বন্য প্রাচ্য: দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক অর্থনীতি

বন্য প্রাচ্য: দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক অর্থনীতি

বারবারা হ্যারিস-হোয়াইট ও লুসিয়া মিশেলুত্তি

লেখাটি Barbara Harriss-White ও Lucia Michelutti সম্পাদিত The Wild East: Criminal Political Economies in South Asia (২০১৯, ইউসিএল প্রেস, লন্ডন) পুস্তকের ভূমিকা থেকে তৈরি করেছেন কল্লোল মোস্তফা

সম্প্রতি চীন ও রাশিয়ায় পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত ও ‘অবাধ’ বিকাশের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘বন্য পাশ্চাত্য’ বা ‘বুনো পশ্চিমের পুঁজিবাদ’  কথাটা তুলনামূলক আলোচনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘বন্য প্রাচ্য’ বা ‘বুনো পূর্ব’ নিয়ে আলোচনায় ঢুকবার আগে চলুন দেখা যাক, বন্য পাশ্চাত্য বা বুনো পশ্চিম সম্পর্কে যে বোঝাপড়া আমাদের আছে তা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দুর্বৃত্ত ও লুটেরা অর্থনীতির ধরনটি বুঝতে কতটা সাহায্য করতে পারে। ফার্নান্ড ব্রাউডেল বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের ব্যাখ্যার জন্য ভালো-মন্দ যা-ই হোক, কোনো একটা মডেল প্রয়োজন, যার সঙ্গে তুলনা করে বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায়।’ (১৯৭৪, xi)

বুনো পশ্চিমের পর্যায়টি তিন শতাব্দীজুড়ে বিস্তৃত যার সমাপ্তি ঘটেছে উনিশ শতকের শেষের অর্ধে এসে। এই পুরো সময়ে উত্তর আমেরিকা বলতে আমরা যে অঞ্চলটিকে জানি, সেটাকে দখল করা সম্পন্ন হয়। বুনো পশ্চিমের ইতিহাসকে দুটো ধরনে ভাগ করা যায়: একদিকে বুর্জোয়া সেটেলার বা বসতি স্থাপনকারীদের ইতিহাস, অন্যদিকে দখল ও আদিম সঞ্চয়নের ইতিহাস।

বুনো পশ্চিমের পর্যায়টি তিন শতাব্দীজুড়ে বিস্তৃত যার সমাপ্তি ঘটেছে উনিশ শতকের শেষের অর্ধে এসে। এই পুরো সময়ে উত্তর আমেরিকা বলতে আমরা যে অঞ্চলটিকে জানি, সেটাকে দখল করা সম্পন্ন হয়। বুনো পশ্চিমের ইতিহাসকে দুটো ধরনে ভাগ করা যায়: একদিকে বুর্জোয়া সেটেলার বা বসতি স্থাপনকারীদের ইতিহাস, অন্যদিকে দখল ও আদিম সঞ্চয়নের ইতিহাস।

প্রথম ধরনের ইতিহাসের বয়ান অনুসারে, বিভিন্ন বিবদমান বিদেশি শক্তি ও দেশীয় ট্রাইবের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি, রাজনৈতিক আপস, সামরিক অভিযান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে অধীনস্থ করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বুনো পশ্চিমের জয় করা হয়। একে একে বিভিন্ন ফার্ম, রেঞ্চ ও শহর গড়ে তোলা হয়, হান্টিং ট্রেইল বা শিকারের রাস্তাগুলো চিহ্নিত করা হয় এবং খনিগুলোকে খনন করা হয়। রেলপথ ও টেলিগ্রাফ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ হয়ে ওঠে, ব্যাবসা-বাণিজ্য উত্তর-দক্ষিণ অক্ষ থেকে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ঘুরে যায় এবং অভিবাসীদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। তাদের নিজেদের বয়ান অনুসারে, বুনো পশ্চিমের সেটলার বা বসতিস্থাপনকারীরা জেফারসনীয় কৃষিভিত্তিক গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বনির্ভরতা-কেন্দ্রিক ধারণা ও আদর্শ গড়ে তোলে। তা ছাড়া উপনিবেশ স্থাপনকারীরা বাজারের বন্য প্রবণতা দিয়েও প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এই সময়টা ছিল অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিকাশের যুগ (Rothbard 2017)। এই পর্যায়ে যেহেতু রাষ্ট্র একরকম অনুপস্থিত ছিল সেহেতু আইনকানুন, সম্পত্তির অধিকার ও সুরক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও বাজারের মাধ্যমে, আইনের শাসনের ধারণার বিস্তার ঘটিয়ে এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও যৌথ শক্তি ক্যাম্প ও ওয়াগন ট্রেইন, খনি শ্রমিক, গবাদি পশুর মালিক ও বসতি স্থাপনকারীদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করেছিল। সেটলার বা বসতিস্থাপনকারীরা অভিবাসনের আগেই যৌথভাবে আইন তৈরি ও শাস্তি নির্ধারণ করে নিত এবং আইন প্রয়োগকারী অফিসারদের মাধ্যমে যাত্রাপথে উদ্ভূত বিরোধের মীমাংস করত। Anderson ও Hill (১৯৭৯) এ বিষয়ে তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিরোধ ছিল ক্ষতিকর, অপরাধ ঘটত কদাচিৎ এবং মারাত্মক শাস্তি দেওয়ার ঘটনাও ছিল ব্যতিক্রম। তারা এই সময়টার নাম দিয়েছেন ‘এনার্কো-ক্যাপিটালিজম’ বা ‘নৈরাজ্যিক-পুঁজিবাদ’। তারা মনে করেন, বন্দুকযুদ্ধের যেসব ঘটনা হলিউডের বিভিন্ন ছবিতে দেখানো হয়, সেগুলোর বেশিরভাগই কল্পনা।

আর দ্বিতীয় ধরনের ইতিহাসের বয়ান কার্ল মার্ক্স যে ঘটনাকে ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ, ক্রীতদাসে পরিণতকরণ এবং খনিতে সমাহিতকরণ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, সেদিকটাই তুলে ধরে। (১৯৬৭, অধ্যায় ৩০, ৭৫১)। (এর সঙ্গে যুক্ত হয় আমেরিকান প্ল্যান্টেশনগুলোতে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা দাসদের বিশাল বহর, যা আমেরিকার দক্ষিণের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি পালটে দিয়েছিল।) স্বাধীনতার ৭৫ বছরের মধ্যেই অস্ত্রধারী সেটলার এবং মিলিশিয়াদের পক্ষে (যাদের একটা বড় অংশ ছিল ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া কৃষক এবং ১৮৪৮ সালে ইউরোপ থেকে আসা উদ্বাস্তু) বিপুল পরিমাণ জমি দখল, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ করে আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে আপ্পালেশিয়ানস ও মিসিসিপির মাঝখানের প্রায় সব আদিবাসী আমেরিকান জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে দেওয়া সম্ভব হয়। মজুরি শ্রমিক হতে অনিচ্ছুক আদিবাসী ‘ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীর এই ধ্বংসসাধনের কারণেই এই পুরো ঘটনাটিকে পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের বদলে অনেকে প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক পাতি বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক বুনো পশ্চিমের ঔপনিবেশিকরণ হিসেবে দেখে থাকেন। কারণ, পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় দুটো পূর্বশর্তের উপস্থিতি প্রয়োজন: সম্পত্তির অধিকার এবং ‘মুক্ত’ মজুরি শ্রমিক। (Baker, 1990) বিপ্লবের পর স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র এমনভাবে গঠিত হয় যেন তা পুঁজি ও ভূমি-কেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে ইউরোপের দিকে চলা ঔপনিবেশিক বাণিজ্য স্রোতের বিপরীতে অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থা গড়ে ওঠে যেখানে জমি কেনাবেচা করা সম্ভবপর হয়। এ সময় পুঁজির সঞ্চয়নের পথে প্রধান বাধা ছিল মুক্ত মজুরি শ্রমিকের সার্বক্ষণিক সংকট। গৃহযুদ্ধের পর আদিম সঞ্চয়নের দ্বিতীয় পূর্বশর্ত: শ্রমশক্তির জোগানের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলতে থাকে। সদ্য অবমুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমশক্তির (যাদের বেশিরভাগই ঋণের কারণে ভূমিতেই আবদ্ধ ছিল) সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপ থেকে উচ্ছেদকৃত অভিবাসী শ্রমিকের দল। এভাবে ১৮৯০ সাল নাগাদ বসতি স্থাপন এবং শিল্প ও নগরগুলোর জন্য শ্রমশক্তির জোগান সম্পন্ন হয়।

দ্বিতীয় ধরনের ইতিহাসের বয়ান কার্ল মার্ক্স যে ঘটনাকে ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ, ক্রীতদাসে পরিণতকরণ এবং খনিতে সমাহিতকরণ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, সেদিকটাই তুলে ধরে।

***

এখন প্রশ্ন হলো- বুনো পশ্চিম দখল সম্পন্ন হওয়ার এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে এসে আমেরিকার ইতিহাসের এই দুই ধরনের সঙ্গে বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্ক কী? আমরা মনে করি, ঠিক কোন কোন ঘটনার ব্যাখ্যা ও তুলনা করতে হবে, তা নির্ধারণে এই দুই ধারার বয়ান কাজে লাগবে। প্রথম ধরনের বয়ান থেকে দেখতে হবে সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব (দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে মাটির উপরের ও মাটির নিচের উভয় ধরনের সম্পদ), পণ্য অর্থনীতি বিকাশের ধরন, মাত্রা ও ব্যবহৃত প্রযুক্তি, পুঁজি ও কারুশিল্পের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অবকাঠামো ও বাণিজ্যের ভূমিকা, প্রথমে বেসরকারি আইনকানুন তৈরিতে ও পরবর্তী সময়ে সরকারি আইন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রতিযোগিতা। আর দ্বিতীয় ধরনের বয়ান থেকে জবরদস্তির মাধ্যমে এলাকা দখল, উৎপাদনের ধরনের পরিবর্তন, ভূমি ও জনগণের ওপর ব্যক্তিগত সম্পত্তির আইন বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র ও শ্রেণি গঠনে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনের ধরনের ভূমিকা (আমেরিকার ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর সামাজিক আয়োজন বনাম সেটলার বনাম দাসনির্ভর প্ল্যান্টেশন); ব্যাপক জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ ও দাসত্বের প্রেক্ষাপটে মজুরি শ্রমবাজারের বিকাশ। আর উভয় বয়ানের ক্ষেত্রে- আঞ্চলিক রাজনীতি ও সংস্কৃতি, সাক্ষ্য-প্রমাণ, ব্যাখ্যা ও মিথের ভূমিকা।

দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বৃত্ত অর্থনীতিতে এই সব প্রক্রিয়াই উপস্থিত। তবে বুনো পশ্চিমের ক্ষেত্রে দখলকৃত এলাকার সম্প্রসারণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বুনো পূর্বের ক্ষেত্রে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ হলো কাঁচামাল ও জ্বালানি সম্পদ আহরণ, বিনিয়োগ ও পণ্য উৎপাদন। বুনো পশ্চিমের ঔপনিবেশিকরণের ফলে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্বৃত্ত শোষণমূলক কার্যক্রমের কারণে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় (PricewaterhouseCoopers, ২০১৬)। যেসব এলাকায় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে, সেখানকার প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে (Prakash, Rockmore এবং Uppal, ২০১৬)। বেশ কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নির্বাচনি গণতন্ত্র ও কার্যকর রাষ্ট্র থাকা অবস্থায় বুনো পূর্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে, বুনো পশ্চিমের ক্ষেত্রে যা ছিল না। বুনো পূর্বের ক্ষেত্রে আইনকানুনের কোনো কমতি নেই, ঘাটতি যা আছে তা হলো তার যথাযথ প্রয়োগের সক্ষমতার। বুনো পশ্চিমে বেসরকারি বা সামাজিক আইন থেকে রাষ্ট্রীয় আইন তৈরি হয়েছিল আর বুনো পূর্বে রাষ্ট্রীয় আইনের জায়গা দখল করছে বেসরকারি স্বার্থ ও দুর্বৃত্ত কার্যক্রম থেকে উৎসারিত কর্তৃত্ব। বুনো পশ্চিমে অপরাধের আওতা তত বিস্তৃত ছিল না (যেমন: গরু চুরি, মাঝে মাঝে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার দখল ইত্যাদি); কিন্তু বুনো পূর্বে সব ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে (PricewaterhouseCoopers, ২০১৬)। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের করপোরেট সেক্টরের বড় বড় অপরাধের যেমন ইতিহাস রয়েছে (পুঁজি পাচার, কর ফাঁকি, মুদ্রা কারসাজি), তেমনি তুলনামূলক ছোট অপরাধেরও নজির রয়েছে (কেনাকাটা ও আর্থিক জালিয়াতি, সম্পত্তি চুরি) (Anderson ও Hill ১৯৭৯; Kar ২০১০; PricewaterhouseCoopers, ২০১৬)।

বুনো পশ্চিমের ক্ষেত্রে দখলকৃত এলাকার সম্প্রসারণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বুনো পূর্বের ক্ষেত্রে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ হলো কাঁচামাল ও জ্বালানি সম্পদ আহরণ, বিনিয়োগ ও পণ্য উৎপাদন।

যেখানে বুনো পশ্চিমকে বলা হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্মনির্ভরশীলতার ওপর গঠিত, বুনো পূর্বের পুঁজি গড়ে ওঠার জন্য জরুরি হলো সন্ত্রাস, অপরাধ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, আমলাতন্ত্র, পাবলিক সেক্টরের ম্যানেজার, পুলিশ, রাজনীতিবিদদের ভূমিকা। এখানে নির্বাচনি গণতন্ত্রের সঙ্গে কালোটাকা মিলেমিশে একাকার। নতুন নতুন অপরাধী সংগঠন রাজনৈতিক প্রচারণায় বৈধ-অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করে এবং এর মাধ্যমে অপরাধী রাজনৈতিক অর্থনীতির জন্ম ও বিকাশ ঘটায়। অপরাধী রাজনীতিবিদরা নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে দায়মুক্তি পায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের এবং তাদের পোষ্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। অবশ্য এ ধরনের কাঠামোগত পার্থক্য থাকার পরও বুনো পূর্ব, বুনো পশ্চিমের মতোই মুনাফা এবং ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তোলার তাড়না দিয়ে পরিচালিত হয়, এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক রূপান্তরের জন্ম দেয় এবং পরিবেশের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অনেক অঞ্চলেই আমরা দেখি স্থানীয় আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব সম্পদ, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছেড়ে অভিবাসী শ্রমজীবী হতে বাধ্য করা হয়। আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীর মতোই আদিবাসী ভারতীয় ও দলিতরা ‘প্রবৃদ্ধির তলায় চাপা পড়েন’: তারা প্রান্তিকীকরণ, ক্ষুধা, অপরাধমূলক শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হন। (Shah ও অন্যান্য, ২০১৭) বুনো পশ্চিমের সোনার বদলে বুনো পূর্বে রয়েছে বাতাস (স্পেকট্রাম), আর্থিক খাত, ভূমি, বালি, কয়লা, গ্রানাইট, পাথর, তেল, পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ও জৈব সম্পদ যেমন: চন্দন, মাংস, নির্মাণ খাত, রাসায়নিক, মাদক, জুয়া ও চলচ্চিত্র। পুঁজির সঞ্চয়ন, শ্রমশক্তি, পুলিশ, আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক দলের মধ্যকার পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমেই অপরাধের রাজনীতিকরণ এবং রাজনীতির অপরাধীকরণ উৎসাহিত হয়, যার মধ্য দিয়ে মাফিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সংগঠিত অপরাধী চক্রের বিকাশ ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অনেক অঞ্চলেই আমরা দেখি স্থানীয় আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব সম্পদ, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছেড়ে অভিবাসী শ্রমজীবী হতে বাধ্য করা হয়। আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীর মতোই আদিবাসী ভারতীয় ও দলিতরা ‘প্রবৃদ্ধির তলায় চাপা পড়েন’: তারা প্রান্তিকীকরণ, ক্ষুধা, অপরাধমূলক শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হন।

বুনো পূর্বের মাফিয়া

‌‘মাফিয়া’ অভিধা ও এর অর্থ নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। একটা প্রভাবশালী প্রবণতা হলো মাফিয়া বিষয়টিকে স্রেফ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা, যেমন: ‘এন্টারপ্রাইজ সিন্ডিকেট’ (Blok ১৯৭৪), ‘মাফিয়া এন্টারপ্রাইজ’ (Arlacci ১৯৯৩), ‘প্রোটেকশন ইন্ডাস্ট্রি’ (Gambetta ১৯৮৮, ১৯৯৩; Varese ২০০১) ইত্যাদি। অন্যদিকে Tilly (১৯৮৫) মাফিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরে সংগঠিত অপরাধকে যুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে তুলনা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। (আরও দেখুন: Volkov ২০০২ ও Varese ২০১১)। আর এই ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে Armao (২০০০) বলেছেন, অন্য যে কোনো সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে মাফিয়ার পার্থক্য হলো, মাফিয়ারা তাদের মুনাফার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বিচারব্যবস্থাকে কাজে লাগায়। Armao (২০১৫, ৩)-এর বক্তব্য অনুসারে, যখন কাঠামোবদ্ধ ও স্থায়ী কোনো একটি দল, যারা সন্ত্রাসী ও অপরাধী কার্যক্রমের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে, তারা যখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন ‘মাফিয়া’ নামের তৃতীয় একটি পদ্ধতির জন্ম হয়। আমরা এখানে মাফিয়া বলতে এই ধারণাটিই বুঝিয়েছি। বুনো পূর্বে মাফিয়া গোষ্ঠীর জন্ম এই কারণে হয়নি যে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষগুলো মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। (সিসিলির Cosa Nostra বা ক্যালাব্রিয়ার Ndrangheta-এর ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে); দক্ষিণ এশিয়ার মাফিয়া গোষ্ঠীগুলো আধা-রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে না; বরং রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে। Paoli (২০০৩; ২০১৪) মাফিয়া গোষ্ঠীকে এমন একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে দেখিয়েছেন, যারা পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠেনি। অথচ বুনো পূর্বের মাফিয়াদের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই সমাজ ও রাজনীতিতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি অনেক গভীর।

যখন কাঠামোবদ্ধ ও স্থায়ী কোনো একটি দল, যারা সন্ত্রাসী ও অপরাধী কার্যক্রমের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে, তারা যখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন ‘মাফিয়া’ নামের তৃতীয় একটি পদ্ধতির জন্ম হয়। আমরা এখানে মাফিয়া বলতে এই ধারণাটিই বুঝিয়েছি।

এ ধরনের জটিল বহুমাত্রিক বাস্তবতার কারণে সামাজিক এবং আইনগতভাবে মাফিয়াদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ–যারা মাফিয়াদের সঙ্গে ওঠবস করেন–তাদের থেকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এই বিষয়টি সারা দুনিয়াতেই ঘটতে দেখা যায়, কিন্তু এ বিষয়ে গবেষণা ও তাত্ত্বিক কাজ খুব কমই হয়েছে। সম্প্রতি Schneider (২০১৮) and Ben-Yehoyada (২০১৮) দেখিয়েছেন, সিসিলির কোসা নোস্ত্রাকে আইনগতভাবে সুসংহত, হায়ারার্কিক্যাল বা উঁচু-নিচু ক্রমবিভাজনসম্পন্ন ও ভাতৃত্বভিত্তিক একটি সংগঠন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। আর এ ধরনের সংজ্ঞায়নের কারণে শুধু যে তাদের অ-মাফিয়া সহযোগীদের বিচার করতেই সমস্যা হয় তা নয়, জনগণের কাছে রাজনীতির সঙ্গে মাফিয়াদের সম্পর্কও আড়ালে থেকে যায়। (পূর্বোক্ত: ৩৬০)। ‘অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী’ ও ‘বহিরাগত এজেন্ট’–এ ধরনের পার্থক্য করাও সমস্যাজনক। কারণ, বাস্তবে এই গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের জটিলতার কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় মাফিয়া বলতে বোঝানো হয় রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট এমন কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, যারা বেআইনিভাবে ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোনো বিশেষ ব্যাবসা, সেক্টর ও অঞ্চলের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে, যেমন: এলকোহল মাফিয়া, পানি মাফিয়া, তেল মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, জমি দখলের কাজে নিয়োজিত ভূমি-মাফিয়া ইত্যাদি। এই সিন্ডিকেটগুলো তাদের খদ্দের ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রক্ষার জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ, বিচারব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বা একসঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে। (Michelutti et al. ২০১৮, ৫; Martin ও Michelutti ২০১৭)।

দক্ষিণ এশিয়ায় মাফিয়া বলতে বোঝানো হয় রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট এমন কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, যারা বেআইনিভাবে ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোনো বিশেষ ব্যাবসা, সেক্টর ও অঞ্চলের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে, যেমন: এলকোহল মাফিয়া, পানি মাফিয়া, তেল মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, জমি দখলের কাজে নিয়োজিত ভূমি-মাফিয়া ইত্যাদি।

দক্ষিণ এশিয়ার মাফিয়ারা বিভিন্ন মাত্রায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। লোকে ছোট মাফিয়া ও বড় মাফিয়া ইত্যাদির কথা বলে। স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ যেমন: কোম্পানি, লবি, ফার্ম, পরিবার, সিন্ডিকেট, গ্রুপ, রিং ইত্যাদির মাধ্যমে কোনো নিরাপত্তা প্রদানকারী চক্র থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী লবি বা ইন্টারেস্ট গ্রুপ কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কাজ করা একদল উচ্চাভিলাষী অপরাধী অনেক কিছুই বোঝায়। এই মাফিয়ারা সিসিলির মাফিয়াদের মতো কাঠামোবদ্ধ ও হায়ারার্কিক্যাল বা উঁচু-নিচু ক্রমে বিভাজিত নয়, যদিও শক্তিশালী পরিবারতন্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। এরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ধারণা ও বর্ণভেদ প্রথাকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগায়, যদিও এগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বিভিন্ন কোম্পানি ও গ্রুপগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ও সুসংহত অপরাধী সংগঠনের হয়ে কাজ করে ব্যাপারটা এ রকম নয়; বরং এরা সবাই মিলে একটা অপরাধী অর্থনীতির অংশ। গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যবেক্ষণ হলো, অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যাবসা-বাণিজ্য, অপরাধী মুনাফাবাজি কর্মকাণ্ড ও অপরাধী সংগঠনের মধ্যে নানান মিল ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। এখানে ‘কোনো রকমে দিন পার করা’র জন্যও অনেক সময় সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হয় (Pine ২০১২; আরও দেখুন: Hoque ও Michelutti, ২০১৮)।

তথ্যসূত্র

Anderson, T. and P. Hill. 1979. ‘The American Experiment in Anarcho-Capitalism: The Not So Wild,Wild West’, Journal of Libertarian Studies 3(1): 9–29.

Arlacci, P. 1993. Men of Dishonor. Inside the Sicilian Mafia. New York: William Morrow.

Armao, F. 2000. Il sistema Mafia. Dall’economia-mondo al dominio locale. Torino: Bollati Boringhieri.

Armao, F. 2015. ‘Mafia-owned-democracies. Italy and Mexico as Patterns of Criminal Neoliberalism’, Revista de Historia Actual, 1: 4–21.

Baker, E. 1990. ‘The Primitive Accumulation of Capital in the United States’, Iskra 1(1): 1–14.

Ben-Yehoyada, N. 2018. ‘Where Do We Go When We Follow the Money? The Political-economic Construction of Antimafia Investigators in Western Sicily’, History and Anthropology 29(3):359–75.

Blok, A. 1974. The Mafia of a Sicilian Village, 1860–1960: A Study of Violent Peasant Entrepreneurs.New York: Harper & Row.

Braudel, F. 1974. Capitalism and Material Life, 1400–1800. London: Harper and Row.

Gambetta, D. 1988. ‘Mafia: The Price of Distrust’, in Trust: Making and Breaking Cooperative Relations, edited by D. Gambetta, 158–75. Oxford: Basil Blackwell.

Gambetta, D. 1993. The Sicilian Mafia: The Business of Private Protection. Cambridge, MA: Harvard University Press.

Hoque, A. and L. Michelutti. 2018. ‘Brushing with Organized Crime and Democracy: The Art of Making Do in South Asia’, Journal of Asian Studies 77(4): 991–1011. doi:10.1017/

S0021911818000955.

Kar, D. 2010. The Drivers and Dynamics of Illicit Financial Flows from India: 1948–2008. Washington, DC: Global Financial Integrity.

Martin, N. and L. Michelutti. 2017. ‘Protection Rackets and Party Machines. “Mafia Raj” Across Western Uttar Pradesh and Punjab’, Asian Journal of Social Science, 45(6). Doi: https://doi.org/10.1163/15685314-04506005.

Marx, K. 1967. Capital, Volume One. New York: International Publishers Co.

Michelutti, L., A. Hoque, N. Martin, D. Picherit, P. Rollier, A. Ruud and C. Still. 2018. Mafia Raj: The Rule of Bosses in South Asia. Stanford, CA: Stanford University Press.

Paoli, P. 2003. Mafia Brotherhoods: Organized Crime, Italian Style. Oxford: Oxford University Press.

Paoli, P. 2014. The Oxford Handbook of Organized Crime. Oxford: Oxford University Press.

Pine, J. 2012. The Art of Making Do in Naples. Minneapolis, MN: University of Minnesota Press.

Prakash, N., M. Rockmore and Y. Uppal. 2016. ‘Do Criminally Accused Politicians Affect Economic Outcomes? Evidence from India, Connecticut’. http://web2.uconn.edu/economics/working/2018-08.pdf (accessed 28 April 2019).

PricewaterhouseCoopers. 2016. Global Economic Crime Survey. https://www.pwc.com/gx/en/economic-crime-survey/pdf/GlobalEconomicCrimeSurvey2016.pdf (accessed 30 April 2019).

Rothbard, M. 2017. The Progressive Era. Auburn, AL: Mises Institute.

Shah, A., J. Lerche, R. Axelby, D. Benbabaali, B. Donegan, J. Raj and V. Thakur. 2017. Ground Down by Growth: Tribe, Caste, Class and Inequality in 21st Century India. London: Pluto Press.

Schneider, J. 2018. ‘Fifty Years of Mafia Corruption and Anti-mafia Reform’, Current Anthropology 59(S18): S16–S27.

Tilly, C. 1985. ‘War Making and State Making as Organised Crime’, in Bringing the State Back, edited by P. Evans, D. Rueschemeyer and T. Skocpol, 169–91. Cambridge: Cambridge University Press.

Varese, F. 2001. The Russian Mafia: Private Protection in a New Market Economy. Oxford: Oxford University Press.

Varese, F. 2011. Organized Crime. Critical Concepts in Criminology. Vol. 1. London: Routledge.

Volkov, V. 2002. Violent Entrepreneurs: The Use of Force in the Making of Russian Capitalism. Ithaca, NY: Cornell University Press.

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •