হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর বর্তমান পরিস্থিতি: সংস্কার ও রাষ্ট্র ভাবনা

হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠী মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও নাগরিক অধিকার থেকে অনেক দূরে। সমাজের গুরুত্বপূরণ দায়িত্ব পালন করলেও তাদেরকে অদৃশ্য অপমানিত অস্বীকৃত বঞ্চিত জনগোষ্ঠী হিসেবেই জীবন পার করতে হয়। গত ১৮ এপ্রিল ২০২৫-এ ঢাকায় এ বিষয় এক সেমিনারের আয়োজন করে ‘হরিজন অধিকার আদায় সংগঠন’। এতে হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে সূচনা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের সভাপতি সুরেশ বাসফোর। সকলের অবগতির জন্য এই প্রবন্ধের মূল অংশ এখানে প্রকাশ করা হলো।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আজ হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠির মধ্যে মানুষের মর্যাদা পাওয়ার যে আশা-আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠেছে এই সেমিনার তারই বহিঃপ্রকাশ। আমরা মনে করি হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর মানবিক-নাগরিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন, যা বিগত কোন সরকারই করেনি। মৌলিক অধিকার (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো যা সব নাগরিকেরই প্রাপ্য, আমাদের জন্য তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ, ‘৯০ ‘২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানসহ সকল আন্দোলনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছি। করোনার মতো একটি অতিমারি দুর্যোগে আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি। কিন্তু আজও এদেশে বসবাসরত প্রায় এক কোটি হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।
এখনও জাত-পাত, পেশা-ভাষা, সংস্কৃতি ও জন্মগত কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয় আমাদের। সাম্প্রতিক সময়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় হরিজন জনগোষ্ঠীর একজন শিশু বীরাকে (৭) স্কুল ড্রেস পরিহিত অবস্থায় হোটেলের বাইরে বসে খেতে দেখা যায়। ভিন্ন ভাষা এবং সুইপার হওয়ার কারণে রংপুরের মৌবন হোটেলে খেতে বসলে ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জীবন বাসফোরকে হোটেল কর্মচারীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়। সান্তাহারে মিঠুন বাসফোর হোটেলের এক কর্মচারীকে স্পর্শ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মচারী তাকে মারধর করে, এক পর্যায়ে গরম তেলে পড়ে গিয়ে তার হাত ঝলসে যায়। বহু জেলায় সেলুন-রেষ্টুরেন্টে প্রবেশাধিকার নেই, স্কুল-কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হতে পারেনা, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের শশ্মানে সৎকার হয় না, যানবাহন থেকে শুরু করে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুইপার-মেথর বলে লাঞ্চিত হতে হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনার এমন ঘটনা মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন বললেও এই বৈষম্য দূরীকরণে আইনি পদক্ষেপ কিংবা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের উদ্যোগ নজরে পড়েনি। বরং পাল্টা অভিযোগকে এই সমাজে টিকিয়ে রেখে ‘নিজেদের পাল্টাও’ বলে এই ঘোরতর অপরাধকে অস্বীকার করার ঝোঁক দেখা যায়। আমাদের সাথে এরকম নির্মম-অমানবিক বর্ণবাদী কর্মকা- প্রতিনিয়ত ঘটছে। বৈষম্য দূরীকরণে এনজিওদের পৃষ্ঠপোষকতা করে নিজের দায়িত্বকে আড়াল করার কৌশল অবলম্বন করেছে সব সরকার।
বহু জেলায় সেলুন-রেষ্টুরেন্টে প্রবেশাধিকার নেই, স্কুল-কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হতে পারেনা, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের শশ্মানে সৎকার হয় না, যানবাহন থেকে শুরু করে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুইপার-মেথর বলে লাঞ্চিত হতে হয়।
বিগত সরকারের সময়ে “বৈষম্য বিরোধ বিল-২০২২” নামে একটি বিল ২১তম সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়, যাতে মানব সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিতকরণ এবং সমানাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হরিজন-দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিরোধী। বৈষম্যকে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত না করে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাপূর্ণ এই বিল সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২য় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা বহুপূর্ব থেকেই বৈষম্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাধীন কমিশন ও হরিজন-দলিতদের স্বার্থ রক্ষায় বৈষম্য “বিলোপ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন” করার দাবি জানিয়ে আসছি।
দীর্ঘকাল ধরে রেল লাইনের ধারে, মেডিকেলের পাশে, সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভা, হাট-বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি খাসজমিতে আমরা বংশ পরাম্পরায় বসবাস করে আসছি। ভূমির উপর আমাদের নিজেদের কোন অধিকার না থাকায় কখনো সরকারের নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কাজে আবার কখনো প্রভাবশালীদের ভূমি দখলের ফলে অনেকটা যাযাবর জীবন কাটাতে হয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকার আমলে তৈরিকৃত কলোনিগুলোর অবস্থা অবাসযোগ্য। বিগত সরকার বিভিন্ন জেলায় হরিজন-দলিতদের আবাসন সংকট নিরসনে বেশ কিছু পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিবাস, সেবক কলোনি নামে বিল্ডিং তৈরি করেছে। এটা লোক দেখানো মাত্র। এর মধ্য দিয়ে বাস্তবে সংকট কমেনি বরং বেড়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে রেল লাইনের ধারে, মেডিকেলের পাশে, সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভা, হাট-বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি খাসজমিতে আমরা বংশ পরাম্পরায় বসবাস করে আসছি। ভূমির উপর আমাদের নিজেদের কোন অধিকার না থাকায় কখনো সরকারের নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কাজে আবার কখনো প্রভাবশালীদের ভূমি দখলের ফলে অনেকটা যাযাবর জীবন কাটাতে হয়।
১০/১০ বা ১০/১২ বর্গফুট এর একটিমাত্র ঘরের মধ্যে তিন প্রজন্মের ৯-১০ জন লোককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এরই মাঝে ছেলেকে বিয়ে করালে বা অতিথি এলে মাঝখানে কাপড় বা পর্দা টানিয়ে অথবা রান্নাঘরে ঘুমাতে হয়। ১০-১২টি পরিবারের জন্য একটি বাথরুম, একটি টয়লেট। লাইনে দাঁড়িয়ে সারতে হয় গোসন ও টয়লেটের কাজ। এই দুর্বিষহ জীবনে মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁইটুকুও আবার কেড়ে নেয়া হয় নানাছলে। সিটি কর্পোরেশন অথবা সরকারের পক্ষ থেকে নির্মাণ করে দেয়া বহুতল ভবনে শুধুমাত্র কর্মরত কর্মীরাই থাকতে পারবে। বাকিদের ঘর ছাড়া হতে হচ্ছে। চলছে এসব নিয়েও অনিয়ম-দূর্নীতি। আবার অনেকে চাইলেও এলাকার বাইরে থাকতে পারছে না। খাওয়ার কিংবা গোসলের পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থার অভাবে অমানবিক জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। একই অবস্থা টিনশেড, কাঁচাপাকা বা বহুতল সব কলোনিগুলোতে। ফলে অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশে বেড়ে উঠছে শিশুরা। প্রতিনিয়ত রোগাক্রান্ত হচ্ছে নারী-শিশু-বৃদ্ধরা।
১০/১০ বা ১০/১২ বর্গফুট এর একটিমাত্র ঘরের মধ্যে তিন প্রজন্মের ৯-১০ জন লোককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এরই মাঝে ছেলেকে বিয়ে করালে বা অতিথি এলে মাঝখানে কাপড় বা পর্দা টানিয়ে অথবা রান্নাঘরে ঘুমাতে হয়। ১০-১২টি পরিবারের জন্য একটি বাথরুম, একটি টয়লেট।
দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভা, হাট-বাজার-অফিস-আদালত, মার্কেট-ক্লিনিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতা কাজে লক্ষ লক্ষ পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিযুক্ত আছে। অথচ কোন সরকারই এই শ্রমের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করেনি। আমরা যে বেতন পাই তা বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারের সাথে খুবই অসংগতিপূর্ণ। কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি- মৌলভীবাজার পৌরসভায় ঝাড়ুদার কর্মীরা এখনো ৫০০ টাকা বেতন পায়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার পায় ৪০০০/-টাকা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার ৫৫০০ টাকা পায়, যার দিন হাজিরা ১৮৩টাকা মাত্র। অন্যদিকে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার পায় ৫৩০০/-টাকা, রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার পায় ২,৪৫০/-টাকা, ভ্যান ও ড্রেন কর্মী- ৩০০০ টাকা। যার দিন হাজিরা ৮১ টাকা থেকে ১০০ টাকা মাত্র। এর মধ্যে কারণে-অকারণে চলে হাজিরা কাটা। ফলে প্রতিদিন ১০/১২ ঘন্টা গ্রাম-শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজতে হয়। আবার কেউ কেউ ৩/৪টি প্রতিষ্ঠানে অমানুষিক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই অল্প টাকার বেতনে পুষ্টিকর খাবার, সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা খরচ যোগানো কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। আবার সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভায় স্থায়ী চাকুরি না হওয়াতে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামত ছাঁটাই-বহাল রাখার অনিয়ম চলছেই। রাত্রিকালীন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি আমরা। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। ফলে হাজার হাজার নারী ঝাড়ুদারকর্মী এই বিশেষ সময়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। অবসর ভাতা না থাকায় বৃদ্ধ বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করতে হয়। বেশিরভাগ পৌরসভাতে উৎসব বোনাস, অবসর ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে নিয়োজিত পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কোন প্রকার নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকায় অল্প বয়সে নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
মৌলভীবাজার পৌরসভায় ঝাড়ুদার কর্মীরা এখনো ৫০০ টাকা বেতন পায়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার পায় ৪০০০/-টাকা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ঝাড়ুদার ৫৫০০ টাকা পায়, যার দিন হাজিরা ১৮৩টাকা মাত্র।
শিক্ষা ক্ষেত্রে হরিজন-দলিতরা সর্বাধিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা বাইরে হরিজন দলিত ছাত্রদেরকে অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্ররা সাধারণত বিদ্রূপ ঘৃণাসূচক মনোভাব প্রকাশ করে। এক বেসরকারি জরিপ থেকে জানা যায় যে স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে এখনও ১০০ জনের মধ্যে ২১ জন তীব্র বৈষম্য, ২৭ জন মাঝারি বৈষম্য ও ৩৪ জন কম বৈষম্যের শিকার। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও পাড়ায়-মহল্লায় শিক্ষার হার বাড়ছে। মা-বাবার সচেতনতার কারণে প্রাইমারীতে ও নি¤œ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিশুরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ৭০% শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়ছে। কলেজ পর্যন্ত পড়ার হার ২৫-৩০%। বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং, ওকালতি, ডিপ্লোমা ইঞ্জিয়ারিং, ডিগ্রি পড়ার হার ১০-১৫%। ফলে বাড়ছে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম। বাড়ছে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, সামাজিক বৈষম্য, মাদকাসক্তি, অপসংস্কৃতির প্রভাব। একটি দেশের নাগরিককে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য। এখানে রাষ্ট্রের উদ্যোগে অবৈতনিক শিক্ষা চালু, সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ, সকল শিক্ষার্থীকে শিক্ষাভাতার আওতায় আনা এবং কাজের ব্যবস্থা করে মূলধারামুখী করতে হবে।
এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার দ্বার কতটুকু উন্মুক্ত তাও ভেবে দেখা দরকার। দেশে ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোটা আছে। ফলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা দরকার। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ভিন্ন পেশায় চাকুরির জন্যও কোন সরকারি চাকুরিতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেকেই চাকুরী প্রতিযোগিতায় মূলধারার সাথে টিকতে না পেরে আদিপেশায় যুক্ত হচ্ছে, অথবা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকে। এতে পাড়াগুলোতে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পরে।
….সংবিধানে বলা আছে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের চোখে সমান। কিন্তু যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারাই হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করেছে অথবা আড়াল করেছে। সরকারের সুদৃষ্টি, মানবিকতা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর জীবন-মান আজও দুর্বিসহ। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ খুবই কম। …১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে ঢাকার মিরিনজিল্লা কলোনির দশজন হরিজন শহীদ হয়। ২২ নভেম্বর গভীর রাতে পাক-হানাদার বাহিনী মিরিনজিল্লা কলোনির সামুন্দ লাল, মহাবীর লাল, ঘসিটা দাস, আনবার লাল, খালবাল দাস, নান্দা লাল, লালু দামানকার, ঈশ্বর লাল, নান্দু লাল ও সংকর দাসকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়, পরবর্তীতে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তাদের লাশ পাওয়া যায়। চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জসহ নাম না জানা আরও অনেক জায়গায় হরিজন-দলিতরা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলে তাদের অবদান লিপিবদ্ধ হলেও মিলেনি রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা। নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য কমলেই কেবল সামাজিক বৈষম্য কমবে।
চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জসহ নাম না জানা আরও অনেক জায়গায় হরিজন-দলিতরা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলে তাদের অবদান লিপিবদ্ধ হলেও মিলেনি রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা। নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য কমলেই কেবল সামাজিক বৈষম্য কমবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাই আজকের এই সেমিনার থেকে আমরা নিম্নোক্ত দাবি তুলে ধরছি-
১. বৈষম্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাধীন কমিশন ও হরিজন-দলিতদের স্বার্থ রক্ষায় “বৈষম্য বিলোপ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল” গঠন করতে হবে।
২. অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোটা এবং উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সরকারি সকল পেশায় সম-অধিকার নিশ্চিত করতে বিশেষ কোটা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. সারাদেশের সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা, হাট-বাজার-মার্কেট-ক্লিনিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন বৃদ্ধি ও চাকুরি স্থায়ীকরণ করতে হবে। সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, উৎসব বোনাস, অবসর ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে হবে।
৪. সরকার কর্তৃক খাস জমিতে হরিজন জনগোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। ১শ/২শ বছরের পুরাতন জায়গা বসবাসরত হরিজন-দলিতদের নামে দলিল করে দিতে হবে। পূর্ণবাসন না করে উচ্ছেদ করা যাবে না।
৫. দেশে বসবাসরত হরিজন জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
৬. মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হরিজন-দলিতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং শহীদ পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
৭. জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৮. একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগে জাত হরিজনদের জন্য ঘোষিত ৮০ ভাগ কোটা বাস্তবায়ন করতে হবে।