আন্তর্জাতিক আইন এবং ইসরায়েলের অবিরাম গণহত্যা
জাকিয়া আফরিন
সকল আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা অগ্রাহ্য করে ইসরাইল দশকের পর দশক ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর দখলদারিত্ব ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ অক্টোবর থেকে তারা সেখানে শুরু করেছে ভয়াবহ গণহত্যা। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালত ইসরাইলকে গণহত্যা থামাতে বলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এর প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি করতে বলেছে, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ করেছে। কিন্তু তারপরও ইসরাইল গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে এবং এর সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে আরও সংঘাত বিস্তৃত হচ্ছে। তাহলে আন্তর্জাতিক আইন কী কাজ করে কিংবা জাতিসংঘ দিয়ে কী হবে এই প্রশ্নটিই বারবার উঠছে। এই বিষয়টিই এই লেখায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন কি সত্যিকার অর্থে কোনো আইন? এ প্রশ্ন আমাদের মনে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি করে জাগছে। দু-বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ইউক্রেনে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ইতিহাসের ভয়ংকর একটি গণহত্যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি ফিলিস্তিনে। আজকের হিসাবমতে (এপ্রিল ৭ ২০২৪), অক্টোবর ৭-এর পর থেকে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ; এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ নারী ও শিশু।
একটি সন্ত্রাসী হামলার জবাব হিসেবে ইসরায়েল এই পর্যায়ের আগ্রাসন শুরু করে এবং সেই জবাবকে এ মুহূর্তে বলা হচ্ছে ‘ফিলিস্তিনি জাতিকে নির্মূল করে দেওয়ার অভিযান’। এই বক্তব্যকে আবেগময় যুক্তিহীন কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধাস্ত্র (আইনি এবং বেআইনি) ব্যবহারের পাশাপাশি ইসরায়েল সৃষ্টি করেছে তীব্র খাদ্যসংকট, ধ্বংস করেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা। ইসরায়েল সরকারের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার কথা, ধ্বংস করার পরিকল্পনা। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানবৃন্দ, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, মানবাধিকার কর্মী, আইন বিশেষজ্ঞ অনেকে বিবৃতি দিয়েছেন, অনুরোধ করেছেন; কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্রকে তার ধ্বংসলীলার পথ থেকে এক চুলও নড়াতে পারেননি। এই তো প্রথম নয়, ইসরায়েল ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়াই। তাই এই প্রশ্ন যথাযোগ্য যে আন্তর্জাতিক আইন কি সত্যিকার অর্থে কোনো আইন?
সে জায়গা থেকেই শুরু করি।
সহজ কথায় বলতে গেলে, আইন সার্বভৌম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। আইনের মূল উপাদান হচ্ছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কোনো প্রতিষ্ঠান, নিয়মনীতি, নিয়ম ভঙ্গের সুস্পষ্ট পরিণতি। আন্তর্জাতিক আইনের বেলায়ও একই উপাদান প্রয়োজন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা দেখাও যায়। তবে বিশেষ একটি পার্থক্য হলো, আন্তর্জাতিক আইন তৈরি হয় বিভিন্ন উৎস থেকে এবং নিয়মভঙ্গের সুস্পষ্ট পরিণতি না-ও থাকতে পারে।
দু-একটি উদাহরণ দিয়ে বলি:
বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য। নিয়মানুযায়ী বিধিনিষেধ মেনে অন্যান্য দেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে এ দেশের। কিন্তু নিয়মের বাইরে কিছু হলে, শাস্তিস্বরূপ বাংলাদেশ থেকে কোনো কিছু রপ্তানিতে আপত্তি করতে পারে অন্যান্য দেশ। তাই ইউরোপের দেশগুলো চাইলে চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ তুলে। নব্বই দশক থেকে শুরু করে এই হুমকি বাংলাদেশের বাণিজ্যে ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে বিভিন্ন সময়। রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধে নির্দেশ দিয়েছে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ২০২২ সালের ১৫ মার্চ; এই পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া কোনোরকম বাধা ছাড়াই। বর্তমানে মিয়ানমার ও ইসরায়েলের প্রতি আদেশ রয়েছে গণহত্যা প্রতিরোধ করার– বাস্তবায়নের কথা ভিন্ন।
আর একটি পার্থক্য হলো বিভিন্ন দেশ বেছে নিতে পারে কোন আন্তর্জাতিক আইন তারা মেনে চলবে এবং কোন আইন বর্জন করবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক যে চুক্তি ১৯৮৯ সালে প্রণীত হয়েছে, তার সদস্যসংখ্যা মাত্র ২২। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। আবার নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে যে চুক্তি, বাংলাদেশসহ অসংখ্য সদস্যদেশ সেই চুক্তির ধর্মসংক্রান্ত বৈষম্যহীনতা নিয়ে যে অনুচ্ছেদ, তাকে গ্রহণ করেনি। একজন নাগরিক দেশের সড়ক আইন মেনে চলবে কিন্তু কর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাবে, তা কখনো ভাবা যায়!
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক যে চুক্তি ১৯৮৯ সালে প্রণীত হয়েছে, তার সদস্যসংখ্যা মাত্র ২২। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। আবার নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে যে চুক্তি, বাংলাদেশসহ অসংখ্য সদস্যদেশ সেই চুক্তির ধর্মসংক্রান্ত বৈষম্যহীনতা নিয়ে যে অনুচ্ছেদ, তাকে গ্রহণ করেনি।
দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের সঙ্গে এই আন্তর্জাতিক আইনের পার্থক্য এখানেই। একজন নাগরিক নিজের ইচ্ছেমতো আইন মেনে চলতে পারে না। তাকে সব আইন মেনে নিতে হয়। তবে দেশের দুর্নীতিপরায়ণ ধনী মানুষের মতো আন্তর্জাতিক পরিসরেও ক্ষমতাবানরা ভিন্ন মর্যাদা পেয়ে থাকেন। ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভেবে দেখলে, এই কথার সত্যতা যাচাই হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওপর জাতিসংঘ শাস্তি আরোপ করলেও, ইসরায়েল এ পর্যন্ত কোনো নিয়মভঙ্গের তালিকায় আসেনি। এর জন্য প্রভাবশালী নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলোই দায়ী।
এরপর বলতে হয় প্রথার কথা। চুক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎস প্রথা। যে প্রথাকে বিশ্বজুড়ে আইনের মতো মেনে চলা হয়, যেমন: নির্বিচারে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না, আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া, নাগরিক সুবিধা দেওয়ার বেলায় বৈষম্য না করা–এমনই নানা বিধান। তবে প্রথা নিয়েও বিতর্ক হয় এবং হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ড্রোনের সাহায্যে নিজেদের শত্রুপক্ষকে অহরহ আক্রমণ করে। এই কি তবে প্রথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সার্বভৌমত্বকে পাত্তা না দিয়ে অনেক বছর ধরে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে বাস করা মানুষকে (সন্ত্রাসী বলে অভিযোগ করে) বিচারের নামে হত্যা করে আসছে। তবে কি তারা একেই প্রথা বলে দাবি করবে?
সার্বভৌমত্বকে পাত্তা না দিয়ে অনেক বছর ধরে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে বাস করা মানুষকে (সন্ত্রাসী বলে অভিযোগ করে) বিচারের নামে হত্যা করে আসছে। তবে কি তারা একেই প্রথা বলে দাবি করবে?
এই অনুষঙ্গ মনে রেখে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে আসি। আন্তর্জাতিক আইনের কয়েকটি বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি–
ফিলিস্তিন কি একটি রাষ্ট্র?
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী? রাষ্ট্র চারটি উপাদানের সমষ্টি। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, নির্দিষ্ট জনসংখ্যা, সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা। একমাত্র স্বীকৃতি বিষয়টি ফিলিস্তিনের বেলায় গোলমেলে। ভূখণ্ড এবং জনসংখ্যা সম্পর্কে দ্বিমত থাকলেও, এর অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সার্বভৌম ক্ষমতাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ১৯৮৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ১৩৮ রাষ্ট্র স্বীকৃতিও দিয়েছে ফিলিস্তিনকে। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ স্বাধীনতা মেনে না নিলেও, বিভিন্ন সংস্থায় সদস্যপদ রয়েছে ফিলিস্তিনের। সাধারণ পরিষদ রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণের পরামর্শ দিলেও নিরাপত্তা পরিষদে এই নির্দেশনার পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও ফিলিস্তিন নিয়ে আমরা এখনো এই প্রশ্নের জবাব খুঁজি।
এই প্রসঙ্গক্রমেই চলে আসে স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকারের কথা। আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন আত্মনিয়ন্ত্রণ বা self determination-কে মোটামুটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে। যে কোনো চিহ্নিত জনগোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় ধারণ করতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত হংকং, মাকাও, পাপুয়া নিউ গিনি, সাবা সার্বাক, দক্ষিণ থাইল্যান্ড, মিন্দানাওর মতো অঞ্চলের কথা। একই সুরে চলে আসতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথাও। যদিও দাবির সঙ্গে চুক্তিতে পাওয়া অধিকারের দূরত্ব অনেকখানি।
আন্তর্জাতিক আইন দেশ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে স্বায়ত্তশাসনের কথাও উল্লেখ করেছে। এই অধিকারের পথ উন্মুক্ত শুধু সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য ভিন্ন জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর জন্য; যারা রাষ্ট্রের নির্যাতন, অবহেলা এবং হিংস্রতার শিকার হয়েছে। তবে তা পরিষ্কার করে বলেনি রাষ্ট্রের কোনো অংশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে কি না। মূল রাষ্ট্রকে অবশ্যই এই পদক্ষেপের সঙ্গে একমত হতে হবে কিংবা কোনো সমঝোতায় আসতে হবে। বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠা রাষ্ট্রের অন্যতম উদাহরণ। ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি পেলেও ইসরায়েল এর অনুমতি পায়নি।
দখলদারিত্ব সম্পর্কিত আইন
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা (West Bank, Gaza strip) নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এই সময়ে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমের কিছু অংশ নিজের দখলে নেয় এবং এসব জায়গা নিজেদের অধিকারে শাসন করতে থাকে।
১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ও পরে ইসরায়েল বিভিন্ন সময় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ফিলিস্তিনের অংশ দখল করতে থাকে। ১৯৯০ সালে অসলো চুক্তির পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। দখলকৃত অংশ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং ইসরায়েল দ্বারা শাসিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু মূল সার্বভৌমত্ব রয়ে যায় ইসরায়েলের কাছে। চুক্তির পর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং ফিলিস্তিনকে ঐতিহাসিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ইসরায়েল দাঁড় করিয়েছে দেওয়াল।
২০১৩ সালে জাতিসংঘের নির্দেশনায় পরিচালিত এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্থানীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড এ ধরনের দখলদারি মানসিকতায় ইন্ধন জোগায়।
- এবার দেখা যাক দখলদারি শক্তি বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কী বিধান প্রণয়ন করেছে এবং ইসরায়েল সম্পর্কেই-বা কী বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের মানবাধিকার আইন ও যুদ্ধকালীন মানবতাবিষয়ক আইন প্রযোজ্য বলে মনে করছি। বলা বাহুল্য যে মানবাধিকার আইনের একটি অংশই দখলদারি সংক্রান্ত।
- দখলদারি শক্তি নিজের জনগোষ্ঠী দখল করা অঞ্চলে নিয়ে আসতে পারবে না এবং সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পারবে না।
- দখলদারি শক্তির দায়িত্ব বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করা, তাদের যথাসম্ভব অধিকার ক্ষুণ্ন না করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- দখলকৃত ভূমিতে কোনো অস্থায়ী বা স্থায়ী পরিবর্তন করতে পারবে না। একমাত্র নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে ভূমিতে কোনো পরিবর্তন হলে, তা ক্ষমাযোগ্য।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে, ইসরায়েল তার দায়িত্ব শুধু এড়িয়ে চলেনি; বরং আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্থাপনা তৈরি করেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে, ইসরায়েল তার দায়িত্ব শুধু এড়িয়ে চলেনি; বরং আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্থাপনা তৈরি করেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে।
ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার
আন্তর্জাতিক আইনে আত্মরক্ষার অধিকার একটি স্বীকৃত অধিকার। জাতিসংঘের মূল সনদে (ART 51) এই অধিকার পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে, সেখানে দ্বিধার কোনো অবকাশ নেই যে ইউক্রেন তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবি রাখে। জাতিসংঘের কোনো সদস্যের ওপর আঘাত এলে এককভাবে সেই সদস্য কিংবা অন্যদের সঙ্গে মিলে তার সহমত আত্মরক্ষার অধিকার পালন করতে পারবে।
অক্টোবরের ৭ তারিখের ঘটনার পর ইসরায়েল এবং তার বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় নানা দেশ এই অধিকারের কথা বারবার উল্লেখ করছে। এই যুক্তির সপক্ষে কিংবা বিপক্ষে মতামত কিংবা যুক্তির সপক্ষে সব কটি মতামত রাজনৈতিক বলা যায়। যদি ইরাকের ওপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কথা ভাবি, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। আত্মরক্ষার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ইরাকের ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধ সম্পর্কে তারা জাতিসংঘের অনুমোদন পায়নি কিংবা নিরাপত্তা পরিষদের কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি। নিজেদের অভিনব ব্যাখ্যায় নতুন এক শব্দ তারা নিয়ে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক আইনের গবেষণায় Pre-emptive Self defence যাকে বলা যেতে পারে প্রত্যাশিত শো হতে যাচ্ছে সেই ঘটনার। অর্থাৎ কাল্পনিক আঘাতের জবাব দেওয়ার জন্য আত্মরক্ষা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই রাজনৈতিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত আইনি প্রচেষ্টা হয়নি। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জাতিসংঘ সনদ অনুসারে এ যুদ্ধটি বেআইনি। যদিও যা হওয়ার ততক্ষণে হয়ে গেছে।
ইসরায়েলের যুক্তিটিও রাজনৈতিক। তবে তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সহজে পার পেয়ে যাবে? খুব সম্ভবত নয়। এর কারণ বেশ কয়েকটি।
> ইসরায়েল গাজাকে দেশ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। গাজার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সব চলাফেরা, জীবনযাপন এমনকি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় মজুতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। তাই এই আক্রমণকে অন্য দেশের আক্রমণ বলা যায় না।
> আঘাত করার সময় এবং এখন অবধি ইসরায়েল আন্তর্জাতিক যুদ্ধকালীন মানবতাবিষয়ক আইনগুলো ভেঙে চলেছে। যে চারটি স্তম্ভ এ আইনের ভিত্তি তা হলো:
> সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভিন্নতা বজায় রাখা
> আঘাত হতে হবে সমানুপাতিক হারে। কেউ পাথর ছুড়লে তার দিকে কামান দাগানো না করা সাধারণ জ্ঞান।
> উদ্দেশ্য হতে হবে সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করা যতটা সম্ভব সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করে
> যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে তাদের সবার সঙ্গে (সাধারণ মানুষ, যোদ্ধা, বন্দি) মানবিক ব্যবহার করা।
ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের যে নমুনা পুরো পৃথিবীর সামনে আজ প্রকাশিত, এই কোনো নিয়মেরই ধার ধারছে না তারা।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের ২০০৪ সালের রায়ের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অংশ মনে করা যায়। আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলের আত্মরক্ষার দাবি বেআইনি ঘোষণা করেছিল এই বলে যে, দখলদারি শক্তি দখলকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর আত্মরক্ষার দাবি করতে পারে না। তাই বলা যায়, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার দাবি একেবারেই রাজনৈতিক; এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলের আত্মরক্ষার দাবি বেআইনি ঘোষণা করেছিল এই বলে যে, দখলদারি শক্তি দখলকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর আত্মরক্ষার দাবি করতে পারে না। তাই বলা যায়, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার দাবি একেবারেই রাজনৈতিক; এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
এতসব আইন ভঙ্গ করেও ইসরায়েলের কোনোরকম জবাবদিহিতা এ পর্যন্ত দিতে হয়নি। অথচ তাত্ত্বিকভাবে বিবেচনা করলে ১৯৪৮ সালের পর থেকে ইসরায়েলকে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্ন করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে জাতিসংঘে। সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই দায়বদ্ধতা। আন্তর্জাতিক আইন মেনে না চলার কারণে ১৯৬৬ সালের পর থেকে ৩১টি দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে জাতিসংঘ। ইরাক, ইরান, উত্তর কোরিয়া, সুদানসহ নানা দেশের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা (অস্ত্র আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা বিষয়ে সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি) সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। এই দেশগুলোর অর্থনীতিতে কী পরিমাণ চাপের সৃষ্টি করা গেছে এই কারণে তার প্রমাণ খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হয় না। সর্বসাকুল্যে বর্তমানে ১৫টি দেশের বিরুদ্ধে নানারকম শাস্তি আরোপ করা হয়েছে। অথচ বড় ধরনের অপরাধ করেও এ তালিকায় ইসরায়েলের নাম নেই।
আন্তর্জাতিক আইন মেনে না চলার কারণে ১৯৬৬ সালের পর থেকে ৩১টি দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে জাতিসংঘ। ইরাক, ইরান, উত্তর কোরিয়া, সুদানসহ নানা দেশের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা (অস্ত্র আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা বিষয়ে সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি) সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। এই দেশগুলোর অর্থনীতিতে কী পরিমাণ চাপের সৃষ্টি করা গেছে এই কারণে তার প্রমাণ খুঁজে পেতে কষ্ট করতে হয় না। সর্বসাকুল্যে বর্তমানে ১৫টি দেশের বিরুদ্ধে নানারকম শাস্তি আরোপ করা হয়েছে। অথচ বড় ধরনের অপরাধ করেও এ তালিকায় ইসরায়েলের নাম নেই।
বর্তমানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে অভূতপূর্ব অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালত এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে, তার সবই এসেছে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোর কাছ থেকে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক দেশগুলো বরাবরের মতো সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের সব কর্মকাণ্ডে। এই প্রশ্ন মনে জাগা তাই যুক্তিযুক্ত। আন্তর্জাতিক আইন কি তবে কোনো আইন?
যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকায় এ আইনের কার্যকারিতা নির্ভর করে শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপর। নিরাপত্তা পরিষদে বসে থাকা যুদ্ধংদেহি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা দেশগুলোর ইচ্ছার কাছে জিম্মি পুরো বিশ্ব। তবু আশা করা যায়, এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। বিশ্ব নাগরিকের সচেতনতা আজ ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মানুষ ফিলিস্তিনের প্রতি অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করায় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইসরায়েল ইস্যু নিয়ে ভোট না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তারই দলের সমর্থকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সাধারণ মানুষের এই জেগে ওঠার কারণেই আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলসহ রাশিয়া, মিয়ানমার গণহত্যার দায়ে বিচারের কাঠগড়ায়। আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। ১৯৪৫ সালের নুরেমবার্গ মামলার পর প্রায় ৩৯ বছর পার হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণহত্যার বিচার দাঁড় করাতে। ইসরায়েলকে আদালতে হাজির হতে বাধ্য করে সেই বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই উদ্যোগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে বলে মনে করি।
১৯৪৫ সালের নুরেমবার্গ মামলার পর প্রায় ৩৯ বছর পার হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণহত্যার বিচার দাঁড় করাতে। ইসরায়েলকে আদালতে হাজির হতে বাধ্য করে সেই বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই উদ্যোগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে বলে মনে করি।
সময়ই বলে দেবে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের প্রভাব এড়িয়ে কতদিন ফিলিস্তিনের ওপর জুলুম চালিয়ে পার পাবে। তবু আইনের প্রতি আস্থা রেখে যাওয়াই বিজয়ের পথে যাত্রা।
(লেখাটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট এবং আইনেরকথা.কম-এর যৌথ আয়োজনে বিশেষ পাবলিক লেকচার, “আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ” থেকে সংকলিত।)
জাকিয়া আফরিন: সম্পাদক, আইনেরকথা.কম; খণ্ডকালীন শিক্ষক, গোল্ডেন গেট ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: zafrin@gmail.com
তথ্যনির্দেশ
Zakia Afrin: Transitional authority in Iraq, Vandeplas Publishers, 2009.
Rashid Khalidi: Hundred Years’ War on Palestine, Metropolitan Books; Reprint edition, 2021)
ইসরায়েল ফিলিস্তিন বিষয়ে জাতিসংঘের নীতিমালা
আদিবাসী অধিকারবিষয়ক চুক্তি (C169 – Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)
Legal Aspects of Self Determination, Hurst Hannum
Legal Consequences of the Construction of a wall in the occupied Palestinian Territory