জোনাস মেকাস এর ওয়ালডেন-এ চিত্রিত আমেরিকান ড্রিম/মার্কিন স্বপন
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

আমি কিছু খুঁজিনা, আমি সুখি।
-জোনাস মেকাস (ওয়ালডেন সিনেমা থেকে)।
সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য
ওয়ালডেন | পরিচালক ও প্রযোজক: জোনাস মেকাস | কণ্ঠ ও মূল চরিত্র: জোনাস মেকাস | চিত্রায়ন ও সম্পাদনা: জোনাস মেকাস | শব্দ ও সঙ্গীত: জোনাস মেকাস ও জন কেল | পরিবেশনা: দ্য ফিল্ম-মেকার্স কোঅপারেটিভ | প্রকাশের তারিখ: ১৯৬৮ | দৈর্ঘ্য: ১৭৭ মিনিট | দেশ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র | ভাষা: ইংরেজি।
জোনাস মেকাস
২০১৯ সালের ২৩ শে জানুয়ারি জোনাস মেকাস নিউ ইয়র্ক শহরে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ১৯২২ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর লিথুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯৪৯ সালে আপন ভাইয়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে আগমন ও পরিবার-সন্তানাদিসহ আমৃত্যু বসবাস করেন। তিনি ৬৮ মতান্তরে ৫৯ সংখ্যক সিনেমা রেখে গেছেন, যদিও এখনো অবধি তার অনেক সিনেমার উল্লেখ উইকিপিডিয়া বা আইএমডিবিতে নেই। তিনি অসংখ্য ফটোগ্রাফ, চিত্রিত-লিখিত ডায়েরি, কবিতা, শিল্পকর্ম এবং দুই মহাদেশব্যাপী বিশাল যাপিত জীবনের গল্প রেখে গেছেন। তাকে আমেরিকান আভাগার্দ সিনেমার গডফাদার বলা হয়। তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্প সম্পর্কিত এবং তার কর্মের সম্প্রসারণমূলক ও সহযোগিতামূলক নানাবিধ অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান, তথা অ্যান্থলজি ফিল্ম আর্কাইভ, দি ফিল্মমেকার্স কো-অপারেটিভ এবং ফিল্ম কালচার জার্নাল ইত্যাদি ইত্যাদি। তার সিনেমার “আমেরিকান ওয়ে অফ লাইফ”য়ের প্রদর্শন একধরণের “আমেরিকান ড্রিম”য়ের/মার্কিন স্বপনের প্রতিনিধিত্বশীল উপস্থাপন ধরা হয়েছে কারণ মার্কিন স্বপন যে সকল স্বপ্ন দেখায় তার বাস্তব প্রয়োগভূমি মূলত আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র এবং সেখানকার মানুষের যাপিত জীবন। ফলে তার নির্মিত “ওয়ালডেন” সিনেমায় প্রদর্শিত যাপনকে মার্কিন স্বপনের একধরণের বাস্তব প্রয়োগকৃত ফলাফল ধরে সে যাপনকে “আমেরিকান ড্রিম/মার্কিন স্বপন” হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। যে স্বপনের প্রচার-প্রসারের জোয়ারে বান ডেকেছিল ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়। জোনাস মেকাস মূলত নিউইয়র্ক শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের গল্প, প্রামাণ্যচিত্রের ধরণে কিন্তু হুমায়ূন আহমেদীয় কায়দায়, একই ফর্মুলায় একই গল্প নাম বদলে, বা কখনো কখনো একই নাম-ধামের ধারাবাহিকতা ধরে একের পরে এক পরিবেশন ও উপস্থাপন করেন।
মজা হচ্ছে তার সিনেমার চরিত্রেরা বানানো নয় বরং রক্তমাংসের মানুষ এবং পর্দার প্রদর্শিত ঘটনা মার্কিন (আংশিক) বাস্তবতা। পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র হয়েও নির্মাণ কৌশল ও উপস্থাপনের ধরনের ফলে তার সিনেমায় একসময় নির্মাতা-দর্শক ব্যবধান মুছে যেয়ে মনে হতে পারে ক্যামেরা স্বয়ং (দর্শকের) নিজের হাতে (বা) তিনিই নির্মাতা আর ক্যামেরা না চলে জীবনের ছন্দে নাচছে! সাথে রঙ হিসেবে পর্দায় যা যা দেখা যায় তা আমাদের নিজস্ব স্বপ্ন-কল্পলোকের আস্বাদ দেয়, মোহিত করে জীবনের রঙে। আমরা নানা মানুষ দেখতে দেখতে তাদের নিজের মতো করে ভেবে নেয়ার সুযোগ পাই, ব্যাখ্যা করতে পারি। ধরে নেই, নিজেই স্বয়ং প্রতিভূ ও কেন্দ্র, বাকিসব প্রান্তিক! আর মার্কিন স্বপনের কেন্দ্রীয় ভাব-ভাবনাও সমরূপ। শব্দ নকশায় ১৬ মিলিমিটারের প্রজেকশনের খুব ফেটিশ ধরনের শব্দ, যথাযথ সঙ্গীত, সাথে সাথে তার খুব হিসেবি শারীরিক উপস্থিতি ও স্বগতোক্তি আমাদের চুরি করে দেখার আনন্দ ও মনে মনে ইচ্ছাপূরণ কল্পনার পাখনা মেলার সুযোগ করে দেয়। তার সিনেমার অন্যের অতিপ্রকাশ দর্শন, নিজেকে লুকিয়ে ফেলার আনন্দ দেয়। আমরা শ্রেণিস্তর ভুলে আলোচিত “ওয়ালডেন” সিনেমায় “মার্কিন স্বপন” হিসেবে একটা খণ্ডিত মধ্যবিত্ত যাপনকে আদর্শ হিসেবে দেখতে থাকি দশকের পর দশক ধরে। যেখানে রোগশোক, অর্থনৈতিক-সামাজিকসহ ব্যক্তিগত সমস্যারা খুব মিহিসুরে লুকানো থাকে সবকিছু “উদযাপন”য়ের মার্কিন স্বপনের রাজনীতি পরিবেশনার ভিতর দিয়ে। এসবের সমান্তরালে চলতে থাকে মার্কিন স্বপন তাড়িত “নায়ক” জোনাসের জীবন ও সিনেমা নির্মাণের। কিন্তু তার যাপিত জীবন ও ভাবের বিশেষ “ওয়ালডেন” সিনেমায় অনেক স্থান, ভাব ও ব্যক্তির উল্লেখ থাকলেও বাসা ভাড়া, খাবারের-পোষাকের দাম, দামী পার্টি ও গ্যালারির দাওয়াতের জীবনযাপনের খরচ, সিনেমা বানানোর খরচের সংস্থান কীভাবে হয় তা প্রদর্শিত হয়না। তার আয়ের উৎসসহ অনেককিছু সিনেমায় সবসময় রহস্যময় থেকে যায় যা একধরনের অসমঊর্ণতা তৈরি করে! তাহলে কি ধরা যায় ফুলানো-ফাপানো মার্কিন স্বপনের উল্লেখের বাইরের চিত্র খুব নির্মম ও কদর্যতায় মাখানো যা সিনেমায় প্রদর্শিত অতি ফাপানো মার্কিন স্বপনের পাশেও বেমানান, অন্যায্য ফলত উল্লেখ করা যায়না, প্রদর্শন করা যায়না, ঢেকে লুকিয়ে রাখতে হয় সবার দৃষ্টির অন্তরালে? সংস্কৃতির এমন বেড়াজালে মার্কিন স্বপনের দুনিয়াময় আজরাইলরূপ এবং নিজ ভূখণ্ডের ভিন্নমত ও পথ নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় দমন-মামলা-হামলা চললেও সেসবের খতিয়ান আড়াল থেকে যায় (দেশ-বিদেশে মার্কিন হত্যা-নিপীড়ন নতুন কিছু নয় শুধুমাত্র পুঁজিবাদী শিক্ষার/কথার চালে পা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র -ইসরায়েলের দোস্তি এবং শত বছরব্যাপী ফিলিস্থিনি গণহত্যা সম্পর্কে ভাবেন, অনুসন্ধান জারি রাখেন, উপলদ্ধি করবেন।) ।

বাংলার বাতাসে উড়ে বেড়ানো মার্কিন স্বপনের সুবাস
বিটিভিতে নানান ধারাবাহিক সিরিজ ও সিনেমা প্রচারের ফলে আমেরিকান যাপনের/স্বপনের সাথে মানুষের আগে থেকেই খানিক জানাশোনা ছিল। তবে বাংলার সাধারণ মানুষ ৯০ এর দশকে ডিভি লটারির মাধ্যমে সরাসরি মার্কিন দর্শন ও বাসের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার সুযোগ পায় যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে মার্কিন স্বপনের সুবাস বাংলার (প্রায়) ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তারপর নানা পন্থায় বাংলাদেশি আপামর আস্তিক-নাস্তিক, সমকামী-বিপরিতকামী (সহ মাঝের সবাই), কাউরো মার্কিন দেশে গমন ও বসবাসে কোনোপ্রকার অনীহার কথা শোনা যায় না। আবার একদল মার্কিন ডলার ও সেদেশে বাসের স্বপ্নের সাথে সাথে শুক্রবার জুম্মা নামাজের পরে মার্কিন-ইসরায়েলের পতাকা পোড়ায় নানা আন্দোলনকর্মের ফলাফল ও প্রদর্শনকাণ্ড হিসেবে। বাংলায় কারো খানিক অর্থ জমলেই তা টাকা থেকে রূপান্তরিত হয়ে দ্রুত ডলার হয়ে বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা হয়ে যায়, লন্ডন ও কানাডার “বেগম পাড়ায়” বাড়ির পরে বাড়ির মালিক বনে যায় বাংলাদেশিগণ! কোনো বড় অপরাধ করে গা ঢাকা দেওয়ার নিরাপদ গন্তব্য আমেরিকা। দেশি বিগতবাজার ধনী তারকাগণ অর্থসহ, সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে অবসর জীবন ও বাচ্চাদের বড় করার জন্য বেছে নেন সে দেশ! কিন্তু বাংলার প্রান্তিক মানুষের জন্য সেদেশে গমন, মার্কিন স্বপন আর বেহেশতে গমনে বোধকরি কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু মার্কিন পণ্য-স্বপ্ন-সাধ দোকানে দোকানে নানা নামে বহাল তবিয়তে বিরাজমান।
অর্থ ও বস্তু কেন্দ্রিক প্রদেয় সুবিধা এবং বিজ্ঞাপনের মতো সব পাওয়ার আশ্বাসের সমন্বয় হচ্ছে মার্কিন স্বপন এবং সেদেশে যাওয়ার মূল অনুপ্রেরণা। সহজভাবে বলা যায় কারো কথা কিছু ভাবনায় না রেখে আত্মকেন্দ্রিকভাবে শুধু নিজে বড় হওয়ার এবং সব পাওয়ার আশ্বাসের ভাবনাহীন যাপন হচ্ছে মার্কিন স্বপন। যেখানে যাবার ও বসবাসের অভিপ্রায়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, নিঃস্ব হয়, বেছে নিতে বাধ্য হয় বিপদজনক পথ ও পেশা। এমন মারাত্মক স্বপন বিষয়ক অনেক বইপত্র-শিল্পকর্ম ও বাহাস রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় হালের সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ২০০৬ সালে প্রকাশিত মার্কিন স্বপন বিষয়ক রচিত বইয়ের কথা, ফলে সহজে অনুমেয় আলোচিত বিষয়ের ক্ষমতা এবং জনপ্রিয়তার ব্যাপকতা। হলিউড যেমন নিয়ম করে কোটা প্রথার মতন ইহুদিদরদী সিনেমা বানায় প্রতিবছর, তেমনি কোটার আরেক বড় অংশ পূরণ করা হয় “মার্কিন স্বপন” সম্পর্কিত সিনেমা দিয়ে। স্বাধীন ধারার নানা মাধ্যমের যেসব কর্ম রয়েছে সেসবেরও বড় একটা অংশের বিষয় এসবের খুব ব্যতিক্রম নয়, মার্কিন স্বপনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ইহুদি দরদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ওয়ালডেন সিনেমায় এমন মার্কিনি স্বপ্নজাত দর্শন উদ্ভূত জীবনযাপন বিজ্ঞাপনের মতো করে সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে প্রদর্শিত হয়।
মার্কিন স্বপন পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতির সামাজিক জীবন যাপন প্রথার “ঝুলানো মূলা” যা গণতান্ত্রিক বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। যেখানে স্বপ্ন দেখানো হয় সকল ব্যক্তির (পুঁজির) সর্বোচ্চ স্বাধীনতার, সফলতম ভালো (ব্যবসায়িক) জীবন যাপনের। ব্যক্তির (পেশাগত সফলতার) বিকাশে সামজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, নৈতিকসহ সকল বাধা অপসারন। মানুষ শুধু চারপাশে নানান ভোগ্যপণ্য ও বস্তুনির্ভর ভাবনাহীন/প্রশ্নহীন সুখী জীবন যাপন করে যাবে। বেশি বেশি সুখ, ভাবনাহীনতা, ভোগ, (পণ্য কেনার) স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অফ চয়েস, (নির্দেশিত, বিজ্ঞাপায়িত কথা নিজের ইচ্ছে মতো করে বলার) বাক-স্বাধীনতা, (অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী) সবার সমান অধিকার, ও (সম্পদ অনুযায়ী) নানাবিধ সুযোগ এসব মোটামুটি গোঁড়ার মূল কথা (সীমাবদ্ধ) মার্কিন স্বপনের! কিন্তু স্বপ্নের মতো এরকম যাপন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একটা অর্থনৈতিক শ্রেণির মানুষেরা যাপন করতে পারে। নিম্ন আয়ের অর্থনৈতিক শ্রেণির খোদ মার্কিনি নাগরিকেরাও এ স্বপনের অংশীদার নন। যাদের অধিকাংশের কেউ কালো, কেউ বাদামি, কেউ আরবের, কেউ বাংলার এবং কেউ নানান ধরনের প্রান্তিক যাপন, যৌনতা ও ভিন্ন মতের মানুষ। কখনো কারো কারো ভাগ্যে স্বপনের শিকা ছিঁড়লেও সাধারণ অনেক মানুষ কর্মহীন, অর্থহীন, গৃহহীন, সম্পদহীন ও সুবিধা বঞ্চিত। সম্পদহীন এসব মানুষের জন্য “মার্কিন স্বপন” সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবে হাজির থাকে যেখানে কালো ও অন্যান্য জাতির মানুষদের সাথে বর্নবাদী, পক্ষপাতমূলক আচরন করা হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কঠোরভাবে দমন করা হয় ভিন্নমতের। সাংস্কৃতিক-সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানাধরনের “শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব”বাদী মনোভাবের চর্চা করা হয়, সাথে সাথে “ডাইনি নিধন” হিসেবে চলতে থাকে ইসলাম ও হোমোফবিয়া এবং গর্ভপাত বিরোধী, বিজ্ঞান বিরোধী নানান প্রচারণা, কর্মকাণ্ড। মার্কিন স্বপনের নানান ভয়াবহতম বিপরীত চিত্র তুলে ধরে সেখানকার ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রীট আন্দোলন। যেখানে আওয়াজ তোলা হয়েছিল সম্পদ বণ্টনের। চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলা হয়েছিল মার্কিন দরিদ্র ৯৯% মানুষের হাতে রয়েছে ১% সম্পদ, আর শীর্ষ ১% ভাগ ধনীর নিকট কুক্ষিগত ৯৯% সম্পদ, সাথে সাথে দাবী জানানো হয়েছিল মার্কিন স্বপনসৃষ্ট পাহাড় সমান আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য, শ্রেণি-বৈষম্য কমানোর জন্য! পরিস্থিতি তথৈবচ।
হাজারো মানুষের স্রোতের সাথে জোনাস মেকাসও লিথুনিয়া থেকে (মার্কিন স্বপনের টানে), ভালো জীবন যাপনের আশায় আমেরিকায় অভিবাসন-নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তার চোখে মার্কিন দেশের শ্রেণি বৈষম্য খুব আলোকপাত করেনি, তিনি হয়তো শুধু নিজের বদলানো ভাগ্য নিয়ে আলোড়িত হয়ে থেকেছেন সারা জীবন (কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেঁচে গেছেন তিনি!)। নিষ্ঠার সাথে যাপন করেছেন উদার পুঁজিবাদী রাজনৈতিক জীবন এবং এই রাজনৈতিক ফর্মুলার শিল্প, স্বাধীনতার মাপকাঠি অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন (তথাকথিত) অরাজনৈতিক আমেরিকান যাপন বা মার্কিন স্বপন। যেখানে কেউ বলতে পারে, সে কিছু খোঁজেনা এবং সে সুখি, মানে না খুঁজে সুখি বা তার খোঁজার দরকার নাই! বিপদ হচ্ছে এই না খোঁজার সুখ খুব কারখানাজাত পণ্য নির্ভর আর এই ভাবনাহীন সুখের জোগান পৃথিবীর প্রান্তিক অংশের প্রান-প্রকৃতি ধ্বংস করে, কোনো প্রান্তিক জনগনের শোষণকৃত শ্রমের মাধ্যমে তৈরি। ফলে, মুষ্টিমেয়র মার্কিন স্বপন সারা দুনিয়ার জন্য স্বপ্ন না হয়ে দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। পণ্যের শ্রম-শোষিত উৎস এবং পরিবেশ বিপর্যয়কর চূড়ান্ত ফলাফল লুকিয়ে ভাবনাহীন যাপন নিশ্চিত করা হয় কারণ ভাবনার এবং সামগ্রিক সহজ কৌতূহল ও প্রশ্ন মার্কিন স্বপনের জন্য লালবাতি বিপদ সঙ্কেত।

মার্কিন স্বপনের বিজ্ঞাপনীয় আশাবাদী যাপনচিত্র জোনাস মেকাসের ওয়ালডেন
জোনাস মেকাস ৬০ এর দশকে অর্থের সংস্থান অনুযায়ী নানা ধরনের ফিল্ম দিয়ে নানা স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানাচ্ছিলেন “হরে কৃষ্ণ”, “ক্যাসিস”, “সার্কাসের নোট”, “মিলব্রুক থেকে রিপোর্ট” ইত্যাদি ইত্যাদি নামে। কাজ থেমে থেমে আগাচ্ছিল, এসময় আলব্রাইট-নক্স আর্ট গ্যালারীর প্রায় দুই হাজার ডলারের একটা তহবিল কাজের গতি সঞ্চার করে। দশ মাসে কাজ সম্পূর্ণ করার অধীনে ১৯৬৮ সালে ওয়ালডেন সিনেমার প্রথম কাট প্রদর্শন করা হয় উক্ত গ্যালারীর জন্য। কিন্তু চূড়ান্ত পোষ্ট-প্রডাকশনের কাজ চলতে চলতে ১৯৬৯ সালে সিনেমার ১৭৭ মিনিটের সম্পূর্ণ রূপ সবার প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত হয় “ডায়েরি, নোট এবং স্কেচগুলো (ওয়ালডেন নামেও পরিচিত)” নামে। যে সিনেমায় ভিসুয়াল ডায়েরির আকারে চিত্রায়িত হয়েছে জোনাস মেকাসের বিগত বছরগুলোর জীবনযাপন, তার জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ন ঘটনাবলী, বন্ধু বান্ধবের সাথেকার দেখা সাক্ষাৎ, নিউইয়র্ক শহরের ঋতু বদল ইত্যাদি ইত্যাদি। ওয়ালডেন সিনেমা মার্কিন স্বপনের জীবনযাপনের প্রধানতম বিষয় হিসেবে বিয়ে, খাবার-দাবার, যত্রতত্র ঘোরাঘুরি, ফ্ল্যাটের ভিতরকার পারিবারিক আবহ, টবের ফুলগাছ, জানালার আলো, বাচ্চাদের খেলাধুলা-কর্মকান্ড, সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, লেকের বোট, মানুষজনের গোসল-সাঁতার, হাঁটাহাটি, কুকুর, বিড়াল, ফুল লতা পাতার ভিতরে নানা ধরনের “লুক” দিতে থাকা পার্ক বেড়ানো স্বর্ণকেশি এক ললনা, হইহুল্লোড়, পানাহার, নিউইয়র্ক শহরের মানুষজন, প্লাকার্ড হাতে আন্দোলনকারী, সার্কাস, শিল্পী বন্ধুবান্ধব, পারিবারিক লোকজন, হরে-কৃষ্ণ কীর্তন দল, জন্ম-বিয়ে-খাবার-দাবার, মাঝে মাঝে জোনাস স্বয়ং এবং খেলাধুলাসহ সমরূপ বিষয় সমূহের পুনরাবৃত্তিময় ব্যবহার সিনেমা আখ্যান হিসেবে উপস্থাপন করে। মূলধারার সিনেমায় যেমন জায়গার নাম বদলিয়ে চিত্রনাট্যের নির্বাচিত নাম বসিয়ে দেয়া হয় তেমন জোনাস উল্লেখিত সিনেমায় নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কের লেকের নাম “ওয়ালডেন” হিসেবে উল্লেখ করেন। তার মনে হয়তো ডেভিড হেনরি থরোর সমনামের বই (ওয়ালডেন, ১৮৫৪) বা বর্নিত পুকুরের/লেকের কথা মনে হয় বা থরোর মতো পাশের কাঠের কেবিনে বসবাসের বাসনা জাগে। নামকরণের ভিতর দিয়ে তিনি এসবসহ আরেক আমেরিকান বড় শিল্পীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, নিজ অবস্থান পরিষ্কার করে যোগাযোগ-সংযোগ প্রত্যাশা করেন।
জোনাস নিউইয়র্ক নগরীতে ৬০র দশকে ধারন করেন তার চারপাশের (নির্বাচিত) উদার পুঁজি বিকশিত, সচ্ছল-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল সমাজের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আবহ। অংশগ্রহণ, পর্যবেক্ষণ, চলচিত্রায়ন করতে থাকেন উন্মুক্ত বাজার কেন্দ্রিক অর্থনীতির গৃহ-ব্যক্তিগত পরিসর যা “ওয়ালডেন”য়ের পরেও চলমান ছিল কয়েক দশক ধরে তার মৃত্যু অবধি। উল্লেখিত সিনেমায় প্রদর্শিত জীবন খুব আশাবাদী, উজ্জ্বল ও (আরোপিত) আলোকময় দেখায়। যেখানে খাবারের টেবিল ভরা থাকে খাবারে, মানুষজন শিক্ষিত, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে অফিসে যায়। সুন্দর সুন্দর স্বাস্থ্যময় শ্বেতাঙ্গ বাচ্চারা হেলে দুলে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝেই শিল্প সাহিত্যের মানুষের সঙ্গ, উদার প্রকৃতির বিশাল ভুগোলের আমেরিকায় শহরের মাঝে বসে প্রকৃতি বন্দনা, ভাসা ভাসা কাব্যিক দার্শনিকতা, শীতের মাঝে আকস্মিক বসন্তের আবহাওয়া বিরাজ করলেও নির্বিকার থাকা, পার্কে বেড়ানো এবং খাবার-দাবারে ভরপুর সুখি সুখি ভাবনাহীন যাপন। মানুষের সাধারণ যাপনের এরূপ ইতিবাচক মার্কিন স্বপনের চিত্র দেখায় ওয়ালডেন।
(নিজ বা আরোপিত) সম্পাদনাগুনে (দৃশ্য ধারনের সময় বা সম্পাদনা টেবিলে) ৬০য়ের দশকে ঘটে চলা গণ-আন্দোলনের তুমুল নিউইয়র্ক সেখানে নেই, মিছিল নেই, হাজারো গৃহহীন, নেশাখোর, নানান জেন্ডারের যৌনকর্মীরা নেই, রাশিয়া-আমেরিকার ঠাণ্ডা-যুদ্ধ নেই, সমাজতন্ত্র বিরোধী আগ্রাসী নানাবিধ আক্রমণ নেই, যেন ওয়ালডেনে প্রদর্শিত চিত্রের “ফিলিং গুড”য়ের বাইরে কিছু নেই! মাঝে মাঝে ভোগ্য-পণ্যময় জীবনের অংশ হিসেবে ওয়ালডেনে প্রদর্শিত পরিবেশ বন্দনা একসময় একরকমের “ফিলার” বলে বোধহয়, যেখানে পরিবেশ সচেতনতা, সহমর্মিতা নেই। জন ওয়াটারের সিনেমা প্রদর্শন করতে যেয়ে মার্কিন স্বপনের যে আইনি ও নৈতিকতার বেড়াজালে তিনি পড়েছেন সেসব (নিজ গল্পও) কোথাও নেই! বাস্তবতা হলো মার্কিন স্বপনসৃষ্ট এরূপ ফলাফল খোদ মার্কিন স্বপন নিজেও অস্বীকার করে, এড়িয়ে যায়, দমিয়ে অদৃশ্যমান করে রাখার চেষ্টা করে সর্বত্র। জোনাসও তার মার্কিন স্বপন নির্মাণে সমভাবে এসব বিষয় না দেখিয়ে এড়িয়ে যান, ঢেকে রাখেন। ফলে, তার “ওয়ালডেন” সুদূরপ্রসারী ও সূক্ষ্মভাবে মার্কিন যাপনের/মার্কিন স্বপনের একধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রপোগান্ডার কাজ করে “শিল্প” হিসেবে! ভেবে দেখুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় রাশিয়া-আমেরিকা দুদেশই উঠে পড়ে লেগেছিল তাদের ইতিবাচক “ভাবমূর্তি” নির্মাণের এবং এজন্য তারা বিশাল পরিমাণের বিনিয়োগ করেছিল প্রপাগান্ডা শিল্প-সাহিত্যের জন্য! ফলশ্রুতিতে সময়জ্ঞান ধরে বলা যায় যখন তিনি আমেরিকাকে মুক্ত উজ্জ্বল আলোর বাতাসে ভাসাচ্ছেন তা শুধু তার ব্যক্তিগত ভাবালুতা ভাবা ভুল ও আংশিক সিদ্ধান্ত হবে বরং তার উক্ত কাজের উপাদান-বক্তব্য-দর্শন ও মার্কিন স্বপনের তৎকালীন প্রপোগান্ডার উপাদান-বক্তব্য-দর্শনের সমরূপতা আমাদের ভিন্ন ভাবনার অবকাশ দেয় (তিনি হয়তো সরাসরি যুক্ত না হলেও প্রভাবিত হয়েছিলেন!)। ফলত “মার্কিন স্বপন”য়ের প্রতিনিধিত্বশীল কর্ম হিসেবে ধরে (নিয়ে এবং “ওয়ালডেন” ও জোনাস সম্পর্কিত অন্যান্য মতামত ভাবনায় রেখে) “ওয়ালডেন”য়ের তুলনামূলক পাঠ-বিচার-বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিবেচনাবোধের পরিচয় ও সময় উপযোগী হবে।

পরিশেষ
জোনাস মেকাস এমন এক স্বপ্ন দেখা অভিবাসী যে নতুন ভূমি আমেরিকাকে সজাগ ও সঙ্কোচহীন থেকে অধিকার করে নিতে চায়, হজম করতে চায় এবং নিজের ভঙ্গীতে তত্ত্বায়িত করে মার্কিন স্বপনকে যাপন-উপস্থাপন করতে চায় নিরন্তর। ফলে অভিবাসী আমেরিকান হয়েও তার গল্পে “অভিবাসী প্রান্তিকতা” নেই বরং সে নিজেকে মূলধারা মনে করে “হতে” না চেয়ে। মার্কিন স্বপনজাত মূলধারার হলিউড মার্কা ফর্মুলা সহজে বাতিল করে বিপরীত ধরনের চলচ্ছবি হাজির করেন খোদ মার্কিন মুল্লুকে বাস করে। ওয়ালডেনসহ তার অন্য যে সিনেমাগুলোকে আভাগার্দ ও ডায়েরি ফিল্মের তকমা দেয়া হয় সেখানে খুব সরলভাবে সিনেমা নির্মাণের পশ্চিমা রীতি অস্বীকার করে প্রচলিত “সিনেমা” বানাতে না চেয়ে বরং তার সংস্থানে যা রয়েছে তার সেরা ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি নির্মাণ করেছেন দুর্দান্ত সব সিনেমা। জোনাস মেকাস আমেরিকান জীবনের/মার্কিন স্বপনের যে আরোপিত, অতি-ইতিবাচক বিজ্ঞাপনমার্কা ধারাবাহিক ভিসুয়াল নির্মাণ করেছেন ওয়ালডেনে তা মার্কিন স্বপ্ন, মানুষ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা গার্হস্থ্য, ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থাপন করার ভিতর দিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় “মার্কিন স্বপন”এর একধরণের দার্শনিক বয়ান হাজির করার চেষ্টা করেন সম্পূর্ন বিপরীত রাজনীতির নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে। ফলে, তার সিনেমার নির্মাণ প্রকরণে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা যান্ত্রিক বৈচিত্রের কৌশলী প্রকরণ, প্রয়োগ না থেকে রয়েছে নিজস্ব গতির, সুরের, যাপনের প্রতিদিনের সহজ ধারাবাহিকতা। যেভাবে ধীরে ধীরে চর্চার ভিতর দিয়ে তৈরি হয় “বোধ”, সেভাবেই জোনাসের সিনেমা তৈরি হয় এবং তা জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলে মধ্যবিত্ত গদ্যময় কাব্যিক “ভালোলাগা” উৎপাদনের ভিতর দিয়ে। আবার একইসাথে জনপ্রিয় সিনেমা নির্মাণ কৌশলের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরোধী নির্মাণ কৌশল ও ভাষা ব্যবহারের কারণে তার সিনেমার ভিতরের যাপন “মার্কিন স্বপন”এর প্রচারণার অনুরূপ হয়েও বহিরাঙ্গে সম্পূর্ন বিপরীত রূপ ধারণ করে উপস্থাপিত হয়ে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করে সীমাবদ্ধ মুষ্টিমেয় মানুষের মার্কিন স্বপনের সাথে। ভিন্নস্বরে ধীরে ধীরে এসব সিনেমারা “প্রতিষ্ঠান বিরোধী”তার রাজনীতি পরিবেশন করে এবং প্রান্তিক স্বরকে ক্ষমতায়িত ও দৃশ্যমান করে। প্রতিষ্ঠিত মতামত, বিষয়, (শিল্প+মাপকাঠি=শিল্পকাঠি) শিল্পকাঠি ও দৃশ্যপট সম্পর্কে নতুন ভিন্নধরনের বিতর্ক, মতামত উপস্থাপন করে।
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, সমালোচক। ইমেইল: maangorepublik@gmail.com
দোহাই
Jonas Mekas (Author), Anne Konig (Editor) “Scrapbook of the Sixties: Writings 1958 – 2010”, Spector Books (2nd edition), United States, 2019.
Barack Obama “The Audacity of Hope: Thoughts on Reclaiming the American Dream” Crown / Three Rivers Press, United States, 2006.
https://en.wikipedia.org/wiki/Jonas_Mekas#Filmography
https://en.wikipedia.org/wiki/Walden_(1968_film)
https://www.imdb.com/name/nm0577263/
https://en.wikipedia.org/wiki/John_Cale
https://en.wikipedia.org/wiki/American_Dream#Public_opinion
https://en.wikipedia.org/wiki/Diversity_Immigrant_Visa