পাহাড়ে-সমতলে হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি

পাহাড়ে-সমতলে হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি

“ডিসেম্বর মাস একদিকে যেমনি আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের মাস, তেমনি স্বাধীন চিন্তার ধারক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মাসও। এরকম একটা সময়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্টো যাত্রার যেন এক পরিপূর্ণতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি , কণ্ঠরোধ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড অথবা হত্যাচেষ্টার মত বিভিন্ন মর্মান্তিক এবং অপরাধমূলক ঘটনার মধ্য দিয়ে – হোক সেটা পাহাড়ে, সমতলে অথবা হোক তা রাজনৈতিক ময়দানে বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার রাত ১০টার দিকে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বিপুল চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহসভাপতি লিটন চাকমা, পিসিপির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা ও ইউপিডিএফের সদস্য রুহিনসা ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবারের আরেকটি সংবাদে দেখা যায়, রাজু ভাস্কর্যে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতাকর্মীদের ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীরা বেধড়ক মারধর করে।

আবারো, একই কায়দায় ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ এর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে বেছে বেছে শারীরিকভাবে আক্রমন করে। এতে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি মেঘমল্লার বসু (২৭), সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ (২৫), ঢাকা মহানগর সহসাধারণ সম্পাদক তাজমির তাজওয়ার শুভ্র (২৬) ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সদস্য শাহরিয়ার শিহাব (২৩) গুরুতর আহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের বিভাগে শিক্ষার্থী মেঘমল্লার বসুর চোখ লক্ষ্য করে ধারালো কোনকিছু দিয়ে নৃশংসভাবে আঘাত করা হয়। তার বাম চোখের অবস্থা বেশ আশংকাজনক।

এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে এটা নির্দেশ করছে যে, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার পাহাড় কিংবা সমতলের ভিন্ন পরিচয়, ভিন্ন চিন্তার নাগরিকদের কিংবা ক্ষমতাসীনদের তাবেদার নন, এরকম সকলকে শত্রু বা প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করছে এবং তাদের স্বাধীন কণ্ঠস্বর, এমনকি প্রয়োজনে শারীরিক অস্তিত্ব বিপন্ন করতে সদা প্রস্তুত! এই বিরাজমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদদের আত্নত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাথে তো সাংঘর্ষিক তো বটেই, আমাদের সাংবিধানিক অধিকারকেও হরণ করছে প্রতিদিন।

এরকম পরিস্থিতিতে সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগ্রহী নন। আর হলগুলোতেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চোখ নষ্ট করার মত গুরুতর অপরাধকে বেমালুম নাই করে দেওয়ার ব্যাপারে সব সময় তৎপর! এটা পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক এবং সুস্থ বৈশিষ্ট্যের সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এরকম শিক্ষা এবং শিক্ষার্থী-অবান্ধব প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেশ রক্ষাকারীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং এর আলাপ তোলেন তখন তা জনপরিসরে হাস্যরসের জন্ম দেয়।

এরকম নাগরিক স্বার্থবিরোধী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা, সর্বজনের শিক্ষাব্যবস্থাপনা যেখানে সচল এবং সর্বগ্রাসী, সেখানে ন্যায়-বিচার চাওয়া বা ন্যায্যতা দাবী করাটাও বর্তমান সময়ে অরণ্যরোদন অথবা বোধহীন শক্ত অনড় পাথরে মাথা ঠোকার মতই। তাই আমরা এরকম পরিস্থিতিতে শুধুই নিন্দা জ্ঞাপন করতে পারছি এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি । একই সাথে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি, আমরা আমাদের স্বাধীন চিন্তা এবং মতপ্রকাশের লড়াইটা ধারাবাহিকভাবে জারি রাখব, সত্যিকারের স্বাধীন এবং ন্যায্য বাংলাদেশ বিকাশের স্বপ্ন নিয়ে।”

১৭ই ডিসেম্বর ২০২৩

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •