কেমন আছে সুন্দরবন!

কেমন আছে সুন্দরবন!

বাদল সরদার

সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের ওপর ছোবল মারতে শুরু করেছে। এই কেন্দ্র ছাড়াও আরও অনেক দিক থেকে সুন্দরবন বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতি, লোভ আর দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। এবিষয়ে আমাদের বিশদভাবে জানাচ্ছেন একজন বনজীবী। সেইসাথে তিনি সমাধানের পথও দেখাচ্ছেন।

রাজনৈতিক পালাবদল শেষে সবাই যখন রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা আলোচনায় ব্যস্ত, তখন সবার অগোচরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবন, সুন্দরবননির্ভর মানুষ এবং প্রাণ-প্রকৃতিতে নেমে এসেছে ভয়ানক বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ের শুরু হয়েছে আরও অনেক বছর আগে থেকেই। বন কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর কিছু মানুষের লোভের প্রকোপে পড়ে টালমাটাল অবস্থা সুন্দরবনের। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা, মাছ-কাঁকড়ার উৎপাদন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, লবণাক্ততাসহ নানাবিধ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এখানকার ভূমিপুত্রদের জীবন। কর্মসংস্থান না থাকায় এখন ছিন্নমূলের মতো অন্যান্য পেশার দিকে ছুটছেন তারা।

বন কর্মকর্তাদের অনিয়ম আর কিছু মানুষের লোভের প্রকোপে পড়ে টালমাটাল অবস্থা সুন্দরবনের। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা, মাছ-কাঁকড়ার উৎপাদন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, লবণাক্ততাসহ নানাবিধ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এখানকার ভূমিপুত্রদের জীবন। কর্মসংস্থান না থাকায় এখন ছিন্নমূলের মতো অন্যান্য পেশার দিকে ছুটছেন তারা।

সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার। যার প্রায় ৬,০০০ বর্গকিলোমিটার আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। বিশাল ব্যাপ্তির এই বন বৈশিষ্ট্যগতভাবে প্রায় সব জায়গায় অনেকাংশে একই। বাংলাদেশের সুন্দরবনে সাধারণত তিন শ্রেণির মানুষ প্রবেশ করতে পারেন:

১. বন বিভাগ/প্রশাসন।

২. বিএলসিকৃত বা নিবন্ধনকৃত জেলেরা।

৩. সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত গবেষক/অন্যান্য।

সরকারি ‘বিএলসি’ এবং ‘পাশ’:

‘বিএলসি’ হলো একজন জেলের ‘জেলে’ হিসেবে সরকারি স্থায়ী স্বীকৃতি বা নিবন্ধন। আর ‘পাশ’ হলো উক্ত জেলের ইচ্ছানুযায়ী প্রত্যেক গোনমুখে সাত দিন মেয়াদে জঙ্গলে উক্ত পেশা অনুযায়ী মাছ/কাঁকড়া/অন্যান্য সংগ্রহের অনুমোদন।

 মছ ও কাঁকড়া ধরার সময়: এক মাসে ২টা পক্ষ: শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ শুরু হয় প্রথমা থেকে যথাক্রমে, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া… একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, পূর্ণিমা পর্যন্ত, মোট পনেরো দিন। তারপর আবার প্রথমা, দ্বিতীয়া… অমাবস্যা।

সমগ্র সুন্দরবনে মাছ/কাঁকড়া ধরা হয় সাধারণত একাদশী থেকে পরের পক্ষের দ্বিতীয়া/তৃতীয়া পর্যন্ত মোট সাত দিন। এই সময়টায় মাছ/কাঁকড়া বেশি পাওয়া যায়, জঙ্গলে জোয়ারের জলের উচ্চতাও বেশি থাকে। এই সময়কে বলা হয় ‘গোনমুখ’। প্রতি মাসে ২টা করে গোনমুখ পাওয়া যায়।

সরকারি পাশ নেবার প্রক্রিয়া:  একজন জেলেকে প্রত্যেক গোনমুখে সাত দিন মেয়াদে পাশ নিতে হয়। সাধারণত প্রতি মাসে দুবার করে পাশ করে থাকেন যে কোনো পেশাজীবী জেলেরা। সরকারি পাশ খরচ যে কোনো পেশানুযায়ী সাত দিনে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। সাত দিন শেষ হলে উক্ত পাশ বন কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করতে হয়। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে প্রত্যেক দিনের জন্য ১২০ টাকা করে প্রদান করতে হয়।

সংকট: প্রত্যেক জেলেকে পাশ জমা দেওয়ার সময় অবধারিতভাবে বন কর্মকর্তার অফিসে ৮০০-১২০০ টাকা জমা দিতে হয়, যার কোনো বৈধতা নেই। পুরো টাকাটা জমা হয় বন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত পকেটে। সমগ্র সুন্দরবনে সকল পেশাজীবী জেলেদের কাছ থেকে এই বিশাল অঙ্কের টাকা নেওয়া হয় বহু বছর ধরে। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরো সময়টাতেই জেলেদের পাশ খরচ ছিল মাত্র তেইশ (২৩) টাকা। বিষয়টা নিয়ে অনেকবার পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি সত্ত্বেও কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সুন্দরবনে অনেক শ্রেণির পেশাজীবী রয়েছেন এবং সেটা শত শত বছর ধরে। উল্লেখযোগ্য পেশাগুলো হলো: কাঁকড়া ধরা, মধু ও গোলপাতা সংগ্রহ, চরপাটা জাল, বড়শি, ফাঁসজাল, খেপলা জাল ইত্যাদি ব্যবহার করে মাছ ধরা ইত্যাদি।

কাঁকড়া ধরা

কাঁকড়া ধরার প্রক্রিয়া: প্রায় ১০০০(+-) হাত লম্বা কটের দড়ি, যার এক হাত দূরত্বে একটা করে লোহার (জালের কাঠি) কাঠি, তার এক হাত পর একটা করে ১ ইঞ্চি মাছের (কুঁচে মাছ, স্থানীয়ভাবে ‘চাঁরা’ বলা হয়) টুকরো, এভাবে পুরো দড়িটা কাঠি আর মাছের টুকরো গেঁথে সাজানো হয়। দড়িটা নদী/জঙ্গল/খালের ভেতর দিয়ে ফেলে যাওয়া হয়। ১০/১৫ মিনিট পর তোলা হয়। কোনো চাঁরায় কাঁকড়া ধরলে গোলাকার চাকজালতি দিয়ে সেটা জলের নিচ থেকে তোলা হয়।

কাঁকড়া ধরায় সরকারি নিয়ম: পুরুষ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ গ্রাম আর মেয়ে কাঁকড়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০০ গ্রাম। এর নিচে কাঁকড়া ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ এবং অবৈধ।

সংকট: সুন্দরবনে চোরাকারবারিরা কাঁকড়া ধরার জন্য চারো/আটনের ব্যবহার করছে যার পরিমাণ বিশাল। এবং আইন অনুযায়ী যা সম্পূর্ণ অবৈধ। একজন নিয়মিত জেলে প্রতিদিন গড়ে ১০ কেজি করে যদি কাঁকড়া পান, তবে তার ৮০ শতাংশের বেশি ছোট কাঁকড়া ধরে থাকেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এমনকি ২-৫ গ্রামের ছোট্ট কাঁকড়ার বাচ্চাও বিক্রি করা হয় ঘের ব্যবসায়ীদের কাছে। দিনের পর দিন কাঁকড়ার প্রজনন কমে আসছে এবং সেটা সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। মাত্র ১০ বছর আগেও যে হারে বড় কাঁকড়া ছিল, এখন সে অনুযায়ী সংখ্যাটা একেবারে নগণ্য। বর্তমানে কাঁকড়ার জেলেরা ভয়াবহ সংকট পার করছেন।

জেলেরা বন কর্মকর্তাদের বাড়তি টাকা নেওয়ার জন্য কিছু বলতে পারেন না, যেহেতু তিনি নিজেই অবৈধ গ্রেডের কাঁকড়া ধরছেন। আবার ওই ছোট কাঁকড়া না ধরলে তার পাশ ও চাঁদা খরচ বাদ দিলে পরিবারের জন্য বাঁচে না তেমন কিছুই।

একজন মার্কিন প্রবাসীর ১২ পিস ১০০ গ্রামের কাঁকড়া কিনতে লাগে ৫০০০(+) টাকা, অথচ একজন জেলে ১২ পিস ১০০ গ্রামের কাঁকড়া বিক্রি করেন পায় সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এমনকি আমাদের ঢাকা শহরেও এর দাম কমপক্ষে ৫০০ টাকা। বাংলাদেশে কাঁকড়ার বাজার ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সরকারি অসাড়তার কারণে প্রায়ই চীন বা অন্যান্য দেশে কাঁকড়ার রপ্তানিও বন্ধ থাকে, তখন জলের দামে বিক্রি হয় সব।

সমাধান

০. পাশের খরচ আইন অনুযায়ী হতে হবে। সরকারি বন কর্মকর্তাদের এই প্রমাণিত অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

০. আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট গ্রেডের বাইরে ছোট কাঁকড়া ধরা বন্ধ করতে হবে।

০. বাণিজ্যিকভাবে ছোট কাঁকড়া কেনাবেচা কঠোরভাবে রোধ করতে হবে।

০. আটন/চারো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

০. কাঁকড়া রপ্তানির দিকে নজরপূর্বক জেলেদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে।

চরপাটা জাল দিয়ে মাছ ধরা

বাংলাদেশের মৎস্য খাতের বড় একটা অংশ আসে সুন্দরবন থেকে। সুন্দরবনে মাছের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ হয় চরপাটা জেলেদের মাধ্যমে।

চরপাটা এবং তার ব্যবহার: চরপাটার ছোট জালকে বলা হয় খাল পাটা, যা কিনা ছোট/বড় খালের আকৃতি অনুযায়ী হয়ে থাকে। চরপাটা অর্থাৎ সুন্দরবনের নদী/খালের পাড়/কিনারা যাকে বলা হয় চর, আর পাটা অর্থাৎ বড় জাল দিয়ে চর বা খালের মুখ বেড়া দেওয়ার মতো আটকে দেওয়া। চরপাটার জাল সাধারণত দৈর্ঘ্যে ১০ রশি থেকে ২০ রশি (১ রশি = ৮০ হাত) পর্যন্তও হয়ে থাকে। ভাটার সময় সুন্দরবনের মাল (মাল অর্থাৎ জঙ্গলের উপরের অংশ), খাল ও নদীর জল নেমে যায়। ওই সময় চরপাটার লম্বা জাল জঙ্গলের গা ঘেঁষে মাটির নিচে জঙ্গলের দৈর্ঘ্য বরাবর পুঁতে রাখা হয়। ১০-১৫ হাত পরপর জালের গা বরাবর একটা করে লম্বা লাঠি/পাড়া পুঁতে রাখা হয়। এরপর জোয়ারের জল আসে এবং খাল, মাল জলে ভরে যায়। যখন জোয়ার থমথমে হয়ে যায় অর্থাৎ ভাটার টান শুরু হয়, তখন ওই জাল উঁচু করে পাড়ার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। জল সব নেমে গেলে মাছ ওই জালে সব আটকে পড়ে থাকে। অপরদিকে খালপাটা দেওয়া হয় খালের মুখে।

চরপাটার নিয়ম: সরকারি নিয়মানুযায়ী চরপাটার জালের ফাঁস বড় হতে হবে একটা পাঁচ টাকার কয়েনের সমান। অর্থাৎ যে জালের ভেতর দিয়ে পাঁচ টাকার কয়েন ভেদ করবে না, সে জাল অবৈধ।

০. বিষ প্রয়োগ করা নিষেধ।

০. ২৫ ফুটের চেয়ে কম দৈর্ঘ্যের খালে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ।

০. চরপাটার লাঠি/পাড়ার জন্য সুন্দরবনের চারাগাছ কাটা নিষিদ্ধ। 

সংকট

০. সমগ্র সুন্দরবনে চরপাটার জাল কোথাও বলতে গেলে নিয়মানুযায়ী ব্যবহার করা হয় না। প্রায়ই এই জালের ফাঁস খুবই ছোট হয়ে থাকে। এতটাই ছোট যে কলমের ডগাও ঢুকবে না। যার ফলে ছোট মাছ নিধন হচ্ছে বছরের পর বছর।

০. প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির জেলে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন। তারা জাল পেতে রেখে খাল/মালের আগায় গিয়ে বিষ ছিটিয়ে দিয়ে আসেন। ওই এলাকার সমস্ত মাছ থেকে ক্ষুদ্র অণুজীব মরে ভাটার স্রোতে ভেসে জালে আটকে যায়, যা সমগ্র সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমকে ব্যাহত করে।

০. বিষ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুন্দরবনে আরও কয়েক প্রকারের চোরাই জাল ব্যবহার করা হয়। যেমন: ভেসালি জাল, ডুবো জাল।

০. পাড়া/লাঠির জন্য প্রত্যেক জেলে প্রায়ই চারাগাছ কাটতে থাকেন। এর সংখ্যাটা অনেক।

০. চরপাটার পাশ খরচ সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১২০০-১৫০০ টাকা।

ছবি: চরপাটা জালের ব্যবহার বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

সমাধান

০. বিষ দিয়ে মাছ শিকারি চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে স্থানীয় মানুষকে সচেতন করতে হবে যেন বিষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

০. পাশের অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ করা।

বড়শি দিয়ে মাছ ধরা

সুন্দরবনে বড় বড় মাছের উৎস হলো বড়শি। বড়শিতে সাধারণত ২০ কেজি পর্যন্ত বড় মাছ পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য মাছের ভেতর পাঙাশ, ভেটকি, কাইন, ভোলা, গাগরা অন্যতম।

বড়শির পদ্ধতি: এক একজন জেলে সুন্দরবনে ৩০০ থেকে ২০০০ পিস বড়শি ব্যবহার করে থাকে। একটা মোটা কট সুতার আট-দশ হাত পরপর এক হাত লম্বা দড়ির মাথায় একটা করে বড়শি গাঁথা হয়। বড় বড় খালের মোহনা দিয়ে লম্বাকারে নদীর তলদেশ বরাবর ফেলে যাওয়া হয়। এসব বড়শির টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় চিংড়ি, মিনু মাছ (চরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে), চিটে (চরে একধরনের মাংসাল ছোট প্রাণী), কেওড়া বেশি ব্যবহৃত হয়।

নিয়ম: যে কোনো প্রকারের হাঙর ধরা নিষেধ। শাপলাপাতা নামের একটা বিলুপ্তপ্রায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ।

সংকট

০. উপরের দুটি মাছই বড়শিতে ধরা হয়। শাপলাপাতা মাছের নাকের ভেতর দিয়ে মোটা কটের দড়ি ঢুকিয়ে নৌকার পাশে ছেড়ে দেয়, ওরা উপায় না পেয়ে নৌকার নিচে শরীর আটকে থাকে। এককথায় এদের প্রজাতিকে রীতিমতো বিলুপ্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

০. বড়শির পাশ খরচ সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১০০০-১৫০০ টাকা।

সমাধান

০. আগে একটা সময় সুন্দরবনের প্রধান প্রধান খালের মোহনায় বন কর্মকর্তাদের অস্থায়ী পল্টন ছিল। যাতে সুন্দরবনে বড়শিসহ যে কোনো পেশা কর্তৃক করা অনিয়ম পর্যবেক্ষণ ও পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হতো, সেই ব্যবস্থা পুনরায় জোরদার করতে হবে।

০. পাশের অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধ করতে হবে।

অন্যান্য পেশায় খুব সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু সুন্দরবনের এসব পেশা ও কর্মকাণ্ডের বাইরে নিয়মবহির্ভূত আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু অপকর্ম নির্বিঘ্নে ঘটে চলেছে।

হরিণ মারা: বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে, আন্দোলনের সময়টুকুতেও সুন্দরবন থেকে মারা হয়েছে কয়েক লাখ হরিণ এবং প্রতিদিন নির্বিচারে হরিণ মারা হচ্ছে। সেটা স্থানীয় অনুমানে হাজারেরও ওপরে।

যেভাবে মারা হয়: সাধারণত এক এক দলে তিন থেকে দশজন পর্যন্ত মানুষ থাকে। দড়িলাফ খেলার জন্য যে রাবার জাতীয় প্লাস্টিকের দড়ি থাকে ওইরকম ৪/৫ হাত লম্বা দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে হরিণের উচ্চতানুযায়ী ফাঁসি করা হয়। এক লাইনে ৫০-১০০ ফাঁসিও পাতা হয়। এক দিন পর ফাঁসি থেকে হরিণ খালাস করা হয়, দা দিয়ে কুপিয়ে অথবা মুখে টেপ লাগিয়ে ঘাড় মটকিয়ে কিছুদিন বাঁচিয়েও রাখা হয়। কখনো বিভিন্ন জটিলতায় ফাঁসিতে আটকানো হরিণ খালাস করতে যেতে না পারলে হরিণগুলো দীর্ঘদিন ধরে না খেয়ে মরে যায়। নির্মম সেই মৃত্যু। আর একটা পদ্ধতি হচ্ছে, জোয়ারের জল যখন বৃদ্ধি পায়, হরিণ তখন মাটিতে ঠাঁই পায় না, সাঁতরে বেড়ায়, গাছের গায়ে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ৩-৬টা নৌকা নিয়ে ওদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে মারা হয়। এই হরিণ মারাটা অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই চলেছে।

এক দিন পর ফাঁসি থেকে হরিণ খালাস করা হয়, দা দিয়ে কুপিয়ে অথবা মুখে টেপ লাগিয়ে ঘাড় মটকিয়ে কিছুদিন বাঁচিয়েও রাখা হয়। কখনো বিভিন্ন জটিলতায় ফাঁসিতে আটকানো হরিণ খালাস করতে যেতে না পারলে হরিণগুলো দীর্ঘদিন ধরে না খেয়ে মরে যায়। নির্মম সেই মৃত্যু। আর একটা পদ্ধতি হচ্ছে, জোয়ারের জল যখন বৃদ্ধি পায়, হরিণ তখন মাটিতে ঠাঁই পায় না, সাঁতরে বেড়ায়, গাছের গায়ে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ৩-৬টা নৌকা নিয়ে ওদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে মারা হয়। এই হরিণ মারাটা অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই চলেছে।

সংকট

০. এই অপরাধীদের ধরার জন্য পর্যাপ্ত বন কর্মকর্তারও সংকট রয়েছে। কারণ, দলগুলোতে সংঘবদ্ধভাবে অনেকেই থাকে এবং তারা আক্রমণাত্মক।

০. স্থানীয় সহযোগী মানুষের অভাব।

০. রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় এগুলো মারা এবং বিক্রিবাট্টা করা হয়।

# অথচ সরকারিভাবে হরিণ মারা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

সমাধান

০. বন বিভাগকে স্থানীয় গ্রাম থেকে মোটামুটি বেতনে কর্মী নিয়োগ বাড়ানো।

০. বন বিভাগের অসাড়তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া এবং জরুরি ভিত্তিতে বন আইনে জোর দেওয়া।

০. সুন্দরবনের প্রধান খালগুলোতে বন কর্মকর্তাদের অস্থায়ী টহল ফাঁড়ি স্থাপন করা।

পোনা মারা

# আপনি সুন্দরবনে ঢুকতেই দেখবেন হাজার হাজার নেটের বাক্সজাল দিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ে চিংড়ির পোনা ধরছেন। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা।

# সরকারিভাবে মাছের যে কোনো ধরনের পোনা ধরা এবং বিক্রি নিষিদ্ধ।

সংকট

০. প্রতিদিন শত শত কোটি মাছের পোনা চলে যাচ্ছে ব্যক্তিমালিকানার মাছের ঘেরে। মাছশূন্য হয়ে উঠছে নদীগুলো।

০. চিংড়ির পোনার সঙ্গে ধরা পড়ছে অসংখ্য অন্য প্রজাতির মাছের পোনাও, যার অধিকাংশ মারা যায় পাত্রের ভেতরেই।

০. প্রশাসন টাকা খেয়ে অবাধে ব্যবসা করতে দিচ্ছে এই পোনার ফড়িয়াদের।

০. বন কর্মকর্তারা প্রতিদিন টাকার বিনিময়ে জঙ্গলের ভেতরে নেট জাল/ছোট জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরতে দিচ্ছেন।

সমাধান

০. পোনা বিক্রি এবং ধরা বন্ধ করা।

০. ঘুষ বন্ধ করা।

কেওড়া সংগ্রহ

সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় গাছটার নাম হলো কেওড়া গাছ। কেওড়া ফল খেতেও ভালো। সাধারণত জঙ্গলের পশুপাখিরা উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে এই মৌসুমটার জন্য। অনেক প্রজাতির পশুপাখির প্রধান খাদ্য কেওড়া। লোকালয়ের অংশে যে পরিমাণ কেওড়া গাছ আছে, তাতে কেওড়ার স্থানীয় চাহিদা মিটে যায়।

সুন্দরবনের ভেতরে কেওড়া গাছ ভেঙে কেওড়া সংগ্রহের কোনো অনুমতি নেই। কিন্তু বন কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে সুন্দরবনে এই কেওড়া ব্যবসায়ীদের কেওড়া সংগ্রহের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এক একজন ব্যবসায়ীর আওতায় পাঁচ থেকে দশজনের দৈনিক চুক্তির লেবার দিয়ে কেওড়া ভাঙা হচ্ছে। দুই বছর আগেও এ রকম ছিল না।

সুন্দরবন বন্ধ

আগে একটা সময় সারা বছরে ৩-৪ মাস সুন্দরবন বন্ধ থাকত। এখন সেটা বাড়তে বাড়তে ৭-৮ মাসে গিয়ে ঠেকেছে। এই সময় জেলেদের ৫৮ কেজি করে সেদ্ধ নিম্নমানের চাল দেওয়া হয়। এখানে যেহেতু মানুষের বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই, তাই এটা একটা ভয়ানক সংকট।

সংকট

০. জেলেরা ঠিকঠাক এই অনুদানটা পান না। স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তাদের নিজস্ব লোকদের এই সুবিধা দিয়ে থাকেন। এমন অনেক মানুষ এই সহযোগিতা পান, যারা কোনোদিন জঙ্গলেই যাননি।

০. এই বিতরণকৃত মোটা সেদ্ধ চাল খুবই নিম্নমানের। এই সহযোগিতা বাস্তবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে খুবই হাস্যকর রকমের কমই বলা যায়।

০. বন্ধের সময় মাছ-কাঁকড়ার স্থানীয় ফড়িয়াদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময় হয়, যার সুবাদে জেলেরা প্রতি গোনমুখে ৩০০০-৫০০০ টাকার বিনিময়ে অবাধে জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরতে পারেন। এমনকি এই টাকার অংশ দেওয়া হয় স্থানীয় থানা কিংবা প্রশাসনিক জায়গাগুলোতে।

০. বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় বন্ধের সময় চরম দুঃসময় পার করতে হয় জেলেদের।

সমাধান

০ গবেষণামূলকভাবে মাছ-কাঁকড়ার প্রজনন ঋতুতে সুন্দরবন বন্ধ রাখা উচিত।

০. বন কর্মকর্তাদের ঘুষ নিয়ে দায়িত্ব পালন না করার অভ্যাসের স্থায়ী পরিবর্তন করা।

সবচেয়ে তীব্র সংকট হলো বন কর্মকর্তাদের পাশ-এর অতিরিক্ত টাকা নেওয়াটা এবং সেটা পরিমাণে বড় অঙ্কের। এটা একটা সরকারি নিয়মের মতো। অনেক জেলে জানেনই না যে তাদের পাশের সরকারি খরচ মাত্র ২০-৫০ টাকা। ঘুষ খেয়ে পুরো সুন্দরবনটাকে অসহায় করে তুলেছেন বন কর্মকর্তারা। মানুষের সুবিধাবাদী স্বভাবের সুযোগ নিয়ে দেশের রাজস্ব লুটে দেশের সম্পদকে দিনের পর ক্ষয় করে আসা এই সিস্টেমকে না বদলালে, আমাদের আগামীর রাষ্ট্র, দুর্যোগকে মোকাবিলা করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে। সঙ্গে তার এই অনাবিল সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ড ব্যতীত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

বাংলাদেশে বন বিভাগে যেসব আইন আছে, সেগুলোর সঠিক প্রয়োগটুকু করতে পারলেও সুন্দরবন রক্ষায় অনেকখানি কাজ হয়। রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই- সুন্দরবনের এই প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচান। এই বন আমাদেরকে অনেক বড় ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করে। প্রকৃতিকে মানুষের শত্রু বানিয়ে না তোলাটাই যে কোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বাদল সরদার: সুন্দরবন অঞ্চলের স্থানীয় বনজীবী ও মৎস্যজীবী | ই-মেইল: badalsardar42@gmail.com

টীকা:

১। আটন বা চারো হলো বাঁশের চিকন চটা দিয়ে বানানো এক ধরনের বাক্সের ন্যায়। সাধারণত এটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৫”/৭” থেকে ৩০”/১২” হয়ে থাকে। যার দুই দিকে দুটি মুখ অথবা একপাশে একটা মুখে বিশেষ দরজা থাকে। এর মাঝখানে মাছের টুকরো বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে কাঁকড়া ওই মাছ খেতে এর ভেতরে ঢোকে কিন্তু বেরোতে পারে না। এই আটন/চারো খালের তলদেশে অথবা মালের ওপর (জল ভরা অবস্থায়) একটু দূরত্বে পেতে রাখা হয়।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •