জায়নবাদ, প্রথম তেল যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ-২

মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৭

জায়নবাদ, প্রথম তেল যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ-২

তারিক আলি

ষাট দশকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক  ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম। এবারে সপ্তম পর্ব। 

ছয় মাস পর স্বাধীন অফিসাররা মিশরের দখল নিয়ে নেন। এই ‘সামরিক বিপ্লব’ সংঘটনে মূল শক্তি ১৮ জন মেজর এবং কর্নেলদের মধ্যে ৪ জন ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য (সাদাত, আমের, হুসেইন ও মেহান্না), ৩ জন ছিলেন মার্ক্সবাদী (খালেদ মোহিদিন, রিফাত ও সাদ্দিক) এবং বাকি সবাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী। নাসেরের নিজের গঠন বেশ বিস্তৃত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছিল। শুরুতে তিনি ওয়াফদ-এ ছিলেন, এরপর মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন এবং পরিশেষে বামপন্থিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ভূমিকা গ্রহণ করেন। অধিকাংশ অফিসার-বুদ্ধিজীবী ছিলেন শহরকেন্দ্রিক পাতি-বুর্জোয়া/মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা প্রচুর পড়াশোনা করতেন, একে অপরের সঙ্গে বিতর্ক করতেন এবং সমমনা অফিসারদের সঙ্গে পাঠচক্র আয়োজন করতেন।

মিলিটারি একাডেমিতে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে জামাল আবদেল নাসের নতুন নিযুক্তদের সরাসরি প্রভাবিত করার সুযোগ পেতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আরব সামরিক বাহিনীর অতীত সাফল্যগাথা বর্ণনা করতেন। ইউরোপ যখন আধা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তখন প্রাথমিক ইসলাম বিজ্ঞান এবং সভ্যতায় কতটা অগ্রসর ছিল তা আলোচনা করতেন। তিনি বলতেন, রেনেসাঁসের উত্তরণকালে ইসলাম কীভাবে অসাড় এবং শক্তিহীন হয়ে পশ্চিম ইউরোপের কাছে তার উত্তরাধিকারিত্ব সমর্পণ করেছিল। অতীত গৌরবগাথা খুবই ভালো কিন্তু তা আর ফিরে আসবে না। তাই ভাবতে হবে কীভাবে সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে আরব বিশ্বের জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তাই এই দীর্ঘ যাত্রায় তাদেরকে বিজ্ঞান এবং আধুনিক চিন্তায় সমৃদ্ধ হতে হবে।

অতীত গৌরবগাথা খুবই ভালো কিন্তু তা আর ফিরে আসবে না। তাই ভাবতে হবে কীভাবে সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে আরব বিশ্বের জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তাই এই দীর্ঘ যাত্রায় তাদেরকে বিজ্ঞান এবং আধুনিক চিন্তায় সমৃদ্ধ হতে হবে।

১৯৫২ সালে স্বাধীন অফিসারদের বিজয় লাভের পর একমাত্র জেনারেল, তাদের নেতা মুহাম্মদ নাজিবকে অপসারণ করে নাসের মিশরের শাসনকর্তা হলেন। সেক্যুলার বামদের সরিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে আঁতাত করার মাধ্যমে নাসের এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। বামদের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল যে তারা ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছিল। মস্কোর নীতি অনুসরণ করে মস্কোপন্থি আরব কমিউনিস্টরা জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণে ইসরাইলের নিজস্ব ভূমি প্রতিষ্ঠার অধিকারকে সমর্থন করেছিল। এ কারণে তারা অনেকে পরবর্তী সময়ে কারাবন্দি হয়েছিলেন। কিন্তু ইসরাইল যখন ট্রান্স-জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহর সঙ্গে ভূমি দখলের জন্য জোটবদ্ধ হলো, মিশরীয় কমিউনিস্টদের অবস্থান তখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তখন তারা ইসরাইলকে একটি সাম্রাজ্যবাদী বীজ হিসেবে চিহ্নিত করল। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী অবস্থানের জন্য তারা ক্ষমা পেল না। মুসলিম ব্রাদারহুড ‘কমিউনিস্টদের বিশ্বাসঘাতকতা’ প্রচারণা চালানো অব্যাহত রাখল।

মিশরীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে সব সময় দলীয় বিভাজন ছিল। বিশ দশক থেকে তাদের মধ্যে তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল। তাদের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল মস্কোকে এমন বিরক্ত করছিল যে, ১৯৩০ সালে মিশরীয় কমিউনিস্ট দলগুলোর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের (কমিনটার্ন) সদস্যপদ বাতিল করা হলো। ঠিকঠাক চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরবর্তী বছর তারা সদস্যপদ ফিরে পেয়েছিল, তবে মস্কো তাদের জন্য নতুন নেতৃত্ব নিয়োগ করলো।

১৯৩২ সালের মার্চ মাসে মস্কো-নিযুক্ত মিশরীয় কমিউনিস্টরা, সেই সময়ের কমিনটার্ন চরম বামপন্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, রঙিন এবং উদ্ভাবনীতে পূর্ণ একটি খসড়া কর্মসূচি প্রকাশ করে, কিন্তু যা সামগ্রিকভাবে ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির একটি সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’ করতে সক্ষম হয়নি। এই খসড়াটি মিশরকে বর্ণনা করে দাস শ্রমে পরিচালিত একটি বৃহৎ ব্রিটিশ তুলা বাগান হিসেবে, যেখানে দাসচালক এবং মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকায় ছিল জমিদার এবং রাজা। ওয়াফদ ‘বুর্জোয়া-ভূস্বামী-প্রতিবিপ্লবী-জাতীয়-সংস্কারবাদ’-এর প্রতিনিধিত্ব করছিল।

দুই মাস পর কমিনটার্ন এর সাপ্তাহিক ইনপ্রেকর, মিশরীয় খসড়া কর্মসূচির বাস্তববিবর্জিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করল না এবং এর পেছনে নিজের দায় অস্বীকার করে বাস্তবতাকে আরও নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে নির্দেশ দিল এই বলে যে,

‘মিশরে শ্রমিক আন্দোলনের সাময়িক দুর্বলতার কারণে পুলিশ উস্কানিদাতা এবং কল্পনাবিলাসী পাতি-বুর্জোয়ারা সম্মিলিতভাবে মিশরীয় কমিউনিস্ট পার্টির কার্যাবলিকে বিক্ষিপ্ত করতে সক্ষম হয়, পার্টিকে শ্রমিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং পার্টি বিপ্লবী গণসংগ্রাম থেকে দূরে চলে যায়।’

এক শতাব্দী পর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী, উভয়েরই হুঁশ ফিরে আসে। কিন্তু একটি ব্যাপার অপরিবর্তিত থাকে: মিশরে গণ আন্দোলনে কমিউনিস্টদের প্রভাবকে তার প্রকৃত শক্তির চাইতে বড় করে দেখা। পার্টির প্রকৃত সদস্যসংখ্যা কখনো ২৫০০ জনের বেশি হয়নি। এর বিরোধী পক্ষ মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যসংখ্যা ছিল কমপক্ষে ২৫০,০০০ জন। এটা যদি ধরাও হয় যে এই সংখ্যার মধ্যে উগ্র ক্যাডার এবং সমর্থকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারপরও  দুএর পার্থক্য অনেক বেশি। এটা সত্যি যে, মস্কো এবং বেইজিংয়ের রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যোগসূত্র কমিউনিস্টদের জন্য একটি গুরুত্ব তৈরি করেছিল, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কমিউনিস্টদের দুর্বলতা ক্ষমতায় আসীন হবার পর তার খুব সহজে কমিউনিস্টদের এড়িয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যৌথ কূটকৌশল প্রতিষ্ঠা ব্যাখ্যা করে। আগে থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুডের সংযম ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ব্রাদারহুড ক্ষমতার জন্য রাজপথের আন্দোলনকে ব্যবহার করেনি; তারা অন্তত ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত স্বাধীন অফিসারদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করে; তাদের সর্বোচ্চ নেতা সায়ীদ কুতুব শিক্ষামন্ত্রী পদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

স্নায়ুযুদ্ধে বিভক্ত বিশ্বে তিনি কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল নন তা স্পষ্ট করবার পর নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। যখন ইসলামপন্থীরা জোর করতে থাকলো যে নতুন মিশর অবশ্যই শরীয়া আইন দিয়ে শাসিত হতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ সকল আইন থাকতে হবে তার অধীন করতে চাইল তখন এই বিরোধিতা শুরু হয়। স্বাধীন অফিসাররা যারা এতদিন আনন্দের সঙ্গে ইসলামপন্থী বাগাড়ম্বর ব্যবহার করছিল এবং আল-আজহারের প্রাচীন সুন্নি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অর্থ অনুদান দিয়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করছিল, এখন তারা বিরোধী হলো। এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ছিল গতানুগতিক, মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। সাত মাস পর, ১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর, ব্রাদারহুড নাসেরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে চাইল। নাসেরকে করা গুলি লক্ষ্যচ্যুত হয়েছিল। অভিযোগ আছে যে, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থবিরোধী নেতাকে হত্যা করার জন্য ব্রাদারহুড ব্রিটিশের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। খুনের চেষ্টাকারী ও তার পাঁচ সহযোগীকে আটক করে বিচারের পর মুত্যুদন্ড কার্যকর করা হলো। সংগঠনের বহু হাজার কর্মীকে আটক করা হলো।

ঘটনার মোড় পরিবর্তনে শাসক এবং বামদের মধ্যে নৈকট্য তৈরি হয়। নাসের এবং তার সহকর্মীরা আরও একবার তাদের ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে সহ্য করা হয়নি। এসব ঘটনা ঘটে খুবই উত্তেজনাকর আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে। পশ্চিমের সঙ্গে নিরাপত্তা জোটে যাবার জন্য পূর্বসূরিদের তুলনায় বেশি প্রস্তুতি ছিল না। তাদের অবস্থান ছিল স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে ‘ইতিবাচক নিরপেক্ষতা’র পক্ষে যে যুক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তুলে ধরেছিলেন। এবং যিনি ১৯৫২-৫৬ সাল সময়কালে ঘনঘন মিশরে সফর করেছিলেন এবং ব্রিটিশের সুয়েজ খাল দখলের বিরুদ্ধাভিযানে নাসেরকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলো নিয়ে বানদুং সম্মেলন হচ্ছিল। সেখানে চীন ও ভারতের সমর্থনে নাসের অভিভূত হন, আর পাশ্চাত্যপন্থি রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের বিরোধিতায় তিনি হতবাক হন। দেশে ফেরার পথে নাসের নতুনদিল্লি, করাচি ও কাবুল সফর করেন। নেহরু তাকে আবারও অভিভূত করেন। কয়েক মাস পর যুগোস্লাভিয়ার নেতা জোসেফ ব্রজ টিটোর সঙ্গে তার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়, টিটো নেহরুর মতামতের ওপর আরও জোর প্রদান করেন। টিটো ও নেহরু নাসেরকে স্নায়ুযুদ্ধ ঘরানার বাইরে থাকতে এবং একইসঙ্গে স্থায়ীভাবে মিশর ত্যাগের ব্যাপারে ব্রিটিশদের ওপর চাপ দেওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করেন।

১৯৫৫ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলো নিয়ে বানদুং সম্মেলন হচ্ছিল। সেখানে চীন ও ভারতের সমর্থনে নাসের অভিভূত হন, আর পাশ্চাত্যপন্থি রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের বিরোধিতায় তিনি হতবাক হন।

মিশরীয় নেতৃত্ব লক্ষ্য করে যে, ইসলামিক বিশ্ব পুরোপুরি বিভক্ত। ১৯৫৬ সাল নাগাদ অধিকাংশ মুসলিম সরকার ছিল ওয়াশিংটন এবং লন্ডনের একান্ত অনুগত; এগুলো হলো তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদি আরব, জর্ডান ও ইরাক। সিরিয়া ছিল আধা অনুগত। শুধু ইন্দোনেশিয়া ও মিশর তাদের স্বাধীন অবস্থান তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এবং এই অবাধ্যতার জন্য উভয়কেই কঠোর শাস্তি পেতে হয়।

মিশরের জন্য প্রথম শাস্তি ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বহু মাস ধরে আশওয়ানে নীল নদীর উঁচু বাঁধ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য মিশরের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (IBRD) একটি চুক্তি নিয়ে বোঝাপড়া হচ্ছিল। সকলের সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তিটি চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। বিশ্বমঞ্চে নাসেরের বিরোধী ভূমিকায় বিরক্ত হয়ে ওয়াশিংটন হঠাৎ তাদের দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাহার করে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস দাবি করে যে পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের মৈত্রী জোট মিশরকে ‘একক বৃহত্তম প্রকল্প’ অনুমোদনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তারা যুক্তি দেয়, মিশর হলো সেই দেশ যে কেবল স্নায়ুযুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল তাই নয়, প্রায়ই সে মার্কিনবিরোধী সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। তাই অভিযোগকারী তিন দালাল রাষ্ট্র ভেবেছে যে তারাই এই তহবিলের জন্য বেশি দাবিদার।

১৯৫৬ সালের ১৯ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডালেস মিশরকে এই সিদ্ধান্ত অবহিত করে। নাসেরের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জনমতেরই প্রতিফলন ছিলো। ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ায় এক ভাষণে মিশরীয় প্রেসিডেন্ট অ্যাংগলো-আমেরিকান প্রতারণার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘নিজেদের ক্রোধে সাম্রাজ্যবাদীদের দমবন্ধ হোক।’ তিনি উল্লসিত জনসম্মুখে সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বলেন, এর আয় থেকে বাঁধ নির্মিত হবে এবং মিশর তার অর্থনীতি ও সীমানার সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে। নাসের রাতারাতি আরব এবং উপনিবেশ বিরোধী বিশ্বে নায়ক বনে যান। অঞ্চলের সব সামরিক বাহিনী বিভক্ত হয়ে যায়। রাজ্যপ্রধানরা খুব ভীত হয়, জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখে পশ্চিমা সমর্থক রাজনীতিবিদদের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়।

তিনি উল্লসিত জনসম্মুখে সুয়েজ খাল জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বলেন, এর আয় থেকে বাঁধ নির্মিত হবে এবং মিশর তার অর্থনীতি ও সীমানার সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে। নাসের রাতারাতি আরব এবং উপনিবেশ বিরোধী বিশ্বে নায়ক বনে যান।

পশ্চিম কীভাবে জবাব দিয়েছিল? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এন্থনি এডেন মিশরীয় নেতাকে ‘নীল উপত্যকায় একজন হিটলার’ উপাধিতে ভূষিত করে সমালোচনা করেন। নাসের ব্রিটিশকে ভালোভাবে বুঝতেন। তিনি সচেতন ছিলেন যে ব্রিটিশের প্রথম উদ্যোগ হবে সশস্ত্র কূটনীতি। তিনি এটাও জানতেন, পশ্চিম ইসরাইলকে ব্যবহার করবে। তাই নাসের আগত দ্বন্দ্বে পশ্চিমের সঙ্গে ইসরাইলের যুক্ত না হওয়ার শর্তে প্রধানমন্ত্রী মোশে শ্যারেটকে সর্বাঙ্গীণ শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পাঠালেন। শ্যারেট সহানুভূতিশীল ছিলেন, কিন্তু বেন-গুরিয়ন রক্তের গন্ধ পেল। প্রস্তাবটি ন্যাক্কারজনকভাবে প্রত্যাখ্যাত হলো।

ওয়াশিংটন থেকে অনুমতির তোয়াক্কা না করে কনজারভেটিভ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, এন্থনি এডেন, তার সমাজতন্ত্রী ফরাসী সহযোগী গাই মুয়ে এবং তাদের জায়নবাদী পথ অনুসারী বেন-গুরিয়ন মিশর আক্রমণ এবং দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই অনুসারে ২৯ অক্টোবর ইসরাইলি সামরিক বাহিনী সিনাই উপদ্বীপ আক্রমণ করে। এর দুদিন পর, অ্যাংলো-ফরাসি অভিযাত্রীদের একটি দল প্যারাসুটযোগে সুয়েজ খাল এলাকায় অবতীর্ণ হয়। এই আক্রমণে তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মৌখিক সম্মতি ছিল।

মিশরীয় বাহিনীর যখন পর্যুদস্ত অবস্থা, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন তিন দখলদার শক্তিকে চরম সতর্কবাণী পাঠায়। পরদিনই সামরিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ওয়াশিংটনকে আড়াল করে আক্রমণ করার সাহস দেখানো এই তিন শক্তিকে সর্বসমক্ষে আক্রমণ করেন এবং বলেন: ‘আমরা এই সশস্ত্র আগ্রাসনকে ক্ষমা করতে পারি না এবং করছি না।’ ২২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ এবং ফরাসি সামরিক বাহিনী পোর্ট সায়ীদ ত্যাগ করে।

মিশরীয় বাহিনীর যখন পর্যুদস্ত অবস্থা, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন তিন দখলদার শক্তিকে চরম সতর্কবাণী পাঠায়। পরদিনই সামরিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।

নাসের স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধে হেরে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জয়ী হন। মিশরীয়দের জন্য নতুন বছরের উপহার হিসেবে নাসের সকল বিদেশি ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করেন। পোলিশ অর্থনীতিবিদ অস্কার ল্যাংগে সুয়েজ যুদ্ধের দুই বছর আগে কায়রো সফর করেছিলেন এবং সামরিক নেতাদের উৎসাহিত করেছিলেন এই বলে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দেশ এবং দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য ভালো হবে। সুয়েজ আক্রমণের পর একটি দ্বৈত সুযোগ তৈরি হয়েছিল: ন্যাটো শক্তিকে শায়েস্তা করা, যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তুরস্কের প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা এবং একইসঙ্গে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি ভিত্তি তৈরি করা। মিশরের রাস্তাঘাট আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। কায়রো তখন তার কবি আহমেদ শাওকির কথা স্মরণ করেছে:

‘আশার ভোর হতাশার অন্ধকার মুছে দেয়, এখন শুধু দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রভাত।’

প্রথম তেল যুদ্ধের নেপথ্য চিন্তা ছিল স্পষ্ট। ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অন্যত্র তাদের স্বার্থরক্ষা করার উদ্দেশ্যে মিশরে নাসেরের জাতীয়তাবাদী বিকল্পকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ব্রিটেন ইরাক হারানোর আশঙ্কা করেছিল। আলজেরিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উদ্ভব নিয়ে ফ্রান্স দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল। ইসরাইলের জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী মিশরকে দুর্বল করতে এবং এর বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী ধারণার বিস্তার রোধ করতে চেয়েছিল। এর ফলাফল হয়েছিল উল্টো।

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিশর, সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠন করে। এরকম জোটবদ্ধতাই দ্বাদশ শতাব্দীর সালাদিনকে আরবদের একত্রিত করে জেরুজালেম পুনর্দখল করতে সক্ষম করেছিল। আরব বিশ্বে ঐতিহাসিক স্মৃতি অনেক গভীরতা বহন করে এবং এই জোটের খবর অনেক আরব হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল। ইয়েমেন ও লেবানন একটি বৃহত্তর ফেডারেশনের অংশ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু পশ্চিম তখন একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরিতে সক্রিয় ছিল। বর্তমানের মতো তখনও জর্ডানের রাজতন্ত্র পশ্চিমের পররাষ্ট্র দপ্তর বা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করতো। জর্ডান ও ইরাকের হাশেমি শাসক এবং সৌদি আরবের ওয়াহাবিদের মধ্যে একটি জোট গঠনের জন্য তারা তখন আহ্বান জানায়। ঘটনার মোড় পরিবর্তনে রিয়াদের ওহাবিরা অত্যন্ত চিন্তিত ছিল। আল-সাউদ রাজবংশের সদস্য ক্রাউন প্রিন্স আমির ফয়সালের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজাকে রাজি করানো হলো যাতে পরিস্থিতি বাধ্য করলে নতুন রাজা নাসেরের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পারেন।

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিশর, সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠন করে। এরকম জোটবদ্ধতাই দ্বাদশ শতাব্দীর সালাদিনকে আরবদের একত্রিত করে জেরুজালেম পুনর্দখল করতে সক্ষম করেছিল। আরব বিশ্বে ঐতিহাসিক স্মৃতি অনেক গভীরতা বহন করে এবং এই জোটের খবর অনেক আরব হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল।

কায়রো এবং দামেস্কে তারা একটি নতুন ভবিষ্যৎ, একটি রূপান্তরিত রূপরেখা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন যা সম্ভব হবে যদি একটি প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ এই ঐক্যবদ্ধ আরব প্রজাতন্ত্রের শরীক হয়। এ ধরনের সংমিশ্রণই এই অঞ্চলে মেরুকরণ করবে এবং ঐক্যবদ্ধ আরব প্রজাতন্ত্রের শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে, যাদের তেল সম্পদ আরব জনগণের চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হবে। এটি একটি স্বপ্ন, এই আকাঙ্খা একটি ভাববাদী কল্পনা মনে হতে পারে, তবে অপ্রত্যাশিত দ্রুত গতিতে তা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিল।

১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে একটি জাতীয়তাবাদী বিপ্লব ইরাকে রাজতন্ত্রের পতন ঘটায়। হাশেমি রাজা ফয়সাল এবং তার ঘৃণ্য চাচাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আনন্দঘন জনতা আবদেল করিম কাসেম এবং একদল বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী অফিসারদের ক্ষমতা দখল উদ্‌যাপনের জন্য বাগদাদের রাস্তায় নেমে আসে। পশ্চিম ও তার মিত্ররা হতবাক হয়ে যায়। তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত রাজতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ চুক্তির মৃত্যু হয়। একটি কায়রো-দামাস্কাস-বাগদাদ অক্ষ এখন একটি বাস্তব সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে। তিনটি রাজধানীর রেডিও স্টেশনভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা জর্ডানের জনগণকে বিদ্রোহের জন্য আহবান জানাতে থাকে। এই উসকানিতে জনপ্রিয় বার্তাটি ছিল: আপনার রাজতন্ত্রকে উৎখাত করতে জেগে উঠুন, যে রাজতন্ত্র ইসরাইল থেকে অর্থ নিয়েছে এবং প্যালেস্টাইনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যের এই নির্লজ্জ দালালকে অবশ্যই ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে।

জর্ডান মূলত পশ্চিমা শক্তির নেপথ্য হস্তক্ষেপে রক্ষা পায়। তবে জনগণ ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ থেকে যায়। রাজতন্ত্রের অল্প কিছু বন্ধুর আশঙ্কা ছিল, যদি কখনো অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু জবাবদিহির অভাব পশ্চিমাপন্থি রাজতন্ত্রের শুধু একটি বৈশিষ্ট্যে সীমিত ছিল না। মিশর ও ইরাকে সেনাবাহিনী ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে এবং দরিদ্রদের সাহায্যে অতি প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার করে। কিন্তু রাজনৈতিক স্তরে তাদের একদলীয় রাষ্ট্রের মডেল ছিল অনমনীয়।

যুক্তি ছিল তিনটি। প্রথমত, শাসনব্যবস্থার মতাদর্শীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অর্থ মূল চালিকাশক্তি থাকায় বুর্জোয়া গণতন্ত্র আসলে একটি প্রহসন। এবং মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত গুরুত্বের কারণে, যে কোনো সুযোগকে কাজে লাগাতে সাম্রাজ্যবাদী অর্থ ক্রমাগত ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয়ত, একটি ভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামোর বাস্তবতা হিসেবে তারা চীন এবং যুগোস্লাভিয়ার উদাহরণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যারা মানুষের প্রকৃত চাহিদা পূরণ করতে এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক বেশি সফলতা দেখিয়েছে। তৃতীয়ত, পশ্চিমারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শাহ, সুলতান এবং আমিরদের শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছিল। এবং তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই শাসনব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। যেখানে স্থানীয় গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল যেমন, ১৯৫২ সালে ইরান পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা জনপ্রিয় মধ্যপন্থি জাতীয়তাবাদী নেতা মোসাদ্দেগকে উৎখাত করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শাহকে ফিরিয়ে আনে। গণতন্ত্রের প্রতি পশ্চিমাদের দেখানো অনুরাগ তাই সম্পূর্ণরূপে কর্তৃত্ব স্থাপনকারী আলংকারিক এক যন্ত্র। প্রতিটি মহাদেশে তাদের অধিকাংশ মক্কেল রাষ্ট্রগুলো দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নৃশংস একনায়কত্ব, যা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর (অলিগার্কির) সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছে।

সব যুক্তি দুর্বল ছিল না, তবে তারা আরব জনগণের প্রকৃত চাহিদা খেয়াল করেনি এবং বিশেষ করে তা এমন এক পরিস্থিতিতে যখন একটি সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের সম্ভাবনা নিয়ে ক্রমাগত স্থায়ী আলোচনা হচ্ছে। আরব বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা হিসেবে নাসেরের জনপ্রিয়তা ছিল সন্দেহাতীত। ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে, হিজাজের ব্যক্তিগত বাড়িতে, মাগরেবের কাসবাহে এবং আরব বিশ্বের অন্য সব জায়গায় তার ছবি প্রদর্শিত হচ্ছিল। কিন্তু এই জনপ্রিয়তার অর্থ এই নয় যে তিনি মিশর বা সিরিয়ার ভেতরে যা কিছু করেছেন বা নতুন ইরাকি শাসকদের কাছে তিনি যা দাবি করেছেন, তার সবকিছু একই মাত্রায় সমর্থিত হচ্ছিল।

পশ্চিমের বিরুদ্ধে যে কোনো গণভোটে তিনি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী হতে পারতেন। তবে নিজ দেশে সংখাগরিষ্ঠতা কম হতো এবং সিরিয়া ও ইরাকে, তার প্রতি সমর্থন থাকলেও অন্যান্য প্রগতিশীল দলের সঙ্গে একজোট না হলে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল।

নাসেরের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ‘আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন’ ছিল পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি একটি জনমুখী ‘তৃতীয় পথ’ যা কোনো বিশেষ শ্রেণির জন্য নয়, সমগ্র জনগণের স্বার্থ রক্ষার কথা বলতো। মানুষ এই মতামত গ্রহণ করছে কি না, তা নির্ধারণ করার একমাত্র উপায় ছিল তাদের পছন্দমতো সংসদ নির্বাচন করার অধিকারের অনুমতি দেওয়া। কিন্তু ব্রাদারহুড এবং বামপন্থিদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন, গণমাধ্যমের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বুদ্ধিজীবীদের আধা নিয়ন্ত্রণ আসলে শাসনব্যবস্থার নিরাপত্তাহীনতার অবস্থা নির্দেশ করে। এ রকম শাসনব্যবস্থা আরব রাষ্ট্রগুলোর বৃহত্তর জোটের জন্য কোনো শুভ সূচনা করেনি। সিরিয়া ও ইরাকে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন ছিল: দ্য বা’থ (পুনরুত্থান) সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট দলগুলো। তারা আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে সম্মত হলেও তাদের পারস্পরিক পার্থক্য স্পষ্ট থেকে যেত। কিন্তু এধরনের কোনো চুক্তি করা সম্ভব হয়নি।

মিশরেও মুসলিম ব্রাদারহুডের কারণে সরকারের স্থিতিশীলতায় হুমকি দেখা দেয়। ১৯৬৪ সালে তারা তিনবার নাসেরকে হত্যা করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রযন্ত্র হিংস্র প্রতিক্রিয়া দেখায়: ১৯৬৫ সালে গণগ্রেফতারসহ সাইয়্যেদ কুতুব এবং অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আপসে অনমনীয়তা, সততা, নৈতিকতা এবং কঠোর জীবন অনুশীলনের জন্য এমনকি অধর্মীয় অংশেও কুতুব অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। বিশ্বাসীরাও তার বুদ্ধিমত্তাকে সম্মান করত। কারাগারে বসে লেখা তার শেষ বই, মাইলস্টোনস, তার মৃত্যুর পর সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের স্থান পায়। কুতুবের আদর্শিক মতবাদের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, এই সংকলনটি আজও বিশ্বাসীর জন্য পাঠ্যপুস্তক। ইসলামি ক্যাডারদের শিক্ষিত করার জন্য বইটি একটি ম্যানুয়াল হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র ব্রাদারহুড অনুপ্রাণিত ইসলামি জিহাদ এবং অনুরূপ গোষ্ঠীগুলোর জন্য এটি একটি সম্মানিত পাঠ্য। বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি পুনরাবৃত্তিমূলক, সাধারণ, অ-অনুপ্রেরণাদায়ক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আপত্তিকর। তবুও এই বই মুসলমানদের দুটি প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং শুধু এ কারণে এর ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

কুতুবের মৌলিক যুক্তিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ–

প্রথমত, একমাত্র প্রথম প্রজন্মের ইসলাম মুসলমানদের জন্য অনুকরণের যোগ্য। কারণ, তাদের মন ও আত্মায় বিশুদ্ধতা ছিল। পরপর তিনটি অনুচ্ছেদে বেশ কয়েকবার ‘পরিষ্কার ঝরনা’কে একমাত্র স্থান হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে যেখানে মুসলমানরা ‘তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করে’। এই পরিষ্কার ঝরনা হলো কোরআন। কুতুব তার বইজুড়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে কোরআন একাই সব জ্ঞানের উৎস এবং দৈনন্দিন জীবনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।

তিনি নবীর কনিষ্ঠ বধূ আয়েশার একটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। আয়েশাকে তার প্রয়াত স্বামীর চরিত্র নির্ধারণ করতে বলা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘তার চরিত্র ছিল কোরআন।’ …কুতুব উল্লেখ করেছেন যে পৃথিবীতে গ্রিক, রোমান ও পারস্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটলেও ‘অনন্য প্রজন্ম’ অন্য সবকিছুকে উপেক্ষা করে কেবল কোরআনের শব্দের ওপর নির্ভর করেছিল। অন্যান্য সংস্কৃতির প্রভাবে জাহিলিয়া (অজ্ঞতা) সৃষ্টি হয়েছিল এবং তা থেকে মুক্তি পেতে মুসলমানদের কেবল কোরআন অধ্যয়ন করতে হবে। আর কিছু নয়।

দ্বিতীয়ত, মুহাম্মদ একজন আরব জাতীয়তাবাদী হলে জাতীয়তাবাদের অশোভন অনুপ্রেরণায় উপজাতিদের সম্মিলিত করতে পারতেন এবং দখলদার রোমান ও পারস্য শক্তিকে বিতাড়িত করতে পারতেন। কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি সর্বজনীন ঈশ্বর হিসেবে আল্লাহর নামে তা করতে পছন্দ করেছিলেন। পারস্য, রোমান, আফ্রিকা এবং অন্য যে কেউ আল্লাহ এবং তার নবীর আনুগত্য গ্রহণ করলে তার নামে মুহাম্মদের তৈরি নতুন সম্প্রদায়ে আল্লাহ সহজেই তাদের গ্রহণ করতে পারতেন।

তৃতীয়ত, ধনীদের পরাজিত করে এবং দরিদ্রদের মধ্যে তাদের সম্পদ পুনঃবণ্টন করে মুহাম্মদ সহজেই অভাবগ্রস্তদের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে পারতেন। একবার এটি করা হলে কোনো প্ররোচনা ছাড়াই দরিদ্ররা আল্লাহর ব্যানারে সমবেত হতো; কিন্তু কুতুব পাঠককে জানান, আল্লাহ নবীকেও এই রাস্তায় নিয়ে যাননি। কারণ, তিনি একটি তৃতীয় পথ পছন্দ করেছিলেন: ‘তিনি জানতেন যে, সমাজে প্রকৃত সামাজিক ন্যায়বিচার আসতে পারে শুধুমাত্র আল্লাহর আইনের কাছে সমস্ত বিষয় সমর্পণ করে সমাজ যদি সেই আইন নির্ধারিত ন্যায্য সম্পদ বিভাজন মেনে নিতে ইচ্ছুক হয় তাহলেই।’

দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে ইসলামের অধঃপতন শুরু হয়েছিল, যারা ইসলামের বিশুদ্ধতা পরিত্যাগ করে অন্যান্য সভ্যতা ও ঐতিহ্যের দূষিত স্রোত থেকে পান করতে শুরু করেছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, একমাত্র সত্যিকারের বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তনই ইসলামকে সম্পূর্ণ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।

আসুন কোরআনের কৃত্রিম চরিত্র এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতি তার ঋণকে একদিকে রেখে দেওয়া যাক। কুতুবের রাজনীতি ছিল এক জীবন-মরণ সংগ্রাম। প্যান-আরব জগৎ এবং কমিউনিস্টদের সম্পর্কে নাসেরের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে একটি হালকা মোড়কের বিতর্ক হিসেবে, মাইলস্টোনস ভূমিকা রাখলেও একটি রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে এর বার্তাটি ছিল পরস্পরবিরোধী এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই লেখনী কোরআনে কল্পনাকৃত প্রাথমিক ইসলামে ফিরে আসার পক্ষে কথা বলে।

 প্রাথমিক ইসলামে ফিরে আসার লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি দুই ধাপের জিহাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

‘প্রথম ধাপ, প্রচার এবং প্ররোচনা পদ্ধতির মাধ্যমে ধারণা এবং বিশ্বাসের সংস্কার করা; এবং দ্বিতীয় ধাপ, যে জাহিলি ব্যবস্থা মানুষকে তাদের ধারণা এবং বিশ্বাস সংস্কার করতে বাধা দিয়ে পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য করে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরিবর্তে মানব প্রভুর সেবা করতে বাধ্য করে, বলপ্রয়োগে সেই ব্যবস্থার সংগঠন ও কর্তৃপক্ষকে বিলুপ্ত করা।’

কিন্তু কুতুবের জন্য প্রচার-প্ররোচনা এবং বলপ্রয়োগ একই ধাপ ছিল। তার রচিত বইটি মৌলবাদী পাঠ্য হিসেবে এর কোনো অপ্রীতিকর সম্ভাবনার ওপর একটি আবরণ দিয়েছে। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামের প্রথম প্রজন্মের মতো জীবনযাপন করতে বা কোরআনের আইনকে তাদের আচরণবিধি বানাতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে কী হবে? প্রচার-প্ররোচনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে কী হবে? সমাধান খুব স্পষ্ট। তাদেরকে বলপ্রয়োগে বাধ্য করা হবে। ইসলামি জিহাদে আল-কায়েদা গঠনের জন্য ওসামা বিন লাদেনের ওয়াহাবি আরব যোদ্ধাদের সঙ্গে কুতুবের সমর্থকরা যোগদান করে। তারা বিশ্বাস করে যে, ‘আফগানিস্তানের আমিরাত’ ছিল প্রকৃত ইসলামের একমাত্র আদর্শ। তালেবান শাসনামল অতীত এবং ভবিষ্যৎ উভয়ের একটি চিত্র।

কুতুব কি এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হবেন? তা জানা মুশকিল। কিন্তু তার মৃত্যু এবং দমন-পীড়নের পর্যায়টি সরকারের জন্য কেবল একটি সাময়িক সমাধানই হতে পেরেছে। নাসের অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মীয় উগ্রবাদকে তীব্র আঘাত করার পর কমিউনিস্ট প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করার কৌশল পরিকল্পনায় তিনি উদ্যোগী হলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি মিশরীয় কমিউনিস্টদের হয় সরকারি কাঠামোতে হজম করা হয়েছে বা তাদের জন্য সমাধান অযোগ্য ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। তবে নাসেরীয় আধিপত্যের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে উঠেছিল বা’থ সমর্থক গোষ্ঠী।

যেহেতু প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বা’থ পার্টির বিভিন্ন অংশ সিরিয়া ও ইরাক শাসন করেছে, এর উৎস সম্পর্কে অধ্যয়ন শুধু একাডেমিক অনুশীলন নয়। বা’থ পার্টি ছিল মিশেল আফলাকের (১৯১০-৮৯) মস্তিষ্কপ্রসূত একটি দল। তিনি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টান বংশোদ্ভূত একজন বামপন্থি আরব জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ছিলেন। ১৯১০ সালে দামেস্কে একটি জাতীয়তাবাদী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা উভয়ই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উসমানীয়রা এবং তাদের ফরাসি উত্তরসূরিরা তার বাবাকে বন্দি করেছিল। মিশেল আফলাক সোরবোনে শিক্ষিত হয়েছিলেন, প্যারিসকে খুব ভালোবাসতেন, একটি আরব ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং মার্ক্সকে আবিষ্কার করেছিলেন।

১৯৩২ সালে সিরিয়ায় ফিরে এসে তিনি স্থানীয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করেন এবং তাদের পত্রিকায় লিখতে থাকেন। অন্য অনেকের মতো তিনিও ধরে নিয়েছিলেন যে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি ফরাসি উপনিবেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে কিন্তু ১৯৩৬ সালে পপুলার ফ্রন্ট সরকার যখন ঔপনিবেশিক কাঠামোকে অক্ষত রেখে দিল এবং সিরিয়ার কমিউনিস্টরা এটিকে এক অর্জন হিসেবে স্বীকার করে নিল তখন আফলাকের ভ্রমচ্যুতি ঘটে। অনেক বছর পর তিনি একজন সাক্ষাত্কার গ্রহণকারীকে বলেছিলেন:

‘এই সময়কালে আমি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের কঠোর সংগ্রামের প্রশংসা করেছি। আমি কমিউনিস্ট পার্টির তরুণদের কঠোরতার প্রশংসা করতাম। ১৯৩৬ সালের পর এবং ফ্রান্সে লিওন ব্লুম ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে আমি হতাশ হলাম এবং বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদ পেলাম।’

তিনি এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, স্থানীয় কমিউনিস্টরা কোনো আদর্শের প্রতি নয় বরং সোভিয়েত রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির স্বার্থের প্রতি অনুগত, এবং সে কারণে যে কোনো দীর্ঘ সংগ্রামে তাদের সঙ্গে মিত্রতা নির্ভরযোগ্য হবে না। এই অভিজ্ঞতা আফলাক, তার ঘনিষ্ঠ কমরেড সালাহ বিতার এবং অন্যান্য তরুণ আদর্শবাদী আরব জাতীয়তাবাদীদের যে কোনো আন্তর্জাতিকতাবাদী প্রেক্ষিত থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। ইউরোপীয় সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের ‘সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতি’ তাদের হতবাক করেছিল। তাদের মূল ভাবনা ছিল কীভাবে তাদের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন করা যায়। বাকি সবকিছু সেই লক্ষ্যের অধীনস্ত ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আফলাকের যে তত্ত্ব তার অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল সেটি হলো: একটি আরব

জাতি, একটি আরব জনগণ, এবং তাদের জন্য দরকার একটি আরব প্রজাতন্ত্র। এই ঐক্য ইতিহাস থেকে

উদ্ভূত। ইসলাম এবং এর নবী আরবদের একত্রিত করে অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনা করেছিলেন। এই

ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমস্ত আরবের সম্পত্তি ছিল। শুরুতে জাতি

এবং জাতীয়তা তার কাজের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়

উপনিবেশপন্থি ইউরোপীয় বামদের প্রতি তার মোহভঙ্গ হওয়া, যা তাকে কঠোরভাবে

জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মূল্যায়ন করতে পরিচালিত করেছিল। ব্রিটিশ এবং

ফরাসি সাম্রাজ্যের পরাজয় আরবদের জন্য ভালো হবে। আলেকজান্দ্রীয় জনতা থেকে উৎসাহিত হয়ে  জাতীয়তাবাদীরা আশা করেছিল রোমেল হয়তো তাদের কাজটা সহজ করে দেবে।

১৯৪২ সালে এল-আলামেইন-এ রোমেলের পরাজয়ের ঠিক এক বছর পর বা’থ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সিরিয়ার স্বাধীনতার পর, দলটি অ-কমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করে এবং সমগ্র আরব বিশ্বে এর আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। জর্ডান এবং ইরাকে বিভিন্ন গোপন পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় । হিজাজ ও ইয়েমেনে তার বিভিন্ন গ্রুপ কাজ করছিল। শুধু সিরিয়া ও লেবাননই বিভিন্ন সময়ের জন্য কার্যকরী দলগুলোকে আইনি অনুমতি দিয়েছিল। প্রথম সিরিয়াই এই দলটিকে দমন করে এবং আফলাককে গ্রেফতার করে। আফলাক ১৯৪৯-৫৪ সালে চার দফায় কারাগারে ছিলেন। প্যারিসে তিনি ফরাসি কমিউনিস্টদের কঠোরতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। সিরিয়ায় তিনি নতুন কর্মীদের মধ্যে, যাদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র, সেই ‘কঠোরতার’ প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে প্রভাবিত করেন।

১৯৪৩-৬৫ সময়কালে বা’থ-এর মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আফলাক নিশ্চিত করেছেন যে দলটিকে একটি প্যান-আরব সংগঠন হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এর নীতি ও সংগঠনের ওপর এর আধিপত্য রয়েছে। তিনি ক্ষমতাচর্চার পরিবর্তে দলের জন্য কাজ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে মিশর-সিরিয়া একীভূত হওয়ার পেছনে আফলাক গতিশীল শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু নাসেরের সঙ্গে তার পারস্পরিক বিদ্বেষ খুব তীব্র ছিল। উভয়েই আধুনিকীকরণের পক্ষে, পুঁজিবাদবিরোধী কর্মসূচির উপাদানগুলোর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার মানুষ, উভয়েই নতুন ধারণার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আফলাক যেখানে মূলত একটি পার্টির ব্যক্তি ছিলেন, যেখানে নাসের ছিলেন এমন একজন জননেতা যার নাম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তাই আফলাককে সমান পর্যায়ে মোকাবিলা করার ব্যাপারে নাসের বিরক্ত ছিলেন। এটি ব্যাখ্যা করে সিরিয়ার মতাদর্শিক নেতা কেন ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত ছিলেন। নাসের অবশ্য একচেটিয়া ক্ষমতা পছন্দ করতেন। এবং দামেস্কে মিশরীয় দূত আবদেল হাকিম আমেরের উচ্চ হস্তক্ষেপে তাদের জোটের সমাপ্তি ঘটে।

কিন্তু এসব বিভাজনের মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল আরও সাম্প্রতিক ঘটনার বস্তুগত বাস্তবতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয় ও পতনের পর থেকে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা উৎসাহিত নতুন রাষ্ট্রগুলো আধুনিকতা এবং স্থানীয়/আঞ্চলিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ের ভিত্তিতে তাদের নিজস্ব একটি উপ-জাতীয়তাবাদী অস্তিত্ব গড়ে তুলেছিল। উসমানীয়রা আরব প্রাচ্যকে বাইরে থেকে একত্রিত করেছিল, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তনের অভাবে ভেতরে একত্রিত করতে পারেনি। আমরা দেখেছি, এই কারণে নেপোলিয়নের সংক্ষিপ্ত দখলের পর মিশর একটি আধা স্বাধীনতা উপভোগ করেছিল। পরবর্তীকালে, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধারণ করার জন্য জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ খুবই দুর্বল একটি অবলম্বন হিসেবে প্রমাণিত হয়। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী-আরোপিত বিভাজনগুলো সিরিয়া ও লেবাননের মতো প্রতিকূল ভৌগোলিক এলাকায়ও বিদ্যমান ছিল।

উপদ্বীপটি ছিল সম্পূর্ণ অন্য একটি গল্প। উসমানীয় সাম্রাজ্য উপেক্ষিত উপজাতীয় বিভাগগুলো এ অঞ্চলে একাধিক সার্বভৌমত্ব তৈরি করেছিল। যদিও ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় আল-সৌদরা শেষ পর্যন্ত উপদ্বীপটি দখল করেছিল, তবে এর নেপথ্যে ছিল তেল আবিষ্কার, বৃহৎ মার্কিন তেল কোম্পানি আরামকো (ARAMCO) তৈরি এবং ধহরানে বিশাল ইউএসএএফ ঘাঁটি, যা সৌদি আরবের ঐক্য সংরক্ষিত করেছিল। এবং একে আরব প্রতিক্রিয়াশীলতার ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল।

সাম্রাজ্যবাদ, তেল এবং ১৯৪৮ সালের পর ইসরায়েল–এই তিনটি কারণে আরব জাতীয়তাবাদে একটি বড় আকারের গতি প্রদান করে। অসুবিধার মুহূর্তে আঁকড়ে ধরার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছিল। যদি জায়নবাদী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে সম্ভবত এই অঞ্চল থেকে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে আরব জাতীয়তাবাদ অদৃশ্য হয়ে যেত এবং প্রতিটি দেশ তার নিজ জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী হতো।

মিশর এবং সিরিয়া ও ইরাকে বা’থবাদীদের বিরোধ তিনটি রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে। এবং তেল আবিবে তৈরি হতে থাকে আরব জাতীয়তাবাদের জন্য চূড়ান্ত আঘাত।

আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৬ 

ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ইমেইল: fatemaorama@gmail.com

পাদটীকা

১। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে মিশরীয়, সিরিয়ান এবং ইরাকি সেনাবাহিনীর এই বৈশিষ্ট্যটি দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশে নিরলসভাবে নির্মিত ঔপনিবেশিক সামরিক কাঠামো থেকে বিপরীতধর্মী ছিল। আরব বিশ্বে ঔপনিবেশিক উপস্থিতিকাল তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত ছিল। ট্রান্স-জর্ডানে বেদুইনদের জন্য গ্লুব পাশার নিখুঁত প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে, ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা মিশর, সিরিয়া, ইরাক এমনকি সৌদি আরবে নির্ভরযোগ্য আর কোনো বাহিনী তৈরি করতে পারেনি। সিরিয়া ও ইরাকে, বিশেষ করে তরুণ ক্যাডেটরা যারা অফিসার হয়েছিলেন তারা বিভিন্ন ধরনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

২। মরিস অরবাচ, উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের উইলসডেনের বামপন্থি লেবার এমপি, যিনি কায়রো থেকে তেল আবিব পর্যন্ত বার্তা বহন করেছিলেন। স্থানীয় জায়নবাদীরা তাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। বিস্তারিত বিবরণের জন্য Avi Shlaim, The Iron Wall, London 2000, pp. 118-30।

৩। ব্রিটিশ লেবার পার্টি, যুদ্ধে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়, ব্রিটিশ জনমতকে বিভক্ত করে এবং মিডিয়া ও অন্যত্র ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে বড় করে তোলে।

৪। এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করার জন্য অবশ্যই একাধিক উপায় আছে। আয়েশার পরিপক্বতা কখনোই সন্দেহ করা হয়নি এবং তার মন্তব্য, যদি এটি আদৌ করা হয়ে থাকে, তবে মুতাযিলীদের দেওয়া একই অর্থ বোঝাতে পারে যে, কিতাবটি অবতীর্ণ হয়নি।

৫। কামেল এস. আবু জাবের, আরব বাআথ সোশ্যালিস্ট পার্টি, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৬।

৬। দূর প্রাচ্যে একই দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতারা এবং ১৯৪২ সালের আগস্টে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ক্ষমতার বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে লাহোরে একদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় মাহমুদাবাদের রাজা আমাকে আফলাক এবং তার তত্ত্বের ইতিহাস বর্ণনা করেছিলেন। জিন্নাহর মুসলিম লীগকে রাজা অর্থায়ন করেছিলেন, কিন্তু পরে তার পুরোপুরি মোহভঙ্গ ঘটেছিল। তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেছিলেন। সেখানে তিনি আফলাকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং মনে করছিলেন পাকিস্তানে বা’থের একটি সংস্করণ প্রয়োজন। পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি সবচেয়ে কাছাকাছি একটি সংস্করণ ছিল। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ-রাজনৈতিক ঐতিহ্য তাদের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য তৈরি করে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •