বাংলাদেশ, খোলা কবরের গল্পজমিন
আনমনা প্রিয়দর্শিনী
আজকের বাংলাদেশ দিনবদলের গ্রাফিতি! এই গ্রাফিতি কল্পনার বাইরে দাঁড়ানো ঘটনা আর অঘটনার আঁচড়ে আঁকা অসমাপ্ত এক ক্যানভাস। এই ক্যানভাস মরতে মরতে বাঁচতে চাওয়া মানুষের জিতে যাওয়ার কেচ্ছার। কিন্তু এই কেচ্ছা নিদারুণ করুণ, খোলা কবরের গল্পনামা।… নতুন ভোর একটা পূর্ণ দিন হয়ে ওঠার আগেই এক অনিশ্চিত আগামীকাল তাকে গ্রাস করতে থাকে।
আয়েশি সোফায় গা ডুবিয়ে দূর আমেরিকার এক সুখী সুখী অ্যাপার্টমেন্টে বসে আমি মৃত্যুর গল্প পড়ি, জীবনের মৃত্যু দেখি। টিয়ার গ্যাসের যেই ধোঁয়া আমার দেশে ফেলে আসা বারান্দাটার গ্রিল আঁকড়ে থাকে, তা আমার চোখ ছুঁতে পারে না। তবুও আমি ঝাপসা দেখি। কোনো স্নাইপার আমার বুক তাক করে বুলেট ছোড়ে না, তবুও আমার বুক টনটন করে। প্রিয় মানুষের রক্ত আমায় কাকভেজা করে না, তবুও আমার চারপাশ শুধু লাল-ই লাগে। সময়-স্থানের এই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েই, আমি তড়পাতে তড়পাতে দেখি প্রাণে প্রাণে কত তফাত, জীবন কতটা মৃত্যুর কাছাকাছি।
আব্দুর রহমান জিসান (১৮) রায়েরবাগ এলাকার দোকানে পানি সরবরাহ করতেন। ২০ জুলাই দুপুরে একটা বুলেট তার ডান চোখ ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। তার চেনা গলিতেই সে পড়ে রয় লম্বা সময়। নয়দিন পর জিসানের স্ত্রী, মিষ্টি, নিজ জীবনের অবসান ঘটায়। সমাজে এই মৃত্যু আত্মহত্যা বলে স্বীকৃত হলেও, মিষ্টি জানতেন যে তিনি খুনের শিকার।[1]
২১ জুলাই, ৭/৮ বছরের এক ছেলে বাঁচার তাগিদে টাউন হল বাজারের এক গাছের আড়ালে লুকায়। হয়তো ‘বাড়ি যাব’ ভেবে তার উঁকি দেওয়ার মুহূর্তটাতেই বুলেট তাকে দেখে ফেলে। সেই ভোরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নাম না-জানা সেই শিশু কিংবা তার মা কেউ-ই জানতেন না যে সেদিনই ছিল তার শেষ লুকোচুরি খেলা। রক্তে ভেজা সেই গাছটা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে এই খুনের সাক্ষী হয়ে।[2]
সাংবাদিক এ টি এম তুরাব ফুসফুস ও যকৃতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৯ জুলাই আইসিইউতে মারা যান। লন্ডন থেকে তার স্ত্রী, তানিয়া, আকুতি জানান তুরাবকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও দেখার। দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার জন্য, তানিয়া শেষ বিদায় জানাতে পারেননি তার জীবনের তুরাব নামের অংশটাকে। কিন্তু তুরাবের মা তার বুকের ধনকে বিদায় জানান ৯৮টি গুলিতে (প্যালেট) ঝাঁজরা হওয়া দেহে শেষ আদরের হাত বুলিয়ে। শুনেছি এখনো মা বিলাপ করেন: ‘পুলিশ ক্যান আমার ছেলেরে মারলো?’[3]
তুরাবের মা আবু সাঈদের মায়ের মাতম নিজের বুকে বাঁধে। মায়েদের বিলাপ কোটি মানুষের প্রতিবাদে মেশে: ‘হামার বেটাক মারলু ক্যানে?’ স্বৈরাচার মারে, কারণ তার অস্তিত্বই টিকে থাকে মারণ-রাজনীতির (নেক্রোপলিটিকস)[4] ওপর, যে রাজনীতি রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে জনগণের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে।
এই মারণ-রাজনীতিকে শুধু জৈব-রাজনীতি হিসেবে বুঝলে কিছু কম বোঝা হয়। রাষ্ট্রের জৈব-রাজনীতি জনগণের দেহ, স্বাস্থ্য ও সংখ্যাকে শাসন করে জনগণের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মারণ-রাজনীতি জনগণের জীবন ছাপিয়ে মৃত্যুর হিসাব কষে কার জীবন খরচযোগ্য এবং কার জীবন জীবনের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুযোগ্য তার সূত্র তৈরি করে। রাষ্ট্রের দলিল-দস্তাবেজের সুশীল আলাপে এই খুনি রাজনীতির হদিস নাই। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর প্রতিটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জনগণ দেখে এর বিস্তীর্ণ মানচিত্র।
মানুষ জানে কীভাবে এই রাজনীতিকে পুঁজি করেই আওয়ামী লীগ সরকার খুনের নকশা তৈরি করে এবং নিজ জনগণকে সেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়: ক্যাম্পাসে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে সরকার সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগের সহজ শিকারে পরিণত করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে খুন-জখমের মসৃণ জমি তৈরি করে। নির্বিচার গুলির বৃষ্টি সাধারণ মানুষকে হত্যাযোগ্য করে তোলে। বুক ও চোখ তাক করে ছোড়া বুলেট মৃত্যুকে নির্মম ও নিশ্চিত করে। হাসপাতালে বাধ্যতামূলক আঙুল ছাপ দেওয়ার চাপ আহত মানুষকে চিকিৎসা না নিয়েই মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে বাধ্য করে। আচমকা হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি নিজ চেনা ঘরে খেলতে থাকা শিশুর জীবন কাড়ে। প্যারামিলিটারি ইউনিটের যথেচ্ছ প্রয়োগ – যার নেতাদের নামে অত্যাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ রয়েছে – নৃশংসতাকে নিদারুণ করে। এবং ‘দেখামাত্র গুলি’ করার কারফিউ জারি মৃত্যুর সংখ্যা রাজপথ থেকে পাড়া-মহল্লায় ছড়ায়।
এই প্রতিটি হিসেবি সিদ্ধান্ত দেখায় যে রাষ্ট্র কীভাবে একটা ‘মৃত্যুপুরী’ (ডেথ ওয়ার্ল্ড) তৈরি করে ও নিজ জনগণকে সেই মৃত্যুর পথে পরিকল্পিতভাবে ঠেলে দেয়। এই প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে যে স্বৈরাচার সরকার তার সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এই রাষ্ট্রে কে বাঁচবে আর কে মরবে তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা আর শক্তি প্রয়োগের মধ্যদিয়ে। খুন করার এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জানান দেয় যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র লাশে লাশে দেশ খুন করে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে এক নোংরা যুদ্ধ নাজেল করার মাধ্যমে।
এই যুদ্ধ জারি থাকে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পুরো দেশকে এক ‘বিচ্যুত ভূখণ্ড’ (স্পেস অব এক্সসেপশন)[5] হিসেবে পরিণত করার মাধ্যমে যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতা পরিচালিত হয় আইনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতে। দেশ এমন এক স্থানিক ও মতাদর্শিক পরিসরে রূপান্তরিত হয় যেখানে ‘নিরাপত্তার’ নামে রাষ্ট্রের আগ্রাসন, ক্ষমতা, সহিংসতা জনগণের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হয় সাংবিধানিক ও মানবাধিকার আইনকে লোপাট করে। হাসিনা সরকার এমন এক সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে যেখানে রাজনৈতিক, বাকস্বাধীনতা, এবং খোদ বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে জনগণ বেঁচে রয় স্রেফ ‘জিন্দা-লাশ’ (লিভিং-ডেড)[6] হয়ে। এই জিন্দা লাশেরা অধিকার আর পরিচিতির সবটা দাবি খুইয়ে শ্বাস নেয় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক ‘নামমাত্র জীবন’ (বেয়ার লাইফ)[7] বয়ে বেড়িয়ে। জীবন, ক্ষমতা ও অধিকারের দাবি ঠোঁটে নিয়ে মরতে থাকা এই মানুষ তবুও প্রতিবাদের শব্দ ছোড়ে। কিন্তু সবটা অধিকার হারানো এই জনগণ যখন শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তখন রাষ্ট্রের চোখে তারা কেবলই হত্যাযোগ্য জানোয়ারে পরিণত হয়। মারণ-রাজনীতির এই কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই সরকার একের পর এক খুন করে আর জিন্দা-লাশেরা লাশ হয়ে জানান দেয় যারা বেঁচে আছে, তারাও পুরোটা বেঁচে নাই আসলে।
এই জুলুম, এই মৃত্যু-শাসন মৃত্যুর পরেও জারি থাকে। মৃতের প্রতি নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও ‘মারণ-সহিংসতা’ (নেক্রোভায়োলেন্স)[8] চলমান রেখে স্বৈরাচার তার দাপটের সীমানা আঁকে মৃত্যুর সীমানা পার হয়ে। এই ‘মারণ-সহিংসতা’ রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নির্মমতা ও ক্ষমতার ব্যাপ্তি প্রকাশের এক হাতিয়ার, যা মৃতদেহে আঘাতের মধ্যদিয়ে জীবিত মানুষের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে। মৃতের প্রতি এই সহিংসতা আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভাবন নয়। মৃতদেহ পোড়ান, তার ছাই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া, শহরের পথে পথে মৃতের দেহকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে জনগণের কাছে প্রদর্শন করা ও জানোয়ারের খাদ্যে মৃতকে রূপান্তরিত করার বাস্তবতা ট্রয়ের হেক্টর, ফরাসি ধর্মযুদ্ধের প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক, ব্রিটিশ হটানোর স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষুদিরাম, এমনকি ফিলিস্তিনের কিশোরের মৃতদেহ বয়ে বেড়িয়েছে ইতিহাস ও বর্তমান জুড়ে। বাংলাদেশের মানুষ ’৭১-এ এই মারণ-সহিংসতা দেখেছে, ইতিহাসের ভিন্ন ও নতুন পুনরাবৃত্তি ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
মৃতের প্রতি এই সহিংসতা আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভাবন নয়। মৃতদেহ পোড়ান, তার ছাই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া, শহরের পথে পথে মৃতের দেহকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে জনগণের কাছে প্রদর্শন করা ও জানোয়ারের খাদ্যে মৃতকে রূপান্তরিত করার বাস্তবতা ট্রয়ের হেক্টর, ফরাসি ধর্মযুদ্ধের প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক, ব্রিটিশ হটানোর স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষুদিরাম, এমনকি ফিলিস্তিনের কিশোরের মৃতদেহ বয়ে বেড়িয়েছে ইতিহাস ও বর্তমান জুড়ে। বাংলাদেশের মানুষ ’৭১-এ এই মারণ-সহিংসতা দেখেছে, ইতিহাসের ভিন্ন ও নতুন পুনরাবৃত্তি ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
প্রথমত, রাষ্ট্র শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং খুনের আলামত, গল্পছবি লোপাট ও বিকৃত করে। সে কারণেই এফআইআর-এ সাঈদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পুলিশের ছোড়া গুলিকে আড়াল করা হয়। এই আড়ালের রাজনীতিকে শুধু ‘বিস্মৃতির’ রাজনীতি হিসেবে দেখলে বহু কিছু কম দেখা হয়। বরং একে বোঝা জরুরি গুলি খেয়েও শাল বৃক্ষের মতো বুক টান করে দাঁড়ানো এক যুবকের সাহসকে অগ্রাহ্য করার রাজনৈতিক ফন্দি হিসেবে। এই উপেক্ষাকে জানা প্রয়োজন জনপ্রতিরোধকে নিছক এক গল্পহীন লাশে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা হিসেবে।
শুধু সাঈদের নয়, প্রতিটি খুনের গল্পই রাষ্ট্রের বয়ানে বিকৃত, নির্মিত এক ‘স্বাভাবিক ঘটনা’য় পরিণত হয়। রাষ্ট্রের পরিচালকরা খুনের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে গল্পে গল্পে – ‘যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়, তাহলে তারা গুলি ছুড়বেন। মানুষ মরবে। সেটাই স্বাভাবিক।’ প্রতিটি জীবনই রাষ্ট্রের কাছে নিছকই ‘খরচযোগ্য’ ‘তৃতীয় শক্তি’, রাজাকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের ‘অপ্রয়োজনীয় জীবন’ হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটি লাশই এখানে রাষ্ট্রের ‘জনশত্রু’ তকমা নিয়ে প্রিয় জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়। বেঁচে যাওয়া বুকে ভয় জমাতে সেই পড়ে থাকা নিথর দেহেও রাষ্ট্রের বাহিনী ক্ষমতার উলঙ্গ প্রদর্শনী চালায়। গুলি করে হত্যা করে পুলিশ ১৪ বছরের ছেলেকে বারবার লাথি মারে, যুবকের লাশ ছুড়ে ফেলে ভ্যান থেকে, আম টোকানোর মতো করে পুলিশ লাশ টোকায় আগুনে পুড়িয়ে কয়লা করার জন্য। মানুষ চোখের জ্বালায় দেখে কয়লা হওয়া লাশের হাতেও হাতকড়া।[9] মারণ-সহিংসতার এই প্রদর্শন চলে মৃত্যুতেই যেসব শেষ নয় তা প্রমাণ করার জন্য। মৃতের যেই দেহ মুহূর্ত আগে তার প্রিয় মানুষের আদরে উষ্ণ ছিল, সেই দেহে সহিংসতা চলতে থাকে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ারও বহু মুহূর্ত পর পর্যন্ত। রাষ্ট্র মৃতের বুকে দাঁড়িয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে।
এখানেই ইতি নয়। রাষ্ট্র মৃতের প্রতি এই সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ দেয় লাশ গুম করার মধ্য দিয়ে। গুমের এই রাজনীতি খুনি সরকারকে খুনের দায় অস্বীকার করার জমিন তৈরি করে দেয়। আর মৃত ব্যক্তি হারান তার শেষবেলার শেষ আশ্রয় – নিজ কবরের এক টুকরো মাটি। প্রিয় হাত এক মুঠো মাটি হাতেই হাতড়ে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের খোঁজ। মৃত্যুর গায়ত্রী মন্ত্র ঠোঁটে নিয়েই পিতা তার সন্তানের নাম ধরে ডাকে: ‘সুবোধ, তুই কই বাবা?’ আর আমাদের অজানা রয়ে যায় কীভাবে কতশত পরিবার প্রিয়জনের অন্তহীন খোঁজে আটকা পড়ে জীবিত আর মৃত জগতের মাঝখানে। এই ‘অস্পষ্ট বিচ্ছেদ’ (এমবিগিয়াস লস)[10] স্বজনের যন্ত্রণাকে অনন্তকালের জন্য স্থির করে দেয়। এই ব্যথা, এই কান্না টিকে থাকে সময় গোনা শেষ হওয়ার পরও; কোনোদিন এর ক্ষয় হয় না।
কিন্তু সরকার ভুলে যায় যে কোনো কিছুই হাওয়ায় মেশে না শেষ চিহ্ন রেখে না যেয়ে। প্রতিটি লাশ তার দেহে বয়ে বেড়ায় তার নিজ মৃত্যুগল্প। ভাঙা খুলি, ফুটো পাঁজর, চুরমার মেরুদণ্ড বলে যায় মারণ-রাজনীতির কেচ্ছা। জনগণ জানে রাষ্ট্রের ‘স্মৃতি-খুনের’ এই জমানায় সবকিছু মনে রাখার দায় শুধু তাদের। বেঁচে যাওয়া মানুষ তাই মৃতের গল্প জমায়। যোগাযোগের বাধা ও মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করেই তারা ভাঙা হাড়, ভাঙা মন, ভাঙা জীবনের গল্প কুড়ায়, গল্প ছড়ায়। মৃতদের এই গল্প তাদের এক নতুন জীবনের গল্প গড়ার সাহস জোগায়, যেই জীবন ‘জিন্দা-লাশের’ না, যেই জীবনটা তাদের এখনো বাঁচা বাকি। মানুষ তাই লড়াই করে, কঠিন লড়াই, যতক্ষণ-না বাংলাদেশে এক নতুন সূর্য ওঠে। শেষমেশ ভোর হয়!
কিন্তু সরকার ভুলে যায় যে কোনো কিছুই হাওয়ায় মেশে না শেষ চিহ্ন রেখে না যেয়ে। প্রতিটি লাশ তার দেহে বয়ে বেড়ায় তার নিজ মৃত্যুগল্প। ভাঙা খুলি, ফুটো পাঁজর, চুরমার মেরুদণ্ড বলে যায় মারণ-রাজনীতির কেচ্ছা। জনগণ জানে রাষ্ট্রের ‘স্মৃতি-খুনের’ এই জমানায় সবকিছু মনে রাখার দায় শুধু তাদের। বেঁচে যাওয়া মানুষ তাই মৃতের গল্প জমায়। যোগাযোগের বাধা ও মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করেই তারা ভাঙা হাড়, ভাঙা মন, ভাঙা জীবনের গল্প কুড়ায়, গল্প ছড়ায়। মৃতদের এই গল্প তাদের এক নতুন জীবনের গল্প গড়ার সাহস জোগায়, যেই জীবন ‘জিন্দা-লাশের’ না, যেই জীবনটা তাদের এখনো বাঁচা বাকি।
কিন্তু এই নতুন ভোর একটা পূর্ণ দিন হয়ে ওঠার আগেই এক অনিশ্চিত আগামীকাল তাকে গ্রাস করতে থাকে। ‘প্রতিশোধ’ ও ‘সুবিচারের’ নামে নির্বিচার লুটতরাজ ও ভাঙচুর, অমুসলিম, মাজারপন্থি, শিয়া ও আদিবাসী জনগণের ওপর নির্লজ্জ হামলা, যৌনকর্মীদের ওপর আক্রমণ, প্রকাশ্যে আদালতে বন্দিদের ওপর জীবননাশক সহিংসতা, এবং পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্মম খুন অন্যরকম মারণ-রাজনীতির (নেক্রোপাওয়ার) পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এই আপাত উত্তর-স্বৈরাচারকালেও আমরা দেখি মানবতার অসম বণ্টন, যেখানে কিছু মানুষ (সুন্নি মুসলিম বাঙালি যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত নন) বেঁচে থাকার স্বীকৃতি পায়, আর বাকিরা (অমুসলিম, মাজারপন্থি, শিয়া, আদিবাসী, যৌনকর্মী, পুলিশ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী) নতুন ‘জিন্দা-লাশ’ হয়ে বাঁচে জীবনের উল্টো পিঠে।
মারণ-রাজনীতির অবসান হওয়া হয়তো এখনো অনেক দূরের গল্প। এখনো এখানে প্রতিটি খুন মারণ-ক্ষমতারই (নেক্রোপাওয়ার) পুনরাবৃত্তি। যদিও প্রতিটি পুনরাবৃত্তিই নতুন; অতীত এবং ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন।
যে জানে সে মানে কীভাবে অমুসলিম ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী সহিংসতার ত্রাস আর আতঙ্কে ধুঁকে ধুঁকে মরে। স্বজন হারানো মানুষ শোনে সেই ছয় শিশুর বাঁচার তীব্র চিৎকার, যাদের জীবিত পুড়িয়ে মারা হয়েছে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর শাহ আলমের বাড়িতে।[11] এই শিশুদের মা-ও হয়তো তুরাবের মায়ের মতো বিলাপ করেন: ‘আমার সন্তানকে মারলো ক্যান?’ প্রশ্ন হলো: এই দিনবদলের দিনে আমরা কি প্রস্তুত তার কান্না শুনতে?
মারণ-রাজনীতির অবসান হওয়া হয়তো এখনো অনেক দূরের গল্প। এখনো এখানে প্রতিটি খুন মারণ-ক্ষমতারই (নেক্রোপাওয়ার) পুনরাবৃত্তি। যদিও প্রতিটি পুনরাবৃত্তিই নতুন; অতীত এবং ভবিষ্যৎ থেকে ভিন্ন। মৃতের গল্প তাই চলমান। মৃতের গল্প অদ্বিতীয়। বাংলাদেশ তাই এখনো এক অন্তহীন খোলা কবরের গল্পজমিন।
আনমনা প্রিয়দর্শিনী: লেখক, গবেষক ও শিক্ষক; সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটি, টেক্সাস।
ই-মেইল: aanmona@gmail.com।
[1] ‘Govt’s shifting narratives amidst a sea of red’ by Shahidul Alam, The New Age, 03 August 2024.
[2] ‘The fear of truth,’ by Saydia Gulrukh, The New Age, 24 July 2024.
[3] ‘আমার বুকের ধন তুরাবকে পুলিশ কেন মারলো?’ হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ জুলাই ২০২৪
[4] Necropolitics. Achille Mbembe. Public Culture 15(1): 11-40. 2003.
[5] ‘State of Exception,’ by Giorgio Agamben (Translated by Kevin Attell). Chicago: University of Chicago Press, 2005.
[6] ‘Homo Sacer: Sovereign Power and Bare Life’ by Giorgio Agamben. Palo Alto, CA: Stanford University Press, 1998.
[7] See vi.
[8] ‘The Land of Open Graves’: Living and Dying on the Migrant Trail, by Jason De León. Berkley, BA: University of California Press, 2015.
[9] ভ্যানে লাশের স্তূপ করা ভিডিও আশুলিয়া থানা রোডের, শরিফ রুবেল, ৩১ আগস্ট ২০২৪।
[10] ‘Ambiguous Loss Theory: Challenges for Scholars and Practitioners’ by Pauline Boss. Family Relations, 56(2): 105-110. 2007.
[11] কুমিল্লায় সাবেক কাউন্সিলরের বাড়ি থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার, প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০২৪।