড ডিঙানো মাত্রই পেলাম শূন্য ক্যাম্পাস।
সব ডিঙিয়ে শহীদ মিনারে পৌছে হতবিহবল হয়ে গেলাম। আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে শহীদ মিনারে কখনও ভিআইপিদের জন্য এমন আয়োজন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লাল গালিচা, দুই সারি সোনালী মখমলে মোড়ানো সোফায় একাধিক উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তারা গা এলিয়ে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন। ভীষণ লজ্জা পেলাম।
আমার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে শহীদ মিনারে কখনও ভিআইপিদের জন্য এমন আয়োজন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লাল গালিচা, দুই সারি সোনালী মখমলে মোড়ানো সোফায় একাধিক উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তারা গা এলিয়ে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন।
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গঠিত একটা সরকার ক্ষমতার ব্যাকরণ ভেঙ্গে আয়োজন করতে পারলেন না! সেই লাল গালিচা, সেই তুলতুলে সোফা!
পেছনের সারিতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারের ডিসকমফোর্ট সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এড়িয়ে গেলেন। একই সাথে ভুলে গেলেন জুলাইয়ের স্পর্ধা। জুলাইয়ে আমরা হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ক্ষমতাকে না বলতে শিখেছি। আজকের ক্ষমতার ইকু্য়েশনের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছে তাদেরকে উপেক্ষা করে, গত জুলাইয়ের শ্লোগান দিয়ে এই জুলাইয়ের দাবী-আওয়াজকে দাবিয়ে রাখাকে প্রতিরোধের সরকারীকরণ বলব নাতো কি বলবো?
১৪ই জুলাই নারী দিবস উদযাপনের ভরকেন্দ্র ছিলো রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীদের সাহস। শুনলাম সারারাত ছাত্রীদের হলের বাইরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আর তাই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্যাম্পাসকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সামনের সারিতে বসে আপনারা রোকেয়া হলের ছাত্রীদের আজকের শ্লোগানগুলো শুনেছেন কি ইন্টেরিম?
আজকের ক্ষমতার ইকু্য়েশনের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছে তাদেরকে উপেক্ষা করে, গত জুলাইয়ের শ্লোগান দিয়ে এই জুলাইয়ের দাবী-আওয়াজকে দাবিয়ে রাখাকে প্রতিরোধের সরকারীকরণ বলব নাতো কি বলবো?
“সারাবছর গেইট খোলা রাখতে কয়টা গণঅভ্যুত্থান লাগবে?”
অথবা,
“একদিনের মুক্তি, বাকি দিন বন্দী কেন?”
নারীর জন্য নিরাপদ রাত, সান্ধ্য-আইন বাতিল করার এই দাবীকে কি আপনাদের ড্রোন-শোতে স্থান দিতে পারতেন? ছাত্রীদের আজকের দিনের সাহসী উচ্চারণকে উপেক্ষা করে লাল-গালিচায় কার সাহসের উদযাপন করলেন?
চম্পা খাতুনের কথা মনে আছে? ন্যায্য মজুরী চাইতে রাস্তায় নেমেছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মরে গেলো? কোনও তদন্ত কি হয়েছিলো? পুলিশ রিফর্মের এত কথা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সংস্কার কি হবে?
নারীর জন্য নিরাপদ রাত, সান্ধ্য-আইন বাতিল করার এই দাবীকে কি আপনাদের ড্রোন-শোতে স্থান দিতে পারতেন? ছাত্রীদের আজকের দিনের সাহসী উচ্চারণকে উপেক্ষা করে লাল-গালিচায় কার সাহসের উদযাপন করলেন?
ঘৃণ্য অপরাধী র্যাবের সদস্য আলেপ উদ্দীনের কথা মনে আছে? গুমের শিকার ব্যক্তির স্ত্রীকে ধর্ষণ করে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিলো? আপনারা বলতে চান র্যাবে যৌন সন্ত্রাসের আর কোনও ঘটনা ঘটেনি? র্যাবের যৌন সন্ত্রাসের আমলনামা প্রকাশের কোনও উদ্যোগ কি নিয়েছেন? র্যাব অবলুপ্ত করার দাবি কি আপনারা শুনেছেন?
বসুন্ধরা ব্রাদার্স বহাল তবিয়তে যৌনশোষণ করে যাচ্ছে, নতুন নতুন অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, কিন্তু আনভীর, সানভীর, তাসভীর আছেন বহাল তবিয়তে। রিকশার্যালিতে পতাকা ওড়াতে ওড়াতে বিত্তশালীদের অপরাধগুলো ভুলে গেলেন?
নিরাপরাধ বম নারীদের মুক্তির দাবি ইন্টেরিমের সকলের কানে তোলা হয়েছে, কিন্তু যখন ঢাকা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী, অপেক্ষাকৃত দৃশ্যমান নারীর যৌনহয়রানিকারীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, তখন সামরিক ইশারা উপেক্ষা করে বম নারীদের মুক্তির দাবী বা চিংমা খেয়াংয়ের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার আপনারা নিশ্চিত করবেন?
দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় কোনও নারীর প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নে একটা বাঙালী-মুসলমান-পুরুষদের মধ্যকার কনসেনসাসকে জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রহসন করে জুলাই নারী দিবস?
প্রিয় ইন্টেরিম,
জুলাইয়ের ৩৬ দিন ২০২৪ সালে স্থবির নয়।
জুলাই মানে দিন-মাস-বছরের চিরায়ত হিসেবের প্রত্যাখান।
জুলাই মানে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা।
জুলাই মানে সতত সংগ্রাম।
কথায় কথায় ড্রোন-শো, নানাবিধ দিবস ঘোষণা, জেলায় জেলায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ সরকারি নানা কায়দায় জুলাইয়ের সিলেক্টিভ উদযাপন বন্ধ করেন। স্বৈরাচারী ক্ষমতা চর্চার অপচয়কারী-আতিশায্যের ঐতিহ্য থেকে সরে দাড়ান। জুলাইয়ের শোকের জন্য নীরবতার জায়গা করুন, ২০২৫-এর স্লোগান শুনতে পাবেন।
আল্লাহর দোহাই লাগে, ‘২৪-এর জুলাইকে শেখ হাসিনার অগাস্ট হতে দিয়েন না।
সায়দিয়া গুলরুখ: নৃবিজ্ঞানী, লেখক ও সাংবাদিক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী
২.
জুলাইয়ের নারীদের নিয়ে কথা বলতে আসলে আমার আর ইচ্ছে করে না
প্রাপ্তি তাপসী
জুলাইয়ের নারীদের নিয়ে কথা বলতে আসলে আমার আর ইচ্ছে করে না। বারবার কথা বলে বলে, ছবি আর ভিডিও দেখায়ে প্রমাণ করা যে নারীরা এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলো- নারীদের তুমুল অংশগ্রহণের কারণেই খুনী হাসিনা এই আন্দোলনটাকে “ডানপন্থী, উগ্রবাদী, জঙ্গী, ইসলামিস্ট” ট্যাগ দিতে পারে নাই; এসব করতে আর ভালো লাগে না। যারা ছিলেন, তারা জানেন; জুলাইয়ের মেয়েদের, মায়েদের, বোনেদের অবদানের ফলেই এই আন্দোলনটাকে দমানো যায় নাই।
বেশিদিন না, মনে হয় ৩৬ জুলাই পার হতে না হতেই এই মেয়েদেরকে সবজায়গা থেকে সরায়ে নিজেরা নিজেরা মিলে সব দখল করা শুরু করলেন। সেগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য শুরু হওয়ায় সবাই মিলে হাস্যকরভাবে আবার খুঁজতে থাকলেন “জুলাইয়ের নারীরা কোথায়?” তারপর ধরে ধরে কিছু মেয়েদের নিয়ে কয়েকটা জায়গায় বসাইলেন- যেন তাদের দয়া করলেন; যেন তারা শোপিস, যেন তারা নারীদের টোকেন; এছাড়া যেন তাদের জীবনে কোনো সংগ্রাম আর অর্জন কিছুই নাই।
জুলাইয়ের নারীরা বললে তো আমার মাথায় আসে ১৬ জুলাই আমাদের মিছিলের সামনে থাকা ছোটো ছোটো হাতে প্ল্যাকার্ড ধরা চুল বেণী করা স্কুলের মেয়েদের কথা; পড়াশোনার খরচ মেটাতে ক্যাম্পাসে ফুল বিক্রি করা সাভারে থাকা আপাদমস্তক পর্দা করা লামিয়া আপুর কথা, যিনি পুলিশের গুলি ছোঁড়ার দুইদিন পরও পালিয়ে পালিয়ে ক্যাম্পাসে এসে আমাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
জুলাইয়ের নারী বলতে তো আমি বুঝি, ঢাবিতে গায়েবানা জানাজার দিন পুলিশের ছোঁড়া সাউন্ড গ্রেনেডে পুরো পেট পুড়ে যাওয়া দিল আফরোজের কথা; সাউন্ড গ্রেনেডে যার জামা ঝলসে ছিঁড়ে গেলেও চিৎকার করে বলছিলেন “আমি এখান থেকে যাবো না”; এখনও তার ঘা দগদগে।
জুলাইয়ের নারী বলতে বুঝি সাইন্সল্যাব-বাটা সিগন্যাল মোড়ে বাসা, ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে আন্দোলনে আসা মায়ের কথা; যিনি গুলি আর টিয়ার গ্যাসের মাঝখানে জোর করে ধরে নিয়ে আমাদের পানি, জুস আর খাবার খাওয়ায় দিসিলেন।
জুলাইয়ের নারীরা বলতে বুঝি সেই রিকশাওয়ালা বোনের কথা, ৩ অগাস্ট রাতে যখন চারিদিকে ধরপাকড় আর গলিতে গলিতে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা রেইড দিচ্ছে, তখন অসীম সাহস নিয়ে অলিগলি করে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছিলেন যিনি। ইনাদের কয়েকজনের ছবি আমার কাছে আছে, হয়তো কোনোদিন যদি সাহস করতে পারি জুলাইয়ে ফিরে যাওয়ার, তবে আপনাদের দেখাবো।
আরও, জুলাইয়ের নারী বললেই আমার চোখের সামনে আসে চট্টগ্রামের সুমাইয়াদের কথা, বীর চট্টলার নারীরা কী ভয়াবহ প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন; স্পষ্ট মনে আছে এক ভিডিওতে পুলিশের কাছ থেকে ছিনায় আনসিলেন কয়েকজন ছাত্রকে- তাদের জুলাইয়ের পর বিনা দোষে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হইতে হইসে। যে প্রক্টর মেয়েদের হানি ট্র্যাপার আর যে শিক্ষক মেয়েদের মাগী বলে গালি দিছিলেন, তারা আছেন বহাল তবিয়তে।
আরও, জুলাইয়ের নারী বললেই আমার চোখের সামনে আসে চট্টগ্রামের সুমাইয়াদের কথা, বীর চট্টলার নারীরা কী ভয়াবহ প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন; স্পষ্ট মনে আছে এক ভিডিওতে পুলিশের কাছ থেকে ছিনায় আনসিলেন কয়েকজন ছাত্রকে- তাদের জুলাইয়ের পর বিনা দোষে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হইতে হইসে। যে প্রক্টর মেয়েদের হানি ট্র্যাপার আর যে শিক্ষক মেয়েদের মাগী বলে গালি দিছিলেন, তারা আছেন বহাল তবিয়তে।
জুলাইয়ের নারী বললে আরও বুঝি প্রাথমিকের শিক্ষিকাদের কথা, জুলাইয়ের পরও পুলিশ যাদের কপালে দিসে জলকামান আর লাঠির বাড়ি। জুলাইয়ের নারীদের কথা ভাবতে গেলে আরও মনে পড়ে সীমা, আদ্রিতাদের কথা- জুলাইয়ের পর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন করতে গেলে যাদের পুলিশই আক্রমণ করে, আবার তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়।
জুলাইয়ের নারী হলো সবার প্রিয়, এত্তো সরল যে আমার রীতিমতো মায়া হয় এমন- আমাদের রূপাইয়া- জুলাইয়ে অভ্যুত্থান সফল করেও যাকে জানুয়ারী মাসে পুলিশের উপস্থিতিতে স্টুডেন্টস ফর সভেরেন্টির লাঠির বাড়িতে ১২টা সেলাই দিতে হয় মাথায়।
জুলাইয়ের নারী বলতে তো বুঝি সেই বম নারীদের, যারা কোনো অপরাধ না করেও এক বছরের শিশুসন্তান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দী হয়ে আছেন। জুলাইয়ের নারী বলতে বুঝি, তথ্য আপাদের- ৮৪ দিন ধরে রাস্তায় বসে থাকার পরও যাদের দেখে সরকারের মন গলে নি। কিংবা, বারংবার জুলাইয়ের নারীরা তো তারাই, যারা জুলাইয়ের পরও হেনস্থা হচ্ছেন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, হচ্ছেন নিপীড়ন আর বৈষম্যেরও শিকার।
জুলাইয়ের নারী বলতে তো বুঝি সেই বম নারীদের, যারা কোনো অপরাধ না করেও এক বছরের শিশুসন্তান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জেলে বন্দী হয়ে আছেন। জুলাইয়ের নারী বলতে বুঝি, তথ্য আপাদের- ৮৪ দিন ধরে রাস্তায় বসে থাকার পরও যাদের দেখে সরকারের মন গলে নি। কিংবা, বারংবার জুলাইয়ের নারীরা তো তারাই, যারা জুলাইয়ের পরও হেনস্থা হচ্ছেন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, হচ্ছেন নিপীড়ন আর বৈষম্যেরও শিকার।
জুলাইয়ের নারীরা কেউ হয়তো পড়ার টেবিলে, কেউ মোবাইলে, কেউ চুলার কাছে, কেউ রিকশায়, কেউ সেলাই মেশিনে, কেউ ঝাড়ু দেওয়ায়, কেউ লেখায়, কেউ গানে, কেউ বেতনের আশায় শ্রম ভবনে, কেউ বাচ্চা সামলানোতে বা অফিসের ডেস্কে। জুলাইয়ের নারীরা তারাই, যাদের জীবনে আজীবন জুলাই; যে জুলাইয়ের জন্য তাদের মাইক্রোফোনে আর কীবোর্ডে হুংকার দিতে হয় না; আপনারা মানেন আর না মানেন।
প্রাপ্তি তাপসী: বিতার্কিক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সংগঠক
৩.
জুলাই উইমেনস ডে তে যাচ্ছিনা
মারজিয়া প্রভা
নারী প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় দ্বিচারিতা অবস্থানের সাথে এইটা একখান প্রতিবাদ হিসেবে ঘোষণা দিলাম। গোপনও রাখতে পারতাম। এমনিই না যাইতে পারতাম। ঘুমের অজুহাতে। কিন্তু গতকাল হলের মেয়েদের গত বছরের ১৪ জুলাইয়ের রিক্রিয়েট এর ভিডিও দেখে হঠাৎ মায়া লাগলো। একের পর এক নারীর উপর হামলার কথা একের পর এক মনে পড়লো। এই পুতুল পুতুল খেলা আর কতদিন? নারীদের সংগ্রামকে এরকম বনসাইকরণ আর কতদিন?
জুলাই উইমেনস ডে তে আমার মনে পড়লো যৌন হয়রানিকারীকে শাহবাগ থানায় যখন ফুল দিয়ে সংবর্ধনা করা হলো তখন রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কথা। উলটা নারীটির উপর এমন চাপ প্রয়োগ করা হলো সে মামলাটা তুলে নিতে বাধ্য হওয়ার কথা।
কিংবা মনে পড়লো মোহাম্মদপুরে মেয়েদের সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে মব হওয়াটাকে সম্পুর্ণ এড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জনপরিসরে সিগারেট খাওয়া’ কে অপরাধীকরণ করার কথা।
কিংবা মনে পড়লো নাদিরা ইয়াসমিন যখন নারীদের সম্পত্তির সমানাধিকারের বইটি প্রকাশ করেছে, তার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের মব সামলানোর বদলে সরকার তাকেই সাতক্ষীরায় বদলি করে দেওয়ার কথা।
কিংবা মনে পড়লো নাদিরা ইয়াসমিন যখন নারীদের সম্পত্তির সমানাধিকারের বইটি প্রকাশ করেছে, তার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের মব সামলানোর বদলে সরকার তাকেই সাতক্ষীরায় বদলি করে দেওয়ার কথা।
প্রেসক্লাবে আজও ৪৮ তম দিন ধরে প্রেসক্লাবে তথ্য আপারা বসে আছে চাকরির রাজস্বকরণ ও তাদের কাছ থেকে কাটা বেতন ২০ কোটি টাকা ফেরতের দাবিতে। মনে পড়লো তাদের এই ন্যায্য আন্দোলনকে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার “সন্তান কোলে সরকারকে ব্ল্যাকমেইল” হিসেবে ট্যাগ দেওয়ার কথা! গতকালকেও সচিবালয় যাবার পথে তাদেরকে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হতে হয়েছে।
ধর্ষণের ভুক্তভোগী লামিয়ার আত্মহত্যা, গত ১১ মাসে ৭৮০টা ধর্ষণের ঘটনা, হেফাজতের সমাবেশে নারীকে প্রকাশ্যে বেশ্যাকরণের পুনরাবৃত্তি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে।
আমার মনে পড়ছে মৈত্রীযাত্রায় সম্পৃক্ত হওয়া নারীদের প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি করার কথা।
মনে পড়ছে চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের নারী রাজনৈতিক কর্মীকে পুরুষ শিবিরকর্মী লাথি মারলে মব যেয়ে সেই পুরুষ কর্মীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে, অথচ উপদেষ্টার প্রেস সচিব দেখিয়েছে মব হচ্ছে ‘আন্দোলন’।
ধর্ষণের ভুক্তভোগী লামিয়ার আত্মহত্যা, গত ১১ মাসে ৭৮০টা ধর্ষণের ঘটনা, হেফাজতের সমাবেশে নারীকে প্রকাশ্যে বেশ্যাকরণের পুনরাবৃত্তি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে।
আমার মনে পড়ছে মৈত্রীযাত্রায় সম্পৃক্ত হওয়া নারীদের প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি করার কথা।
নারীর সাথে ধারাবাহিক প্রবঞ্চনার কোন সুরাহা না করে এই জুলাই উইমেনস ডে আসলে কতটা মিথ্যা তা বলে বোঝানো যাবেনা। নারীর ভিজিবিলিটি দেখানোর জন্য আওয়ামী সরকার রোজ বছর নারী দিবস, রোকেয়া দিবস উদযাপন করে গিয়েছে। তাতে এই রাষ্ট্র নারীকে আসলে কি দিয়েছে? নাকি নারীকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদী শাসনামলই কায়েম হয়েছে?
নারীর সংগ্রাম ও রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এই গণঅভ্যুত্থানকারী সরকার নারীকে আসলে কি দিচ্ছে? সে তো তার নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের উপর জনসম্মুখে বেশ্যাকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ করতে পর্যন্ত পারেনি! স্টেটমেন্ট দিতে পারেনি। বরং উল্টো নতজানু হয়ে বলেছে যে কমিশনের রিপোর্ট এখন বাস্তবায়ন হবেনা।
একদিনের জুলাই নারী দিবস দিয়ে বাংলাদেশের নারী কি করবে? যে নারী অধিকারকর্মীরা আজকে সরকারে বসেছে, তারা লংকায় গিয়ে রাবণ হয়নি?
বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মেহনতি সাধারণ নারীর জীবনে আসলে প্রতিটি দিন জুলাই।
যতদিন এই প্রবঞ্চকারী রাষ্ট্র কাঠামো ভাঙ্গবে না, পুরানো ফ্যাসিবাদী কায়দায় সব চলতে থাকবে, যতদিন রাষ্ট্র মচ্ছব করার জন্য নারী আর তার শরীরকে একটা উইপন হিসেবে ব্যবহার করবে, যতদিন রাষ্ট্রের কাছে নারী হবে কেবল একদিনের উপভোগের বিষয় ততদিন রাষ্ট্র নারীর হবে না।
যে রাষ্ট্র নারীর নয়, সেই রাষ্ট্রীয় প্রহসনের উদযাপনকে আমি বয়কট করি।
তাই জুলাই উইমেনস ডে তে আমি যাচ্ছিনা।
মারজিয়া প্রভা: অ্যক্টিভিস্ট এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী
৪.
‘জুলাই উইমেন্স ডে’-তে স্মরণ করি জুলাই শহিদ কন্যা লামিয়াকে
নুজিয়া হাসিন রাশা
সরকার ঘোষিত ‘জুলাই উইমেন্স ডে’-তে স্মরণ করি জুলাই শহিদ কন্যা লামিয়াকে, যে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। স্মরণ করি সেই সকল শিশু ও নারীকে, যারা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। স্মরণ করি চট্টগ্রামের ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর অন্যতম নারী সংগঠক অ্যানী দি, রিপা দি ও দীপা দি-কে—যাদের কোমরে লাথি মেরেছিল চিহ্নিত রাজাকারের মুক্তির প্রতিবাদে আওয়াজ তোলার ‘অপরাধে’ শিবির কর্মী।
স্মরণ করি বিএনপি কর্মী দ্বারা ধর্ষণের শিকার সেই নারীকে। স্মরণ করি সেই নারীকে যাকে দেখতে হয়েছে তার নিপীড়ককে ফুলেল মালা দিয়ে গ্রহণ করে নিতে। স্মরণ করি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জুলাই যোদ্ধা’ সুমাইয়া শিকদার ও তাঁর সহযোদ্ধাদের—যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ‘হানি ট্র্যাপ’ বলে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করেছিল।
স্মরণ করি নাদিরা ইয়াসমিনকে, যার বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্র। স্মরণ করি দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নারী শিক্ষার্থীদের, যারা লেট গেট দিয়ে হলে ঢুকলে স্লাট-শেমিংয়ের মুখোমুখি হয়। স্মরণ করি সেই নারী সমন্বয়কদের, যারা “গ্রহণযোগ্য নেত্রী” হতে পারেননি তাদের পোশাকের কারণে।
স্মরণ করি সেই শিক্ষার্থীদের, যাদের যৌন নিপীড়কদের ক্লাসে বসতে হয়। স্মরণ করি তথ্য আপাদের, যাদের বেকার করে দিয়ে অভ্যুত্থানের সরকার ‘আওয়ামী আবর্জনা’ ট্যাগ দিয়েছে। স্মরণ করি টিএনজেড-এর সেই নারী শ্রমিককে, যিনি বকেয়া বেতনের দাবিতে দিনের পর দিন রাস্তায় আন্দোলন করতে গিয়ে মিসক্যারেজের শিকার হয়েছিলেন।
স্মরণ করি সকল নারীকে, যারা কেবল টোকেনাইজড হয়েছে কিন্তু কখনো কর্তৃত্বে পৌঁছাতে পারেনি। স্মরণ করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিজেহার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের সেই নারী স্টাফকে—যিনি পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, অথচ হলের প্রভোস্ট, কলা অনুষদের ডিন, প্রোভিসি (শিক্ষা), প্রক্টর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি—সকলেই ছিলেন নির্বিকার। তিনি কোনো বিচার পাননি।
স্মরণ করি ঢাকার বাইরের শহর থেকে আসা সেই নারী শিক্ষার্থীদের, যারা হলে সিট না পেয়ে এ শহরে দিন কাটায় তীব্র অনিরাপত্তা ও আর্থিক সংকটে। স্মরণ করি শাহবাগ মেট্রোর নিচে ধর্ষণের শিকার হওয়া ফুলবিক্রেতা ছোট্ট শিশুটিকে, আর উদ্যানের ছবির হাটে পড়ে থাকা বৃদ্ধার ধর্ষিতা দেহটিকে।
স্মরণ করি ঢাকার বাইরের শহর থেকে আসা সেই নারী শিক্ষার্থীদের, যারা হলে সিট না পেয়ে এ শহরে দিন কাটায় তীব্র অনিরাপত্তা ও আর্থিক সংকটে। স্মরণ করি শাহবাগ মেট্রোর নিচে ধর্ষণের শিকার হওয়া ফুলবিক্রেতা ছোট্ট শিশুটিকে, আর উদ্যানের ছবির হাটে পড়ে থাকা বৃদ্ধার ধর্ষিতা দেহটিকে।
স্মরণ করি আদিবাসী নারীদের যাদের লড়তে হচ্ছে পাহাড়ে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সেনাশাসনের সাথে। স্মরণ করি—যারা আজও ভাগ্য বদলাতে পারেনি, সেই সব নারীদের।
যারা বারবার নিজেদের লড়াই ফিরে ফিরে পায়, আমি তাদের মিছিলে হাঁটি। সরকারি সকল নাটকের মুখে থুথু দিয়ে আমরা বারবার তাদের কথাই বলতে চাই।
নুজিয়া হাসিন রাশা: প্রেসিডেন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন সংগঠক