মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৯
নির্বোধদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা
তারিক আলি

২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামি মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তারিক আলির বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত-পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তার ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম। এবারে নবম পর্ব। এখানে ইরান বিপ্লব ও তার আগে পরের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে।
১৯৭৩-পরবর্তী অচলাবস্থা আরও চার বছর অব্যাহত ছিল। হোয়াইট হাউসের নতুন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ফিলিস্তিনের বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উভয় পক্ষকে চাপ দিতে সক্রিয় হন। তবে তিনি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই মিশরীয় সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে পৃথক শান্তি স্থাপনের একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়: ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট সাদাত জেরুজালেমে গিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনকে প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করেন এবং একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইসরায়েল মিশরে তার অধিকৃত অঞ্চলটি ফিরিয়ে দেয় এবং দুদেশ রাষ্ট্রদূত বিনিময় করে। এ ঘটনাটিতে এক মুহূর্তের জন্য হলেও, বাকি সমস্যাগুলোর একইভাবে সমাধান হবে বলে আস্থা অনুভূত হয়েছিল। অনুগত মিশরীয় টিভি এবং রেডিওতে প্রচারিত মিথ্যায় পরিপূর্ণ প্রতিবেদন এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অথচ ইসরায়েল সবসময় স্পষ্ট ছিল যে তারা বিজিত অঞ্চলগুলোতে ইহুদি বসতি নির্মাণের নীতি বন্ধ করবে না বা স্থগিত করবে না।
সাদাতের শান্তি চুক্তির দ্বৈত উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, ইনফিতাহ (উন্মুক্ত দরজা) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাসেরবাদী অতীতের মূল নীতিগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া। দ্বিতীয়ত, পররাষ্ট্র নীতিতে নিরপেক্ষতার অবসান ঘটানো, সামরিক নির্ভরতা এবং পশ্চিমা বলয়ে পুনঃপ্রবেশ করা।
দেশের সামাজিক কাঠামোতে ইনফিতার অভ্যন্তরীণ পরিণতি বেশ ভয়ানক ছিল। পূর্বে মিশরের অধিকাংশ জনগণ বিশাল সরকারি খাত থেকে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সুরক্ষা পাচ্ছিল। এই সুরক্ষা পর্যাপ্ত না হলেও বর্তমানের অভিজ্ঞতার তুলনায় তা ভালো ছিল। নাসেরীয় আমলে সম্পদের বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তবে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতি তীব্র অসন্তোষ পুরাতন শাসন থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রধান যৌক্তিকতা হিসেবে কাজ করেছে।
সাদাত দেশের রাজনৈতিক কাঠামো উদারীকরণ না করেই অর্থনৈতিক খাতকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেন। অন্য কথায়, পণ্য যে কোনো সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল। মিশরীয় বামপন্থিরা ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ করলেও প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা দুর্বল ছিল। কালক্রমে গণতন্ত্র আসবে এই বিশ্বাসে ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থিরা এই নতুন ধারাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটেনি। বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি পুঁজির জন্য অর্থনীতি উন্মুক্তকরণ একটি তীব্র শ্রেণি মেরুকরণ তৈরি করে। কিন্তু নাসের-পরবর্তী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোতে এই উদারনীতির কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। পূর্ববর্তী শাসনামলে একইভাবে রাজনৈতিক কাঠামো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকলেও আরব সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নের মধ্যে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলো জনসংখ্যার বিভিন্ন সামাজিক স্তরে প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। এখন তারও অবসান ঘটল। সম্ভাব্য একমাত্র বিরোধিতা গোপনে কাজ করছিল।
আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এর আরও উগ্রপন্থি শাখা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তারা সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশ করেছিল। একসময় তারা শাসনের প্রতি একটি দর্শনীয় ও প্রকাশ্য শত্রুতা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইনফিতাহ এর চার বছর পর, ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর, মিশরের প্রেসিডেন্ট একটি সামরিক কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন। সেই কুচকাওয়াজের চারজন সৈন্য তাদের অস্ত্র নামিয়ে ভিআইপি পডিয়ামে মেশিনগানের গুলিতে সাদাতকে হত্যা করে। এই আক্রমণে সরকারি দলের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। অভিজাতরা এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তবে জাতি এ ব্যাপারে উদাসীন থাকে। নাসেরের জানাজার তুলনায় সাদাতের জানাজায় মানুষের কম উপস্থিতি এই বৈপরীত্য প্রকাশ করেছে স্পষ্টভাবে।
হত্যাকারীদের বিচার হয়। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপর থেকে মিশরসহ অন্যান্য অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক আয়োজনগুলোতে তাজা গোলাবারুদ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ইসলামি কার্যকলাপের তীব্র পুনরুজ্জীবনের জন্য দায়ী অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। মুবারক সাদাতের স্থলাভিষিক্ত হন। একনায়কত্ব বজায় রাখার বিনিময়ে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পরপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের ছাড় দেন। এই ছাড় ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের শক্তিশালী করতে এবং তাদের সামাজিক সমর্থনের ভিত্তি প্রসারিত করতে সাহায্য করে। তবে রাজনৈতিক-ধর্মীয় উচ্ছ্বাসের নতুন উত্থানকে অনুপ্রাণিত করার আসল ঘটনাটি ছিল আরব বিশ্বের বাইরে।
১৯৭১ সালে প্রতীকী যুদ্ধের সূচনা হচ্ছিল। কারণ, তখন জনগণ থেকে তার বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে অজ্ঞ একজন ব্যর্থ, অতি আত্মবিশ্বাসী রাজা, দেশ-বিদেশের চাটুকারদের প্রশংসায় অন্ধ হয়ে, সিসিল বি. ডি মিলকে অনুকরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মহান সাইরাস এবং ২ হাজার ৫০০ বছরের ‘ইরানি রাজত্ব’কে সম্মান জানাতে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। অবশ্য এ অনুষ্ঠানের অন্য সবকিছুর মতো জন্মদিনের তারিখটিও প্রশ্নবোধক ছিল। প্রস্তাবিত জাঁকজমকের কারণ স্পষ্ট ছিল: নিজের দাবিকৃত ‘আর্যদের আলো’– শাহের বংশগত নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করা। নির্বাচিত স্থানটি ছিল ঐতিহাসিক: প্রাচীন পারস্যের রাজধানী পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষ।
অধিকাংশ অতিথিই উপস্থিত হলেন। ইথিওপিয়া ও জাপানের সম্রাট হাইল সেলাসি এবং হিরোহিতো, বেনেলাক্স এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর কম সম্মানিত রাজারা এবং আরও কম সম্মানিত মরক্কো, জর্ডান ও নেপালের রাজারা, ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী চার্লস উইন্ডসর এবং বিভিন্ন বর্ণের রাজনীতিবিদরা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন লাজুক স্পিরো অ্যাগনিউ (বর্তমানে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং সেইসঙ্গে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ও চীনা পলিটব্যুরোর একজন সিনিয়র প্রতিনিধি। ইউরোপের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র ফরাসি নেতা পম্পিডুই অনুপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালের মে মাসে নিজের রাজধানীতে সংকট প্রত্যক্ষ করে, সম্ভবত তিনি বিশ্বব্যাপী তার প্রতিপক্ষদের তুলনায় ভবিষ্যৎকে আরও স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অসংখ্য শিক্ষাবিদ ও পর্দার তারকারা। বিশিষ্ট ব্রিটিশ রাজনৈতিক দার্শনিক স্যার ইসাইয়া বার্লিনের একটি সাহসী পুস্তিকা, ‘টু কনসেপ্টস অব লিবার্টি’, সম্প্রতি তেহরানে প্রকাশিত হয়ে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। এই বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মদিনের অনুষ্ঠানটির ব্যাপারে তেহরানে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতার জন্য ওনার সম্মানী কত ছিল তা জানানো হয়নি।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, উপস্থিত সবাই আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। প্যারিস থেকে খাবার এবং ২৫ হাজার মদের বোতল এসেছিল। মেন্যুতে একমাত্র স্থানীয় খাবার ছিল ইরানের ক্যাস্পিয়ান সাগরের অংশ থেকে সংগৃহীত ইরানি ক্যাভিয়ার। অনুষ্ঠানের মোট খরচ হয়েছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার। আমন্ত্রিত অ-রাষ্ট্রীয় তারকাদের ‘ব্যয়’ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। খরচের এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সমগ্র জনসংখ্যার বহু মাসের খাদ্যব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ খুব জমকালো ছিল। ময়ূর সিংহাসনে উপবিষ্ট অতিরঞ্জিত পোশাক পরিহিত রাজা মৃত সাইরাসের সমাধির সামনে দাঁড়ানো মাত্রই অতি শক্তিশালী আলোয় চারদিক ঝলমলে হয়ে উঠল। চমকিত অতিথিদের মধ্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হলো। অবিরাম অনুশীলন করা বাক্যটি বলে শাহ মঞ্চের জড়তা কাটিয়ে উঠেছিলেন:
‘আনন্দে ঘুমাও, সাইরাস, কারণ আমরা জেগে আছি।১
মার্কিন ক্যাম্পাসের গতানুগতিক জগতে ফিরে আসার পর, উচ্ছ্বসিত প্রাচ্যবিদরা রিপোর্ট করেছিলেন যে শাহের জাদুকরী শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ মরুভূমির বাতাস বইতে থাকে। কিন্তু তারা অন্য আরও বাতাস প্রবাহের ব্যাপারটি খেয়াল করেননি। যখন পশ্চিম এবং পূর্বের নেতারা শাহকে সংবর্ধনা দিচ্ছিলেন, তখন ইরানের বাইরে খুব কম পরিচিত একজন ইরানি ধর্মগুরু একটি দূরদর্শী সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন। ইরাকি নির্বাসন থেকে, খোমেনি তার সংকেতঘণ্টা বাজিয়েছিলেন:
ইরানের জনগণ কি ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতক এবং ইসরায়েলকে তেল সরবরাহকারী মুসলিমদের শাসন উদ্যাপন করবে? তা কি করা উচিত? ইরানের রাজাদের অপরাধ ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করেছে… এমনকি ‘ভালো’ হিসেবে খ্যাত রাজারাও ছিল জঘন্য এবং নিষ্ঠুর। ইসলাম মূলত রাজতন্ত্র ব্যবস্থার বিরোধী। সারা ইরান থেকে মানুষ অনবরত তাদের স্নানঘরের অভাবের কথা জানাচ্ছে। তাদের স্নানঘর নির্মাণের জন্য তারা ইসলামের দাবিকৃত দাতব্য কর ব্যবহারের অনুমতি চায়। কী হলো সেই সমস্ত সোনালি প্রতিশ্রুতি এবং দাম্ভিক দাবিগুলো যে ইরানের জনগণ সমৃদ্ধ ও সন্তুষ্ট এবং ইরান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সমান স্তরে অগ্রগতি করছে? যদি এই সাম্প্রতিক বাড়াবাড়ি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের ওপর আরও খারাপ দুর্ভাগ্য নেমে আসবে।
ইরানের ভেতরে পরিচিত এবং ভীতির পাত্র আয়াতুল্লাহর ব্যাপারে ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছিল। মোল্লা এবং তাদের মাদ্রাসার (ধর্মীয় বোর্ডিং স্কুল) দরিদ্র ছাত্রদের ‘পরজীবী’ বলে আখ্যায়িত করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৬৩ সালে, তিনি তার শক্ত ঘাঁটি কোম থেকে অসাধু শাসককে তার ভুয়া বন্ধুদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে এবং তার নীতি পরিবর্তন করতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন:
মি. শাহ! আমি আপনাকে কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। প্রিয় মি. শাহ, আপনি বিরত থাকুন… আমি চাই না যে আপনার বিদেশি প্রভু যদি একদিন আপনাকে চলে যেতে বলে, তাহলে জনগণ তাদেরকে ধন্যবাদ জানাক। আমি চাই না আপনি আপনার বাবার মতো হন.. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও আমেরিকা ইরান আক্রমণ করে আমাদের ভূখণ্ড দখল করে। তখন জনগণের সম্পত্তি বেদখল হয়েছিল এবং তাদের সম্মান হুমকির মুখে পড়েছিল। কিন্তু আল্লাহ জানেন, পাহলভি [শাহের বাবা] চলে যাওয়ায় সবাই খুশি হয়েছিল!… আপনি কি জানেন না যে একদিন যদি পরিস্থিতি উল্টে যায়, তাহলে আপনার চারপাশের এই মানুষগুলোর কেউই আর আপনার বন্ধু থাকবে না?
এই পরামর্শ উপেক্ষিত হলো। এবং এই পরামর্শের বাহক সংস্কারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ধর্মীয় নেতাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হযলো। ইরাক এবং পরে ফ্রান্সে নির্বাসন থেকে, খোমেনির টেপ-রেকর্ড করা ক্ষয়কারক বাণীগুলো, সারা দেশে প্রচারিত হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে মসজিদগুলোতে শুক্রবার জুমার নামাজের পর সেগুলো বাজানো হতো।
১৯৭৭ সালের শেষ থেকে ইরানে বিপ্লব-পূর্ব উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে তা আরও বাড়তে থাকে। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বিপ্লব জয়লাভ করে। আবার তা পরাজিতও হয়। রাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে এক নিষ্ঠুর ও দুর্নীতিগ্রস্ত পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, ইরানি সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য তৈরি করা ক্র্যাক রেজিমেন্টগুলো বিভক্ত হয়ে যায়। ইরানের শাহ পালিয়ে গিয়ে নির্বাসিত হন। ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী রাজবংশের অবসান ঘটে। কারাগারগুলো উন্মুক্ত হয়। নির্যাতনে অসাড় রাজনৈতিক বন্দিদের কাছে অবশেষে এই বিজয়কে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
তারা প্রায় দু-বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে এটা স্পষ্ট ছিল যে শাহ হেরে গেছেন। তার প্রস্থান কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সময়ই বিপ্লবের সবকিছু নির্ধারণ করতে পারে। তাই বন্দিরা মুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল।
রাস্তায় উল্লসিত জনতার সমাগম ঘটে। সর্বত্র উচ্ছ্বাস ছিল। ইতিহাসের একটি পরিচিত দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ১৭৮৯ সালে বাস্তিলের বাইরে প্যারিসের জনতা উল্লসিত ছিল। ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ড স্টেশনে পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকরা তাদের সবচেয়ে বিপ্লবী নেতাকে ট্রেন স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে সমবেত হয়েছিল। জারবাদী রেজিমেন্টগুলো বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলশেভিকদের সঙ্গে যোগদান করে। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে বেইজিংয়ে উত্তেজিত এবং উৎসুক জনতা মাও সে তুং ও তার সেনাবাহিনীর শহরে প্রবেশ এবং চীনা বিপ্লবের বিজয় ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিল। ১৯৫৯ সালে হাভানায় স্বৈরশাসক এবং তার মাফিয়া সহকর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং বিজয়ী গেরিলা সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে সায়গন: ভিয়েতনামি কমিউনিস্টদের আগমন ঘটছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা ভূপাতিত করা হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টারগুলো তাদের দূতাবাস থেকে মার্কিন কর্মীদের সরিয়ে নিচ্ছে।
১৯৭৯ সালে তেহরান এর ব্যতিক্রম ছিল না। পরিচিত দৃশ্যগুলো অনেককেই, বিশেষ করে ইরান ও অন্যান্য স্থানে বামপন্থি এবং উদারপন্থিদের বিভ্রান্ত করেছিল। ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে পশ্চিম ইউরোপজুড়ে (এবং বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানিতে শক্তিশালী) ইরানি রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে তাদের সংহতি প্রকাশের একটি প্রচারণা ছিল। সেই অনুযায়ী যখনই শাহ বিদেশ ভ্রমণ করতেন তখনই তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বন্দিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তেহরানের খবরে ব্যাপক উত্তেজনা ছিল।
প্যারিসের শহরতলি থেকে বাড়িমুখী যাত্রারত একজন দাড়িওয়ালা ধর্মীয় নেতা এই বিপ্লবের প্রতীক ছিলেন। মনে হচ্ছিলো তিনি একজন গিরোন্ডিন, একজন ফাদার গ্যাপন, একজন কেরেনস্কি। তিনি বেশিদিন টিকতে পারবেন না মনে হয়েছিল। শ্রমিক ও নাগরিক পরিষদ, অথবা জাতীয় ফ্রন্টের ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থিদের সঙ্গে জোটবদ্ধ বামপন্থিরা, অথবা সেনাবাহিনীতে বিপ্লবী অফিসাররা বা অন্য যে কোনো কিছু ধর্মীয় নেতাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন। খোমেনি ছাড়া যে কেউ সফল হবেন।
বিপ্লবের বিজয় নিশ্চিতকারী বিশাল গণ-সমাবেশগুলোতে অংশগ্রহণকারী জনগণ আল্লাহু আকবর (ঈশ্বর মহান) বা খোমেনি দীর্ঘজীবী হোন স্লোগান দেয়, অথবা তারা পাগড়িধারী ধর্মগুরু, যারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র তৈরির কথা বলছিলেন, তাদেরকে উল্লসিত করে। ইরানের বামপন্থিদের জন্য এর শোচনীয় পরিণাম অকল্পনীয় ছিল। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত বোকা বামপন্থিরা গণ-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে এসে উৎসাহ ও উত্তেজনায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে একই স্লোগান দিয়ে তাদের সংহতি জানাচ্ছিল। তারা ধরে নিয়েছিল এসব স্লোগান ছিল ইরানি জনগণের সুবিধা লাভের একটি কৌশল মাত্র। তারা ভেবেছে এই সমস্ত ধর্ম ছিল খালি একটি ফেনা; নতুন এবং শক্তিশালী বাতাস তা পরবর্তী সময়ে উড়িয়ে দেবে। এবং এ ধরনের ভুল চেতনা শীঘ্রই একটি বিশাল মাত্রার শ্রেণি সংগ্রামের দ্বারা সংশোধিত হবে। খোমেনির কর্মকাণ্ডই হলো আসল কথা, তার রাজনৈতিক কর্মসূচি তাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এটা ঠিক ছিল না, কিন্তু অনেকেই এভাবেই বিশ্বাস করেছিল।
ইরানের বামপন্থিদের জন্য এর শোচনীয় পরিণাম অকল্পনীয় ছিল। পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত বোকা বামপন্থিরা গণ-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে এসে উৎসাহ ও উত্তেজনায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে একই স্লোগান দিয়ে তাদের সংহতি জানাচ্ছিল। তারা ধরে নিয়েছিল এসব স্লোগান ছিল ইরানি জনগণের সুবিধা লাভের একটি কৌশল মাত্র। তারা ভেবেছে এই সমস্ত ধর্ম ছিল খালি একটি ফেনা; নতুন এবং শক্তিশালী বাতাস তা পরবর্তী সময়ে উড়িয়ে দেবে।
তিন মাসের মধ্যেই নতুন শাসনব্যবস্থার রূপরেখায় ইসলামি জ্যাকোবিনিজমের কঠোর এবং একগুঁয়ে চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের বিজয়ের পর এই প্রথম এমন একটি উত্থান হলো। সময়ের ব্যবধান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি ছিল ইতিহাসের বিরুদ্ধে, আলোকিতকরণের বিরুদ্ধে, ‘ইউরোমেনিয়া’, ‘ওয়েস্টক্সিফিকেশন’–প্রগতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। উত্তর-আধুনিকতা ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠার আগে এটি ছিল একটি উত্তর-আধুনিক বিপ্লব। এই সম্বন্ধকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারীদের মধ্যে ফুকো ছিলেন একজন। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে দৃশ্যমান ইউরোপীয় সমর্থক হয়ে ওঠেন। কীভাবে তা সম্ভব হলো?
ক্ষমতাচ্যুত শাহের বাবা দমন-পীড়নের মাধ্যমে ধর্মগুরুদের উৎপাটনের চেষ্টা করেছিলেন: যে কোনো ভিন্নমতের জন্য প্রকাশ্যে তাদেরকে বেত্রাঘাত করা হতো। পুত্র শাহ এ ব্যাপারে সতর্ক হলেন। অনুদান এবং দানের বিনিময়ে তিনি ধর্মযাজকদের কিনে ফেলার চেষ্টা করেন। এবং তাতে তিনি কিছুটা সফলও হন। তবে মূল সমস্যাটি ধর্মগুরুকেন্দ্রিক ছিল না। প্রকৃত সমস্যা ছিল শহর ও গ্রামে বসবাসকারী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের প্রতিকূল পরিস্থিতি। ইরানি সমাজে বসার ঘরগুলোতে হয়তো ধর্ম তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু গৃহকর্মীদের আবাসস্থলে এটি প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। শিয়া গোঁড়ামি পলায়নবাদকে উৎসাহিত করেছিল।
গ্রামাঞ্চলে নিপীড়িত এবং বিচারহীনতায় আক্রান্ত কৃষকরা অধীর আগ্রহে যুগের ইমাম – একজন শিয়া মসিহর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বিপ্লবটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে একটি শহরকেন্দ্রিক ঘটনা ছিল। প্রকৃতপক্ষে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শাহ তার পক্ষে কিছুটা কৃষক সমর্থন একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর একটি কারণ হলো ১৯৬০-এর দশকে শাহের ভূমি সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমে কিছু কৃষক জমি লাভ করে। কিন্তু বাকিরা গ্রাম থেকে উৎপাটিত হয়ে শহরে আধা-সর্বহারা হিসেবে টিকে থাকে। ১৯৭০-এর দশকের শিল্পায়নের লক্ষ্যে শ্রম সরবরাহের জন্য এই উৎপাটন করা হলেও তাদের বেশিরভাগই কারখানায় কাজের সুযোগ পায়নি। তাই অনিশ্চিত অস্তিত্বে আক্রান্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া এই উচ্ছেদকৃত প্রাক্তন কৃষকরাই শহরে ইসলামি বিপ্লবের অগ্রদূত হয়ে ওঠেন।
ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে একমাত্র স্থানীয় মসজিদের মাধ্যমে জগতের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল। মসজিদ থেকে তাদের দানপ্রাপ্তি হতো। তারা আকাশ-ঈশ্বর এবং তার পার্থিব অনুসারীদের মাধ্যমে মৃত্যু-পরবর্তী উন্নততর জীবন লাভের প্রত্যাশী ছিল। অবশ্য তারা সকল ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করত না। প্রায়ই সাপ্তাহিক পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য তারা এক বোতল আরাক পান করে ফেলত। তবে পথিমধ্যে কোনো মোল্লার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আরাক পান করার পর সাবধানে মুখ ধুয়ে ফেলত। ব্যভিচারের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শিয়া ধর্ম সুন্নি ধর্মের মতোই কঠোর ছিল। কিন্তু এক-রাতের ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে সুন্নি নিয়ম থেকে এই ধর্ম একটি শিথিলতা এনেছিল। পতিতালয় বা হোটেল রুমে যাওয়ার পথে, পুরুষদের ‘অস্থায়ী বিবাহ’কে বৈধতা দেবার জন্য একটি বিশেষ ধর্মীয় সার্টিফিকেট লাভের ব্যবস্থা ছিল।
ইরানে ১৯৭৫-৭৬ সালের অর্থনৈতিক সংকট শাহের বহুল প্রশংসিত ‘সংস্কার’-এর ব্যর্থতা স্পষ্ট করে। পরজীবী একটি রাষ্ট্র কাঠামো বেশিরভাগ তেল সম্পদ ভোগ করতো। অস্ত্রখাতে প্রচুর ব্যয় হচ্ছিল এমন এক সময়ে যখন দশ লাখ মানুষ বেকার এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৩০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। ব্যাংক ঋণের সীমাবদ্ধতা এবং আমদানি-নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ফলে বাজারের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই শাসনকে উৎখাত করার জন্য ব্যবসায়ীরা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ধর্মগুরুদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
নগরবাসী দরিদ্রদের কাছে ধর্মগুরুদের দেওয়া সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্নীতির অবসান এবং দেশের সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধতার প্রতিশ্রুতি আবেদনময়ী ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, ধর্মগুরুরাই তাদের একমাত্র বিকল্প; জাতীয়তাবাদ এবং কমিউনিজম উভয়েই ব্যর্থ দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রে মিশর এবং কম্বোডিয়াকে প্রধান উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো। বিকল্প হিসেবে একমাত্র ইসলামই বাকি ছিল। মানুষ এই প্রকল্পকে সমর্থন করলে ইসলামের পুনরুত্থান সম্ভব। যেহেতু সেই সময়ে কমিউনিজম আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে পড়েনি, তাই ইসলামপন্থিরা নির্লজ্জভাবে এর বৈশিষ্ট্যের কিছু অংশ চুরি করে নিয়েছিল। ধর্মীয় আন্দোলনের বিপ্লবী শাখাগুলো ‘শ্রেণিহীন সমাজ’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করত। শ্রেণিহীন সমাজের সবচেয়ে সোচ্চার প্রচারক ছিল মুজাহিদিনরা-যারা ইসলামি বিশ্বের একটি অনন্য ধারার বিকাশ দেখাচ্ছিল। কারাগারের ভেতরে ‘অশুচি’ বামদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে অস্বীকার করা মোল্লা এবং অন্যান্য ধর্মীয় বন্দিদের সঙ্গে তারা বন্ধুত্ব করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। একপর্যায়ে মুজাহিদিনরা মার্কসবাদের এত কাছাকাছি চলে গিয়েছিল যে কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে তারা ইসলাম ত্যাগ করে নিজেদের বিপ্লবী মার্কসবাদী ঘোষণা করেছিল। পেইকার নামে এই দলটি ছিল ইরানি বামপন্থিদের তৃতীয় বৃহত্তম দল।
বাজার সমর্থন, বেকার ও কর্মরত শ্রমিকদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং শিয়া ধর্মের মুক্তিমূলক আদর্শের সমন্বিত মিশ্রণটি ইরানি সমাজে একটি শক্তিশালী এবং অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্মগুরুরা সময়ের সদ্ব্যবহার করলেন। এবার তারা জানতেন শাহ আর কখনো ফিরে আসতে পারবেন না। তারা এর পরের দেড় বছর বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীসহ তাদের দমনমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এবং কারখানা, অফিস, স্কুল ও সামরিক ইউনিট থেকে সমস্ত বামপন্থি প্রভাব অপসারণ শুরু করেন। তখনও তুদে (Tudeh) পার্টি এর ভবিষ্যৎ পরিণাম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা বরং ‘অতি-বামপন্থিদের’ দমন পীড়নকে স্বাগত জানায়।
১৯৫১ সালে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। সেই সময় বামপন্থি এবং ধর্মনিরপেক্ষ-উদারনৈতিক-জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করে। মোসাদ্দেগ প্রধানমন্ত্রী হন এবং শাহ পালিয়ে নির্বাসিত হন। কিন্তু সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার পাল্টা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য মোসাদ্দেগ সরকার জনসমর্থন সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। পশ্চিমারা হামবড়া শাসককে ফিরিয়ে আনে। ফলে ইরানের নিজের পায়ে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র সুযোগটি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে, শেষ কাজার রাজার সরাসরি বংশধর, বৃদ্ধ অভিজাত ব্যক্তি অবশিষ্ট শক্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মোসাদ্দেগের রক্ষীরা শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করেছিল। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি প্রতিরোধে নেমে আশা করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর ভেতরে তুদে সংগঠনের কোষগুলোর একটি শক্তিশালী গোপন উপস্থিতি বেরিয়ে আসবে এবং তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু তুদের হস্তক্ষেপ যথেষ্ট আন্তরিক ছিল না। আবার কিছু দলীয় নেতা বিশ্বাস করেছিলেন যে মোসাদ্দেগ ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হলে হয়তো তারা ক্ষমতায় বসবে। কিন্তু এই চিন্তা ছিল সংকীর্ণ এবং বোকামি। শাহ ফিরে আসার পর সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত তুদে সংগঠনটিকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা হয়। দলটি এই আঘাত থেকে কখনো আর পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি।
পশ্চিমাপন্থি কিছু ধর্মগুরুকে বিক্ষোভের মানুষ ভাড়া করতে সিআইএ পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। অবশেষে মোসাদ্দেগের পতন ঘটে। নাসেরের মতো তার একই অপরাধ ছিল- তিনি ইরানের তেল জাতীয়করণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছিল। মোসাদ্দেগ ভেবেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো লন্ডনকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার জন্য সতর্ক করবে। অবশ্য ট্রুম্যান ও অ্যাকেসন উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে কিছুটা সময় নিরপেক্ষতার ভান বজায় রেখেছিলেন। ম্যাকমিলান তার ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন: ‘অ্যাকেসন ব্রিটেন ও পারস্যকে শান্ত থাকার জন্য আবেদন করেছেন! যেন আমরা দুটি বলকান দেশ যাদেরকে ১৯১১ সালে স্যার এডওয়ার্ড গ্রে বক্তৃতা দিচ্ছেন!’
পশ্চিমাপন্থি কিছু ধর্মগুরুকে বিক্ষোভের মানুষ ভাড়া করতে সিআইএ পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। অবশেষে মোসাদ্দেগের পতন ঘটে। নাসেরের মতো তার একই অপরাধ ছিল- তিনি ইরানের তেল জাতীয়করণ করেছিলেন।
এবারে এখনো এরকম ঘটনা ঘটেনি। তবে শীঘ্রই তা ঘটবে। এবার লন্ডন ওয়াশিংটনের স্নায়ুযুদ্ধের আতঙ্ককে ব্যবহার করে জয়লাভ করেছিল। এর সপক্ষে তারা জোর দিয়ে বলে যে ইরানি কমিউনিস্টরা মোসাদ্দেগ শাসনের পেছনে থেকেছে এবং ভবিষ্যতে কমিউনিস্ট বিজয়ের সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায় না। এরপর বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পদাপসারণ করে গৃহবন্দি করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদী বিকল্পকে অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলে ওয়াশিংটনের স্বার্থের প্রতি অধীন থাকার শর্তে শাহ তার ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। তিনি সেই শর্ত পূরণ করেছিলেন। ইরানি কমিউনিস্ট এবং তাদের সমর্থকরা তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। গণগ্রেপ্তার এবং নির্যাতন তার শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ১৯৫০-এর দশকে হাজার হাজার ইরানি ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী নির্বাসনে পালিয়ে যান। তারপর ষাটের দশকে শাহের ‘শ্বেত বিপ্লব’ আসে, যা ভূমি সংস্কার প্রবর্তন করে এবং নারীদের ভোটের অধিকার দেয়। খোমেনি এই উভয় পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের দাঙ্গার পেছনে থাকার জন্য খোমেনি দেশ থেকে বহিষ্কৃত হন। আক্ষরিক অর্থেই তাকে ইরাকের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে দেশের বাইরে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি এমন একজন নির্বাসিত ব্যক্তি যিনি তার জবরদস্তিমূলক নির্বাসনকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালের বিপ্লব অনেক বুদ্ধিজীবী, উদারপন্থি ও বামপন্থি ছাত্র এবং ধর্মীয় আন্দোলনের একটি অংশকে আশাবাদী করেছিল। তারা শীঘ্রই আশাহত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের বিরক্তি নতুন সরকারকে ক্ষমতায় আসতে অবদান রেখেছিল। কিন্তু বিপ্লব ধর্মগুরুদের এড়িয়ে যেতে পারবে–এই আশা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। বামপন্থিদের একটি অংশ ধর্মীয় একনায়কতন্ত্রের পরিণতি সম্পর্কে ন্যূনতম সতর্কীকরণ জারি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সে কারণে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। অন্যদিকে অন্যান্য গোষ্ঠী যারা ‘বিপ্লব মৃত, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ ঘোষণা করেছিল, তারা ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করেছিল। এদের একটি গোষ্ঠী তেহরানে নতুন সংবিধান রচনার জন্য নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ পরিষদের একমাত্র অপেক্ষাকৃত অবাধ নির্বাচনে ১ লাখ ৫০ হাজার ভোট পেয়েছিল। ধর্মীয় শাসনের প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতার তুলনায় এই গোষ্ঠীগুলোর সমস্যা আরও বেশি ছিল রাষ্ট্র, সমাজ এবং দলের স্তরে গণতন্ত্রের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থতা।
১৯৭৯ সালের বিপ্লব অনেক বুদ্ধিজীবী, উদারপন্থি ও বামপন্থি ছাত্র এবং ধর্মীয় আন্দোলনের একটি অংশকে আশাবাদী করেছিল। তারা শীঘ্রই আশাহত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের বিরক্তি নতুন সরকারকে ক্ষমতায় আসতে অবদান রেখেছিল।
তুদে পার্টির কমিউনিস্টরা এবং ন্যাশনাল ফ্রন্টের ধর্মনিরপেক্ষ-উদারপন্থিরা গণ-আন্দোলন থেকে কার্যত অনুপস্থিত ছিলেন। এই অনুপস্থিতি থেকে কিছু অতি-বামপন্থি গোষ্ঠী সুবিধা আশা করলেও আসলে তা একটি সমস্যাই ছিল। সেকারণে আন্দোলনে মোল্লারাই একমাত্র সংগঠিত শক্তি ছিল। তাদের মতাদর্শই প্রাধান্য বিস্তার করে। এই বিজয় যারা গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, জাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করছিলেন–তাদের সবার ভাগ্য ঠিক করে দিয়েছিল। কেন্দ্রীভূত পাহলেভি রাষ্ট্রের পতন স্বায়ত্তশাসনবাদী আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপ্ত করে এবং খুজেস্তান, কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তান ও আজারবাইজানে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ধর্মগুরুরা তাদের বিরুদ্ধে এমন এক জোরালো লড়াই করেছিলেন, যা প্রাচীন শাসনব্যবস্থার ধরনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই গণতন্ত্রের স্ফুরণ দেখা যায়। পুস্তিকা, বই, সংবাদপত্র, জনসভা, আলোচনা এবং কমিটির বিস্তার ঘটে। কেবল তাদের উপস্থিতি এবং কথাই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্মীয় নেতাদের শাসনের ‘ঐশ্বরিক অধিকার’কে চ্যালেঞ্জ করে। এই নেতারা স্থায়ীভাবে এই হুমকি দূর করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন এবং এতে ধর্মনিরপেক্ষদের সমালোচনাহীন ঘোষণাগুলো তাদের সুবিধা দেয়।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির পর তুদে পার্টির সুবিধাবাদী হস্তক্ষেপ, নরমভাবে বললে, অকার্যকর ছিল। ধর্মগুরুদের সঙ্গে একটি জনপ্রিয় ফ্রন্ট তৈরির চেষ্টায় তারা নিজেদের অপমানিত করেছিল। মার্চ মাসে, নারীদের পর্দা করার জন্য খোমেনি একটি ফরমান জারি করেছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ২০ হাজার নারী বেরিয়ে এসে এই ফরমানের বিরুদ্ধে পথে বিক্ষোভ করেছিলেন। খোমেনির বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল করার জন্য তুদে পার্টি ‘বুর্জোয়া নারীদের’ নিন্দা করেছিল; তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার থাকার জন্য ন্যাশনাল ফ্রন্টে তাদের প্রাক্তন উদারপন্থি মিত্রদের নিন্দা করেছিল; তারা ধর্মগুরুদের প্রতিরোধ করার জন্য কুর্দি এবং তুর্কমানদের তীব্র সমালোচনা করেছিল। অতি বামপন্থি দলগুলোও ‘সুগন্ধি’ নারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
শীঘ্রই তাদের সবাইকে ধ্বংস করা হয়। ১৯৮১ সালে উগ্র বামপন্থি এবং মুজাহিদিনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এমনকি শাহের আমলের চেয়েও কারাগারগুলো বেশি উপচে পড়তে শুরু করেছিল। ১৯৮৩ সালে তুদেহর নেতা এবং সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ঠিক একইভাবে- যেমন তারা নারী, বিপ্লবী বামপন্থি, কুর্দি এবং তুর্কোমানদের সংগ্রামকে উপহাস করেছিল। বিশ দশকের গোড়ার দিক থেকে ষাটের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত ইরানে একটানা নির্যাতন এবং চরম শাস্তি নিষিদ্ধ ছিল। শাহের শাসনকালে তা আবার ফিরে আসে। তার গোপন পুলিশ সাভাক বিশ্বজুড়ে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। প্রতিবছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সাভাককে মানবাধিকার এবং মর্যাদার চরম লঙ্ঘনকারী হিসেবে উল্লেখ করছিল। সরকার ধর্মীয় বন্দি এবং কমিউনিস্ট উভয়কেই নির্যাতন করতো। প্রায়ই তাদেরকে একই কক্ষে বন্দি রাখা হতো। ধর্মগুরুরা তাদের ‘শত্রুদের’ বিরুদ্ধে ঠিক একই পদ্ধতি ব্যবহার করছিল।
শীঘ্রই তাদের সবাইকে ধ্বংস করা হয়। ১৯৮১ সালে উগ্র বামপন্থি এবং মুজাহিদিনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এমনকি শাহের আমলের চেয়েও কারাগারগুলো বেশি উপচে পড়তে শুরু করেছিল।
শাহ কখনো কখনো নগদ অর্থ বা নির্বাসনের মাধ্যমে তার বিরোধীদের কিনে ফেলতেন। কিন্তু ধর্মগুরুরা তাদের বিরোধীদের জনসমক্ষে অপমান করতে চেয়েছিলেন। তারা শো-ট্রায়াল পরিচালনা করতেন। টেলিভিশনে অনুতপ্ত হতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত বন্দিদের নির্যাতন করা হতো। আধুনিক ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো বহু সংগ্রামের প্রবীণ তুদেহ নেতৃত্ব টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে নিজেদের ‘শয়তানি’ অতীতের ভূমিকার নিন্দা করে নির্দেশমত ইসলাম ও তার শিয়া অভিভাবকদের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন। তারা অতীতে ধর্মগুরু নেতাদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, ‘উন্মাদ পেটি-বুর্জোয়া’ এবং ‘ভূস্বামীদের প্রতিনিধি’ হিসেবে উল্লেখ করার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তারা নিজেদের লিখিত সব দলিলপত্রের নিন্দা করেছিলেন।২ নির্যাতনের শিকার যারা তাদের কর্মের জন্য নিন্দা করা সম্ভব নয়। তবে আমি প্রায়ই ভাবতাম যে নিজেদের ভূমিকার অতিরঞ্জিত নিন্দা শিয়া মতবাদের প্রতি কি অন্তর্ঘাত যাদের সংস্কৃতি শহীদদের রক্তে স্নান করা। তুদে ক্যাডারদের শহীদ হতে অস্বীকৃতি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তাদের অধিকাংশের জন্য, ‘ধর্মান্তর’ সম্পূর্ণ বানানো ছিল।
আরও হাজার হাজার বামপন্থি কর্মী শাহকে উৎখাত করার জন্য অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তারাও নির্যাতিত হয়েছিল। অনুতপ্ত হতে অস্বীকৃতি জানানোর পরিণতিতে তারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল।
এটি ছিল ধর্মীয় একনায়কতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ চেহারা, কিন্তু প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থন পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালের মার্চের গণভোটে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পড়েছিল। কেউ কেউ শাহের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা প্রকাশের জন্য ভোট দিয়েছিল। উগ্র বামপন্থিরা বয়কটের ডাক দিয়েছিল। শাসনব্যবস্থা তার সমস্ত বিরোধিতা মুছে ফেলে তার বৈধতা তৈরি করছিল। এটি বিপ্লবের এক মাস পরে হলেও তা ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ করা হয়েছিল। এই সমর্থনের ফলে অনেক ধর্মীয় নেতা সন্ত্রাসকে জনসাধারণের ইচ্ছার এক বিপ্লবী প্রকাশ হিসেবে ন্যায্যতা দিতে চেয়েছে।
শাহের শাসনের পতন নিঃসন্দেহে নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের ওপর একটি আঘাত ছিল। কিন্তু এই ঘটনাগুলো এবং যেমন নিকারাগুয়ায় স্যান্ডিনিস্তার বিজয় এগুলোর মধ্যে গুণগত পার্থক্য ছিল। কারণ, ওয়াশিংটন তখনও শীতল যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিযুক্ত ছিল। হাভানা, হ্যানয় ও মানাগুয়ার হুমকি এমনভাবে সংহত ছিল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র যা কখনো হতে পারতো না। তেহরানের বিপদ পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করেছিল। কারণ, তেহরান যদি ইরাক, সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে শিয়া বিদ্রোহকে উসকে দেয়, তবে তা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রনীতি সর্বত্র ইসলামপন্থিদের উত্তেজিত করেছিল। এটি মহান শয়তান (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রথমটি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ছিল ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মতো প্রকৃত ইসলামের অন্য শত্রুদের রক্ষাকারী। দ্বিতীয়টি (সোভিয়েত ইউনিয়ন) ছিল নাস্তিকতা ও বস্তুবাদের উৎস। কোনো মূল্যায়নই ভুল ছিল না, তবে ধর্মগুরুদের মূল লক্ষ্য ছিল মার্কিন দূতাবাসের বাইরে হাজার হাজার লোককে একত্রিত করে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য শাহের প্রত্যাবর্তনের দাবি করা। এর পর নাটকীয়ভাবে দখল করে দূতাবাসের সবাইকে জিম্মি করা হয়েছিল। এটি ছিল একটি মহাকাব্যিক নাটক, একজন ঘৃণ্য শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের দাবি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী?
বাস্তবে মার্কিন দূতাবাসের বাইরের সমাবেশগুলো গভীর প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ঢেকে রেখেছিল। এই সামাজিক ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই ব্যভিচারী এবং সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে থাকে। এবং বামপন্থি, জাতীয় সংখ্যালঘু (কুর্দিস্তানে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হয়েছিল)এবং মুজাহিদিনদের ওপর সম্পূর্ণ দমন-পীড়ন শুরু হয়।
এ ধরনের সামাজিক কাঠামো কি কখনো সাম্রাজ্যবাদের জন্য হুমকি হতে পারে? সাম্রাজ্যবাদের আসল শত্রুরা তো বাজারের আধিপত্যকে অতিক্রম করতে চেয়েছিল। তারা তাদের শক্তির শীর্ষে পৌঁছে নাটকীয়ভাবে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের স্থান হ্রাস করেছিল: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল ছিল। মার্কিন মূল ভূখণ্ডের থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে কিউবা মাফিয়া-পুঁজিবাদ থেকে নিজেদের মুক্ত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের জন্য তা একটি প্রচণ্ড এক আঘাত ছিল। এই সমস্ত রাষ্ট্র একটি উন্নততর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য প্রচেষ্টা করছিল। তাদের সবার অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদের জন্য হুমকি ছিল। আর ইরানে নির্বোধদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার হুমকি সেই তুলনায় দীর্ঘমেয়াদে অতি নগণ্য ছিল।
এই ব্যবস্থা ঐশ্বরিক অনুমোদনের দাবি করে, যেখানে ধর্মগুরুরাই এর একমাত্র ব্যাখ্যাকারী, এবং তারা যা খুশি তাই করতে পারে। ধর্মগুরুদের মধ্যে বা বাইরে থেকে আসা এর যে কোনো ভিন্নমত আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করা, অন্য কোনো কর্তৃত্বের কাছে তা দায়বদ্ধ নয়। খোমেনির পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণের ফলে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বনি সদরের মতো আরও উদারপন্থি ইসলামপন্থিরা পালিয়ে যান এবং ভিন্নমতাবলম্বী আয়াতুল্লাহদের কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ধর্মান্ধ অযৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে একটি শাসনব্যবস্থা কতক্ষণ স্থায়ী হতে পারে? এটি উৎখাত করার জন্য কোন ধরনের সামাজিক শক্তিকে একত্রিত করা যেতে পারে? কারাগারে এবং ব্যক্তিগত বাড়িতে যে মুহূর্তে এই প্রশ্নগুলোর ফিসফিসানি শুরু হয়েছিল, তখনই একটি বাস্তব হুমকির আবির্ভাব ঘটে।
এই ব্যবস্থা ঐশ্বরিক অনুমোদনের দাবি করে, যেখানে ধর্মগুরুরাই এর একমাত্র ব্যাখ্যাকারী, এবং তারা যা খুশি তাই করতে পারে। ধর্মগুরুদের মধ্যে বা বাইরে থেকে আসা এর যে কোনো ভিন্নমত আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করা, অন্য কোনো কর্তৃত্বের কাছে তা দায়বদ্ধ নয়।
পশ্চিমারা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে ছিল না, কিন্তু তেহরান শাসনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উপাদান দেখে তারা বিরক্ত হচ্ছিল। তারা তখন অবন্ধু প্রতিবেশীর দ্বারস্ত হলো। সাদ্দাম হোসেন সেই অস্থিতিশীল অঞ্চলে আধা-নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। অভ্যন্তরীণভাবে তিনি ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করতে এবং বা’থ-এর আরও উগ্রপন্থি উপাদানগুলোকে দুর্বল করতে ভূমিকা পালন করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলোচনার সুযোগ পেয়ে সাদ্দাম খুশি হলেন। শাহের পতনের পর থেকে, তিনি ওয়াশিংটন ও লন্ডন থেকে সর্বাধিক-অনুগ্রহপ্রাপ্ত-জাতির স্থান পেতে শুরু করেন।
উপসাগরীয় রাজ্যগুলোর আমির ও শেখদের নিরাপত্তার জন্য ওয়াশিংটন বিচলিত ছিল। বিশেষত সৌদি রাজতন্ত্রের ‘স্থিতিশীলতা’ নিয়ে তাদের খুব বেশি উদ্বেগ ছিল। ওয়াশিংটনের সম্মতিই ছিল এই শাসকদের বৈধতার একমাত্র উৎস। একপর্যায়ে সিটিজ অব সল্ট- গ্রন্থের একটি চরিত্র এমন একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে যার উত্তর সবার জানা: ‘এবং আমির, তিনি কি তাদের আমির ছিলেন? তাদের রক্ষা এবং সুরক্ষার জন্য তিনি সেখানে ছিলেন, নাকি তিনি আমেরিকান আমির ছিলেন?’
তারা প্রত্যেকে আমেরিকারই আমির ছিলেন। তাই ইরানের বিপ্লবের রোগ নিজস্ব জনগোষ্ঠীতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় তারা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। যদি তাদের জনগণের হৃদয়ে বিদ্রোহের মনোভাব জাগ্রত হয়, তাহলে আমেরিকানদের প্রভাব এবং শাসনকার্যে নির্মমভাবে ব্যবহৃত সুন্নি ও শিয়া ইসলামের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সত্ত্বেও তাদের শাসনব্যবস্থার পতন হতে পারে। এটা তারা জানতেন। ওয়াশিংটন যদি শক্তিশালী শাহকে বাঁচাতে না পারে, তাহলে তাদেরকে বাঁচাবে কীভাবে?
এই ভীতসন্ত্রস্ত লোকেরাই তখন বাগদাদের লোভী আধিপত্যবাদীদের চোখের সামনে ব্যাগভর্তি অর্থ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তারা সাদ্দামকে তোষামোদ করছিলেন এবং সোনার মুদ্রা দিয়ে তাকে স্নান করিয়েছিলেন। কুয়েতি শাসক পরিবারের এক বংশধর, কবি সৌদ এল-সাবাহর নেতৃত্বে চাটুকারদের একটি দল তার প্রশংসা করে পদ্য রচনা করেছিলেন। সাদ্দামকে ‘ইরাকের তরবারি’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। তারা তাকে ইরানের ধর্মগুরুদের চূর্ণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সাদ্দামকে তারা স্মরণ করায় যে ইরাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনগোষ্ঠী এবং কারবালা, তাদের পবিত্রতম স্থান, যা বহু শতাব্দী আগে শহীদ হোসেনের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। যদি ইরানিরা বাহরাইন ও কুয়েত দখল করে, তাহলে তারা ইরাকে বিদ্রোহ উসকে দেবে এবং রিয়াদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ইরাকি বা’থের নেতা এ ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। কেবল একটি প্রশ্ন নিয়েই তার আগ্রহ ছিল–হোয়াইট হাউসের আমির কী চান?
তারা সাদ্দামকে তোষামোদ করছিলেন এবং সোনার মুদ্রা দিয়ে তাকে স্নান করিয়েছিলেন। কুয়েতি শাসক পরিবারের এক বংশধর, কবি সৌদ এল-সাবাহর নেতৃত্বে চাটুকারদের একটি দল তার প্রশংসা করে পদ্য রচনা করেছিলেন। সাদ্দামকে ‘ইরাকের তরবারি’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। তারা তাকে ইরানের ধর্মগুরুদের চূর্ণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
শুধু যখন ওয়াশিংটন সাদ্দামকে যুদ্ধের জন্য সবুজ সংকেত দিল, এবং তার বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী ইউনাইটেড কিংডমকে ইরাকের সম্ভাব্য সামরিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রস্তুত করল তার পরই সাদ্দাম হোসেন খোমেনির ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। উপসাগরের শাসকদের মতো সাদ্দাম সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতেন যে আমেরিকানরা সব ব্যাপারে বিজ্ঞ।৩
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল এক ভয়াবহ সংঘাত। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলা আট বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে দশ লাখেরও বেশি মুসলিম প্রাণ হারান। ১৯৮২ সালে তেহরান সরকারের সফল পাল্টা আক্রমণের ফলে ১৯৮০ সালে ইরাক কর্তৃক দখলকৃত সমস্ত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা হয়। বাগদাদে বা’থ নেতৃত্ব মিলিত হন এবং সাদ্দাম হোসেনকে বিচ্ছিন্ন করেন। তারা একটি ব্যাপক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় যাতে ইরানের দাবি সম্পূর্ণরূপে মেনে নেওয়া হয়। যদি এটি ঘটত, তাহলে সাদ্দামের পতন হতো। কিন্তু খোমেনি তার সামরিক বিজয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলামি বিপ্লব প্রসারিত না হলে এটি ভেঙে পড়তে পারে। এবং শাসনব্যবস্থাকে সমর্থনকারী অনেক বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যে তাকে সমর্থন জানান। এই সিদ্ধান্ত বাগদাদে বা’থ-এর বিরোধী অংশের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল এক ভয়াবহ সংঘাত। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলা আট বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে দশ লাখেরও বেশি মুসলিম প্রাণ হারান।
সাদ্দাম বেঁচে গেলেন। অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা নির্মূল করে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো এ অঞ্চলে প্রবেশ করে ইরানি নৌবাহিনীকে ধ্বংস করতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যাত্রীভর্তি একটি ইরানি এয়ারলাইনসের বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে। সাদ্দামের শক্তির পেছনে ওয়াশিংটনের যুদ্ধজাহাজ এবং ব্রিটেনের ঝলমলে অস্ত্র রয়েছে, ইরানিরা তা পুরোপুরি বুঝতে পেরে অবশেষে শান্তি প্রস্তাব রাখে। তাদের শাসনব্যবস্থা রক্ষা পায় তবে নিজস্ব বাহিনীতে মতবিরোধ দেখা দিলেও ধর্মযাজকদের দমন সাময়িকভাবে শক্তিশালী হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শাসনব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নেতাদের শাহাদতের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তারা তাদের দেশ এবং জনগণের সঙ্গে যা করেছে তার জন্য অন্যদের দোষারোপ করতে পারেনি। নতুন প্রজন্ম যারা কখনো শাহকে জানত না তারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছালো। ধর্মযাজকরা আগত সংস্কারের বীজ বপন করলেন।
নতুন এ ঘটনার প্রথম লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে চলচ্চিত্র উৎসব এবং আর্টহাউস সিনেমা হলে। এরপর সংস্কারের দাবিতে ছাত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। তারপর নারীরা ধর্মীয় পুলিশের আরোপিত বিধিনিষেধ অমান্য করতে শুরু করে। একজন সংস্কারবাদী ধর্মগুরু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি পরামর্শ দিতে সক্ষম হন যে ব্যাংকগুলো সুদ দিতে পারে। কিন্তু শাসনের কট্টরপন্থী গুন্ডাদের দ্বারা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা তিনি বন্ধ করতে অক্ষম হন। ২০০১ সালে ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে রাস্তায় বছরের প্রতি সপ্তাহে একটি করে মোট ৫২টি বিক্ষোভ হয়েছিল, বছরের প্রতিটি দিনের জন্য একটি করে ৩৭০টি ধর্মঘট হয়েছিল। এবং তরুণদের সঙ্গে ঘৃণিত ধর্মীয় পুলিশ, দুর্নীতিগ্রস্ত স্যাডিস্টদের প্রকাশ্য সংঘর্ষ হয়েছিল। দু-বছর ধরে প্রকাশ্যে তরুণ এবং পর্দাবিহীন তরুণীরা ইসলাম-পূর্ব পৌত্তলিক নববর্ষ, নওরোজ উৎসব উদ্যাপন করেছে। এর বিরুদ্ধে ধর্মীয় পুলিশ নিকৃষ্ট ভূমিকা রাখে। এটি কেবল শুরু। তবে এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে মানুষ তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়। মার্কিন বোমার চেয়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা অনেক কার্যকরী শিক্ষক। নতুন প্রজন্ম মিথ্যা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থা কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে পারেনি। ধর্মযাজক এবং তাদের ধর্মের প্রতি অনেকেই যে ঘৃণা অনুভব করে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৮
ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ই-মেইল: fatemaorama@gmail.com
পাদটীকা
১। (২৯) দ্য ম্যান্টল অব দ্য প্রফেট (লন্ডন ১৯৮৬) গ্রন্থটি ইরানে ইসলামি বুদ্ধিজীবীদের উৎপত্তির একটি শক্তিশালী এবং উদ্দীপক ঐতিহাসিক বিবরণ। লেখক রায় মোত্তাহেদেহ প্রাচ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ইরানি প্রতিক্রিয়ার তুলনা করে বলেন: ‘সেই সময়ের একটি রসিকতা দাবি করেছিল যে একজন ইরানি অফিস কর্মী সংবাদপত্রে শাহের এই কথাগুলো পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তার স্ত্রীকে বলার জন্য অপ্রত্যাশিতভাবে তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়েছিলেন; সেখানে তিনি তার স্ত্রী এবং তার প্রতিবেশী সাইরাসকে তার বিছানায় একসঙ্গে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন।
সেই নাটকীয় মুহূর্তে তিনি হাত তুলে বললেন: ‘আনন্দে ঘুমাও, সাইরাস, কারণ আমরা জেগে আছি।’
২। (৩০) ১৯৮৪ সালে, ইরানি কমিউনিজমের প্রধান তাত্ত্বিক এহসান তাবারি টেলিভিশনে উপস্থিত হন। তিনি অর্ধশতাব্দী আগে মার্কসবাদী হয়েছিলেন। তারা তার অতীত অবস্থান নিয়ে তাকে নির্যাতন করে: ‘শিয়াবাদের মতো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ স্পার্টাকাস এবং পুগাচেভের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে না।’ সহকর্মীদের মতো তাবারি ‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী’ হওয়ার জন্য ধর্মযাজকদের প্রশংসা করেননি। তবে প্রত্যাখ্যানের মধ্যেও তিনি ইসলাম এবং এর শিয়া চিন্তাবিদদের অসংখ্য প্রশংসাসূচক দৃষ্টান্ত অন্তর্ভুক্ত করেন। তবুও তারা তাকে নির্জন কক্ষে আটকে রেখেছিল। তিনি তার বিশ্বাসের রূপান্তরের যৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিলেন। তার মার্কসবাদ-বিরোধী স্মৃতিকথার রূক্ষ্নতা উদারবাদী ধর্মগুরুদেরও অবাক করে দিয়েছিল। তার পুরোনো সহকর্মীদের তিনি সোভিয়েত এজেন্ট, খুনি, ইরানের বিশ্বাসঘাতক, সাদ্দাম হোসেনের গুপ্তচর ইত্যাদি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। লেখাগুলো মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তার এই অবস্থান তার উপর নির্যাতনের, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার, ফলাফল ছিল। তাবারি ভাঙা হৃদয়ে মারা যান। কখনো তিনি তার প্রকৃত মতবাদ প্রকাশের সুযোগ পাননি…
৩। (৩১) ইসরায়েল একাই নিরপেক্ষ ছিল। বেগিন মন্তব্য করেছিলেন: ‘যখন গোয়িম গোয়িমকে হত্যা করে, তখন, আমরা কেবল দেখতে পারি।’ তিনি দেখছিলেন এবং প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে ইরানের চেয়ে বিশাল সেনাবাহিনী সমৃদ্ধ ইরাককে ইসরায়েল অনেক বড় সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখেছিল। এবং তাই যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে, তারা ইরানকে খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে, যার ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।