জিয়া খুন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন এবং আরেক নির্বাচন

বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৭

জিয়া খুন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন এবং আরেক নির্বাচন

আনু মুহাম্মদ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫৩ বছর অতিক্রম করেছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বেড়েছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে, শাসনব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। ১৯৯০ ও ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানে দুবার স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। এই কয়েক দশকে অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠামো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে, কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে আটকে গেছে দেশ। এই ধারাবাহিক লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ডায়েরী ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের  রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। সপ্তম পর্বে ১৯৮১ সালে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট খুন, নির্বাচন এবং আরেক বার সামরিক শাসনের ক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি  সাংগঠনিক তৎপরতার কিছু অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করা হয়েছে।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে ‘হিজবুল বাহার’ নামের জাহাজে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে কয়েকদিনের এক সফরের আমন্ত্রণ পেলাম। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে যারা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় শীর্ষস্থান লাভ করেছেন প্রধানত তাদের নিয়েই এই তিনদিনের সফরের আয়োজন ছিল। সফরটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল, কিন্তু ততদিনে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শিক যে অবস্থান দাঁড়িয়েছে তাতে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ডায়েরিতে বেশ কড়া কড়া কথা লিখেছিলাম দেখলাম। যেদিন ভোরে এই জাহাজ সফরে ক্যাম্পাস থেকে রওনা দেবার কথা সেদিন বেলা করে বিভাগে যেতেই বিভাগের কার্যকরী প্রধান অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে পাকড়াও করলেন। ঠাট্টা করে বললেন, ‘যেতে পারো নাই কেন? নীতিগত কারণে না ঘুম থেকে উঠতে পারো নাই সেইজন্য?’ পরে জেনেছি এই সফরে বিপুল সমাগম হয়েছিল। এই সফরে মুগ্ধ অনেক কৃতী শিক্ষার্থী পরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। 

এই বছরই আমার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষার আগে মাস দেড়েক ক্যাম্পাসে বেশ আরামদায়ক সময় কাটিয়েছি। যেদিন পরীক্ষা শেষ হয় তার দুদিনের মধ্যেই হলের সিট ছেড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জীবন শেষ করার পর পুরোদমে রাজনৈতিক সাংগঠনিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এই বছরই নতুন পর্বে বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত সাময়িকী সংস্কৃতি প্রকাশনা শুরু হয়, আমি তার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আগে বলেছি ১৯৭৪ সালে জরুরী অবস্থা জারীর পর যখন চারটি দৈনিক বাদে সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা সাময়িকী বন্ধ করে দেয়া হয় তখন সংস্কৃতিও তার শিকার হয়। সেসময় আমি সংস্কৃতি পড়তাম তবে সম্পাদক বদরুদ্দীন উমর বা অন্য কোনো লেখক কারও সাথে আমার তখন দেখা হয় নাই।

১৯৮১তে বাঙলাদেশ লেখক শিবিরেরও নতুন যাত্রা শুরু হয়। এখানেও আমাকে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়, কৃষক ফেডারেশন ও ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে দায়িত্ব নেই। ততদিনে এসব সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা ও সংঘাতও তৈরি হয়েছে। সংগঠন থেকে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বহিষ্কার হন এ বছরই। বাঙলাদেশ লেখক শিবিরসহ বেশ কয়টি সংগঠনের সম্মেলন প্রস্তুতি কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংগঠনগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া জোরদার করার উপায়। এগুলো নিয়ে সব সংগঠনের মধ্যেই ব্যাপক অস্থিরতা ছিল।     

জাতীয় রাজনীতিতেও পরের কয়েক দশকের যাত্রাপথ তৈরি হয় এই বছরেই। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। এই হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা জার্মানী হয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ভারতেই ছিলেন। ১৯৮১ সালে ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হয়। ঐ বছরেরই ১৭ই মে তিনি ভারতের দিল্লী থেকে কোলকাতা হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

একই বছর ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। সেদিন আমি অনিশ্চয়তার আশংকায় মানুষের অস্থির ছুটাছুটি দেখেছিলাম। এর আগে আমি পরীক্ষা শেষ হবার পর বিআইডিএস-এ গবেষণা ফেলো হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। তখন আদমজী কোর্টে ছিল বিআইডিএস অফিস ও লাইব্রেরী। স্থান সংকুলান না হওয়ায় দিলখুশা বাণিজ্যিক এলাকায় আরেকটি ভবনের কিছু অংশ ভাড়া নেয়া হয়েছিল, সেখানেই আমি বসতাম। ওখানে বসেই জিয়া হত্যার খবর পেলাম। সাথে সাথে সব ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে মানুষজন রাস্তায়। মানুষের ভীড়ে কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না, আমি বের হয়ে মানুষের স্রোত দেখতে দেখতে  হেঁটে বাসায় ফিরলাম। এই কদিনের অস্থির সময়ে ফরহাদ মজহারের সাথে রাষ্ট্র রাজনীতির বহু বিষয়ে আলোচনা হলো। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত বিচিত্রা অফিসে। পরে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসে আমাদের অনেক কথা হয়। তিনি সেবছর নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এখানেই যোগ দিয়েছিলেন। ওষুধ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আমার লেখার সূত্রেই আলোচনা শুরু হয়েছিল। মনে আছে ফরহাদ মজহার ও সাকি সেলিমার বাসায় বসেই টিভিতে জিয়ার নানা খবর, তার জানাজায় বিশাল জনসমাগম দেখেছি, কথা বলেছি। 

জিয়া খুনের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি সাত্তার। পরে ১৯৮১ সালের ১৫ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আরেক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সাত্তার সেখানে বিএনপি থেকে প্রার্থী হন। আর তার বিপরীতে প্রার্থী হন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (১৯১৮-১৯৮৪)। তিনি প্রার্থী হলেন নাগরিকদের একটি কমিটির পক্ষ থেকে। ১৯৭০ সালে জেনারেল ওসমানী আওয়ামী লীগে যোগদান করে ছিলেন এবং ‘৭০-এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালেও তিনি সিলেট থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে তিনি সংসদ সদস্য, মন্ত্রিত্ব এবং আওয়ামী লীগ সদস্য পদ ত্যাগ করেন। পরে মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের পর তিনি পদত্যাগ করেন।

১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জেনারেল (অবঃ) এমএজি ওসমানী অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তখন জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর), বাংলাদেশ পিপলস লীগ, গণ আজাদী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হন জিয়াউর রহমান।  ১৯৮১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় জোট গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নাগরিক কমিটির ব্যানারে জেনারেল ওসমানী প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলেন। ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। এছাড়া এই নাগরিক কমিটির সাথে ছিলেন ডা. কাজী কামরুজ্জামান, কর্ণেল কাজী নূরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার প্রমুখ।

সাত্তারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় জোট গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নাগরিক কমিটির ব্যানারে জেনারেল ওসমানী প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হলেন। ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক।

বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে বিজয়ী হন, তবে সেসময় থেকেই সেনাবাহিনী প্রধান হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতামুখী তৎপরতা শুরু হয়। তার চাপেই বিচারপতি সাত্তার শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দেন এবং ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ সামরিক আইন জারী করে এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ আবারও সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। এরশাদ সামরিক আইন জারি করার পর ওসমানী প্রতিবাদ করেন এবং রাজনীতি থেকে পুরোপুরি সরে দাঁড়ান।

১৫.৩.৮১

১২, ১৩ ও ১৪ই মার্চ কৃষক ফেডারেশনের জাতীয় সম্মেলন শেষে আজই ফিরলাম। ১১ তারিখ যেতে এবং আজ আসার পথে ভোগান্তি হয়েছে প্রচুর। বাস স্ট্রাইক ছিল- পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা ছাড়াও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ ইত্যাদি পর্যন্ত বলে তারপর যাওয়া গেছে। প্রায় ৪০ জন গেছি আমরা। আবরার, শাহরিয়ার ভাই কেউ নেই বলে আমার আর বকুলদারই পুরো দায়িত্ব নিতে হয়েছে।

সংগঠনের মধ্যে বর্তমান যে সংকট চলছে তা নয়া পদধ্বনিতে ইতিমধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এবারে কৃষক সম্মেলনেও তার প্রতিফলন পাওয়া গেল। জামান ভাই, সাত্তার ভাই, শাহরিয়ার ভাই সম্মেলনে যাননি। পটুয়াখালী, নোয়াখালী থেকে কোনো প্রতিনিধি আসেননি। সাত্তার খান যে বক্তব্য পাঠিয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে কয়েক ঘন্টা। তাঁর বদলে সভাপতি হয়েছেন ডাক্তারদা। হাসান আলী মোল্লা কমিটিতে নেই। উমর ভাই এবারও সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। পটুয়াখালী কৃষক আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।…সব কিছু মিলিয়ে বিদ্যমান কোন্দল, সংকট আরও ঘনীভ’ত হয়েছে। আর ঠিক এ সময়ে আমার উপর বর্তেছে বড় এক দায়িত্ব।..

২৪.৪.৮১

ফ্রন্টিয়ার জাতীয় একটি পত্রিকা বের করবার ব্যাপারে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আলাপ হলো।

২৫.৪.৮১

গত কদিন ‘স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ র কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলাম। বিচিত্রা থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, পরে লেখক শিবির ও মৌলিক অধিকার কমিটির যৌথ সভায় বৃহত্তর কমিটি গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আমরা কজন মিলে তালিকা তৈরি করি কাদের নিয়ে কমিটি করা হবে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ, সিনিয়র কজনকে উদ্যোক্তার জন্য রাজী করানো হয়। আমি ঘোষণাপত্র লিখলাম। আগামীকাল সভা।

২৭.৪.৮১

ডাক্তারদার সঙ্গে আমার এবং বকুলদার দীর্ঘ প্রায় পাঁচঘন্টা কথা হলো, আমাদের সেই চিঠি এব বক্তব্য নিয়ে। 

৩.৫.৮১

গত কয়েকদিন আমি এবং ফরীদি গোপীনাথপুর, জামালপুর, নান্দিনা ঘুরে এলাম।… ফসল কাটার সময় এখন, কাজের খুব চাপ। কেউ বেকার নেই। তবে লক্ষ্য করলাম, ক্ষুধার্ত থেকে হলেও গরীব কৃষকদের বাজারে ধান নিয়ে যাওয়ার চাপ বাড়ছে।… ফেরার পথে জয়দেবপুরে মে দিবসের আলোচনা।       

২.৬.৮১

জিয়া নিহত হয়েছেন ৩০শে মে সকালে চট্টগ্রামে।…জিয়া কী করে নিহত হলেন কারা তাকে মেরেছেন তা আজ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। খুনী বলে যাদের নাম এ কদিন করা হয়েছে তারা আসলে কতটুকু জড়িত তা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল। নাটকীয়ভাবে তাদের মৃত্যু (খুন) এই প্রশ্ন এবং সন্দেহকেই জোরদার করেছে। এ পর্যন্ত ঘটনাবলী যেভাবে ঘটেছে তাতে দেখা যাচ্ছে নিহতদের মধ্যে জিয়াসহ সকলেই মুক্তিযোদ্ধা!

দৈনিক বাংলায় জিয়া হত্যার সংবাদ, সূত্র: songramernotebook.com

জিয়া কী করে নিহত হলেন কারা তাকে মেরেছেন তা আজ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। খুনী বলে যাদের নাম এ কদিন করা হয়েছে তারা আসলে কতটুকু জড়িত তা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল। নাটকীয়ভাবে তাদের মৃত্যু (খুন) এই প্রশ্ন এবং সন্দেহকেই জোরদার করেছে।

৩.৬.৮১

আজকে পুরো ঘটনা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছি। গত কদিনে বহু লোকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। আমি এবং ফরহাদ ভাই, কামাল ভাই, লেনিনভাই মিলে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে মার্শাল ল’ বিরোধী একটি বিবৃতি দেবার কথা ভাবছি।… ফরহাদ মজহারের সঙ্গে পরিচয় অল্পদিনের। কাজের লোক বলেই মনে হচ্ছে।

২৭.৬.৮১

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ছিলাম প্রায় সারাটা দিনই। বৈঠকে ফয়েজ আহমদ, সাদেক খান, আল মাজীও ছিলেন। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস দেখলাম, বুঝতে চেষ্টা করলাম। নেদারল্যান্ডের একটি সাহায্য সংস্থার অর্থায়নে নির্মিত। বলা হচ্ছে এখানে ওষুধের মান উন্নয়ন, পরীক্ষা নিরীক্ষার যে ব্যবস্থা আছে তা অন্য কোথাও নেই। এগুলো করবার পরও গণস্বাস্থ্য অন্য বিদেশী কোম্পানিগুলোর তুলনায় কম দামে ওষুধ বিক্রি করবে। ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন করবে না।…

১.৭.৮১

গণস্বাস্থ্য সম্পর্কে সাকি সেলিমার সঙ্গে অনেক আলাপ হলো। যা শুনলাম তার অনেক কিছুই যা এতদিন জেনে এসেছি তার সাথে মেলে না। 

১৩.৭.৮১

…কৃষক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির ২য় সভা হলো খুলনা থেকেও প্রায় ২০/২২ মাইল দূরে ভদ্রদিয়া গ্রামে।… অন্যান্য বিষয়ের সাথে ‘কৃষক আন্দোলনের আশু কর্মসূচী’ বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হলো। এবারের বৈঠকে গিয়ে শুয়েছি টাফ-এর অফিসে মেঝেতে, খালি চটের উপর, ব্যাগ ছিল বালিশ। খেয়েছিও তেমন। ঘুমের জন্য প্রায় প্রতি রাতেই খুব কম সময় পেয়েছি। হাঁটতে হয়েছে ৮/১০ মাইল। অথচ খারাপ লাগেনি।

২৯.৭.৮১

গত  ২৫ তারিখে গিয়েছিলাম কুষ্টিয়ায়। সেখান থেকে রংপুর হয়ে আজকেই ফিরেছি। কুষ্টিয়ায় এর আগে যাইনি। কুমারখালি, শিলাইদহ এবং মিরপুরের কয়েকটি এলাকায় গিয়েছিলাম। কৃষক ফেডারেশনের বেশ ভাল অবস্থা সেখানে। কুমারখালিতে সেমিনার করে মীরপুর, শিলাইদহ ঘুরলাম। ফেডারেশনের বিভিন্ন কর্মীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা ছাড়াও ‘তামাক’ সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধান করলাম। কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন তামাক চাষী এবং রংপুরে তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জমিদার এবং মাঝখানকার হাজারো মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের তলায় পিষ্ট কৃষকদের কথাই মনে হচ্ছিল। একই ঘটনা।

২৫.৮.৮১

গত ১৮ তারিখে ঢাকার বাইরে গেছি, আজই ফিরলাম। প্রথম দিন পাবনায় গিয়ে মোস্তফা ভাই এবং আমি টাফ অফিসেই ছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা হলো। পরদিন সকালে উঠে জালালপুর, বাবুলচরা গেলাম। জালালপুরে তাঁতী এবং তাঁতশ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান শেষে জালালপুরেরই এক গরীব কৃষকের বাড়িতে খেলাম। প্রচন্ড ক্ষুধায় খুব সাধারণ খাবারও অনেক ভালো লাগলো। রাতে বৃষ্টির মধ্যে কোমর পানি ভেঙে মাইলখানেক হেঁটে বাবুলচরায় গেলাম। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পূর্বনির্ধারিত কৃষক গণজমায়েত হলো না। ২০ তারিখ গেলাম শাহজাদপুর। সেখানে দীর্ঘ আলোচনা হলো। ২১ তারিখ গেলাম বগুড়ার ছিলিমপুর। এখানে দিনে ও রাতে ছিলিমপুর ও শাপগ্রামে কৃষক সংগঠন নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। পরদিন সকালে মহাস্থানগড় হয়ে গেলাম ক্ষেতলাল- হাটশহর। এখানেও কিছু যোগাযোগ হলো। সেদিনই সারারাত ট্রেণে, সানোয়ার ভাইসহ, গেলাম দিনাজপুরের চিরির বন্দর। এখানে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ভ’মিহীন ও কৃষক কর্মীদের সঙ্গে খুব ভালো আলোচনা হলো। ২৪ তারিখ শেষ রাতে ঢাকার পথে রওনা হয়ে রাতে এসে পৌঁছেছি।

২৮.৯.৮১

সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম ২৪ তারিখ। এসেছি গতকাল। গিয়ে কাজ হয়েছে অনেকগুলো।

১.১০.৮১

সংস্কৃতি প্রকাশিত হলো।

১৮.১০.৮১

নারায়ণগঞ্জ হকার্স ইউনিয়নের সভায় গিয়েছিলাম। এর আগে কখনো হকারদের সমস্যা এভাবে বুঝতে পারিনি।

২৮.১২.৮১

সংস্কৃতি ২য় সংখ্যা বের হলো আজ।                 

এর মালিক ছিলেন হেলাল উদ্দীন। খুবই সজ্জন ব্যক্তি। বই-এর কাজে ছাড়াও এই প্রেসে বহুদিন গেছি সংস্কৃতি পত্রিকার কাজে। লেটার হেড প্রেস, কালিভরা প্রুফ দেখতে হতো প্রায়ই। হেলাল আত্মহত্যা করেন, তারপর আর সেই প্রেসে যাওয়া হয়নি।  

এবছরের প্রথম দিকে পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা, বৈশ্বিক পুঁজিবাদের গতিশীলতা, তার প্রতিষ্ঠান, সংকট ও শক্তি নিয়ে পড়ালেখার চেষ্টা করতে করতে বিচিত্রায় একটা সিরিজ লেখা শুরু করলাম যার শিরোনাম ছিল  ‘আন্তর্জাতিক চক্রান্ত’। নামটা খুব ঠিক না হলেও বাস্তব পরিস্থিতিতে তার সমর্থনে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আমার এই সিরিজে প্রথম লিখলাম বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি, তার উপর বহুজাতিক পুঁজির আধিপত্য, ক্ষুধা ও বাণিজ্য নিয়ে। এরপর অস্ত্র, ওষুধ, বহুজাতিক কোম্পানি, সবশেষে বাংলাদেশ। এগুলো পরে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত আমার বিশ্ব পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের অনুন্নয়ন গ্রন্থে সংকলিত হয়। এটাই আমার প্রথম প্রকাশিত বই। এই বই প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ অগ্রজ বন্ধু এনামুল করিম দীপু। রসায়ন বিভাগের ছাত্র দীপুভাই ছিলেন এক অদ্ভ’ত চরিত্র। হলে আমার পাশের রুমে থাকতেন তিনি। রাজনীতি বা অর্থনীতি বা দর্শন বা এসব নিয়ে আমার ছোটাছুটি সম্পর্কে তাঁর তেমন আগ্রহ কখনই দেখিনি। কিন্তু তিনি আমার সব কথা-কাজে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। তিনিই একদিন আমার একটা বই প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখালেন। কেন তিনি এই বই প্রকাশের সব ব্যয়ভার নিজের কাঁধে নিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। আমার সাথে সাথে তিনি প্রেসে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন। দীপু ভাই মারা যান অকালেই। যে প্রেসে বইটি ছাপা হয়েছিল সেটি ছিল পুরনো ঢাকায়। প্যাপিরাস প্রেস, এর মালিক ছিলেন হেলাল উদ্দীন। খুবই সজ্জন ব্যক্তি। বই-এর কাজে ছাড়াও এই প্রেসে বহুদিন গেছি সংস্কৃতি পত্রিকার কাজে। লেটার হেড প্রেস, কালিভরা প্রুফ দেখতে হতো প্রায়ই। হেলাল আত্মহত্যা করেন, তারপর আর সেই প্রেসে যাওয়া হয়নি। এর আগে ১৯৭৪ ও ১৯৭৯ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ শিরোনামে একটা যৌথ বই প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, সহ লেখক ছিলেন ডক্টর আতিউর রহমান। প্রকাশক ছিলেন শাহানা রহমান। এই দুটো বইএরই প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমার বন্ধু রুমমেট মনজুরুল হক।  (চলবে)

আগের কিস্তি: বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৬

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, লেখক ও সম্পাদক- সর্বজনকথা। ইমেইল: sarbojonkotha@gmail.com 

টীকা

১। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার এই নির্বাসিত জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় সরাফ আহমেদ রচিত প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দু:সহ দিন গ্রন্থে (প্রথমা, ২০২৩)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •