সর্বজনীন শিক্ষা: নীতি ও সংস্কারের গতিমুখ-২

সর্বজনীন শিক্ষা: নীতি ও সংস্কারের গতিমুখ-২

কাবেরী গায়েন

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এক কঠিন সংকটে। সংখ্যাবৃদ্ধির উচ্ছ্বাসের নীচে চাপা পড়ে আছে এর ভয়াবহ অবনতির দশা। শিক্ষানীতি একটি দেশের শিক্ষাদর্শনের আইনি ও প্রায়োগিক কাঠামো। বাংলাদেশের শিক্ষাদর্শন ঔপনিবেশিক অতীতের সাথে সাম্প্রদায়িক ও বাণিজ্যিক কাঠামোতে বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এক অস্বস্তিকর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘সর্বজনীন’, ‘গণমুখী’ এবং ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ শিক্ষানীতির দাবি বহুদিনের হলেও বাস্তব চিত্র ক্রমেই আরও দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিষয় একবাক্যে বলা  সহজ, কিন্তু বিষয়টি অনুধাবন করা এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা এক দীর্ঘ বিপ্লবের সমান নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও প্রতিজ্ঞা দাবি করে। এই লেখায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে প্রণীত শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এবং একইসঙ্গে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় নিয়েও আলোচনা উত্থাপন করা হয়েছে।

স্বাধীনতার ৫২ বছরে শিক্ষানীতিসমূহ থেকে কী পাওয়া গেল?

১। শিক্ষা সর্বজনীন হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক মুখে বলা হলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেনি। কোনো শিক্ষানীতিই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করেনি। কুদরত-এ-খুদা কমিশনও নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও শিক্ষার অধিকার আইন দিয়ে সুরক্ষিত নয় বলেই প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষরতার বাইরে, যে আলোচনাটি হয় না বললেই চলে।

২। প্রাথমিকেই বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। ১৯৭৫-পরবর্তী প্রতিটি শিক্ষানীতিতেই বেসরকারি খাতে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিয়ন্ত্রণহীন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষারও ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা ১২ রকমে দেওয়া সম্ভব। এসব ধারা থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেটেও রয়েছে মানের তারতম্য। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। কোনো কোনো মাধ্যমে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষাখাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে না।

৩। মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায়ও রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেদে বিপুল তারতম্য। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একই শহরে একই কারিকুলামের আওতায় কোথাও কয়েক হাজার টাকার বেতনে শিক্ষা কিনে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি অল্প টাকায় মলিন শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।

৪। ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশ শিক্ষা ও পরিসংখ্যানব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৯ হাজার ২৬৮টি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ জন। ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে দেওয়া শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির তথ্যানুয়ায়ী কওমি মাদ্রাসা আছে ১৯ হাজার ১৯৯টি। এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। যদিও শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা দাবি করেন, এই সংখ্যা আসলে অনেক বেশি। কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন-২০১৮-এর জন্য ৬টি শিক্ষাবোর্ডকেও স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। এছাড়াও রয়েছে হাফেজিয়া, ইবতেদায়ি, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা বোর্ডের আওতায় শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থী। সঠিক শিক্ষার্থী সংখ্যা জানা যায়নি। এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বিশ্বাসভিত্তিক এবং কারিকুলামের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।

বর্তমানে দেশে ৯ হাজার ২৬৮টি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ জন। ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে দেওয়া শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির তথ্যানুয়ায়ী কওমি মাদ্রাসা আছে ১৯ হাজার ১৯৯টি। এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ লাখের মতো।

৫। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কারিকুলামও সরকারি নির্দেশ মেনে চলে না। ব্যানবেইস-এর ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৪২টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের মতে এই সংখ্যা ৩৫০টি। কিন্ডারগার্টেন স্কুল বাদেই শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তিন লাখের মতো। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সাড়ে চার হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ। ক্যামব্রিজ বা এডেক্সেল কোনো ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই দেশীয় কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়নি। লক্ষ্যই হলো বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং সেখানে বসতি গড়ার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

ব্যানবেইস-এর ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৪২টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের মতে এই সংখ্যা ৩৫০টি। কিন্ডারগার্টেন স্কুল বাদেই শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তিন লাখের মতো। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সাড়ে চার হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ।

৬। শিক্ষা মানের অবনমন। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বাড়ছে প্রতিবছর। সবশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সাত এবং তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের সাক্ষরতা ৭৪.৬৬ শতাংশ। এই হার পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দশমিক সাত শতাংশ বেশি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরেই ক্রমবর্ধমান বিস্তার সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাসংকট নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। বিশেষ করে শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। এই উদ্বেগ অকারণ নয়। ২০২২ সালে ইউনিসেফ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ে তথ্যপত্র (ফ্যাক্ট শিট) ২০২০। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় পাঠদক্ষতা রয়েছে, আর সংখ্যাবিষয়ক কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা রয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর। কেবল প্রাথমিক শিক্ষায় নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার বিপুল ঘাটতি। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে। ফলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যতই বাড়ুক, কিংবা বাড়ুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা, জনমনে শিক্ষার মান, মানসম্মত শিক্ষায় সাধারণের প্রবেশগম্যতা এবং সর্বোপরি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় পাঠদক্ষতা রয়েছে, আর সংখ্যাবিষয়ক কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা রয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর। কেবল প্রাথমিক শিক্ষায় নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার বিপুল ঘাটতি। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে।

৭। বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়। বেশিরভাগ সরকারি স্কুলেই বিজ্ঞান শিক্ষার অবকাঠামো তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানী তৈরি করার জন্য কোনো সরকার আগ্রহ দেখিয়েছে মর্মেও জানা নেই। অনেক সরকারি স্কুলেই বিজ্ঞান শেখানোর উপযুক্ত শিক্ষক নেই, ল্যাবরেটরি নেই, প্রয়োজনীয় বইপত্র নেই। সরকারি উদ্যোগে রাসেল কম্পিউটার ল্যাব কিছু কিছু স্কুলে দেওয়া হলেও সেই ল্যাবে শিক্ষার্থীদের কাজ করতেদেওয়াহয় কতটুকু, সেটি নিয়ে ভিন্ন গবেষণা হতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতে-কলমে ল্যাবরেটরিতে কাজ শেখার কথা কাগজে-কলমে বলা আছে। কিন্তু স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিজ্ঞান শিক্ষার ভৌত পরিস্থিতি এবং শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা না শিখেই ব্যাবহারিক পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে যান। রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ব্যাবহারিক পরীক্ষার অংশটুকু করে দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডেমনেস্ট্রেটররা। একদিকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নকল ধরা পড়লে পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার বিধান বহাল, অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নিরঙ্কুশ সম্মতিতে বিজ্ঞান শিক্ষার এই ফাঁকিবাজি ব্যবস্থা নাম না-জানা অতীত থেকেই চলে আসছে। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য সরকারের বরাদ্দই-বা কী? শিক্ষাক্ষেত্রে যে বরাদ্দ আমরা প্রতিবছর দেখি তার মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আলাদা বরাদ্দ স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নেই বললেই চলে। অন্য আর পাঁচটি বিষয়ের মতোই মুখস্থ করে পরীক্ষায় খাতায় লিখে আসা বিজ্ঞানশিক্ষা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা ধারণাটিকে এক মস্তপ্রহসনে পরিণত করেছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দও হতাশাজনক। বার্ষিক বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন এবং বাকি টাকা ব্যয়িত হয় ভবন নির্মাণে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতে-কলমে ল্যাবরেটরিতে কাজ শেখার কথা কাগজে-কলমে বলা আছে। কিন্তু স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিজ্ঞান শিক্ষার ভৌত পরিস্থিতি এবং শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা না শিখেই ব্যাবহারিক পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে যান। রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ব্যাবহারিক পরীক্ষার অংশটুকু করে দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডেমনেস্ট্রেটররা।

৮। তবে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির ব্যাপারে। স্কুলগুলোতে বিষয় হিসেবে ধর্ম পড়ানো হয় না, পড়ানো হয় বিশ্বাস হিসেবে। অন্যদিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অবহেলা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রযুক্তিগত পড়াশোনার মাধ্যমে চাকরি উপযোগী করে গড়ে তুললেও বিজ্ঞানী তৈরিতে উৎসাহিত করছে না। তাই বিজ্ঞানের বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও তারা বিজ্ঞান গবেষণার চেয়ে চাকরির সুযোগ-সুবিধার দিকে আকৃষ্ট। সবাই বিসিএস দিয়ে অতীতের আইসিএস বা সিএসপির মতো সুবিধাভোগী শ্রেণির অন্তর্গত হতে পারাকেই জীবনের সার মনে করছেন। উচ্চশিক্ষার বিসিএসমুখীন অভিযাত্রা দেশের সুবিধাভোগী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে পারার এক দীর্ঘ ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি। (গায়েন, ২৬ জুলাই ২০২৩) এক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দেশের প্রয়োজন মেটানোর মতো বিজ্ঞানীও তৈরি হচ্ছেন না। বিজ্ঞানকে প্রমাণ করার জন্য চেষ্টা দেখা যায় ধর্মীয় গ্রন্থে ‘আগেই কী বলা হয়েছে’ সে সাপেক্ষে। ১৯৭০-এর দশকেও দেশে বিজ্ঞান আন্দোলন ছিল। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য একদল তরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পত্রিকা বের করেছেন, বৈজ্ঞানিক কল্প-উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সেই ধারাটি আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ স্তিমিত হয়ে গেছে। যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীর সামর্থ্য আছে, তারা দেশের বাইরে চলে গেছেন, যাচ্ছেন। এই মেধাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি বর্তমানে সামর্থ্যবান পিতামাতা সন্তানকে তৈরিই করছেন বিদেশের উপযোগী করে। নয়া অর্থনীতিবাদের গোলকধাঁধায় পড়া, প্রতিযোগিতায় আসীন অভিভাবকরাও এই দায় এড়াতে পারেন না।

১৯৭০-এর দশকেও দেশে বিজ্ঞান আন্দোলন ছিল। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য একদল তরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পত্রিকা বের করেছেন, বৈজ্ঞানিক কল্প-উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু সেই ধারাটি আশির দশকের মাঝামাঝি নাগাদ স্তিমিত হয়ে গেছে।

৯। দেশে বিজ্ঞানচর্চার আবহ যেমন নেই, সমাজবিজ্ঞান এবং মানবিক বিদ্যাচর্চারও মুক্ত পরিবেশ নেই। ধর্মীয় অতিরিক্তপনা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের কাছে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাটি ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এই পরিখা প্রত্যেক সরকার ভোটের রাজনীতির জন্য তৈরি করেছে। নির্দয়ভাবে স্কুল পাঠ্যবই থেকে তুলে দিয়েছে বহুত্বের ধারণা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অধীন শিক্ষার মূল পাঠ্যবইগুলোকে মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী করে তুলতে গিয়ে বইগুলোর আঙ্গিক ও আদর্শিক যে পরিবর্তনগুলো হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদন (শরিফুজ্জামান, ১০ এপ্রিল২০১৪) থেকে কয়েকটি উদাহরণ এখানেদেওয়াহলো।

“অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে লালন শাহের কবিতা ‘মানবধর্ম’। কবিতাটি নির্বাচনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘…ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচিতির চেয়ে মানুষ হিসেবে পরিচয়ই বড়। শিক্ষার্থীরা জাতপাত বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মিথ্যে গর্ব করা থেকে বিরত থাকবে।’ কবিতাটি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে কবি ফররুখ আহমদের ‘মেঘ বৃষ্টি আলোর দেশে’ কবিতা দিয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জর্জ হ্যারিসনের ছবিসহ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ লেখাটি পড়ত, কিন্তু পরিমার্জন কমিটি লেখাটি বাদ দিতে চাইলে স্টিয়ারিং কমিটি আপস করেছে এইভাবে যে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা লেখাটি পড়লেও গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া ঝাঁকড়া চুলের জর্জ হ্যারিসনের ছবিটি সেখানে থাকবে না।

অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার গদ্য ‘মংডুর পথে’ প্রতিস্থাপিত হচ্ছে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মদিনার পথে’ লেখাটি দিয়ে। দশম শ্রেণিতে জ্ঞানদাশের কবিতা ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু’ প্রতিস্থাপিত হচ্ছে মুহাম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ কবিতা দিয়ে। শুধু ভাষায় নয়, চিহ্নায়নের নানা স্তরেও পরিবর্তন। তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা’ বই-এর প্রচ্ছদে হাফপ্যান্ট পরা যে বালকটি নৌকা বাইছে এবং যে বালিকাটি শাপলা ফুল তুলছে নৌকায় বসে, সেখানে প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে বালকটিকে পায়জামা পরানো হবে এবং কিশোরীর মাথায় দেওয়া হবে হিজাব। পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদে ফুল, পাখি, প্রজাপতি ও কাশবনের মধ্যে নৌকা বাইছে এক কিশোর আর নৌকার অন্য প্রান্তে বসা এক ফ্রক পরা কিশোরী, সেটিও পাল্টে মাদ্রাসা শিক্ষার ‘উপযোগী’ করা হবে। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ানো নারীর ঘাড়ের পাশ দিয়ে সামান্য যে পিঠ দেখা যায়, শিল্পীর আঁকা সেই পিঠও দেওয়া হবে ঢেকে। তবে সবকিছুকে বোধহয় ছাড়িয়ে গেছে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গদ্যটির শিরোনাম পরিবর্তনের সুপারিশ করে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে। এসবের তুলনায় ব্রতচারী নৃত্য তুলে দেওয়া, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ দেওয়া বা অন্যান্য পরিবর্তনের তালিকা আর না বাড়াই।’’

তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা’ বই-এর প্রচ্ছদে হাফপ্যান্ট পরা যে বালকটি নৌকা বাইছে এবং যে বালিকাটি শাপলা ফুল তুলছে নৌকায় বসে, সেখানে প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে বালকটিকে পায়জামা পরানো হবে এবং কিশোরীর মাথায় দেওয়া হবে হিজাব।

চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে এই উদ্দেশ্যে বাংলা ও ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষার মূল বইগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার মূল বই করার মাধ্যমে এই দুই শিক্ষা বোর্ডের পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য যে উদ্যোগ, তাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার বইগুলোকে ‘মাদ্রাসা উপযোগী’ করাই যদি পদ্ধতি হয়, তবে আর মাদ্রাসার জন্য সাধারণ শিক্ষার বই প্রতিস্থাপনের কথা বলে কী লাভ? সাধারণ শিক্ষার যে উদার মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থাকার কথা, সেটিই যদি বইগুলোর মাদ্রাসাকরণের জন্য বাদ দিতে হয়, তবে মাদ্রাসা শিক্ষার বইগুলোকে আলাদা রাখাই ভালো। না হলে একই ক্লাসের শিশু-কিশোরদের একই বইয়ের দুই ধরনের নৈতিকতার মানদণ্ড জারি রাখা হয়, যা বিপজ্জনক।

দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার একই শ্রেণির জন্য সংকলিত একই বইকে যদি ভিন্ন দুই নৈতিকতার মানদণ্ডে বিন্যস্ত করা হয়, তবে কোন ধারাটি গ্রহণযোগ্য এবং কোনটি বর্জনীয় সমাজে, সে বিষয়ে এই শিশু-কিশোররা কোন সিদ্ধান্তে আসবে? লালনের ‘মানবধর্ম’ কবিতাটি কি তবে অনৈতিক? অনৈতিক কি জর্জ হ্যারিসনের ছবি, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ভ্রমণকাহিনি, ফুল-পাখি-প্রজাপতি-কাশবনের ভেতরে বালকের হাফপ্যান্ট? শিল্পীর আঁকা গ্রামীণ নারীর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে পিঠের যে সামান্য আভাস দেখা যায়, তা নয় নৈতিক? নৈতিক ড্রেস তবে বালিকার হিজাব, তার ফ্রক অনৈতিক?

আর যে পরিমার্জন কমিটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ শিরোনাম পাল্টে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের সুপারিশ করতে পারে, তারা কীভাবে শিশুদের জীবন-মনন গঠনের জন্য যে বই পড়ানো হবে, সেই বই-নির্বাচন কমিটির সদস্য হতে পারে? ব্যাপারটি গোলমেলে মনে হওয়ায় প্রতিবেদনটি ফের পড়লাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক জানিয়েছেন,

সাধারণ শিক্ষার বইগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার ‘উপযোগী’ করার কাজ করেছে মূলত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। তারা এমন করবে সেটি হয়তো স্বাভাবিক। পরিমার্জন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছিনের মহাসচিব শাব্বির আহমেদ মোমতাজি যথার্থই বলেছেন, ‘সাধারণ শিক্ষা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য; কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই যেসব বিষয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে, সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।’

যে পরিমার্জন কমিটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ শিরোনাম পাল্টে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের সুপারিশ করতে পারে, তারা কীভাবে শিশুদের জীবন-মনন গঠনের জন্য যে বই পড়ানো হবে, সেই বই-নির্বাচন কমিটির সদস্য হতে পারে?

মাদ্রাসার জন্য সাধারণ শিক্ষার বইয়ে পরিবর্তন এনে কিন্তু সরকার পক্ষান্তরে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দাবিকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে যদি কখনো একই শক্তির কাছ থেকে দাবি ওঠে যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সবকিছুই মাদ্রাসা শিক্ষার নৈতিকতার মানদণ্ড পার হয়ে আসতে হবে, তখন সরকার নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবে জানি না।

আগে মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষার পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। একটি ঘোষিত বিশ্বাসনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, অন্যটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসামূলক অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা। কাজের ধরনও তাদের অর্জিত শিক্ষার অনুগামী হবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা বেড়ে যায় তথাকথিত ‘পরিমার্জনা’র কারণে। কারণ, সাধারণ শিক্ষার বই যখন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচ্ছাদনে মুড়ে দেওয়া হয়, তখন সেসব বই না বহন করে সাধারণ শিক্ষার স্পিরিট, না বহন করে মাদ্রাসার ধারা। হয়ে যায় ‘হাঁসজারু’। এই হাঁসজারুত্বের সমস্যা এ কারণেও যে চাকরি-বাকরিতে ব্যবধান যাবে কমে, যা খুব ইতিবাচক অথচ যে ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে এই ব্যবধান ঘুচবে তা সমস্যাজনক।

অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন চরিত্র থেকে সরে আসা এসব বই পড়ে মনন রয়ে যাবে মাদ্রাসার, যা মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসনির্ভর অথচ প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের ইহজাগতিক চাকরিতেই তারা বহাল হবেন। প্রজাতন্ত্রের চরিত্র তখন কোন দিকে ঝুঁকবে, নীতিনির্ধারকরা ভেবেছেন কি? প্রজাতন্ত্রের চরিত্র অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের রাখতে চাইলে সবার জন্য একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা চালু করতে না পারলেও এসব ‘আছর’ থেকে বের হয়ে সাধারণ শিক্ষার নির্বাচিত বইগুলো অবিকলভাবেই পড়ানো হোক মাদ্রাসায়, নয়তো একবারেই বাদ দেওয়া হোক। শিশু-কিশোরদের মুক্তি দেওয়া হোক একই বইয়ের দুই নৈতিক মানদণ্ডের দোদুল্যমানতা থেকে। (গায়েন, ২৮এপ্রিল২০১৪)

ফের এবছর যখন পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হলো ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে, তখন সাম্প্রদায়িক উসকানির মুখে তার অনেকটাই বাতিল করা হলো। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির বলি আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা।

১০। জাতিগত বহুত্বের ধারণার প্রায় অনুপস্থিতি শিক্ষাক্রমকে এক জাতিসত্তার প্রায় একমাত্রিক পাঠ্যক্রম করে তুলেছে। সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী এদেশে ৫০টি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র কথা বলা হয়েছে। (দ্য ডেইলি স্টার, ২৩ সেপ্টেম্বর২০২৩) তাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ মূল ধারার পাঠ্যক্রমে নেই।

১১। শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ হতাশাব্যঞ্জক। গত ১জুন ২০২৩-২৪ সালের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে জিডিপির ১.৭৬শতাংশ। গত বছর শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন শিক্ষা নিয়ে ‘মেগা প্রজেক্ট’ করার চিন্তা রয়েছে সরকারের। অথচ বাস্তবতা হলো, প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি বছরের চেয়েও কমেছে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ। চলতি অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছিল জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ। এর আগের বছরে, ২০২১-২২ অর্থবছরে, এই বরাদ্দ ছিল ২.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ, ক্রমাগতভাবে কমছে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বরাদ্দ, যা বহু বছর ধরেই এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আন্দোলন সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ইউনেসকো প্রস্তাবিত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছে। কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনেও জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল।

চলতি অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছিল জিডিপির ১.৮৩ শতাংশ। এর আগের বছরে, ২০২১-২২ অর্থবছরে, এই বরাদ্দ ছিল ২.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ, ক্রমাগতভাবে কমছে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বরাদ্দ, যা বহু বছর ধরেই এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আন্দোলন সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ইউনেসকো প্রস্তাবিত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই ক্রমহ্রাসমান বরাদ্দ এখনো যদি জাতীয় উদ্বেগে পরিণত না হয়, তবে আর কবে হবে? এই পরিস্থিতিতে দাবি-দাওয়া আন্দোলনের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শন নিয়েও গভীর চিন্তাভাবনা প্রয়োজন, করণীয় নির্ধারণের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে: বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার রেটোরিকের মধ্যেই কি আমরা আমাদের শিক্ষাদর্শনের মুক্তি খুঁজব যা তাৎক্ষণিক দাবিদাওয়াভিত্তিক নাকি আমাদের আলোচনায় একটি অপুঁজিবাদী শিক্ষাদর্শনের প্রশ্নও আবর্তিত হবে? এবছর ঘোষিত প্রস্তাবিত শিক্ষাবাজেটে বরাদ্দের আরও একধাপ ক্রমাবনমনের ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদী শিক্ষাদর্শনের দেউলিয়াত্ব আরও একবার প্রমাণিত হলো, শিক্ষাদর্শন নিয়ে আমাদের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে।

সুপারিশের আগে চাই অনুধাবন

শিক্ষাদর্শনের নামে যে ভালো ভালো কথা বলা হয় কিংবা যেসব ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে (Curren et al 2003), সেই ভালো ভালো শিক্ষা এবং দক্ষতা আসলে বহুদেশে কিনে নিতে হয় চড়া দামে। শিক্ষা এখন সবচেয়ে বড় বাণিজ্য। কেউ প্রশ্ন করে না দামের। যে সেই দাম চুকাতে পারে, সে কিনে নেয় শিক্ষা। যে পারে না, কট্টর পুঁজিবাদ কিংবা নয়া উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থায়, আজও, সে কিনতে পারে না মানসম্মত শিক্ষা। কোনো কোনো দেশে এই বিপণনে একধরনের আভিজাত্য এসেছে। টাকার বিনিময়ে ভালো পণ্য কেনার মতোই ভালো শিক্ষা কেনা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা আটকে আছে এখনো ফাটকা বাজারে। তাই রাজনৈতিক প্রয়োজনে সাক্ষরতা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি; বরং তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত সাধারণের শিক্ষার মান। পাশাপাশি তৈরি আছে ধনবানের জন্য স্কুল। মাসে ৩০ হাজার টাকা দিয়েও সেই স্কুলে পড়ে তাদের সন্তানরা। বাংলাভাষা এবং বর্ণমালা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখন দুয়োরানি, ইংরেজি সুয়োরানির কাছে সে হেরে ভূত হয়েছে অনেক আগে। কাজেই মুখে কুদরত-এ-খুদার শিক্ষানীতির কথা বললেও, সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা চালু করাকে স্লোগান হিসেবে নিলেও, আমাদের, যাদেরই সক্ষমতা আছে, লক্ষ্য ইংরেজি শিক্ষায় সন্তানকে শিক্ষিত করা, শিক্ষাশেষে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। কাজেই শিক্ষানীতি নামের যে বাণিজ্যিক-সাম্প্রদায়িক শিক্ষাদর্শনে আমরা আটকে আছি, তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করতেই পারি, কিন্তু বিকল্প প্রস্তাব জনগণের কাছে উত্থাপন না করতে পারলে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারে পাওয়া, নিওলিবারাল পুঁজির মোড়কে বাণিজ্যিক ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষাদর্শন আসলে একটি কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারে না।

তাহলে, ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা কেমন দেখতে চাই? আমাদের চিন্তাপদ্ধতির মূলে যদি সর্বজনীন শিক্ষদর্শন সত্যিই কাজ করে, তবে বলতেই হয়, প্রথম চাওয়া অপুঁজিবাদী, অবাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থা। শ্রেণিবৈষম্যের ঊর্ধ্বে সর্বজনীন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাই। রাষ্ট্র অর্থ জোগাবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সরকারি আমলা করবেন না, করবেন শিক্ষায়তনিক বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয়ত, চাই অসাম্প্রদায়িক, ইহজাগতিক শিক্ষাব্যবস্থা। বিজ্ঞানচেতনা এবং যুক্তি হবে এই ইহজাগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি। এমনকি ধর্ম যদি ক্লাসে পড়তে হয়, সেটি একটি বিষয় হিসেবে পড়তে হবে, বিশ্বাস হিসেবে নয়।  ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের এগারো দফার প্রথম তিন ধারায় এবং ১৯৯১ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের দশ দফায় একটি একমুখীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন হলেও সেই দাবি ক্রমেই জনপরিসর থেকে ফিকে হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিকাশের জন্য চাই রাষ্ট্রের উদ্যোগ। গণমানুষের সার্বিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যাভিসারী জ্ঞান উৎপাদন এবং বণ্টন, দুই-ই যদি শিক্ষায়তনে না থাকে, তবে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কারণ আছে। চতুর্থত, শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষদের সমাজে সম্মানের আসনে রাখার বাস্তবতা তৈরি করা, যেন শ্রেষ্ঠ মেধাবীরাই শিক্ষার জগতে আসেন, যেমন চেয়েছে খুদা কমিশন। কল্যাণরাষ্ট্র ফিনল্যান্ডে যে উদ্যোগ সাফল্য এনেছে। এজন্য বাজেট বরাদ্দ চাই। শিক্ষাক্ষেত্রে এখনো রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সবচেয়ে কম। আর চাই বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা। ক্ষমতাসীনের বিপরীতে কথা হলেই যদি জেল-জুলুম হয়, সেখানে জ্ঞানচর্চার বিকাশ হতে পারে না। অর্থাৎ শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন হবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক ইহজাগতিক এবং স্বাধীন।

আর চাই বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা। ক্ষমতাসীনের বিপরীতে কথা হলেই যদি জেল-জুলুম হয়, সেখানে জ্ঞানচর্চার বিকাশ হতে পারে না। অর্থাৎ শিক্ষানীতি ও শিক্ষাদর্শন হবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক ইহজাগতিক এবং স্বাধীন।

পুঁজিবাদী সমাজে কোনো অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কার্ল মার্কস বলে গেছেন যে তিনটি করণীয়র কথা (উদ্ধৃত Rikowski, 2004), সেই তিন করণীয় মার্কসবাদী শিক্ষাবিদরা শিক্ষাবিষয়ক আলোচনায় ব্যবহার করছেন মর্মে উল্লেখ করেছেন রিকোস্কি। এগুলো হলো প্রথমত, পুঁজিবাদী সমাজ এবং এর শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনৈতিকতা নানা মুখোশে মুখ ঢেকে আছে, সেই পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোর সমালোচনা দৃশ্যমানভাবে জারি রাখা। দ্বিতীয়ত, মানুষের প্রয়োজন এবং শিক্ষার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের সঙ্গে দৃশ্যমান ডিসকোর্স তৈরি করা। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা এবং শিক্ষার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাজ করা।(সমাপ্ত)

(লেখাটি ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি আন্দোলন-এর সেমিনারে পঠিত। ঈষৎ পরিবর্তিত।)

আগের কিস্তি: সর্বজনীন শিক্ষা: নীতি ও সংস্কারের গতিমুখ-১

ডক্টর কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: kaberi.gayen@du.ac.bd

তথ্যসূত্র:

দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯৮৭)। ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে। অনুষ্টুপ প্রকাশন: কোলকাতা।

আবদুল মতিন খান (১৯৮৮/১৯৯০)। ‘এযাবৎকালের শিক্ষানীতি ও বিকল্প কাঠামো’ (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত, বাংলাদেশের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। বাঙলাদেশ লেখক শিবির: ঢাকা।

শহীদুল ইসলাম (১৯৮৮/১৯৯০)। ‘বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা: ঐতিহাসিক পটভূমি’ (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত, বাংলাদেশের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। বাঙলাদেশ লেখক শিবির: ঢাকা।

কাবেরী গায়েন (২০১৪)। ‘শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় আচ্ছাদন কেন?’, মতামত, প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুযারি২০১৪।

কাবেরী গায়েন (২০২৩)। ‘বাংলাদেশের শিক্ষাদর্শন: ঔপনিবেশিক অতীত, সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।’ সাপ্তাহিক একতা, ২৬ জুলাই২০২৩।

কাবেরী গায়েন (২০২৩)। ‘দেশের পড়াশোনা কীভাবে বিসিএসমুখী হলো’। আজকের পত্রিকা, ২৬ জুলাই২০২৩।

দ্য ডেইলি স্টার (২০২৩)। ‘জনশুমারিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আসেনি।’ ২৩ সেপ্টেম্বর২০২৩।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

Bangladesh Education Committee Report 1974. Ministry of Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh.

Curren, R., Robertson, E. and Paul Hager, P. (2003). The Analytical Movement,

in Curren 2003: 176– 191. doi:10.1002/9780470996454.ch13

National Education Policy 2010. Ministry of Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh.

Rikowski, G. (2004). Marx and Education. Policy Future in Education, 2(November 3&4).

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •