সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অনির্বাচিত আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ অত্যাচারী সরকার পতনের পর ছয় মাস পার হয়েছে। এর মধ্যে সরকার অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছে, যার কিছু কিছু রিপোর্ট  ইতিমধ্যে জমা পড়েছে। সংবিধান ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলছে বেশি। সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে এ নিয়ে সরকার ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক চললেও সরকারের ভূমিকায় সংস্কার অর্থ এখনও পরিষ্কার হয়নি। গণঅভ্যুত্থানে যারা নিহত ও গুরুতর আহত হয়েছেন তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বা কর্মজীবী। নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায়। ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন-রাত কাটাচ্ছেন এখনো। মন্দির, মাজার, মসজিদসহ বহু শিল্পকর্ম আক্রান্ত হয়েছে। বহু কারখানা অচল হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার, বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। হাসিনা আমলের পরিবেশ বিধ্বংসী প্রাণবিনাশী প্রকল্প এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি এখনো অব্যাহত আছে। যানজট দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে। এর মধ্যে সরকার নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে জনজীবনে আরও বোঝা চাপিয়েছে। 

অন্যদিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী নানা গোষ্ঠী যারা গত দেড় দশকে নানাভাবে শক্তিবৃদ্ধি করেছে তাদের আক্রমণাত্নক তৎপরতা বেড়েছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। বহু মাজার ভাঙচুরের পর একাধিক উপদেষ্টা কয়দিন আগে জানালেন তারা আর মাজারে আক্রমণ সহ্য করবেন না। এই ঘোষণার পর আরও কয়েকটা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে শিল্প সংস্কৃতির নানা আয়োজন, শিল্পীদের অনুষ্ঠানও বাধার মুখে পড়ছে। এদিকে যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কর্তৃত্বে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ধারা দখল, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির পথ তৈরি করেছিল সেই ধারাও অব্যাহত রাখা হচ্ছে।

শিক্ষার্থী জনতার গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া ছাপিয়ে বিশ্ব জুড়েই এক বড় আলোচনা বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেই বিতর্কের একটি মুখ্য বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে এ সংখ্যার ‘জুলাই আন্দোলন: কালার রেভল্যুশন, রেভল্যুশন নাকি গণ-অভ্যুত্থান?’ লেখায়।

সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কারের জন্য বিভিন্নজন মতামত/প্রস্তাব দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন। এই সংখ্যায় কিছু প্রস্তাবসহ কয়েকজনের অভিমত প্রকাশ করা হলো- যথাক্রমে জাকিয়া আফরিন, কল্লোল মোস্তফা, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, মাহা মির্জা, আনু মুহাম্মদ এবং কয়েকটি নারী সংগঠন, (মাহা মির্জার প্রস্তাব অনলাইনে যুক্ত করা হয়েছে)। ‘২৪-এর গণআন্দোলনের গান’ এর ২য় পর্বে আরও গান যুক্ত করা হয়েছে। ‘মাগুরায় গণঅভ্যুত্থান: একজন সংগঠকের ডায়েরী’ লেখায় ঐ শহরে কীভাবে একদল কম বয়সী শিক্ষার্থী নিজেদের তাগিদ থেকে প্রতিবাদ শুরু করার পর পুরো শহর জেগে উঠলো তারই বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

এর পাশাপাশি এই সংখ্যায় ‘উন্নয়নের ‘স্লো পয়জনিং’-এর কালে’ লেখায় উন্নয়ন নামের অব্যাহত বিষতৎপরতা আলোচনা করা হয়েছে। ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত’ লেখায় সরকারের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলন যে নিছক বেতন বাড়ানোর আন্দোলন নয় তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া থাকছে চলচ্চিত্রে আমেরিকান ড্রিম/মার্কিন স্বপন নিয়ে আলোচনা।

ধারাবাহিক লেখা ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর’ ৭ম পর্বে ১৯৮১ সালে ‘জিয়া খুন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন এবং আরেক নির্বাচন’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান’- ১৪শ কিস্তিতে মূলত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় লুম্পেন পুঁজির আধিপত্য এবং তার প্রভাবের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। তারিক আলীর ‘মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা’-৮ম পর্বে পরাজয়ের অধ্যায়সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেখানে আরব কবির বিখ্যাত কবিতার অনুবাদ আছে। প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের ভূমিকা এবং যুদ্ধ নজরদারি অর্থনীতি নিয়ে লেখা বই এর পর্যালোচনা অনুবাদ ‘কীভাবে একটি ‘গণহত্যার কারখানা’ কাজ করে’ থাকছে এই সংখ্যায়।   

আরও থাকছে সেমিনার রিপোর্ট ‘স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথ: বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সন্ধানে’ এবং সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য- ‘চিনিকলের পর পাটকলসহ সকল বন্ধ কলকারখানা খুলে দেওয়ার দাবি’। অনলাইনে থাকছে বিবৃতি- ‘পাঠ্যপুস্তকে ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবি এবং আদিবাসীদের ওপরে হামলা-আক্রমণের নিন্দা ও প্রতিবাদ’।  

আনু মুহাম্মদ

২৯শে জানুয়ারি ২০২৫

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •