বাংলাদেশে ‘পারমাণবিক মর্যাদা’ কেন একটি বিভ্রম?

বাংলাদেশে ‘পারমাণবিক মর্যাদা’ কেন একটি বিভ্রম?

মোশাহিদা সুলতানা

নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েই রয়েছে গুরুতর সব আশংকা যার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো- পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি, শুকনা মৌসুমে পদ্মার পানি সংকট, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব ও খেসারত, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির ওপর বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের চাপ ইত্যাদি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুরেই আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটমের প্রতি। নির্মাণাধীন প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরী ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয়গুলো অমিমাংসীত রেখেই ঋণ করে দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন মোশাহিদা সুলতানা।

এপ্রিলের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটমকে রূপপুরে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন।  অনেকের কাছেই এটি ছিল এক অপ্রত্যাশিত বিস্ময়। খবরটি এমন এক সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের জন্য নতুন করে নিউক্লিয়ার প্রকল্পের মতো ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্পের জন্য ঋণ করা একটি প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে একদিকে যখন সরকার জ্বালানির অভাবে লোডশেডিং বন্ধ করতে পারছে না, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করছে; আবার অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্নগামী মানব উন্নয়নের সূচক এবং ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখন নতুন করে ঋণ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো একটি উচ্চাভিলাষী ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা।

সিপিডির সাম্প্রতিক একটি বিশ্লেষণ থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে যে সংকটের চিত্র উঠে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন ঋণ খোঁজা শুরু করেছে। এ ছাড়া বিদেশি উৎস থেকে তেল ও এলএনজি কিনতে উচ্চ সুদে নতুন ঋণও নিতে হচ্ছে  বাংলাদেশকে। দেশ এখন একটি বিশেষ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের চাপ উভয়ই দ্রুত গতিতে বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ হবে বা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন উৎস কী হতে পারে এ নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের  কি সত্যিই আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে? নাকি সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পেছনে আংশিকভাবে হলেও জাতীয় মর্যাদা বা প্রেস্টিজ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে?

‘পারমাণবিক মর্যাদা’ বলতে সরকারগুলো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের কারণে উচ্চ মর্যাদা লাভকে বোঝায়। পারমাণবিক মর্যাদায় বিশ্বাসীরা মনে করেন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে তাদের দেশ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে অগ্রগামী। এই এগিয়ে থাকা তাদেরকে অস্ত্র ব্যবহারে একচেটিয়া ক্ষমতা দেয়।  এই অস্ত্র না থাকলে অন্য দেশগুলো এই বিশেষ ক্ষমতা চর্চা করতে পারে না। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত দেশগুলো এটিকে মর্যাদার প্রতীক মনে করার আরেকটি কারণ হলো এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নেতৃত্বের ইমেজ তৈরি করে, যা ব্যবহার করে অনেক সময় তারা অন্য দেশকে হুমকি দিতে পারে, অথবা সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণকে ঠেকানোর জন্য পারমাণবিক অস্ত্রকে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে প্রদর্শন করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, বিভিন্ন দেশ মর্যাদা অর্জনের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। ১৯৯৫ সালে হার্ভার্ডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালেস্টার ইয়ান জনস্টনের গবেষণায় দেখা গেছে যে চীনে মাও সে তুং-এর পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্তটি আংশিকভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি এবং গোয়েন্দা নির্বাহী গ্রেগরি এফ ট্রেভারটন তার বই ‘ফ্রেমিং কমপেলেন্ট স্ট্র্যাটেজিসে’ চন্দ্রশেখর রাও-এর উক্তি ব্যবহার করে উদাহরণ দিয়েছেন যে কেন  ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম বিস্ফোরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্র প্রদর্শন করে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি। ১৯৭১ সালে প্রিন্সটন একাডেমিক উইলফ্রেড কোহল ফ্রান্সের শার্ল দা গল সম্পর্কে এবং ২০০৬ সালে ইয়েলের অধ্যাপক ব্যারি ও’নিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে আলোচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে পারমাণবিক মর্যাদা এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব অর্জনের জন্য তারা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩২টিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দুটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ বাদ দিলে বাকি ৩০টি দেশের অধিকাংশই উচ্চ বা উচ্চ-মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। ভারত ও  পাকিস্তানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জনের  কৌশলের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন, ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পারমাণবিক কর্মসূচির একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত ১৯৫০-এর দশকে কানাডা থেকে প্রথম পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর কিনেছিল।

একইভাবে, মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে ১৯৫৫  সালে চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির সূচনা হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়ার পর ভুট্টোর নির্দেশনায় পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই দেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র ও পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝোঁকার পেছনে একটি সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। তারা জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং অস্থির ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তাদের জাতীয় পরিচয় জাহির করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর এ জন্য তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অর্থাৎ সংঘাতের আশঙ্কা এই দেশগুলোকে তাদের জাতীয় এবং সামরিক পরিচয় গঠন এবং দৃঢ় করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে পারমাণবিক কর্মসূচি ও পরিবর্তী সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পাশাপাশি চলতে থাকে।

বাংলাদেশ যখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কিছু স্বার্থান্বেষী মহল একে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশের পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা নেই এবং এটি এ দেশের উদ্দেশ্যও নয়। বাংলাদেশ স্রেফ রাশিয়ার প্রযুক্তি দেশে আমদানি করে তা ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এতে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা কিছুমাত্র বাড়েনি। বরং বলা যায়, বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার নামে বাংলাদেশের পারমাণবিক খাতে ভারতের হস্তক্ষেপের সুযোগ বেড়েছে। ভারত সেই সুযোগ ব্যবহার করবে কি করবে না সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

যে গোষ্ঠী পারমাণবিক মর্যাদাকে এত বড় করে হাজির করছে তারা ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত হওয়া পারমাণবিক মর্যাদার ধারণাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। ঐতিহাসিকভাবে পারমাণবিক মর্যাদার ধারণাটি বিদেশ থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং দক্ষতা আমদানি করার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং তা অস্ত্র এবং শক্তি উৎপাদনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের মতো পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য অনির্দিষ্টকাল ধরে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে সেই মর্যাদা দাবি করা আসলে অর্থহীন। বাংলাদেশ এবং রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতার প্রতিফলন নয়। এবং এটি দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রযুক্তিগত সক্ষমতারও প্রমাণ নয়।

বাংলাদেশের মতো পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য অনির্দিষ্টকাল ধরে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে সেই মর্যাদা দাবি করা আসলে অর্থহীন। বাংলাদেশ এবং রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতার প্রতিফলন নয়। এবং এটি দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রযুক্তিগত সক্ষমতারও প্রমাণ নয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়ের ৯০ শতাংশ রাশিয়া ঋণ আকারে প্রদান করছে। অর্থাৎ, রাশিয়া এই প্রকল্পে বাংলাদেশকে ধার দিচ্ছে যেন বাংলাদেশ রাশিয়ার পারমাণবিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারে এবং রুশ পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীদের নিয়োগ করতে পারে। এই তথাকথিত আর্থিক সক্ষমতা, বাস্তবে, আমাদের নাগরিকদের জন্য ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা। এবং তারপর, একবার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হলে, যতক্ষণ-না বাংলাদেশ নিজেই প্রকল্পটি চালানোর সক্ষমতা লাভ করে ততক্ষণ রাশিয়া এটি পরিচালনা করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে ভারত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় মানবসম্পদ উন্নয়নে  ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখাটা ভারতের জন্য গর্বের বিষয় হতে পারে, কিন্তু ভারতের কাছ থেকে মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ নেওয়া কি বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে সেরকম  মর্যাদার বিষয়?

তাই প্রশ্ন জাগে: এই পারমাণবিক মর্যাদা কি কোনো মোহ বা বিভ্রম? এই তথাকথিত মর্যাদা থেকে আসলে কে বা কারা উপকৃত হচ্ছে?

বাংলাদেশ, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে ভারত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় মানবসম্পদ উন্নয়নে  ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখাটা ভারতের জন্য গর্বের বিষয় হতে পারে, কিন্তু ভারতের কাছ থেকে মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ নেওয়া কি বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে সেরকম  মর্যাদার বিষয়?

বর্তমান সময়ে আধুনিকতা এবং উন্নয়ন প্রদর্শনের জন্য ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প নির্মাণ একটি কৌশল মাত্র। অনেক উন্নয়নশীল দেশে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই উন্নয়নকে দৃশ্যমান করার জন্য কৌশল হিসেবে বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যদিও এই প্রকল্পগুলো থেকে প্রাপ্ত সুবিধাদি খুব কমই সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছায়।

একটি দুর্বল রাষ্ট্রের জন্য নাগরিকদের সত্যিকারের উন্নয়ন নিশ্চিত করার চেয়ে উন্নয়ন সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করা অধিকতর সহজ। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ থেকে জনগণ যে সুফল পেতে পারত তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে উন্নয়ন সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করে তাদেরকে মোহাবিষ্ট রাখা একটি সুপরিচিত কৌশল হিসেবে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা রূপপুরের উদাহরণ টেনে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায়, যখন বাস্তবে, আমরা কেবল অন্য দেশ থেকে আনা প্রযুক্তি এবং দক্ষতা নিয়ে গর্ব করি।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে এমন ৩২টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশ পারমাণবিক শক্তি থেকে তাদের মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশেরও কম উৎপাদন করে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে জাপান, জার্মানি, চীন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও ভারত। পারমাণবিক বিদ্যুৎ যদি এতই উপকারী হয়, তবে কেন এই দেশগুলো আরও বেশি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে না? উত্তরটা আসলে খুব সহজ। এমনকি প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও ঝুঁকি, অত্যধিক খরচ এবং ভবিষ্যৎ তেজস্ক্রিয় দূষণের কারণে পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভর করা থেকে বিরত থাকে। তারা ভালো করে জানে যে, পারমাণবিক বর্জ্য থেকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে তেজস্ক্রিয় দূষণের বোঝা বহন করতে বাধ্য করতে পারে। পাশের দেশ ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির অবদান মাত্র ৩.১ শতাংশে ঠেকেছে?  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হলে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক বিদ্যুতের অবদান প্রায় ৭ শতাংশ হবে। দ্বিতীয়টি নির্মাণ করলে এর অবদান আরও বৃদ্ধি পাবে।

প্রথম ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। ২০ বছরের পরিশোধের সময়কাল ২০২৭ সালে শুরু হবে, প্রথম তিন বছরের জন্য প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে দিতে হবে এবং তার পরের বছরগুলোতে এর চেয়ে কিছুটা কম করে দিতে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম এবং দ্বিতীয় ইউনিট দুটোর নির্মাণকাজ যথাক্রমে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০২৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত নির্মাণের ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, নির্মাণকাজ সমাপ্তির সম্ভাব্য নতুন তারিখ ঠিক করা হয়েছে ২০২৬ সাল।

একটি দেশ প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগেই কীভাবে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বিবেচনা করতে পারে তা সত্যিই এক বিস্ময়। যখন দেশটি জানে না প্রথমটি সফলভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে কি না, তখন দ্বিতীয়টির সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে তো প্রশ্ন থাকারই কথা।  আমরা নিশ্চিত নই যে বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হতে দু-তিন বছর লাগবে না তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে। এই সমস্ত অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে, কীভাবে একটি দেশ দ্বিতীয় আরেকটির ঝুঁকি নিতে পারে?

হাস্যকরভাবে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা পারমাণবিক মর্যাদার একটি বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞা মানুষের কাছে হাজির করেছে। পারমাণবিক মর্যাদার মোহে ভরসা না করে বাংলাদেশকে তার প্রকৃত সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে হবে। সাগরে গ্যাস উত্তোলনে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন হতে পারে তেমন একটি উদ্যোগ। সারা বিশ্ব আজ সৌর, বায়ু ও সবুজ হাইড্রোজেন সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকেছে। বিদেশ থেকে আমদানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকার বদলে নিজেদের দেশে এসব প্রযুক্তির সক্ষমতা তৈরি তাই এখন সময়ের দাবি। 

মাও সে তুং এবং জওহরলাল নেহেরুর সময় থেকে, বিশ্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, মর্যাদা এখন অত্যাধুনিক সৌর, বায়ু এবং সবুজ হাইড্রোজেন প্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করার ক্ষমতা দ্বারা পরিমাপ করা হয়। হাস্যকরভাবে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা পারমাণবিক মর্যাদার একটি বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞা মানুষের কাছে হাজির করেছে। পারমাণবিক মর্যাদার মোহে ভরসা না করে বাংলাদেশকে তার প্রকৃত সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে হবে। সাগরে গ্যাস উত্তোলনে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন হতে পারে তেমন একটি উদ্যোগ। সারা বিশ্ব আজ সৌর, বায়ু ও সবুজ হাইড্রোজেন সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকেছে। বিদেশ থেকে আমদানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকার বদলে নিজেদের দেশে এসব প্রযুক্তির সক্ষমতা তৈরি তাই এখন সময়ের দাবি। 

মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: moshahida@du.ac.bd

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •