বাংলাদেশের জাতিগত সংকটের কারণ ও সমাধানের পথ-২

বাংলাদেশের জাতিগত সংকটের কারণ ও সমাধানের পথ-২

আন্তনী রেমা

পাহাড় ও সমতলের জাতিগত সংকটের কারণ, স্বরূপ এবং সমাধানের পথ নিয়ে সর্বজনকথা সেমিনারে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। লেখাটি উপরোক্ত বিষয়ে উপস্থাপিত বক্তব্যের লিখিত ও পরিমার্জিত রূপ।

আমার ধারণা এখানে নৃবিজ্ঞানের অনেকেই আছেন। গারো ইতিহাসের ব্যাপারে ওনারা হয়তো-বা অনেক বেশিই জানবেন। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কথা আমরা জানি এবং এই ভূখণ্ডের মধ্যে প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা যে সংগ্রাম করেছিলেন সেই কথা হয়তো আমরা জানি। পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিটি আদিবাসী অঞ্চলেই ব্রিটিশদের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে বা সংগ্রাম ছিল সেখানে। যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমাদের ইতিহাস বলছে আমরা নয়-নয়বার সম্মুখযুদ্ধ করেছিলাম ব্রিটিশদের সঙ্গে।

গারোদের ওরাল একটা মিথ দিয়ে আমি শুরু করতে চাই। আমরা আজ এখন যেখানে অবস্থান করছি, ঢাকা। এই ‘ঢাকা’ শব্দটা আসলে কীভাবে আসছে? এর হয়তো অনেক ইতিহাস থাকতে পারে, কিন্তু গারোদের একটা ওরাল মিথ আছে। সেটা হচ্ছে, কোনো এক সময় এদিক দিয়ে এক রাজা যাচ্ছিলেন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এবং তখন এটা শালবন ছিল। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার কারণে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ এখানে অবস্থান করবেন। নতুন জায়গা, সে হিসেবে রাজা জানেন না যে এই জায়গার নাম কী। তখন ওনার যে সৈন্যসামন্ত বা লোকবল ছিল ওনাদের বললেন যে, যাও একটু খুঁজে দ্যাখ আশপাশে কোনো মানুষ আছে কি না। একটু জিজ্ঞেস করে দ্যাখ এই জায়গাটার নাম কী। এবং অন্যদের উনি নির্দেশ দিলেন তাঁবু টানানো, রান্নাবান্না এই সমস্ত কাজের। এক গারো নারীর সঙ্গে ওনাদের দেখা হয়েছিল এবং জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা এই জায়গাটার নাম কী? তো স্বাভাবিকভাবেই গারো নারী ওনাদের ভাষা জানেন না। উনি মনে করেছেন যে ওনার জুম-যে চাষ, ঢাকা শহরের এই অঞ্চল, মধুপুরের অঞ্চলে, ১৯৫০ সালে আইন করে জুম চাষ বন্ধ করে দেওয়ার আগপর্যন্ত আমরা জুম চাষই করতাম। তিনি মনে করেছিলেন জুমের পাশে হয়তো হাতি-ঘোড়াগুলো বাঁধতে চাইছিলেন! তিনি তখন নাকি বলেছিলেন, ‘দাখা, দাখা’। মানে এখানে বাঁধা যাবে না। ওনারা মনে করেছেন ঐ নারী জায়গার নামই বলছেন–দাখা। পরবর্তী সময়ে ওনারা রাজাকে গিয়ে বললেন, এই জায়গার নাম হচ্ছে ‘দাখা’। যেটা পরবর্তী সময়ে ‘ঢাকা’ হয়েছে।

এই ভূখণ্ডের মধ্যে প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা যে সংগ্রাম করেছিলেন সেই কথা হয়তো আমরা জানি। পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিটি আদিবাসী অঞ্চলেই ব্রিটিশদের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে বা সংগ্রাম ছিল সেখানে। যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমাদের ইতিহাস বলছে আমরা নয়-নয়বার সম্মুখযুদ্ধ করেছিলাম ব্রিটিশদের সঙ্গে।

এটা যদিও ওরাল মিথ, কিন্তু ইতিহাসও বলছে যে, এই ঢাকা শহরে নীলক্ষেত, গাজীপুর, নরসিংদী–এই অঞ্চলগুলোতে আমাদের একসময় বসবাস ছিল। কিন্তু এখন কেন নাই? নানা কারণেই হচ্ছে যে, প্রান্তিক হতে হতে এখন মধুপুরের একটা জায়গায় গিয়ে আমরা ঠেকেছি। গাজীপুরে অল্প কিছু এখনো গারো আছে। এই আন্দোলনেও আমরা বারবার বলছি যে, আমরা সংবিধানে সংযুক্তির কথা বলে আসছি। এখন যারা সংবিধানে সংযুক্ত হতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নাকি যারা সংযুক্ত হতে দিচ্ছে না তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী? এই প্রশ্নটি করছি।

আমরা সংবিধানে সংযুক্তির কথা বলে আসছি। এখন যারা সংবিধানে সংযুক্ত হতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নাকি যারা সংযুক্ত হতে দিচ্ছে না তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী? এই প্রশ্নটি করছি।

একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যদিও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছিল, কিন্তু গারোসহ অন্য আদিবাসীরা কিন্তু বাঙালিদের মুক্তির মাধ্যমেই নিজেদের মুক্তির একটি স্বপ্ন দেখেছিল। যে কারণে বাঙালিদের পাশাপাশি, বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই সময় আদিবাসীরাও সমান তালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এবং শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নয়, আপনারা জানেন যে অনেকেই ট্রেনিং করেছে মধুপুর জঙ্গলে।

প্রয়াত পঙ্কজ ভট্টাচার্য, নিজেও বলেছেন যে, সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছেন। সেই ট্রেনিং নেওয়ার সময় এগিয়ে এসেছেন আদিবাসীরাও। এখন যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা বাঙালিদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ’৭২-এ আমরা প্রথমবারের মতো এই বাংলাদেশে প্রতারিত হলাম। আমার উঠানে বসে যে সংবিধান লেখা হয়েছিল ’৭২ সালে, সেই সংবিধানে আমাকে স্বীকার করা হলো না। সেই সংবিধানে আমার স্থান হয়নি। এখন ঠিক তেমনিভাবে দেখেন আজ ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমার কিন্তু আসলে জায়গা হচ্ছে না। আমার জায়গা যতটুকু হচ্ছিল পাঠ্যবইয়ে, সেটুকুও মুছে ফেলার জন্য সন্ত্রাসীর দল হমুকি দিল, পাঠ্যপুস্তক থেকে পরবর্তী সময়ে আমাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা অনেকখানি এ রকম যে, এনসিটিবি হয়তো ওয়েটই করছিল যে, ওনারা আসবে আর আমরা বাদ দিয়ে দেব।

যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা বাঙালিদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ’৭২-এ আমরা প্রথমবারের মতো এই বাংলাদেশে প্রতারিত হলাম। আমার উঠানে বসে যে সংবিধান লেখা হয়েছিল ’৭২ সালে, সেই সংবিধানে আমাকে স্বীকার করা হলো না। সেই সংবিধানে আমার স্থান হয়নি। এখন ঠিক তেমনিভাবে দেখেন আজ ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমার কিন্তু আসলে জায়গা হচ্ছে না।

এটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেদিন কোথাও পুলিশ দেখি নাই। আমরা যখন মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন এমন একটি জায়গায় আটকানো হয়েছে, মেট্রোরেল স্টেশনের একদম নিচে, যেখানে পেটানোটা অনেক বেশি সহজ হবে, মানে বাইরের মানুষজন খুব বেশি দেখবে না। পুলিশ, অল্প কিছু পুলিশ এবং তাদের লোকজন সেখানে ছিল। পুলিশ দুই দলকে সামনাসামনি না করে আলাদা করতে চাইলেই করতে পারত। পুলিশের উপস্থিতিতেই সেখানে হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো আপনারাও ফুটেজ দেখেছেন, হয়তো-বা পত্র-পত্রিকায় পড়েছেন।

বাংলাদেশে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরাই বসবাস করে না। সেখানে ১১টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, বাংলাদেশে ৫০-এর বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আছে, ৩৯টির বেশি জাতিগোষ্ঠী সমতল এলাকায় বসবাস করে যারা আদিবাসীদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। পাহাড়ের সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়ে আদিবাসীদের সমস্যাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে, তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানোর একটা পাঁয়তারা চলছে।

বাংলাদেশে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরাই বসবাস করে না। সেখানে ১১টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, বাংলাদেশে ৫০-এর বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আছে, ৩৯টির বেশি জাতিগোষ্ঠী সমতল এলাকায় বসবাস করে যারা আদিবাসীদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। পাহাড়ের সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়ে আদিবাসীদের সমস্যাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে, তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানোর একটা পাঁয়তারা চলছে। রেং বলেছেন যে, আসলে মুক্তির পথ শেষ পর্যন্ত বহু ভাষা এবং বৈচিত্র্যের যে মানুষ আমরা বসবাস করি বাঙালি ভিন্ন, তাদেরকে স্বীকার করে নেওয়া, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি–এগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগগুলো নেওয়া। আমরা যদি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের কথা বলি, বাংলাভিন্ন দেশের বাইরের ভাষাগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কাজ আমরা দেখতে পাইনি। সবশেষে বলি, রেং অনেকখানি বলেছেন, বৈচিত্র্য সুন্দর, এই সৌন্দর্যকে দেখতে একটা সুন্দর চোখ লাগে। তো আমি আহ্বান রাখব বাংলাদেশের সকল মানুষের সেই সৌন্দর্য দেখার সুন্দর চোখ হোক।

অনুলিখন: নিশাত তাসনিম

আন্তনী রেমা: শিল্পী, মাদল

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •