গ্রন্থ পর্যালোচনা
কীভাবে একটি ‘গণহত্যার কারখানা’ কাজ করে

‘The Palestine Laboratory: How Israel Exports the Technology of Occupation Around the world’ বইটির লেখক অ্যান্টনি লভেনস্টেইন(জ. ১৯৭৪)। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিবাসী স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্রকার। ২০২৩ সালে তাঁর এই বইটি প্রকাশিত হয়। প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের ভূমিকা এবং যুদ্ধ নজরদারি অর্থনীতি বোঝার জন্য এই বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বইয়ের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ভারতের সাময়িকী ফ্রন্টলাইন (সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গ্রন্ধ পর্যালোচনা, “How a ‘mass assassination factory’ works” এর অনুবাদ প্রকাশ করছি। পর্যালোচনা করেছেন তালমিজ আহমেদ (সৌদি আরব, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত)। অনুবাদ করেছেন নিশাত তাসনিম।
‘গাজায় সংঘর্ষ, এই অঞ্চলে সংঘটিত বিশাল আকারের হত্যাযজ্ঞ এবং কীভাবে সেখানে রপ্তানি বাজারের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অস্ত্রের সরাসরি পরীক্ষা চালানো হচ্ছে সেসব সম্পর্কিত সকল তথ্যের প্রবাহের ওপর ইসরাইলী নিয়ন্ত্রণ এই বইয়ের আলোচ্য।’
গাজা যুদ্ধের ১০ মাসে ইসরাইলি যুদ্ধ মেশিন সেখানে ৪০,০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, আরো ৭০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে পশ্চিম তীরে এবং কয়েক হাজার মানুষ ইসরাইলি কারাগারগুলোতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গাজায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৭০% ই নারী ও শিশু। অপরিসীম ঘৃণা এবং নিষ্ঠুরতার ফলাফল এই মৃত্যুগুলো বর্ণিত হচ্ছে গণহত্যা হিসেবে, একটি পরিহাসমূলক নিন্দিত অবস্থা সেই রাষ্ট্রের জন্য যার নিজেরই উত্থান হয়েছে ভয়ঙ্কর গণহত্যার মধ্য দিয়ে।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বিভাগের বিভিন্ন দিক, এটির বৈশ্বিক প্রচার ও প্রভাব এবং ইসরাইল তার দখলকৃত অঞ্চল- পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমের ধ্বংস নিশ্চিত করতে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে-যেগুলো প্রকাশিত নয় অথবা যদি সেগুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও থাকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখানে নিরব দর্শক হিসেবেই রয়ে যায়- সেসব নিয়ে আলোচনা করতেই অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক বিশিষ্ট ইহুদি ধারাভাষ্যকার অ্যান্টনি লভেনস্টেইন এই বইয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
ইসরাইল চেষ্টা করেছে ভুল উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিশ্বে তার অবস্থান অর্জন করতে। যদিও ইউরোপে ইহুদিরা দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে তাদের খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের দ্বারা বৈষম্য ও গণহত্যার শিকার হয়েছে, ইসরাইলের সূচনালগ্নে জায়ানবাদের কট্টর সমর্থক থিওডোর হার্জল ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিগমনকে নায্যতা দিয়েছিল এই বলে যে, নতুন রাষ্ট্র ইসরাইল হবে “এশিয়ার বিপরীতে ইউরোপের দেওয়ালের একটি শাখা, আমাদেরকে বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার একটি দূরবর্তী শাখা হিসেবে কাজ করতে হবে”। এই বিবৃতি, যার কোন ঐতিহাসিক সত্য ভিত্তি নেই, অব্যাহত ভাবে পশ্চিমের অশিক্ষিতদের প্রলুব্ধ করতে উৎসাহিত করে যাচ্ছে।
২০১৭ এর মতো সাম্প্রতিক সময়ে এসেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনে তাদের দখলদারিত্ব ও নিপীড়নকে নায্যতা দিয়েছিল, “আমরা (ইসরাইল) ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ। ইসরাইলে এসেই ইউরোপের সমাপ্তি ঘটেছে। ইসরাইলের পূর্বে, এরপর আর কোন ইউরোপ নেই” এই বক্তব্যের মাধ্যমে, একটি বহুসংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ পরিসরে বৈচিত্রময় সম্প্রদায়গুলোর আবাসযোগ্যতার ধারণাকে খারিজ করে দেওয়ার মাধ্যমে।
নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বলেন “এটা (ইসরাইল) হলো মৌলবাদী ইসলাম এর সাথে মুক্ত ও সভ্য পৃথিবীর সম্মুখ সীমারেখা। আমরা ইরাক ও ইরান থেকে ভেসে আসা মৌলবাদী ইসলামের ঢেউকে ইউরোপের দিকে যাওয়া থেকে রুখে দেই”। এটি বলার মধ্য দিয়ে সে বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আতঙ্কে ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করেছে। যেটা নেতানিয়াহু স্মরণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হল, ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে তার দমন-পীড়নই পশ্চিমের বিরুদ্ধে জিহাদকে নায্যতা দান ও উসকে দেওয়ার পেছনে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
লভেনস্টেইন ইসরাইলি যে পলিসি ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্বকে বৈধ সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বত্ত্বাতে অমিশ্রণযোগ্য করে দেখায় সেটিকে বর্ণনা করতে গিয়ে “পলিটিসাইড” প্রপঞ্চটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এটি একটি লম্বা ধারাক্রমঃ ইসরাইল এবং এর দখলকৃত অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার মধ্যে অইহুদির সংখ্যা ইহুদি জনগোষ্ঠির থেকে বেশি। যেখানে অইহুদি জনগোষ্ঠির সংখ্যা ৫৩% সেখানে ইহুদি মোট ৪৭%। ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগণকে কাঠামোর ভেতর দিয়ে “আলাদা” করে দেওয়ার মাধ্যমে তার এই চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা করে। শারীরিক ভাবে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়গুলোর মাঝ দিয়ে দেওয়াল তুলে দেওয়ার মাধ্যমে আর মানসিক ভাবে আলাদা করা হয়েছে একটা নিষ্ঠুর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যা ফিলিস্তিনিদের দেখায় বর্বর, অযৌক্তিক, নীচ এবং “জঙ্গী” হিসেবে।
যদিও ২০০৫ সালে শেষ ইহুদি সেটেলারদের গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে দুই মিলিয়নেরও বেশী সংখ্যক ইসরাইলি দিয়ে পরিবেষ্টিত অঞ্চলটি উঁচু বেড়া দিয়ে বদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যার বেশীরভাগই বন্ধ সীমানা এবং সার্বক্ষণিক এটিকে লক্ষ্যবস্তু করে রাখা হয়েছে ড্রোনের নজরদারিতে ও নিয়মিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে।
ফিলিস্তিনিদের ওপর পশ্চিম তীর ও গাজায় এই আক্রমণগুলো ইসরাইলকে তার অস্ত্রের বাজারজাতকরণ সহজ করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরীক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। লভেনস্টেইন দেখান যে, ২০০৯ সালে প্যারিসের বিমান প্রদর্শনীতে ইসরাইলের বিপনন দল তাদের অস্ত্রের কর্মক্ষমতা দেখানোর জন্য ফিলিস্তিনিদের হত্যার আসল দৃশ্যগুলো দেখিয়েছিল। গাজায় শেষবারের যুদ্ধে রপ্তানিবাজারের জন্য তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন অস্ত্রের সরাসরি পরীক্ষা চালিয়েছে যা ইসরাইলকে একটি “গণহত্যার কারখানা’তে রূপান্তর করেছে।
বর্তমানে ইসরাইল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অস্ত্র জোগানদাতা। এটির ৩০০ টি কর্পোরেশন এবং ৬০০০ বেশি স্টার্টআপ রয়েছে প্রতিরক্ষা শাখায়, সেখানে প্রায় ১৪০০০০ ইসরাইলি কর্মরত আছে যা তাদের মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ১০%। ২০২১ সালে ইসরাইলী প্রতিরক্ষাবাহিনী ১১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি করেছিল দুই বছরে যা ৫৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। আলাদা ভাবে সে বছর এটির সাইবার সিকিউরিটি ফার্মগুলো ১০০টি চুক্তি সম্পন্ন করেছে যার মূল্যমান ৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই কম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মগুলোর সাথে খুব ঘনিষ্ট ভাবে কাজ করে। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টাতে এই দুই রাষ্ট্র যৌথভাবে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার সকল কট্টর স্বৈরাচারদের সমর্থন দিয়ে গেছে।
২০২১ সালে ইসরাইলী প্রতিরক্ষাবাহিনী ১১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি করেছিল দুই বছরে যা ৫৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। আলাদা ভাবে সে বছর এটির সাইবার সিকিউরিটি ফার্মগুলো ১০০টি চুক্তি সম্পন্ন করেছে যার মূল্যমান ৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইসরাইল ছিল আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের নিয়মনীতি প্রণয়ন, এমনকি আফ্রিকা ও তার প্রতিবেশী অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একটি প্রধান অংশীদার। ইসরাইল বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে “বানটাস্টাইন” ধারণাটি নিয়ে বর্তমানে ১৬৫ জন ফিলিস্তিনীকে পশ্চিমতীরে ইসরাইলি বসতি ও শত্রুতাপূর্ণ বন্দোবস্ত দিয়ে “ছিটমহল” এর মতো ঘিরে রেখেছে।
লভেনস্টেইন দেখান যে পৃথিবীর সবচেয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাগুলোর পেছনে মদত দেওয়ার ইসরাইলি পথ তারা স্নায়ুর যুদ্ধের পরও জারি রেখেছে। বর্তমানে ইসরাইল শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, হাঙ্গেরি, মরক্কো, স্পেন, সৌদি আরবের উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার, সংক্ষেপে বললে সেই সমস্ত রাষ্ট্রসমূহ যারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভিন্ন মতালম্বীদের আন্দোলনের মুখোমুখি রয়েছে।
একটি প্রধান অস্ত্র উৎপাদনকারী রাষ্ট্র হওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক নজরদারি ও সাইবার সিকিউরিটি সেক্টরগুলোতেও ইসরাইলের উত্থান ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এটির মুখমন্ডল শনাক্তকরণ সম্পর্কিত প্রযুক্তি প্রথম পরীক্ষিত হয় এর দখলকৃত অঞ্চলগুলোর অসংখ্য চেকপয়েন্টগুলোতে। এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যেন চিহ্নিত ফিলিস্তিনিদের টার্গেট করে বিমান হামলা চালানো যায়, যেমনটা লভেনস্টেইন বলেছেন, “ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা অথবা আহত করা যেন পিৎজ্জা অর্ডার করার মতোই সহজ”। এই প্রযুক্তিগুলো এখন সফল ভাবে বাজারজাত করা হয়েছে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়াসহ পুরো পৃথিবীর সব আধিপত্যবাদী শাসকদের কাছে। অস্ত্র বিক্রি ইসরাইলের জন্য পৃথিবীব্যপী একটি শক্তিশালী সমর্থক ভিত্তি তৈরি করেছে।
একটি প্রধান অস্ত্র উৎপাদনকারী রাষ্ট্র হওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক নজরদারি ও সাইবার সিকিউরিটি সেক্টরগুলোতেও ইসরাইলের উত্থান ঘটেছে ব্যাপকভাবে। এটির মুখমন্ডল শনাক্তকরণ সম্পর্কিত প্রযুক্তি প্রথম পরীক্ষিত হয় এর দখলকৃত অঞ্চলগুলোর অসংখ্য চেকপয়েন্টগুলোতে।
দখলকৃত অঞ্চলে ইসরাইলের কার্যকলাপের সমালোচনা বন্ধ করতে ইসরাইল বিভিন্ন হাতিয়ার ব্যবহার করে। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলো জনপরিসরে যেসব ব্যক্তি বা রাষ্ট্র ইসরাইলের কর্মকান্ড নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে “ইহুদি বিদ্বেষ” এর অভিযোগ আনা। জার্মানির বিষয়ে লভেনস্টেইন বলেন, ইসরাইলি নৃশংসতার ব্যাপারে ইসরাইল তাদেরকে নিঃশ্চুপ থাকার তাগাদা দিয়েছে এটিকে ‘পুনর্বাসন” এর সাথে যুক্ত করে এবং ইসরাইলি অস্ত্রের বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে। এই পদ্ধতিটি উল্লেখযোগ্য ভাবে সফল হয়েছে।
অনুরূপ ভাবেই বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ইসরাইলি প্রভাবের মধ্যে রয়ে গেছে। এগুলো ফিলিস্তিনিদের পক্ষের বার্তাগুলোকে কমিয়ে আনে ও ইসরাইলের সমর্থনে দেওয়া বার্তাগুলো যেন মুছে না যায় সেটা নিশ্চিত করে, এমনকি যখন তারা ফিলিস্তিনিদের গণহারে নির্বাসিত করা বা গণহত্যার প্ররোচনা দেয় তখনও। লভেনস্টেইন এটিকে “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অস্ত্রায়ন” নামে অভিহিত করেছেন।
লভেনস্টেইন ভারত-ইসরাইল যৌথতা নিয়ে বিস্তারিত কিছু আলোচনা করেছেন। তিনি খুঁজে বের করে দেখিয়েছেন যে ভারত শুধু ইসরাইলী অস্ত্রাদি কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে তা-ই নয় বরং এটি ইসরাইলি কিছু কৌশলকেও গ্রহণ করেছে নিজ দেশের জনগণের মধ্যকার ক্ষুব্ধ অংশটিকে দমনের জন্য। এর মধ্যে আছে “দমনমূলক কলাকৌশল” যেমন ভিন্নমতালম্বীদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দিতে বুলডোজার ব্যবহার করা, আরও আছে রাজনৈতিক সমালোচকদের ওপর মুখমন্ডল শনাক্তকরণ ও ফোন হ্যাক করার মতো নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার।
গাজায় সহিংসতা ও ধ্বংস এবং ইসরাইলের অপরিসীম নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি বৈশ্বিক নিন্দা চলছে, এই অভূতপূর্ব সমালোচনার মুখে ইসরাইলকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কখনোসখনো ইসরাইলের কর্মকান্ড নিয়ে কিছু সাড়াশব্দ করেছেন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরাইলের প্রধান অস্ত্র জোগানদাতা হিসেবেই রয়ে গেছে।
খোদ ইসরাইলের অভ্যন্তরেও অসন্তুষ্টির প্রকাশ চলছে। কিন্তু লভেনস্টেইন দেখিয়েছেন যে, অধিকাংশ ইসরাইলির কাছে আরবদের গণ নির্বাসনে পাঠানোর যে উদ্দীপনা ও লক্ষ্য সেটি ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে। উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা আরো কঠোর হামলা, এমনি জাতিগত ভাবে নির্মূল করার হুমকি নিয়মিত দিয়ে চলেছে। একজন সিনিয়র সম্পাদক স্বীকার করেছেন যে, অনেক ইসরাইলি যেসব “প্রপঞ্চ” ব্যবহার করছে তা যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের থেকে ধার করা।
লভেনস্টেইন হচ্ছেন নোয়ান চমস্কি, ইলান পেপ এবং অভি স্লেইমদের মতো সেই অসাধারণ ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন যারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ইসরাইলি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারাক্রম, এটির রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থার নির্যাস, পৃথিবীর সকল স্বৈরাচারদের সাথে এর গভীর সম্পর্ক এবং দেশের অভ্যন্তরে ভিন্নমতালম্বীদের দেখার ক্ষেত্রে তাদের সহিংস ও রুক্ষ পথ নিয়ে। এই সবকিছুই প্রথমদিকের সেই সব পূজারীদের আদর্শ থেকে অনেক দূরের যারা তাদের জায়ানবাদী সত্ত্বাকে “পৃথিবীর আলো” হিসেবে মনে করতো।
লভেনস্টেইন হচ্ছেন নোয়ান চমস্কি, ইলান পেপ এবং অভি স্লেইমদের মতো সেই অসাধারণ ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন যারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন
গাজায় চলমান যুদ্ধের সময় এই বইটির প্রকাশ তথ্য প্রবাহের উপর ইসরাইলি আধিপত্য ও দায়মুক্তির পথে সময়োপযোগী ও কার্যকর চ্যালেঞ্জ। যে আধিপত্য ও দায়মুক্তি গাজায় দৃষ্টিসীমার বাইরে ঘিরে রাখা অঞ্চলটিতে এখন পর্যন্ত তাদের ঘটানো সহিংসতা ও গণহত্যার ঘটনাকে ঝেড়ে ফেলার প্রয়াস তৈরি করে। উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে লভেনস্টেইনের উপসংহার, যেখানে বলা হয়েছে যে, সামনের বছরগুলোতে ইসরাইলে যদি আমূল কোন পরিবর্তন না ঘটে তাহলে তাদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে ইহুদি-ফিলিস্তিনি সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং ইসরাইলি স্টাইলের ধর্মীয় জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ফুলে ফেপে উঠবে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির ঢেউ এর জন্য উর্বর মাটি জোগাবে।
ইসরাইলি এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনেক দূরে।
নিশাত তাসনিম: গবেষক। ইমেইল: tasnim.nishat.ju@gmail.com