সুন্দরবনের বনজ সম্পদ এবং বনজীবীদের অধিকার

সুন্দরবনের বনজ সম্পদ এবং বনজীবীদের অধিকার

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়

উপকূলীয় অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের জীবন-জীবিকা ভূত-ভবিষ্যৎ সবই সুন্দরবনকেন্দ্রিক। বনের সম্পদ আহরণ করে বিনিময় বা বিক্রি করে জীবন চলে। নিজেদের নৈমিত্তিক প্রয়োজনও সুন্দরবনের দ্রব্য-সামগ্রী দিয়ে মেটানো হয়। গরান কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এখানকার মানুষের ঘরের খুঁটি, চালের কাঠামো তৈরি হয় হেতাল দিয়ে আর গোলপাতা হলো ছাউনি। সুন্দরবনের নলখাগড়া ঘরের বেড়ার কাজ করে, আর মেলে দিয়ে তৈরি হয় শোয়ার বিছানা-মাদুর। এভাবে এলাকার মানুষ বলা যায় সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে।

শুধু কাঠের ব্যবহার দেখলেই অবাক লাগে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সুন্দরবনের কাঠের মোট ১৪ প্রকার ব্যবহার রয়েছে এই অঞ্চলগুলোতে। গোল ফল খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোল গাছ থেকে গুড় তৈরি করা যায়। কেওড়া ফল তরকারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া আরও অনেক দ্রব্যের বহুরকম ব্যবহার রয়েছে স্থানভেদে নানারূপে। এখানকার বনজ সম্পদ ভেষজ হিসেবে প্রচলিত শত শত বছর ধরে। আমাশয় নিরাময়ে ব্যবহার হয় পশুর গাছের ছালের রস বা কাঁকড়া, পেটের ব্যথায় ধুন্দলের ফল, কাটা স্থানে জোড়া লাগে গেওয়ার আঠা, বিষক্রিয়ায় হরগোজার পাতা আর চোখের জ্বালায় গোলপাতার রস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এখানকার বনজ সম্পদ ভেষজ হিসেবে প্রচলিত শত শত বছর ধরে। আমাশয় নিরাময়ে ব্যবহার হয় পশুর গাছের ছালের রস বা কাঁকড়া, পেটের ব্যথায় ধুন্দলের ফল, কাটা স্থানে জোড়া লাগে গেওয়ার আঠা, বিষক্রিয়ায় হরগোজার পাতা আর চোখের জ্বালায় গোলপাতার রস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

শত বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনেক বিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধও। এই বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধের চর্চার মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে কতগুলো সর্বজনীন চিরায়ত জ্ঞান। এগুলোর অন্যতম হলো:
(ক) বনের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলকে আত্মীয় মনে করা।
(খ) দা-কুড়াল-খন্তা ছাড়া অন্য অস্ত্রসহ বনে প্রবেশ না করা।
(গ) ৪-৫টি গরান ঝাড়ের মাত্র একটি গরান কেটে নেওয়া।
(ঘ) চারাগাছ না মারা বা নষ্ট না করা।
(ঙ) মৌচাকের নিচের অংশই শুধু কেটে নেওয়া।
(চ) বনকে পবিত্র স্থান বলে জ্ঞান করা।
এভাবে তারা বনজ সম্পদকে প্রথাগত পদ্ধতিতে ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকে।

সম্পদের প্রথাগত যথাযথ ব্যবহার এবং দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বনজীবীরা দাবি করতে পারেন তাদের বেঁচে থাকার স্থান সুন্দরবনে নিরাপদ বিচরণের ন্যায়সংগত অধিকার। অবাঞ্ছিত মানুষ নয়, সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষেরাই প্রকৃতপক্ষে তার অংশীদারত্বের দাবিদার। তাদের নানামুখী চেষ্টা, সতর্ক তদারকি প্রভৃতি সুন্দরবনকে রক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। পরিতাপের বিষয় হলো, অপরিণামদর্শী শাসকশ্রেণি স্থানীয় জনসাধারণকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। বন ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো অংশীদারত্ব না থাকায় যাচ্ছেতাইভাবে বনের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। ধনীরা লোপাট করছে সম্পদ। বন্যপ্রাণী নিধন হচ্ছে গোপনে, প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ কর্তন নিয়মিত চলছে যেমন ইচ্ছা। বন ব্যবস্থাপনা এবং বনজ সম্পদ ব্যবহারের শত বছরের অভিজ্ঞতা জন্ম দিয়েছে বন ব্যবস্থাপনার চিরায়ত লোকজ জ্ঞানের এক সমৃদ্ধ মেধাস্বত্ব। এই চিরায়ত জ্ঞানের, অভিজ্ঞতার মেধাস্বত্ব চুরি করে পাচার করতে চায় করপোরেট কোম্পানিগুলো তাদেরই সৃষ্ট বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্বাধিকার আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। কর্তৃপক্ষকে এদিকে নজর দেওয়া জরুরি। স্থানীয় বিবেকবান মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে নিজস্ব জ্ঞান-অভিজ্ঞতাকে নিজেদের কাজে লাগাতে। এই সবকিছু এ দেশের মানুষের শত বছরের কষ্টার্জিত ফসল।

অবাঞ্ছিত মানুষ নয়, সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষেরাই প্রকৃতপক্ষে তার অংশীদারত্বের দাবিদার। তাদের নানামুখী চেষ্টা, সতর্ক তদারকি প্রভৃতি সুন্দরবনকে রক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। পরিতাপের বিষয় হলো, অপরিণামদর্শী শাসকশ্রেণি স্থানীয় জনসাধারণকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়।

কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে উপকূলীয় দরিদ্র মানুষদের বনে প্রবেশের অগ্রাধিকার না দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সম্পদ আহরণকারীদের পারমিট প্রদানে আগ্রহী। এর ফলে মুনাফা যাদের একমাত্র কাম্য তাদের কাছে যা ধারণা করা যায় তা-ই ঘটে থাকে। নির্বিচারে গাছপালা কাটা, গোলপাতা উজাড় করে দেওয়া, নিষিদ্ধ হরিণ শিকার করা এমনকি বাঘ মেরে তার চামড়া বিদেশে পাচার তাদের নিয়মিত কাজ।

সুতরাং আমাদের সর্বপ্রথম কাজ হলো বনজীবীদের পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান এবং উপকূলীয় জনসাধারণকে বনে অবাঞ্ছিত মনে না করা। তা ছাড়া বনজীবীদের আর্থিক সহায়তা দান, বাঘ-কুমির ও বনদস্যুদের হাতে নিহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা এবং লোকজ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যাতে করপোরেট কোম্পানি চুরি করতে না পারে তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সুন্দরবনের ভ্রমণ ও শিকার
১০০ বছরেরও আগে সুন্দরবনের ভ্রমণ সম্পর্কে শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র মহাশয় লিখেছেন,

‘ভ্রমণের পক্ষে সুন্দরবনের মতো অনুপযুক্ত স্থান আর নাই। সুবিস্তৃত এবং তরঙ্গসংকুল অসংখ্য নদী, নিবিড় দুর্ভেদ্য জঙ্গল, ভীষণ হিংস্র জন্তুসমূহের অত্যাচার প্রতিনিয়ত জল প্লাবনে অত্যন্ত কর্দমাক্ত ভূপৃষ্ঠ, আবাস, আশ্রয় বা ভ্রমণ চিহ্নিত পথের অভাব এবং আরও শত প্রকার উৎপাত সুন্দরবনকে মানুষের পক্ষে অগম্য করিয়া রাখিয়াছে।’ (যশোর – খুলনার ইতিহাস – শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র, পৃ: ৭০)

এসব বিবরণ সবই সত্য, কিন্তু তারপরও ভ্রমণপিয়াসি মানুষ প্রতিবছর দলে দলে সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তো বটেই, পৃথিবীর এমন কোনো দেশ সম্ভবত নাই, যে দেশের মানুষ সুন্দরবন ভ্রমণ করেননি। সুন্দরবন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা প্রায় সাড়ে চারশ নদ-নদী, অতুলনীয় সবুজের সমারোহ, অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত চিতল হরিণের ঝাঁক এবং তাদের মায়াবী চোখ, অসংখ্য নানা-জাতীয় বানরের হাস্যকর মুখভঙ্গি, সর্বোপরি রয়েল বেঙ্গল টাইগার–সবকিছু মিলিয়ে সুন্দরবনকে করে তুলেছে মনোরম। পর্যটকদের করে তুলেছে সতৃষ্ণ। তাই যতদিন যাচ্ছে পর্যটকদের ভিড় সুন্দরবনে বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যটন কেন্দ্র এবং পর্যটন সংগঠন গড়ে উঠেছে। ব্যবস্থাপনা ও যাতায়াত যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে। ফলে সুন্দরবন ভ্রমণপিপাসুরা অনেকটা নির্দ্বিধায় সুন্দরবন ভ্রমণ করতে পারেন। যে সতীশ চন্দ্র মিত্র সুন্দরবনকে ভ্রমণের অনুপযুক্ত স্থান বলেছিলেন তিনিই আবার লিখেছেন,

‘প্রত্যেকবারই রাড়ুলি নিবাসী রায় সাহেব নলিনী কান্ত রায় চৌধুরী মহাশয় আমাদের অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক হইতেন। তিনি বম্বে মেডিকেল কলেজে ৬ বৎসর অধ্যয়নের পর ডাক্তার হইয়া বাড়ি আসেন। তদবধি জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর যাবৎ অবিরত সুন্দরবনে ভ্রমণ শিকার করিতে করিতে তৎসম্বন্ধীয় এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন। সাহস করিয়া বলিতে পারি তাহার মতো সমগ্র বঙ্গদেশে এ বিষয়ে এরূপ অভিজ্ঞতা আর কাহারো নাই।’ (ঐ, পৃ: ৭০)

বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে বন্যপ্রাণী নিধন নিষেধ হয়েছে। কোনো প্রাণীকেই বিনা কারণে হত্যা করা উচিত নয়। পশু-পাখি নির্বিচারে হত্যা করলে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘদিন মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা না করায় পৃথিবী থেকে বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, বহু পাখি এখন আর দেখা যায় না। এই সবকিছুর ফলে মানুষের জীবনযাপনের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই বাংলাদেশ সরকারও বন্যপ্রাণী হত্যার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু বহু বছর ধরে সুন্দরবনের মানুষ শিকারে যেত। তখন শিকার করাটা একটা আনন্দের এবং গর্বের ব্যাপার ছিল। হরিণ শিকার করত মাংস খাওয়ার জন্য, আর বাঘ শিকার করত বীরত্ব দেখানোর জন্য। অবশ্য বাঘ বহু সময় লোকালয়ে এসে উৎপাত করত তখন তাকে না মারলে চলতও না।

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বহু শিকারি ছিলেন যারা বেশ বিখ্যাত হয়ে আছেন তাদের শিকারের জন্য। এদের মধ্যে ডাক্তার তমিজউদ্দিন, আরজান সরদার, কিনু গাজী, ইসমাইল গাজী, পাঁচু গাজী, মেহের গাজী, নিজামুদ্দি, পচাব্দী গাজী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাঘের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বন বিভাগের অনুরোধে এরা প্রত্যেকেই একাধিক বাঘ শিকার করেছেন। শিকারিরা বাঘ শিকারের ক্ষেত্রে কতগুলো নিয়ম মেনে চলত। যেমন: শিকারিরা কখনোই ঘুমন্ত বাঘের গায়ে গুলি করত না, আহাররত অবস্থায় বাঘ মারত না, সামনাসামনি মুখে কখনো গুলি করত না। এরকম অনেক নিয়মকানুন ছিল শিকারিদের বাঘ শিকারে।

একবার জঙ্গলের একটি বাঘ পচাব্দীর বাবা ও চাচাকে আক্রমণ করে এবং দাদাকে (পিতামহকে) খেয়ে ফেলে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পচাব্দী ওই রাতেই জঙ্গলে প্রবেশ করে, ফাঁদ পেতে বাঘটিকে হত্যা করে। একবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সুন্দরবন পরিদর্শনে এলে পচাব্দী তার সফরসঙ্গী হন। গভর্নর তাকে ঢাকা নিয়ে টেলিভিশনে উপস্থিত করলে পচাব্দী তার শিকার-কাহিনি বর্ণনা করেন। শিকারে বীরত্বের জন্য তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আবুল এহসান পচাব্দীকে আড়াইশ টাকা পুরস্কার প্রদান করেন। (চলবে)

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক ও রাজনীতিবিদ। বাগেরহাট।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •