পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলন কেন?

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলন কেন?

২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিভিন্ন দাবিতে সাময়িকভাবে প্রতীকী বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে। তখনই প্রথম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা গণমাধ্যমে জোরালোভাবে আসে। তখন অনেকেরই ধারণা ছিল যে এই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য করা হয়েছে। দ্বৈত ব্যবস্থার কারণে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পবিস) যে বহুদিন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) দ্বারা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হয়ে আসছিল তা আড়ালে রয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের কারণে গ্রামবাসীর ভোগান্তির চিত্র মুখ্য হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনের সক্রিয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বৈরাচারী সরকারের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় জনমত তাদের বিপক্ষে চলে যায়। এই আন্দোলন যে দীর্ঘদিনের একটি বঞ্চনার আন্দোলন, তা ধীরে ধীরে নজরে আসে যখন এই আন্দোলনের পেছনের ইতিহাস উন্মোচিত হয়। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের ইতিহাস এ কারণে লিপিবদ্ধ করে রাখা জরুরি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলন যে নিছক বেতন বাড়ানোর আন্দোলন নয়; বরং দ্বৈত ব্যবস্থা অবসানের মাধ্যমে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে এই আন্দোলন, তা এই টাইমলাইনে উঠে আসা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের হয়রানিমূলক আচরণ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের কর্মসূচি পর্যালোচনা করলে অনুধাবন করা সম্ভব। ‘সর্বজনকথা’ থেকে আমরা এই আন্দোলনের একটি নিরপেক্ষ টাইমলাইন প্রকাশ করছি বিভিন্ন সভা ও কর্মসূচির নথিপত্র ব্যবহার করে।

আন্দোলনের টাইমলাইন

 ২৮ জানুয়ারি ২০২৪

দুর্নীতির মাধ্যমে নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ভঙ্গুর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণ করে গ্রাহক হয়রানি এবং গ্রাহক ও সমিতির লোকজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া, আরইবির ব্যর্থতার দায়ভার সমিতিগুলোর ওপর চাপানো, আর্থিক অনিয়ম, সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও জুলুম করা ইত্যাদি কারণে দীর্ঘকালের অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে সমিতিগুলোতে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ২৮ জানুয়ারি ২০২৪। এর আগেও কর্মসূচি ছিল, তবে সেই দাবিগুলো ছিল বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যাওয়া বৈষম্যের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ দাবি-দাওয়া উপস্থাপন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদগুলো একটি সামগ্রিক দাবির প্রেক্ষাপট তৈরি করে ২৮ জানুয়ারির স্মারকলিপি প্রদানের মধ্য দিয়ে।

অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে দাপ্তরিক কাজ সহজীকরণের উদ্দেশ্যে ২৮ জানুয়ারি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের পদনাম/পদবি এবং পদমর্যাদা নির্ধারণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপি প্রদানের কারণে ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুজন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড ও অপর দুই কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়।

৩ মে ২০২৪

সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুজন কর্মকর্তাকে আরইবিতে সংযুক্ত করা হয় এবং ৪ মে আরইবির পরিচালক (প্রশাসন) একেএম এসকান্দার আলী অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনসহ মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে অতর্কিত হাজির হয়ে কয়েকটি ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ জব্দ করে আরইবিতে নিয়ে আসেন।

৫ মে ২০২৪

ফলশ্রুতিতে ৫ মে সারা দেশে প্রায় সব কটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ও আরইবির পলিসি প্রণয়নে অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ভঙ্গুর বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণের কারণে গ্রাহক হয়রানির বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্রাহকসেবা অক্ষুণ্ন রেখে কর্মবিরতি শুরু হয়।

৭–১০ মে ২০২৪

৭ মে সমিতির আরও ৩ জন কর্মকর্তা ও একজন কর্মচারীকে আরইবিতে সংযুক্ত করা হয়। ১০ মে কর্মসূচি চলাকালে বিদ্যুৎ বিভাগ, আরইবি এবং সমিতির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাসপেন্ড, সংযুক্ত, স্ট্যান্ড রিলিজ সবাইকে এক সপ্তাহের মধ্যে অব্যাহতি দিয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং দাবির বিষয়গুলো লিখিতভাবে আরইবিতে পাঠানো, ১৫ দিনের মধ্যে একটি, আরও প্রয়োজন হলে একাধিকবার আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।

সংযুক্তদের সংযুক্তি আদেশ বাতিল করলেও আরইবি সাময়িক বরখাস্ত ও স্ট্যান্ড রিলিজ করা কর্মকর্তাদের অব্যাহতি দেয়নি। পরে সমিতির ৩৭ হাজার ৫৪২ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকলিপি আরইবিতে পাঠানো হয়। কিন্তু ১০ মে-র সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আরইবি বা মন্ত্রণালয় আলোচনায় বসার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

তদুপরি মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে এই সময়ের মধ্যে আরইবি কর্তৃক ‘বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আইন-২০১৩’ সংশোধনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে গিয়ে গ্রাহক এবং সমিতিগুলোকে শোষণ করার জন্য উক্ত আইনে আরইবি কিছু ধারা সংশোধন ও সংযোজন করে প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে একটি ধারা ৬(প) ধারা অনুসারে ‘বোর্ড উহার কিংবা সমিতির যে কোনো কার্যাবলি বা অন্যান্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে যেরূপ মনে করিবে সেরূপ আদেশ প্রদান করিবে।’

১ জুলাই ২০২৪

বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে অসম্পৃক্ত হওয়ায় আরইবির পলিসি গ্রাহকবান্ধব না হওয়া, নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ভঙ্গুর বিতরণ ব্যবস্থা নির্মাণের কারণে গ্রাহক হয়রানি এবং সভার সিদ্ধান্ত না মেনে চালাকির আশ্রয় নেওয়াসহ সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও হয়রানির প্রতিবাদে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্রাহকসেবা সচল রেখে পুনরায় কর্মবিরতি শুরু হয়।

৫–১০ জুলাই ২০২৪

বিদ্যুৎ বিভাগে আরইবি, পবিস এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সভার আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় পুনরায় ১০ মে বিদ্যুৎ বিভাগে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়।

১ আগস্ট ২০২৪

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ‘আরইবি-পবিস সিস্টেম রিফর্ম করা সময়ের দাবি’ উল্লেখ করেন এবং রিফর্মের জন্য আরইবি, পবিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ১ আগস্ট কমিটি গঠিত হয়। ২২ আগস্ট ওই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। উক্ত কমিটির সদস্যরা হলেন:

        ১) জনাব ড. সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (তৎকালীন), বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সভাপতি

        ২) জনাব মো. জাহিদুল ইসলাম, যুগ্ম সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং সদস্য সচিব

        ৩) জনাব মো. ইদ্রিস, নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ), বাপবিবো এবং সদস্য

        ৪) জনাব মো. শহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, বাপবিবো এবং সদস্য

        ৫) জনাব ফকির শরীফ উদ্দিন আহমেদ, পরিচালক, বাপবিবো এবং সদস্য

        ৬) জনাব মো. মকবুল হোসেন, সিনিয়র জিএম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পবিস এবং সদস্য

        ৭) জনাব দীপক কুমার সিংহ, ডিজিএম, কুমিল্লা পবিস-১ এবং সদস্য

        ৮) জনাব রাজন কুমার দাস, এজিএম, মুন্সিগঞ্জ পবিস এবং সদস্য

        ৯) জনাব আবু সালাম জাবেদ, ওয়্যারিং পরিদর্শক, নোয়াখালী পবিস এবং সদস্য

ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং দেশে কারফিউ চলাকালীন আরইবি সমিতির কর্মকর্তাদের দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বদলি করতে থাকে। আরইবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে যানবাহন চলাচল না থাকায় বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদানের সময়সীমা বর্ধিত করার অনুরোধ জানানো হলে––‘আকাশ দিয়ে উড়ে যান’–এমন ভাষা ব্যবহার করা হয় এবং আরইবির নিপীড়ন অব্যাহত থাকে।

৮ আগস্ট ২০২৪

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা আরইবি অভিমুখে লংমার্চ করতে বাধ্য হন। লংমার্চে সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা শান্তিপূর্ণভাবে আরইবির সামনে এবং মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা গমনের সময় আরইবির পেছনে অবস্থান করেন। ওই লংমার্চের দিন সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় আরইবি এবং পবিসের প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তগুলোও আরইবি বাস্তবায়ন করেনি, বরং চালাকির আশ্রয় নেয়।

২২ আগস্ট ২০২৪

আরইবি-পবিস রিফর্ম কমিটির প্রথম সভায় আরইবির প্রতিনিধি উপস্থিত হননি। সমিতির প্রতিনিধিরা বিদ্যুৎ বিভাগে উপস্থিত হলে তাদের উপস্থিতি স্বাক্ষর গ্রহণ এবং আরইবি অনুপস্থিত থাকায় পরবর্তী সময়ে সভা আয়োজনের চিঠি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ ছাড়াও জানা যায়, আরইবির প্রতিনিধিরা আগের দিন অর্থাৎ ২১ আগস্ট সিনিয়র সচিবের সঙ্গে সভা করেন।

২৪–২৭ আগস্ট ২০২৪

২৪ আগস্ট আলোচনায় বসার দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে গণছুটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২৭ আগস্ট আরইবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় রিফর্ম কমিটির কার্যক্রম শুরু করার আশ্বাস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর রিফর্ম কমিটির পরপর ৪টি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেখা যায় সভায় যা আলোচনা হয়, কার্যবিবরণীতে তা আসে না; বরং এমন সিদ্ধান্ত আসে যা আলোচনা হয়নি। সমিতির প্রতিনিধিরা রিফর্মের প্রস্তাব উপস্থাপন করলেও আরইবির প্রতিনিধিরা রিফর্ম চান না এবং এতে চেয়ারম্যানের সম্মতি আছে বলে কমিটিকে অবহিত করে। একপর্যায়ে দেখা যায়, রিফর্মের বিষয়ে আলোচনা বাদ দিয়ে তারা ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেন। ইতোমধ্যে সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা মাননীয় বিদ্যুৎ উপদেষ্টা, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ ছাড়াও সমিতির জিএমরা অচলাবস্থা নিরসন ও সমস্যা সমাধানের জন্য চেয়ারম্যান বরবার চিঠি দেন। এমনকি জিএমরা সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে মাননীয় বিদ্যুৎ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার জন্য সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে চিঠি দেন।

১৬ আগস্ট ২০২৪

কোনো আলোচনা বা সুরাহা না হওয়ায় সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এদিকে ১৬ আগস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আদালত ঘেরাও কর্মসূচি। অথচ কিছু অজ্ঞাতনামা ছাত্রছাত্রী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিচয় দিয়ে আরইবির সামনে মানববন্ধন করে। সেদিনই দিবাগত রাতে আরইবি সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নামে দেশদ্রোহী ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করে।

১৭ আগস্ট ২০২৪

১৭ আগস্ট ভোরবেলা নেত্রকোনায় সমিতির একজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হলে নেত্রকোনার বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাকে ছেড়ে দিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। ইতোমধ্যে মামলার এজাহার ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৬ আগস্ট লিখিত চাকরিচ্যুতির চিঠিগুলো পরদিন ১৭ আগস্ট সমিতিগুলোতে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হয়। ফলে সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গ্রেফতারের প্রতিবাদ হিসেবে প্রতীকী সাময়িক বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখেন। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর আলোচনার আশ্বাসে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার পর পুনরায় সরবরাহ চালু হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই আলোচনার বৈঠকটিও বাতিল হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িক বন্ধ করাকে এতদিনের অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে হাজির না করে দেশদ্রোহ হিসেবে জনগণের সামনে হাজির করা হয়।

১৬ ও ১৭ আগস্ট দুদিনে সমিতির ১৭১ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর নামে দেশদ্রোহ ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা ও ২৪ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। মামলায় মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেওয়া হয়। ৬৩ জনকে ১৭ আগস্টের পর সপ্তাহজুড়ে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করা হয়।

২৩ অক্টোবর ২০২৪

আন্দোলনের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-জনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গণমাধ্যমে কথা বলা শুরু করলে ২৩ অক্টোবর আরইবি-পবিস বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। জাতীয় কমিটির সদস্যরা হলেন:

        ১) অধ্যাপক জনাব সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, ভাইস চ্যান্সেলর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি

        ২) অধ্যাপক জনাব এ কে এনামুল হক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এবং সদস্য

        ৩) অধ্যাপক জনাব মো. জিয়াউর রহমান খান, ইইই, বুয়েট এবং সদস্য

        ৪) অধ্যাপক জনাব মো. মাহবুব রহমান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য

        ৫) অধ্যাপক জনাব খালেদ মাহমুদ, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য

সরকার কর্তৃক জাতীয় কমিটি গঠনের পর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীরা তাদের সব আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কাজে ফিরে যান। এরপরও আরইবি ১৭ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৫৬ জনকে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করে। এ সময় আরইবির কর্মকর্তারা বিভিন্ন সমিতিতে গিয়ে হুমকি-ধমকিসহ বিভিন্ন প্রকার নিপীড়ন চালাতে থাকেন। আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পরও আরইবির এমন নিপীড়নে অসহায় হয়ে তা বন্ধ এবং নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করে প্রেস রিলিজ প্রদান করে।

১৫ নভেম্বর ২০২৪

মামলা, চাকরিচ্যুতি, শাস্তি ইত্যাদি হুমকি চলমান থাকায় পুনরায় ১৫ নভেম্বর সমিতির আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন। তা সত্ত্বেও পরদিন ১৬ নভেম্বর আবার একজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়।

১২ ডিসেম্বর ২০২৪

১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ জন কর্মকর্তা/কর্মচারী জামিনে কারামুক্ত হন এবং ২ জন তখনও জেলবন্দি। এর পর থেকে আরইবি পুনরায় সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীকে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বদলি করা শুরু করে এবং ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন শতাধিক কর্মকর্তা/কর্মচারীকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বদলি করে। এর মধ্যে রয়েছে নারী বিলিং সহকারী অফিসার, যিনি আরইবির সঙ্গে আলোচনায় বিলিং বিষয়ক সমস্যা নিয়ে কথা বলায় আক্রোশের শিকার হন। একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা হয়েও উনি ছাড় পাননি। হয়রানিমূলক এসব বদলি অব্যাহত রয়েছে। একদিকে কমিটি কাঠামো পুনর্মূল্যায়ন করছে, অন্যদিকে সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পরও উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করা সংস্কারের বিরুদ্ধে ও বৈষম্যের পক্ষে আরইবির অটল অবস্থানই প্রকাশ করছে। আরইবি কর্তৃক সমিতির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নতুন করে আবারও হয়রানি শুরু করায় বিদ্যুতের মতো জরুরি ও সংবেদনশীল এই পল্লী বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেকেই বদলি আতঙ্কে দিন পার করছেন এবং কর্মস্পৃহা কমে যাচ্ছে। সঠিকভাবে কাজে মনোনিবেশ না করতে পারার কারণে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •