শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের জয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল এবং বাংলাদেশের শিক্ষা

শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের জয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল এবং বাংলাদেশের শিক্ষা

মঞ্জুরে খোদা

ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ কলম্বোর এক বিক্ষোভ মিছিলে দিশানায়েকে(মাঝখানে)। ছবি: এরাঙ্গা জয়াবর্ধন/এপি

প্রবল দুই রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ভেঙে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বামদলের নেতা। কীভাবে হলো তার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ আছে এই লেখায়।

শ্রীলঙ্কার তরুণদের মধ্যে জেভিপির প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেভেরার চিন্তাধারা ও প্রভাব

জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট) বা জেভিপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রোহানা উইজেভেরা। তিনি শ্রীলঙ্কার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত। উইজেভেরার বাবা ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী এবং সিলন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। উইজেভেরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করেছেন, যদিও অর্থাভাবে তার লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃত্তি পেলে সেখানে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখাপড়ার পাশাপাশি, কৃষিকর্মী হিসেবে কাজ করেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সংগঠনের কাজে মনোযোগ দেন এবং চীন, কোরিয়া, আলবেনিয়াসহ আন্তর্জাতিক বাম রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন।

৬০-এর দশকে চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্বে সিলনের কমিউনিস্ট পার্টি চীন ও রাশিয়াপন্থি দুই ভাগে বিভক্ত হলে তিনি চীন বলয়ের সঙ্গে যুক্ত হন এবং একজন কট্টর চীনপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি তার রাজনৈতিক দর্শনে জোসেফ স্ট্যালিন এবং মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারাকে যুক্ত করেন ও তাদের অনুসরণের কথা বলেন।

একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দল গড়ে তুলতে তিনি গ্রাম এলাকার ছাত্র ও বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করেন, যাদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ২৫-এর মধ্যে। তিনি দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত করতে ৫টি বিষয়ে জ্ঞান দান করেন। যে বক্তৃতাগুলো ‘ফাইভ ক্লাস’ নামে পরিচিত। সেটাই পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের মূল ইশতেহার হয়ে ওঠে। সেগুলো হচ্ছে:

১। শ্রীলঙ্কায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট

২। শ্রীলঙ্কায় বাম আন্দোলনের ইতিহাস

৩। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাস

৪। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও

৫। শ্রীলঙ্কায় বিপ্লবের পথ

তার ভাবনা ছিল জেভিপির আর্থসামাজিক নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি শ্রীলঙ্কায় ১৯৭১ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সালে দুটি ব্যর্থ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারত-লঙ্কা চুক্তির প্রতিবাদে তিনি সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে সামরিক ও সামাজিক অভিযান শুরু করেন। আশির দশকের বিদ্রোহে তিনিসহ প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত হন।

১৯৭১ সালের বিদ্রোহের সময় রোহানাকে গ্রেফতার করা হলে বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তখন তিনি এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা করেন, ‘উই মে বি কিলড বাট আওয়ার ভয়েস নেভার ডাই (তুমি আমাকে হত্যা করতে পার, কিন্তু আমাদের কণ্ঠ কখনো রোধ হবে না)’। তার সেই বক্তৃতায় ১৯৫৩ সালের ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ব্যারাক ট্রায়ালের বিখ্যাত বক্তব্য ‘হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মি’ প্রতিধ্বনিত হয়। পরবর্তী সময়ে তার সাজা কমিয়ে ২০ বছর ও সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেলেও ১৯৮৯ সালে বিদ্রোহের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যদিও তাকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে।

সশস্ত্র থেকে নিয়মতান্ত্রিক ধারা ও ঘুরে দাঁড়ানো

জেভিপির আন্দোলনের মূল ভাবধারা ছিল কট্টর মার্ক্সবাদী দর্শন। বহাল রাষ্ট্রকে তারা সম্পূর্ণ উৎখাত করতে চেয়েছিল। সিংহলি বঞ্চিত তরুণরা এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। জেভিপি যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে, তখন তাদের অন্যতম ঘোষণা ছিল দেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা। তবে সেই ইতিহাস দিয়ে জেভিপির বর্তমান ভারতনীতি চিহ্নিত করা উচিত হবে না। যদিও সমালোচকরা বলেন, সশস্ত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, বহাল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করা আর সংবিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে পার্থক্য আছে।

সেই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পর তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে গণভিত্তিসম্পন্ন সংগঠন গড়ে তোলা ও তাদের আস্থা অর্জনের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনে দল ও জোটগতভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ৯০-এর দশকে জেভিপির পলিটব্যুরোর সদস্য ও প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা সোমাওয়ানসা অমরাসিংঘে দলকে সশস্ত্র রাজনীতি থেকে সংসদীয় রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে দলের ভাবমূর্তি সমকালীন ছাঁচে তৈরি করে তরুণদের কাছে জেভিপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলেন।

তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটিও সহজ ছিল না, দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। বিশ্লেষকদের অভিমত, দিশানায়েকে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে এক বৃহত্তর জোট গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তার এই কর্মসূচিই বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে।

একটি মার্ক্সবাদী দলকে বিপ্লবী গণরাজনীতি থেকে মোড় ঘুরিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা কেমন হবে সেটা সময় বলবে। কীভাবে আইএমএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বোঝাপড়া ও নীতি প্রণয়ন করবেন, তা উন্নয়ন অর্থনীতির পর্যবেক্ষক-গবেষকদের আগ্রহের বিষয়। তবে বহুলভাবে যে আলাপটি প্রচলিত যে, দেশ পাল্টানোর আগে তারা নিজেদের প্রস্তুত করার প্রয়াস নিয়েছেন।

জনজীবনে সংকট ও জুলাই অভ্যুত্থান

২০২২ সালের এপ্রিল-জুলাই মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পণ্য সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ ৮৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। এসব সংকটের জন্য শ্রীলঙ্কার জনগণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার সরকারকে দায়ী করেন। এ অবস্থায় এক নজিরবিহীন বিদ্রোহ ও জনবিক্ষোভে রাজাপাকসে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান।  সেই সময় অনিল বিক্রমাসিংহ অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব নিয়েই অভ্যুত্থানকারী নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন।

গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেভিপি বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে থাকে। সেই সময় এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেভিপি দলের প্রধান অনূঢ়া দিশানায়েকে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সামনে চলে আসেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর অন্যায় নিপীড়নের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেন। বলা দরকার যে, ২০২২-এর জুলাই অভ্যুত্থানে অনূঢ়া ও তার দল কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

রাজাপাকসের উত্তরসূরি, প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এ কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে এবং শ্রীলঙ্কার রুপি শক্তিশালী হয়েছে। তবে মানুষের দুর্দশা এখনো কাটেনি। অনূঢ়া দিশানায়েকে যেসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে আছে কঠোর দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ, বড় ধরনের কল্যাণ প্রকল্প এবং কর কমানোর অঙ্গীকার। বিশ্লেষকরাও আগেই আভাস দিয়েছিলেন যে, এবারের নির্বাচনে অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলোই মুখ্য বিষয় হবে। ইতোমধ্যে অনূঢ়া দিশানায়েকে ক্ষমতা নিয়ে সব ধরনের পণ্যের দাম কমিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, যা বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে।

দ্বিদলীয় ধারার বাইরে বাম বিকল্প

শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে দ্বিদলীয় ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি চলমান। ১৯৫০ সালের শুরু থেকেই দেশটির রাজনীতিতে বেশিরভাগ সময় শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (মধ্য-বাম) ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (মধ্য-ডান) দল দুটি তাদের নিজ নিজ দল ও জোটের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দলের প্রভাব ও অবস্থান ক্ষয় হতে থাকে। তার প্রমাণ পাওয়া গেল গত মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

দিশানায়েকে মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, দুই রাজনৈতিক পক্ষের বাইরে তৃতীয় বিকল্প বেছে নিতে হবে। প্রচারকালে তিনি নিজেকে পরিবর্তনের পক্ষের প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। দেশের অধিকাংশ শাসক আর অভিজাত রাজনীতিবিদের শিকড় সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ রাজনীতির মধ্যে। কিন্তু দিশানায়েকে কোনো জাতি বা বর্ণপরিচয় নিয়ে সামনে আসেননি। বিশ্লেষকদের মতে, জেভিপি বাম দল হলেও দিশানায়েকের অবস্থান মধ্যবামের দিকেই। এখন সময়ই বলে দেবে তিনি আসলে কতটা বিপ্লবী!

শ্রীলঙ্কার নির্বাচন পদ্ধতি ও দিশানায়েকের জয়

শ্রীলঙ্কায় প্রেফারেন্সিয়াল ব্যালট পদ্ধতি প্রচলিত। ভোটাররা তিনজন প্রার্থীকে তাদের পছন্দের ক্রমানুসারে টিক দিতে পারেন। শ্রীলঙ্কায় আগের কোনো নির্বাচনে দ্বিতীয় গণনায় যেতে হয়নি। এবারই প্রথম তা করতে হয়েছে। এই দুই প্রার্থীকে ভোটারদের মধ্যে কতজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দ হিসেবে রেখেছিলেন তা গণনা করা হয়। সেখানে মোট ভোটার রয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৭৫ শতাংশ মানুষ। তার মানে প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রথম গণনাতেই তিনি ৫০ শতাংশ ভোট না পেলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে থাকেন। ফলে যদি কোনো প্রার্থী প্রথম গণনায় ৫০ শতাংশ ভোট না পান, তাহলে দ্বিতীয় দফায় ভোট গণনা করা হয়। সে ক্ষেত্রে দুই শীর্ষ প্রার্থীকে বিবেচনায় নিয়ে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। তাতেও বাকিদের অনেকটাই পেছনে ফেলে দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

নতুন প্রেসিডেন্টের সংসদে মাত্র ৩টি সংসদীয় আসন রয়েছে। এই সংখ্যা দিয়ে স্বাধীনভাবে একটি কার্যকর সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণের পরই তিনি সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। দিশানায়েকের মতে, ‘তাদের নীতিমালার জন্য প্রয়োজন একেবারে এক নতুন শুরুর, জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যে সংসদের কোনো যোগ নেই, তাকে টেনে নেওয়ার কোনো মানে হয় না।’ ১৯৭০-১৯৮০-এর দশকে যাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল, জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটে এবার তাদের হাতে এই টালমাটাল সময় অতিক্রমের ভার তুলে দিলেন।

পরিবারতন্ত্র ভেঙে দিল এক দিনমজুরের ছেলে

গত মাসে অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে বামপন্থি অনূঢ়া দিশানায়েকে ছিলেন তুলনামূলকভাবে অপরিচিত। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের বড় ছেলে নমাল রাজাপাকসে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সজিথ প্রেমাদাসা এবং দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট জে আর জয়াবর্ধনের ভাগনে ও অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে। সহজেই বোধগম্য তার বিপরীতে দাঁড়ানো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তার তুলনায় রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ছিলেন অনেক বেশি প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত। অনূঢ়া দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের টানা দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের অবসান ঘটল।

শুধু তাই নয়, তিনি প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী হেভিওয়েট প্রার্থীদের তুলনায় দিশানায়েকে এলিট ক্লাসের কাছে ছিলেন এক অচ্ছুত ও গুরুত্বহীন রাজনীতিক। জেভিপির প্রধান অনূঢ়া দিশানায়েকের দল ও জোট এনপিপি নির্বাচনের আগে কখনো শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল এমনকি ক্ষমতার কাছাকাছিও ছিল না। ২২৫ জন সংসদ সদস্যের আইনসভায় নবগঠিত এই জোটের আসনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩টি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন অনূঢ়া দিশানায়েকে। তবে এবারের নির্বাচনে তিনি চমক তৈরি করেন। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটিতে নিজের দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম ও দরিদ্রবান্ধব নীতির কারণে গত কয়েক বছরে অনূঢ়ার প্রতি সমর্থন বেড়েছে। প্রভাবশালী পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বামপন্থিদের উত্থান সত্যিই অভাবনীয়।

অনূঢ়া দিশানায়েকে প্রার্থী হলে, দেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে ব্যাপক ক্রোধ লক্ষ করা গেছে। কেননা, তার দেশের সংকট-দুর্দশার জন্য তিনি যেভাবে এই অভিজাততন্ত্রকে আক্রমণ করেছেন, অভিযুক্ত করেছেন, তাতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক, সামাজিক ভারসাম্যমূলক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বার্থের কর্মসূচি ও বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দেশত্যাগ অনূঢ়া দিশানায়েকে-কে ক্রমেই জনপ্রিয় করে তুলছিল। ২০২২-এর জুলাইয়ের নজিরবিহীন জনবিস্ফোরণের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ের মিডিয়াও তাকে এড়াতে পারেনি, সামনে আনতে বাধ্য হয়েছিল।

কে এই অনূঢ়া দিশানায়েকে?

অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে এখন শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ৫৫ বছরের দিশানায়েকে ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নন। তার বাবা একজন দিনমজুর এবং মা গৃহিণী। রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে অনুরাধাপুরা জেলার থাম্বুতেগামা গ্রামের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই দিশানায়েকে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন।

তিনি কোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নন। তার বাবা একজন দিনমজুর এবং মা গৃহিণী। রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে অনুরাধাপুরা জেলার থাম্বুতেগামা গ্রামের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই দিশানায়েকে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন।

১৯৮৭ সালে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা চুক্তির সময় ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন দিশানায়েকে। এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে দেশটিতে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামীণ তরুণদের অসন্তোষ থেকেই সেই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে দিশানায়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সে সময় তিনি আরও ঘনিষ্ঠভাবে জেভিপির সঙ্গে যুক্ত হন। দিশানায়েকের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের দিক থেকে, জেভিপির সমাজতান্ত্রিক যুব সংগঠনের সংগঠক হিসেবে। ২০০০ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে স্বল্প সময়ের জন্য কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন এবং ২০১৪ সালে তিনি জেভিপির মূল নেতৃত্বে আসেন। দলের মূল নেতৃত্বে আসার পর তিনি ৮০-র দশকের বিদ্রোহ ও দলের রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য জনতার কাছে বারবার ক্ষমা চান। ২০১৪ সালে বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সশস্ত্র সংঘাতের সময় এমন অনেক কিছুই ঘটেছে, যা ঘটা উচিত হয়নি। আমরা এখনো মর্মাহত। আমাদের হাতে যেসব কিছু ঘটেছে, তা একদমই ঘটা ঠিক হয়নি। আমরা সবসময়ই সেসব ঘটনার জন্য দুঃখিত ও লজ্জিত।’

ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তিনি শ্রীলঙ্কার শোষিত, বঞ্চিত, সাধারণ মানুষের আস্থার নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। দলের জনবান্ধব কর্মসূচির সঙ্গে বাড়তে থাকে অনূঢ়া দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আবেদন ও জনপ্রিয়তা। কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে শ্রীলঙ্কার অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে ভিন্ন ইমেজে খেটে খাওয়া মানুষের কাছের মানুষে পরিণত হন। রাজনীতিকে অভিজাতদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে সাধারণ মানুষের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষ দিশানায়েকের ওপর আস্থা রাখা শুরু করে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ভারতের জন্য অস্বস্তি

শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের বিজয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারতের জন্য খুব একটা স্বস্তিকর নয়। কেননা, নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট প্রতিবেশী ভারতের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তার দল জেভিপি-কে শ্রীলঙ্কায় চীনপন্থি হিসেবেই দেখা হয়। সেই দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নেপালের পর শ্রীলঙ্কায় বামদের আগমন ঘটল। মালদ্বীপেও ড. মোহাম্মাদ মুইজ্জু কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র আওয়ামী লীগের পতন তাদের যেন অনেকটা এতিম করে দিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নেপালের পর শ্রীলঙ্কায় বামদের আগমন ঘটল। মালদ্বীপেও ড. মোহাম্মাদ মুইজ্জু কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র আওয়ামী লীগের পতন তাদের যেন অনেকটা এতিম করে দিল।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর উত্থানের পর এবার নয়াদিল্লির চিন্তা শ্রীলঙ্কার বামপন্থি প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে-কে নিয়ে। চিন্তার কারণ, দিশানায়েকে চীনপন্থি, যদিও মুইজ্জুর মতো প্রকটভাবে চীনের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ পায়নি। তবে ভোটে দিশানায়েকেও ভারতবিরোধী আবেগ প্রকাশ করেছিলেন।

কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই চীনপন্থি দিশানায়েকে ভারতের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। দিল্লিতে ভারতীয় নেতৃত্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার বৈঠকও হয়। সাউথ ব্লকের এক সূত্র এ প্রসঙ্গে বলেন, দিল্লির কাছে অনূঢ়া দিশানায়েকে তাই একেবারে অজানা নন। ভারত মনে করছে, চীনের স্বার্থ উপেক্ষা না করলেও দিশানায়েকে ভারতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বাস্তববাদী হয়ে উঠতে পারেন।

সম্পর্কের প্রকৃত গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর। ততদিন পর্যন্ত ভারত তার মতো করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। নির্বাচনী প্রচারের সময় অনূঢ়া দিশানায়েকে উত্তর শ্রীলঙ্কায় আদানি গোষ্ঠীর সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কলম্বোয় কনটেইনার বন্দর প্রকল্পও রয়েছে এই গোষ্ঠীর হাতে। ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে সেটিও। এআইএডিএমকে (All India Anna Dravida Munnetra Kazhagam) অনূঢ়া দিশানায়েকে-কে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেও বলেছে, তারা চায় তিনি শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর দ্রুত মীমাংসা করবেন।

বামপন্থি অনূঢ়া দিশানায়েকে-কে ভারতের দুই কমিউনিস্ট দল সিপিআই ও সিপিএম স্বাগত জানিয়েছে। সিপিএমের কাছে শ্রীলঙ্কায় কোনো বামপন্থির প্রেসিডেন্ট হওয়া এক ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’। সিপিআই মনে করে, এই জয় দক্ষিণ এশিয়ার বামপন্থি আন্দোলনকে উৎসাহিত করবে। দুই কমিউনিস্ট দলই নতুন প্রেসিডেন্টকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন।

নতুন প্রেসিডেন্টের চ্যালেঞ্জ

সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ক্ষমতাচ্যুতির পর রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে গত দুই বছরের বেশি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্তানুযায়ী কর বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সদ্য বিদায়ী সরকার। এর চাপ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণের আশায় অনূঢ়া দিশানায়েকে-কে মানুষ ভোট দিয়েছে। একদিকে আইএমএফের কঠিন শর্ত অন্যদিকে জনজীবনের সংকট। এই সংকট মোকাবিলা করে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই হবে ভবিষ্যতে তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

জেভিপি তার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে হাজির করে সামন্ততন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য শ্রেণিসংগ্রাম। দিশানায়েকে একে আরও স্পষ্ট করে বলেন, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, গ্রামীণ জনগণের বাঁচার সংগ্রামের কথা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার খারাপ হতে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে এভাবে তিনি ক্রমে মানুষের কাছে আসতে থাকেন।

২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা দেশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয়ে যায়। এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গিয়েছিল। সরকারি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর অর্ধেক ছিল বিদেশি ঋণদাতাদের পাওনা। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। ভোক্তা বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেশজুড়ে বড় আকারের অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটায়। বিশ্লেষকরা বলেছেন, দেশটিতে আইএমএফের বেলআউট প্রোগ্রামের ব্যাপারে তার অবস্থান কী হবে? ২০২৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার আইএমএফ থেকে বেলআউট হিসেবে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার গ্রহণ করে। ঋণ নেওয়া হয় চীন, ভারত ও আরব আমিরাত থেকে। শর্তানুযায়ী, দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০২৮ সাল থেকে এই ঋণ পরিশোধ শুরু করতে প্রস্তুত হওয়ার কথা। কীভাবে এই ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করা হবে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোজুড়ে গির্জা ও আন্তর্জাতিক হোটেলগুলোয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় ২৯০ জন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হন। এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। কীভাবে এসব হামলা চালানো হলো, কীভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ হলো, তা নিয়েও কোনো সদুত্তর মেলেনি। অনেকের অভিযোগ: সাবেক সরকার তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত করেছে। এ প্রসঙ্গে সিংহলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনূঢ়া বলেছিলেন,

‘শুধু এ তদন্তের বিষয়ই নয়, রাজনীতিবিদদের যারা দুর্নীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারাই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। যারা ঋণমুক্ত শ্রীলঙ্কা গড়ার কথা বলেছিলেন, তারা ঋণের বোঝা বাড়িয়েছেন। যেসব মানুষ আইন জোরালো করার কথা বলেছেন, তারাই আইন ভঙ্গ করেছেন। ঠিক এ কারণে দেশটির জনগণ ভিন্ন নেতৃত্ব চায়। আমরা তা দিতে পারি।’

শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ

১। শ্রীলঙ্কা একটি দ্বীপরাষ্ট্র, বাংলাদেশ বদ্বীপ, নদী-নালার দেশ। উভয়েই দক্ষিণ এশিয়ার ও সার্কভুক্ত দেশ। উভয় দেশে ভারত রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়াতে তৎপর।

২। উভয় দেশেই কয়েক দশক ধরে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ও তাদের জোট পালা করে ক্ষমতায় ছিল। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলগুলো বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করলেও বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের মতো স্বৈরতান্ত্রিক ও একতরফা ছিল না। সেখানে মানুষের ভোটাধিকার ছিল বা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা তাদের মতো করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। গত দেড় দশকে এর অস্তিত্বই ছিল না। 

৩। শ্রীলঙ্কার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরিবারকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক ধারাও সেভাবে পরিবারতান্ত্রিক। কিন্তু সেখানে ২০২২ সালে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেভাবে তৃতীয় ধারা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে সেটা এখনো হয়নি। কিছু বামপন্থি দল একটি বিকল্প তৈরির আকাঙ্ক্ষায় স্বাধীন অবস্থান নিয়ে কাজ করলেও তাদের দৃশ্যমান কোনো অবস্থান নেই।

৪। বিচ্ছিন্নতাবাদ, বিদ্রোহ ও জঙ্গি তৎপরতার কথা বলতে গেলে শ্রীলঙ্কার ইতিহাস খুবই রক্তাক্ত ও বেদনাদায়ক। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তিন দশকের রক্তাক্ত যুদ্ধ ও সহিংসতা ২০০৯ সালে সমাপ্ত হয়। বামপন্থিদের সশস্ত্র বিদ্রোহে প্রায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। ২০০৯ সালে রাজধানী কলম্বোতে আন্তর্জাতিক হোটেল গির্জাগুলোতে আক্রমণে প্রায় ৩০০ জন নিহত হন। বাংলাদেশেও সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পার্বত্য অঞ্চলের যুদ্ধ, পিলখানা-আনসার বিদ্রোহ, নিষিদ্ধ বামপন্থি ও জঙ্গি তৎপরতায় হাজার-হাজার মানুষ নিহত হন।

৫। ২০২২ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় ছাত্র-জনতা এক নজিরবিহীন গণবিস্ফোরণ সৃষ্টি করে এবং তারা রাজপ্রাসাদ দখল করে নিলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে বিমানে সিঙ্গাপুর পালিয়ে যান। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এক অভাবনীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণভবন দখল করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে যান।

৬। শ্রীলঙ্কায় যে অভ্যুত্থান হয়েছিল তার মূলে ছিল অর্থনৈতিক সংকট। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিশ্বব্যাংক/আইএমএফ তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। প্রায় এক দশকের মতো ক্ষমতায় থাকাকালে পাকসে সরকার ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, পণ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশেও সরকারের দুঃশাসন ও বারবার ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করায় মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

৭। শ্রীলঙ্কায় সরকার ও প্রশাসনকে আত্মীয়করণ ও দলীয়করণ করা হয়েছে। যেমন: যখন রাজাপাকসে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে ছিলেন প্রেসিডেন্ট। সেভাবে সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে দলীয়করণের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। সরকার ও প্রশাসনকে দলীয়করণের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এটাও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ও আলোচনা। বাংলাদেশেও পতিত সরকার দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে।

৮। ২০২২ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তির মধ্যে আসার পর তিনি নির্বাচন দেন এবং তিনি নিজেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশেও জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা সরকার ও প্রশাসনিক সংস্কারের কতক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। ইতোমধ্যে সেনাপ্রধান নির্বাচনের জন্য দেড় বছরের একটা সময়ের কথা বলেছেন। তবে সময় বলবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা

১। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে একটি অখ্যাত দলও মানুষের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারে।

২। গণতন্ত্র থাকলে পরিবারতন্ত্র, অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রশ্নে তা সামান্যই কাজে লাগে।

৩। প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

৪। নীতিনিষ্ঠ অবস্থানে থেকে বাম ঐক্য ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারা যায়।

৫। হঠকারিতাসহ বাম আন্দোলনের অতীতের ভুল ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন | ই-মেইল: torikbd@gmail.com

দোহাই:

১। শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের বিজয় ও দিল্লির অস্বস্তি. ড. মঞ্জুরে খোদা, দৈনিক সমকাল, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২। Anura Kumara Dissanayake: who is Sri Lanka’s new leftist president? Hannah Ellis-Petersen, The Guardian, 23 September 2024

৩। Janatha Vimukthi Peramuna (JVP), home page: https://www.jvpsrilanka.com/english/

৪। New government, new hopes and new challenges, Kelum Bandra, Daily mirror, 26 September 2024, https://www.dailymirror.lk/

৫। Sri Lanka elects Marxist-leaning Dissanayake as president to fix economy, Aljazeera, 22 September 2024, https://www.aljazeera.com/news/2024/9/22/sri-lanka-elects-marxist-leaning-dissanayake-as-president-to-fix-economy

৬। সহিংস অতীত মুছে দিশানায়েকে যেভাবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, অর্জুন জনার্দন (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনূদিত), প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

৭। উইকিপিডিয়া, https://en.wikipedia.org/wiki/Janatha_Vimukthi_Peramuna – Janatha Vimukthi Peramuna – Wikipedia

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •