মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৬
জায়নবাদ, প্রথম তেল যুদ্ধ, প্রতিরোধ
তারিক আলি
ষাট দশকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বি-উপনিবেশীকরণের একটি নয়া ধারার সূচনা হয়। সংঘাতের কারণে পুরোনো সাম্রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল৷ জার্মান সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটলেও তা কিন্তু ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মাধ্যমে তা হয়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরোধ যার সাক্ষী কুর্স্ক এবং স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধ, তা নাৎসি জার্মানির সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, আর নৌবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তাও নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যদিও তখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্জিত প্রতিপত্তি এবং সামরিক শক্তি তার জন্য উদ্বেগের ব্যাপার ছিল। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন ইউরোপকে ভাগ করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে পরিণত করতে সম্মত হলো। জার্মানি ভাগ হয়ে স্ট্যালিন পেল পূর্ব ইউরোপ। এর বিনিময়ে তাকে ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রিসে কমিউনিস্ট প্রতিরোধকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হলো এবং এই তিন দেশ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যের অধীন চলে গেল। বাকি বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে এশিয়ার জন্য কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের দখল নিয়ে পারমাণবিকীকরণ করল। তবে এশিয়ার অন্যান্য জায়গায় বিদ্রোহ চলছিল।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপ্লবের ভয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে জোর দিল যাতে তারা দ্রুত বি-উপনিবেশায়ণ করে। ব্রিটেন ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। জাপানের পরাজয়ের ফলে ইন্দো-চীন, মালয় ও ইন্দোনেশিয়ায় নতুন করে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠে। চীনের মূল ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট বাহিনী জাতীয়তাবাদীদের একের পর এক পরাজিত করতে থাকে এবং ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং বেইজিং দখল করে গণপ্রজাতন্ত্র গঠনের ঘোষণা দেন।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে আদেশি (ম্যান্ডেট) ব্রিটিশ শাসনের বিলুপ্ত করে জাতিসংঘ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনে সম্মতি দেয়। এ ঘটনা অনেক জায়গায় তেমন প্রভাব ফেলেনি। যেমন, সদ্য স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া তাদের নিজেদের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিল। ইরান উদাসীন ছিল। কিন্তু আরব বিশ্বের পক্ষে এ ঘটনা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখা অসম্ভব ছিল। ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিবাদী (জায়োনিস্ট) বসতি স্থাপনকারীদের ফিলিস্তিন দখল তাদের সবাইকে প্রভাবিত করেছিল। একজন মিশরীয়, ইরাকি, সৌদি, সিরিয়ানরা একজন ফিলিস্তিনি আরবের মতো সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সবাই কিছু একটা হারিয়েছে–এ রকমটা অনুভব করছিল। এতে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের এতদিন পর্যন্ত এক করে রাখা আরব সংস্কৃতিতে ভাঙন দেখা দিল এবং এই বিভক্তির বিস্ফোরণ এমনভাবে ঘটল যা সামগ্রিক অর্থে একটা বিপর্যয় নিয়ে এলো, আরবিতে যার পরিচিতি ‘আল-নাকবা’ হিসেবে। জায়নবাদীদের এই বিজয় আরব আধুনিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। এতে ইতিহাসে আরব পরিচয়ের ধারাবাহিকতা চিরতরে কি অবলুপ্ত হয়ে গেল– কিছু লেখক এই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিবাদী (জায়োনিস্ট) বসতি স্থাপনকারীদের ফিলিস্তিন দখল তাদের সবাইকে প্রভাবিত করেছিল। একজন মিশরীয়, ইরাকি, সৌদি, সিরিয়ানরা একজন ফিলিস্তিনি আরবের মতো সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সবাই কিছু একটা হারিয়েছে–এ রকমটা অনুভব করছিল। এতে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের এতদিন পর্যন্ত এক করে রাখা আরব সংস্কৃতিতে ভাঙন দেখা দিল এবং এই বিভক্তির বিস্ফোরণ এমনভাবে ঘটল যা সামগ্রিক অর্থে একটা বিপর্যয় নিয়ে এলো, আরবিতে যার পরিচিতি ‘আল-নাকবা’ হিসেবে।
ইউরোপে বাম ও উদারপন্থি সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরা ভারতের স্বাধীনতা এবং চীনের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলের প্রশ্নে তাদের মধ্যে ব্যাপক তিক্ততা ও মতানৈক্য দেখা দেয়। বোধগম্যভাবে, ইহুদি জাতির আবাসভূমি তৈরির দাবির প্রতি অনেকের সমর্থনের মূল কারণ ছিল জুডিওসাইড বা ইহুদি-জাতিগত হত্যাযজ্ঞ। তবে নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্ট্যালিনের সমর্থন ও অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত দ্বারা ইউরোপ এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো প্রভাবিত হয়েছিল। এর পেছনে যুক্তি ছিল, সমাজতান্ত্রিক ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ বিরাজমান শাসনব্যবস্থার সামাজিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে প্রগতিশীল মূল্যবোধের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে। এই রাষ্ট্রের ধারণাটি কীভাবে এলো এবং কীভাবে এর উদ্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলে থাকলেও সংখ্যায় তারা খুবই কম ছিল। আরব বিশ্বের বাইরে এবং এমনকি সেই বিশ্বের মধ্যেও কারো কারো জন্য ফিলিস্তিনিরা হয়ে ওঠে ইতিহাসের পরিত্যক্ত সন্তান।
পাকিস্তানের নতুন মুসলিম রাষ্ট্রটি পশ্চিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। সে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি এর নেতারা এবং বেশিরভাগ গণমাধ্যম খুব কমই ফিলিস্তিন বা সেখান থেকে বিতাড়িত জনগণের কথা উল্লেখ করেছে। অজ্ঞতা আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করেছে। তবে ১৯৫৬ সাল সবকিছুতে পরিবর্তন নিয়ে আসে। মিশরে ইংরেজ-ফরাসি-ইসরায়েলের যৌথ আক্রমণ আমাদেরকে জাগিয়ে তুলেছিল। পাকিস্তান সরকার পশ্চিমাদের সমর্থন করছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল এবং আমার স্কুলসহ অন্য অনেক স্কুলের মধ্য দিয়ে তারা মিছিল নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের স্কুল পরিচালনাকারী আইরিশ ভাইয়েরা স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে রাজি হয় এবং তাঁদের শিক্ষার্থীদের লাহোরের রাস্তায় গণবিক্ষোভে যোগদানের অনুমতি দেয়। আমরা আমাদের পশ্চিমাদের দালাল সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলি। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় মিশরীয় নেতা গামাল আবদেল নাসের আমাদের নায়ক বনে যান। তিনি ব্রিটেনকে বলেছিলেন, তিনি সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করতে বদ্ধপরিকর। তিনি আরও সতর্ক করেন, সুয়েজ খালের সাবেক মালিকরা যদি এটা না করে, তাহলে তারা নিজেদের ক্রোধে শ্বাসরুদ্ধ হবে। কিন্তু উল্টো তারাই নাসেরের শ্বাসরোধের চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। তবে ওয়াশিংটন মূলত নাসেরকে ব্রিটেনের একতরফা প্রতিরোধের চেষ্টায় আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে সরে গিয়েছিল। নাসের বেঁচে যান এবং আমরা স্কুলে ফিরে যাই। এই প্রথম আমি ইসরায়েল সম্পর্কে চিন্তা করি। সংবাদপত্রগুলো এই পরিস্থিতি পশ্চিমা সৃষ্টি বলে নিন্দা করেছিল এবং আরব বিশ্বের হৃদয়ে এই একটি ছুরি স্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে আমার চিন্তা সেখানেই থেমে গিয়েছিল।
ষাটের দশকে যখন আমি ব্রিটেনে আসি তখনই আমি ১৯৪৮-এ ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের মাত্রা বুঝতে শুরু করি। আমাকে শিক্ষার অধিকাংশ উৎস ছিল সোশ্যালিস্ট, মার্ক্সবাদী, ইহুদি বংশোদ্ভূত নৈরাজ্যবাদী-স্বাধীনতাবাদী ব্যক্তিত্ব। ইয়াগায়েল গ্লাক্সটেইনের (যিনি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করতেন এবং টনি ক্লিফের নামে লিখেছিলেন) সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। তিনি নিজেকে একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। নতুন রাষ্ট্রের কাঠামোর প্রতিটি স্তরে আরব-বিরোধিতা এবং বৈষম্যকে সহ্য করতে না পেরে তিনি ইসরায়েল ত্যাগ করেছিলেন। আরববিরোধী বর্ণবাদকে সহযোগিতা ও ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তিনি, বিশেষ করে জায়নবাদী শ্রমিক আন্দোলনের নিন্দা করেছিলেন। ‘আপনি জানেন কেন পশ্চিমের ইসরায়েল দরকার?’ তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, এবং জবাবে ‘তেল’ বলার ওপর জোর দিতেন। ‘তেল, তেল, তেল,’ তুমি কি বুঝতে পেরেছো?’ আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সংজ্ঞা, পুনরাবৃত্তি, স্পষ্টতার ব্যবহারে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিশ্লেষিত হয়েছিল।
আকিভা অর ১৯৩১ সালে বার্লিনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং যুদ্ধে কঠোর অভিজ্ঞ সেই সৈনিকের চেহারা কখনো বদলায়নি। তিনি আমাদের পাশে থাকায় আমি খুশি হয়েছিলাম। বহু আগে ইসরায়েলের প্রতি তার দেশপ্রেম চলে গিয়েছিল। কিন্তু তাদেরই একজন হওয়ার সুবাদে তিনি ভেতরের অনেক খবর জানতেন। তিনি বহু বছর ধরে ব্রিটেনে বসবাস করে ১৯৯০ সালে ইসরায়েলে ফিরে আসেন। জেরুজালেমের কাছে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি বন্ধুর সঙ্গে তিনি বাস করতেন। আমরা মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতাম এবং একে অপরকে ই-মেইল দিতাম। আকিভার রাগ আরও তীব্র হচ্ছিল। তিনি উপজাতীয় মনোভাবাপন্ন এবং বর্জনবাদী জন্ডিসযুক্ত চোখের মুখোশধারী বাম জায়নবাদীদের ভালো করেই জানেন। তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তাদের ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তীব্র আবেগ এবং ইসরায়েলের ইতিহাসে ব্যাপক জ্ঞানী আকিভাকে বাম জায়নবাদীরা একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করছিল।
জাবরা নিকোলা ছিলেন খ্রিষ্টান বংশোদ্ভূত একজন ফিলিস্তিনি। তিনি হাইতায় থাকতেন। কিন্তু জীবনের শেষ বছরগুলো নির্বাসনে কাটিয়েছেন। তিনি একটি দ্বিজাতিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে সকল নাগরিকের একই রকম অধিকার থাকবে এবং যে রাষ্ট্র একদিন আরব সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ফেডারেশনের অংশ হবে। এই অবস্থান থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। সময় এবং সুযোগের অপেক্ষা করা ছাড়া মধ্যবর্তী আর কোনো সমাধান ছিল না। জাতীয়তাবাদ একটি সমস্যা, কোনো সমাধান নয়। ইহুদি জাতীয়তাবাদ ফিলিস্তিনের কী ক্ষতি করেছে তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না? এবং উত্তর ছিল শোষণের জবাবে জাতীয়তাবাদ ব্যবহার না করে বরং সেটাকে সম্মিলিতভাবে অতিক্রম করা উচিত। জাবরার বক্তব্য দুর্দান্ত এবং ইউটোপিয়ান মনে হয়েছে। আমি সহজেই আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
আমি ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করেছি। জাবরার ছেলে ফোন করে জানালো তার বাবা আমাকে জরুরি দেখতে চান। আমি যখন পশ্চিম লন্ডনের হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি একটি জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে মারা যাচ্ছেন। তাকে ঘিরে সহরোগীরা টিভি দেখছে। যেহেতু তাদের বেশিরভাগই আংশিকভাবে বধির ছিল, তাই তাদের সঙ্গে কথোপকথন হওয়া কঠিন ছিল। জাবরা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। তার শক্তি আমাকে চমকে দিল। ‘আমি মরতে চাই,’ তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন। ‘আর কিছু করতে পারব না।’ এবং তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে বিশ্বের প্রতি তার অবজ্ঞা ইঙ্গিত করলেন। কে তাকে দোষ দিতে পারে? এই হাসপাতালে থাকা তার খুব অপছন্দ ছিল। আমি তার পরিত্যাগ করা কমলা বাগান, নীল আকাশ এবং ভূমধ্যসাগরের কথা ভাবছিলাম। তিনিও নিশ্চয়ই একই কথা ভাবছিলেন। আমি তার হাত শক্ত করে ধরে বলেছিলাম, এখনো তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। একটি নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে হবে যেভাবে তিনি একসময় আমাদের প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তিনি রাগে মাথা নাড়লেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। আমার মনে হয়, তিনি বেঁচে থাকবেন বলে যে মন্তব্য করেছিলাম তা তিনি আমার অভিনয় হিসেবে নিয়েছিলেন। আর তাই আমার প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। আমরা তাকে লন্ডনের কবরস্থানে দাফন করেছি। বাড়ি থেকে অনেক দূরে আরেকজন ফিলিস্তিনির সমাধি তৈরি হলো।
তাদের সকলেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন গল্প বলেছিলেন, তবে প্রতিটি গল্পের মৌলিক বিবরণ কোথাও-না-কোথাও এক সূত্রে গাঁথা ছিল। জায়নবাদ – একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি জাতীয়তাবাদ – ছিল নাস্তিক ইহুদিদের সৃষ্টি। কেননা, এরা মনে করেছিল ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ তাদের সেই সমাজে একীভূত হওয়াকে অসম্ভব করে তুলেছিল। তারা বুঝেছিল, ইহুদিরা শুধু একটি সংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে কোথাও একীভূত হতে পারে এবং সে জন্য তাদের নিজস্ব একটি জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা উচিত। থিওডর হার্জল (১৮৬০-১৯০৪) জায়নবাদ নামে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি নতুন রাষ্ট্র কোথায় স্থাপন করা উচিত, সে ব্যাপারে খোলা মনের ছিলেন। ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য আর্জেন্টিনা, মরিশাস, উগান্ডা বা অন্য কোনো রাষ্ট্র বিবেচনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি চরমপন্থি অনুসারীরা ভিন্নমত পোষণ করেছিল। তারা জোর দিয়েছিল যে, একটি ইহুদি রাষ্ট্র শুধু ওল্ড টেস্টামেন্টের জায়নে (জেরুজালেম বা ল্যান্ড অব প্যালেস্টাইনের হিব্রু নাম) প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত: এভাবেই এই মতবাদের নাম হয়ে ওঠে জায়নবাদ। বাইবেলের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এর অর্থ দাঁড়ায়, প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত এলাকা তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আরবদের বসবাস। হারজলই চরমপন্থিদের পৌরাণিক দাবি মেনে নেয়। এরপর ইউরোপে বসবাসরত সংখ্যালঘু ইহুদিদের মধ্য থেকে অল্প সংখ্যক ইহুদিবাদী ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় সব প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন করে ইহুদি অভিবাসীদের প্রলুব্ধ করার জন্য নানা অসত্য প্রচারণা শুরু করে। তাদের রূপকথায় ফিলিস্তিনকে একটি জনশূন্য এলাকা হিসেবে প্রচার করা হয়।
থিওডর হার্জল (১৮৬০-১৯০৪) জায়নবাদ নামে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি নতুন রাষ্ট্র কোথায় স্থাপন করা উচিত, সে ব্যাপারে খোলা মনের ছিলেন। ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য আর্জেন্টিনা, মরিশাস, উগান্ডা বা অন্য কোনো রাষ্ট্র বিবেচনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি চরমপন্থি অনুসারীরা ভিন্নমত পোষণ করেছিল। তারা জোর দিয়েছিল যে, একটি ইহুদি রাষ্ট্র শুধু ওল্ড টেস্টামেন্টের জায়নে (জেরুজালেম বা ল্যান্ড অব প্যালেস্টাইনের হিব্রু নাম) প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত: এভাবেই এই মতবাদের নাম হয়ে ওঠে জায়নবাদ।
এই ইহুদিবাদী প্রকল্পের জন্মের কয়েক বছর আগে অটোমান সুলতানের অনুমতি নিয়ে ফ্রাঙ্কো-ইহুদি ব্যারন এডমন্ড ডি রথসচাইল্ড ফিলিস্তিনে কিছু ইহুদি বসতি স্থাপনে অর্থায়ন করেন। ১৮৯১ সালে হার্জলের ইহুদিবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠার ছয় বছর আগে, রথসচাইল্ডের অর্থায়নে স্থাপিত বসতিগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সফর করার পর ইহুদি চিন্তাবিদ আশের গিঞ্জবার্গ (১৮৫৬-১৯২৭) ‘ট্রুথ ফ্রম প্যালেস্টাইন’ নামের এক বিখ্যাত লেখা লেখেন। এতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ইহুদি রাষ্ট্র বন্দোবস্তের ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কেবল সংঘাতের জন্ম দেবে। ইউরোপের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আরবদের ব্যাপারে প্রচারিত অমার্জিত এবং গৎবাঁধা বর্ণবাদী বিবরণের বিরুদ্ধে তিনি সতর্ক করেছিলেন। নিবন্ধটির প্রকৃত গুরুত্ব এই যে, এটা জায়নবাদের মৌলবাদী জনশ্রুতি প্যালেস্টাইন ‘মানুষবিহীন একটি ভূমি’, তা ধ্বংস করার মধ্যে নিহিত। ‘ভূমিহীন মানুষ’ ইহুদিদের জন্য এই জনশ্রুতির প্রচার পরিকল্পিত। গিঞ্জবার্গের ভাষায়:
বিদেশের আমরা বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত যে, ফিলিস্তিন এখন সম্পূর্ণ নির্জন, গাছপালাবিহীন একটি মরুভূমি এবং যে কেউ সেখানে তার ইচ্ছেমতো জমি কিনতে পারে। এটা সঠিক নয়। সমগ্র এলাকা জুড়ে চাষযোগ্য জমি খালি নাই। আছে শুধু বালুকাময় এলাকা বা পাথুরে পাহাড় যা শুধু গাছ লাগানোর জন্য উপযোগী সে রকম জমি এবং এটি অনেক পরিশ্রম এবং প্রচুর খরচের পরও চাষ করা হয় না। কারণ, আরবরা দূরভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য বর্তমানে কঠোর পরিশ্রম করতে রাজি নয়। তাই প্রতিদিন কেউ বিক্রিযোগ্য ভালো জমি খুঁজে পায় না। কৃষক বা বড় জমিদার কেউই সহজে ভালো এবং দাগহীন জমি বিক্রি করতে চায় না… বিদেশে থেকে আমরা ভাবতে অভ্যস্ত যে আরবরা মরুভূমির বর্বর, পশুর মতো অজ্ঞ, যারা তাদের চারপাশে কী ঘটছে তা দেখে না বা বোঝে না। এটি মারাত্মক একটি ভুল ধারণা। আরবরা, সমস্ত ইহুদির মতো খুব ধূর্ত এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন।
আরবরা, বিশেষ করে যারা শহরে বাস করে, তারা ফিলিস্তিনে আমাদের আদ্যোপান্ত কার্যকলাপ বোঝে। তবে তারা না জানার ভান করে। কারণ, আমরা যা করি তাতে তারা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি অনুভব করে না এবং তারা আমাদেরকেও ঠকাতে চেষ্টা করে… যখন একটি ইহুদি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন কৃষকরা আনন্দিত হয়। কারণ, তারা সেখানে তাদের শ্রমের জন্য ভালো মজুরি পায় এবং প্রতিবছর তাদের আর্থিক অবস্থা সমৃদ্ধ হয়। বড় জমির মালিকরাও খুশি। কারণ, আমরা বালুকাময় ও পাথুরে মাটির জন্য এমন উচ্চমূল্য দিতে পারি যা তারা অতীতে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। যাইহোক, এমন এক সময় আসতে পারে যখন ফিলিস্তিনে আমাদের জনগণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের আদিবাসী জনসংখ্যাকে বের করে দিতে হবে। সংখ্যায় তা অল্প হোক বা বেশি হোক। তখন কিন্তু তারা সহজে তাদের জায়গা ছেড়ে দেবে না।
১৮৯১ সালে হার্জলের ইহুদিবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠার ছয় বছর আগে, রথসচাইল্ডের অর্থায়নে স্থাপিত বসতিগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সফর করার পর ইহুদি চিন্তাবিদ আশের গিঞ্জবার্গ (১৮৫৬-১৯২৭) ‘ট্রুথ ফ্রম প্যালেস্টাইন’ নামের এক বিখ্যাত লেখা লেখেন। এতে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ইহুদি রাষ্ট্র বন্দোবস্তের ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কেবল সংঘাতের জন্ম দেবে। ইউরোপের ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে আরবদের ব্যাপারে প্রচারিত অমার্জিত এবং গৎবাঁধা বর্ণবাদী বিবরণের বিরুদ্ধে তিনি সতর্ক করেছিলেন।
লেখাটির কোনো একটি জায়গায় গিঞ্জবার্গ ব্যাখ্যা করেছেন শারীরিক শক্তিবলে কল্পিত একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে তা ইহুদি রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। কেননা, অভিবাসিত ইহুদি সম্প্রদায় নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য নির্ভর করেছিল নিজেদের ‘আধ্যাত্মিক শক্তির ওপর। তবে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে তাদের পরিকল্পনা সনাতনী ঔপনিবেশিক আগ্রাসন থেকে ভিন্ন কিছু নয়:
অবশেষে জার্মান বা ফরাসিদের মতো কেবল ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র হোক। এই প্রক্রিয়ার একটি ছোট উদাহরণ ইতোমধ্যে প্যালেস্টাইনে বিদ্যমান। ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে হেরোডের রাজত্বের সময় ইসরায়েল প্রকৃতপক্ষে ‘ইহুদিদের রাষ্ট্র’ ছিল, কিন্তু ইহুদি সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যাত এবং নির্যাতিত হয়েছিল…এমন ইহুদি রাষ্ট্র আমাদের জনগণের জন্য মরণব্যাধি হবে এবং এর মূল উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ করে দেবে। এই ছোট রাষ্ট্রটি… শুধু কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এবং অসাধু শক্তিশালী শক্তির অধীন অবিরাম দাসত্বের মাধ্যমে টিকে থাকবে…
এভাবে আসলে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি, ‘ছোট, হতাশাজনক জনগণ’, আধ্যাত্মিক দাসত্বের প্রভাবে দমিত হবে … প্রাচীন জনগণের জন্য এমন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেয়ে ইতিহাস থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, যা জাতিগুলোর জন্য একটি আলোকবর্তিকা হয়ে আছে, কি বেশি পছন্দনীয় নয়?[1]
গিঞ্জবার্গ বুঝতে পেরেছিলেন যে ইহুদিদের সাংস্কৃতিক উপস্থিতি যদি রাজনৈতিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এটি অনিবার্যভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করবে এবং ঠিক তা-ই ঘটেছে।
ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ধারণা তৈরিতে যেসব নাস্তিক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তারা প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা (১৯৩৬-১৯৩৯) দমন করার জন্য যেমনি ছিল নিষ্ঠুর তেমনি তারা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে বর্বরতা করেছে, যা ভবিষ্যৎকেও নির্ধারিত করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ ছিল ইহুদি উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ব্রিটিশদের সক্রিয় উপস্থিতি না থাকলে অনেক আগেই উপনিবেশ বন্ধ হয়ে যেত। রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বোমারু স্কোয়াড্রনদের সাহায্যে ২৫ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য এবং জায়নবাদী সহায়করা জনগণের ক্ষোভের বিস্ফোরণকে চূর্ণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মালয় অভিযান পর্যন্ত এটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ দমন ছিল। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে, উইনস্টন চার্চিল ১৯৩৭ সালে পিল কমিশন অব ইনকোয়ারির কাছে প্রমাণ দেন এবং ইহুদিদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে এই পদক্ষেপের ন্যায্যতা দেন, যা তিনি আরও একটি বিকৃত ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করেন:
আমি একমত নই যে খাবারের গামলার কাছে থাকা কুকুরটির সেই গামলার ওপর চূড়ান্ত অধিকার রয়েছে, যদিও সে সেখানে অনেকক্ষণ পড়ে থাকতে পারে। আমি সেই অধিকার স্বীকার করি না। আমি স্বীকার করি না, রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে একটি বড় অন্যায় করা হয়েছে। আমি স্বীকার করি না যে আমেরিকার বা অস্ট্রেলিয়ার কালো মানুষের সঙ্গে একটি অন্যায় করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়নি এ জন্য যে একটি শক্তিশালী জাতি, একটি উচ্চ গ্রেডের জাতি, একটি আরও জাগতিক জ্ঞানী জাতি, তাদেরকে সেভাবে রাখার জন্য, এসে তাদের জায়গা নিয়েছে।
এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদী বুকানিয়ারদের সময়োপযোগী প্রতিরক্ষা। সেই সময়ে নাৎসি জার্মানিতে আরেকটি ‘উচ্চ গ্রেডের জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চাইছিল। আশ্চর্যের বিষয় নয়, চার্চিল সেই সময়ে নাৎসি জার্মানিতে সংঘটিত ঘটনাগুলোর সঙ্গে কোনো সমান্তরাল ভাবনা আঁকেননি। ঠিক যখন ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে তখন ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ অবশেষে পরাজিত হয়েছিল। আরবদের পিষ্ট করতে জায়নবাদীদের সহযোগিতায় কৃতজ্ঞ ব্রিটিশ তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে তা হবে যুদ্ধের পর। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সন্তুষ্ট করার জন্য তারা ইহুদি অভিবাসন সীমিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ব্রিটিশদের এই প্রতিশ্রুতিতে জায়নবাদীদের ডানপন্থি অংশ ইরগুনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সন্ত্রাসী অভিযান শুরু করে। বেন-গুরিয়নের নেতৃত্বে বাম জায়নবাদীদের দল চার্চিলকে সমর্থন করে, এবং হাগানাহ স্বেচ্ছাসেবকরা ইরগুন সন্দেহভাজনদের অনুসন্ধান করতে এবং গ্রেফতার করতে সাহায্য করে। আন্তঃ ইহুদি গৃহযুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে শেষ হয়েছিল। এরপর দুই বিরোধী দল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একজোট হয়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ জাতিসংঘে তাদের ম্যান্ডেট বা শাসনভার ফিরিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন-দ্য-স্পট দিকনির্দেশনা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের বিভাজনে সম্মত হয়। আরব রাষ্ট্রগুলো পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ব্রিটেন অনুভব করল তারা যেন হঠাৎ করেই তার সাম্রাজ্যের অংশ হারিয়েছে। তারা বিরক্ত হয়ে তখন ইরাক, মিশর এবং ট্রান্স-জর্ডানে তাদের প্রভাব ব্যবহার করল। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে বিপর্যস্ত করার জন্য ব্রিটেন এই রাজ্যগুলোকে তাদের সৈন্যবাহিনী ফিলিস্তিনে পাঠাতে উৎসাহিত করে। লন্ডন আশা করেছিল এই সম্মিলিত আক্রমণে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তার ফলে পুনরায় তাদেরকে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ শুরু করতে বলা হবে এবং স্বাধীনতার জন্য একটি সুশৃঙ্খল উত্তরণ ঘটাতে বলা হবে। কিন্তু মস্কোর নির্দেশে চেক সরকারের অস্ত্র সহযোগিতায় সশস্ত্র ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরব সৈন্যদের পরাজিত করে ব্রিটিশদের অবাক করে দেয়।
ইসরায়েলি নেতা বেন-গুরিয়ন অর্থ এবং অর্ধেক ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড (পশ্চিমতীর) যা ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহকে কিনে ফেলেছিলেন। বাকি অর্ধেক ভূখণ্ড ইসরায়েল গ্রাস করেছিল। ব্রিটিশ আনুকূল্যে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত জর্ডানের হাশেমি শাসক, নবী মুহাম্মদের সরাসরি বংশধর এবং মক্কা ও মদিনার অভিভাবকের পুত্র, এই জঘন্য চুক্তিটি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নগদ অর্থ প্রদানের দাবি করেছিলেন। ইসরায়েলি দূতকে আবদুল্লাহ জানিয়েছিলেন যে ‘যিনি মাতাল হতে চান তার চশমা গণনা করা উচিত নয়’, যার অর্থ হলো, ফিলিস্তিনের অর্ধেক ভূমি এবং তার নিরপেক্ষতার বিনিময়ে, রৌপ্যের টুকরো ওজন করার সময় ইসরায়েলিদের খুব বেশি কঠোর হওয়া উচিত নয়। এভাবেই ফিলিস্তিনিরা বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং একজন আরব রাজা–এই অপবিত্র ত্রিত্ত্ব তাদেরকে জায়নবাদীদের কাছে বিক্রি করেছিল। আর ইহুদিরা কোনো বড় শক্তির তিরস্কারের তোয়াক্কা না করে তাদের দেশকে প্রসারিত করেছিল। আবদুল্লাহ এবং জায়নবাদীদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি জাতিসংঘের পরিকল্পনাকে লঙ্ঘন করেছিল, কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ছিল।
প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই, ইসরায়েলের জায়নবাদী নেতারা দেশটিকে জনশূন্য করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তারা এমন একটি ভূমি চেয়েছিল যা ইউরোপে ‘মানুষবিহীন ভূমি’র পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে মিলে যায়। তাই ফিলিস্তিনিরা অমানুষ হিসেবে বিবেচিত হলো। যাদের বিতাড়িত করা যেত না তাদের সঙ্গে ‘আন্টারমেনশেনের’ বা অমানবিক (সাব-হিউম্যান) আচরণ করা হচ্ছিল। অনেক ইহুদি ইসরায়েলের সম্মিলিত স্মৃতিভান্ডার থেকে এই জঘন্য পর্বগুলোকে মুছে ফেলে। ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস এবং সমগ্র সম্প্রদায়ের বিতাড়নের সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রের বেশিরভাগ নাগরিকই উদ্ভট কল্পনায় আক্রান্ত হয়। বাকি আরব বিশ্ব থেকে সুরক্ষিত জায়নবাদীদের বিশ্বাস ছিল যে, কখনোই ফিলিস্তিনি গল্পগুলো যাচাই করা যাবে না বা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিসংখ্যান পরীক্ষা করা যাবে না এবং প্রায় এক দশক ধরে তারা তাদের বা তাদের নামে সংঘটিত অপরাধ ধামাচাপা দিতে সফল হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই, ইসরায়েলের জায়নবাদী নেতারা দেশটিকে জনশূন্য করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তারা এমন একটি ভূমি চেয়েছিল যা ইউরোপে ‘মানুষবিহীন ভূমি’র পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে মিলে যায়। তাই ফিলিস্তিনিরা অমানুষ হিসেবে বিবেচিত হলো। যাদের বিতাড়িত করা যেত না তাদের সঙ্গে ‘আন্টারমেনশেনের’ বা অমানবিক (সাব-হিউম্যান) আচরণ করা হচ্ছিল। অনেক ইহুদি ইসরায়েলের সম্মিলিত স্মৃতিভান্ডার থেকে এই জঘন্য পর্বগুলোকে মুছে ফেলে।
১৯৫৩ সালে ইসরায়েলে জন্মগ্রহণকারী ইয়ায়েল ওরেন কানের গল্পটি অস্বাভাবিক নয়। তিনি তার অভিজ্ঞতা লেখার সময় স্পষ্টতা এবং সততার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। তিনি সেই জার্মান উদ্বাস্তুদের কন্যা যারা ১৯৩৭ সালে ব্রিটেনে এবং পরে ফিলিস্তিনে পালিয়ে গিয়েছিল। তিনি এমন একটি বিশ্বে বেড়ে ওঠেন যেখানে অভিবাসী ইহুদিরা ফ্যাসিবাদ ঘাতকদের প্রতিরোধে ব্যর্থ ছিল এবং ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হচ্ছিল। তাদেরকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তুলনা করা হচ্ছিল, নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টিকারী তরুণ সাহসী জায়নিস্টদের সঙ্গে। এটি এমন একটা বিশ্ব ছিল, যেখানে ফিলিস্তিনিরা অদৃশ্য ছিল:
শিশুকাল। তখন আমি খুব ছোট। বাবার কাঁধে বসে আমরা জাদুকরী বাগানে হাঁটতাম। আমি কাঁটাযুক্ত নাশপাতি ফণীমনসা সারি ধরে দৌড়েছি। আমার কল্পনার স্বর্গ এমনই ছিল।। তবুও, বাগানে বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ আমাকে বিরক্ত করত। জায়গাটি কেন এমন মরূদ্যান হয়ে গেল তা বুঝতে পারতাম না। কে এমন একটি স্বর্গ পরিত্যাগ করবে? জায়গাটার নাম ছিল বাশিত। বাবাকে জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পাইনি। যখন এই স্বর্গটি ধ্বংস করে আমাদের নতুন বাড়ি বানানো হয়েছিল এবং তার একটি নতুন নাম হয়েছিল ‘অ্যাসেরেট’ তখন আমার প্রশ্নগুলোও স্বর্গের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আমি ইসরায়েলিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি যারা অতীতের ঘটনা ভুলে গেছে। অনেক বছর পর, গাজাতে ‘রাতাহ’ শরণার্থী শিবিরে বাশিতের সাবেক বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ততদিনে আমি জেনেছি যে, আমার শৈশবের বাড়ি কেফার মোর্দেচাই বাশিতের জমিতে তৈরি হয়েছিল। তবে আমি আর সেখানে থাকতাম না।
উদ্বাস্তুদের খুপরি আমাকে বিব্রত করছিল। তাদের জমিতে নতুন ভিলাগুলো নির্মাণের কথা ভেবে অসহায়ত্বের তিক্ত ব্যথা অনুভব করেছি। উদ্বাস্তু শিবিরে একজন নারী, যিনি মূলত বাশেতের কাছের একটি শহর ইবনসে থেকে এসেছিলেন, তিনি আমার কষ্ট বুঝতে পারছিলেন এবং আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি আমার প্রতি খুবই সহানুভূতি ছিলেন। আর আমি তখন জানতে পারি যে তিনি ইসরায়েলি বিল্ডিং সাইটে তার স্বামীকে এবং ইসরায়েলি বুলেটে এক ছেলেকে হারিয়েছেন।[2]
বেন-গুরিয়নের লোভ এবং বর্বরতা ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেছে। মৌলিক অবিচার হলেও, যদি তিনি তখন জাতিসংঘের দ্বারা নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থাকতেন, তাহলে ইসরায়েলি নেতারা এবং তাদের প্রবাসী সমর্থকরা কিছু ন্যায্য যুক্তি দিতে পারত যে তারা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে এবং যে কোনো আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে তারা তাদের সীমানা রক্ষা করবে। কিন্তু তারা ঠিক এর উল্টোটা করেছে। তারা আবদুল্লাহর সঙ্গে জাতিসংঘের অনুমোদনের চেয়ে বেশি এলাকা চুরি করেছে। তারা বহু বছর আগে যে জাতিগত নির্মূলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা চালাতে শুরু করে। এই নির্মূল পরিকল্পনা শুরু থেকেই জায়নবাদী প্রকল্পের একটি অংশ ছিল। ১৮৯৫ সালে হার্জল তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন:
‘আমরা ট্রানজিট দেশগুলোতে কর্মসংস্থান সংগ্রহ করব এবং সীমান্তের ওপারের জনসংখ্যাকে সেখানে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করব, আমাদের দেশে কোনো কর্মসংস্থান অস্বীকার করার সময়… ভূমি দখল এবং দরিদ্রদের অপসারণ করার প্রক্রিয়া, উভয়ই অবশ্যই বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।’
১৯৩৮ সালে বেন-গুরিয়ন ‘ইহুদি এজেন্সি এক্সিকিউটিভের কাছে বাধ্যতামূলক হস্তান্তর’ ধারণার পক্ষে ছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন:
‘আমি দেশ ভাগ করার পক্ষে। কারণ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমরা যখন একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠব তখন আমরা বিভাজন বাতিল করব এবং সমগ্র ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়ব।’
এটিই ইহুদিবাদী অবস্থানকে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অযোগ্য করে তুলেছিল। বেন-গুরিয়ন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আবদুল্লাহর সঙ্গে একটি পৃথক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে আশা করেছিলেন যে তা তাদের পক্ষে ফিলিস্তিন সমস্যার দ্রুত এবং চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে। কিন্তু ১৮৫১ সালে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের বাইরে একজন তরুণ ফিলিস্তিনি আবদুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে। ফলে সাময়িকভাবে বেন-গুরিয়নের পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। আরবে কদাচিৎ বিশ্বের একজন স্থানীয় ক্ষমতাবানের হত্যাকাণ্ডে এমন খোলামেলা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
ফিলিস্তিনের প্রতিকূলতা ক্রমাগত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। আবদুল্লাহকে পাঠানোর এক বছর পর, মিশরের জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্ন কর্নেল, মেজর এবং ক্যাপ্টেনদের একটি দল, সেনাবাহিনীর স্বাধীন অফিসারদের সঙ্গে একটি গোপন সংগঠনে দলবদ্ধ হয়ে মোহাম্মদ আলীর রাজবংশের অবসান ঘটায়। রাজা ফারুক, তার জীবন রক্ষা পেয়ে বিনা আপত্তিতে এবং আনন্দিত চিত্তে মিশর ত্যাগ করে ফরাসি রিভেরাতে চলে গেলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই, ব্রিটিশ জেনারেল অ্যালেনবি ঘোষণা করেছিলেন: ‘ইংরেজরা সহজেই মিশরকে উচ্ছেদ করতে পারে: কার্যত তারা বৃহৎ জমির মালিকদের একটি শ্রেণি তৈরি করেছে মিশরে যাদের ওপর গ্রেট ব্রিটেন তার দখল নীতি নিশ্চিত করার জন্য নির্ভর করতে পারে। কিন্তু মিশরে ব্রিটিশ উপস্থিতি সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে নীল নদের তীরে ভারতীয় ঔপনিবেশিক মডেল সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। মোহাম্মদ আলীর অগ্রসর অটোম্যানিজম ব্র্যান্ডের স্মৃতি মুছে যায়নি। গ্রামীণ ধনীদের বংশধরদের মিশরীয় সেনাবাহিনীতে একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৬ সালে বিচক্ষণ উদারপন্থি-জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী প্রতিরক্ষার স্বার্থে ব্রিটিশ-আরোপিত সামরিক শর্তকে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের ওপর জোর দেন। তিনি কর্মকর্তা নিয়োগের ওপর বিধিনিষেধের অবসান ঘটান। শহুরে মধ্যবিত্ত এবং পেটি-বুর্জোয়া পটভূমি থেকে ক্যাডেটদের সামরিক একাডেমিতে প্রবেশের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি ধীরে ধীরে অফিসার বাহিনীর চরিত্র এবং সামাজিক ভিত্তি পরিবর্তন করে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা মাইলু শহরের জাতীয়তাবাদ, ইসলামবাদ এবং সমাজতন্ত্র থেকে উদ্ভূত মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৩৮-৪০ সালের ক্যাডেট নিয়োগ থেকে স্বাধীন অফিসারদের বেশিরভাগ ক্যাডার সরবরাহ হয়েছিল।
১৯৫২ সালে স্বাধীন অফিসারদের ক্ষমতা দখল মেঘহীন আকাশ থেকে বজ্রপাতের মতো আসেনি। ১৯৪৯-৫১ সাল জুড়ে, রাজপরিবারসহ বৃহৎ এস্টেটগুলো কৃষক বিদ্রোহের কবলে পড়ে। বেশ কয়েকবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কৃষকরা সরকারের ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে। এই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেবল সেনাবাহিনীর সহানুভূতিশীল অংশ থেকে সরবরাহের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। এবং কমিউনিস্ট সংগঠন এস্টেটের বিপ্লবী কৃষকদের শিল্পের কেন্দ্রীয় এস্টেটগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। সেই সংযুক্তি অল্প পরিমাণে ব্যারাকের সঙ্গেও তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৪-৪৮ সাল থেকে, মিশরীয় কমিউনিস্টরা শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে এবং গ্রামাঞ্চলে ইউনাইটেড-ফ্রন্ট কমিটি তৈরি করতে সফল হয়েছিল যা ছাত্র এবং শিক্ষকদের কৃষক কর্মীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য সমন্বিত করে। স্বাধীন অফিসাররা সচেতন থাকলেও এই সমস্ত উন্নয়নের অংশ ছিল না।
কেউ কেউ এই অভ্যুত্থানকে একটি সামাজিক বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেছে। রাজতন্ত্রের উৎখাত জনগণকে উত্তেজিত করেছিল এবং ধারাবাহিক সংগ্রামের উত্থান ঘটতে থাকে। এই সংগ্রামের মাত্রা এমনকি সবচেয়ে কট্টরপন্থি সেনা কর্মকর্তাদের লক্ষ্যকে অতিক্রম করে যায়।। ১৯৫২ সালের ১৩ আগস্ট নতুন শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশ মালিকানাধীন কারখানারগুলোতে শ্রমিকদের বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে। সামরিক ট্রাইব্যুনাল দুজন প্রধান শ্রমিক-শ্রেণির নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয। এর পরদিন দুজনে বিদ্রোহী পুরুষ শ্রমিকদের ফাঁসি দেওয়া হয়। এক মাস পর, কৃষক বিদ্রোহ এড়াতে এবং একই সঙ্গে ভূমির মালিকদের রাজনৈতিক শক্তিকে ভাঙতে সরকারের কট্টরপন্থি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল সদস্যরা ‘সীমিত ভূমি সংস্কার’ ঘোষণা করেন। এটি জমির মালিকানাকে সর্বোচ্চ ৩০০ ফেডন (১২০ হেক্টর) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে এবং অঙ্গীকার করে যে অবশিষ্ট সমস্ত বাজেয়াপ্ত জমি পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। মালিক-শ্রেণি এ সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা কোরআন থেকে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা সমর্থক আয়াত উপস্থাপন করে। কিন্তু তাতে এই সংস্কার বাতিল হয় না। এই সংস্কার বিপ্লবের একটি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল ছিল। কিন্তু এক দশক পর করুণ একটি ফলাফল লক্ষ করা গেল। মাত্র ১০ শতাংশ বাজেয়াপ্ত জমি ২ মিলিয়ন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
সে সময় দেশে চিন্তার দুটি প্রধান স্রোতধারা ছিল। কৃষক, শ্রমিক এবং বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর মিশরীয় কমিউনিস্টদের প্রভাব জাতীয়তাবাদীদের জন্য উদ্বেগ তৈরি করেছিল। পূর্ববর্তী শাসনামলে দমন-পীড়নে আক্রান্ত হওয়ায় সারা দেশে কমিউনিস্টদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল। বামদের বিরুদ্ধে একটি সুসংগত মতাদর্শ মোতায়েন করতে স্বাধীন অফিসাররা মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই সংযুক্ত ছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড (জামিয়াত আল-ইখওয়ান মুসলিমুন)-এর জন্মবৃত্তান্ত বেশ আকর্ষণীয় ছিল। ১৯২৪ সালে ইস্তাম্বুল খিলাফতের পতনের পর ভারতে যে আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল এটি ছিল তারই অনুরূপ একটি পুনরুজ্জীবিত আন্দোলন। কামাল পাশা একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। স্থবির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যা নিজেকে সংস্কার করতে ব্যর্থ হচ্ছিল এবং ধর্ম যা ইসলামকে বিভক্ত করছিল, তিনি তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। আধুনিকতাবাদীরা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু রক্ষণশীল ধর্মতাত্ত্বিক এবং ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসীরা, যারা ফেজ (টুপি) পরে নিজেদের পরিচয় জাহির করতে আনন্দিত ছিলেন, তারা তখন নিজেদের অনাথ অনুভব করেছিলেন।
তাদেরই একজন ছিলেন ইসমাইলিয়ার একজন অসন্তুষ্ট মিশরীয় স্কুলশিক্ষক, হাসান আল-বান্না (১৯০৬-৪৯)। ১৯২৩ সালে গৃহীত মিশরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তাকে অত্যন্ত বিরক্ত করেছিল। এর এক বছর পর খেলাফতের বিলুপ্তি হওয়া তার কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। প্রতিক্রিয়ায় তিনি আধুনিকতা এবং এর কুফলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।। ইসলামি বিশ্বের অবস্থা অবলোকন করে আরব উপদ্বীপে ওহাবি বিজয় দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং অন্যত্র এই বিজয়ের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার কোনো কারণ দেখতে পান না। তাই ১৯২৮ সালে তিনি শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমে নৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রচারের জন্য মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতা ইশতেহার থেকেই নতুন সংগঠনের চরিত্র স্পষ্ট ছিল। এই ইশতেহার সপ্তম শতাব্দীর রাজনীতিতে ফিরে আসার পরামর্শ দেয়: ‘আল্লাহ আমাদের উদ্দেশ্য, নবী আমাদের নেতা, কোরআন আমাদের সংবিধান, জিহাদ আমাদের পথ এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে মৃত্যু আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। প্রতিদ্বন্দ্বীদের গোঁড়ামি, পৌত্তলিক ও একেশ্বরবাদীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও তাদের পরাজিত করার জন্য ইসলামের নবীকে একটি নতুন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হয়েছিল। মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী নতুন অঞ্চল জয় করার সঙ্গে সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই এ ব্যবস্থার বেশিরভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল। সম্প্রসারণের গতি ত্বরান্বিত করতে ধর্ম এবং রাষ্ট্র, পুস্তক এবং তরবারির একটি সংমিশ্রণ প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে দৈনন্দিন জীবন পরিচালিত করার বিধিনিষেধ চালু করতে নতুন আইন তৈরি করা আবশ্যক ছিল। খ্রিষ্টধর্মকে তা প্রতিহত করতে কনস্টানটাইনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ইসলাম কখনোই এ ধরনের দার্শনিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়নি।
অধিকাংশ অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে প্রাথমিক ইসলামের অনুশীলন ইতোমধ্যেই পরিত্যাগ করা হয়েছিল। শাসনব্যবস্থা অনেক বেশি শিথিল হয়েছিল। আধুনিকতা এবং বিংশ শতাব্দীর সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে প্রাথমিক ইসলামের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে যুক্তি দেওয়া একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল। তবে এটি বিশ্বের বিদ্যমান সমস্যাগুলো থেকে পশ্চাদপসরণও ঘোষণা করেছিল। শুরু থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ‘মুনাফেক’, ‘ধর্মত্যাগী’ এবং ‘ধর্মত্যাগীদের’ তুলনায় অন্যান্য শত্রুর প্রতি কম প্রতিক্রিয়াশীল ছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুড তার প্রথম দশকে ক্যাডার নিয়োগ এবং প্রচারমাধ্যমে ব্যস্ত থাকে। এই কর্মকাণ্ড মূলত মিশরের আধুনিকতাবাদী এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে, ইয়ং ইজিপ্ট পার্টির সবুজ শার্টে দলবদ্ধ হয়ে কট্টরপন্থি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ এবং ইসলামপন্থিরা নুরেমবার্গে নাৎসি কংগ্রেসে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেয়। যুদ্ধের সময় আলেকজান্দ্রিয়ার প্রায় ৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে এল আলামিনে যখন ফিল্ড মার্শাল রোমেলের সেনাবাহিনী অবস্থান করছিল, তখন জনগণ খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের বিশ্বাস ছিল ব্রিটিশরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই খাদ্য সংকট তৈরি করেছে। তাদের মূল স্লোগান ছিল ইয়াল-আমাম ইয়া রোমেল! (ফরোয়ার্ড রোমেল!), যা অবশ্যই ব্রিটিশ সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিত ছিল না। জার্মান ও ইতালীয় সেনাবাহিনী যদি ব্রিটিশদের পরাজিত করে আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করত, তাহলে ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে জাতীয়তাবাদী জনতা তাদের স্বাগত জানাত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মুসলিম ব্রাদারহুড বা কমিউনিস্ট জনতা নিঃসন্দেহে এর অংশ হতো না।
হাসান আল-বান্না মুসলিম ব্রাদারহুডকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখেন। যদিও ব্রাদারহুড একটি গোপন রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছিল এবং তাদের একটি সশস্ত্র গুপ্ত শাখা সংগঠিত হয়েছিল; কিন্তু তারা নিজেদের একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন। মিশরীয় কমিউমিস্ট পার্টি তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত হতো। যুদ্ধের পর, বাম জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কার্যকর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জোটকে দুর্বল করার জন্য তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের কর্মীদের মিশরীয় বামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করে এবং ইসলামের নামে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। এর কৈফিয়তকারীরা এখনো এই সত্যটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে হাসান আল-বান্না ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ব্রিগেডিয়ার ক্লেটনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে ছিলেন। কায়রোতে ব্রিগেডিয়ার ক্লেটনের ব্রিটিশ দূতাবাসে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ‘ওরিয়েন্টাল কাউন্সেলর’ হিসেবে কাজ করছিলেন।[3]
যদিও ব্রাদারহুড একটি গোপন রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছিল এবং তাদের একটি সশস্ত্র গুপ্ত শাখা সংগঠিত হয়েছিল; কিন্তু তারা নিজেদের একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন। মিশরীয় কমিউমিস্ট পার্টি তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত হতো। যুদ্ধের পর, বাম জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কার্যকর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জোটকে দুর্বল করার জন্য তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল।
ব্রাদারহুডের সতর্ক এবং পরিকল্পিত সন্ত্রাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি নেতাদের হত্যা, থিয়েটারে বোমা হামলা এবং ইসরায়েলের জন্মের পর, ইহুদি ব্যবসাকেন্দ্রে বারবার বোমা নিক্ষেপ করা। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে তারা হারেত এল-ইয়াহুদকে (ইহুদি কোয়ার্টার) আঘাত করে, দুই ডজন লোককে হত্যা করে এবং তারও তিন গুণ মানুষকে আহত করে। লক্ষ্য ছিল সরকারকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং সংবিধান স্থগিত করতে বাধ্য করা। তারা ধরে নিয়েছিল এর ফলে সমাজে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তিগুলোকে দুর্বল করা যাবে। ব্রাদারহুডের পুলিশের জেনারেলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নাগরিক স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল। এদিকে সরকারও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রাদারহুডকে অবৈধ ঘোষণা করার তিন সপ্তাহ পর, প্রধানমন্ত্রী নুকরাশি পাশা একজন ব্রাদারের গুলিতে নিহত হন। তাদের নেতা ব্যাখ্যা করেন, যখন বাকস্বাধীনতা নিষিদ্ধ করা হয়, ‘তখন হাত সক্রিয় হয়ে ওঠে।’ তিন মাস পর, ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিরোধী হাতগুলো সক্রিয় হয় এবং সাবধানে পরিকল্পিত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে একজন সরকারি এজেন্ট হাসান আল-বান্নার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী এবং মার্ক্সবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামি জিহাদের কারণ স্বতঃসিদ্ধ। একটি মুসলিম দেশে তাদের জনসমর্থন অর্জনের ক্ষমতাকে বাদ দিয়ে এ ধরনের গোষ্ঠীর উপস্থিতি মুসলিম ব্রাদারহুডের হৃদয়ে একটি ছুরিকাঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কেন? কারণ, শত্রু ছিল বস্তুবাদী। হাসান আল-বান্না, ব্রাদার্স এবং তাদের অসংখ্য উত্তরসূরি আজ যা মেনে নিতে পারে না তা হলো বস্তুবাদ: সংকীর্ণ আক্ষরিক অর্থে একটি চিন্তাধারা বা মতবাদ হিসেবে নয়, এমনকি একটি সুযোগের ব্যবহারেও নয়, কেননা এটা একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা। রাষ্ট্র যে-ই শাসন করুক না কেন, তা পরিবর্তন করা যায় না। সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর বস্তুবাদ– পশু, ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কার, রাজনীতিবিদ, পুরোহিত, নান, মোল্লা এবং রাব্বিদের বস্তুবাদীয় চিন্তা একই ধরনের অবচেতন প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়। চিন্তার মাধ্যমে লোকেরা বস্তুর মধ্যে সত্যের সন্ধান করে। কেননা, তারা জানে যে, তাদের অনুসন্ধান করার আর কোথাও নেই।
১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত মিশরের সর্বশেষ অবাধ সাধারণ নির্বাচনে ওয়ার্ডের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ উদার জাতীয়তাবাদীদের বিজয় হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সামরিক দখল জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে একটি তীব্র বিভাজন তৈরি করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী যখন জাতিকে জানান যে, তিনি ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব, বাণিজ্য এবং নৌ-চলাচলের একটি চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে যাচ্ছেন, তখন দেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। শুধু ১৯৫০ সালেই উনচল্লিশটি ধর্মঘট হয়েছিল এবং প্রতিটি শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। ব্রিটিশদের চলে যেতে হবে। মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে এই দেশে তাদের অব্যাহত উপস্থিতিতে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে জনগণ ‘দেশপ্রেম এবং কমিউনিস্ট অপপ্রচারের’ মধ্যে আর পার্থক্য করতে পারছে না।
ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে কট্টরপন্থি লেবার সরকার সাম্রাজ্যবাদী ঔদ্ধত্যের সঙ্গে আচরণ করার ফলে রক্ষণশীল পূর্বসূরিদের কাছ থেকে প্রশংসা লাভ করেছিল। তারা মিশর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার জন্য নির্বাচিত সরকারের ওপর একটি শর্ত আরোপ করে। শর্তানুযায়ী নির্বাচিত মিশর সরকারকে ওয়াশিংটন-পৃষ্ঠপোষক জোটে যোগ দিতে হবে। বিপ্লবী বিস্ফোরণের ভয়ে সরকার ন্যাটোর আরব সম্প্রসারণে অংশগ্রহণের মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে (অন্য সদস্যরা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও তুরস্ক অন্তর্ভুক্ত)। ডেপুটিদের চেম্বারে এ ঘোষণার ফলে সমস্ত শহরে আনন্দ মিছিল হয়। ইসমাইলিয়ায় ব্রিটিশ সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়।
এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক কমিটি গেরিলা দল গঠন করে এবং সুয়েজ খাল অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা সবাই জাতীয়তাবাদী বা বামপন্থি ছিল না। মুসলিম ব্রাদারহুড এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ইয়ং ইজিপ্টের গঠিত একটি অংশ এ অভিযানে অংশ নেয়। প্রশ্ন দাঁড়ায়: সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে কে? ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী ও বাম নাকি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ও ডান? মিশরীয় সেনাবাহিনী উভয় পক্ষের স্বেচ্ছাসেবকদের অস্ত্রের ব্যবহার এবং যুদ্ধের নিয়ম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়। যখন বিপুল সংখ্যক কৃষক সংঘবদ্ধ হয়েছিল তখন যুদ্ধগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে হয়।
লেবার সরকার এ সময় তার সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহের সম্মুখীন হচ্ছিল। মরিশাস থেকে এয়ারলিফট করা সৈন্যরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল যে তাদেরকে মিশরীয় জনগণের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হলে তা তারা প্রত্যাখ্যান করবে। কয়েক শতাধিক সৈন্যকে গ্রেফতার করা হয়। সৈনিকরা তারা হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ল। এমনকি দ্য টাইমস ১৯৫১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই মন্তব্যটি করতে বাধাগ্রস্ত হয়: ‘ব্রিটিশ সৈন্যদের স্নায়ু একটি কঠোর অগ্নিপরীক্ষার শিকার। জাতীয় অনুভূতির বিরোধিতার কারণে একটি সামরিক ঘাঁটি তার সমস্ত উপযোগিতা হারানোর পরও তাকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে কী আগ্রহ থাকতে পারে! তারা ভাবছিল…’
এই সংগ্রামে প্রতিটি শহর থেকে মিলে মোট ছয়শ স্বেচ্ছাসেবক নিহত হয়েছিলেন। ওয়াফদ সরকার জানত যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গণ-অভ্যুত্থানে তার ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হতে পারে। তাই লন্ডন থেকে মিশর তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করল; ঘোষণা করা হলো যে কোনো নাগরিক বিদেশি সৈন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে তা কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে; প্রতিটি নাগরিককে অস্ত্র বহন করার অনুমতি দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়া হলো; ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের হুমকি দেয় এবং মস্কোতে বন্ধুত্বের প্রস্তাব পাঠায়। এবং আরব বিশ্বে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফ্রন্ট তৈরির বিষয়ে জনসম্মুখে আলোচনা করে। এমনকি ডানপন্থি সংবাদমাধ্যমও ব্রিটিশদের প্রত্যাহারের দাবি জানায়। লন্ডনে লেবার সরকার তা মেনে নিতে অস্বীকার করে।
১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ইসমাইলিয়াতে মিশরীয় পুলিশ ব্রিটিশ ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। সমগ্র দেশ ধরে নিয়েছিল যে মিশরীয় সেনাবাহিনী শিগগিরই মাঠে নামবে। পরদিন একটি সাধারণ ধর্মঘট সমগ্র দেশকে স্থবির করে দেয়। ছাত্র এবং শ্রমিকরা মিছিল করে শহরের কেন্দ্রে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেখানে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির ব্রিটেনের সঙ্গে অবিলম্বে বিরতি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। বেলগ্রেড, জাকার্তা, নয়াদিল্লি, মস্কো ও বেইজিং থেকে সংহতির প্রতিশ্রুতি আসে।
বামপন্থি হুমকির অতিমাত্রা আশঙ্কা করে রাজতন্ত্রবাদীরা এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের উপদেষ্টারা গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলামপন্থিরা গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তার সহযোগীরা কায়রোর ব্যবসায়িক জেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা অন্ধকার গলিপথে প্রেমিক-প্রেমিকাদের এবং কায়রোর অসংখ্য বার থেকে বেরিয়ে আসা লোকজনের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। সরকার আতঙ্কিত হয়ে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা দেয়। পরদিন রাজার আদেশে তা বাতিল হয়। ব্রিটিশ এবং বামপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে গ্রেফতার করা হয়। কায়রোতে অগ্নিসংযোগ গ্রেফতারের অন্যতম কারণ ছিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের এই ভূমিকার কী উদ্দেশ্য ছিল, সেই প্রশ্নের জবাবে নেতারা বলেন: ‘…একটি সালাফি (মৌলবাদী) বার্তা, একটি সুন্নি পথ, একটি সুফি সত্য, একটি রাজনৈতিক সংগঠন, একটি ক্রীড়া সংগঠন, একটি আর্থিক সংস্থা এবং একটি সামাজিক মতবাদ।’
আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৫
পরের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৭
ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ইমেইল: fatemaorama@gmail.com
পাদটীকা:
[1] এই পাঠ্যটির প্রতিদৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমি আকিভা অর-এর কাছে কৃতজ্ঞ। লেখাটি হিব্রু ভাষা থেকে তার নিজের বই, ইসরায়েল: পলিটিকস, মিথস অ্যান্ড আইডেনটিটি ক্রাইসিস, লন্ডন ১৯৯৪-এর জন্য অনুবাদ করা হয়েছে। অর উল্লেখ করেছেন যে গিঞ্জবার্গ ফিলিস্তিনে নিজের রাজনৈতিক উপস্থিতির বদলে সাংস্কৃতিক উপস্থিতিকে পছন্দ করেছেন। এবং তিনি ইসরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপতি, চাইম ওয়েইজম্যানসহ অনেকের কাছে একজন সম্মানিত সেক্যুলার চিন্তাবিদ এবং পরামর্শদাতা ছিলেন। দুঃখজনকভাবে, তার ধারণাগুলো উপেক্ষিত হয়েছে এবং তার কাজ আজ ইসরায়েলে অজানা। অনূদিত উদ্ধৃতিগুলো কালেক্টেড ওয়ার্ক্স অব আহাদ-হা’ম, জেরুজালেম ১৯৫০,-এর হিব্রু সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে। আহাদ-হা’ম (ওয়ান অব দ্য পিপল) গিঞ্জবার্গের ছদ্মনাম ছিল।
[2] সিক্রেটস অ্যান্ড লাইজ: আ জার্নি টু দ্য ট্রুথ, ইয়ায়েল ওরেন কান-এর অপ্রকাশিত আত্মজীবনী।
[3] ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতার বিশদ বিবরণ এবং এই সময়কালে তাদের ঘোষণাগুলোর একটি সতর্ক বিশ্লেষণ দ্য মোসলেম ব্রাদারহুড ইন দ্য ব্যালেন্স, ক্যামো ১৯৪৫-এ পাওয়া যাবে। ষাট দশকের প্রথম দিকে বইটি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।