মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতরের বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতরের বাহিনী

আহমাদ ইশতিয়াক

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো এক বা একাধিক আঞ্চলিক বাহিনী। গবেষকদের মতে এদের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। ভারতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের  নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত ও বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি দেশের ভেতরে আঞ্চলিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রদর্শন করেছিলেন অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা যথাযথ স্বীকৃতি পান নি। এদের মধ্যে ১০টি আঞ্চলিক বাহিনীর ওপর বছরজুড়ে অনুসন্ধান করা হয় এবং তা ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ডেইলি স্টার পত্রিকায় ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখানে একসঙ্গে এগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশিত হলো। অন্যান্য আঞ্চলিক বাহিনী নিয়েও আমরা লেখা প্রকাশ করতে চাই।    

আত্রাই পাড়ের ওহিদুর বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিলো এক দুর্ধর্ষ  প্রতিরোধ বাহিনী। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক নেতা ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীটি পরবর্তীতে ‘ওহিদুর বাহিনী’ নামে পরিচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হলেও একপর্যায়ে ওহিদুর বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজারেরও অধিক। মুক্তিযুদ্ধে ওহিদুর বাহিনীর বীরত্বগাঁথা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে পৃথক দুটি গ্রন্থ।  ওহিদুর রহমানের লেখা ‘মুক্তি সংগ্রামে আত্রাই’ গ্রন্থে এই বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। অন্য গ্রন্থটি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মিজানুর রহমান মিজান।

ওহিদুর বাহিনীর বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরজমিনে নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরের একাধিক উপজেলায় যান এই প্রতিবেদক। এসময় ওহিদুর রহমান সহ বাহিনীর পঞ্চাশ জনেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়। জানা যায়  বর্তমানে নওগাঁ জেলার সদর থেকে রাণীনগর, আত্রাই হয়ে পূর্বে নাটোরের সদর, নলডাঙ্গা, সিঙড়া ও বগুড়ার নন্দীগ্রাম পর্যন্ত এবং পশ্চিমে রাজশাহীর বাগমারা, পুঠিয়া উপজেলা পর্যন্ত ৪টি জেলার ১৪টি থানা জুড়ে ছিল ওহিদুর বাহিনীর বিস্তৃতি।

যেহেতু ওহিদুর রহমান পূর্বে কৃষক আন্দোলন ও কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই তাঁর অনেক কর্মী-সমর্থক ছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ নওগাঁয় এসে পৌঁছালে ২৬ মার্চ নওগাঁর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গঠিত হয় আত্রাই থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ।

প্রথমেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ।  ১০ এপ্রিল আত্রাইয়ের তেঁতুলিয়া গ্রামের গান্ধী আশ্রমে অনুষ্ঠিত কর্মীসভায় অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে আত্রাই থানা দখলের সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে ওহিদুর বাহিনীতে কৃষক ও নেতাকর্মীরা যোগ দিলেও একপর্যায়ে  ছুটিতে থাকা ও পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপিআর সদস্য সহ  ছাত্র-যুবক-শ্রমিক সহ সর্বস্তরের মানুষ ওহিদুর বাহিনীতে যোগ দেন। ফলে বাহিনীর বিস্তৃতিও ছড়িয়ে পড়ে বিশাল অঞ্চল জুড়ে।

ওহিদুর বাহিনীর বিস্তৃত এই যুদ্ধাঞ্চল জুড়ে প্রবাহিত হয়েছে আত্রাই, ছোট যমুনা, ফক্কিনী, খাজুরা ও নাগর সহ ৬টি নদী ও চলন বিল সহ ১৩টি বিল।  নদীমাতৃক হওয়ায় ওহিদুর বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হতো জলপথে। বাহিনীতে ৫২টি বড় পানসি নৌকা ছিল, লোকে বলতো ‘ওহিদুরের বায়ান্ন ডিঙ্গি’। এছাড়া বাহিনীর অস্ত্রাগার, চিকিৎসা, রসদ সরবরাহ এবং গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য ছিল পৃথক নৌকার ব্যবস্থা। 

স্থায়ী কোন হেডকোয়ার্টার ছিলোনা, কয়েকটি অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার ছিল। বিল হালতির মধ্যে থাকা খোলাবাড়িয়া গ্রাম ছিল তেমনই  একটি ঘাঁটি। এছাড়া ঝিকরা, মিরাট, হাঁসাইগাড়িতেও অস্থায়ী ঘাঁটি ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশী সফল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। একের পর এক সফল অপারেশনে ওহিদুর বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ফুরিয়ে এসেছিলো। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য একের পর এক থানা আক্রমণ চালানো শুরু করেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে  রাজশাহীর বাগমারা থানা দখল ছিল ওহিদুর বাহিনীর তেমনই একটি অপারেশন।  বাগমারা থানার মতো আত্রাই থানাতেও দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ চালিয়েছিলেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ৯ ডিসেম্বর নওগাঁর রানীনগর থানায় আক্রমণ করে  ৪০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ৫০টিও বেশী রাইফেল নিজেদের দখলে নেন ওহিদুর বাহিনী। এছাড়া নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরের বিভিন্ন  রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও  গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলো ছিল বেগুনবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, বাঁইগাছা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, সোনাডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, মৈনম রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, তাহেরপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, সড়ককুতিয়া রাজাকার ক্যাম্প প্রভৃতি।

ওহিদুর বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল ৬ সেপ্টেম্বর আত্রাইয়ের সাহাগোলা ব্রিজ ধ্বংস। এই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এছাড়া ছিল তারানগর-বাউল্লার যুদ্ধ, বামনীগ্রামে অ্যামবুশ,  বার্নিতলার যুদ্ধ, তাহেরপুর- ভবানীগঞ্জ ও ব্রহ্মপুর হাটে অপারেশন,  নলদিঘির যুদ্ধ, নলডাঙ্গা ব্রিজ অপারেশন, ভবানীগঞ্জের খন্ড যুদ্ধ প্রভৃতি। ১৯ সেপ্টেম্বর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া গ্রামে গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণ শেষে ফেরার পথে তারানগর বাউল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি নৌকার বহরে অতর্কিত আক্রমণ চালায় ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময়  গুলিবিদ্ধ ও নদীতে ডুবে ১৫০ জনেরও বেশী পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১৪ ডিসেম্বর ভোরে ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে বাহিনীর ৭০০-৮০০ মুক্তিযোদ্ধা আত্রাই থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ওহিদুর রহমান।                    

ভৈরব তীরের রফিক বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট শহরের ভৈরব-দড়টানা নদীর অপর পাড়ে চিরুলিয়ার বিষ্ণুপুরে গড়ে উঠেছিলো আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অনুসারীদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনীটি পরবর্তীতে পরিচিতি পেয়েছিল ‘রফিক বাহিনী’ নামে।  

শাহাদত হোসেন বাচ্চুর  ‘চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখায় পাওয়া যায়  এই বাহিনীর সৃষ্টি ও বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের বীরত্ব। এছাড়া  স্বরোচিষ সরকার রচিত ‘একাত্তরের বাগেরহাট মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থে রয়েছে এই বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধের বর্ণনা। রফিক বাহিনীর উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনটি তৈরির কাজে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরেজমিনে বাগেরহাটের সদর, চিতলমারী, ফকিরহাট উপজেলা ও খুলনার রূপসা উপজেলা সফর করেন এই প্রতিবেদক। এসময়ে রফিক বাহিনীর অন্তত ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। 

একাত্তরের ৯ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘বাগেরহাট  মহকুমা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। এ কমিটির তত্ত্বাবধানে মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সমান্তরালে এপ্রিলের শেষের দিকে  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভাসানী গ্রুপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের অনুসারীদের উদ্যোগেও  একটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এই ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন বাগেরহাটের ভাসানী ন্যাপের শেখ আজমল আলী গোরাই, পরিচালনায় ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন। 

২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর বাগেরহাট শহর ছেড়ে দলটির সব সদস্যই বিষ্ণুপুরে অবস্থান নেন।  প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হলেও একপর্যায়ে রফিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০০’র  বেশী। প্রাথমিকভাবে অস্ত্র জোগাড়ের পর বিভিন্ন থানা আক্রমণ, রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণের মাধ্যমে অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধেও বেশ কিছু অস্ত্র আসে।    

রফিক বাহিনীর সদর দপ্তর বিষ্ণুপুরের খালিশপুর গ্রামে। এছাড়া সন্তোষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চিতলমারী ইউনিয়নের সুড়িগাতী গ্রামে রফিক বাহিনীর আরও দুটি ঘাঁটি ছিল। রফিক বাহিনীর একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাগেরহাটের ১৫০ কিলোমিটার এলাকা শত্রুমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন রফিক বাহিনীর সদস্যরা। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ২৫টিরও বেশী সফল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছিলো।

২৪ জুলাই রূপসা থেকে বাগেরহাটগামী  রাজাকারদের বহনকারী একটি বিশেষ ট্রেনে আক্রমণ চালিয়েছিলেন রফিক বাহিনী। এই অপারেশনে পঞ্চাশেরও অধিক রাজাকার হতাহত হয়। অপারেশনের শেষে রফিক বাহিনী প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রফিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল মাধবকাঠির যুদ্ধ। ১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা বিষ্ণুপুর গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার দুই সহোদরকে হত্যা করে সমস্ত গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘৬ তারিখে মিলিটারি ও রাজাকারেরা মাধবকাঠি মাদ্রাসায় অবস্থান নিলে পরদিন রাত ১২টায় আমরা দেড়শো মুক্তিযোদ্ধা মাদ্রাসার চারপাশ ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করি।  ৮ তারিখ দুপুর পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটে লঞ্চে করে নদী দিয়ে পালিয়ে যায়।’  এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।

২৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানস ঘোষের কাছ থেকে অস্ত্রের প্রস্তাব পেয়ে ভারত সীমান্তের দিকে রওয়ানা হন রফিকুল ইসলাম। যদিও পথিমধ্যে পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে পড়ে আহত হন তিনি। ঐদিনই দেবী বাজারের কাছে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের ক্যাম্পগুলো ধ্বংসের লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। যা রফিক বাহিনীর কাছে ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। রফিক বাহিনীর সদস্য আবদুল মজিদ শেখ বলেন, ‘আমরা প্রতি বাঙ্কারে দুজন করে ছিলাম। মিলিটারি যখন লঞ্চ নিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের সামনে এগোতে লাগলো তখন আমরা গুলি শুরু করলে লঞ্চের সারেং মারা যায়। তলা ফুটো হয়ে লঞ্চ চারদিকে ঘুরতে লাগলো। গুলিতে মিলিটারির পাশাপাশি বহু রাজাকারও মারা যায়।’  এমতাবস্থায় সড়কপথে পাকিস্তানি সেনারা অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কারফিউ জারি করে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৩ সেপ্টেম্বর দোপাড়া ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আরেকটি দুর্ধর্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন রফিক বাহিনী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে রফিক বাহিনীর বিজয় পাল শহীদ হন।

৩০ অক্টোবর বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে রফিক বাহিনীর যুদ্ধে এক ক্যাপ্টেন সহ চারজন পাকিস্তানি সেনা ও তিনজন রাজাকার নিহত হয়। ৯ নভেম্বর বাবুরহাটের আরেকটি যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫ সেনা ও বহু রাজাকার নিহত হয়।

শ্রীপুর বাহিনী বা আকবর বাহিনী

মাগুরার শ্রীপুরের একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে মাগুরার শ্রীপুরে গড়ে উঠেছিলো একটি আঞ্চলিক বাহিনী।  কাগজে কলমে বাহিনীটি ‘শ্রীপুর বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও লোকমুখে তা আকবর বাহিনী হিসেবেই পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে মাত্র ছয়টি রাইফেল নিয়ে শুরু করা শ্রীপুর  বাহিনীতে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ৮০০’রও বেশী। এই বাহিনীর কার্যক্রম ও বীরত্বগাঁথা নিয়ে আকবর হোসেন ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী’ নামে  একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। সেই গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়,  ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আকবর হোসেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মাত্র ৩ বছর পরেই ১৯৫৪ সালে  চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৫ সালে  শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। 

মার্চের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে  নিজের অনুসারী ও স্থানীয় ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করতে শুরু করেন আকবর হোসেন।  ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা শুরুর পর মাগুরায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, এর অন্যতম সদস্য ছিলেন আকবর হোসেন। মাগুরার নোমানী ময়দানের পার্শ্ববর্তী আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাম্পে আগত ছাত্র- তরুণদের বেশীরভাগই ছিল শ্রীপুর কলেজের শিক্ষার্থী।

 ২৮ মার্চ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।  এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর মাগুরায় আগমনের আগমুহূর্তে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরা আনসার ক্যাম্প থেকে ৬টি রাইফেল,  ওয়্যারলেস ও বেশ কিছু গোলাবারুদ নিয়ে শ্রীপুরে চলে আসেন।  এসময়ে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে শ্রীপুর বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুই ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। পাকিস্তানি বাহিনী ছাড়াও ছিল স্থানীয় ডাকাত ও পাকিস্তানপন্থী বিহারীরা। মুক্তিযুদ্ধের আগে  মাগুরা ও ফরিদপুর অঞ্চলে ডাকাত দলের তৎপরতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার সুযোগে ডাকাতেরা  লুটপাট, হত্যা, এমনকি ধর্ষণের মতো কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

এমতাবস্থায় আকবর হোসেন সহ বাহিনীর নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ডাকাত নিধনের জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রীপুর  বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ জনে। এসময় বাহিনীর অস্ত্র বলতে ছিল ২৪টি রাইফেল ও হাজারখানেক গুলি।

শ্রীপুর বাহিনীর সম্মিলিত প্রথম অপারেশন ছিল ৫ জুন, রাজবাড়ীর রামদিয়ায় একদল মুক্তিযোদ্ধা ডাকাত সর্দার  চাঁদ খাঁর বাড়িতে অভিযান চালান। চাঁদ খাঁর জমা করা সমস্ত লুটের সামগ্রী সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চাঁদ খাঁ ও একের পর এক ডাকাত নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে  আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেও শ্রীপুর বাহিনীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা, ইপিআর, আনসার সদস্য সহ বহু ছাত্র, যুবক, তরুণ  শ্রীপুর বাহিনীতে যোগ দেয়।  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয়  টুপিপাড়া গ্রামে খোলা হয়  প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

 থানার নামে বাহিনীর নামকরণ করা হলেও এই বাহিনীর অবস্থান কেবল শ্রীপুর বা মাগুরার থানাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু, রাজবাড়ির পাংশা, বালিয়াকান্দি,   ফরিদপুরের মধুখালী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান। শ্রীপুর বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল  ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানা দখল।  ৯ আগস্ট দিবাগত রাতে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে  মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল শৈলকুপা থানায় আক্রমণ চালায়। এসময় থানায় থাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও  পুলিশ রাজাকার সহ অন্তত ৩০ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ৫৭টি রাইফেল ও ৪ হাজার গুলি উদ্ধার করেন।  শৈলকূপা থানা দখলের মাধ্যমে শৈলকূপার অনেকটা অংশ মুক্ত হয়ে যায়। একইসঙ্গে থানায় শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শৈলকুপা থানা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল- আলফাপুরের যুদ্ধ,  নাকোলের যুদ্ধ, কাজলীর যুদ্ধ, চারবার শ্রীপুর থানা অপারেশন, বালিয়াকান্দি থানা আক্রমণ,  ইছাখাদা ও বিনোদপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, মাগুরা আনসার ক্যাম্প আক্রমণ প্রভৃতি। 

২১ আগস্ট শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করে ৩৪টি রাইফেল, দেড় হাজার গুলি উদ্ধার করেন এবং একইসঙ্গে পুলিশের সাবেক এসআই আকরাম হোসেন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে থানার ওসি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর দুদিন পরেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘শ্রীপুর থানা মুক্ত’ ঘোষণা দেয়া হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনী সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও সফল যুদ্ধগুলোর একটি ছিল ঝিনাইদহের শৈলকুপার আলফাপুরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১০ অক্টোবর ৫০০’র বেশী পাকিস্তানি সেনা শ্রীপুর বাহিনীর টুপিপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়।  পূর্ব সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা আগেই ক্যাম্পে ছেড়ে চলে যান। পাকিস্তানি সেনারা খামারপাড়া বাজারে ঢুকে লুটপাট চালায়। নদীর অপর পার থেকে শ্রীপুর বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা  পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলি করলে ৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১১ অক্টোবর দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা কাজলি ঘাট দিয়ে নদী পার হতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে ৩ পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। এরপরের দুদিনে  লাঙ্গলবাঁধের উল্টো দিক থেকে আগত পাকিস্তানি সেনাদের অভিযানে আবাইপুর ও গয়েশপুরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।  ১৩ অক্টোবর চতুড়িয়া গ্রামে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ২৪ নভেম্বর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের মাগুরা থেকে শ্রীপুর গামী একটি বহরে  আক্রমণ চালায়। এসময় এক কর্নেল সহ ৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। 

অক্টোবর  মাসে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে  শ্রীপুর বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক বাহিনী ও আকবর হোসেনকে বাহিনী প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি সনদ প্রদান করেন ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর।

টাঙ্গাইলের বাতেন বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক বাহিনীর কথা বললে সর্বপ্রথম উঠে আসবে টাঙ্গাইলের ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র কথা। এই বাহিনীর  বীরত্বের ইতিহাস প্রায় সবারই জানা। ঠিক একই সময়ে টাঙ্গাইলে গড়ে উঠেছিল আরও একটি দুর্ধর্ষ আঞ্চলিক বাহিনী। টাঙ্গাইলের সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে গঠিত সাড়ে ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার বাহিনীটি পরবর্তীতে পরিচিতি পেয়েছিল ‘বাতেন বাহিনী’ নামে। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কনোড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে বাহিনীটি প্রথমে গঠিত হলেও পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা এমনকি গাজীপুরের জেলাতেও এই বাহিনী বিস্তৃতি ছিলো।

বাতেন বাহিনীর উপর বিস্তারিত জানার জন্য এই প্রতিবেদক টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের বেশ কয়েকটি উপজেলা সফর করেন। এসময় বাতেন বাহিনীর প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মুক্তিযুদ্ধে বাতেন বাহিনীর বীরত্বগাঁথা নিয়ে বাহিনীর বেসামরিক প্রধান মীর শামছুল আলম শাহজাদা  ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ – ১৯৭১ বাতেন বাহিনী’ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সেই গ্রন্থ সূত্রে ও  বাহিনীর একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২ এপ্রিল শামছুল আলম শাহজাদার নেতৃত্বে কোনড়া গ্রামে প্রাথমিকভাবে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।  ৩ এপ্রিল নিজ গ্রাম কোনড়ায় এসে কোনড়া ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ছাত্র, তরুণ, যুবকদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে শুরু করেন  খন্দকার আবদুল বাতেন।

৩ এপ্রিল সংঘটিত সাটিয়াচরা যুদ্ধে পালিয়ে আসা দুজন ইপিআর সেনার কাছ থেকে পাওয়া ২টি রাইফেল ও ৪৫ রাউন্ড গুলিই ছিল বাতেন বাহিনীর প্রথম অস্ত্রের সম্বল।  এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আতোয়ার রহমান খন্দকার বাতেনকে আরও বেশ কয়েকটি রাইফেলের সন্ধান দিলে তারুটিয়া গ্রামের একটি ডোবা থেকে ৮টি রাইফেল উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র দিয়ে পাকাপাকিভাবে শুরু হয় বাতেন বাহিনীর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। 

২০ এপ্রিল সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে সংগঠিত একটি দল অস্ত্র সহ বাতেন বাহিনীতে যোগ দিলে বাহিনীর সক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যায়।  এপ্রিলের শেষের দিকে ফজলুল হক মল্লিকের নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আরেকটি দল অস্ত্র, গোলাবারুদ সহ বাতেন বাহিনীতে যোগ দেয়।  এসময়ে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের লাউহাটি বাজারে স্থাপন করা হয়েছিলো বাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টারও। এ পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ বাহিনীতে যোগ দেয়। একইসঙ্গে যোগ দেন পালিয়ে আসা ও ছুটিতে থাকা বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার সদস্যরাও। 

বাতেন বাহিনীতে ৪১টি কম্পানি, ১২৩টি প্লাটুন ও ৩৭০টি সেকশন ছিল। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল  সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশী। ৫০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও হাজারের বেশী  পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধে বাতেন বাহিনীর প্রথম সফল অপারেশন ছিল  মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ। থানায় বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া, পুলিশ অবস্থানের খবর পেয়ে বাতেন ও বারীর নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ থানা আক্রমণে অংশ নেয়।  ৪ মে রাতে থানা দখলের পর প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।

সিঙ্গাইর থানা দখলের একদিন পরে ৫ মে ল্যান্স নায়েক মোখলেসুর রহমানের নেতৃত্বে বাতেন বাহিনীর আরেকটি দল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানা আক্রমণ চালিয়ে থানা দখল করে। অপারেশনের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোলাগুলির একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ নিহত হয়। পরবর্তীতে থানা থেকে  বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। 

১৭ মে দিবাগত রাতে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানায় আক্রমণ চালান বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় থানায় অবস্থানকারী মিলিশিয়া ও পুলিশরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় দুইপক্ষের মধ্যে ৩ ঘণ্টা প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে অনেক লাশ ও প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। দৌলতপুর থানা দখলের পর ১৮ মে থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বাহিনী প্রধান খন্দকার আবদুল বাতেন। 

মে মাসের শেষের দিকে ঘিওর হাটের দিন ছাগল ও তরকারী বিক্রেতার ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বাধায় ঘিওর থানা দখল করেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের মাঝে ছিল ধল্লা ব্রিজের অবস্থান। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজটিকে রক্ষার জন্য ২০ জন রাজাকার মোতায়েন করে। সেখানে অবস্থানকারী রাজাকারেরা প্রতিনিয়তই ব্রিজ দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষের জিনিসপত্র লুট করে নির্যাতন করতো।  বিষয়টি জানার পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিজটিতে  অবস্থানকারী ২০ রাজাকারকে বেঁধে ফেলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেন। 

টানা কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেয়ার একপর্যায়ে গুলির অভাবে বাতেন বাহিনীর ৬২টি চাইনিজ রাইফেল ও ১৫টি এলএমজি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তখন গোপন সূত্রে খবর পেয়ে মানিকগঞ্জের জাব্রা ব্রিজের কাছের একটি গ্রাম থেকে ১৭ পেটি চাইনিজ গুলি উদ্ধার করেন বাতেন বাহিনীর দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা। ফেরার পথে গ্রামবাসী বাহিনী প্রধান খন্দকার বাতেনকে পাকিস্তানিদের গানবোটে আক্রমণের অনুরোধ জানায়। প্রতি সপ্তাহে গানবোটটি নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা নিকটবর্তী একটি নির্দিষ্ট ঘাটে থামিয়ে গ্রামে গ্রামে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং নারীদের ধর্ষণ করতো। খন্দকার বাতেন গানবোটটিতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে নদীর দুইপাড়ে বাঙ্কার খুঁড়ে পজিশনে রাখা হয়। দ্বিতীয়দিন রাত তিনটার দিকে গানবোটে পাক সৈন্যরা আগমন করে।  ঘাট থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে থাকা অবস্থায় একসঙ্গে গর্জে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মারণাস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের অবিশ্রান্ত গুলিতে গানবোটটি একপর্যায়ে নদীর একপাশে পড়ে যায়। এই অপারেশনে গানবোটে থাকা ৪৩ পাকিস্তানি সেনার মধ্যে ৩৮ জন নিহত হয়। বাকি ৫ জনকে আহত অবস্থায় আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অপারেশনের শেষে গানবোট থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদও উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। 

জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বর সাজে খাসকাউলিয়া গ্রামে রাজাকার নিধন ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন।  গোপন সূত্রে খবর আসে, ২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পরে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে খাসকাউলিয়া মাদ্রাসায় জরুরী বৈঠক করবে শীর্ষস্থানীয় রাজাকারেরা। অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণ ৭/৮ জন রাজাকার নিহত হয়। 

২০ জুলাই বাতেন বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গানবোট নদীতে ডুবিয়ে দিলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সাটুরিয়া থানায় দ্বিতীয়বার আক্রমণ ছিল বাতেন বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন। ১৩ আগস্ট  রাতে সাটুরিয়া থানায় আক্রমণ চালিয়ে থানা দখল করে  ১৪ আগস্ট থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয় সাটুরিয়ার খাদ্য গুদামও। 

মুক্তিযুদ্ধের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে  সাটুরিয়া থানায় তৃতীয় বার আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর থানা দখল করেছিলেন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এই যুদ্ধে বাহিনীর ৫০০ মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন সাটুরিয়ার সর্বস্তরের জনতা। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়ারত হোসেন। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ভোর হয়ে গেলে আশপাশের গ্রামের মানুষ দা, লাঠি, খন্তা যে যা পারলো তা নিয়েই থানায় হামলা করতে এগিয়ে আসে। নভেম্বরের শেষে টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানাও দখল করেন বাতেন বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর  বাতেন বাহিনীর আক্রমণে নৌকা ডুবে ৩৩ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এই  অপারেশনটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাতেন বাহিনীর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।  

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুবিধার্থে বাতেন বাহিনীতে চালু ছিল ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল। একইসঙ্গে যুদ্ধের খবরাখবর পরিবেশনের জন্য প্রকাশিত হতো একটি পত্রিকাও।

মানিকগঞ্জের হালিম বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মানিকগঞ্জ সহ ঢাকার উত্তরাংশে বিস্তৃত এক অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠেছিলো স্বতন্ত্র একটি আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীটি পরিচিত ছিল ‘হালিম বাহিনী’ নামে। মানিকগঞ্জ ট্রেজারি থেকে সংগৃহীত  থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে শুরু করা হালিম বাহিনীতে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল অন্তত ২ হাজার। 

হালিম বাহিনীর উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে ২০২৪ সালের  জুন মাসে সরেজমিনে মানিকগঞ্জের সদর, ঘিওর, শিবালয়, হরিরামপুর, সিঙ্গাইর, ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ সফর করেন এই প্রতিবেদক। এসময়ে হালিম বাহিনীর অন্তত ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধে হালিম বাহিনীর যুদ্ধের বীরত্বগাঁথার বর্ণনা রয়েছে অন্তত দুটি গ্রন্থে। এর একটি  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের নবম খণ্ড। অপরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস,  সেক্টর ২।

এই দুটি গ্রন্থ সূত্রে ও  হালিম বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার খবর ওয়্যারলেস মারফতে তাৎক্ষনিকভাবেই জানতে পেরেছিলেন মানিকগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এমতাবস্থায় মানিকগঞ্জে  ৭ সদস্য বিশিষ্ট ‘মানিকগঞ্জ স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়।  সংগ্রাম পরিষদের  অন্যতম সদস্য ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী। পরিষদের সদস্যরা ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ সহ সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন।

২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জের ট্রেজারির তালা ভেঙে বেশ কিছু রাইফেল ও কয়েক হাজার গুলি তুলে নেন। শিবালয়ের প্রতিটি ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়।  এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে মানিকগঞ্জ মহকুমার, সদর,  শিবালয়, ঘিওর, হরিরামপুর, সিঙ্গাইর সহ সর্বত্র  হালিম বাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের  প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়। 

মে মাসের  মাঝামাঝি সময়ে রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা হরিণা গ্রামের থানা সদরের নবনির্মিত ভবনসমূহে ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপরই মানিকগঞ্জের সর্বত্র হালিম বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর একের পর এক যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে অন্তত ৪০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন হালিম বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে কয়েকশো পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়েছিলো।  

প্রথম পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল ১৭ জুনের সিঙ্গাইরের চারিগাঁও লঞ্চঘাট অপারেশন। ঢাকা থেকে লঞ্চ মারফত নিয়মিতভাবে মানিকগঞ্জে অস্ত্র-রসদ সরবরাহের খবর পেয়ে পাকিস্তানি লঞ্চ আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। ১৭ জুন সিঙ্গাইরের কালীগঙ্গা নদীপাড়ের চারিগাঁওতে পজিশন নিয়ে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। দুপুরে পাকিস্তানি লঞ্চ অ্যামবুশ পজিশনে ঢুকতেই অতর্কিত আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। লঞ্চের মধ্যে ১২/১৪ জন মিলিটারি ছিল সবাই গুলিতে মারা যায়। কালীগঙ্গা নদীর মতো ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীতে একাধিক আক্রমণ চালানো হয়।

হালিম বাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল সিঙ্গাইরের বায়রা গ্রামের অ্যামবুশ। ১৩ জুলাই সকালে খবর আসে বায়রা গ্রামের পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদী দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা একাধিক নৌকা যোগে মানিকগঞ্জে রসদ সরবরাহ করবে।  বিষয়টি জানতে পেরে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি রসদবাহী নৌকার উপর অতর্কিত আক্রমণের উদ্দেশ্যে নদীর দুপাশে অবস্থান নেন। এই  যুদ্ধে ২০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিলো।

হালিম বাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল জুলাই মাসে সংঘটিত মাচাইন বাজারের যুদ্ধ। মাচাইন বাজার ও মাচাইন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি নদী। মাচাইন বাজারের পূর্বপাশে স্কুল বিল্ডিংয়ে পাকিস্তানি বাহিনী  তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। গ্রামের বাজারের ঘাট থেকে পাকিস্তানি সেনারা নিয়মিতই ইছামতি নদী হয়ে পদ্মায় টহল দিতো।এদের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ জুলাই পর্যন্ত একাধিকবার রেকি করেন। বেশ কয়েক দফা রেকি করার পরে ১৮ জুলাই রাতে অপারেশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ১৮ জুলাই রাত ১১টার দিকে আনুমানিক ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার দুটি দল জল ও স্থলপথে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা তখন পালাচ্ছিল। এসময়  রউফ খানের দলের গুলিতে  ৭/৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।  

৯ আগস্ট ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী দুজন মুক্তিযোদ্ধা সহ নৌকাযোগে শিবালয়ের মালুচী গ্রামে আসেন। অতঃপর তিনি ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থানরত দারোগা ও পুলিশদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। পুলিশরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মা নদীতে পাকিস্তানি লঞ্চে আক্রমণের পর ধ্বংস করা হালিম বাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। এই যুদ্ধে ১১ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৩ রাজাকার নিহত হয়েছিলো। কেবল জলেই নয়, স্থলপথেও পাকিস্তানি বাহিনীকে পুরোপুরি পর্যদুস্ত করেছিলেন হালিম বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ২৯ আগস্ট মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার নয়াডিঙ্গি ব্রিজে ধ্বংসের অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজটি অনেকাংশেই চলাচলের অনুপযুক্ত করে দিয়েছিলেন।

অধিকতর অস্ত্র সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের ত্রিপুরার মেলাঘরে যান ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী।  মেলাঘরে তাঁর সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা হয়। অক্টোবর মাসে হালিম বাহিনীর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল সিঙ্গাইরের বায়রা গ্রামের যুদ্ধ। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল রসদ আনার জন্য সিঙ্গাইর থেকে মানিকগঞ্জ গিয়েছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে হালিম বাহিনী তাদের ফেরার পথে বায়ড়ায় ধলেশ্বরী নদীর দু’পাড়ে অবস্থান নিয়ে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতেন। দুপুর ৩টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা যখন নৌকাযোগে বায়রায় পৌঁছে তখন ধলেশ্বরীর উভয় পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন এলএমজি দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করলে পাকিস্তানিরা পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এসময় ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ১৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।  

এই যুদ্ধের কয়েকদিন পর ১৩ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর হরিরামপুরের হরিণা ক্যাম্প দখল করেন মুক্তিযোদ্ধারা। বেলুচ সেনাদের সাহায্য নিয়েই এই যুদ্ধ জয় করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জের হরিণায় সিও কার্যালয়ে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি।  ক্যাম্পটিতে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ছিল। হরিণা ক্যাম্পে থাকা ৪ জন বেলুচ সেনা বাকি পাকিস্তানি সেনাদের উপর বিরক্ত ছিল। নান্নু মিয়া নামের স্থানীয় একজনের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানি পক্ষাবলম্বন ত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে চায়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ অক্টোবর বিকেলের মধ্যে ১২-১৫টি নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধারা সুতালড়ি ক্যাম্প  আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর- পশ্চিম দিক ও  বুড়ির বটতলা এবং পাটগ্রাম স্কুল বরাবর অবস্থান নেন। ঘেরাও শুরুর পরপরই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ।  প্রথমে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে। একপর্যায়ে দুটি ক্যাম্পই মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে এলে বেলুচ সেনারা আত্মসমর্পণ করে জানায় ক্যাম্পে আর কোন সেনা নেই। বেলুচ সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে দেখে ৭ রাজাকারও আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা এসময় হরিণা ক্যাম্পের দোতালার একটি ঘর থেকে ৮ জন নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করে। 

পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে হালিম বাহিনীর সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ ছিল অক্টোবর মাসে সিঙ্গাইরের গোলাইডাঙ্গার যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনরূপ ক্ষতি ছাড়াই এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৮২ সেনা নিহত হয়েছিলো। গোলাইডাঙ্গা স্কুলে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ২৮ অক্টোবর গোপনসূত্রে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান ১০/১২টি নৌকায় করে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি দখলের লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে।  তখন তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতেন মুক্তিযোদ্ধারা।  পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে স্কুলে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের না দেখতে পেয়ে নৌকাযোগে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশ পজিশনে ঢুকতেই দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা।  আক্রমণে পাকিস্তানিদের সব নৌকাই ডুবে যায়। পানিতে ডুবে বেশীরভাগ সেনা মারা যায়। বাকিরা গুলিতে। 

যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন বলেন, ‘সেদিন আমরা মাত্র ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানিদের পানিতে নামিয়ে, কাদায় ডুবিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলাম। টানা  তিনদিন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে সেই যুদ্ধের বীরত্ব প্রচার করা হয়েছিলো।’ 

মুক্তিযুদ্ধে হালিম বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে আরও ছিল  ১৩ জুলাই ও অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বায়ড়া গ্রামের যুদ্ধ, ১৮ জুলাই মাচাইন বাজারের যুদ্ধ, ৯ আগস্ট মালুচি গ্রামের অ্যামবুশ,  ২৮ নভেম্বরের ঘিওরের  নারচি ও কুস্তাগ্রামের যুদ্ধ। ৮ ডিসেম্বরে শিবালয়ের দাসকান্দি গ্রামের যুদ্ধ প্রভৃতি।

মানিকগঞ্জের সদর, সিঙ্গাইর, ঘিওর, শিবালয়, দৌলতপুর, হরিরামপুর, ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, ধামরাই, সাভার, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর সহ ২২টি থানার প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে  ছিল হালিম বাহিনীর বিস্তৃতি। হালিম বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি ইউনিট ও পাঁচটি কোম্পানিতে ভাগ করা হয়েছিলো। অধ্যক্ষ রউফ খানের নেতৃত্বে  হরিরামপুর-শিবালয়-ঘিওর-দৌলতপুর অঞ্চল। তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে সিঙ্গাইর-মানিকগঞ্জ-সাটুরিয়া ও সাভার অঞ্চল এবং সিরাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন  ইউনিটটি ছিল ঢাকার নবাবগঞ্জ-দোহার-কেরানীগঞ্জে। 

মেঘনা পাড়ের পাঠান বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধকালে জহিরুল হক পাঠান নামের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক বাঙালি সুবেদার পাকিস্তানি বাহিনীর চোখে ভয়ঙ্কর ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেসময় চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বিশাল এক অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠা আঞ্চলিক বাহিনীটি পরিচিত ছিল পাঠান বাহিনী নামে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছুটিতে আসা ও প্রাক্তন কয়েকজন সেনা সদস্যকে নিয়ে বাহিনীটি গঠিত হলেও একপর্যায়ে পাঠান বাহিনীতে  মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০০’র ও বেশী।

পাঠান বাহিনীর উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে ২০২৪ সালের  জুন মাসে এই প্রতিবেদক সরজমিনে চাঁদপুর, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর মোট ১০টি  উপজেলা সফর করেন। এসময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে পাঠান বাহিনীর ত্রিশ জনেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়। পাঠান বাহিনীর যুদ্ধ ও  বীরত্বগাঁথার বিবরণ একাধিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহান কবির বীর প্রতীক রচিত  ‘চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ ও ডা. দেলোয়ার হোসেন খান রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর’ গ্রন্থ অন্যতম।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে  দুটি ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংসের পাশাপাশি অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন জহিরুল হক পাঠান। সেই বীরত্বের  স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার জহিরুল হক পাঠানকে ‘তমাঘায়ে জুররাত’ খেতাবে ভূষিত করে। একইসঙ্গে তাঁর বীরত্ব  ‘রণাঙ্গনে পাকিস্তান’ শীর্ষক মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।  ফলে পূর্ব থেকেই এই অঞ্চলে সুপরিচিত ছিলেন জহিরুল হক পাঠান। 

মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময় চাঁদপুরে সর্বদলীয় চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। মার্চ মাসের শুরুতেই হাজীগঞ্জে কলিম উল্লাহ ভূঁইয়ার উদ্যোগে হাজীগঞ্জের অলিপুর গ্রামে ৩০ জন ছাত্র যুবক সংগঠিত হয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হয়। যার মূল দায়িত্বে ছিলেন কলিম উল্লাহ ভূঁইয়া।

২৫ মার্চের পরবর্তীতে ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ফরিদগঞ্জের পাইকপাড়া স্কুলে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির এক জরুরী বৈঠকে জহিরুল হক পাঠানকে চাঁদপুর মহকুমা মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও দেয়া হয়। তখন জহিরুল হক পাঠান প্রথমে বিশাল একটি এলাকাকে ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করেন।  নায়েক সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে হাজীগঞ্জ, রামগঞ্জ, চাটখিল ও রায়পুরের একাংশ। নায়েক সুবেদার জহিরুল ইসলামকে মতলব থানার দায়িত্বে, সার্জেন্ট জয়নাল আবেদীনকে চাঁদপুর মহকুমার সদর ও হাইমচর, নায়েক সুবেদার আবদুর রবকে ফরিদগঞ্জ, রামগঞ্জ ও রায়পুরের কিছু অংশ,  হাবিলদার সিরাজুল ইসলামকে কচুয়া থানা এবং নায়েব সুবেদার মফিজকে হেডকোয়ার্টার ও শাহরাস্তি থানার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে পাইকপাড়া স্কুলকে বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করা হলেও পরবর্তীতে বাহিনীর হেডকোয়ার্টার লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের পানি আলী গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে স্থানান্তরিত  করা হয়। চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের মোট ১৩টি থানার ১ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিলেন পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।  উত্তরে চাঁদপুরের মতলবের সাদুল্লাপুরের মেঘনা নদীর তীর থেকে কচুয়ার বিটারা ইউনিয়ন পর্যন্ত, দক্ষিণে হাইমচরের চর ভৈরবী ইউনিয়ন থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, রায়পুর ও নোয়াখালীর চাটখিল  পর্যন্ত।  পূর্বে কচুয়া থেকে কুমিল্লার লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ থানা ও পশ্চিমে মতলব, চাঁদপুর মহকুমা সদর ও হাইমচরের মেঘনা নদী প্রান্ত পর্যন্ত ছিল পাঠান বাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল। পাঠান বাহিনীর একটি গোয়েন্দা ইউনিটও  ছিল।

পাঠান বাহিনীর বেসামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো হাজীগঞ্জ সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে। পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে  পাঠান বাহিনীর একটি দুর্ধর্ষ যুদ্ধ ছিল গাজীপুরের প্রথম যুদ্ধ।

২৭ এপ্রিল ফরিদগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যার্থে চাঁদপুর থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ বোঝাই একটি লঞ্চের আগমনের খবর পেয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন জহিরুল হক পাঠান।  স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে লঞ্চটি টুরগি অতিক্রম করেছে জানার পর তৎপর হয়ে উঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। নদীর বাঁক দিয়ে ঘুরে পাকিস্তানিদের লঞ্চটি গাজীপুর বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে অ্যামবুশের ফাঁদে প্রবেশ করতেই  সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে একসঙ্গে গর্জে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র। যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান বলেন, ‘…অবস্থা বেগতিক দেখে ওরা কিছু নদীতে ঝাঁপ দিলো, বেশীরভাগই মারা গেল। বাকিরা ধানুয়া দিয়ে পালিয়ে গেল। তলা ফুটো হওয়ায় লঞ্চটা শেখের টেকের নদীতে ডুবে গেল।’ পরদিন মুক্তিযোদ্ধারা নদীর তলা থেকে লঞ্চটিকে তুলেন। এসময় লঞ্চ থেকে ২টি ভারী মেশিনগান, ৪টি চাইনিজ এলএমজি সহ প্রচুর রাইফেল ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। 

মুক্তিযুদ্ধে পাঠান বাহিনীর খাজুরিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই এক জনযুদ্ধ।  পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন গ্রামের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে খাজুরা বাজার, রূপসা, কড়ইতলী, চান্দ্রা, গাজীপুর, খল্লাক, সোল্লা বাজার সহ বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ দা, কুড়াল, বটি, শাবল সহযোগে পাকিস্তানি সেনাদের খতম করতে এগিয়ে আসে। 

২৯ জুলাই লোক মারফতে সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা জানতে পারেন পাকিস্তানি বাহিনীর বড় একটি দল  ফরিদগঞ্জ থেকে ১৫/১৬টি নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণের জন্য আসছে। পাকিস্তানি সেনাদের দলটি যখন মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের পজিশনের আওতায় আসে তখন  গর্জে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালি পুলিশরা পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম আক্রমণে এক অফিসার সহ ৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এছাড়া ফরিদগঞ্জ থানার দারোগা সহ ৮ জন পুলিশ নিহত হয়। একইসঙ্গে পাকিস্তানিদের ৫টি নৌকা পানিতে ডুবে যায়।

পাঠান বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে মে মাসের প্রথম দিকে শাহরাস্তির ঠাকুর বাজারের যুদ্ধ, ১৭ মে হাজীগঞ্জের বলাখালের রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটের যুদ্ধ, ১৫ জুলাই শাহরাস্তির নরিংপুরের যুদ্ধ, ২৭ ও ২৮ আগস্ট কুমিল্লার লাকসামের হাসনাবাদের যুদ্ধ,  ৭ সেপ্টেম্বর সূচীপাড়া খেয়াঘাটের যুদ্ধ,  ফরিদগঞ্জে পাকিস্তানি খাদ্যবাহী লঞ্চে আক্রমণ,   ২৯ সেপ্টেম্বর অফিস চিতসির যুদ্ধ,  ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মতলবের মোহনপুরে মেঘনা নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

অক্টোবর মাসে জহিরুল হক পাঠান কলকাতা গমন করেন। এসময় তিনি ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর বাহিনীর বিস্তারিত কার্যক্রম তুলে ধরেন। এসময় জহিরুল হক পাঠানকে চাঁদপুর মধুমতি সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

রণাঙ্গনে পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম বীরত্বগাঁথায়  ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় চাঁদপুর। চাঁদপুর মুক্ত হওয়ার ২১ দিন পর ২৯ ডিসেম্বর চাঁদপুর টেকনিক্যাল হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেন পাঠান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।

পুনর্ভবা তীরের শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্প ও জর্জ বাহিনী

জর্জ জে এম দাশ নামের ইপিআরের এক অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনার হাত ধরেই গড়ে উঠেছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বৃহৎ একটি প্রশিক্ষণ শিবির। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে প্রশিক্ষক ও সংগঠক এবং পরবর্তীতে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন জর্জ দাশ। কিংবদন্তীতুল্য এই মানুষটি দিনাজপুরের সর্বমহলেই পরিচিত ছিলেন ‘জর্জ ভাই’ নামে।

মুক্তিযুদ্ধে জর্জ দাশ ও তাঁর বাহিনীর বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে সরজমিনে দিনাজপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলায় সফর করেন এই প্রতিবেদক।  এসময় জর্জ বাহিনীর ১০ জনেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জর্জ দাশ ও তাঁর বাহিনীর বীরত্বগাঁথার কথা উল্লেখ রয়েছে একাধিক গ্রন্থে।  জর্জ দাশ ও তাঁর বাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে  ‘মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরের জর্জবাহিনীর অবদান ও মহানায়ক জর্জ দাশ’ গ্রন্থ। এছাড়া ‘দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র’, ‘মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা’ গ্রন্থেও আংশিকভাবে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৫৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দিয়েছিলেন জর্জ জে এম দাশ।  পায়ে আঘাতের দরুন পঙ্গুত্বের কারণ দেখিয়ে ১৯৬৯ সালে ল্যান্স কর্পোরাল পদ থেকে জর্জ দাশকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ দিনাজপুরে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এসময় জর্জ দাশের নেতৃত্বে গোপনে যুবকদের প্রশিক্ষণের কাজও শুরু হয়। জর্জ দাশের ভাই লুইস দাশও ইপিআর সদস্য ছিলেন। বিরলের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করেন জর্জ দাশ।   

২৭ মার্চ বিকেলে ইপিআরের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান জর্জ দাশ। পাকিস্তানি সেনারা গোলাবর্ষণ শুরু করলে বাঙালি সেনাদের নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন জর্জ দাশও। পাকিস্তানি সেনারা তখন পিছু হটলে বাঙালি সেনা ও ছাত্র-তরুণদের নিয়ে কুঠিবাড়ির অস্ত্রাগার লুট করেন জর্জ দাশ। টানা চারদিন যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী পুরোপুরি পিছু হটায় ৩১ মার্চ দিনাজপুর শত্রুমুক্ত হয়। তখন দিনাজপুর স্টেডিয়াম ও বালুয়াডাঙ্গার অস্থায়ী ক্যাম্পে যুবকদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেন জর্জ দাশ।  

১২ এপ্রিল সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে দশমাইলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জর্জ দাশের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধাও অংশ নিয়েছিলেন।  কিন্তু পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পারায় ১৩ এপ্রিল দিনাজপুরের পতন হয়। তখন জর্জ দাশ ও তাঁর দল বিরলের পুনর্ভবা নদী ধরে ভারতের রাধিকাপুর ক্যাম্প দিয়ে  ভারতের গঙ্গারামপুর থানার রাজীবপুর মিশনে আশ্রয় নেন।  এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে রাজীবপুর মিশনের পাশে ছোট পরিসরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেন জর্জ দাশ।  

মুক্তিযুদ্ধে  দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারাও অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একটি বড় অংশই যুদ্ধ করেছিলেন জর্জ দাশের অধীনে। বর্তমানে দিনাজপুরের  বিরলের ১০ নং রাণী পুকুর ইউনিয়নের হালজায়, রঘুদেবপুর, আছুটিয়া, ঝিনাইকুঁড়ি ও তৎসংলগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামে বসবাস করেন সাঁওতাল, মুন্ডা, কড়া, ওঁরাও, মাহালী, তুরি সহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।  এসব জাতিগোষ্ঠীর প্রায় শতাধিক বাসিন্দা জর্জ দাশের অধীনে  মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 

এই অঞ্চলে ‘কড়া’ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তত ১৪ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র জীবিত রয়েছেন কিনা কড়া। জর্জ দাশের সঙ্গে তিনি ঝিনাইকুঁড়ি গ্রামের একটি ব্রিজ ধ্বংসের অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারাই নন, দিনাজপুর শহরের যে সকল খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই জর্জ দাশ তথা তাঁর বাহিনীর অধীনেই যুদ্ধ করেছিলেন। জর্জ দাশেরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 

রৌমারীর আফতাব বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের এক বাঙালি সুবেদার পাকিস্তানীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন সাক্ষাৎ ত্রাসের নাম।  আফতাব আলী নামের সেই সুবেদারের নেতৃত্বে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তাপাড়ের জনপদে গড়ে উঠেছিলো কিংবদন্তি তুল্য এক আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী। যা আফতাব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল।  রণাঙ্গনে চারবার গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্যও দমেননি সুবেদার আফতাব। আজো কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার  জনপদে লোকমুখে শোনা যায় এই বাহিনীর বীরত্ব ও সাহসিকতার কথা।  

মুক্তিযুদ্ধে আফতাব বাহিনীর  উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে চলতি বছরের মে মাসে সরজমিনে কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজীবপুর, চিলমারী, উলিপুর, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও পলাশবাড়ি  সফর করেছিলেন এই প্রতিবেদক। এসময় আফতাব বাহিনীর অন্তত চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। 

আফতাব বাহিনীর বীরত্বগাঁথার কথা  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের ১০ম খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। একইসঙ্গে এই বাহিনীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস,  সেক্টর- ১১ গ্রন্থেও।

 ২৫ মার্চ গণহত্যার পরবর্তীতে ২৭ মার্চ ডেল্টা কোম্পানির বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে পলাশবাড়িতে অ্যামবুশ স্থাপন করেন। প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে  সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে সেনারা পিছু হটে ফের সংগঠিত হওয়ার জন্য  তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র  নদী পাড়ি দিয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রৌমারীতে এসে অবস্থান নেন। এরই মধ্যে মার্চের শুরুতেই রৌমারীর সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়েছিলো। প্রথমদিকে প্রশিক্ষণ ঢিমেতলে চললেও সুবেদার আফতাবের আগমনের সঙ্গেই রৌমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়।   এসময় স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণেরাও আফতাব বাহিনীতে যোগ দেন। স্বল্প সময়েই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী  কোদালকাঠি, টাপুরচর, দাঁতভাঙ্গায় বাহিনীর একাধিক ক্যাম্প গড়ে উঠে। দেশের অভ্যন্তরে সর্ববৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির হয়ে উঠে রৌমারী। এ সময়েই জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের সবুজপুর ঘাট থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ হয়ে রাজীবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। যা রৌমারী মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল।

জুন-জুলাই মাসে রৌমারীর কোদালকাঠি চরে ছিল আফতাব বাহিনীর শক্ত অবস্থান। ৬ আগস্ট  রৌমারী দখলের লক্ষ্যে প্রথমেই কোদালকাঠির চরে ব্যাপক গোলাবর্ষণ চালিয়ে কোদালকাঠির চরের দখল নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তখন পিছু হটে কর্তিমারীর চরে চলে যেতে বাধ্য হন মুক্তিযোদ্ধারা। 

এমতাবস্থায় মুক্তাঞ্চল হিসেবে রৌমারীর গুরুত্ব অনুধাবন করে  ও বেদখলের আশঙ্কায় ৩য় বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলকে সাহায্যের অনুরোধ করেন সুবেদার আফতাব। তখন  লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী খানের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে রৌমারীতে পাঠিয়ে কোদালকাঠিকে সামনে রেখে চূড়ান্ত অবরোধের পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেন পাকিস্তানিরা কোনভাবেই  রাজীবপুরের সোনাভরী নদী ও জালছেঁড়া খাল দিয়ে রৌমারীতে ঢুকতে না পারে।

এ পর্যায়ে  ৩য় বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি ও আফতাব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজীবপুর থেকে ঘুঘুমারির চর পর্যন্ত ৪০ মাইল এলাকা ঘেরাও করে রাখেন। রৌমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুল হকের নেতৃত্বে গঠন করা হয় রৌমারী প্রতিরক্ষা নগর কমিটি। ৮ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা গানবোট ও কয়েকটি লঞ্চ সহযোগে জালছেঁড়া খালে প্রবেশ করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে দিনভর যুদ্ধের পর কোদালকাঠিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

আগস্ট মাসে একাধিক খণ্ডযুদ্ধের পরবর্তীতে সেপ্টেম্বর মাসের ২১ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা মোট ৬ বার গানবোট, লঞ্চ ও ষ্টীমার সহযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের হাজীরচর, যাদুরচর এবং রাজীবপুর ক্যাম্প দখলের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েও শেষমেশ ব্যর্থ হয়। । সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে  ১ম বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিন আফতাব বাহিনীকে কোদালকাঠির চর দখলের নির্দেশ দেন। 

১ অক্টোবর সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে  ২৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা কোদালকাঠি দখলের লক্ষ্যে  নদী পার হয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই শংকর মাধবপুর গ্রামের উত্তর প্রান্তে পৌঁছে যান। ২ অক্টোবর সকালে পাকিস্তানি সেনাদের একটি পেট্রোল টিম শংকর-মাধবপুর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়। এরপরই শুরু হয় দ্বিমুখী যুদ্ধের। দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা খারুভাঞ্জ অবস্থান থেকে দুই দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে।

দক্ষিণে হাবিলদার রিয়াজুলের প্লাটুন ও মাঝে থাকা হাবিলদার মনসুরের প্লাটুনের সঙ্গে পাকিস্তানিদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় মাঝে থাকা হাবিলদার মনসুরের ২ নম্বর প্লাটুনের মুখোমুখিও হয় পাকিস্তানি সেনারা। অন্যদিকে হাবিলদার মনসুরের অবস্থানের সম্মুখে প্রবল কাদা থাকায় অগ্রসর হতে পারছিল না পাকিস্তানি সেনারা, কাদায় আটকে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা প্রাণভয়ে শংকর মাধবপুরের দিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।

পিছনের দিক থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা ধানক্ষেতে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। এসময় ভুলবশত নিজেদের মুখোমুখি অবস্থানের গোলাগুলিতেই পাকিস্তানি সেনারা নিজেরাই বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পাকিস্তানিদের দুটি কোম্পানিই ধ্বংস হয়ে যায়।  আনুমানিক দেড়শোর বেশী পাকিস্তানি মারা যায়।

জামালপুর মহকুমার দেওয়ানগঞ্জ থানার পশ্চিমাংশ থেকে কুড়িগ্রামের  ঘুঘুমারির চর হয়ে উত্তরবর্তী ভারতীয় সীমান্ত রেখা পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে ছিল আফতাব বাহিনীর বিস্তৃতি। রৌমারীকে মুক্তাঞ্চল রাখার লড়াইয়ের  পাশাপাশি  পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ৩০টিরও  বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আফতাব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। আফতাব বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম যুদ্ধ ছিল দুর্গাপুর ব্রিজ অপারেশন,  গাইবান্ধার কামারজানির পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, সুন্দরগঞ্জ থানা অপারেশন, কালীর বাজার পাট গুদাম দখল, উলিপুরের যুদ্ধ, চিলমারী রেইড, বালাবাড়ি যুদ্ধ প্রভৃতি।

পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে আফতাব বাহিনী কখনোই অস্ত্রশস্ত্রের মুখাপেক্ষী থাকেনি। ভারতের উপরও তারা নির্ভর ছিলেন না।  রৌমারীতে স্থাপন করা হয়েছিলো বাংলাদেশের প্রথম বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। রৌমারী মুক্তাঞ্চলের উপর ভিত্তি করে এনবিসি টেলিভিশন নির্মাণ করেছিল ‘The country mad for disaster’ এবং ‘Dead line Bangladesh’। এই দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হওয়ার পরে বিশ্বজুড়েই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল। 

পলাশডাঙ্গা যুব শিবির

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম জাঙ্গালিয়াগাতি। প্রত্যন্ত সেই গ্রামেই পাঁচ ছাত্রনেতার উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’ নামের একটি আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী। কালক্রমে যা হয়ে উঠেছিলো ৬০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে যে কয়টি আঞ্চলিক বাহিনী  যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো পলাশডাঙ্গা যুব শিবির ছিল  তার মধ্যে অন্যতম।

ঢাকা-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের কড্ডার মোড় ধরে কয়েক কিলোমিটার এগুলেই রাস্তার বাম দিকে চোখে পড়ে সুদৃশ্য এক স্মৃতিসৌধ। পাশেই পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের ৪৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম সম্বলিত একটি তালিকা। স্মৃতিসৌধের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে এগোলেই দেখা মিলবে মধ্য ভদ্রঘাট, বাজার ভদ্রঘাট, বসাকপাড়া, কালীবাড়ি ভদ্রঘাট সহ বিভিন্ন পাড়ার। সর্বমোট ২৭টি পাড়া বা গ্রাম নিয়ে গঠিত ভদ্রঘাট ইউনিয়নের তেমনই একটি পাড়া জাঙ্গালিয়াগাতি।  

পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে চলতি বছরের মে মাসে সরজমিনে সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বেশ কয়েকটি উপজেলা সফর করেন এই প্রতিবেদক। এসময় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এই বাহিনীর ত্রিশ জনেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধার কথা হয়।

মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ডের ‘ভদ্রঘাট যুদ্ধ সিরাজগঞ্জ’ পরিচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের বীরত্বগাঁথার কথা বর্ণিত হয়েছে। একইসঙ্গে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির নিয়ে ‘জনসাধারণের স্মৃতিতে পলাশডাঙ্গা যুব শিবির- ভদ্রঘাট যুদ্ধ পর্ব’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন সাধন চন্দ্র বসাক। 

এই দুটি গ্রন্থ সূত্রে ও পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের নেতৃত্বস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে দুর্ধর্ষ এই আঞ্চলিক বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। 

৮ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠ ও স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২৪ এপ্রিল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা উল্লাপাড়ার ঘাঁটিনা রেলসেতুতে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান।  তখন পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে শুরু হয় সংঘর্ষ। প্রায় ৩ ঘণ্টা ব্যাপী চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শহীদ হন ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে  মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। একপর্যায়ে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে জহির উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন তরুণ ও মহকুমার সদরের কান্দাপাড়া থেকে ১৫ জন তরুণ এই মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিলে বাহিনীর পরিসর বাড়ে।

অন্যদিকে  ছুটিতে থাকা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা লুৎফর রহমান অরুণের তত্ত্বাবধানে গোপনীয়তার সঙ্গে শুরু হয় বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ। প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধারা চান্দু শেখের বাড়িতে থাকলেও একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়লে হরেন্দ্রনাথ বসাকের বাড়ির দুটি ঘরের একটিকে  অস্ত্রাগার ও আরেকটিকে বসবাসের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা আরও বাড়লে  পার্শ্ববর্তী রশিদ, সুকুমার, হারান মাস্টারের বাড়ি সহ বেশ কয়েকটি বাড়ি ও কালীবাড়ি ভদ্রঘাট স্কুলে আশ্রয় নেন মুক্তিযোদ্ধারা।

মে মাসে  ছাত্রনেতা আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে সিরাজগঞ্জে ফিরে এসে বাহিনীতে যুক্ত হন। ৬  জুন  মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’। ভদ্রঘাট বা পার্শ্ববর্তী কোন এলাকার নাম পলাশডাঙ্গা না হলেও কেন বাহিনীর নাম পলাশডাঙ্গা যুব শিবির রাখা হলো জানতে চাই বাহিনীর সহকারী পরিচালক আব্দুল আজিজ সরকারের কাছে। তিনি বলেন, ‘পলাশীর প্রান্তরে নামানুসারে ‘পলাশ’, খালের পাশের বাড়িতে প্রথম আশ্রয় নেয়ায় ‘ডাঙ্গা’, আমরা সবাই যেহেতু যুবক তাই যুব, আর সংগঠন নাম ‘শিবির’। সবকিছু মিলিয়েই ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’। আর জাঙ্গালিয়াগাতি বা ভদ্রঘাট লিখলে আমাদের ধরা পড়ার ভয় ছিল, সে কারণেই ঠিকানা পলাশডাঙ্গা করা হয়েছিলো।’ 

প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রতি রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা ছোটখাটো অপারেশনে বের হতেন। এসব অপারেশনে রাজাকার ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। ১৭ জুন ভোরে পাকিস্তানি সেনারা ভদ্রঘাটে আক্রমণ চালায়। মুহূর্তেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ক্যাম্পে থাকা শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাও। যুদ্ধে এক পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। তখন বাড়তি পাকিস্তানি সেনা এসে যোগ দিলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভদ্রঘাট ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ভদ্রঘাটের ছোট্ট গ্রাম জাঙ্গালিয়াগাতিতে সৃষ্ট পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা  সিরাজগঞ্জ মহকুমা সদর থেকে উল্লাপাড়া,  বেলকুচি, শাহজাদপুর, তাড়াশ, পাবনার ফরিদপুর, সাথিয়া, ভাঙ্গুড়া থেকে নাটোরের গুরুদাসপুর হয়ে বগুড়ার শেরপুর পর্যন্ত এক  বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন ছোট বড় অন্তত ৫১টি যুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ ছিল তাড়াশ থানার নওগাঁ হাটের যুদ্ধ।  ১০ নভেম্বর রাতে লতিফ মির্জার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নওগাঁ বাজার সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিলেন। রাজাকারদের সূত্রে খবর পেয়ে ভোরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে  দুইপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়। ভোর ৫টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত টানা ১০ ঘণ্টা যুদ্ধের একপর্যায়ে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে।   যুদ্ধে ১৩০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

নওগাঁ বাজারের পাশেই শাহ শরীফ জিন্দানির মাজার। সেদিন মাজার এলাকা ও নদীর পাড়ে যুদ্ধটি ছিল উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ গেরিলা যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি অফিসার ক্যাপ্টেন সেলিম সহ ৯ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। তখন প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া গিয়েছিল। নওগাঁ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর একাধিকবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিলো। 

নওগাঁ যুদ্ধ ছাড়াও পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের  ‍মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এসব যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জের  তাড়াশ থানার যুদ্ধ, ঘাটিনা ব্রীজ অপারেশন, জামতৈল ব্রিজ অপারেশন, পাবনার ভাঙ্গুড়ার  দিলপাশার ব্রিজ অপারেশন, সাঁথিয়া থানার কাশিনাথপুরের যুদ্ধ, বেড়া উপজেলার ডাববাগান যুদ্ধ, ঘাটনা যুদ্ধ, ফরিদপুর সাঁথিয়া ও গুরুদাসপুর থানা আক্রমণ,  কৈডাঙ্গা ব্রিজের যুদ্ধ, ঝাঐল ব্রিজ অপারেশন প্রভৃতি।

পলাশডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধারা যেসব রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছেন এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল  সলংগা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ,  বস্তুলের মফিজ মাদানীর ক্যাম্প আক্রমণ, মান্নাননগর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ধামাইচ হাটের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের  গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ ছিল তাড়াশ থানার যুদ্ধ। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল তাড়াশ থানা আক্রমণের পর দখল করে ২০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিজেদের আয়ত্তে নেন।

পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলন বিলের মধ্যেই অবস্থান করেছিলেন তাঁরা, সেখান থেকেই তাঁরা গিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতেন। চলনবিল দুর্গম হওয়ায় পাকিস্তানিদের পক্ষে চলনবিলে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি।  চলনবিলের মধ্যে উল্লাপাড়ার গয়াহাটা ও কালিয়াকৈরে দুটি ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল।  ধরাইল বিলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি আস্তানা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বেশীরভাগ সময়ই নৌকায় অবস্থান করতেন। চলাচলের বাহন হিসেবে ৫৪টি নৌকা ব্যবহার করা হতো।

পেয়ারা বাগান: পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী

খালের দুধারে পেয়ারা বাগান।  সারিবদ্ধ পেয়ারা গাছের দুপাশে নালার মতো বয়ে গেছে চিকন খাল। ভিতরে কেউ থাকলে বাইরে থেকে সহজে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায়না। ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুরের তিনটি থানা জুড়ে বিস্তৃত এই পেয়ারা বাগানই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হয়ে উঠেছিলো এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি।  

বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদার নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা  দক্ষিণাঞ্চলের এসব পেয়ারা বাগানকে মুক্তিযুদ্ধের  প্রথম পর্যায়ে এক  বিস্তৃত মুক্তাঞ্চলে পরিণত করেছিলেন।  পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর উপরে বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে এই প্রতিবেদক অক্টোবর মাসে সরেজমিনে ঝালকাঠী, পিরোজপুর ও বরিশালের একাধিক উপজেলা সফর করেন।

মহিউদ্দিন আহমদের ‘লাল সন্ত্রাস’ ও মুনীর মোরশেদ রচিত ‘সিরাজ সিকদার ও পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ১৯৬৭-১৯৯২’  গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে এই বাহিনীর কথা। একইসঙ্গে এই বাহিনীর প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধ দিয়ে ‘৭১ এর বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ঘাঁটি এলাকা পেয়ারাবাগান’ শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদিত হয়েছে। যা সম্পাদনা করেছেন মুনির মোরশেদ। 

১৯৬৮ সালে কতিপয় সহযোগীকে নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ গড়ে তুলেন বামপন্থী ছাত্রনেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭১’র ৮ জানুয়ারি ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম করুন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা।  যুদ্ধ শুরু হলে ১৮ এপ্রিল ঢাকা ছেড়ে বরিশালে চলে যান সিরাজ সিকদার। ঝালকাঠীর কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের রুনসী গ্রামে আশ্রয় নেন তিনি। মার্চের শুরু থেকেই ঝালকাঠীর বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়েছিলো। এর মধ্যে পিপলদিয়া স্কুল ও রমানাথপুর স্কুলেও  প্রশিক্ষণ চলছিলো।  ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা ঝালকাঠী শহরে প্রবেশ করলে আগে  সংগ্রহ করা ৩৬টি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণরত শতাধিক ছাত্র-যুবক ও আওয়ামী নেতাকর্মী কীর্ত্তিপাশা হাইস্কুলে অবস্থান নেন। পাকিস্তানিদের জাতীয় শত্রু বিবেচনা করে  ২৯ এপ্রিল কীর্ত্তিপাশা স্কুলে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ৩০ এপ্রিল ঝালকাঠীর ভীমরুলি স্কুলে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

২ মে পেয়ারা বাগানকে ১ নম্বর ফ্রন্ট এরিয়া ও ভীমরুলিকে সদর দপ্তর করে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য ভীমরুলীতে খোলা হয় সামরিক স্কুল। পেয়ারা বাগানকে  ৮টি গেরিলা সেক্টরে ভাগ  করা হয়।  এ সেক্টরগুলো ছিল  কীর্ত্তিপাশা, শতদশকাঠী, আটঘর, বাউকাঠী, পশ্চিম জলাবাড়ি, পূর্ব জলাবাড়ি কুড়িয়ানা ও আতা।  এছাড়া বাহিনীতে গণসংযোগ কমিটি, একটা সেন্ট্রাল সিকিউরিটি ইউনিট, গোয়েন্দা ইউনিট ও ছিল।    

প্রতিটি সেক্টরে একজন কমান্ডার ও একজন রাজনৈতিক কমিশনারের অধীনে এক গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করতেন। সেক্টরগুলোর মধ্যে কীর্ত্তিপাশার কমান্ডার ছিলেন ভবরঞ্জন, রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন  জাহাঙ্গীর কবির; শতদশকাঠীর কমান্ডার ছিলেন মনসুর ও রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন সেলিম ওরফে হিরু, আটঘরের কমান্ডার ছিলে রণজিৎ ও রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন  খুরশিদ আলম খসরু।  বাউকাঠী সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন আনিস ও রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন আসাদ, পশ্চিম জলাবাড়ির কমান্ডার ছিলেন শ্যামল ও রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন ফকু চৌধুরী, পূর্ব  জলাবাড়ির কমান্ডার ছিলেন শাহজাহান ও রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন মান্নান। 

পেয়ারা বাগানে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ৭ মে ঝালকাঠীর হেমানন্দকাঠীতে পাকিস্তানি লঞ্চে আক্রমণ। এই যুদ্ধে ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিলো। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ছিল ২৫ মে বরিশালের বানারীপাড়া থানা আক্রমণ। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত- মধ্যবর্তী  এক মাসে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পেয়ারা বাগানের ৭২ বর্গ মাইল এলাকা মুক্ত করেছিলেন।

একাধিক যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী পেয়ারা বাগানের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত অবস্থান বুঝতে পেরে পেয়ারা বাগানের চতুর্দিকে এক ব্রিগেড সেনা মোতায়েন করে। ছারছীনা পীর আবু সালেহ তার মাদ্রাসার ছাত্রদের পেয়ারা বাগান কাটার নির্দেশ দেন।  একইসঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার লোক ধরে এনে পেয়ারা বাগান কাটা শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা কুড়িয়ানা- গাবখান- বাউকাঠী ও সন্ধ্যা নদীতে ৩৫টি স্পিডবোট ও দুটি গানবোট সহযোগে  নিশ্ছিদ্র  টহল বসায়।  

পাকিস্তানি সেনাদের সার্বক্ষণিক নজরদারীর মাঝেই ৫ জুন রাতে খরস্রোতা সন্ধ্যা নদী পেরোনোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭১ এ পেয়ারা বাগান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেশব্যাপী ৫টি ফ্রন্ট এরিয়া ও দুটি আঞ্চলিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলো পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী। বাহিনীর ১ নম্বর ফ্রন্ট এরিয়া ছিল পেয়ারাবাগান।  বাহিনীর ২ নম্বর ফ্রন্ট এরিয়া ছিল বরিশালের উত্তরাঞ্চলে। রামকৃষ্ণ পাল ও খুরশিদ আলম খসরুর নেতৃত্বে বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালের গৌরনদী থানা সহ বাবুগঞ্জ, মুলাদি, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, বামনা, গলাচিপা; মাদারীপুরের সদর, কালকিনি, পালং, শরীয়তপুরের নড়িয়া, জাজিরা  অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন।  বাহিনীর  ৩ নম্বর ফ্রন্ট এরিয়া ছিল ভোলাতে। এই ফ্রন্টে বাহিনীর রাজনৈতিক কমিশনার ও কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে জিয়াউল কুদ্দুস ও লাল গাজী। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ৩ নম্বর ফ্রন্টের মুক্তিযোদ্ধারা লালমোহন থানা ও চরফ্যাশন থানা আক্রমণ করে দখলে নেন। 

এই ফ্রন্টের অন্যতম যুদ্ধ ছিল  ১৬ অক্টোবরের ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা’র যুদ্ধ। এই যুদ্ধে স্থানীয় সিদ্দিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ৫ ঘণ্টাব্যাপী চলা দেউলার যুদ্ধে নিহত হয়েছিলো অন্তত ২৯ জন পাকিস্তানি সেনা ও থানার ওসি সহ ২ জন পুলিশ। মুন্সিগঞ্জকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলো  ৪ নম্বর ফ্রন্ট এরিয়া। মে মাসের শেষদিকে শাহজাহান তালুকদারের নেতৃত্বে লৌহজংয়ে পাকিস্তানি দালাল উচ্ছেদের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। ৫ নম্বর ফ্রন্ট ছিল পাবনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের বেশ কয়েকটি থানা জুড়ে। এই অঞ্চলে বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক থানায় অপারেশন চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মাদারিপুর,  সাভার ও মানিকগঞ্জে বাহিনীর দুটি পৃথক ফ্রন্ট এরিয়া ছিল। অন্যদিকে সাভার ও মানিকগঞ্জ জুড়ে গঠিত হয়েছিলো বাহিনীর সাভার ফ্রন্ট এরিয়া। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সমগ্র দেশব্যাপী শতাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।…

আহমাদ ইশতিয়াক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক। ইমেইল: ahmadistiak1952@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •