সম্পাদকীয়
মে দিবসের এতো বছর পরেও তার প্রাথমিক দাবিগুলো বাংলাদেশে এখনও পূরণ হয়নি। বাংলাদেশে জিডিপি বেড়েছে, বৈষম্য বেড়েছে কিন্তু কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নাই। বিভিন্ন খাতওয়ারী যে মজুরি নির্ধারণ করা হয় তার পরিমাণ দারিদ্রসীমার অনেক নীচে এবং সেটাও নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। এসব নিয়ে নানা ছলচাতুরী প্রতারণা চললেও শ্রমিকদের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিব্যবস্থা সংগঠন সবই খুব দুর্বল। তাছাড়া নিয়মিত মজুরি পুনর্বিন্যাসের কথা থাকলেও কখনোই তা করা হয় না, প্রতিবারই দাবিদাওয়া আন্দোলন সংগ্রাম দরকার হয়। নিপীড়ন জখম এমনকি শ্রমিক খুনের ঘটনাও ঘটে। তারপরও মজুরি এবং অন্যান্য দাবিদাওয়া অপূর্ণই থাকে। এই সংখ্যায় পোশাক শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন ও মজুরি পরিস্থিতি আলোচনা করা হয়েছে।
সকল আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা অগ্রাহ্য করে ইসরাইল দশকের পর দশক ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর দখলদারিত্ব ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ অক্টোবর থেকে তারা সেখানে শুরু করেছে ভয়াবহ গণহত্যা। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালত ইসরাইলকে গণহত্যা থামাতে বলেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গৃহীত প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি করতে বলা হয়েছে, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ করেছে। কিন্তু তারপরও ইসরাইল গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে এবং এর সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে আরও সংঘাত বিস্তৃত হচ্ছে। তাহলে আন্তর্জাতিক আইন কী কাজ করে কিংবা জাতিসংঘ দিয়ে কী হবে এই প্রশ্নটিই বারবার উঠছে। এই প্রশ্নই এই সংখ্যায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
দখলদার গণহত্যাকারী ইসরাইলের বহিষ্কার দাবি করে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে বাংলাদেশের মানুষের খোলা চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে গত ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিন বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যা শুরুর দিন। এই দিনেই এই সময়ের আরেকটি গণহত্যার বিরুদ্ধে ঢাকায় সমাবেশ হয়। ফিলিস্তিন সংহতি কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত এই সমাবেশ শেষে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মহাসচিবের কাছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে এক খোলা চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠি এই সংখ্যায় প্রকাশিত হলো।
তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার বৈধকরণের পর অর্থনীতি রাজনীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। আর্থিক খাতের অভূতপূর্ব লুন্ঠনের নতুন পর্বে জোরজবরদস্তি ব্যাংক একীভূতকরণ করে লুটেরা অপরাধীদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। অবাধ দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার আরও বেড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের লাঠিয়াল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবাধ ক্ষমতা দেয়ার আয়োজন আরও বিস্তৃত হচ্ছে। যৌন নিপীড়কদের অপতৎপরতা বাড়ছে। তেল গ্যাস বিদ্যুত খাতে আরও সর্বনাশা চুক্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানই এখন দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সড়কে, রেলপথে, নৌপথে অকাল মৃত্যু অব্যাহত আছে ফিটনেসবিহীন গাড়ী, প্রশিক্ষণবিহীন চালক, নৈরাজ্যিক নিয়োগ, চাঁদাবাজীর রাজত্ব ইত্যাদির কারণে। জবাবদিহিহীন জবরদস্তি ক্ষমতার দাপট পুরো দেশে সর্বজনের জীবনকে সবসময়ই ঝুঁকির মধ্যে রাখছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে এখন ভূমিদস্যুদের দাপট ও সংঘাত দুটোই স্পষ্ট। নীতি নির্ধারকদের মধ্যেও তারাই ক্ষমতাশালী। রূপগঞ্জ এই ভূমিদস্যুদের দখল দাপটের একটা বড় দৃষ্টান্ত। গত নির্বাচন ঘিরে এখানে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতা- সংঘাত প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। তা প্রকাশিত হয় দুই গ্রুপের মিডিয়ার মধ্য দিয়ে। এই সংখ্যার একটি লেখায় তার একটি চিত্র উপস্থিত করা হয়েছে।
নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুতর সব আশংকা- পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি, শুকনা মৌসুমে পদ্মার পানি সংকট, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব ও খেসারত, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির ওপর বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের চাপ ইত্যাদি অমিমাংসিত রেখেই ঋণ করে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে একটি লেখায়।
বাংলাদেশের জনগণ সামরিক-বেসমারিক, গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক ইত্যাদি বহু ধরণের শাসন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থায় নাম বা খোলসের কিছু ভিন্নতা দেখা গেলেও মৌলিক নীতিতে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থেকেছে। অন্যান্য আরও অনেক দিকের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সম্পর্কিত সরকারি নীতিতে এর সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত একটি লেখা ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং জাতিগত সমস্যা : পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিপ্রেক্ষিত’ গুরুত্ব বিবেচনা করে সর্বজনকথার পাঠকের জন্য পুনপ্রকাশ করা হলো। আমরা চেষ্টা করবো নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় লেখা পুনপ্রকাশের।
এ সংখ্যাতেও কয়েকটি ধারাবাহিক লেখা ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৪’, ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১২’, ‘মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৬’, ‘আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন – ৩’ প্রকাশিত হলো। এছাড়া ‘সমকালীন বাংলাভাষার চলচ্চিত্রে চিত্রিত ভাবনা, নির্মাণভঙ্গি, বিষয় আশয়’ নিয়ে একটি লেখা, প্রীতি উরাং হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত দাবি করে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হলো। আরও থাকছে গত কয়েক মাসে সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবরের নির্বাচিত অংশ।
কাগজসহ প্রকাশনা শিল্পের বহুধরনের ব্যয়বৃদ্ধির চাপে বাধ্য হয়ে সর্বজনকথার দাম বাড়াতে আমরা বাধ্য হলাম। সর্বজনকথা একেবারেই বিজ্ঞাপন নির্ভর নয়, পুরোপুরি পাঠকদের ওপর এই প্রকাশনার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এছাড়া আমরা গবেষণা প্রশিক্ষণ, ধারাবাহিক সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন শুরু করেছি। আমরা এসব উদ্যোগে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করি।
আনু মুহাম্মদ
২৭ এপ্রিল ২০২৪