সব নারী ও কন্যার জন্য অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন: সম্ভব?
সামিনা লুৎফা

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান ছিল ‘সব নারী ও কন্যার জন্য অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা’। যা করতে হলে ইউএনউইমেন (২০২৪)-এর মতে, প্রথমত, অধিকার অর্জনের জন্য সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য এবং শোষণকে চ্যালেঞ্জ করে নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতির পক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমতা আনতে হলে প্রতিটি দেশকে নিশ্চিত করতে হবে যে অন্তর্ভুক্তি এবং ক্ষমতায়নের পথের পদ্ধতিগত বাধা এবং পিতৃতন্ত্রকে নির্মূল করা হবে। বৈষম্য দূর করা হবে এবং তরুণ ও প্রান্তিক নারী ও কন্যাশিশুদের কথা বলার ক্ষেত্র তৈরিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তৃতীয়ত, ক্ষমতায়নের মূলসূত্র হবে ক্ষমতা কাঠামোকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা যেন শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অভিগম্যতা নিশ্চিত হয়। তরুণ নারী এবং কন্যাশিশুদের নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনের সুযোগগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈশ্বিক এই তিন লক্ষ্য পূরণে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের যাত্রা কেমন হবে তা চিহ্নিত করতে আমাদের শুরুতেই জেনে নেওয়া দরকার যে এখন লিঙ্গভিত্তিক অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নে আমরা বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে কোন অবস্থানে আছি। এই প্রবন্ধে এই বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সে (বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, ২০২৪) প্রথম স্থানে আছে বাংলাদেশ। অথচ সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, সহিংসতা এবং শোষণ শেষ তো হয়ইনি বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। বৈশ্বিক বিচারে ১৪৬টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ৯৯তম, যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ ধাপ নেমে গিয়েছে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি, প্রথমত, ২০১৪ সালের পর ২০২৪-এ আমাদের লিঙ্গভিত্তিক অর্থনৈতিক সমতা স্কোর বাংলাদেশের অর্জন সর্বনিম্ন, যা বলে দেয় যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতার চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নারীর অগ্রগতিকে থমকে দিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলবে। একই সূত্র থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে পুরুষ ও নারীর মধ্যে আয়বৈষম্য প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে এবং বেকারদের মধ্যে নারীর শতকরা হার পুরুষদের প্রায় দ্বিগুণ। তৃতীয়ত, জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকায় নারীর প্রতিনিধিত্বও হ্রাস পেয়েছে। সর্বোচ্চ দায়িত্বে লম্বা সময় ধরে নারীরা থাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে আসা নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিদর্শন প্রচুর। এ ছাড়া প্রতি নয়জন পুরুষের বিপরীতে শুধু একজন নারী মন্ত্রী ছিলেন ২০২৪-এ। ২০২৫ এসে এটি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংসদ না থাকায় রাজনীতিতে নারীর অভিগম্যতার কোনো সূচক পাওয়া যাবে না, যা আমাদের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে বাধা দেবে। চতুর্থত, ২০২৪ সালে পেশাদার এবং প্রযুক্তিকর্মীদের মধ্যে নারীদের অন্তর্ভুক্তি মাত্র এক-পঞ্চমাংশ, যা আশঙ্কাজনক। সবশেষে দেখি, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুবিধালাভের দিক থেকে আমাদের দেশ নারী-পুরুষের সমতার সূচকে বিশ্বে ১৪৬তম, শিক্ষাগত অর্জনে ১২৫তম, স্বাস্থ্য ও জীবনের ক্ষেত্রে ১২৯তম হয়ে লিঙ্গভিত্তিক সমতা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে পুরুষ ও নারীর মধ্যে আয়বৈষম্য প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে এবং বেকারদের মধ্যে নারীর শতকরা হার পুরুষদের প্রায় দ্বিগুণ। তৃতীয়ত, জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকায় নারীর প্রতিনিধিত্বও হ্রাস পেয়েছে।
এবার দেখা যাক দেশের ভেতরে কী ঘটছে! গত নভেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরের বরাতে নাজনীন আখতার জানাচ্ছেন যে ২০২৪-এর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে (প্রথম আলো, ৯ নভেম্বর ২০২৪)। এসব মামলার অর্ধেক ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে (ধর্ষণের অভিযোগে ৪ হাজার ৩৩২টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১ হাজার ৮৭০টি) করা হয়েছে। আর যেসব কারণের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে যৌতুকের জন্য নির্যাতন (৩ হাজার ২০৮টি), দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ (৪৭টি), অপহরণ (৩ হাজার ২৮৭) এবং শিশু পণবন্দি করা (২৫টি) রয়েছে। আর অন্য আরেক গবেষণা থেকে জানতে পারি যে বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার নারীদের মাত্র শতকরা ১ ভাগ পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে যান। অভিযোগ না জানানোর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক কলঙ্কিতকরণের প্রয়াস, পারিবারিক বাধা ইত্যাদি।
২০২৪-এর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে।
একটি সংবাদ প্রতিবেদন বলছে, স্বামীর হাতে হওয়া নির্যাতন ও হত্যার তথ্য অনেক কম জানা যায়। তথ্য পাওয়া যায়নি মানে কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতার হার গত কয়েক মাসে কমেছে এমন না, বরং ভবিষ্যতে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু নারীরা এখন লেখাপড়া করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইছে, বা অধিকার ও মতামত প্রকাশে সচেতন হয়ে উঠছে, কাজেই যারা আওয়াজ তুলছে তারা নারীর ‘ঐতিহ্যবাহী নিঃশব্দ’ ভূমিকার কর্তাসত্তাহীন উদ্যাপনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তাদের এসব আওয়াজ এবং স্বাধীনতা পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বলে পুরুষরা ‘ক্ষমতা হারানোর’ শঙ্কায় সহিংসতা চালাচ্ছে, যা নারীর অবাধ চলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ করছে; নারীর জীবন ও জবানকে বেঁধে ফেলছে ভয়ের সংস্কৃতির শেকলে।
আর নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুঁজির মালিক সস্তায় নতুন শ্রমিক জন্ম দেওয়া, পুরোনো শ্রমিকের কাজের ভার নারীর দেহের ওপর ন্যস্ত রাখা বা নারীকেই সস্তা শ্রমিক বানিয়ে পুঁজি শোষণের মূল ব্যবস্থা চালু রাখে। সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন, যা আবার প্রান্তিক ও সস্তা শ্রমিকের শ্রম-ঘাম শোষণ করে টিকে থাকে। ফলে নারীর দেহ মালিকের কবজায় থাকে, নারীর নিজ স্বর সে নিজেই শুনতে ভুলে যায়। পিতৃতন্ত্র আর পুঁজিবাদ মিলেমিশে নারীকে এক ভোগযোগ্য, সস্তায় শ্রম উৎপাদনে পারদর্শী বস্তু বা পণ্য বা সম্পত্তি হিসেবে দেখে বলে নারী তার নিজের আওয়াজ ওঠাতে পারে না, ভগিনীরা জেগে ওঠে না। আর শ্রমিক নন এমন নারীদের কেউ কেউ মূল্যবোধের দাপটে শৃঙ্খলে মর্যাদা দেখেন এবং দরিদ্র নারীর চেয়ে বেশি অধিকারের মায়ায় মজে থাকেন বলে পুরুষ দুনিয়ার নারীবিদ্বেষ তার নিজের দোষে প্রাপ্ত শাস্তি বলে মনে হয়। নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাই, নীতি নির্ধারণে তার আওয়াজ ক্ষীণ, নির্ধারকের টেবিলে তাকে জায়গা দেওয়া হয় না আর জায়গা নিতে পুরুষালি ধাক্কধাক্কিতে যেতে গেলে তাকে গাল খেতে হয় সহজলভ্য ‘পতিতা’ বলে, বা শিকার হতে হয় ভাষিক বা শারীরিক যৌন নিপীড়নের।
নির্যাতনের শিকার নন এমন নারীরাও এ দেশে নানা বৈষম্যের শিকার হন। শ্রমবাজারে নারীর বাঁধভাঙা অংশগ্রহণ সত্ত্বেও পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে আটক সাধারণ ও প্রান্তিক নারীরা এখনো বাল্যবিবাহের শিকার হন, পড়াশোনা শেষ না করেই বাধ্য হয়ে শ্রমবাজার থেকে ছিটকে যান, সম্পত্তির সমান হিস্যা পান না, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমকাজে সমবেতন নেই, প্রশিক্ষণ বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নাম থাকে তালিকার নিচে। গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা, সমতার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ও সন্তানের অভিভাবকত্বও পান না, অথচ শিকার হন লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজনের, পরিবারে বা কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবেও তাদের হক সামান্যই অর্জিত হয়েছে। যে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তারও ঘরের কাজ পেছন ছাড়ে না কখনোই! সঙ্গে যুক্ত হয় কলঙ্কিতকরণের এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক প্রবণতা – আমাদের প্রচলিত বয়ানে নারী হিজাব পরলে হয় ‘জঙ্গি’ আর ওড়না না পরলে হয় ‘খারাপ মেয়ে’। পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্রে নানান পুংব্যাখ্যা এমনকি কর্মঠ, উদ্যমী, নিজের-পায়ে-দাঁড়ানো নারীর কর্তাসত্তাকেও নাকচ করে টিকে থাকে।
অথচ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এ দেশের নানাবিধ আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাসও নতুন নয়। গত শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই নারী শিক্ষার আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা যেমন আমরা জানি, তেমনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামী প্রীতিলতার উদাহরণও আমাদের আছে। পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই ভাষার জন্য লড়াইয়ে লিলি খান বা তেভাগা বিদ্রোহের ইলা মিত্র বা হাজারো সান্তাল চাষি বা ফুলবাড়ীর আন্দোলনকারীদের মতো পূর্ব-নারীদের নাম আমাদের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার লড়াইয়েও বাংলার নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশে বরং তাদের উপস্থিতি অনেক বছর পর্যন্ত ম্লানতর। তবে সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে আশির দশকে বাংলাদেশে দেখা দেয় নারী আন্দোলনের নানান উপাদান ও উপকরণ। এর মধ্যে যেমন আছে বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর বেসরকারি সংস্থার ‘নারী উন্নয়ন’ তেমনি আছে কৃষি বা কারখানা শ্রমিক নারীর বাঁচার লড়াই। এর মধ্যে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি মানতে বিগত সরকার সরকারি চাকরিতে নারীর জন্য কোটা শূন্যে নামিয়ে এনেছে, যা প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের ভয়াবহ বৈষম্যের ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করবে।
এরমধ্যে আসে জুলাই অভ্যুত্থান, যা ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত এ বর্ষা-জাগরণকালে নারী, ভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তা এবং প্রান্তিক বা নন-বাইনারি লিঙ্গপরিচয়ের মানুষসহ সব ধরনের জনগণের আমরা জোরালো ভূমিকা দেখেছি। দেখেছি কী করে অধিকার আদায়ে দিন-রাত এক করে দিনের পর দিন নারী শিক্ষার্থীরা সমান তালে রাস্তায় থেকেছে, রাতের বেলা হলের তালা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আটক হওয়া ভাই-বন্ধুদের, হাত দিয়ে পথরোধ করেছে পুলিশের ট্রাকের, প্রিজন ভ্যানের, শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে হাজির হয়েছে থানায়, ডিবি অফিসে, খাবার পানি নিয়ে হাজির হয়েছেন পথের মোড়ে, সন্তানের হাত ধরে হাজির হয়েছেন খুনির বিচার চাইতে রাস্তায়। কৌশলগত কারণে যে কোনো আন্দোলনের সামনের সারিতে নারীদের রাখলে পুলিশি বা মাস্তানি আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে বলে নারীদের মিছিলের সামনে দেওয়ার রেওয়াজ বহু পুরোনো! আবার কোনো কারণে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে নারী আক্রান্ত হলে তা ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরিতেও কাজে লাগানো যায় – কাজেই আন্দোলনে-মিছিলে নারীকে এগিয়ে দেওয়া আন্দোলনের জন্য কৌশলগত কারণে খুবই উপযোগী। তবে তা নারীর জন্য ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কাকে সামনে আনে, আবার সে সহিংসতা লোকচক্ষুর আড়াল হতে বেশি সময় লাগে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত এ বর্ষা-জাগরণকালে নারী, ভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তা এবং প্রান্তিক বা নন-বাইনারি লিঙ্গপরিচয়ের মানুষসহ সব ধরনের জনগণের আমরা জোরালো ভূমিকা দেখেছি। দেখেছি কী করে অধিকার আদায়ে দিন-রাত এক করে দিনের পর দিন নারী শিক্ষার্থীরা সমান তালে রাস্তায় থেকেছে, রাতের বেলা হলের তালা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আটক হওয়া ভাই-বন্ধুদের, হাত দিয়ে পথরোধ করেছে পুলিশের ট্রাকের, প্রিজন ভ্যানের, শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে হাজির হয়েছে থানায়, ডিবি অফিসে, খাবার পানি নিয়ে হাজির হয়েছেন পথের মোড়ে, সন্তানের হাত ধরে হাজির হয়েছেন খুনির বিচার চাইতে রাস্তায়।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীর ওপর আক্রমণ হলে তা কেবল শারীরিক নিপীড়নের মধ্যে বাঁধা থাকে না, এসব আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নারীর শরীরও হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী প্রতিপক্ষের দ্বারা বাচিক ও শারীরিক যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার সর্বোচ্চ আশঙ্কায় থাকে। যৌন নিপীড়নের অভিঘাত বড় গভীর এবং ভিন্ন। এরকম নিপীড়নের আশঙ্কাও অনেক নারীকে জনপরিসরে যেতে বাধা দেয়। আর অভ্যুত্থানের পর, নেতৃত্বে থাকা নারীদের বিরুদ্ধে নতুন করে শুরু হওয়া সাইবার অপরাধ লড়াকু মেয়েদের কুঁকড়ে দেয় – ঘৃণা জাগে এ ব্যবস্থার প্রতি, যা নারীকে এতই প্রান্তিক করে রাখে। এ ছাড়াও ৩৬ জুলাই-এর পর নারীর সেই অবদানকে খুব বেশি উদ্যাপন করতে আমরা দেখিনি। উল্টো আমরা দেখেছি, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, জাতিগত বা ধর্মের বিভিন্ন ফেরকার তফাতকে সামনে এনে তাদের বিরুদ্ধে একরকমের সংঘবদ্ধ সহিংসতা চলেছে দেশজুড়ে।
আমরা যেন এক নতুন ইউটোপিয়ায় প্রবেশ করেছি ৩৬ জুলাইয়ের পর। এ এক নতুন কল্পজগৎ, যেখানে বৈষম্যহীনতা আর অন্তর্ভুক্তির নামে সমাজের উদ্যাপনে দেখি নারী ও প্রান্তিক পরিচয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে নতুন এক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী পুরুষালি আস্ফালন। উদ্যাপন নামের আস্ফালনে নারী রয়ে যায় অন্ত্যজ, তার বিরুদ্ধে অস্ত্রে দেওয়া হয় যেন নতুন শান, যৌন ও গৃহস্থালি নিপীড়ন, চরিত্র হনন, কালিমালেপন থেকে শুরু করে ধর্ষণ, হত্যা, অপরাধের জায়েজিকরণ চলেছে সমানতালে। অভ্যুত্থানের পর আমরা নারীদের একটা অধস্তন জায়গায় দেখলাম; যেন-বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে তাদের কথা বা অবদান উল্লিখিত হয়। অথচ তারা আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে, চরম সাহসিকতায় রুখে দাঁড়িয়েছেন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ছিলেন বহু সংগঠিতকরণের মূল চিন্তক এবং কর্তা। অথচ, আন্দোলনের পর নারীদের মুখগুলো কোথাও যেন হারিয়ে গেল। সব মঞ্চে পুরুষের প্রবল উপস্থিতি ও ধমকে, রাজনীতির মাঠে হিস্যা দাবি করার ধাক্কাধাক্কিতে ‘পেরে না-ওঠা’ নারীর জন্য বরাদ্দ হলো আলংকারিক উপস্থিতি, রাজনীতির নেতৃত্বে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের আলাপে তাকে ব্রাত্য করা হলো। জুলাইয়ের নারীরা যেন স্বৈরাচারকে তাড়িয়ে আবার ফিরে গিয়েছে আড়ালে। আমরা তাদের স্বর শুনিনি বা নারী সমন্বয়কারীদের তেমন দেখতেও পাইনি। মনে করে, জোর করে করে তাদের কথা আলাদা করে বলতে হয়, চিত্রসাংবাদিকের ধরা ফ্রেমেও নারী সমন্বয়কদের উপস্থিতি কম দেখা যায়।
আমরা যেন এক নতুন ইউটোপিয়ায় প্রবেশ করেছি ৩৬ জুলাইয়ের পর। এ এক নতুন কল্পজগৎ, যেখানে বৈষম্যহীনতা আর অন্তর্ভুক্তির নামে সমাজের উদ্যাপনে দেখি নারী ও প্রান্তিক পরিচয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে নতুন এক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী পুরুষালি আস্ফালন। উদ্যাপন নামের আস্ফালনে নারী রয়ে যায় অন্ত্যজ, তার বিরুদ্ধে অস্ত্রে দেওয়া হয় যেন নতুন শান, যৌন ও গৃহস্থালি নিপীড়ন, চরিত্র হনন, কালিমালেপন থেকে শুরু করে ধর্ষণ, হত্যা, অপরাধের জায়েজিকরণ চলেছে সমানতালে।
কারণ? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কর্মজীবী নারীর জীবন কাটে দ্বিগুণ বোঝা বয়ে; গৃহস্থালি কাজের বোঝা আর ক্যারিয়ার ঠিক রাখার বোঝা। এর সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার বোঝা যোগ হওয়ার আগেই সে তার নিজের জগতে ফেরত যায় যাতে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির জগতে তার পতন না হয়। কারণ, সে যদি টিকেও থাকে রাজনীতির ময়দানে, সে সাইবার বুলিংসহ আরও অজস্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তখন তার পরিবার তাকে এসবে জড়াতে বাধা দেয়। এ ক্ষেত্রে নারীর সামনে প্রধান বাধা হচ্ছে পুরুষালি ধাক্কাধাক্কিমূলক রাজনীতির সংস্কৃতি। তবু যেন নারীদের অদম্য স্পৃহা কমে না। আহত-নিহতের তালিকা তৈরি বা তাদের জন্য হাসপাতালের সহায়তা দিতে অন্য আরেক দল মানুষ নিরলস স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন যাদের মধ্যেও নারীদের অংশ কম নয়। তবু ঢাকাসহ দেশের নানান অঞ্চলে নারীর ওপর, তার চলাচল ও পোশাকের স্বাধীনতার ওপর অন্যায় আক্রমণের প্রতিটি ঘটনা নারীসহ প্রান্তিক লিঙ্গপরিচয়ের মানুষকে অনেক বেশি ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলেছে। আইনের শাসনের অভাব যে ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ফলে নানান তরিকার মানুষের নানা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ আদায়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠার বিশৃঙ্খলা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য বিপজ্জনক, তবে তা নারী ও প্রান্তিকদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। আর যেন কোনো প্রান্তিক মানুষ ক্ষতির শিকার না হয় তার জন্য কাজ করা ‘নারী অধিকারের রাজনীতি’র প্রধান কাজ।
২০২৫-এর নারী দিবসের প্রতিজ্ঞা তবে কী হবে? এত বাধা নারী অতিক্রম করবে কী করে? এসব নিপীড়ন আর সহিংসতার বৃত্ত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? ডিজিটাল বিপ্লবে নারীর অভিগম্যতা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, সহিংসতার অবসান ঘটানো, সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক অংশ ভাগ করা, শান্তি বজায় রাখা এবং পরিবেশগত ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা – বাংলাদেশ সরকারের মূল কাজ হবে এগুলো নিশ্চিত করা।
সেইসঙ্গে আরেকটু এগিয়ে যুক্ত করতে চাই,
প্রথমত, নারী ও প্রান্তিকের স্বরকে হাওয়া করে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে সারাক্ষণ উচ্চকিত থাকতে হবে, সব বয়ান তৈরিতে প্রান্তিক স্বরের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের সাফল্য, অর্জন ও অংশগ্রহণকে উদ্যাপন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতৃত্বে, মনোনয়নে ও প্রতিনিধিত্বে নারী ও প্রান্তিকের উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। আগামী এক বছরে যেসব রাজনৈতিক দল তাদের নারী নেতৃত্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবে তারা যেন জেনে রাখে যে আগামী নির্বাচনে নারী ভোটারদের তারা পাশে পাবে না। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন করতে হবে, ক্রমান্বয়ে নারী সাংসদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জনসংখ্যায় নারীর অনুপাতে সংসদে নারী সদস্যদের নির্বাচিত করে আনা গেলে কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, সরকারকে সব লিঙ্গপরিচয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শিক্ষালয়, রাস্তা, জনপরিসর তৈরি করায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কোনো নিপীড়ন, বিশেষত যৌন নিপীড়ন মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন করতে হবে, ইতোমধ্যে হওয়া মামলার দ্রুত শুনানি ও বিচার করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক কোনো ধারা অটুট রাখা যাবে না। স্বাধীন কমিশন গঠন করে সাইবার জগতে নারীকে সুরক্ষা দিতে হবে।
চতুর্থত, মজুরি, পদমর্যাদা এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে হবে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, যাতায়াত ও জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষেত্রে ও আবাসিক এলাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, জাদুঘর ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠকরাও মানবেন যে নারীর ব্রাত্য হয়ে থাকার অনেক ঘুপচি এখনো রয়ে গেছে, যার কারণে বড় পদে তাদের প্রবেশ এখনো বাধাহীন নয়। কাজেই ইতিবাচকভাবে তাদের উপস্থিতিকে উৎসাহিত করার দরকার যেমন আছে, তেমনি রয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, দ্বিভাজিত লিঙ্গপরিচয়ের বাইরের মানুষ, যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জাতিগত পরিচয়ের মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজন।
পঞ্চমত, পারিবারিক সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের সমানাধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ এবং অভিভাবকত্ব ও লালনপালনে সমান অধিকার ও দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ষষ্ঠত, নারীর নিজের শরীর, জীবন, জীবিকা নির্বাচনে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাধা অপসারণ করতে হবে। শিশুবয়স থেকে সমতার ধারণা পারিবারিক ও বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শেখাতে হবে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করে মেয়েশিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।
সপ্তমত, শিক্ষায় নারীর ভালো ফল কেন কর্মক্ষেত্রে তার অর্জনে এবং পদোন্নতিতে প্রতিফলিত হয় না, শিক্ষিত নারী কেন কর্মক্ষেত্রে ঝরে যায়, তার অনুসন্ধান ও সমাধানে কাজ করতে হবে।
অষ্টমত, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যেন নারীর জন্য প্রতিবেশ নিরাপদ আর মর্যাদাপূর্ণ হয়।
নবমত, নারীর জন্য সরকার পরিচালনের বাজেট পৃথকভাবে বরাদ্দ করতে হবে এবং সম্পত্তি ও সম্পদে (উত্তরাধিকারসূত্রে এবং স্বোপার্জিত) নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বাধা অপসারণে কাজ করতে হবে সরকারকে। ব্যবসায় নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি, সরকারি চাকরিতে তাদের শতকরা হার বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ, যা অর্জন ছাড়া আগামী এক বছর নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অর্ধেক হয়ে থাকবে। সবশেষে, এমন কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করা যাবে না যা পরিবেশ ও প্রকৃতি, বন-সবুজ পরিসরকে সংকুচিত করে, শিশুদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে ও নারীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে মূল অংশীজনদের বাদ রেখে অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ, গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করার পূর্বশর্ত সমান মর্যাদা, ইনসাফ এবং বহুস্বরিক রাজনৈতিক পরিসর নিশ্চিত করা। কাজেই ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি ইত্যাদি নির্বিশেষে সব নাগরিকের সহাবস্থান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমান মর্যাদা, ইনসাফ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই জুলাই অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা, যা পূরণ করলেই নারীর সামনে হাজির পুরুষালি এবং একনায়কতান্ত্রিক ধমকওয়ালারা থামতে বাধ্য হবে। নারী, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের যাত্রা অবাধ হবে।
ডক্টর সামিনা লুৎফা: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয। ইমেইল: samina.luthfa@du.ac.bd
তথ্যসূত্র
ইউ এন উইমেন [UN Women. 2024. Equal is Greater: Time to Act for Gender Equality, Women Empowerment and Rights].
ইসলাম, তাহসিনা। ২০২৪। ‘স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যায় মামলার সংখ্যা কম কেন?’ ডয়চে ভেলে। ১২.১১.২০২৪
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম [World Economic Forum. 2024. Global Gender Gap: Insight Report 2024. Geneva, Switzerland.