পরাজয়ের অধ্যায়সমূহ নিয়ে কিছু আলোচনা

মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৮

পরাজয়ের অধ্যায়সমূহ নিয়ে কিছু আলোচনা

তারিক আলি

২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তারিক আলির বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক  ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম। এবারে অষ্টম পর্ব। 

১৯৪৮ সালে নাকবা (বিপর্যয়) সংঘটিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা নেতৃত্বশূন্য এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে আরব রাষ্ট্রগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন)-এর ব্যাপারে আরব লিগের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ পনেরো বছর লেগে যায়। তবে ফিলিস্তিনি বাহিনীকে সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান ও মিশরের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত হওয়ার শর্তে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। আরব দেশগুলোর রাজধানীতে শরণার্থী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ১৯৫৬ সালের ঘটনাবলী এবং তার মধ্য দিয়ে মেরুকরণে তারা আরও বিপ্লবী অভিজ্ঞতা পেল। তারা ১৯৪৮ সালের নারী, পুরুষ, তরুণ, শিশু ও নবজাতক যাদের জাতিগত নিধনের সরাসরি অভিজ্ঞতা ছিল না। বিপর্যয়ের গল্প শুনতে শুনতে তারা বড় হচ্ছিল।

বাকি আরব দেশগুলোর মতো তারা জাতীয়তাবাদী এবং মার্ক্সবাদী–এই দুভাগে বিভক্ত হয়েছিল। তবে তাদের ধর্মীয় পরিবেশ বাকি আরব দেশগুলো থেকে শিথিলতর ছিল। ফাতাহ(বিজয়ী) দলের আগমনকালে এই বিভক্তি ঘটে। দলের পাশে ছিল বাম দল পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) এবং পরবর্তী সময়ে দ্য পপুলার ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিডিএফএলপি)। এই দুই দলের ভিন্নতা ছিল কৌশলগত: ফাতাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন গেরিলা বাহিনীর সরাসরি স্বাধীন আক্রমণের পক্ষে ছিল; আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য পক্ষের যুক্তি ছিল- আরব দেশগুলোতে ধারাবাহিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া ফিলিস্তিনের জয়লাভ সম্ভব নয়।

ফাতাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন গেরিলা বাহিনীর সরাসরি স্বাধীন আক্রমণের পক্ষে ছিল; আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য পক্ষের যুক্তি ছিল- আরব দেশগুলোতে ধারাবাহিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া ফিলিস্তিনের জয়লাভ সম্ভব নয়।

১৯৬৫ সালে সিরিয়ার বা’থ দলের সহযোগিতায় ফাতাহ গেরিলা বাহিনী ইসরাইলের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালায়। জবাবে জায়নবাদী নেতারাও আক্রমণে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম জার্মানি থেকে রাসায়নিক অস্ত্রসহ আর্থিক এবং সামরিক সাহায্য নিয়ে তারা অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহিনী গঠনে সক্ষম হল। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা তাদের সামরিক বাহিনীর আয়তন বৃদ্ধি করেছিল। ইসরাইলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত ছিল যে ইসরাইলকে কোনোরকম ঝুঁকিতে না ফেলে তারা বাদবাকি ফিলিস্তিন সহজেই দখল করে নিতে পারবে। সিরিয়া, মিশর ও জর্ডান নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে একে অপরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করল।

১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরাইল মিশর আক্রমণ করে তার বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল। ছয় দিনের মধ্যে ইসরাইল সামরিক বাহিনী জেরুজালেম, জর্ডান থেকে পশ্চিম তীর, দক্ষিণ সিরিয়ার গোলান হাইটস ও সুয়েজ খাল অবধি মিশরের সাইনাই দখল করে ফেলল। সুদূরপ্রসারী ফলাফল তৈরিকারী এই সর্বাত্মক ধ্বংসটি ‘দ্বিতীয় বিপর্যয়’ নামে পরিচিত। জেরুজালেমের পতন হলো। ক্রিশ্চিয়ান ও মুসলমানদের কিছু পবিত্র স্থান ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। ইসরাইলের সামরিক শক্তি পেন্টাগন ও স্টেট ডিপার্টমেন্টেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করল। তারা এর আগে জায়নবাদীদের এত সংগঠিত শক্তিশালী অবস্থা ধারণা করেনি। মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রাষ্ট্রে পরিণত হলো। তার ফলে ইসরাইলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সুসম্পর্ক তৈরি হলো।

আর ফিলিস্তিনিরা? ইসরাইলের দখল তাদের জন্য কী পরিণতি বয়ে নিয়ে এলো? জেরুজালেম, গাজা ও পশ্চিম তীরে তাদের সর্বশেষ ভূমি এখন তেল আবিবের সরাসরি শাসনের অন্তর্ভুক্ত। আকস্মিক বিজয়ের পর একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের সমর্থন দিয়ে ইসরাইল সমাধানের দিকে যেতে পারত। কিন্তু তখন তারা সাফল্যের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল। আক্রমণে স্তব্ধ আরব রাজ্যগুলো ইসরাইলের দখল প্রত্যাখ্যান করল। ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশ সিরিয়া ও জর্ডানে যেনতেনভাবে তৈরি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিল।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনপ্রিয় নাসেরবাদকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। মিশরের প্রতিক্রিয়া কীরকম ছিল? ১৯৬৭ সালের ৯ জুন সমগ্র আরব বিশ্বে ধ্বংসের ব্যাপকতা স্পষ্ট হলো। মুসলিম ব্রাদারহুড অনুপ্রাণিত দলগুলো সোভিয়েত দূতাবাসের দিকে অগ্রসর হলো। তারা এই বিপর্যয়ের জন্য মস্কোকে দায়ী করল। তারা ভেবেছিল, দূতাবাস পুড়িয়ে ফেলা হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পুরোনো শাসকরা এই সুযোগ হাতছাড়া করল না। তারা উচ্চপর্যায়ের সামরিক নেতাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করতে থাকল। এর দুই বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক বাহিনী বামপন্থি দলকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিয়েছিল, বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিস্ট দলটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কমপক্ষে দশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। ইসলামি দলগুলো এবং সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় এজেন্সিগুলো এ ঘটনায় অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল।

কায়রোতে মুসলিম ব্রাদারহুড তখন প্রতিশোধের পরিকল্পনায় লিপ্ত হলো। তারা ভাবল, ‘ফেরাউনের’ পতন এবং তার সমর্থকদের হত্যা করার এটাই সঠিক সময়। পরম্পরা ডানপন্থি দলগুলো ‘পনেরো বছরের সমাজতন্ত্র’কে উলটে দিতে চাইল। তারা জানত যে আবার ‘তেল’-এর নিরাপত্তা পেতে, মিশরকে ফিরে পেতে, সিরিয়া ও ইরাককে শাস্তি দিতে পশ্চিম তাদেরকে অর্থ সাহায্য দিয়ে সমর্থন করবে।

এক ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’তে, মিশরের উদ্দেশে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ক্রন্দনরত নাসের তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান। সারা আরব বিশ্বে সেই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু পরাজয়ের জন্য তিনি নিজেকেই সম্পূর্ণ দায়ী করলেন। তার শত্রুরা উল্লসিত হলো। তারা ভেবেছিল একজন পরাজিত মানুষ আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে না। তাই তারা পরিবর্তনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল। কিন্তু তারপর অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটল। এবং তা শুধু আরব বিশ্বে সীমাবদ্ধ থাকল না।

আরব জনগণ কীভাবে নাসেরের পদত্যাগের জবাব দিয়েছিল তা মিশরীয় ঐতিহাসিক আনোয়ার আবদেল-মালিক বর্ণনা করেন:

সাময়িক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর সমগ্র দেশ প্রতিবাদমুখর হলো: কায়রোর পথেঘাটে ত্রিশ (৩০) লাখের বেশি মানুষ জমায়েত হলো; ডেল্টার কেন্দ্রে অবস্থিত তানতাহ অঞ্চলের সমগ্র জনতা রাজধানীতে মিছিল করছিল; পোর্ট সাইদেও একই প্রতিক্রিয়া ছিল, তবে সেখানের জনগণের প্রতি শহরটি খালি না করে ফেলার জন্য জরুরি নির্দেশ ছিল; প্রতিটি শহর ও গ্রাম থেকে, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আসওয়ান, পশ্চিম মরুভূমি থেকে সুয়েজ পর্যন্ত, একটি পুরো জাতি মিছিল করেছিল। এবং এর স্লোগানগুলোতে স্পষ্ট বার্তা ছিল: সাম্রাজ্যবাদ নয়! ডলার ন!’; ‘নেতা মানে জামাল ১৯৬৭ সালের মে সংকটের পর থেকেই, কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৯১৯ সালের বিপ্লবের জনপ্রিয় যুদ্ধের স্তব বিলাদি, বিলাদি, ফিদাকি দামি! (আমার পিতৃভূমি, হে পিতৃভূমি, তোমার রক্ত আমার ক্ত!) আওড়াচ্ছিলএবং এই আওয়াজ তখন এক বজ্রঝড় একটি ঢালের মতো বিস্ফোরিত হলো। মিশরের জাতীয়তা এবং জাতীয় সংকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সকল ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে তারা জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হলো।

বিমুখ থাকার দিন গত হয়েছে। বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি গত হয়েছে। মানুষ এবং তার পিতৃভূমির মধ্যে সম্পর্ক শনাক্তকরণের অভাব আর নেই

নাসের পদত্যাগ না করতে বাধ্য হলেন। তবে তিনি জানতেন, এই যুদ্ধ একটি পরিবর্তনের দিক চিহ্নিত করেছে। একজন সামরিক ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি পরাজয়ের মাত্রা বুঝতে পেরেছিলেন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আরব বিশ্বে কিছু পরিবর্তন জরুরি। কিন্তু তিন বছর পর তিনি মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তারা উপলব্ধি করেছিল যে তারা নাসেরের সঙ্গে সঙ্গে তার আরব ঐক্যের স্বপ্নকেও বিদায় জানাচ্ছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে পুনরায় সরঞ্জাম সরবরাহ করে। নাসেরের উত্তরসূরি আনোয়ার আল-সাদাত ১৯৭৩ সালে ইসরাইলকে পিছু হটতে বাধ্য করেন এবং এর বিমানবাহিনী ধ্বংস করেন। এ ঘটনায় ইসরাইল খুব বিস্মিত হলো। ইসরাইল তার শক্তি পুনরুদ্ধার করলেও ঘটনাটি গুরুত্বের জায়গা দখল করল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অচলাবস্থা জারি করেছিল। প্রতিটি বড় শক্তি তাদের নিজ পক্ষকে পরাজিত হতে দেবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। একটি বিরল আরব ঐক্য এবং তেল নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী ব্যবহার আরবদের সাহায্য করেছিল।

কিন্তু ব্যাপারটি শুধু বৃহৎ শক্তির আধুনিকতর অস্ত্র বিক্রিতে সীমিত ছিল না। আরবদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিখ্যাত সিরিয়ান কবি নাইজার কাব্বানি তার কবিতায় এই সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন। বাজারে এবং স্যালুনে তার কবিতা আবৃত্তি করা হতো। তার ১৯৫৬ সালের কবিতায় তিনি সাধারণ সৈন্যদের বীরত্বকে মহিমান্বিত করেছিলেন। মিশরের সামরিক পরাজয় হলেও তার রাজনৈতিক আশাবাদ অব্যাহত ছিল। এক দশক পর সে দৃশ্যপট বদলে যায়।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরপরই, কাব্বানি হাওয়ামিশ ‘আলা দাফতার আল-নাকসাহ’ (ফুট নোটস টু দ্য বুক অব সেটব্যাক) শিরোনামে বিশটি স্তবক রচনা করেন। তিনি সুলতান বা কর্নেল কাউকেই রেহাই না দিয়ে সমগ্র আরব নেতৃত্বকে কশাঘাত করেন। ভিন্নমতকে শাস্তি দেওয়ার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কবিদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিরল নয়, তবে খুব কমই একটি কবিতায় এমন বিস্ফোরক প্রভাব রয়েছে। বিশেষভাবে, ১৭ নম্বর স্তবকটি প্রতিটি আরব রাজধানীর রাষ্ট্রীয় লেখক এবং গুপ্ত পুলিশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তবে সমগ্র আরব বিশ্বে এটি পাঠ করা হয়েছিল এবং গান রচিত হয়েছিল।

ডান, বাম উভয় দিক থেকে সমালোচিত কবি অনুশোচনাহীন থাকলেন। তিনি নিজেকে একা ভাবতেন না। সমালোচনায় নতিস্বীকার না করে তিনি লাখ লাখ মানুষের হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। কাব্বানি জানতেন যে হতাশা নিষ্ক্রিয়তা বা মানসিক সহিংসতা তৈরি করে। তাই তার রাজনৈতিক কবিতায় একটি সৃজনশীল এবং সক্রিয় আবেগে তিনি সব সময় আশা উপস্থিত রেখেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে লেখা কাব্বানির আশার ছবি সবসময়ই শক্তিশালী এবং তারুণ্যময়। তিনি লিখেছেন:

বন্ধুরা,

পুরোনো জগৎ মৃত।

পুরোনো সব বই মৃত।

জীর্ণ জুতার মতো ছিদ্রযুক্ত আমাদের বক্তৃতা মৃত।

মৃত মন কেবল পরাজয় বয়ে আনে।

আমাদের কবিতা এখন তেতো।

নারীর কেশ, রজনি, পর্দা এবং সোফাগুলো

এখন তেতো।

সবকিছুই হয়ে গেছে তেতো।

আমার শোকাতুর দেশ,

চোখের পলকে

তুমি আমাকে প্রেমের কবিতা লেখা থেকে

ছুরি দিয়ে লেখা কবিতে পরিণত করেছ।

আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়:

আমাদের কবিতা নিয়ে আমরা লজ্জিত।

প্রাচ্য বোমাবাজি দ্বারা আলোড়িত,

অহংকারী আওয়াজ যা কখনো একটি মাছি মারেনি,

বাঁশি এবং ড্রাম নিয়ে,

আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম

এবং হেরেছিলাম।

কাজের চেয়ে আমাদের কোলাহল বেশি,

আমাদের চেয়ে তলোয়ারের উচ্চতা বেশি

করুণ এই পরিণতি আমাদের।

সংক্ষেপে

সভ্যতার পোশাকে সজ্জিত আমাদের

ভাবনা অবস্থান করে প্রস্তর যুগে।

একটি নল আর বাঁশি দিয়ে

যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়।

আমাদের অধৈর্য

জন্ম দেয় পঞ্চাশ হাজার নতুন তাঁবু।

১০

স্বর্গকে অভিশাপ দিয়ো না

যদি সে তোমাকে পরিত্যক্ত করে,

পরিস্থিতিকে অভিশাপ দিয়ো না।

ঈশ্বর যাকে খুশি তাকে বিজয়ী করেন।

ঈশ্বর তলোয়ারকে পরাজিত করার কামার নন।

১১

সকালে খবর শুনে ব্যথিত হতে হয়।

কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে ব্যথিত হতে হয়।

১২

আমাদের শত্রুরা আমাদের সীমানা অতিক্রম করেনি

পিঁপড়ার মতো তারা আমাদের দুর্বলতার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে।

১৩

পাঁচ হাজার বছর ধরে

দাড়ি গজাচ্ছে

আমাদের গুহায়।

আমাদের মুদ্রা অজানা,

আমাদের চোখ মাছিদের আশ্রয়।

বন্ধুরা,

দরজা ভেঙে ফেলো,

তোমাদের মস্তিষ্ককে জাগাও,

তোমাদের কাপড় পরিষ্কার কর।

বন্ধুরা,

একটি বই পড়,

একটি লেখা লেখ,

ফলাও শব্দ, ডালিম ও আঙুর,

কুয়াশা ও তুষারের দেশে যাত্রা কর।

গুহায় তোমাদের অস্তিত্ব কেউ জানে না।

লোকেরা তোমাদের মংরেলের শাবক মনে করে।

১৪

আমরা পুরু চামড়ার মানুষ

আত্মাহীন।

আমরা জাদুবিদ্যা অনুশীলন করে,

দাবা খেলে এবং ঘুমিয়ে দিন কাটাই।

আমরা কি ‘সেই জাতি যার দ্বারা ঈশ্বর মানবজাতিকে আশীর্বাদ করেছেন’?

১৫

আমাদের মরুভূমির তেল হতে পারতো

শিখা ও আগুনের ছোরা।

আমরা আমাদের সম্ভ্রান্ত পূর্বপুরুষদের জন্য কলঙ্ক:

আমরা বেশ্যাদের পায়ের আঙুল দিয়ে আমাদের তেল প্রবাহিত হতে দেই।

১৬

পথে আমাদের সহিংস পদচারণা

দড়ি বেঁধে মানুষকে টেনে আনি,

জানালা ও তালা ভাঙচুর করি।

আমাদের প্রশংসা যেন ব্যাঙের ডাক,

গালিও দিই একই ডাকে,

অযোগ্যরা বীর হয়,

এবং বীর হয়ে যায় নোংরা দাগ,

আমরা কখনো স্থির হয়ে ভাবি না।

মসজিদে

আমরা অলসভাবে নতজানু হই,

কবিতায়,

নীতিবাক্যে লিখে,

ঈশ্বরের কাছে বিজয় ভিক্ষা চাই

শত্রুদের পরাজয় চাই।

১৭

যদি কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা না রেখে,

সুলতানের সাক্ষাৎ সম্ভব হতো,

তাহলে আমি তাকে বলতাম:

‘সুলতান,

তোমার হিংস্র কুকুরেরা আমার পোশাক ছিঁড়েছে

তোমার গুপ্তচরেরা আমাকে তাড়া করে

ধাওয়া করে তাদের দৃষ্টি

ধাওয়া করে তাদের ঘ্রাণশক্তি

ধাওয়া করে তাদের পদচারণা

নিয়তির অংশ হয়ে গেছে তাদের ধাওয়া

আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে

এবং আমার বন্ধুদের তালিকা বানায়।

সুলতান,

যখন তোমার দেওয়ালের কাছে এসেছিলাম

এবং আমার কষ্টের কথা বলতে চেয়েছিলাম,

তোমার সৈন্যদের বুটে পিষ্ট হয়েছি,

তাদের বুট চেটে খেতে বাধ্য করে।

সুলতান,

তুমি দুইটি যুদ্ধে হেরেছ।

সুলতান,

আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জিব নেই,

জিবহীন মানুষের কি কোনো মূল্য থাকে?

অর্ধেক জনগোষ্ঠী

পিঁপড়া ও ইঁদুরের মতো

দেওয়ালের মাঝে আটক হয়ে আছে।’

যদি জানতাম আমার ক্ষতি করা হবে না

তাহলে আমি তাকে বলতাম:

‘তুমি দুইটি যুদ্ধে হেরেছ

সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়েছ।’

১৮

যদি আমাদের ঐক্য বিসর্জন না দিতাম

যদি এর উত্থানকে বেয়োনেটের খোঁচায় টুকরা না করতাম

যদি তা আমাদের দৃষ্টির নাগালে থাকত

তাহলে আজ কুকুরের আহারের মাংসপিণ্ড হতাম না।

১৯

আমরা ক্রুদ্ধ এক প্রজন্ম চাই

আকাশ চষে বেড়াতে

ইতিহাসকে গুঁড়িয়ে দিতে

আমাদের চিন্তাকে গুঁড়িয়ে দিতে।

আমরা নতুন এক প্রজন্ম চাই

যারা ভুলকে ক্ষমা করে না

যারা মাথা নত করে না।

আমরা মহাকায়া এক প্রজন্ম চাই।

২০

আরবের সন্তানেরা,

তোমরা ভবিষ্যতের বীজ,

আমাদের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলবে।

আমাদের মস্তিষ্কের নেশাকে হত্যা করবে,

ভ্রমকে হত্যা করবে।

আরবের সন্তানেরা,

শ্বাসরুদ্ধ আমাদের এই প্রজন্ম সম্পর্কে পড়বে না,

আমরা ব্যর্থ এক অধ্যায়।

আমরা তরমুজের ছালের মতো মূল্যহীন।

আমাদের ব্যাপারে পড়তে যেয়ো না,

আমাদের মতো উল্লুক হয়ো না,

আমাদের বর্জন করো,

আমাদের ধারণা গ্রহণ করো না,

আমরা কুটিল ও ছলনাবাজদের এক জাতি।

আরব সন্তানেরা,

বসন্তের বৃষ্টি,

তোমরা ভবিষ্যতের বীজ,

তোমরাই সেই প্রজন্ম

যারা পরাজয়কে অতিক্রম করবে।

কবিতাটি আরব বিশ্বে ঝড় তুলেছিল। মিশরীয় সরকার কাব্বানির সব বই এবং উম্মে কুলসুমের গাওয়া এই কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সরকারের এই প্রতিক্রিয়া কাব্বানির বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করেছিল। কাব্বানির দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। সরকারের আরও কিছু নেপথ্যের মানুষ কাব্বানির অনুপস্থিতিতে তার বিচারের দাবি করেছিল। এর কয়েক মাস পর কাব্বানি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য নাসেরের কাছে সরাসরি আবেদন করেন। সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো। তারপর এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।

কিন্তু কবি জাতির স্নায়ুমূলকে স্পর্শ করেছিল। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে বার্ট্রান্ড রাসেল পিস ফাউন্ডেশনের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলের একজন হিসেবে আম্মান, বৈরুত ও দামাস্কাস সফরের সময় আমি প্রথম তার কথা শুনি। এর এক বছর আগে ‘রাসেল/সার্ত্রে ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল’-এর পক্ষে উত্তর কোরিয়া সফর করেছিলাম। স্টকহোমে ট্রাইব্যুনাল সেশন চলাকালীন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনার খবর পাই।

জুন মাসে ছয় দিনের সংক্ষিপ্ত প্রবল আক্রমণের পর আমাকে মধ্যপ্রাচ্য সফরের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হলো। আমাদের দায়িত্ব ছিল ফিলিস্তিনি শিবিরগুলোর পরিস্থিতি তদন্ত করে তার রিপোর্ট জমা দেওয়া। আগস্ট মাসের এক রোববার আমরা আম্মানের উদ্দেশে যাত্রা করি। মনে পড়ে, এয়ারপোর্টে অবজার্ভার পত্রিকা কিনেছিলাম এবং তাতে রোমে একদিন আগে মার্ক্সিস্ট ইতিহাসবিদ আইজ্যাক ডয়েচারের মৃত্যুর খবর পড়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে স্টকহোমে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। তিনি সেখানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক ছিলেন। সেই সময় তার সঙ্গে আমি এক কঠিন সময়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম। মুখ ফসকে বলা একটি মন্তব্যের জন্য আমাকে তার কঠিন প্রতিক্রিয়া নিতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, উত্তর ভিয়েতনামে নিবিড়ভাবে এবং নির্বিচারে বোমাবর্ষণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী ভূমিকা প্রকাশ করেছে। এর জবাবে তিনি আমাকে তিরস্কার করে বললেন, ইউরোপে বিপ্লব ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কি কোনো আলদাভাবে বোমাবর্ষণ করতো? পরবর্তী সময়ে আমাকে একপাশে নিয়ে আমার সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনে তিনি যে আমার জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি দেখেছিলেন তা বোঝাতে চাইলেন। এখন তিনি মৃত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ বিশ্লেষণ করার জন্য তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর নিযুক্ত করা যাবে না। আম্মানের উদ্দেশে ফ্লাইটে ওঠার সময় আমি বেশ একাকী বোধ করলাম।

যুদ্ধে বিধ্বস্ত জর্ডানের রাজধানীতে এসে কাব্বানির কবিতাটিকে তখনও উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয় হিসেবে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ফিলিস্তিনি, যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তারা অনেকগুলো স্তবক আবৃত্তি করেছিলেন। আমাদের সঙ্গে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা তাতে বেশ বিব্রত বোধ করছিলেন। দামাস্কাস ও বৈরুতে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবে সিরিয়ার রাজধানীতে এর ব্যতিক্রম হয়েছিল। সেখানে কবির বন্ধু সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোয়াফাক আল্লাফ কবিতাটির ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। বা’থ-এর সবচেয়ে উগ্র অংশ তখন ক্ষমতাসীন ছিল। সিরিয়ান সরকারের মন্ত্রীদের মতে, কাব্বানির কবিতায় মিশরের পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে বর্ণিত হয়েছিল।

জর্ডানের শরণার্থী শিবির থেকে আমি প্রথম ফিলিস্তিনের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি। সেই বছর আমি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আক্রান্ত বহু মানুষ দেখেছি। কিন্তু তারা তাদের নিজ দেশে অবস্থান করছিল। তাদের নিজেদের ডাক্তার তাদের সেবা করছিল এবং সারা পৃথিবী থেকে তাদের জন্য চিকিৎসা এবং অন্যান্য সহায়তা পাচ্ছিল। শরণার্থী শিবিরেও নাপাম বোমায় দগ্ধ শিশুদের ছবি তুলেছিলাম। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনিরা ছিল আরব বিশ্বের অবহেলিত এক রাষ্ট্রহীন জাতি। আরব বিশ্বের এই অবহেলা ফিলিস্তিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছিল।

পশ্চিমে খুব কমসংখ্যক রাজনীতিবিদ এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন বা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি হত্যার জন্য অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে তারা ইসরাইলি নৃশংসতার প্রতি অন্ধদৃষ্টি রাখছিলেন।

দামাস্কাসে নাগরিক হাসপাতালে আমি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের আরও প্রমাণ পেলাম। নাপাম বোমায় দগ্ধ বহু রোগীর দেখা পেলাম। ডাক্তারদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে অবগত হলাম। জেনেছিলাম, হাসপাতালের সামনে তৈরি চিকিৎসার তাঁবুতে কর্মরত পাঁচজন ডাক্তারকে কীভাবে ইসরাইলি সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছিল। কুনেইত্রা থেকে আসা ১৭ বছর বয়সী রাখাল মুহাম্মাদ আল-মুস্তফার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তারা তাদের পাল চরাচ্ছিল। ইসরাইলি সৈন্যরা তাদের পথ আটকায়। তার ১২ বছর বয়সী কাজিন ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। তাকে পেছন থেকে গুলি করা হয়। মুহাম্মাদও গুলিবিদ্ধ হয়। সে চিকিৎসা সাহায্যের জন্য আবেদন করেও সাহায্য পায়নি। সৈন্যরা তার ছোট দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। এ রকম গল্পের শেষ নেই।

সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. ইউসিফ জুয়াইন আমাকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য বিস্তারিত বলেছিলেন। কিন্তু তাতে আমার অসন্তোষ কাটেনি। তিনি মেডিসিনের ডাক্তার ছিলেন। প্রশিক্ষণকালে তিনি ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের হাসপাতালগুলোতে কাজ করতেন। একদিন দুপুরে সাক্ষাৎকালে তিনি বললেন, সিরিয়া খুব শিগগির মধ্যপ্রাচ্যের কিউবা হয়ে যাবে; সৌদি রাজতন্ত্রের দিন ঘনিয়ে এসেছে; পুঁজিবাদ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বা’থ-এর বিপ্লব এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন,

‘তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আরব জনতা আর ইয়েমেনে আশ্রয় নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে থাকবে না। আমরা এই বহিরাক্রমণ প্রতিহত করব এবং আমাদের চূড়ান্ত বিজয় ঘটবে। দখলদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই জাপানের বিরুদ্ধে চীনা প্রতিরোধ থেকে শিক্ষা নিয়ে জনযুদ্ধ চালাতে হবে। আমরা তাদের বা ওয়াশিংটন ও লন্ডনে তাদের সমর্থকদের সঙ্গে অস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি না। বেশি দামি অস্ত্র দিয়ে নয়, শুধু জনগণই এই যুদ্ধে জেতার একমাত্র উপায়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম হবে…।’

পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে আফালাক সমর্থিত মধ্যপন্থিদের স্বল্পস্থায়ী সংগ্রামের পর সিরিয়া সরকারে ‘অতি মৌলবাদীদের’ পতন ঘটানো হয়েছিল।

বৈরুতে ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। ওয়ালিদ খালিদির পুরোনো ভবনের বাগানে ইতিহাসের অনেক দরকারি পাঠ আলোচিত হচ্ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই পরাজয়ে হতবাক অবস্থায় ছিলেন। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে অক্ষম হচ্ছিলেন। এ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে আমি রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফেতে দেখা করেছি। তারা অনেক মাথা গরম মানুষ ছিলেন। তারা অন্যদের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুলতান ও কর্নেলদের ওপর নির্ভর না করে, নিজেরাই যুদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। এবং তারপর সেই অনিবার্য প্রশ্ন: ‘আপনি কাব্বানির সর্বশেষ কবিতা শুনেছেন?’

লন্ডনে ফিরে, আমি আইজ্যাক ডয়েচারের বিধবা স্ত্রী তামারাকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম এবং তার কাছ থেকে শুনেছিলাম যে তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে আইজ্যাক নিউ লেফট রিভিউকে ছয় দিনের যুদ্ধের ওপর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। জুডিওসাইডের সময় ডয়েচার দম্পতির উভয়ই তাদের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হারিয়েছিলেন। আইজ্যাক খুব কমই যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে আবেগে প্রভাবিত হতে দিতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও উদ্বাস্তু সৃষ্টিকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাইরে একটি শরণার্থী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতি থাকা ছিল স্বাভাবিক। তাই সাক্ষাৎকার থেকে খুব বেশি আশা করিনি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তিনি ইসরাইলিদের ‘মধ্যপ্রাচ্যের প্রুশিয়ান’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন এবং একটি শীতল ও পূর্বসতর্কতা জারি করেছিলেন:

জার্মানরা তিক্ত বাক্যাংশে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্তসার করেছে: মন কৌন সিচ তোসিয়েগেন!’ ‘আপনার বিজয় দ্রুত আপনার জন্য কবর রচনা করবে’! ইসরাইলিদের জন্য একই ব্যাপার প্রযোজ্য। বিজিত অঞ্চলে এবং ইসরাইলে এখন প্রায় সাড়ে দশ লাখ আরব, যা মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি। ইসরাইলিরা কি বিজিত ভূমিকে নিরাপদেরাখার জন্য আরবদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করবে? এটি একটি নতুন শরণার্থী সমস্যা তৈরি করবে, যা পুরোনো সমস্যার চেয়ে আরও বড় এবং বিপজ্জনক। হ্যাঁ, ইসরাইলের জন্য এই জয় পরাজয়ের চেয়েও খারাপ। এই জয় ইসরাইলকে উচ্চতর নিরাপত্তা প্রদান করা তো দূরের কথা, তাকে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে।

আইজ্যাক ডয়েচারের অনুমান সঠিক ছিল। ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের বিজয় কোনো সমাধান আনেনি। ফিলিস্তিনিরা অদৃশ্য জনগোষ্ঠী হতে অস্বীকার করেছিল। একটি নতুন প্রজন্ম জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন সংগ্রাম শুরু করে, যা হলো বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক মুক্তিযুদ্ধের শেষ অংশ। ইসরাইল বর্তমান বিশ্বের ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর মডেলের একমাত্র অবশিষ্ট ঔপনিবেশিক শক্তি। ইসরাইলি বুদ্ধিজীবীদের একটি সাহসী সংখ্যালঘু অংশ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন। হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক, বারুচ কিমারলিং, সম্প্রতি এমিল জোলার প্রতি তার সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি ছাপিয়েছিলেন। কিমারলিংয়ের ‘আমি অভিযুক্ত’ লেখাটি হিব্রু সাপ্তাহিক কোল হা’লার-এর ফেব্রুয়ারি ০১, ২০০২ সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল। এই লেখায় ইসরাইলি সামরিক নেতৃত্বের ব্যাপারে এমন একটি বর্বরতার অভিযোগ করা হয়েছে যা পশ্চিমা মিডিয়ায় কখনো দেখা যায় না:

আমি এরিয়েল শ্যারনকে এমন একটি প্রক্রিয়া তৈরি করার জন্য অভিযুক্ত করি যার মাধ্যমে তিনি কেবল পারস্পরিক রক্তপাতকে তীব্রতর করবেন না, একইসঙ্গে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং ইসরাইলের ভূমিতে আরবদের আংশিক বা প্রায় সম্পূর্ণ জাতিগত নির্মূল করার জন্য দায়ী থাকবেন। আমি এই সরকারের লেবার পার্টির সব মন্ত্রীকে ইসরাইলের ডানপন্থিদের চরমপন্থি, ফ্যাসিবাদী ভিশনবাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য অভিযুক্ত করি। আমি প্রাথমিকভাবে ইয়াসির আরাফাতসহ ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে তাদের চরম অদূরদর্শিতা জন্য অভিযুক্ত করি যা শ্যারনের পরিকল্পনার সহযোগী হয়ে উঠেছে। যদি দ্বিতীয় নাকবা হয়, এই নেতৃত্বও তার একটি কারণ হয়ে থাকবে। আমি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতীয় নেতৃত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত, কথিত সামরিক পেশাদারিত্বের আবরণে জনমতকে উসকে দেওয়ার জন্য সামরিক নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করি। ইসরাইলে এর আগে কখনো সেনা পোশাক পরিহিত জেনারেল, সাবেক জেনারেল এবং সামরিক গোয়েন্দাদের অতীত সদস্যরা প্রয়োজনে ‘শিক্ষাবিদছদ্মবেশে জনসাধারণের মগজ ধোলাইয়ে অংশ নেননি। ২০০২ সালের বিপর্যয়ের তদন্তের জন্য যখন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে, তখন বেসামরিক অপরাধীদের পাশাপাশি তাদের ব্যাপারেও তদন্ত করতে হবে।

প্রয়াত দার্শনিক ইশায়াহু লেইবোভিৎজ ঠিকই বলেছিলেন যে ইসরাইলি সমাজের নৈতিক অবকাঠামোর প্রতিটি ভালো অংশকে এই দখলদারিত্ব ধ্বংস করেছে। আসুন মূর্খদের এই পদযাত্রা বন্ধ করি এবং সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলি, সামরিক শাসন এবং অন্য মানুষের নিপীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্ত করি।

এবং এই সবকিছু জানার পরও আমি খুব কম কাঁদি এবং প্রায়ই চুপ করে থাকি। এ কারণে আমি নিজেকে অভিযুক্ত করি।

ফিলিস্তিনের গল্প এখনো অসমাপ্ত।

আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৭

ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ইমেইল: fatemaorama@gmail.com

পাদটীকা

১.   আনোয়ার আবদেল-মালিক। মিশর: মিলিটারি সোসাইটি। নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৮।

২.  নিজার কাব্বানি, ‘ফুট নোটস টু দ্য বুক অব সেটব্যাক’, মডার্ণ পোয়েট্রি অব দ্য আরব ওয়ার্ল্ড এ সংকলিত। লন্ডন ১৯৮৬, আদবুল্লাহ আল-উধারি দ্বারা অনূদিত ও সম্পাদিত।

৩.  দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পর ডয়েচারের সাক্ষাৎকার (নিউ লেফট রিভিউ ১, ৪৪ জুলাই-

         আগস্ট, ১৯৬৭) কেউ আরেকবার পড়লে ওনার স্বচ্ছতা এবং সাহসে মুগ্ধ হবেন।

         আইজ্যাক এবং তার স্ত্রী তামারা উভয়েই জুডিওসাইডে কার্যত তাদের সমস্ত

         আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তারা জায়নবাদী হয়ে যাননি। সেই কারণে,

         এবং নতুন পাঠকদের উৎসাহিত করার আশায়, আমি এই সাক্ষাৎকারটি এই বইয়ের

         একটি পরিশিষ্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছি।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •