আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন - ৩
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়
শেষ পর্বে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব, বনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপায়, সুন্দরবনের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা এবং সুন্দরবনে মানুষের বসতির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে করণীয়: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে ভরা এক মহাপ্রাণ। প্রকৃতি এর সবকিছু সৃজন করেছে ভারসাম্য রক্ষা করে। এর কোন কিছুকে বাদ দেয়া যায় না এবং একটাকে বাদ দিলে আরেকটা সংকটে পড়ে। জলজ প্রাণী বা মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাখি, শিয়াল, বনবিড়াল, বেজী প্রভৃতিরা খাদ্য পাবে না। এগুলো টিকে না থাকলে বন্যশুকর, বাঘ প্রভৃতি না খেয়ে মরবে। অনুরূপভাবে বানরেরা হরিণের বন্ধু। তারা হরিণদের খাদ্য সরবরাহ করে। বানর না থাকলে হরিণ বিপন্ন হবে। হরিণ বিপন্ন হলে বাঘ কী খাবে? এইভাবে প্রকৃতি একদিকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে সুন্দরবনকে ঠিক তেমনি জীববৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে। তাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। মনে রাখতে হবে সুন্দরবন শুধু বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থলই নয় এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি স্থায়ী আধারও বটে। প্রায় ১০ লক্ষ লোক সুন্দরবনের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
জীবিকার এই প্রাকৃতিক শিল্প, প্রাকৃতির বিপর্যয়ের রক্ষাকবচ হওয়া এবং সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করায় সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি একে রক্ষা করার সামগ্রিম দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বেড়েছে বহুগুণ। বনের গাছপালা রক্ষা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রথম কাজ হল শিকার পুরোপুরি বন্ধ করা। সুন্দরবনের কোন স্থলজ প্রাণী শিকার করা যাবে না। বিদ্যমান অভয়ারণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আরও জোরালো করতে হবে। আরও নতুন নতুন এলাকায় অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক অন্যান্য সম্পদ যেমন কাঠ, গোলপাতা প্রভৃতি আহরণ সীমিত করতে হবে। বন্যপ্রাণী রক্ষা, প্রতিবেশ সচেতনতার বিষয়টি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পর্যটকদের বনের প্রবেশমুখে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কী তারা করতে পারবেন আর কী পারবেন না তা বনে প্রবেশের আগেই ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে। মাছ আহরণে কোন প্রকার বিষ প্রয়োগ দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। জেলেদের সচেতন করতে হবে এবং তা কার্যকরী করার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। মধু সংগ্রহের ব্যাপারে মৌয়ালরা যাতে রাণীমাছি না মেরে ফেলে এবং শুধু চাকের মধু অংশটুকু কেটে নেয়, বাসাবাড়ি না কাটে সে বিষয়ে মৌয়ালদের সচেতন করতে হবে। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রকে আরও উন্নত করার জন্য জীবসম্পদকে নথিভুক্ত করতে হবে। তাতে প্রাণীসমূহের বাস্তুতন্ত্রের তথ্যাবলী, জীব সম্পদের পরম্পরায় চলে আসা স্থানীয় মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, গবেষণা, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্যাবলী থাকতে হবে। জীবসম্পদের উপর সহমর্মিতা জ্ঞাপন এবং অন্তর দিয়ে অরণ্যকে, তার সবকিছুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের প্রাণীসম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। সর্বোপরি স্থানীয় জনসাধারণকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচনা না করে তাদেরকে সুন্দরবন রক্ষার কাজে অংশীদার করতে হবে। অসৎ বেতনভুক্ত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দিয়ে সুন্দরবন রক্ষা করা যাবে না।
বনের গাছপালা রক্ষা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রথম কাজ হল শিকার পুরোপুরি বন্ধ করা। সুন্দরবনের কোন স্থলজ প্রাণী শিকার করা যাবে না। বিদ্যমান অভয়ারণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আরও জোরালো করতে হবে। আরও নতুন নতুন এলাকায় অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে।
সুন্দরবনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা: সুন্দরবনকে রক্ষা করা, তাকে বিকশিত হতে সহায়তা করা, সর্বোপরি রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে সব সরকার তাদের ইচ্ছামতো বা পছন্দমতো নিয়মনীতি ও পদক্ষেপাদি গ্রহণ করেছে। এখানে সুন্দরবনকে রক্ষা করার কথা এসেছে। সুন্দরবনকে রক্ষা করার প্রশ্ন আসছে কেন? পৃথিবীর কোন মানুষ বা কোন প্রাণী যদি সুন্দরবনের জন্য কোন কিছু নাও করে তবুও সুন্দরবন নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। সুন্দরবনের রক্ষা করার জন্য কোন সরকারের কোন ধরনের নীতিমালার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হল সুন্দরবনকে ধ্বংস না করার নীতিমালা প্রণয়ন। কারণ মানবজাতি প্রকৃতির একটি অংশ হয়েও প্রকৃতির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে তার নিজের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে। বিকশিত হতে সহায়তার কথাটাও এসেছে। এক্ষেত্রেও ওই একই কথা। প্রকৃতি নিজেই নিজেকে বিকশিত করে। নিজেই নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। এসব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে থাকে। আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। সরকার সেই কাজটি করেছে তার রাজস্ব আয় এবং আদায়ের প্রয়োজনে। বৃটিশ, পাক এবং বাংলা Ñ সব সরকারই বিষয়টা একই চোখে দেখেছে। কীভাবে সুন্দরবন থেকে অধিক রাজস্ব তুলে আনা যায় সেই নিরিখেই তারা তাদের নীতিমালা স্থির করেছে। সে যাই হোক, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনকে যেভাবে পরিচালনা করছে সেগুলি নিম্নরূপে প্রকাশিত:
সুন্দরবনের রক্ষা করার জন্য কোন সরকারের কোন ধরনের নীতিমালার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হল সুন্দরবনকে ধ্বংস না করার নীতিমালা প্রণয়ন।
সুন্দবনের রয়েছে ২টি ডিভিশন। (১) সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ (২) সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগ। প্রতিটি বিভাগের রয়েছে ২টি করে রেঞ্জ। এই রেঞ্জগুলো হল ১. খুলনা রেঞ্জ, ২. সাতক্ষীরা রেঞ্জ, ৩. শরণখোলা রেঞ্জ, ৪. চাঁদপাই রেঞ্জ। প্রতিটি রেঞ্জে রয়েছে কয়েকটি করে স্টেশন আর প্রতিটি স্টেশনের আছে কয়েকটি করে ক্যাম্প। প্রশাসনিক এই বিভাজন দিয়ে সুন্দরবনকে রক্ষা (?) করা হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাবৃন্দ দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকেন আর কিছু বনরক্ষীরা নৌযানে করে টহল দেয়। তাদের চোখের সামনে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চলতে থাকে। কারণ প্রভাবশালী সরকারি দল ও শ্রেণীর মানুষেরা এসব কিছু করে থাকে। বনদস্যু-জলদস্যুরা দলে দলে বাদাবনে অবস্থান করে। তারা বনের উপর নির্ভরশীল মৌয়াল, বাওয়ালী, জেলে প্রভৃতির টাকা পয়সা কেড়ে নেয়। আটক করে মুুক্তিপণ আদায় করে। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে সরকারি ব্যক্তিবর্গের সহায়তা লাভ করে দুর্বৃত্তরা।
বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাবৃন্দ দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকেন আর কিছু বনরক্ষীরা নৌযানে করে টহল দেয়। তাদের চোখের সামনে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চলতে থাকে। কারণ প্রভাবশালী সরকারি দল ও শ্রেণীর মানুষেরা এসব কিছু করে থাকে।
বিস্তীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চলকে উপরোক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা অসম্ভব। সুন্দরবনের পরিধি আজও সুবিস্তৃত। বাংলাদেশে অবস্থিত সুন্দরবনের মোট আয়তন ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগ হল ৪১৪৩ বর্গকিলোমিটার আর জলভাগ হল ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২% আর সমগ্র বনভূমির ৪৪%। সুন্দরবনের মোট আয়তনের মধ্যে ৩,৮০,৩৪০ হেক্টর হল উন্নত বনভূমি এবং ২৬,৮০৭ হেক্টর হল অপ্রধান বনভূমি। পরষ্পর সংযুক্ত প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী, খাল রয়েছে সুন্দরবনে। প্রায় ২০০টি ছোটবড় দ্বীপ রয়েছে সুন্দরবনে। দেশের , বিশেষ করে উপকূলীয় ৩টি জেলার মোট ১৭টি উপজেলার অসংখ্য মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের এক বিরাট অংশ পরিচালিত হয় এই সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে। তাই এর প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে এই সব স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা।
সুন্দরবনের লোকবাস ও লোকভাষা: সুন্দরবনের সীমারেখা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিণ কখনো এক জায়গায় থাকে নি। এ দুটি প্রায়শই দক্ষিণে সম্প্রসারিত হয়েছে। উত্তর দক্ষিণদিকে সরে গেছে কৃষিজমি, লোকবসতি প্রতিষ্ঠা করা, গ্রাম-নগর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে। আর দক্ষিণ দক্ষিণদিকে সরে গেছে সমুদ্রের বুকে নতুন নতুন চর জাগা, প্রাকৃতিক নিয়মেই সেখানে বনরাজি গড়ে উঠার কারণে। আবার পূর্ব-পশ্চিম অংশও অপরিবর্তিত থাকেনি। যেহেতু ভাগীরথীর ভূ-গঠন প্রক্রিয়া বহুদিন ধরে চলে আসছিল তাই এর পশ্চিমাংশ পূর্বাংশ অপেক্ষা অধিক দক্ষিণাগ্রবর্তী থেকেছে। এখনো পূর্বাংশের ভূ-গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। তাছাড়া সমুদ্রের অতলস্পর্শ পূর্বাংশ সাপেক্ষে পশ্চিমাংশে সন্নিকটে। তবে বর্তমান সময়ে পূর্ব-পশ্চিম সীমান্ত প্রায় সমরেখায় পৌঁছে গেছে। সে যাই হোক সুন্দরবনে ঠিক কোন কাল হতে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠে তা এখনো সুনির্ধারণ করা যায়নি। এ ব্যাপারে দুটি মত প্রচলিত। একটি বিদেশী পর্যটক এবং প-িতবর্গের। আর একটি স্থানীয় জনগণ এবং এদেশীয় গবেষকদের । অবস্থাদৃষ্টে স্থানীয় মতামতটা অধিক গ্রহণযোগ্য। স্থানীয় মতামত হল বেশ কয়েকশত বছর আগে থেকেই সুন্দরবনে মনুষ্য বসতি ছিল। বিদেশীরা বলছেন, না, সুন্দরবনে তেমন মনুষ্য বসতি কোন কালেই ছিল না। লোকবসতির দৃষ্টান্ত দেয়ার জন্য বেশ কয়েকটি সূত্র তুলে ধরা হল।
প্রথমত: সুন্দরবনের পূর্বভাগে বাখেরগঞ্জ অধুনা বরিশাল জেলা এবং নোয়াখালী জেলার মাঝখানে সন্দীপসহ অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ রাজ্য ছিল। ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে যে ওই দ্বীপগুলোতে প্রচুর পরিমাণে লবণ প্রস্তুত হত। লবণ উৎপাদনে কাঠের প্রয়োজন হত। সুতরাং দ্বীপগুলোতে জঙ্গল ছিল এটা ধরে নেয়া যায়। এখনো সন্দীপের স্থানে স্থানে জঙ্গল দেখা যায়। এই এলাকা থেকে প্রতিবছর ২ শত লবণ বোঝাই জাহাজ বিদেশে চালান যেত। পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা এই লবণের ব্যবসা পরিচালনা করত। যদি মনুষ্য বসতি না থাকত তবে কে লবণ প্রস্তুত করত এবং কাদের দিয়েই বা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করত? তাই নিঃসন্দেহে এই এলাকা অতি প্রাচীন এবং এখানে প্রাচীন কালে সভ্য মানুষের বসবাস ছিল এবং এটা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দ্বিতীয়ত: বরিশালের অন্তর্গত হাদিসপুরে তা¤্রশাসনকালে ‘চন্ডভন্ড’ নামে এক ধরনের মানুষ বসবাস করতেন। কেউ কেউ তাদেরকে অসভ্য বললেও আসলে তারা অসভ্য ছিলেন না। লবণ প্রস্তুতকারী শ্রমজীবী মানুষদের স্বল্প বস্ত্র পরা দেখে বিদেশী ভদ্রলোকেরা তাদেরকে ‘অসভ্য’ বলেছেন; কিন্তু আদতে তারা শ্রমজীবী মানুষ। লবণ প্রস্তুতকালে রৌদ্রের প্রখর উত্তাপে ইউরোপীয়দের মতো ভারী পোশাক পরা মোটেই সম্ভব না। তাই তাদের শরীরে স্বল্প পোশাক থাকাই ছিল স্বাভাবিক। তদুপরি সুন্দরবনের মধ্যেই কপোতাক্ষ কূলে প্রতাপাদিত্যের যশোর রাজ্যের রাজধানী ছিল।
লবণ প্রস্তুতকারী শ্রমজীবী মানুষদের স্বল্প বস্ত্র পরা দেখে বিদেশী ভদ্রলোকেরা তাদেরকে ‘অসভ্য’ বলেছেন; কিন্তু আদতে তারা শ্রমজীবী মানুষ। লবণ প্রস্তুতকালে রৌদ্রের প্রখর উত্তাপে ইউরোপীয়দের মতো ভারী পোশাক পরা মোটেই সম্ভব না। তাই তাদের শরীরে স্বল্প পোশাক থাকাই ছিল স্বাভাবিক।
এ কথা সত্য যে সুন্দরবনের সর্বত্র মানুষের বসবাস ছিল না। খুব সামান্য স্থানে ছিল। তবে সুন্দরবনের ভিতরে যে সমৃদ্ধ নগরী গড়ে উঠেছিল তার বহু নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষ বনের ভিতরে নানান ক্ষুদ্র স্থাপনা গড়ে তুলেছিল যা নিদর্শন আজও আছে। তারা সুন্দরবনের নানা দেবতার স্থাপনা বানিয়েছিল। যেমন কাঠের দেবতা বনদেবী, বনবিবি, রাজ্যেশ্বরী, গাজী কালু ও চম্পাবতীর আস্তানা, পাঁচপীরের থান প্রভৃতি। এগুলোর সাথে সম্পর্কিত মানুষদের ক্ষুদ্র একটা অংশ বনের মধ্যে বসবাস করতেন। সুন্দরবনে দীর্ঘকালব্যাপী বসতির আরও যেসব চিহ্ন আজও বিদ্যমান তার দুইএকটি এখানে উল্লেখ করলাম।
সাগরদ্বীপে বেশ কয়েকটি প্রাচীণ মন্দির এখনো ভগ্নাবস্থায় অবস্থিত। বৌদ্ধযুগে হাতিয়াগড়ে একটি সমৃদ্ধ বৌদ্ধমন্দির ছিল। এই বিহারে চীনা পর্যটক পরিদর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়। ধনপতি সওদাগর সুন্দরবনে মন্দিরে পূজা দিয়েছেন বলে জানা যায়। হাতিয়াগড়ের পূর্বে মনিনদী, পশ্চিমে রায়দীঘি ও কংকল দিঘী নামে অতি প্রস্তুত পুকুর ছিল। এর পূর্ব দিকে প্রসিদ্ধ জটার দেউল বিদ্যমান যার মন্দিরের উচ্চতা ৭০/৮০ ফুট। অনুমেয় যে ইহা রাজা প্রতাবাদিত্যের বিজয়স্তম্ভ হতে পারে। এর নিকটে রয়েছে পরান বসুর খাল। তার তীরে বিরিঞ্চির মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। খালের উত্তর তীরে ভরতগড় নামে স্থান বিদ্যমান। এই গড়টি দূর্গ পরিবেষ্টিত ছিল। এই খালের অনতিদূরে আরও একটি ইটের স্তূপ রয়েছে। যাকে ভরতবাজার মন্দির বলা হয়। বর্তমান গৌরীখোলা গ্রামের কাছে দীর্ঘ ইটের স্তূপ রয়েছে যাকে ভরতরাজার বাসভূমি বলা হয়। মাতলা ও ক্যানিং শহর থেকে দূরে মাতলা নদীর তীরে হাড়ভাঙ্গা আবাদে ২০/২২ বিঘা পরিমিত একটি বিরাট দীঘি রয়েছে।
মাতলার অনতিদূরে টার্ভা নামে একটা বড় পতুর্গীজ বন্দর ছিল। কলকাতার পূর্বে এটাই ছিল এই এলাকার প্রসিদ্ধ বন্দর। সতীশচন্দ্র মিত্র উল্লেখ করেছেন, “খোলপেটুয়া ও কদমতলীর মধ্যবর্তী ১৬ নং লাটে তেকাঠি বা তেজকাঠির খাল, নৈহাটির দোয়ানিয়া, মোড়লখালি ও পোদখালি প্রভৃতি খাল ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। এই সব খাল দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে যে বহু বসতিচিহ্ন দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা আমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি।”(সতীশ চন্দ্র মিত্র, যশোর-খুলনার ইতিহাস, পৃ-৪৬)।
একশত বছরের বেশি আগে মনীষী সতীশচন্দ্র মিত্র সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রত্যক্ষ করেছেন সুন্দরবনে মনুষ্য বসতির চিহ্নফলক। আমরা এমন বহু কিছু প্রত্যক্ষ করেছি যাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে বহু যুগ আগে সুন্দরবনে লোকালয় ছিল। বহুকারণে সুন্দরবনের জনবসতি কখনো বৃদ্ধি পেয়েছে কখনো বা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। কখনো বা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক বড় বড় দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের জনপদ ধ্বংস হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
এখন আমরা সুন্দরবনের স্বতন্ত্র ভাষার কিছু নমুনা দিব। যদিও তা বাংলা ভাষারই অন্তর্গত কিন্তু বেশ আশ্চর্যজনক পার্থক্য এবং অভিনবত্ব রয়েছে সেই ভাষাতে।
আইট/আট – বনের মধ্যে পূর্বের বসতবাড়ীর চিহ্নস্বরূপ উঁচু ভিটা।
আদালদার – লবণ প্রস্তুতকৃত রাশির উপর ছাপ মারত যারা
আবাদ – জঙ্গল উঠিত করে চাষের জমি তৈরি করা।
আশে – হাত জোড় করে শুভাশীষ কামনা করা।
ওঝা – বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষার জন্য মন্ত্রপুত করত যারা। বিশেষ করে সাপের কামড় থেকে সারিয়ে তোলা, বাঘের ভয় থেকে স্বস্তি।
করাল – দালাল (ধান/পাট/তাল ইত্যাদির)
কল্লা – দুষ্ট ব্যক্তি, চতুর মানুষ।
কাগজী – সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় যারা কাগজ প্রস্তুত করত। এখন আশাশুনি প্রভৃতি থানার বহু পরিবারের উপাধি বিশেষ।
কাঠির আবাদ – জঙ্গল পরিস্কার করে যে আবাদ তৈরী করা হয়।
কাঠুরিয়া – যারা কাঠ সংগ্রহ করতে বনে যায়।
কড়াল – নৌকায় মাঝির বসার স্থান।
কাবলীওয়ালা – বাঘ।
কারিকর – গান রচয়িতা।
কালাবন – নিবিড় বন।
কুজোর – ডালপালা দিয়ে নদী বা জলাশয়ের মাছ আটকায় এবং পরে জাল দিয়ে ঘিরে মাছ মারে – কুজোর ঘেরা।
কোলা – নদী-খাল প্রভৃতির পাড়ে প্রশস্ত স্থান।
খটি – মাছ শুকাবার স্থান/ শুটকী তৈরীর জায়গা।
খলোস – ধান, তিল, সরিষা প্রভৃতি মাড়াই করার জায়গা।
খোঁজ – পদচিহ্ন/ বাঘ হরিণ প্রভৃতির।
গণ – নদীর অনুকূল প্রবাহ।
গলুই – নৌকার সামনের অংশ।
গাইন – গায়ক/কথক/ সুরকার।
গাছাল – গাছের উপর বসে শিকার করে।
গাজি – বাঘের দেবতা।
গুণ – প্রতিকূলে নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়ার রশি বা দড়ি।
গুরো – নৌকার মাঝে মাঝে কাঠের মজবুত সংযোগ।
গ্যাড়া – গন্ডার।
ঘুঘু – ছোট ডিঙ্গি নৌকা।
ঘের – বনের যে স্থানে কাঠ বা গোলপাতা কাটার হুকুম আছে।
ঘোষড় – নিবিড় বন।
চাড়া – যেখানে বাঘের ভয় আছে।
চাপান – নৌকা বেঁধে রাখা।
চেরাক/ চেরাগ – আলো/ কুপি/ প্রদীপ।
ছাওয়াল পীর – পাঁচ পীরের অন্যতম।
ছাপ্পর – ছই।
জিগীর – উচ্চস্বরে সৃষ্টিকর্তার নাম করা।
জোগা – অমাবস্যা-পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়ে অধিক জলোচ্ছাসের সময়।
টোপ – শিকার ধরার ফাঁদ।
দড়োল – দড়ি দিয়ে যারা পাঙ্গাস মাছ ও কাঁকড়া ধরে।
নাও/না/লাও/ল – নৌকা।
নায়ে/ লায়ে – নৌকার মাঝি।
পেরেম – কাদা।
বড় মিয়া – বাঘ।
বাওয়ালী – বনওয়ালী, যারা বনে সবসময় থাকে ব্যবসার জন্য।
বাদা – জঙ্গল/বন।
বেগোম – নদীর প্রতিকূল স্রোত।
ভাটি – বাংলার দক্ষিণাংশ/ ভাটির দেশ।
ভাটিয়াল – দক্ষিণ দেশী।
মাছি – দুশমন-দস্যু।
মাহিন্দর – লবণ তৈরী করার মজুর।
মোলাঙ্গী/ মোলঙ্গ – যারা লবণ প্রস্তুত করে।
লগি – নৌকা চালাবার বাঁশের লম্বা লাঠি।
শাকরেত – শিষ্য।
শিরা – নদীর প্রধান স্রোতধারা।
শুলো – সুন্দরী, সাল প্রভৃতি গাছের গোড়া থেকে ওঠা সুঁচালো কাণ্ড।
সাঁই – আড্ডা।
সোরা – অতি বড় গাছের ভিতরে খোল হয়ে যাওয়া।
হামর – বানর।
ছিনসে – দুখানি কাঠ ছেঁচে তার মাঝখানে দাঁড় বেঁধে দাঁড় টাকা হয়। তাকে ছিনসে বলে। (সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর- খুলনার ইতিহাস অবলম্বনে)
সমাপ্ত।
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। অবস্থান-বাগেরহাট।