জানোয়ার:
অর্থনীতি, রাজনীতি, নব্য-উপনিবেশায়ন, দূষণ, শোষণের চিত্রায়িত বিনোদন
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন
“আমাদের অর্থনীতিতে কৃষক একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব কিছু খুচরা ক্রয় করেন আর সব কিছু পাইকারি বিক্রি করেন এবং উভয়ভাবে মাল পরিশোধ করেন।”
-ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত (নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি বা ধরা যায় তিনি নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন) ।
সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য
নাম : জানোয়ার (Galician: As bestas) ।
পরিচালক : রদ্রিগো সরোগোয়েন। লেখক : ইসাবেল পেনা, রদ্রিগো সরোগোয়েন।
প্রযোজক : টমাস পিবারট, অ্যান-লর লাবদি, জিন লাবদি, রদ্রিগো সরোগোয়েন, নাচো লাভিলা, এডুয়ার্ডো ভিলানুয়েভা, সান্দ্রা তাপিয়া দিয়াজ, ইগনাসি এস্টাপে, ইবন কোরমেনজানা।
চিত্রগ্রাহক : অ্যালেক্স ডি পাবলো। সম্পাদক : আলবার্তো দেল ক্যাম্পো। সঙ্গীত : অলিভিয়ার আর্সন।
ভাষা : ফরাসি স্প্যানিশ গ্যালিসিয়ান। মুক্তি : ২০২২। দৈর্ঘ্য : ১৩৭ মিনিট। দেশ : স্পেন ফ্রান্স।
অভিনয় : মেরিনা ফোইস, ডেনিস মেনোচেট, লুইস জাহেরা, দিয়েগো অ্যানিডো, মারি কলম্ব, লুইসা মেরেলাস, হোসে ম্যানুয়েল ফার্নান্দেজ ব্লাঙ্কো।
নব্য উপনিবেশায়ন বা চর দখলের নতুন আখ্যান
রদ্রিগো সরোগোয়েনের “জানোয়ার” সিনেমার কাহিনী খানিক অদলবদল করে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব। যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ইত্যাদির ফলাফল পৃথিবীর মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত এবং ক্ষমতাবান এসব “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী”র শোষণ প্রক্রিয়া বংশানুক্রমিকভাবে ক্রম্বর্ধমান। ১% মানুষের অতিরিক্ত মুনাফা ও বিলাসী জীবনের ব্যয়ভার পূরণের হাতিয়ার হিসেবে, বিজ্ঞান, ধর্ম, প্রযুক্তি, বিনোদন, রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষাসহ সব কাঠামো একযোগে ব্যবহার করে যে সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে তা শতশতকোটি মানুষকে “প্রাণী” থেকে “ভোক্তা” “অনুসারী (Follower)” “মিত্র” “দেশবাসী” “নাগরিক” ইত্যাদি ইত্যাদিতে পরিণত করেছে। বিলুপ্ত করা হয়েছে তার স্বাধীন প্রাণীজসত্তা, প্রাকৃতিক ভূগোল, তৈরি হচ্ছে “ইহুদিরাষ্ট্র” “হিন্দুরাষ্ট্র” “ইসলামীরাষ্ট্র” বা গালভরা “সোনার বাংলা” ইত্যাদি বিচিত্র নামের নানান কারাগার। যেখানে সিংহভাগ মানুষকে পরিণত করা হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, অগভীর তরল চরিত্রের হাতের পুতুল “জানোয়ার” হিসেবে। যাদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যাবে, পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ করে একে অন্যের সাথে লড়িয়ে দেয়া যাবে, সেই পুরাতন “ভাগ করো, শাসন করো/ডিভাইড অ্যান্ড রুল”। আখেরে লাভবান হবে সেই মুষ্টিমেয় গুটিকয় মানুষ।
২০২০ সালের করোনা মহামারীর সময়ে যে গেল গেল রব উঠেছিল, প্রাণ-পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে যে সজাগতার খানিক সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হয়েছিল সেসব “যন্ত্রণা” শেষ, সবাই সব ভুলে আবার খুব “নর্মাল”। এসব গণব্যক্তিগত নিষ্ক্রিয়তার ফলে চারপাশের শোষণ বেড়ে চলেছে ব্যাপকভাবে কারণ নিজেদের গদিতে আগুন লাগার আগে সব, সবাই খুব “নর্মাল অ্যান্ড ফর্মাল”। যে কোনো পর্যায়ের ভিন্নমত, প্রতিরোধ সামান্য! চারিদিকে সাধারণ প্রশ্ন বা কৌতূহলের নিদারুণ অভাব। ধারাবাহিকভাবে বিদ্যমান নানাবিধ ব্যক্তিগত অব্যক্তিগত কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে, প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ নিয়ে, আইনকানুন নিয়ে, ব্যক্তিগত অবস্থান-যাপন নিয়ে, পরিবার কাঠামো নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের অভাব। ফলে দিনের পর দিন সমরূপ জীবনযাপন করে ভিন্ন ফলাফলের আশা করার মতো দশা সর্বত্র, কার্যকর জীবনযাপন প্রায় শূন্য! এরূপ পুঁজিবাদী কাঠামোয় কোনো কিছু পুঁজি বা অর্থের হিসাবের বাইরে প্রায় থাকেনা এবং সব হিসাব নির্ধারিত হয় দিন শেষে ক্ষমতাবান পুঁজিপতিদের লাভলোকসান দিয়ে।
এইসব আলাপ তত্ত্ব না হয়ে গল্প হয়ে প্রদর্শিত হয় জানোয়ারে। আসলে উল্লিখিত সিনেমার আন্তন বা জান, ওলগাসহ আমাদের কারো কোনো নিরাপত্তা নেই। আইন-আদালত পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদি মূলত ক্ষমতাবানদের সুরক্ষার জন্য এবং যেদিন প্রয়োজন পড়বে দেখবেন আপনার কল্পিত সুরক্ষা ধোয়ার মত মিলিয়ে গেছে কোনো ক্ষমতাবানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, লাভ-লোকসানের হিসাবের ফলে। সর্বসাধারণ বা আমজনতা প্রচলিত বিদ্যমান কাঠামোয় উপকরণ মাত্র!? “জানোয়ার” এসব ভাবনাদের বেশ উস্কে দেয়, আন্তন ও আন্তা ভাইদের গল্প বলতে বলতে এবং উক্ত গ্রামে এক বড় কোম্পানির বায়ুকল স্থাপনের উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের প্রভাবের ভিতর দিয়ে। বায়ুকল প্রকল্পে সম্মতি প্রদান করে ক্ষতিপূরণ নিতে আগ্রহী গ্রামের পুরনো বাসিন্দা জান আর শহর থেকে আসা নতুন আন্তন বায়ুকল স্থাপনের বিপক্ষে মত দেয়, শুরু হয় গ্রামের ভিতরে দলাদলি, শুরু হয় “জানোয়ার” সিনেমার।
সিনেমায় গ্যালিসিয়ার এক গ্রামের কৃষক-পরিবার-সমাজ যাপন প্রদর্শিত হয়। আন্তন নামের এক ফরাসি, নাগরিক জীবনে ক্লান্ত পরাজিত হয়ে টিকতে না পেরে তার সঙ্গীনীসহ হাজির হয় গ্রামে এবং তার নাযিল হবার কারণ হিসেবে পেশ করে, সে একদিন শারীরিকভাবে খুব ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে এক নীরব জায়গায় থেমে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গলে সে দেখে আকাশভরা তারা, তার খুব ভালো লাগে, সকালে দেখে সে উর্বর জমি, তার খুব ভালো লাগে। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার শহুরে যাপন ছেড়ে গ্রামে এসে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক কৃষিকাজ করে জীবনধারন করবে। অনুমান করা যায় তার উদ্বৃত্ত পুঁজি এবং সম্পদ একত্রিত করে গ্রামের একাংশ দখল নেয় চুক্তিতে বা ক্রয় করে। তার শহুরে বিদ্যা, যোগাযোগ দক্ষতা, চৌকসতার ফলে গ্রামের অপর কৃষকদের তুলনায় সে ভালো করে কারণ স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে তার যে সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে গ্রামের আর কারো তা নেই। তা সত্ত্বেও সে খুব “সংবেদনশীল” আবার “পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা” নিয়ে ব্যস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি রূপে উপস্থিত। তার উপর থেকে হঠাৎ “উড়ে এসে জুড়ে বসা”র ফলে তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান এবং কম সুবিধাভোগী গ্রামবাসীর কি অবস্থা? এসবে তার কিছু এসে যায়না এবং উপলদ্ধিও করার চেষ্টা করেনা, পক্ষান্তরে আত্মসর্বস্ব ভাবনা থেকে সে সর্বদা নিজেকে ভুক্তভোগী হিসেবে জাহির করে। কোনোপ্রকার জবাবদিহি, আত্মপীড়ন তার নেই। কারণ তুলনামূলক ক্ষমতাবানদের তোষণনীতি সংস্কৃতির উপর ভর করে টিকে রয়েছে বিদ্যমান ব্যবস্থা যার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্মতির সুফল দ্বারা সে পরিবেষ্টিত। এবং সে তার প্রতিবেশী আন্তা ভাইদের চেয়ে ক্ষমতাবান, ফলে সব ভাষ্য অকাট্যরূপে তাকে সার্বিকভাবে সমর্থনযোগ্য করে তোলে, তার আত্মপীড়ন হবে কীভাবে?
সমাজ কাঠামো তাকে জবাবদিহিতায় বাধ্য করেনা কারণ তুলনামুলকভাবে সে বেশি ক্ষমতাবান! ফলে তার তথাকথিত “পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা” “সংবেদনশীলতার” প্রভাবে বাকি গ্রামবাসীদের খারাপ অবস্থায় তার কিছু যায় আসেনা। আন্তাদের সব তার কাছে স্থূল বুদ্ধির, অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর প্রতীয়মান হয়। এসবের প্রকাশ তার/তাদের (আন্তন ও ওলগার) আচরণ, ব্যবহারে প্রকাশিত হয়। আন্তারা দুই ভাই, বড় জান, ছোট লরেঞ্জো, যে এক দুর্ঘটনায় সঠিক ধারাবাহিক চিকিৎসার অভাবে খানিক মানসিক প্রতিবন্ধীও বটে। শুরু থেকে তারা আন্তনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য অনুভব করে এবং ধীরে ধীরে বাধা ও প্রতিরোধ তৈরি করে। আন্তনের চরিত্র বিশ্লেষণে মনে রাখা দরকার কীভাবে ক্ষমতাবানেরা উপর থেকে নানা ভালো ভালো উদ্দেশ্যের নামে প্রান্ত দখল করে এবং তার ইতিহাস অবধি বদলে দেয়। সমরূপভাবে একদা ব্রিটিশসহ অন্যান্য পশ্চিমা, নানাবিধ কেন্দ্রের নানান তরিকার সুবিধাভোগী ক্ষমতাবানেরা নানান উছিলায় প্রান্তের নানান দেশের দখল নিয়ে চালিয়ে গেছে শত শত বছরের শারীরিক উপনিবেশায়ন, বিকৃতায়ন।
বর্তমান শোষকেরা কর্পোরেটসংস্থা/এনজিও/শিক্ষা/শিল্প/রাজনীতি নানাবিধ রঙবেরঙয়ের উদ্যোগ, ইত্যাকার নানা নামে, আকারে এখনো নাযিল হন সেই পুরনো ঔপনিবেশিক শোষণের পথ ধরে। কখনো শিক্ষা, স্বাধীনতা, বাণিজ্য, ধর্ম, অধিকার, প্রযুক্তি তো কখনো পরিবেশ, পরিবেশবান্ধব-প্রাকৃতিক কৃষি-পর্যটন আবার কখনো নানাবিধ জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক উপদেশের উছিলা ধরে, আব্দার ও নতুন নতুন শব্দের চমকের শেষ নেই। এই ইতিহাস গ্রামের জান প্রকাশ করতে না পারলেও ভয়াবহতা অনুভব করে। সে জানে বায়ুকল স্থাপনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও একদিন ঠিক বায়ুকল হবে কারণ সকল গ্রামবাসীর চেয়ে বায়ুকলের প্রতিষ্ঠান বেশি ক্ষমতাবান ও বেশি পুঁজির অধিকারী। কিন্তু সে কমপক্ষে তার চেয়ে খানিক ক্ষমতাবান আন্তনের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে চায়, তার ব্যক্তিগত মর্যাদা চায় এবং আন্তনসম অধিকার ও অভিজ্ঞতা চায়।
কিন্তু জানের প্রতিবাদ, প্রত্যাশা খুনে রূপান্তরিত হতে বাধ্য করে সমাজ আন্তন চরিত্রের ভিতর দিয়ে। আর প্রান্তিক পুঁজিহীন মানুষ হিসেবে লরেঞ্জো, জানসহ এরূপ সকলে চিরকাল ধরে অশিক্ষিত, খুনী, ধর্ষক, লোভী, নোংরা, ছোটলোক, অপরাধী থেকে যাবে কারণ প্রচলিত ব্যবস্থায় এসবের প্রতিকার নেই, প্রচলিত কাঠামোয় তাদের কোনোপ্রকার মুক্তির কোনো পথ নেই [২০১৯ এর বং জু-হো পরিচালিত “পরজীবী” (“Parasite” ১৩২ মিনিট) সিনেমার কথা মনে করে দেখুন কীভাবে গরীবেরা ধীরে ধীরে শোষিত, নিপীড়িত হতে হতে মানুষ হত্যায় বাধ্য হয় এবং জেল, ফাঁসির দড়িতে জীবন শেষ হয়! কারণ তাদের বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো পথ খুলে রাখা হয়নি!] । প্রচলিত ব্যবস্থা সুবিধাভোগী আন্তনের ভাষ্যকেই লোকমান্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে কারণ জান আর লরেঞ্জোর চেয়ে আন্তন ও তার পরিবার “শ্রেণি” হিসেবে তুলনামূলক বেশি সুবিধাভোগী এবং আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান (ইয়াসমিন-ত্বকী-তনু-জুলহাজ-তনয়-মুনিয়া-সাগর-রুনি-আলফ্রেড সরেন-অভিজিৎ রায়সহ এরকম আরোসব নামগুলো মনে আছে? বা জামাল খাসোগির খুন বা ইসরায়েলকৃত চলমান গণহত্যা – সর্বত্র ক্ষমতাবানেরা, ক্ষমতাশালী মতবাদ, জনপ্রিয় মতামত বহাল তবিয়তে বিজয়ে ভূষিত!) ।
কৃষিতে নানাসময় কোনো কেন্দ্র/উপকেন্দ্র থেকে এরূপ আন্তনেরা গ্রামে আধুনিক চাষাবাদের, সার-কীটনাশক-রাসায়নিক বিষের, কোম্পানির বীজের বাণিজ্য ঢুকিয়ে ছিল/ঢুকাচ্ছে, নানা উদ্ধার, উন্নয়ন ও বিপ্লবের নামে, এসব নতুন নয়। আবার বাংলা থেকে বিশ্বে সনাতন কৃষিচর্চা নিয়ে কৌতুক, অবহেলা, অপমান, খোদ “চাষা” শব্দকে গালি হিসেবে ব্যবহারের মনোভাব ও বাস্তবায়ন হয়েছিল এরকম গোষ্ঠীর কারো দ্বারা, কোনো মহান প্রকল্পের অংশ বা ব্যক্তিগত মহানুভবতার উদাহরণ হিসেবে! এরূপ শোষণ, উপর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রক্রিয়ার আধিপত্য কায়েমকারী উপনিবেশায়ন এখনো চলছে, স্পেন থেকে বাংলায়, নানান নামে, নানান ধামে, একক বা যৌথভাবে সর্বত্র পৃথিবীময়। আন্তন, জান, লরেঞ্জো ছাড়া সিনেমার বাকি চরিত্রেরা হলো আন্তনের বউ ওলগা, তাদের মেয়ে মেরী এবং জান ও লরেঞ্জোর বয়স্ক মা।
একসময় মেরী শহর থেকে গ্রামের খামারবাড়িতে বেড়াতে আসে তার কোলের সন্তান নিয়ে, তার জামাইয়ের সাথে তার মিল নেই। সে খুব অল্প বয়সে বাচ্চার মা হয়েছে। সে যখন আসে তখন আন্তন আর ধরাধামে নেই। মেরী তার মা ওলগাকে (আন্তন-ওলগার চেয়ে) নবতর কেন্দ্রীয় বয়ান-যাপনের নির্দেশ শোনায়, ওলগা তা মেনে নিতে পারেনা, মেরী আবার শহরে চলে যায় কোলের সন্তানসহ। ওলগা তার নিজের প্রতি তার মেয়ে মেরীর উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থা প্রতিরোধ করে এবং চলতে থাকে। পক্ষান্তরে আন্তন যখন কেন্দ্রিয়/উপকেন্দ্রিয় মতামতের, যাপনের নির্দেশাবলী গ্রামে চাপিয়ে দিচ্ছিল তখন কিন্তু ওলগা গ্রামবাসীকে, তাদের অবস্থানকে বোঝার চেষ্টা করেনি বরং আন্তনের প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহায্য করেছে। সমসাময়িক আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক সাধারণ নিয়মমাপা জীবনযাপন মেরী ও ওলগার, আন্তন থেকে তাদের অবস্থান গুণগতভাবে ভিন্ন নয়। সিনেমার শেষে আন্তনকে খুনের দায়ে আন্তা ভাইদের পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। এখন পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে বর্তমান থাকে আন্তাদের বয়সী মা এবং মধ্য বয়সের নারী ওলগা। একজন মারা যাওয়ার অপেক্ষা করছে, স্বামী আগেই বিগত, এক ছেলে “স্বাভাবিক” এক ছেলে আধা-“বলদ” আর দুজনে প্রতিবেশী খুনের দায়ে পুলিশে। অন্যদিকে ওলগার একা মেয়ে নাতি নিয়ে শহরে ফিরে গেছে, কোনোদিন সে ওলগা-আন্তনের সাধের প্রাকৃতিক কৃষি খামারে ফিরে আসবেনা।
আর্থিক অবস্থা ভালো হলে হয়তো মেরী এ বাড়িকে তার/তাদের ব্যক্তিগত “হাইডাউট” বা “নেচার সেন্টার” ইত্যাদি ইত্যাদি বিলাসের উপকরণ ধরে উদ্বৃত্ত সম্পদ হিসেবে জমিয়ে রাখবে, পুনরায় শুরু হবে আরেকজন পুঁজিপতির কাহিনী। আর তার আর্থিক সক্ষমতা না থাকলে সে এ সম্পত্তি বিক্রি করে দেবে বা দখলে নেবে, গিলে খাবে তার চেয়ে বড় তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান, কেন্দ্রের আরো বেশি কাছাকাছি কেউ (আওয়ামী লীগ সরকার আমলের পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এর মতো কেউ শত শত বিঘা ভূমি জোর করে দখল করে নেবে অথবা অঢেল দুর্নীতির টাকায় কিনে নেবে আরকি!)। পুঁজিবাদী কাঠামোর পুরনো স্বভাব, “বড় মাছ, ছোট মাছ খাবে”, যাকে বলা হয় “মাৎস্যন্যায়”। এরূপ ভাব, ভাবনা, রাজনীতি “জানোয়ার” জুড়ে আন্তন, জান আর ওলগার গল্পের আবরণে প্রদর্শিত হয়। যেখানে কম সুবিধাভোগী প্রান্তের জানের লড়াই-প্রতিরোধ খানিক দৃশ্যমান হয়, অধিকাংশ “বাস্তবতা” “নির্মাণে”র চাপে অদৃশ্য আবার কখনো বিকৃতরূপে প্রদর্শিত।
জানোয়ারে সাদা চোখে মনে হতে পারে আন্তনের ভাষ্যের বিজয় হয়েছে কিন্তু এরূপ ভাসমান বাস্তবতার গভীরে রয়েছে ভিন্ন স্বরের উপস্থিতি। যদিও সমসাময়িক আরেক স্প্যানিশ চলচ্চিত্রকার গালদের গজতেলু-উড়ুতিয়ার “দি প্ল্যাটফর্ম” (“The Platform” ২০১৯, ৯৪ মিনিট, স্পেন।) সিনেমায় “বাস্তবতা” বজায় রেখেও সরাসরি প্রান্তিক মতামতের উদযাপন প্রদর্শিত হয়। কিন্তু “জানোয়ার” দেখতে দেখতে কখনো মনে হতে পারে চলচ্চিত্রকার নিজেও বোধহয় জানের প্রান্তিক যাপনের এরূপ বৈপ্লবিক দর্শন প্রকল্পের অংশ হতে দ্বিধাগ্রস্থ যে দ্বিধা সিনেমাতেও দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। ফলে “জানোয়ার” রোমাঞ্চকর যাত্রার সম্ভাবনার ইশারা দিলেও দৃশ্যত এটি সমাজমান্য সুবিধাভোগী আন্তনের ভাষ্যের সাথে একধরনের সহমর্মীতা যাপন করতে চায়!
বিক্ষিপ্ত কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়
ক. লক্ষণীয় বিষয় গালিসিয়ার এক গ্রাম, পরিবেশবান্ধব কৃষির উছিলায় দখলের গল্পের মতো পরিস্থিতি খানিক ভিন্নভাবে বাংলাতেও বিদ্যমান। বাংলায় “আধুনিক শিক্ষা”য় “শিক্ষিত” ছোট-বড় উদ্বৃত্ত পুঁজিধারী, নানাবিধ কারণে গ্রামের প্রথাগত কৃষকের চেয়ে অনেকগুণ সুবিধাভোগী একদল মানুষ ইদানিং নানান প্রশিক্ষণ নিয়ে, নিজেদের শহুরে চৌকস প্রযুক্তি নির্ভর নেটওয়ার্কিং সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে হঠাৎ “কৃষক” হয়ে যাচ্ছেন। তারপর ক্ষমতাধারী শহর/কেন্দ্র/উপকেন্দ্র থেকে তুলনামূলক যোগাযোগ সুবিধা সম্পন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে জমি কিনে/ভাড়া করে/চুক্তিতে/বন্ধকী নিয়ে শুরু হয় সম্পূর্ণ শতভাগ মুনাফাকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক “প্রাকৃতিক কৃষি”, যার মূলসুবিধা ভোগ করে কোনো শহরকেন্দ্র এবং সুবিধাভোগী ক্ষমতাবানেরা। সেই পুরনো কাসুন্দি, প্রত্যন্ত অঞ্চল শোষণ করে কেন্দ্রে সম্পদ, সেবা, পুঁজি জড়ো করা। আবার সংগৃহীত সনাতন জ্ঞানের উপরে ধীরে ধীরে সংরক্ষণের নামে চলতে থাকে ব্যক্তিগত মালিকানা জাহির করার নানান তরিকা।
এভাবে প্রচলিত উন্মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার পর্যায়ক্রমে কর্পোরেট পুঁজির মুনাফাবৃদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং স্বল্পসংখ্যক তার সুফল ভোগ করে। অপরদিকে দলে দলে লোকজন জোগাড় করে শুরু হয় কোচিং সেন্টারের মতন ব্যাচে ব্যাচে “কৃষিজ্ঞান” বিতরণ, করণীয় তালিকাসহ! ফসল, জ্ঞানের বদলে উৎপাদিত হয় ব্যাচে ব্যাচে মুখস্ত বিদ্যাধারী “কৃষক”, বকলমে উক্ত সেন্টারের/কোচিংয়ের ভোক্তা, সরবরাহকারী এবং বিনা পয়সার প্রচারকারী। এমনতর বাস্তবতা সত্ত্বেও ঢাকায় “মাটিঘেঁষা”/ “শিকড়ের সন্ধানে”/ “শিকড়” সম্পর্কিত, অভিহিত সিনেমায় কখনো ঠিকঠাক কৃষি ও কৃষক কেন্দ্র করে কোনো বয়ান নির্মিত হয়নি। বরং বুলিভরা সব ইচ্ছা-অনিচ্ছার তলানিতে ডুবে থাকা চরিত্র, বানানো গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য, মানহীন অসম্পন্ন প্রযোজনা বোধহয় কৃষিসহ সকল বিষয়ে নির্মিত বাংলা সিনেমার সাধারণ নিয়তিবাদী গরিমামাখা চরিত্র। বদল অনিবার্য।
খ. ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনিদের কোনোপ্রকার যথাযথ সম্মতি ছাড়াই কুচক্রান্ত করে তৎকালীন উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ সরকার তাদের তাবেদারদের নিয়ে উপনিবেশের পুরনো খুঁটি নতুন “ইসরায়েল” নামে উপর থেকে চাপিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের উপরে। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনের মানচিত্র দেখেই বোঝা সম্ভব আইন-কানুন ইত্যাদি সব বানানো আর ধনীদের জন্য, কারণ ১৯১৭ সালের আগে আরবে কোনো “ইসরায়েল” ছিল না যা নানান ছলে-বলে-কৌশলে আরবের ভিতরে বিশাল এক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আর ফিলিস্তিন প্রায় অদৃশ্য! “জোর যার মুল্লুক তার” এছাড়া কি বলা সম্ভব? আইন-আদালত-অধিকার-ধর্ম-সংস্কৃতি সব গরীবকে ভুলিয়ে রাখার ভালো মন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত। আর এসব সম্ভব হয়েছে বিদ্যমান সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলে তাই বিদ্যমান কাঠামো না বদলে আর যাই হোক ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। ফলে ইসরায়েল “গণতন্ত্র” “মানবাধিকার” “স্বাধীনতা” এবং “আত্মরক্ষার” জন্য তার জন্মসূত্রে গাথা মিত্র ব্রিটিশ-মার্কিন-মিশর-সউদি-ফ্রান্স-জার্মানির সম্মতি-সহযোগিতা নিয়ে দিনের পরে দিন ফিলিস্তিনে গণহত্যা গণহত্যা খেলা খেলবে আর ফেসবুক, গুগলসহ সমস্ত টেক জায়ান্টরা সমর্থন করবে এবং ইসরায়েলকৃত গণহত্যায় সমর্থন জোগাবে আর বগল বাজাবে!
নাৎসি বাহিনী ৬০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে বলে জানি কিন্তু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখুন “ইসরায়েল” প্রতিষ্ঠা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১৯১৭ সাল থেকে নানান পক্ষের যত মানুষ মারা গেছে তার মোট সংখ্যা কত? নিশ্চিত চমকাবেন! দিনের পর দিন ইসরায়েলের মিত্র সমর্থক জায়নবাদীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে, এর ফলাফল সবার জন্য, সবকিছুর জন্য, মুক্ত চিন্তার জন্য খুব ভয়াবহ। যেমন, প্রমাণস্বরূপ ভালো উদাহরণ হচ্ছে সকল প্রকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার “মনে করেনা” এবং “প্রমাণ” খুঁজে পায়না, ইসরায়েলকৃত গণহত্যার ফলে বাকি সবাই কি বলে, সেসবে কিছু যায় আসেনা কারণ তাদের “পুঁজি” কম বা নেই, আর মার্কিনমুলুক তো প্রধানতম পুঁজিকেন্দ্র। কারণ পুঁজিবাদ আসলে সেই পুরাতন “জোর যার মুল্লুক তার” এর আধুনিক নামকরণ বৈ কিছু নয়। ইসরায়েল-মার্কিন ভাষ্য প্রতিষ্ঠিত হবে প্রয়োজনে গণহত্যা চলছে, চলবে। কিছু হবেনা, কফি, ব্যক্তিগত সফলতা, ইচ্ছের চরকিতে তেল দিতে দিতে সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান গভীরঘুমে আচ্ছন্ন। কারণ “পুঁজিবাদী” নিরাপত্তায় আস্থা! যে আমার কিছু হবেনা। কিন্তু সবার উপরেই “জানোয়ার” সিনেমার মতন উপর থেকে যেকোনো সময়ে যেকোনো প্রকার অন্যায্য-অন্যায় সিদ্ধান্ত নেমে আসতে পারে, “বায়ুকল” বা “ইসরায়েল” যেকোনো নামে। মূলত প্রচলিত কাঠামোয় কেউ, কিছু নিরাপদ নয়। ভিন্নতর ভাবনা এবং জীবনযাপন অতীব জরুরি।
গ. “জানোয়ার” সিনেমার পাত্রপাত্রীদের অভিনয় খ্যাতি ২০২২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু হয়ে দুনিয়াব্যাপি ছড়িয়েছে, বিশেষত জানরূপী লুইস জাহেরার কথা উল্লেখ প্রয়োজন। তবে এই সিনেমার পৃথিবীর ভিতরে বোধহয় বাংলাদেশ (সরকার/জনগণ/তারকা/গণমাধ্যম ইত্যাদি।) পড়েনা এবং পড়ার আগ্রহও খুব কম! কারণ ঢাকার তথা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজ ২০২৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের খবর এবং ছবি হিসেবে যা খুব উল্লেখযোগ্য করে ছাপিয়েছে সে হলো এক অভিনেত্রীর উপুর্যপরি নানান “সাহসী” “আবেদনময়” “বোল্ড লুকে”র ছবি এবং তিনি “জেনুবিয়া” নামক সিনেমায় অভিনয় করবেন সে খবর আর সাথে যা লেখা হয়েছে সেও খুব পদবাচ্য নয়! আর “কান চলচ্চিত্র উৎসব” সম্পর্কিত তাদের (উক্ত দুই খবরের কাগজ) “জ্ঞান” “খবর” ও “কৌতূহল” বোধকরি এরূপ এক বা একাধিক দেশি-বিদেশি তারকা-প্রভাবক-অভিনেতা-অভিনেত্রী-নির্মাতা-নির্মাণ-আধার-আধেয় কেন্দ্রিক!? যেখানে “জানোয়ার” ধরনের “কান চলচ্চিত্র উৎসব” নেই। উক্ত দুই খবরের কাগজ বাইরের অবস্থাও তথৈবচ!
সিনেমায় ব্যক্তিগত স্বার্থ-সফলতা-বিফলতার গল্পকাঠামো বার বার চিপে তেতো করার রমরমা সময়ে এরকম রাজনীতি, কৃষি, অর্থনীতির রোমাঞ্চকর বয়ান নির্মাণ রদ্রিগো এবং লেখকসহ দলের সকলের ধারাবাহিক কর্মচর্চা, সাহস ও নব মনভঙ্গীর নির্দেশক। সমসাময়িক অর্থনীতি, ব্যক্তিগত পর্যায়ের সামাজিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, উপনিবেশায়ন-বিউপনিবেশায়ন, আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক ভাবনার সীমাবদ্ধতার জটিল তত্ত্বীয় কাঠামো “জানোয়ারে” কার্যকর আখ্যান হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে এক সরল পারিবারিক-সামাজিক সিনেমা হিসেবে! দারুণ প্রযোজনা, চিত্রনাট্য, চিত্রায়ন, শব্দ, সঙ্গীত এবং সবার দারুণ অভিনয়, মানে কুকুর, গরুসহ সবার। ঠিকঠাক লোকেশন, তবে যে খামারকে আন্তনের রুটিরুজির উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং যার আয়-ব্যায়ের উপর তার সব নির্ভর অর্থনৈতিকভাবে, সে খামারের যে আকার এবং ফসলের যে পরিমাণ প্রদর্শিত হয়েছে তা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার,সমালোচক। maangorepublik@gmail.com
দোহাই
‘বেনজীর কি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করতে পারবেন’ | ০৭ জুন ২০২৪
https://www.prothomalo.com/business/economics/d12dy7ayo6
‘আজিজ ও বেনজীর তাহলে কাদের লোক’, সোহরাব হাসান | ০৭ জুন ২০২৪
https://www.prothomalo.com/opinion/column/ph1pg1w8q8
https://www.aljazeera.com/news/2023/11/27/palestine-and-israel-brief-history-maps-and-charts
‘সাহসী’ পোশাক কি আসলে নারীকে সাহসী করে | নিশাত সুলতানা | ০৩ জুলাই ২০২৪
https://www.prothomalo.com/opinion/column/6nikdwzn5d
‘কান থেকে ভাবনার নতুন ছবির খবর, তৈরি হবে তিন ভাষায়’ | ২০ মে ২০২৪
https://www.prothomalo.com/entertainment/dhallywood/w7epthtqrq
‘Ashna Habib Bhabna graces Cannes red carpet’
Bharat Mansata, Vision of Natural Farming, Earthcare Books, Kolkata, 2011.
https://earthcarebooks.com/product/the-vision-of-natural-farming/