সুন্দরবনের বনজীবী
রণজিত চট্টোপাধ্যায়
বনের উপর নির্ভর করে যারা জীবিকা যোগায় তাদের বনজীবী বলে। আর সুন্দরবনের সম্পদ সংগ্রহ করে, বিক্রি করে যারা জীবন ধারণ করেন তাদের সুন্দরবনের বনজীবী বলা হয়। জীবন হুমকি নিয়ে তাদের অসম্ভব পরিশ্রমী কাজ আর সেই সঙ্গে সুন্দরবনের গুরুত্ব নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারের করনীতি অনুমোদন দেয় যে, বন কেটে পরিষ্কার করো, ফসল ফলাও এবং অধিক পরিমাণে খাজনা দাও। এই নীতির ভিত্তিতে তৎকালীন খুলনা জেলা ও তার আশেপাশের জেলাগুলোর জমিদাররা বন কেটে ফসলি জমি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র নিরন্ন জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসে সুন্দরবন এলাকায়। এমনই এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী হল মুন্ডা সম্প্রদায়। সতের-আঠার শতকে জমিদারদের ডাকে ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এই মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকেরা দলে দলে এই অঞ্চলে চলে আসে বন কেটে ফসলি জমি তৈরি করতে।
তাছাড়া বহুকাল ধরে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে মানুষের বাস ছিল তা আমরা আগেই দেখেছি। রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল এই সুন্দরবনের ভিতরে। কিন্তু এতদিন তারা সুন্দরবন কেটে চাষ করার চিন্তা করে নাই। ব্রিটিশ সরকারের সর্বনাশা করনীতি এবং জমিদারদের জমির লালসার দরুণ সবাই বন ধ্বংসের কাজে লেগে যায়। রাজা প্রতাপাদিত্য রাজধানী স্থাপন করার জন্য এবং খাজা খানজাহান আলীর মসজিদ, সুপেয় পানির পুকুর ও দিঘী খনন করার জন্য সুন্দরবন ধ্বংস করার চিন্তা তারা করেননি। সুন্দরবনের মূল্যবান কাঠ, বাঁশ-বেত, মাছ- হরিণের মাংস এবং পানি বিধৌত উর্বর জমি আর সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশও মানুষকে সুন্দরবন আসতে আকৃষ্ট করেছিল।
খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার ১৭ টি উপজেলার ১৫৪ টি ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং ১০ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল।
যাইহোক, বর্তমান সময়ের এই বনজীবী- বাওয়ালি, মৌয়াল, জেলে, চুনারি, জোংড়া খোটা, কাঠকুড়ানি, সুতার প্রভৃতি মানুষের সুন্দরবনের বসতি স্থাপনের ইতিহাস প্রায় আড়াইশত বছরের পুরাতন। খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার ১৭ টি উপজেলার ১৫৪ টি ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং ১০ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এমন কোন শিল্প কি পৃথিবীতে আছে যা দশ লাখ মানুষের জীবিকা যোগায়?
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার মানুষের তালিকা:
সম্প্রদায় | প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল | পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল |
বাওয়ালি | ৮০,০০০ | ৪০০,০০০ |
মৌয়াল | ১৫,০০০ | ৫০,০০০ |
জেলে/মৎস্যজীবী | ১,৪০,০০০ | ৫,০০,০০০ |
চুনারি/জোংড়াখোটা | ৪,০০০ | ৩০,০০০ |
কাঠকুড়ানি | ৮,০০০ | ৩০,০০০ |
সুতার/কাঠমিস্ত্রি | ১০,০০০ | ৪০,০০০ |
সর্বমোট | ২,৫৭,০০০ | ১০,৪০,০০০ |
সূত্র: সিবিডি ১০ সিঃ সুন্দরবনের কেসস্টাডি, ২০০৬ এবং বনজীবীদের ঝুঁকি সমীক্ষা, হিউম্যানিটি ওয়াচ, জানুয়ারি ২০০৮।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উপরোক্ত সম্প্রদায়ের সাধারণ পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। যারা সুন্দরবন থেকে কাঠ এবং গোলপাতা সংগ্রহ এবং বিক্রি করেন তারা বাওয়ালি। মধু এবং মোম সংগ্রহকারীদের বলা হয় মৌয়াল। বাংলায় সর্বত্রই জেলে সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। এখানে যারা সুন্দরবনের অসংখ্য নদ-নদী, খাল এবং নিম্নভূমির জলাশয় থেকে মাছ সংগ্রহ করে লোকালয়ে পৌঁছে দেন তাদেরকে জেলে বা মৎস্যজীবী বলা হয়। চুনারি হল জলাশয় থেকে মরা শামুক ও ঝিনুকের খোসা সংগ্রহ করে তা দিয়ে চুন তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকার্জনকারী জনসম্প্রদায়। বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে, বিক্রি করে যারা জীবিকা সংগ্রহ করেন তারা কাঠকুড়ানি। এদেরকে জোংড়াখোটাও বলা হয়। আর বন সম্পদের উপর নির্ভর করে নৌকা, বৈঠা, চইড়সহ নানাবিধ গৃহ সরঞ্জাম তৈরি করে যারা তারা হলেন সুতার এবং কাঠমিস্ত্রি। সুতার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি আলাদা সম্প্রদায় বিশেষ, কিন্তু কাঠমিস্ত্রি যে কোন সম্প্রদায়ের মানুষেরা হয়ে থাকে। বনজীবী মানুষেরা হতদরিদ্র; ৩৫% মানুষ ভূমিহীন, ৩০% বসত ভিটার মালিক, মাত্র ৩% মানুষের কিছু জমি আছে। সাক্ষরতার হার এদের মধ্যে নগণ্য।
এর বাইরেও অনিয়মিতভাবে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন সকালে বনে যায় এবং সন্ধ্যায় কিছু আয় করে ফিরে আসে। এদের হিসাব করলে এই সংখ্যা অনেক বাড়বে। তাছাড়া উপরের হিসাবটি ২০০৬ এবং ২০০৮ সালের। সেই থেকে আজ অব্দি জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে সুন্দরবনে গমনাগমনের লোকও তেমনি বেড়েছে। আমি সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখেছি, কেবলমাত্র শরণখোলা বাজার, যেখানে বলেশ্বরের প্রবল জলরাশি ভোলা নদীতে এসে পড়েছে একটি কাটাখাল দিয়ে যা এখন প্রমত্তা নদীতে পরিণত হয়েছে, তার তীরবর্তী কতগুলো গ্রামের অসংখ্য মানুষ রোজ বনে যাযন ভোরে আর ফিরে আসেন সন্ধ্যায়। তাই এরা বেসরকারী বা সরকারী জরিপের মধ্যে পড়েন না। ওই গ্রামগুলি হল শরণখোলা, খুড়িয়াখালী, বগি, বকুলতলা, তাফালবাড়ি, সোনাতলা, রাজাপুর, চালিতাবুনিয়া, গাবতলা, সাউথখালী সহ আরো অনেক। এরকম চিত্র খুলনা, সাতক্ষীরা, জেলায় অসংখ্য রয়েছে।
আমি সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখেছি, কেবলমাত্র শরণখোলা বাজার, যেখানে বলেশ্বরের প্রবল জলরাশি ভোলা নদীতে এসে পড়েছে একটি কাটাখাল দিয়ে যা এখন প্রমত্তা নদীতে পরিণত হয়েছে, তার তীরবর্তী কতগুলো গ্রামের অসংখ্য মানুষ রোজ বনে যাযন ভোরে আর ফিরে আসেন সন্ধ্যায়। তাই এরা বেসরকারী বা সরকারী জরিপের মধ্যে পড়েন না।
যাইহোক এখন আমরা এই বনজীবীদের সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা গ্রহণ করব।
বাওয়ালি: সুন্দর বনে যারা কাঠ ও গোলপাতা সংগ্রহ এবং বিক্রি করেন তাদের বাওয়ালি বলে। ধারণা করা হয় যে, বাউল শব্দ থেকে বাওয়ালি শব্দের উৎপত্তি। সাধারণত পুরুষরাই বাওয়ালির কাজ করে থাকে। সব বয়সের পুরুষই এই কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারে। বনবিভাগের নিকট থেকে পারমিট বা পারমিশন বা ছাড়পত্র নিয়ে বাওয়ালিরা বনে যেতে পারেন। বড় বড় নৌকা নিয়ে কাঠ-গোলপাতা কাটতে যান তারা। তাই সাধারণ দরিদ্র মানুষেরা এটা পারেননা। ধনী ব্যক্তিরা বড় বড় নৌকা তৈরি করে সরকারী পাশ সংগ্রহ করে। তারপর সাধারণ মানুষদের চুক্তিভিত্তিতে বা বেতনের চুক্তিতে বনে পাঠায়, এদেরকেই প্রকৃতপক্ষে বাওয়ালি বলে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা প্রভৃতি এলাকার মানুষেরা এই বাওয়ালি পেশায় নিয়োজিত। হিংস্র জীবজন্তু, বাঘ, কুমির, বন্য শুকর, বিষধর সাপ, প্রভৃতির সাথে থেকে বাওয়ালিরা কাঠ সংগ্রহ করে। এরপর রয়েছে বনদস্যুরা, তারা বাওয়ালিদের কাছে থাকা খাদ্য ও টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে যায়। কখনো কখনো তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। অনেক দূর থেকে মিঠা পানি সংগ্রহ করতে হয়। বড়শি দিয়ে মাছ ধরে আহার জোগাড় করতে হয়। প্রতিকূল ঝড়ের সময় সবাইকে এক স্থানে থাকতে হয়। এইভাবে বনজীবীদের মধ্যে অটুট মৈত্রী বন্ধন গড়ে ওঠে। সন্ধ্যার পর বহু নৌকায় বাওয়ালিরা ভাটিয়ালি, জারি,শারি, মারফতি, বিচ্ছেদ গান গেয়ে বিনোদন লাভ করে। কেউ গান গায়, কেউ পুঁথি পড়ে, কেউ হাঁড়িপাতিল বাজায়, আবার কেউবা ছড়া কাটে। বাওয়ালিরা তাদের মহজনদের দ্বারা চরমভাবে শোষিত হয়ে থাকে।
মৌয়াল: সুন্দরবন থেকে যারা মধু এবং মোম সংগ্রহ করে তাদের মৌয়াল বলে। এদের কখনো কখনো মৌলে বা মৌয়ালীও বলা হয়। এদের প্রশাসনের নিকট থেকে পারমিশন নিতে হয়। মধু একটি অত্যন্ত উপকারী ঔষধি গুণসম্পন্ন দ্রব্য। ইহা বহু রোগনাশক জীবনীশক্তি বৃদ্ধিকারী প্রাকৃতিক দ্রব্য বিশেষ। মধু সেই সুপ্রাচীনকাল হতে বাতির কাজ করে এসেছে। আধুনিক বৈদ্যুতিক যুগেও মোমের প্রয়োজন এবং গুরুত্ব তেমন কম হয়নি। হেমন্তকাল থেকে একটানা গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা যায়।
মৌয়ালরা ছোট ছোট নৌকা করে ছোট ছোট দল নিয়ে বনে ঢোকে। নদী বা খাল পাড়ে ছোট-বড় নৌকা নিয়ে মধুর চাক ভাঙ্গে। একটি দলের সবাই মধু সংগ্রহ করতে বনে যায় না। একবার দুইজন নৌকায় থাকেন যারা রান্নাবান্না করা, মধু-মোম পাহারা দেওয়া এবং তা পাত্রান্তর করা প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত থাকেন। যে বা যারা নৌকায় থাকেন তাদের মৌয়ালরা দারোগা বলে। দলের অন্যরা সাধারণত দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করে, মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে কোন দিকে যাচ্ছে তাদের পিছন পিছন ছুটে মৌচাকের সন্ধান পায়। এটি বেশ বিপদজনক। উর্ধ্বমুখী হাঁটতে হাঁটতে কখন কোথায় কোন গর্ত, খাল বা বিপদসংকুল ভিমরুল বা বল্লার চাকের উপর পড়বে তা কেউ বলতে পারেনা। এমনকি বাঘের মুখে পড়াটাও বিচিত্র কিছু নয়। তাছাড়া অনেক উঁচু গাছের ডালে উঠতে হয় মৌচাক ভাঙতে যেখান থেকে মৌমাছির কামড় খেয়ে নিচে পড়ে যাওয়া খুবই সম্ভব। সূর্যমুখী নামে একপ্রকার মৌমাছি আছে, তার বিষাক্ত কামড় সহ্য করা কঠিন। কখনো দেখা গেছে ওই মৌমাছিদের কামড় সহ্য করতে না পেরে জ্বালা দূর করতে মৌয়াল বিপদসংকুল নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। সেখানে রয়েছে কুমির, সুতীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা কামোট সে শরীরের যে কোন অংশ মুহূর্তে কেটে নিয়ে যেতে পারে। বিপদে পড়লে মৌয়ালরা ‘কু’ শব্দ করে অন্যের কাছে সাহায্যের আবেদন করে। এটি ওদের বিপদ সংকেত। এই ‘কু’ শব্দ শোনামাত্র সকলে একটা জায়গায় জড়ো হয়। পরস্পর পরস্পরের বিপদে সুন্দরবনের সবাই এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত নিয়ে। এইভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মধুর অর্ধেক যোগান দেয় এই সুন্দরবন। এর আবার ৭৫% মধু আসে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী এলাকা থেকে। এই মধু এবং মোম থেকেও সরকারের রাজস্ব কম আসেনা। শুধু আর্থিক দিকটাই সব নয় বরং মধুর ঔষধি গুণও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দেহে শত রোগ, শত সমস্যার সমাধান করতে পারে বিশুদ্ধ মধু।
উর্ধ্বমুখী হাঁটতে হাঁটতে কখন কোথায় কোন গর্ত, খাল বা বিপদসংকুল ভিমরুল বা বল্লার চাকের উপর পড়বে তা কেউ বলতে পারেনা। এমনকি বাঘের মুখে পড়াটাও বিচিত্র কিছু নয়। তাছাড়া অনেক উঁচু গাছের ডালে উঠতে হয় মৌচাক ভাঙতে যেখান থেকে মৌমাছির কামড় খেয়ে নিচে পড়ে যাওয়া খুবই সম্ভব।
জেলে বা মৎস্যজীবী: জাল দিয়ে মাছ ধরে বোধ করি সেই কারণে এদের জেলে বলা হয়। সুন্দরবনের বনজীবীদের মধ্যে জেলের সংখ্যাই সর্বাধিক। এদের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও বেশী। প্রশাসনিক কারণে গাছ কাটার উপর বেশি নিষেধাজ্ঞা থাকাতে মাছ ধরার পেশায় মানুষ বেশি বাড়ছে। সুন্দরবনের এক লক্ষ ৬ শত ৮৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে ছোট বড় প্রায় ৪৫০ টি নদী-খাল-নাল রয়েছে। এর প্রত্যেকটিতে অসংখ্য মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী অবস্থান করে। এর মধ্যে আছে ২৭ টি পরিবারের ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯ পরিবারের ১শত ২৪ প্রজাতির গভীর জলের মাছ, ৫ পরিবারের ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও ৮ প্রজাতির গলদা। এছাড়া ৩ পরিবারের ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪ প্রজাতির লবস্টার, ৩ প্রজাতির কচ্ছপ এবং ৬ প্রজাতির ঝিনুক এইসব নদী খালে প্রচুর পরিমাণে অবস্থান করে। (তথ্যসূত্র: বাদাবন ২০১০; পৃষ্ঠা ১৬৫)
এখন নৌকা প্রায় সবই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। ছোট নৌকার স্থানে বড় বড় ট্রলার তৈরি হয়েছে। একসাথে এখন অনেক লোক বনে যায়। জালের বহর পরিমাণ সবই বেড়েছে। সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ‘দুবলার চর’ নামে একটি বিস্তৃর্ণ সমতল চরাঞ্চল রয়েছে। এটি মংলা বন্দর থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই চরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য জেলে তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বহু জেলে বছরের অর্ধেক সময় ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তদুপরি দুবলার চরে শত শত কোটি টাকার শুটকি উৎপাদন হয়। তাই এই এলাকাকে জেলে পল্লী বলা হয়। দুবলার চরের জেলে পল্লীতে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ অবস্থান করে মৎস্য আহরণ, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং শুটকি তৈরির প্রয়োজনে।
এই চরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য জেলে তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বহু জেলে বছরের অর্ধেক সময় ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তদুপরি দুবলার চরে শত শত কোটি টাকার শুটকি উৎপাদন হয়। তাই এই এলাকাকে জেলে পল্লী বলা হয়।
মাছ ছাড়াও চিংড়ি এবং কাঁকড়া সংগ্রহকারী লোকের সংখ্যাও সুন্দরবনে অনেক। সমগ্র খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাটে বিশাল এলাকা জুড়ে চিংড়ি চাষ চলছে প্রায় ৫০ বছর হতে চলল। তাই প্রাকৃতিক চিংড়ির নলা জাতের পোনা বা রেণুর চাহিদা বেড়েছে অনেক। তাই এই কাজে মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। সুন্দর বনাঞ্চল থেকে রেণু সংগ্রহ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু চিংড়ির রেণু ধরতে গিয়ে নানা প্রজাতির কোটি কোটি পোনা ধ্বংস করে ফেলছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ১টি চিংড়ির রেণু ধরার জন্য অন্য প্রজাতির ৩৬৫ টি ডিম বা রেণু ধ্বংস করে ফেলছে। এটা খুবই বিপদজনক। এমনি চলতে থাকলে বিপুল মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ সুন্দরবন অচিরে মৎস্য শূণ্য হয়ে যাবে। তাছাড়া কিছু অসাধু জেলে খালের জলে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে অল্প সময়ে অনেক মাছ ধরতে। কিন্তু তার ফলে অসংখ্য ছোট মাছ, মাছের ডিম এবং রেণু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
চিংড়ির রেণু ধরতে গিয়ে নানা প্রজাতির কোটি কোটি পোনা ধ্বংস করে ফেলছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ১টি চিংড়ির রেণু ধরার জন্য অন্য প্রজাতির ৩৬৫ টি ডিম বা রেণু ধ্বংস করে ফেলছে। এটা খুবই বিপদজনক।
সুন্দরবনের ৩টি বনজীবী মানুষ- বাওয়ালি, মৌয়াল এবং জেলে – এদের অমানবিক পরিশ্রমে মূলভাগের মানুষেরা সুস্বাদু মধু, মাছ খেতে পারে। গোলপাতা, কাঠ প্রভৃতি নানা কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এরা অত্যন্ত দরিদ্র। এরা অমানবিক জীবন যাপন করে। বাঘের পেটে মারা গেলে এদের পোষ্যরা কোন ক্ষতিপূরণ পায়না। অথচ এরা অত্যন্ত পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু এবং ধৈর্যশীল। ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ এই প্রবাদ বাক্য তাদের জীবনের নিত্য সমস্যা। আরও কত সমস্যা সংকট তাদের নিত্যদিনের সহচর। তার উপর রয়েছে মানুষ নামের কলঙ্ক – জলদস্যু বা বনদস্যু। তাদের হাতেও কম বনজীবীদের প্রাণ দিতে হয় না প্রতিবছর। তারপরও তারা বলে, “আমাদের জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য”।
সুন্দরবনের ৩টি বনজীবী মানুষ- বাওয়ালি, মৌয়াল এবং জেলে – এদের অমানবিক পরিশ্রমে মূলভাগের মানুষেরা সুস্বাদু মধু, মাছ খেতে পারে। গোলপাতা, কাঠ প্রভৃতি নানা কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এরা অত্যন্ত দরিদ্র। এরা অমানবিক জীবন যাপন করে। বাঘের পেটে মারা গেলে এদের পোষ্যরা কোন ক্ষতিপূরণ পায়না।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ
নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্ব জগতের সবকিছুর মতই প্রকৃতি ও পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই প্রক্রিয়া চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। তবে অতি সম্প্রতি জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষণীয়। জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রকৃতির সবকিছুর প্রতি- যেমন মানুষ, জীবজগত, উদ্ভিদ জগত, প্রতিবেশ, পরিবেশের গুরুতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবে সুন্দরবন এর আওতার বাইরে নয়। সারা বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনে সকল দেশেই কমবেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানব জাতি আজ সংকটে পড়েছে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর অপরিণামদর্শী ভোগবাদী গুটিকয়েক মানুষের স্বেচ্ছাচারী কর্মকান্ডের কারণে। ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের’ (আই পি সি সি সি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে বেড়ে গেছে ০.৩ থেকে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আগামী ১০০ বছরে তা বাড়বে ১.৪ থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। অন্যদিকে সমুদ্রের জলরাশির উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে পৃথিবীর বহু উপকূলভাগ জলভাগ্ন হবে। আমাদের দেশের ১৭.৫ পার্সেন্ট ভূখণ্ড অর্থাৎ ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা জলের তলে তলিয়ে যাবে। ফলে প্রায় ৪ কোটি মানুষ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিজ দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে। সমুদ্রে জলরাশির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ১০% বৃদ্ধি পাবে। ইকো সিস্টেম ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে। প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটি, জলবায়ু, শব্দ দূষণ হচ্ছে। সবকিছু মানব জীবন, মানব সমাজের টিকে থাকার জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে। আর এর সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে তথাকথিত অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া, নগরায়ন, যান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য, জ্বালানি তেল, কয়লা প্রভৃতির যথেচ্ছ ব্যবহার। আর যুদ্ধ, মারনাস্ত্রের মারাত্মক প্রয়োগ তো রয়েছেই। এই সব কিছু সত্যি সত্যি পৃথিবী নামক গ্রহটির সাথে সাথে মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে ফেলছে।
নির্বিচারে বন উজাড় গ্রীন হাউজ গ্যাসের মারাত্মক উদগীরণ ওজনের স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। এর ধ্বংস ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে হিসাব আছে বিগত ২০০ বছরে মোট ৭০ টি দুর্যোগ হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। তার ১৯টি দুর্যোগ হয়েছে ১৫০ বছরে আর সাম্প্রতিক ৫০ বছরে হয়েছে ৫১টি মহা দুর্যোগ। এছাড়া গত ২০০৭ সালের নভেম্বরে হয়ে গেছে সিডর এবং ২০০৮ সালে আইলা।
আমাদের স্মরণে আছে ১৯৭০ সালে উপকূলীয় এলাকায় এক মহাপ্রলয়ঙ্ককারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। তাতে লোকক্ষয় হয়েছিল ৫ লক্ষ। ৮,১০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা ধ্বংস হয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল ৪ লক্ষ বাড়ি, সাড়ে ৩ হাজার স্কুল, ২০ হাজার মাছ ধরার নৌকা, লক্ষাধিক গবাদি পশু। আর নষ্ট হয়েছিল ৫ লক্ষ টন খাদ্যশস্য। সিডরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শুধু জনবল বাদে আর সবকিছু আগের ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি এখানে অনুধাবনযোগ্য যে, প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক না কেন যদি সুন্দরবন বুক পেতে সিডর আইলাকে রোধ না করত তবে উপকূলীয় সমুদয় এলাকা শ্মশানে পরিণত হত। সুন্দরবনের লক্ষাধিক গাছপালার ক্ষতি হয়েছিল। বন্যপ্রাণীর মৃতদেহের পচা গন্ধে স্থানীয় এলাকায় মানুষ অনেকদিন সমস্যায় ছিল। এখানেই সুন্দরবনের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। সুন্দরবন না থাকলে কী পরিণতি হত? পরিবেশবিদরা মনে করেন, সুন্দরবনের বনপ্রাচীর না থাকলে এতদিনে এই উপকূলীয় এলাকা ধ্বংস হয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হতো। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবন নীরবে রক্ষা করছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্থলভাগের এক তৃতীয়াংশ হল উপকূলীয় এলাকা। উপকূলীয় এলাকা চিহ্নিতকরণের তিনটি সূচক রয়েছে।
(১) জোয়ার ভাটার প্রভাব
(২) নোনা জলের অনুপ্রবেশ
(৩) ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রাবল্য।
এর যে কোন একাধিক সূচক বর্তমান থাকলে তা উপকূলীয় এলাকার বলে চিহ্নিত হবে। বাংলাদেশের এলাকাতে এর তিনটি সূচকই বিদ্যমান। এই বিশ্লেষণে উপকূলীয় এলাকার মধ্যে পড়ছে ১৯টি জেলা, ১৪৭টি উপজেলা, ১৩৫১টি ইউনিয়ন, ৭০টি পৌরসভা, ৭৪৩টি ওয়ার্ড, ১৪,৬৩৬টি মৌজা এবং ১৭,৬১৮টি গ্রাম। মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি এবং পরিমাণ হল ৪৭,২০১ বর্গকিলোমিটার। উপকূলীয় অঞ্চলের সিংহভাগই সুন্দরবন সংলগ্ন। (তথ্যসূত্র: উপকূলীয় অঞ্চল একটি আলেখ্য, পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ২০০১।
জলবায়ুর পরিবর্তনে কী কী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে? শিরোনামাকারে দাঁড়াচ্ছে নিম্নরূপ:
১) এক পরিবেশগত পরিস্থিতি
২) কৃষি সমস্যা জনিত পরিস্থিতি ৩) জীববৈচিত্র্য বিনষ্টজনিত পরিস্থিতি
৪) খাদ্য নিরাপত্তাগত পরিস্থিতি ৫) কর্মসংস্থান জনিত পরিস্থিতি
৬) স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি
৭) সুপেয় পানীয় জলজনিত পরিস্থিতি
৮) শিল্প-সংস্কৃতি জনিত পরিস্থিতি প্রভৃতি।
উপরের সকল বিষয়ই উপকূলীয় প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মারাত্মক হুমকি হল এর লবণাক্ততা। উত্তরের মিষ্টি জলের অভাবে দক্ষিণের সাগর থেকে লোনা জল এসে সবকিছুই ধ্বংস করে দিচ্ছে। কৃষি কাজ তাই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। রবিশস্য নাই বললেই চলে। ঐতিহ্যবাহী নারিকেল-সুপারির ফলন এক দশমাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গবাদিপশু ঘাসের অভাব এখানে আর পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার প্রাবল্যে অসংখ্য গাছপালা লতা-গুল্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বহু প্রজাতির পশু-পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। উৎপাদন নিচে নেমে যাওয়াতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। নানাবিধ রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে। কর্মসংস্থান নাই বললেই চলে। সুপেয় জল সংগ্রহ করা মানুষের জন্য দুর্বিষহ হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মানুষ নয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার অপরিণাম দর্শী মানুষের হাত থেকে বোনকে নানাভাবে রক্ষা করছে। আর এই সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি থেকে রক্ষা করছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। অন্যদিকে কাঠ দিয়ে, মাছ দিয়ে, মধু দিয়ে, পাতা দিয়ে নানা জীববৈচিত্র্যের অপার সৌন্দর্য্যমন্ডিত এক ভ্রমণ-বিনোদনের অপূর্ব প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে কতই না আয়ের উৎস তুলে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের হাতে! অথচ এই সুন্দরবনের ঘাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে সর্বনাশা রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার বিষাক্ত প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।
রণজিত চট্টোপাধ্যায়: লেখক, রাজনীতিবিদ। বাগেরহাট।