উন্নয়নের ‘স্লো পয়জনিং’-এর কালে
মওদুদ রহমান

মানুষ মানুষের চোখে
আরও বেশি বেশি তাকাবে বলে
বোবা সব প্রাণের ভাষা শিখে আরও খুশি ছড়াবে বলে
সরকার সিদ্ধান্ত নিলো,
দিনপ্রতি খরচের জন্য বরাদ্দ হলো
মাথাপিছু ১৬৭টি শব্দ মাত্র।
মার্কিন কবি জেফরি ম্যাকডেনিয়েলের The Quiet World কবিতার উপরের প্রথম ছয়টি লাইনে আমরা দেখতে পাই এক স্বৈরাচারী সরকারকে, যে কিনা মানুষের কথার ডানা ছেঁটে ফেলতে চায় ভাষাহীন প্রাণের সঙ্গে মানুষের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার উছিলায়। কথা বন্ধ করে দিয়ে কল্পিত সেই স্বৈরাচার মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও গাঢ় করতে চায়। অনেকেই ভাবতে পারেন, এমন সরকার কেবল কবির কল্পনাতেই বর্তমান, বাস্তবে এর অস্তিত্ব হয়তো অসম্ভব। তবে গত ১৬ বছর যারা বাংলাদেশে প্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন কিংবা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টারত সব প্রাণের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি আর ছটফটানির খবরাখবর রেখেছেন, তাদের কাছে এমন স্বৈরাচারী সরকার কবির কল্পনাশক্তির চেয়েও বেশি প্রকট। হাসিনা সরকার গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে কখনো সিঙ্গাপুর, কখনো মালয়েশিয়া বানানোর নাম করে দেশের সমস্ত সম্পদ উন্নয়নের চুলায় চড়িয়ে নিজেদের জন্য লুটপাটের ঘি তৈরি করেছে। এই উন্নয়নের রাহু গিলে খেয়েছে আস্ত মানুষ, গিলেছে গাছপালা, নদীনালা, পশু-পাখি সব। অবশেষে এই ১৬ বছরের পর যারা টিকে থাকলেন তাদের হয়তো দায়িত্ব হবে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে একে অপরের সঙ্গে পথ চলতে চলতে, বাস আর লেগুনায় ঝুলতে ঝুলতে, পাড়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে বসে, টিকিট কাউন্টারের সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করা, তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া। এই মাটিতে আগামীর যে প্রাণ জন্মাবে, যে গাছ বড় হবে, যে হরিণছানা দৌড়াবে, যে কৃষক বীজ বুনবে তাদের সবার প্রতি আমাদের দায় হাসিনাশাহির ইতিহাস ভুলতে না দেওয়ার। এই ইতিহাসের ছবি আঁকা হতে থাক গল্প, কবিতা, নাটক আর সিনেমায়।
হাসিনা সরকার গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে কখনো সিঙ্গাপুর, কখনো মালয়েশিয়া বানানোর নাম করে দেশের সমস্ত সম্পদ উন্নয়নের চুলায় চড়িয়ে নিজেদের জন্য লুটপাটের ঘি তৈরি করেছে। এই উন্নয়নের রাহু গিলে খেয়েছে আস্ত মানুষ, গিলেছে গাছপালা, নদীনালা, পশু-পাখি সব।
খোঁড়া ঘোড়ায় বাজি ধরা
২০০৮ সালের নির্বাচনে এক বিশাল সংখ্যক তরুণ বিপুল উৎসাহে ভোটকেন্দ্রে যায়, যাদের অধিকাংশই প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিল, যেই দলে ছিলাম আমি নিজেও। সে সময় কী কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষে এত ভোট পড়ল সেই বিষয়ে সবার পক্ষ হয়ে গড় মন্তব্য করার ধৃষ্টতা আমার দেখানো উচিত হবে না। আমি কেবল আমার নিজের এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে করা ব্যক্তিগত আলাপের রেফারেন্স দিয়ে বলতে পারি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আওয়ামী লীগ জোটের প্রতিশ্রুতিতে আমরা ভীষণ মজে গিয়েছিলাম। আর মজা খাওয়া ফজা ভাইয়ের জাতস্বভাবলব্ধ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর দোসররা এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছিল। সেই সঙ্গে অতি অবশ্যই যুক্ত হয়েছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অব্দি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসন, সেই সময়ে টানা পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কলঙ্ক অর্জন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জীবন, জিনিসপত্রের বাড়তি দামের অত্যাচার আর হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক কমিশন বাণিজ্যের নানান খবরাখবর [১]।
ভোটকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো পাওয়া ভোটের অধিকারটা পাঁচ বছরের জন্য কার বাক্সে জমা দেব সেটা নিয়ে বন্ধুমহলে খুব আলোচনা হতো। আমরা আমাদের মতো করে নানান বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতাম। সেখানে বিগত বিএনপি সরকারের আমলে একই স্ক্রিপ্টে অস্ত্র উদ্ধারের কাহিনির আড়ালে আসলে কী ঘটেছে সেই বিষয়ের ওপর যত প্রশ্ন উঠত, জবাবগুলো ততটা সহজলভ্য ছিল না। প্রতিটি অস্ত্র উদ্ধার মিশনের নাটকীয়তা আর পালিয়ে যেতে চাওয়া জঙ্গির মৃত্যুসংবাদ চ্যানেলগুলোতে যতটা উদ্যাপিত হতে দেখতাম তার বিপরীতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোকে প্রশ্ন করার বোধটা দেখতাম ততটাই প্রাণহীন।
দাঁড়িপাল্লায় যেসব সংখ্যা আর পরিসংখ্যানের ওজন চড়ালে একজন শিক্ষার্থীকে ‘ভালো’ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘নামকরা’ বলা যায়, আমি ছিলাম সেসব বর্গভুক্ত জমিনের বাসিন্দা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার চলাফেরা, ওঠবস সেই গণ্ডির ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি আর ‘ক্যারিয়ার’ গোছানোই ছিল একমাত্র আলাপ। সেখানে ছাত্র রাজনীতির কোনো চর্চা ছিল না। সেখানে ধানের আবাদের ক্ষতি আর বনশালিকের দুঃখ স্থান পেত না। এত কিছুর পরও ২০০৮-এর নির্বাচন আমার এবং আমার দেখা, চেনাজানা অসংখ্য তরুণের মাঝে এক অপরিসীম আশার সঞ্চার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী খুনি আর অপরাধীদের বিচার ছিল এই আশার কেন্দ্রবিন্দু। সেই সঙ্গে ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হওয়ার চটকদার বিজ্ঞাপন। এমন-না যে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী দুঃশাসনের ব্যাপারে আমরা একেবারেই জানতাম না, এমনও-না যে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণা আর বাকশালি ব্যবস্থার কলঙ্ক আমাদের তর্কবিতর্কে উঠে আসেনি, কিংবা এমনও-না যে, ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে আমরা সাধুজ্ঞান করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ জোট সে সময় ছিল আমার এবং বোধ করি আমার মতো অসংখ্য মানুষের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে টেক্কা দিতে পারনেওয়ালা একমাত্র বিকল্প। আমরা জানতাম ঘোড়াটা খোঁড়া, কিন্তু আমরা সেই খোঁড়া ঘোড়াতেই বাজি ধরেছিলাম।
আওয়ামী লীগ জোট সে সময় ছিল আমার এবং বোধ করি আমার মতো অসংখ্য মানুষের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে টেক্কা দিতে পারনেওয়ালা একমাত্র বিকল্প। আমরা জানতাম ঘোড়াটা খোঁড়া, কিন্তু আমরা সেই খোঁড়া ঘোড়াতেই বাজি ধরেছিলাম।
এলোমেলো শুরু? নাকি পরিকল্পিত?
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২৩০ আসনে। আর জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) মিলিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৩ আসনে জয়ী হয়ে বিরোধী পক্ষকে জাতীয় সংসদে নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ বানিয়ে ফেলে [২, ৩] । শুরু হয় আওয়ামী লীগের অহংকারী কাল। ১৬ বছর পরে এসে শুরুর দিকের এই যাত্রাকালকে মনে হতে পারে খুব হিসেবি। কিন্তু শেখ হাসিনা হয়তো নিজেও নিজেকে এত বড় স্বৈরাচার হিসেবে দেখার দুঃস্বপ্ন দেখেননি। কাজেই গত ১৬ বছরের সব অপরাধের অপরাধীদের তালিকায় হয়তো তাদেরও রাখা দরকার, যাদের ছিল ধারাবাহিক মৌন সমর্থন আর মনে মনে ক্ষমতার গুড়ের প্রতি লোভ।
শুরুর দিকে শেখ হাসিনা জমানার পদক্ষেপগুলো বাহ্যত ছিল এলোমেলো আর হেঁয়ালিপূর্ণ। এটাই হয়তো ফ্যাসিজমের শিশুকালের চিহ্ন। যেমন, হুট করেই ২০০৯ সালে ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় [৪]। যার ফলে নাগরিক জীবনে নেমে আসে নানামাত্রিক বিড়ম্বনা। ফলশ্রুতিতে অল্প সময়ের মধ্যেই এই অপরিকল্পিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন রদ করা হয়। আবার তৎকালীন বিএনপি দলীয় মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে সরাতে কোনো আলাপ-আলোচনার তোয়াক্কা না করেই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুভাগ করে ফেলাটা ছিল প্রথম দিককার আরেকটা চিহ্ন, যার মাধ্যমে ক্ষমতার প্রশ্নে ন্যূনতম চ্যালেঞ্জ জানানেওয়ালাকেও যে শেখ হাসিনা সহ্য করবেন না সেই আলামত তৈরি হয়েছিল [৫]। বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি ইলিয়াস আলীর গুম ঘটনা ছিল একটা ‘লিটমাস টেস্ট’, যার মাধ্যমে হয়তো গদিনশিন সরকার যাচাই করছিল কতটা নির্মমতায় সামনের দিনগুলোতে ক্ষমতার স্টিমরোলার চালানো যাবে। কোমরে নৈতিকতার জোর না থাকায় বিএনপিও এসব অন্যায়-অত্যাচার আর গুম-খুনের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ, জনগণ তখন ঘরপোড়া গরু। সেই গরু একপাশের জলে দেখে বিএনপিসম কুমির আর অপর পাশের ডাঙায় দেখে আওয়ামী বাঘ। সে যাবে কোথায়? মনে রাখা দরকার, যেই র্যাবের বিরুদ্ধে অসংখ্য গুম-খুনের অভিযোগ, সেই র্যাব বিএনপিই প্রতিষ্ঠা করেছিল ২০০৪ সালে [৬] ।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে সেনা অভিযান পরিচালনা শুরু হয়, যে অভিযানের বিস্তারিত বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া অনেকেই জানতেন না। আটক অবস্থায় বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং সেই মৃত্যুগুলো ‘হার্ট অ্যাটাকে’র কারণে হয়েছে বলে সরকারিভাবে প্রচারণা চালানো হয়। সেনাবাহিনী ৮৪ দিন অভিযান পরিচালনার পর তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। যেদিন থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়, তাদের আগের দিন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩’ জারি করা হয়, যার মাধ্যমে ওই সময়কালে হওয়া সব কাজের দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয় [৭]। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, নিরাপত্তা হেফাজতে গুম-খুন, ক্রসফায়ারের বিস্তৃত জমিন তৈরি করে গেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আওয়ামী লীগ সেই জমিনে তৈরি করতে শুরু করল স্বৈরাচারী মিনার।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে সেনা অভিযান পরিচালনা শুরু হয়, যে অভিযানের বিস্তারিত বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া অনেকেই জানতেন না।
২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে অল্প সময়েই নানান অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভিসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। কিন্তু এর বিপরীতে টেলিভিশনের লাইসেন্স পেল আরও কয়েক হালি নতুন টেলিভিশন চ্যানেল। ২০০৯ সালের অক্টোবরে একই দিনে ৭১ টিভি, মোহনা টিভি, চ্যানেল ৯ (নাইন), সময় টিভি, গাজী টিভি (জিটিভি), ইনডিপেনডেন্ট টিভি, মাছরাঙা টিভি, এটিএন নিউজ, মাইটিভি ও বিজয় টিভি–এই দশটি চ্যানেলের সম্প্রচার লাইসেন্স দেয় সরকার। পরের বছর ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, এপ্রিলে এসএ টিভি, ২০১১ সালের জুনে এশিয়ান টিভি, অক্টোবরে গানবাংলা টিভি, ডিসেম্বরে দীপ্ত বাংলা টিভি এবং ২০১৩ সালের অক্টোবরে চ্যানেল বায়ান্নর লাইসেন্স দেওয়া হয় [৮], যেহেতু বন্ধ হয়ে যাওয়া চ্যানেলগুলো তেমন আহামরি সত্যবাদী যুধিষ্টির গোছের কিছু ছিল না। তাই মানুষ পুরোনো কিছু চ্যানেলের বিনিময়ে নতুন টিভি চ্যানেলগুলোর প্রাপ্তিকে রিমোট চেপে একের পর এক চ্যানেল পরিবর্তন করতে পারার বাড়তি পাওনা হিসেবেই দেখল। এটা ছিল গণমাধ্যমের জন্য আওয়ামী লীগের ‘ঝি’কে মেরে বউকে শেখানো’ দাওয়াই। নতুন তল্পিবাহকেরা যে সুরে ক্ষমতাবন্দনা শুরু করল, তার চেয়েও চড়া সুরে টিকে যাওয়া পুরোনো গণমাধ্যমগুলো ক্ষমতার গুণগান গাইতে শুরু করল। ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের যতই আগুন লাগুক, যতই লোডশেডিং হোক, আর যতই মানুষ মরে যাক না কেন; মিডিয়ার চাটুকারিতার কারণে গড়পড়তায় গণমাধ্যমগুলোতে একটা আপাত নির্ঝঞ্ঝাট স্থিতিশীলতার চাপিয়ে দেওয়া পরিবেশ বিরাজ করছিল, যা অটুট ছিল হাসিনাশাহির শেষদিন পর্যন্ত। চরম ভয়ভীতি, জীবিকার প্রতি হুমকি আর জীবনের প্রতি শঙ্কা উপেক্ষা করেও হাতে গোনা কয়েকটা পত্র-পত্রিকা আর নিউজ চ্যানেলের কিছু কিছু ধারাবাহিকভাবে আর কিছু কিছু মাঝেসাঝে সত্য উচ্চারণ করে গেছে, ক্ষমতাকে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছে, যার ফলশ্রুতিতে অনেক লেখক, সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়ে এই সাহসিকতার দাম চুকাতে হয়েছে। অনেককে হতে হয়েছে দেশান্তরী আর বাকিরা নিজ নিজ কপালের বরাতে বেঁচে গিয়েছে। ২০০৯ সালে অনলাইন অ্যাকটিভিজম, ব্লগিং–এগুলো পরবর্তী সময়কালের মতো অতটা ‘গণ’রূপ ধারণ করতে পারেনি। তাই খবরাখবর আর জনমত গঠনের জন্য টিভি চ্যানেল আর পত্রিকাগুলোর ভূমিকা তখনও গৌণ হয়ে যায়নি। ফলে বলা যায়, জনতার আওয়াজকে ক্ষমতার পাহাড়ে চাপা দেওয়া গণমাধ্যমগুলো নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিবাদের পাইক-বরকন্দাজ আর পাহারাদার হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছিল একদম শুরু থেকেই। এভাবেই একটি সরকারি ‘বিটিভি’র পাশাপাশি আমরা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম কয়েক হালি বেসরকারি ‘বিটিভি’ এবং পত্র-পত্রিকা, যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সব অনাচারের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের প্রকল্প আর আমাদের মনোযোগে ছড়াতে শুরু করেছিল স্লো পয়জনিংয়ের ধীর কিন্তু নিশ্চিত বিষ!
এত লাশের গল্প লিখবে কে?
বিগত ১৬ বছরে মানুষ মরেছে হরেদরে। আসলে মানুষ মরেনি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে কাঠামোগত উপায়ে। মানুষ মারা হয়েছে সড়কপথে, নৌপথে আর রেলপথে; মানুষ মারা হয়েছে দালান চাপায়, কিংবা দালান থেকে ফেলে দিয়ে। মানুষকে মারা হয়েছে বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে আবার কখনো ভুল চিকিৎসায়। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে পুড়েছে ১২৫টি মানব শরীর, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাক্টরিতে পুড়েছে ১১২টি শরীর, ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় চাপা পড়েছে ১ হাজার ১৩২টি শরীর, সড়কে কেবল ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে লাশের খাতায় নাম লিখিয়েছে ৩৭ হাজার মানুষ, রেল ক্রসিংয়ের অব্যবস্থাপনার কারণে কেবল বৈধ রেল ক্রিসং না থাকায় ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মারা যেতে হয়েছে ১১১ জনকে [৯, ১০, ১১, ১২]।
গত ১৬ বছরে মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে লাশ হয়েছে, বেতন চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে লাশ হয়েছে, এমনকি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে বেইলি রোডে এক সন্ধ্যায় লাগা আগুনে লাশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ৪৬ জন [১৩]। গত ১৬ বছর যেন ছিল কেবলই লাশ গুনতে পারার স্বাধীনতা। লাশ নিয়ে লুকোচুরি, সংখ্যার মারপ্যাঁচ, অফিশিয়াল আর আন-অফিশিয়াল সংখ্যার গরমিল, বেনামি আহত ব্যক্তিদের নীরব পঙ্গুত্ব, পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের অসহায়ত্ব–এই সবকিছুতেই ক্ষয় হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু কী মানুষ! এই পোড়ার দেশে গত ১৬ বছরে কত লাখ গাছ কেটে রাস্তা নির্মাণ কিংবা চওড়া করা হয়েছে, সেখানে বাঁধা বাসার পাখিগুলো কোথায় গেল সে হিসাব কে রেখেছে? কত লাখ হেক্টর একর পরিমাণ নদীর জায়গা দখল করা হয়েছে, খালবিল ভরাট করা হয়েছে, সে হিসাব কোন রেকর্ডে রাখা আছে? সেখানে চলে-ফিরে বেড়ানো মাছগুলোর কী হলো, সে হিসাব বুঝে নেব আমরা কার কাছ থেকে? নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী হত্যা করে সড়ককে করেছি আমরা প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। অথচ হিমালয় অববাহিকায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ অঞ্চলে নৌপথ হতে পারত সবচেয়ে নিরাপদ, আরামদায়ক আর সুলভ বাহন। তা না করে আমরা হয়েছি জাপানি, কোরীয় আর ভারতীয় বাস আর গাড়ির অন্যতম বৃহৎ বাজার। আমাদের পাতে ওঠার কথা ছিল নদীর বাহারি মাছ, দেশীয় প্রজাতির হাঁস আর মুরগি, অথচ আমরা এখন চাষের তেলাপিয়া আর পাঙাশের সঙ্গেই বেশি পরিচিত। আর কমতে থাকা ক্রয়ক্ষমতার এমনই দুরবস্থা গত ১৬ বছরে হয়েছে যে, ফার্মের মুরগির মাংসের পরিবর্তে গিলা-কলিজাই হয়ে উঠেছে আমাদের পাতের অলংকার [১৪]।
গত ১৬ বছর যেন ছিল কেবলই লাশ গুনতে পারার স্বাধীনতা। লাশ নিয়ে লুকোচুরি, সংখ্যার মারপ্যাঁচ, অফিশিয়াল আর আন-অফিশিয়াল সংখ্যার গরমিল, বেনামি আহত ব্যক্তিদের নীরব পঙ্গুত্ব, পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের অসহায়ত্ব–এই সবকিছুতেই ক্ষয় হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু কী মানুষ!
গত সরকারের আমলে পৃথিবীর সবচেয়ে খরুচে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, ফোরলেন আর সেতু হয়েছে [১৫]। এরা হাওড়ের বুক চিরে বানিয়েছে ২৯ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা [১৬]। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীতে বসবাসের অসম্মান [১৭]। আমাদের কৃষকরা এখন খেতমজুর আর নয়তো মৌসুমি রিকশা শ্রমিক [১৮]। আবার দেশের ক্যানসার রোগীর ৬০ শতাংশ সেই একই হতভাগা কৃষক [১৯]!
ক্যানসারের কথাই যখন এলো তখন বেশি দূরে না গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কয়েক লাইন লিখতে পারি। প্রায় তিন বছর আগে আমার শ্বশুরের ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ে। মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের মিলিয়ে যাওয়া সীমান্তরেখার অর্থনৈতিক বর্গে বসবাসকারী আমি ও আমার পরিবার দেশে থাকা সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ১১ মাসের একটা শারীরিক, মানসিক আর অর্থনৈতিক লড়াই চালিয়েছি। শেষমেশ এই সত্তর না-পেরোনো মানুষটাকে হারাতে হয়েছে, যে কিনা জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় বিদেশে কাজ করেছেন দেশের রিজার্ভে রেমিটেন্সের ডলার জোগান দিতে। আর এরই মাঝে নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে আর ধারকর্জ করে আমাদের ব্যয় হয়ে গেছে প্রায় ২০ লাখ টাকা।
এই অভাগার দেশে হয়তো মরে গিয়েই বেঁচে যেতে হয়। আর যারা প্রাণটা নিয়ে হাঁটে-চলে-খায়, তারা বাঁচে জিন্দা লাশ হয়ে। কয়েক মাস আগে কক্সবাজারে এক গ্যাসের চুলা ঠিক করা মিস্ত্রির সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল, ওনার বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলে। উনি বংশপরম্পরায় পাওয়া নৌকা বাওয়া আর মাছ ধরার পেশা আঁকড়ে ধরে জীবিকা অর্জন করতেন। কিন্তু হাওড়ের বুক চিরে রাস্তা করায় সেখানে মাঝিদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। হাওড়ে মাছও আর পাওয়া যায় না তেমন। তাই সে এক বন্ধুর পরামর্শে পরিবার ছেড়ে অচেনা শহরে কম পুঁজিতে এলাকায় এলাকায় ঘুরে ঘুরে চুলা সারাই করার পেশায় নিজের নতুন জীবিকা খোঁজার চেষ্টা শুরু করেছে। গত ১৬ বছরের উন্নয়নের দাম চুকাতে এরকম যে আর কত লক্ষ জিন্দা লাশের গল্প তৈরি হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানের রেকর্ড কে রাখবে?
কার উন্নতি? কীসের উন্নয়ন?
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী খবরে প্রকাশ: সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এই আজিজ খান প্রায় সাত বছর ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন নিয়মিত। ২০২২ সাল থেকে তাকে ফোর্বসের বৈশ্বিক বিলিয়নিয়ার তালিকায়ও দেখা যাচ্ছে [২০]। আজিজ খানের ভেলকি শুরু হয় মূলত গত ১৬ বছরে করা বিদ্যুৎ ব্যবসার মাধ্যমে। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো সামিটের উৎপাদনে আসা তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ছিল ৩৩ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালে সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ মেগাওয়াটে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালেও কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০৫ মেগাওয়াট, যা বাড়তে বাড়তে ২০২৩ সাল নাগাদ এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৩২ মেগাওয়াট উৎপাদনী ক্ষমতায়, যা কিনা ওই সময়ে দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট ক্ষমতার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ [২১, ২২]। গত ১৬ বছরে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিপরীতে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা কেবল ‘ক্যাপাসিটি চার্জের’ নামেই আদায় করেছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি [২৩]। আর সামিট গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পকেটে গেছে এই ভর্তুকির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যা কিনা প্রায় ১০০ কোটি ডলার মূল্যমানের সমান। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালে ফোবর্সের তালিকায় প্রকাশিত আজিজ খানের সম্পদের মূল্যমানও দেখানো হয় ১১০ কোটি ডলার [২১]।
মুহাম্মদ আজিজ খান এবং তার মতো ব্যবসায়ীরা যখন নানান কায়দায় নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছেন, তখন পরিসংখ্যান আমাদের জানাচ্ছিল যে, দেশের মোট শিক্ষিত জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশই বেকার আর মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত [২৪]। এই অসমতার বিপরীত মেরুর মধ্যবর্তী দূরত্ব হয়তো ক্রমেই আরও বাড়ছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া হয়ে ইউরোপগামী ঝুঁকিপূর্ণ পথের তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যক সওয়ারি হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণরা [২৫]। ‘বোট পিপল’ হিসেবে মারা যাওয়ার তালিকায়ও এই হতভাগারাই শীর্ষস্থানীয়। এমনসব ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শেষমেশ যারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারছে, তাদের জীবনটাও হয়ে থাকে কচুরপাতার পানির মতোই টলমলে। এই আছে, এই নাই। সরকারি হিসাবেই ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এসেছে ২৭ হাজার ৬৬২ জন। বাড়তে থাকা সংখ্যার ব্যাপকতা কতটা, তা হয়তো আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যখন রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান আমাদের বলে যে, ১৯৯৩ সালে যেখানে মাত্র ৫৩ জন শ্রমিকের লাশ ফেরত এসেছিল প্রবাস থেকে, সেখানে সেই সংখ্যা ২০১৯ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩ হাজার ৬৫৮ জনে [২৬]।
দেশে গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এস আলম আর সামিটের মতো কোম্পানিগুলোর রাজত্ব আর অন্যদিকে দেশে বেড়েছে গরিবি, বেকারত্ব আর শ্রমিকের অসহায়ত্ব। একদিকে হাসিনা সরকারের সময়কালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী একাই যুক্তরাষ্ট্রে কিনেছেন ২৫০টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কিনেছেন আরও ২৫০টিরও বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট [২৭]। বিপরীতে তৈরি হয়েছে ভিটেমাটি বেঁচে জীবিকার আশায় অসংখ্য তরুণের ‘বোট পিপল’-এর খাতায় নাম লেখানোর গল্প। এই হিসাবের টালিখাতা মেলাবে কে? এই চলমান অসম উন্নয়নের রথ আর কতটা পথ চলার পর থামবে? আর কতবার গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম হলে বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসবে?
বিপরীতে তৈরি হয়েছে ভিটেমাটি বেঁচে জীবিকার আশায় অসংখ্য তরুণের ‘বোট পিপল’-এর খাতায় নাম লেখানোর গল্প। এই হিসাবের টালিখাতা মেলাবে কে? এই চলমান অসম উন্নয়নের রথ আর কতটা পথ চলার পর থামবে? আর কতবার গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম হলে বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসবে?
উন্নয়নের স্লো পয়োজনিংয়ের কালে
এ লেখার শুরুতে ছোট মুখে বড় প্রস্তাব দিয়ে বলেছি, সবাই মিলে কথ্য ইতিহাস তৈরিতে অংশ নিতে। কারণ, যে গণমানুষের লড়াই-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগে ইতিহাস নির্মিত হয়, সেই ইতিহাস সংরক্ষণের ঠিকাদারি যদি শাসকের হাতে চলে যায়, তাহলে সেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় সত্যের কোরবানি চলে। তাই জুলাই অভ্যুত্থানকালে উজ্জীবনী শক্তি তৈরি করা র্যাপার হান্নান আর সেজানের কথা ধার করে নিজেকে নিজেই মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিই: ‘আওয়াজ উডা,’ ‘কথা ক’।
আমার জীবনের প্রায় অর্ধেক গত হয়েছে হাসিনা সরকারের স্লো পয়োজনিংয়ের কালে। গত ১৬ বছরের প্রথম পর্যায়ে আমি আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাল শেষ করেছি। সেই সময়টা ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর প্রশ্নফাঁসের শুরু। এর পরের পর্যায়ে আমি পার করেছি একটা দীর্ঘ বেকারত্বকাল, যে সময়ে আমি বেশ কয়েক জায়গায় ঘুষ দিতে না চাওয়ার ও পারার অক্ষমতার দরুন সে সময়ে পছন্দনীয় কিছু জায়গায় চাকরিতে ঢুকতে পারিনি। আর চাকরিতে দরখাস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কখনো এক হাজার আবার কখনো দেড় হাজার টাকা ব্যাংক ড্রাফট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বাবার কাছে টাকা চাইবার লজ্জা এড়াতে একপর্যায়ে চাকরির পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করে দেওয়ার কালও ছিল এই গত শাসনামল। শেষমেশ বৃত্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে আসার ঘটনাও আমার জন্য ঘটেছে গত ১৬ বছরের ভেতরেই। এই সময়ে দেখেছি আমাদের এলাকার কমিশনার রাজনীতিতে ‘পদোন্নতি’প্রাপ্ত হয়ে স্থানীয় থেকে জাতীয় নেতা হয়েছেন। তার আবাসস্থল এলাকায় থাকা ৫তলা বাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে গুলশানে। কমিশনারের বাড়ির কাছের এক পান বিক্রেতা ও এলাকার পরিচিত কিছু মুখের উপস্থিতি দেখতে পেতে শুরু করি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নামে টানানো ব্যানার আর পোস্টারে। এই প্রবল প্রতাপশালী সাবেক কমিশনারের এলাকায় থাকা অফিসের কাছে রাস্তার পাশে একটা বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে, যেটা প্রায় আট বছরের বেশি সময় ধরে বয়সের ভারে বেঁকে কেজি কেজি ওজনের তার সমেত লটকে আছে। যেটা কিনা যে কোনো সময় পুরোপুরি ভেঙে পড়ে বহু মানুষ হতাহতের কারণ হতে পারে! কিন্তু এই নেতার কখনো সময় হয়নি এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার। বোধ করি উনি এবং ওনারা ব্যস্ত ছিলেন বৃহত্তর উন্নয়নের ঢোল বানাতে এবং পেটাতে। পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে এমন প্রায় ভেঙে-পড়া বৈদ্যুতিক খুঁটি, নাজুক সাঁকো, আর নড়বড়ে ব্রিজের সংখ্যাগুলো ঠিক কত, তা বের করবে কে? নাকি প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে মরেই প্রমাণ করতে হবে যে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় খাঁটির চেয়ে খাদের পরিমাণ ছিল বেশি? আসল নির্যাসের চেয়ে প্রাণক্ষয়কারী বিষ ছিল বেশি?
২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) শিক্ষার্থীরা গাজীপুরে পিকনিকে যাওয়ার সময় তাদের বহনকারী বাস ১১ হাজার কেভির বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে বিদ্যুতায়িত হয়। এতে মারা যায় তিন শিক্ষার্থী [২৮]। কিংবা এরও আগে একই বছরের মার্চ মাসে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে টিনের চালের ওপর পড়ায় ঘুমন্ত অবস্থা থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পরপারে পাড়ি জমান একই পরিবারের পাঁচজন [২৯]। আমরা ভাবি, আহা! এমন মামুলি সব কারণেও বুঝি-বা এত করুণ মৃত্যু হতে পারে! আসলে গত ১৬ বছরে এমন উন্নয়ন প্রাপ্তিই আমাদের ঘটেছে।
আমাদের খেলার মাঠগুলোতে হয় দালান উঠেছে আর নয়তো চলে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জিম্মায়। আমাদের সন্তানদের জীবন মাদরাসা, বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন আর ইংরেজি মিডিয়ামের চক্করে জেরবার। ফাস্টফুডের দোকানগুলো এখন শহরের প্রধান বিনোদনকেন্দ্র। আমাদের শহরে যত অস্থায়ী পুলিশি চেকপোস্ট বসে, তত পাবলিক টয়লেট নাই।
এই উন্নয়নের বিষ আমাদের দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের খেলার মাঠগুলোতে হয় দালান উঠেছে আর নয়তো চলে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জিম্মায়। আমাদের সন্তানদের জীবন মাদরাসা, বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন আর ইংরেজি মিডিয়ামের চক্করে জেরবার। ফাস্টফুডের দোকানগুলো এখন শহরের প্রধান বিনোদনকেন্দ্র। আমাদের শহরে যত অস্থায়ী পুলিশি চেকপোস্ট বসে, তত পাবলিক টয়লেট নাই। আমরা নাম ফাটাতে নদীর তল দিয়ে অলস টানেল বানিয়েছি, কিন্তু আমাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ঢুকে যাচ্ছে আইসিইউতে। আমরা বিদেশি কোম্পানির পকেটে টাকা ঢেলে ধার করা প্রযুক্তির বড়াই করতে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি মহাকাশে, কিন্তু ঘরের কাছে একটা পাবলিক লাইব্রেরি তৈরি করিনি। আমাদের চালে পুষ্টি নাই, মাছে ক্যানসার সৃষ্টিকারী ডাই-অক্সিন, মাংসে থাকে ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম। [৩০, ৩১, ৩২]। আমাদের বনের পাশে বিশালাকার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আর নদীর পাড়ে পারমাণবিক কেন্দ্র। আমাদের বিশুদ্ধ পানির ভরসা হচ্ছে লিটারপ্রতি ২৫ টাকা দামের প্লাস্টিকের বোতল আর বিশুদ্ধ বাতাসের জিম্মাদার হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দামের এয়ার পিউরিফায়ার। কিন্তু সবাই কি এত এত বিষের ফাঁদ এড়িয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে সুস্থ জীবনের সংস্থান করে নিতে পারছে? নিশ্চিতভাবেই না। এই বিষাক্ত আয়োজনে যারা প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে, তারা স্রেফ মরে গিয়ে বেঁচে যাচ্ছে, আর যারা এখনো বেঁচে আছে, তারা ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত হারতে থাকা পক্ষটির নাম ‘সাধারণ মানুষ’ আর জিততে থাকা পক্ষটির নাম ‘ক্ষমতা’। প্রশ্ন হচ্ছে: আগামীর বাংলাদেশে কি গত ১৬ বছরের মতোই আরেকটা দীর্ঘ গ্রহণকালের শুরু হবে? নাকি এই ক্ষমতা সাধারণ মানুষ নিজের হাতে নেবে?
মওদুদ রহমান: লেখক গবেষক। ইমেইল: mowdudur@gmail.com
তথ্যসূত্র:
[১] বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭, শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৫তম
[২] নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ, পরিসংখ্যান প্রতিবেদন ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
[৩] ডয়চে ভেলে, ৩০ ডিসেম্বর ২০০৮, আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়
[৪] ডয়চে ভেলে, ১৮ জুন ২০০৯, বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাবে এক ঘণ্টা
[৫] ডয়চে ভেলে, ৩০ নভেম্বর ২০১১, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগ করার বিল পাশ
[৬] দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ডিসেম্বর ২০২১, যেভাবে র্যাব গঠিত হয়
[৭] বিবিসি নিউজ বাংলা, ১৭ অক্টোবর ২০২২, অপারেশন ক্লিনহার্ট ২০০২ সালে যেভাবে পরিচালনা করেছিল সেনাবাহিনী
[৮] প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর ২০১৩, বেসরকারি টেলিভিশনের রাজনৈতিক লাইসেন্স
[৯] বিবিসি নিউজ বাংলা, ৩ জুন ২০১১, নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১ বছর
[১০] দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৩ মার্চ ২০২৪, নিমতলী থেকে সিদ্দিকবাজার: কোনো অগ্নিকাণ্ডের মামলার রায় হয়নি আজও
[১১] দ্য ডেইলি স্টার বাংলা ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, সড়ক দুর্ঘটনা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
[১২] কল্লোল মোস্তফা (২০২০), সর্বজনকথা, ৭ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তি
[১৩] প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০২৪, ঢাকার বেইলি রোডে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬ জন, এ পর্যন্ত যা জানা গেল
[১৪] ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা, ১০ মার্চ ২০২৩, দামি মাছ কম, মুরগির গিলা-কলিজায় আটকে যাচ্ছেন ক্রেতারা
[১৫] কল্লোল মোস্তফা (২০২৪), সর্বজনকথা, ১১তম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, শেখ হাসিনা সরকার: দুর্নীতি ও নিপীড়নের খতিয়ান
[১৬] সমকাল, ৬ অক্টোবর ২০২০, অলওয়েদার সড়ক হাওরের বিস্ময়
[১৭] প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ছুটির দিনেও বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা
[১৮] মওদুদ রহমান (২০২৪), সর্বজনকথা, ১০ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, রিকশা কেন চলে? কারা চালায়? কারা চড়ে?
[১৯] কালের কণ্ঠ, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৬০ শতাংশ সরাসরি কৃষিকাজে জড়িত
[২০] বণিক বার্তা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন সামিটের আজিজ খান
[২১] বণিক বার্তা, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে আজিজ খানের সম্পদের উল্লম্ফন ঘটেছে গত এক দশকে
[২২] বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩
[২৩] মওদুদ রহমান (২০২৪), সর্বজনকথা, ১০ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, বিদ্যুৎ খাতের নতুন মহাপরিকল্পনায় পুরোনো ভূতের আছর!
[২৪] কালের কণ্ঠ, ১১ জুলাই ২০২৪, বড় হচ্ছে বেকারের মিছিল, ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত
[২৫] বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৬ জানুয়ারি ২০২২, মানব পাচার: মৃত্যুর ঝুঁকি থাকার পরও লিবিয়া-ইউরোপে পাচার কেন ঠেকানো যাচ্ছে না?
[২৬] বিবিসি নিউজ বাংলা, ১ জানুয়ারি ২০২০, বিদেশ থেকে দেশে ফেরা শ্রমিকের লাশ: মৃত্যুর বড় কারণ কী?
[২৭] প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০২৪, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ কেনাবেচায় যুক্তরাজ্যের ফার্মগুলোর ভূমিকা খতিয়ে দেখার তাগাদা
[২৮] দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, শিক্ষার্থীর মৃত্যু: আইইউটিতে ৩ দিনের শোক
[২৯] ঢাকা ট্রিবিউন বাংলা, ২৬ মার্চ ২০২৪, তার ছিঁড়ে ঘরের চালায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু
[৩০] প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি ২০২৪, গবেষণা: চাল চকচকে করতে গিয়ে বাদ পড়ে পুষ্টি
[৩১] যুগান্তর, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, তেলাপিয়া মাছ খেলে হবে যেসব বিপদ!
[৩২] প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮, মুরগি ও মাছের খাবারে বিষাক্ত ট্যানারির বর্জ্য