মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৫

মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৫

শত বর্ষের বশ্যতা

তারিক আলি

ষাট দশকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই (প্রকাশক  ভার্সো, 2003)-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন ফাতেমা বেগম

‘ঈশ্বরের কসম, মহামান্য, কথিত মিচ বট এর সাথে এই শয়তানরা আমাদের গ্রামে আসার প্রথম দিন থেকে আমাদের জীবন উটের প্রস্রাব হয়ে গেছে। প্রতিদিন এটি আরও খারাপ হচ্ছে। আগে আমরা যতটা খুশি থাকা সম্ভব তা ছিলাম’।

আমির তাকে কড়া জবাব দিলেন। ‘শুনুন, ইবনে হাতল, আমি আপনার এবং অন্য সকলের সাথে কথা  বলছি, এবং যারা  উপস্থিত আছেন অনুপস্থিতদের এটি জানিয়ে দিন। সমস্যা সৃষ্টিকারীদের জন্য আমাদের কাছে একটি ‘ঐটা’ ওষুধ রয়েছে।

তিনি দেয়ালে ঝুলানো তরবারির দিকে ইশারা করলেন এবং আঙুল নেড়ে হুঁশিয়ার করলেন। ‘তুমি কি বল, ইবনে হাতাল?’  

মিতেব আল-হাতাল তখন একটা মুচকি হাসি দিয়ে বুঝালেন  যে, তার কথা এখনও শেষ হয়নি। এতে একটি  ভারী নীরবতা প্রতিধ্বনিত পুরো হল ঘর জুড়ে।

‘হাহ- তুমি কি বল, ইবনে হাতাল?’

‘আপনিই সরকার, আপনার কাছে সৈন্য এবং অস্ত্রপাতি রয়েছে। আপনি যা চান তা আজ পাবেন, হয়তো আগামীকালও পাবেন। খ্রিস্টানরা মাটির নিচ থেকে আপনার জন্য সোনা নিয়ে আসার পরে আপনি আরও শক্তিশালী হবেন। কিন্তু আপনি জানেন, মহামান্য, আমেরিকানরা এটা ঈশ্বরের জন্য করছে না।‘

-আব্রাহাম মুনিফ(১৯৩৩-), সিটিস অফ সল্ট  

বসন্তের স্মৃতি

এপ্রিল, ১৯৬৯ সাল। লাহোর। কেবল নীলাভ কৃষ্ণচূড়া ফোটার কারণেই বসন্তের এই দিনটি সুন্দর নয়। শিক্ষার্থী  ও শ্রমিকরা পাঁচ মাস যাবত সংগ্রাম করে ওয়াশিংটন-সমর্থিত এক সামরিক একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছে।[1] তাদের বিদেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়নি। ওয়াশিংটন এবং বেইজিং উভয়েই চেষ্টা করেও ফিল্ড মার্শাল  আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় রাখতে ব্যর্থ হয়। শিক্ষার্থী-শ্রমিকের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দাবি লাখো মানুষের সমর্থন আদায় করেছে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা সেখানে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে ছিল।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার পর চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত আক্রমণের বিষয়ে ‘ন্যাশনাল থিঙ্কার্স ফোরাম’-এ বক্তৃতা দিতে লাহোরে ফিরে এসেছিলাম। সেই ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে কথা বলতে এসেছিলাম যা গণতন্ত্রের প্রতিজ্ঞা করে ‘মানবিক সমাজতন্ত্র’কে চূর্ণ করেছিল। হলে প্রধানত শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটেছিল।  তবে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট এবং চেয়ারম্যান  মাওয়ের বয়স্ক সমর্থকরা সেখানে সোচ্চার ছিল । সেই সময় আমি সক্রিয়ভাবে ট্রটস্কিস্ট ফোর্থ ইন্টারন্যাশনালের একজন অতি সক্রিয় কর্মী ছিলাম।  ট্রটস্কিয় রাজনৈতিক ভাবনা দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপকভাবে  প্রচারিত হয়নি। বৈঠকে আলোচনার একটা ধারা নির্ধারনের চেষ্টা করা হয়েছিল। মাওবাদীরা এক ভাড়াটে  পদ্যরচয়িতাকে নিয়ে এসেছিল যেন সে ট্রটস্কির হত্যা উদযাপনে কয়েকটি লাইন রচনা করে । এতে শ্রোতারা মুগ্ধ হলেও আমি এই উস্কানি উপেক্ষা করেছিলাম।  

সোভিয়েত আক্রমণ সম্পর্কে আমার সমালোচনা ভালভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। রেড গার্ডস অফ দ্য কালচারাল রেভলিউশনের ব্যাপারে চেক শিক্ষার্থীদের সাথে আমার মতের ভিন্নতা কোন প্রতিকূলতা তৈরী করেনি। উপস্থিত অনেক শিক্ষার্থী তাদের প্রাগের প্রতিপক্ষদের সাথে সহজাতভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। মস্কোপন্থী জনতা মনোযোগী ছিল, কিছু  প্রশ্ন উত্থাপন করলেও তারা মূলত নীরব ছিল।  মাওবাদীরা  আক্রমণাত্মকভাবে বিতর্কে লিপ্ত হয়। তারা আমাকে পশ্চিমা  সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল আমার বিশ্লেষণ এবং পরামর্শের কারণে। আমি কয়েকটি বিষয় জানিয়েছিলাম। যেমনঃ আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে,  প্রাগ আক্রমণ তার কফিনের শেষ পেরেকগুলির মধ্যে একটি হতে পারে এবং সমাজতন্ত্রকে কেবল গণতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা যেতে পারে। মাওবাদীরা সোভিয়েত ‘সামাজিক- সাম্রাজ্যবাদীদের’ নিন্দা করেছিল, কিন্তু  জনপ্রিয় চেক কমিউনিস্ট নেতা আলেকজান্ডার ডুবসেকও যে একজন সংশোধনবাদী এবং একজন ‘পুঁজিবাদী-অনুসারী’ হিসেবে গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করেছিল। এরকম একটি কুৎসিত বিতর্কের  শেষে একজন সাদা-দাড়িওয়ালা প্রবীণ বক্তার আগমন ঘটে।  

‘আমাদের দিকে তাকান, তিনি বৈঠকের প্রতি তিরস্কার করলেন। ‘আমাদের সন্তানরা আমাদের জন্য এক বড় জয় এনে দিয়েছে। তারা একজন স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। কিন্তু আমরা যা করতে পারি,  তা হল একে অপরের সাথে লড়াই করা’। তারপর আরও বিনয়ের সুরে বলেন : ‘শোন। পাকিস্তানে  বামেরা যথেষ্ট বিভক্ত।’ তিনি মস্কোপন্থী নেতাদের দিকে ফিরেছিলেন: ‘এখানে, আমাদের সুন্নি আছে।’ তিনি মাওবাদীদের দিকে তাকালেন: “এখানে, আমাদের শিয়া আছে।’ তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এবং ‘এখন এই টগবগে তরুণ চায় আমরা ওয়াহাবিবাদ গ্রহণ করি। দয়া করে, প্রিয় বন্ধু, আমাদের প্রতি দয়া করুন।’

সভায় হাসির ঝড় উঠলো । বৃদ্ধের উপস্থাপন ভঙ্গির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ না করা কঠিন ছিল। সেই সময় পর্যন্ত ওয়াহাবিবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা অস্পষ্ট ছিল এবং এটি কে প্রচলন ঘটিয়েছে তা তো জানা অনেক দূরের কথা। আমি জানতাম, এটি অতি গোড়া  ধর্ম এবং  সৌদি রাজ্যের  রাষ্ট্রধর্ম। সৌদিরা স্থানীয় জামায়াত-ই-ইসলামিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল।  ছোট  একটি দল  জামায়াত-ই-ইসলাম বেশ  অর্থায়নপুষ্ট  একটি মৌলবাদী সংগঠন। এটাই ছিল আমার জ্ঞানের পরিধি। পরে আমি আবিষ্কার করতে পারি যে, অতিরিক্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শনকে  অস্বীকার করার পাশাপাশি ওহাবিরা মুহাম্মদের কর্তৃত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল। । তারা সাধু এবং ধ্বংসাবশেষের উপাসনার প্রতি বিদ্বেষী ছিল, কিন্তু প্রথম চার খলিফার কর্তৃত্ব স্বীকার করেছিল। তাদের দৃষ্টিতে, খিলাফত অবসানের পর থেকে  ইসলামের অবক্ষয় শুরু হয়।[2] 

ওয়াহাবিবাদের শিকড়

ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে আরব উপদ্বীপ এবং উর্বর মুসলিম এলাকা অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।  কায়রো, বাগদাদ, জেরুজালেম এবং দামেস্ক অটোমান-আরব শহরে পরিণত হয়েছিল। এসব অঞ্চলে ইস্তাম্বুল নিযুক্ত আমলাতন্ত্র শাসনকার্য পরিচালনা  করছিল। মক্কা এবং মদিনা বসফরাসের খলিফার সরাসরি সুরক্ষার অধীনে ছিল। কিন্তু উপদ্বীপের আদিম উপজাতীয় কাঠামো এবং স্থলভাগে  বাণিজ্য রুটগুলি বহু আগে  হারিয়ে  বণিক বহর দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার কারণে ভৌগোলিকভাবে  বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং এতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছিল। অবহেলিত উপদ্বীপটি অটোমান সাম্রাজ্যে কখনই পুরোপুরিভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্থানীয় উপজাতিরা এতে বিরক্ত ছিল। আবার একই সাথে অটোমানদের নিয়ন্ত্রণের অভাবকে নিজেদের সুবিধামত ব্যবহার করেছিল।

তখন পর্যন্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা মূলত স্থানীয় চাহিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পুরানো কাফেলার রুটগুলি তখনও প্রধানত তীর্থযাত্রীদের পবিত্র শহরগুলিতে যাওয়ার পথ ছিল ।  তীর্থযাত্রীদের  থাকা  খাওয়ার ব্যবসা স্থানীয় অর্থনীতিকে পুরোপুরি টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কিছু উপজাতি সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা  করেছিল। অর্থের  বিনিময়ে তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও যাত্রীদের কাছে যথেষ্ট  অর্থ থাকতোনা। এতে উপজাতিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়তে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) এর অনুপ্রেরণায় একটি নতুন পুনরুজ্জীবনবাদী সম্প্রদায়ের জন্ম এই অঞ্চলে পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়।  ছোট এবং তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ উয়ায়নার একটি মরুদ্যান-শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  মুহাম্মদের পিতা আবদুল ওয়াহহাব, একজন স্থানীয় ধর্মতাত্ত্বিক, অষ্টম শতাব্দীর একটি অতি-গোঁড়া মুসলিম আইন ব্যাখ্যার অনুসারী  ছিলেন। তার যুবক ছেলে খেজুর  ও গবাদি পশু চরাতে চরাতে ক্লান্ত হয়ে স্থানীয়ভাবে  সেই ব্যাখ্যা প্রচার করতে  শুরু করেন। সবাইকে  পুরানো সময়ের ‘বিশুদ্ধ বিশ্বাসে’ ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি  নবী মুহাম্মদের উপাসনার বিরোধিতা করেন; ধর্মীয় গুরুদের মাজারে প্রার্থনাকারী মুসলমানদের নিন্দা করেন; কবর চিহ্নিত করার রীতির সমালোচনা করেন; এক ঈশ্বরের ঐক্যের উপর জোর  দেন এবং সমস্ত অ-সুন্নি এমনকি কিছু সুন্নি গোষ্ঠীকে  (ইস্তাম্বুলে সুলতান- খলিফা সহ) বিধর্মী এবং ভন্ড হিসাবে নিন্দা করেন। এই মতবাদ অন্যান্য মুসলমানদের, বিশেষ করে শিয়া ‘ধর্মবাদী’ এবং অটোমান সাম্রাজ্য বিরোধী একটি অতি-সংকীর্ণ জিহাদের জন্য একটি রাজনৈতিক-ধর্মীয় ন্যায্যতা প্রদান করে।   

এই মতবাদে  তেমন মৌলিকত্ব ছিল না।  সবসময়ই ইসলামের বিশুদ্ধতার রক্ষক ছিল।  ব্যক্তিগত মতবাদ হিসাবে ইবনে ওয়াহহাবের মতামত নিরীহ হতে পারতো।  কিন্তু সামাজিক প্রেসক্রিপশন হিসাবে – ইসলামিক শাস্তি স্বরূপ প্রহারে বিশ্বাস, ব্যভিচারীদের পাথর ছুড়ে মারার উপর জোর দেওয়া, চোরদের অঙ্গচ্ছেদ এবং  অপরাধীদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড -১৭৪০ সালে বেশ সমস্যা তৈরি করেছিল। এতদিন  তিনি যা শুধু প্রচার করেছেন তা অনুশীলন করতে শুরু করলে এই অঞ্চলের ধর্মীয়  নেতারা তীব্র আপত্তি জানায়। এইসব বাজে কথায় বিরক্ত হয়ে উয়ায়নার আমির একটি বিদ্রোহের আশংকায় প্রচারককে শহর ছেড়ে চলে যেতে বললেন।  

পরবর্তী চার বছর ধরে, ইবনে ওয়াহহাব সমগ্র অঞ্চলে ভ্রমণ করেন।  উসমানীয়রা ইসলামে যে অমনোযোগিতা এবং শিথিলতা এনেছিল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য  তিনি বসরা ও দামেস্ক পরিদর্শন করেন। তার আশঙ্কা সঠিক হয়।  ভ্রমণকালে তিনি সর্বত্র সত্য বিশ্বাস থেকে বিচ্যুতি লক্ষ্য করেছেন। তিনি সমমনা আলেমদেরও খুঁজে পেয়েছেন যারা তাকে তার বিশ্বাসে উৎসাহিত করেছেন। ইবনে ওয়াহহাব এরপর  ইসলামকে তার আদি বিশুদ্ধতায় ফিরিয়ে আনতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেন। একটি ‘শুদ্ধ’ বা স্বর্ণযুগে ফিরে আসা এই অবিরাম বার্তাটি  নিছক কল্পনা হলেও এর প্রচার একটি উদ্দেশ্যকে পূরণ  করে। বিশ্বাস বা ধর্মের  বিশুদ্ধতাবাদী পুনর্গঠন ছাড়া  তো একটি পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।   

জন কিটস লিখেছেন, ‘ধর্মান্ধদের স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নে  তারা সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্বর্গ রচনা করে। ইংরেজ    রোমান্টিক কবি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ বিপ্লবের আগে, সময়কালে এবং পরে উত্থিত বিশুদ্ধবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে কথাটি বলেন।  কিন্তু কথাটি একইভাবে  প্রযোজ্য সেই মরু প্রচারকের জন্যও যিনি তার পরিচিত এলাকায় তার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ফিরে এসেছিলেন।  ১৭৪৪ সালে ইবনে ওয়াহহাব নেজদ প্রদেশের আরেকটি ক্ষুদ্র মরূদ্যান শহর-রাজ্য দেরাইয়ায় পৌঁছেন। উর্বর মাটি এবং দরিদ্র মানুষের শহরটি ফল বাগান, খেজুর বাগান এবং  কুখ্যাত দস্যু-আমির, মুহাম্মদ  ইবনে সৌদ এর জন্য পরিচিত ছিল।  মুহাম্মদ ইবনে সৌদ তার একজন ক্ষমতাবান প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বারা বহিষ্কৃত প্রচারক ইবনে ওয়াহহাবকে পেয়ে আনন্দিত হন। তিনি তখনই বুঝতে  পেরেছিলেন যে ইবনে  ওয়াহহাবের শিক্ষা তার  নিজের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও সাফল্যের দিকে এগিয়ে  নিয়ে যেতে  পারে। দুজনকে যেন একে অপরের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

ইবনে ওয়াহহাব বস্তুত ইবনে সৌদ এর প্রায়  সকল  আকাঙ্ক্ষাকে  ধর্মতাত্ত্বিক যৌক্তিকতা দিয়েছিলেন। যেমন : একটি স্থায়ী  জিহাদের ধারনা দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি অন্যান্য মুসলিম বসতি এবং শহরগুলি লুট করা, খলিফাকে উপেক্ষা করা, তার  নিজের লোকদের উপর কঠোর শৃঙ্খলা আরোপ করা এবং শেষ পর্যন্ত, উপদ্বীপকে একত্রিত করার প্রয়াসে উপজাতি প্রতিবেশীর উপর তার নিজস্ব শাসন জাহির করার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর,  আমির এবং প্রচারক একটি মিথাগ বা একটি বাধ্যতামূলক চুক্তিতে সম্মত হন, যা অনন্তকাল ধরে তাদের উত্তরাধিকারিরা সম্মান করতে থাকবে। এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ইবনে সৌদ এর নির্দেশিত দুইটি  ধারা থেকে তার অন্তর্বাসনা বুঝতে পারা যায়।।  তা হলোঃ রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সেবায় আধ্যাত্মিক শক্তির ব্যবহার হবে, কিন্তু তার বিপরীত নয়।  

ইবনে সৌদ তখনই প্রচারকের আধ্যাত্মিক প্রতিভার সংক্রামক ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিলেন। দুইজনের শিক্ষাকে   একচেটিয়া করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন।  এই উদ্দেশ্যে  তিনি প্রচারকের থেকে মজবুত অঙ্গীকার দাবী করেন: প্রথম দাবী ছিল, কোন অবস্থাতেই ইবনে ওয়াহহাব এই অঞ্চলের অন্য কোন আমিরের কাছে তার আধ্যাত্মিক আনুগত্য এবং সেবা প্রদান করবেন না। অবিশ্বাস্যভাবে, ইবনে ওয়াহহাব, যিনি ইসলামের সার্বজনীনতাকে একাগ্র শক্তিতে  রক্ষা করছিলেন, তিনি ইবনে সৌদের  এই বিধিনিষেধ মেনে চলতে সম্মত হন। আমিরের দ্বিতীয় দাবিটি ছিল নিতান্তই নিষ্ঠুর।  তার শাসনে ইবনে ওয়াহহাবের যতই খারাপ লাগুক না কেন, কখনই তিনি প্রজাদের ইবনে সৌদকে  শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরী করবে না। এই বিষয়েও, মুহাম্মদ ইবনে ওয়াহহাব সম্মত হলেন।  তিনি তার নতুন পৃষ্ঠপোষককে আশ্বস্ত করেছিলেন যে শীঘ্রই এই শ্রদ্ধার ব্যাপার  অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে  কারণ ‘আল্লাহ অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে ঘানিমা [লুট] আকারে আরও বৈষয়িক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’।[3]

ইবনে সৌদ তখনই প্রচারকের আধ্যাত্মিক প্রতিভার সংক্রামক ক্ষমতা বুঝতে পেরেছিলেন। দুইজনের শিক্ষাকে   একচেটিয়া করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন।  এই উদ্দেশ্যে  তিনি প্রচারকের থেকে মজবুত অঙ্গীকার দাবী করেন: প্রথম দাবী ছিল, কোন অবস্থাতেই ইবনে ওয়াহহাব এই অঞ্চলের অন্য কোন আমিরের কাছে তার আধ্যাত্মিক আনুগত্য এবং সেবা প্রদান করবেন না।

একটি  বৈবাহিক সম্পর্ক  তাদের এই চুক্তিকে সীলমোহর করে। এর ফলে  ইবনে ওয়াহহাবের কন্যা ইবনে সৌদের স্ত্রীদের দলভুক্ত  হলেন। এইভাবে একটি রাজনৈতিক এবং সহযোগিতামূলক ঘনিষ্ঠতার ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে উপদ্বীপের রাজনীতিকে রূপ দেয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামরিক নির্দয়তা, রাজনৈতিক খলনায়কত্ব, এবং নারীদের  প্রতি বল-প্রয়োগ এর সংমিশ্রণই ছিল সেই রাজবংশের ভিত্তি প্রস্তর যা আজ সৌদি আরবকে শাসন করছে।

ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামরিক নির্দয়তা, রাজনৈতিক খলনায়কত্ব, এবং নারীদের  প্রতি বল-প্রয়োগ এর সংমিশ্রণই ছিল সেই রাজবংশের ভিত্তি প্রস্তর যা আজ সৌদি আরবকে শাসন করছে।

১৭৯২ সালের মধ্যে, সৌদি-ওয়াহহাবি বাহিনী প্রতিবেশী শাসকদের প্রতিরোধকে পরাস্ত করে ।  রিয়াদ, খারজ এবং কাসিম শহরগুলিকে তাদের অধীনে আনে।  নতুন শক্তি সবদিকে বিজয় লাভ করতে শুরু করে। ওয়াহাবিদের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতিদের ব্যর্থতার ফলে ইসলামের পবিত্র শহরগুলো ইবনে সৌদের উত্তরসূরিদের হুমকির কবলে পড়ে। ১৮০১ সালে ওয়াহহাবিরা শিয়াদের পবিত্রতম শহর  কারবালায় অভিযান চালায়, এর পাঁচ হাজার বাসিন্দাকে হত্যা করে, ব্যক্তিগত বাড়িঘর ও মাজার লুট করে বিজয়ের সাথে বাড়ি ফিরে আসে। ১৮০২ সালে তারা তায়েফ দখল করে এর জনগণকে হত্যা করে। পরের বছর তারা মক্কা দখল করে এবং নবী ও খলিফাদের গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধি ধ্বংস করার জন্য মক্কার শরীফকে নির্দেশ দেয়। উসমানীয়রা ওয়াহাবিদের পরাজিত করার পরেই সমাধিগুলি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। ওহাবি মতবাদ কবরে আড়ম্বরপূর্ণ পাথরের ব্যবহার প্রত্যাখ্যান করেছিল।[4]    

ইস্তাম্বুল আর কতদিন ওহাবী বিদ্রোহ সহ্য করবে? মিশরে ইস্তাম্বুলের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি থাকলেও এই অঞ্চলে তার   আধিপত্য সবসময়ই অস্থিতিশীল ছিল। নিম্ন নীল নদ অঞ্চলের  ঐতিহ্যবাহী অভিজাতরা একটি অন্তহীন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। সার্কাসিয়ান এবং বসনিয়াক উপদলগুলিকে একে অপরের থেকে বিভক্ত করার চেষ্টা প্রায়ই সফল হচ্ছিল। যতক্ষণ  পর্যন্ত নিয়মিতভাবে সাম্রাজ্যের কোষাগারে বকেয়া জমা হচ্ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সুলতান এইসব হুমকি উপেক্ষা করছিলেন। পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদ  বিকাশের হুমকিতেও সুলতান বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের যুগ শুরু হয়েছিল। বিশ্বের নতুন বিজয়ীরা অগ্রসর হচ্ছে। বাণিজ্য পুঁজিবাদের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগটি পূর্ব দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একশ বছরপার হওয়ার কিছু পরে একজন আইবেরিয়ান ভ্রমণকারী ডন ম্যানোয়েল গঞ্জালেস বিশ্বায়নের প্রথম সদর দফতরের বর্ণনা দেন :

লিডেনহল স্ট্রিটের দক্ষিণ দিকে, এবং লিডেনহলের কিছুটা পূর্বদিকে , রাস্তার সামনের দিকে মুখ করে দুর্দান্তভাবে একটি পাথরের নির্মিত  ইস্ট ইন্ডিয়া ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে: কিন্তু সামনের অংশটি  খুব সরু হওয়ার কারণে ভিতরে বিশাল জমিতে তৈরী ভবনটির  বিশালতা দৃষ্টিগোচর নয়– অফিস এবং স্টোরহাউসগুলি প্রশংসনীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে।  পাবলিক হল এবং কমিটি রুমের ডিজাইন শহরে অতুলনীয় ছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়ার পণ্যের ব্যাপক মুনাফা লাভ অ্যাডাম স্মিথকে দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস-এ একটি সমালোচনামুলক অনুচ্ছেদ লিখতে বাধ্য করেছিল। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে ক্রেতাদের কারণে কোম্পানির একচেটিয়া মালিকানা অর্জিত হয়েছিল। কেবল পণ্য ক্রয় নয়,  ক্রেতাদের একইসাথে কোম্পানীর ব্যবস্থাপনার  জালিয়াতি এবং ঠকবাজির মূল্যও দিতে হচ্ছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের বণিকদের তুলনায় ইংরেজ এবং ডাচ রাজ্যগুলি বণিকদের একটি গোষ্ঠীকে আধা-সার্বভৌম ক্ষমতা (অর্থাৎ তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী বজায় রাখার অধিকার) প্রদান করার সাথে সাথে  ভারতে ‘জালিয়াতি এবং অপব্যবহার’ প্রতিস্থাপিত হয়।  কোনও এশীয় ব্যবসায়ী অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেনি। সশস্ত্র বাণিজ্য দ্রুত অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে কোম্পানিটি তার কলকাতা ঘাঁটি থেকে বাইরের দিকে সম্প্রসারিত হয়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর এটি  সমগ্র বাংলাকে দখল করে নেয়। কয়েক বছরের মধ্যেই দিল্লির দুর্গে নামমাত্র মুঘল সম্রাট কোম্পানির পেনশনভোগী অধীনস্থ  হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া বাহিনী দ্রুত বাংলা থেকে পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ডাচরা ইতিমধ্যেই সিলনের (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) কিছু অংশ এবং ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপগুলি দখল করেছিল।

১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন মিশর বিজয় করে। এই বিজয় তার প্রধান শত্রু ব্রিটেনের ভারতে আগ্রাসন প্রতিহত করার  প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হয়।  একবার বিজয় সুসংহত হলে, ফরাসিরা পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার এবং মহীশূরের ব্রিটিশ-বিরোধী মুসলিম শাসকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল।  কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। সিরিয়ায় ব্যর্থ অভিযানের পর, দুই জেনারেলকে সেখানে রেখে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে আসেন। পরের বছর জেনারেলদের একজনকে হত্যা করা হয়, অন্যজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ১৮০১ সালে একটি ব্রিটিশ বাহিনী অটোমানদের সমর্থন করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। তিন বছর দখলের পর ফরাসিরা মিশর ত্যাগ করে। ইউরোপের নতুন সাম্রাজ্যগুলি  তখনও তাদের শিশুকালে ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই অধিকতর দূরদর্শী অটোমান কর্মীরা তাদের সমগ্র রাজত্বের পতন অনুধাবন করতে পারছিল।  

মোহাম্মদ আলী সেই দুরদর্শীদের একজন  তরুণ অফিসার ছিলেন।  তার বাবা ছিলেন অটোমান সেনাবাহিনীর একজন আলবেনিয়ান অফিসার এবং মা ছিলেন  ম্যাসেডোনিয়ান। মোহাম্মদ আলী ১৮০১ সালে আলবেনিয়ান ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হিসাবে ফরাসিদের সাথে লড়াই করার জন্য অটোমান সেনাবাহিনীর সাথে মিশরে এসেছিলেন। তিনি শুনেছিলেন, কায়রোতে একটি অভ্যুত্থানের পরে কীভাবে ফরাসিরা যুদ্ধরত  অভিজাতদের ফাঁদে ফেলেছিল; স্থানীয় আলেমদেরকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদায় উন্নীত করেছিল; অনেক সময়ে তাদের সাথে পরামর্শ করেছিল এবং সাধারণত, অটোমানদের তুলনায় জনতার জন্য অধিকতর কল্যাণকর মনোভাব গ্রহণ করেছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, একটি অপ্রিয় কর ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলকে দরিদ্র করেছিল এবং ফরাসি বিপ্লবের দূতরা সেই কর ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের কর আদায়কারীরা রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রে সবচেয়ে অ-জনপ্রিয় শাখা ছিল। তারা কৃষকদের সাথে  গ্রামীণ  স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করত, কৃষকদের দাস হিসাবে গণ্য করতো। অন্যদিকে, নিজেরা দুর্দান্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করত। রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিশ্চিত করতো যেন সাম্রাজ্যের কোষাগারে নিয়মিত কর জমা হয়। এছাড়া আর কোন ব্যাপারে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা ছিল না। নেপোলিয়ন তার আগমনের পরপরই, ১৭৯৮-এর ১৬ই সেপ্টেম্বর একটি আইন প্রণয়ন করেন: এই আইন জমির মূল্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, কৃষকের মালিকানা এবং সে যে জমিতে কাজ করছিল তার  উত্তরাধিকারের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং জমির মালিকানার রেকর্ড স্থাপন করেছিল। উসমানীয় এবং মুঘল কাঠামোতে তুলনামূলক অবস্থান থাকলেও ইংরেজদের বাংলায় প্রবর্তিত  ভূমি নীতির  ব্যাপারে তাদের বৈপরীত্য ছিল সুস্পষ্ট।  প্যারিস কৃষকের পক্ষে ছিল, আর লন্ডন জমিদার শ্রেণী তৈরি করেছিল।   

মোহাম্মদ আলী আরও উল্লেখ করেছিলেন যে, ব্রিটিশ-অটোমান জোট ফরাসিদের প্রত্যাহারের  একমাত্র কারণ ছিল। এবং তাই তিনি একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তিনি  ফরাসিদের সাথে সহযোগী দুই নেতৃস্থানীয় ধর্মগুরুর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। কয়েক বছরের নিপুণ কৌশলের পর ১৮০৪ সালে মোহাম্মদ আলী ক্ষমতা দখল করেন। সুলতান অনিচ্ছার সাথে তাকে মিশরের উয়ালী নিযুক্ত করেন। ইস্তাম্বুলে ঊর্ধ্বতনদের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কচ্ছেদ ছাড়াই তিনি মিশরের প্রকৃত সার্বভৌম শাসক হন। প্রয়োজনীয় সময়ে  তিনি হিজাজ উপজাতিদের অবক্ষয় রোধ করে উসমানীয় স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন। বিনিময়ে, বিরক্তির সাথে হলেও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ইস্তাম্বুল তাকে স্বাধীন থাকতে দিয়েছিল।   

মোহাম্মদ আলীর সৈন্যবাহিনী ১৮১১ সালে ওয়াহাবিদের পরাজিত করে। মক্কা ও মদিনা পুনরুদ্ধার করে তাদেরকে হিজাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৮১৮ সালে তার ছেলে ইব্রাহিম পাশা, সৌদ-ওয়াহাবি  বাহিনীকে নেজদ এর নিজ ঘাঁটিতে পর্যুদস্ত করেন এবং তাদের রাজধানী দেরাইয়া ধ্বংস করেন।  উসমানীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও পরবর্তীতে ওহাবিরা নেজদকে ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু খিলাফতের ‘ভণ্ড’  মুসলমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে আবার নিজেদেরকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একশ বছর পর তাদেরকে শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে মিত্রতা করতে হয়। আরেকটি আরও শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র পরবর্তীতে তাদেরকে সমগ্র উপদ্বীপের ক্ষমতা অর্পণ করে। ওয়াহাবিবাদ, তার কঠোর অনমনীয়তা এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদের একটি অবিচ্ছিন্ন মিশ্রণের কারণে  কাফেরদের  ব্যবহারের  জন্য  একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

অসহিষ্ণু ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ অটোমান সাম্রাজ্যের পতন দেখে উল্লসিত হয়েছিল। ব্রিটেন, জার্মানি এবং রাশিয়া  তা লুণ্ঠনের জন্য কাঁধে কাঁধ  মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্স ইতিমধ্যেই ১৮৩০ সালে অটোমানদের কাছ থেকে  আলজেরিয়া কেড়ে নিয়েছিল। গ্রীস  স্বাধীনতার লড়াই প্রক্রিয়ায় পতনের সম্মুখীন হয়েছিল। রাশিয়ার দৃষ্টি ছিল বলকান  অঞ্চলের দিকে। ব্রিটেন ইতিমধ্যেই মিশরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং তার এজেন্টরা অন্যান্য মিত্রপক্ষ সন্ধানে আরব উপদ্বীপের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খোদ পশ্চিম  ইউরোপেই, নেপোলিয়ন যুদ্ধের শেষের পর থেকে যে নড়বড়ে শান্তি ছিল তা ভেঙে যেতে বসেছিল।  আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী শত্রুতা এর কারণ ছিল । সারাজেভোতে একটি হত্যাসূত্রে যুদ্ধের সূচনা  হয়, কিন্তু এর পিছনে প্রকৃত কারণ ছিল বলকান অঞ্চলের জন্য অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা।  জার্মানি তার  অস্ট্রিয়ান কাজিনদের সমর্থন করেছিল। ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাশিয়াকে সমর্থন করলো।

অটোমান সুলতান নিরপেক্ষ থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে অস্ট্রো-জার্মান জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তার পছন্দটি বোকামি বলে মনে হয়, কিন্তু সেই সময়ে পোর্টে  এটিকে ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সুলতানের একটি দুর্দান্ত পদক্ষেপ হিসাবে দেখেছিলেন। কোন সাম্রাজ্যই তার ক্ষয়কে পতন  হিসাবে  মানতে  পছন্দ করে না। অটোমান বা হোহেনজোলার্নসরা কেউই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বশক্তি হিসেবে গণ্য করেনি। তারা বা অন্য কেউ রাশিয়ায় জারবাদের আকস্মিক পতন এবং লেনিন ও বলশেভিকদের পরবর্তী বিজয়ের পূর্বাভাসও দিতে পারেনি। লেনিন এবং বলশেভিকদের বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের জন্য প্ররোচিত করতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।  জার্মানিকে তাদের স্বার্থে সম্ভাব্য  একমাত্র ইউরোপীয় হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে সমর্থন করেছিল । তবে তা  কিছু সময় পার হওয়ার পর ।   

অটোমান বা হোহেনজোলার্নসরা কেউই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বশক্তি হিসেবে গণ্য করেনি। তারা বা অন্য কেউ রাশিয়ায় জারবাদের আকস্মিক পতন এবং লেনিন ও বলশেভিকদের পরবর্তী বিজয়ের পূর্বাভাসও দিতে পারেনি। লেনিন এবং বলশেভিকদের বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের জন্য প্ররোচিত করতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। 

১৯১৪-১৮ সালের দ্বন্দ্বে পরাজয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং ইস্তাম্বুল খিলাফতের ভাগ্যে স্থায়ী বিপর্যয় ডেকে আনে।  কয়েক শতাব্দী ধরে তারা প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত নতুন শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট  হয়ে তাদের এক সাথে পতন ঘটলো।  ১৯১৯ সালে ভার্সাইতে ভিক্টরস সম্মেলনে যখন উড্রো উইলসনের উদার  সাম্রাজ্যবাদ প্রতিটি জাতিকে স্ব-নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তখন  তাদের আধিপত্যে একটি নতুন ভবিষ্যতের  সূচনা হলো। এর সাথে  বলশেভিক উপনিবেশগুলিতে বিদ্রোহের আহ্বান  মিলিত হয়ে বিশ্বের  ইতিহাসে নিপীড়িত জনগণ স্থান পেল। একজন অজানা ইন্দো-চীনা, হো চি মিন, ভার্সাইয়ের সমাবেশে তার  দেশের স্বাধীনতার পক্ষে আবেদন জানাতে সক্ষম হন। কিন্তু মিশরীয় সরকারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিকে ব্রিটেন ভেটো দেয়। এই প্রত্যাখ্যান একটি গন-বিদ্রোহ উদ্বুদ্ধ করেছিল। এখানে  পরাজিত হলেও মিশরীয় নেতা সাদ জাঘলুল (সি.১৮৫০-১৯২৭) ওয়ার্ড তৈরি করেছিলেন যা আরব বিশ্বের প্রথম প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দল।  

ভার্সাইয়ের লোকেরা সম্মত হয়েছিল যে প্রাক্তন উসমানীয় আরব রাজ্যগুলিকে সাম্রাজ্যবাদী  রাষ্ট্রগুলির তত্ত্বাবধানে বা ‘ম্যান্ডেট’-এর অধীনে একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তবে  সেই স্বাধীনতা ব্যবস্থা আজ বসনিয়া, কসোভো এবং আফগানিস্তানের মতো নয়। যুদ্ধে বিজয়ীদের  পারস্পরিক লুট ভাগাভাগি নিশ্চিত করার জন্য সেখানে লিগ অফ নেশনস ছিল। জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং  রাশিয়ার পতনের পর দুটি সাম্রাজ্যবাদ অক্ষত ছিল। তারা ইতিমধ্যে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, ‘রাজ্য  সীমান্তের জায়গাগুলির বিনিময়ে।’ ব্রিটেনকে ‘ইরাক ও ফিলিস্তিন পরিচালনা করার এবং মিশরের  উপর নজরদারি করার কর্তৃত্ব দেয়া  হয়েছিল, অন্যদিকে ফ্রান্সকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে দেয়া হয়েছিল সিরিয়া এবং লেবানন। এভাবে ব্রিটেন পূর্বের বড় একটি অংশ লাভ করেছিল। (পূর্ব), আর ফ্রান্স পায় সিরিয়াসহ  মাগরেব এর কর্তৃত্ব।   

ব্রিটেনকে ‘ইরাক ও ফিলিস্তিন পরিচালনা করার এবং মিশরের  উপর নজরদারি করার কর্তৃত্ব দেয়া  হয়েছিল, অন্যদিকে ফ্রান্সকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে দেয়া হয়েছিল সিরিয়া এবং লেবানন।

খেলাফত ও সাম্রাজ্যের পতন সরাসরি জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ ঘটায়। ইরাক ও সিরিয়ায়  বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের  নিশ্চিহ্ন করলেও বিদ্রোহীরা সমগ্র আরব বিশ্বে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। নতুন পুতুল রাষ্ট্রের জনগণ দেখতে পেল যে যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়ার মতো নতুন দেশগুলির তুলনায় তাদেরকে দেওয়া স্বাধীনতা আসলে একটি ভন্ডামি মাত্র। তারপর রুশ বিপ্লব হয়। এটি বিশ্বকে উল্টে দিয়েছিল এবং বিশ্ব বিপ্লবের জন্য নিবেদিত একটি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ঘোষণা করেছিল। ‘মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, আরব এবং পারস্যের কৃষকদের’কে আহবান করা এর চরম সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আবেদন কায়রো, বাগদাদ এবং দামেস্কের পাশাপাশি কাবুল, দিল্লি এবং জাকার্তার বুদ্ধিজীবীদের কাছে পৌঁছেছিল। মুসলিম জনসাধারণ এবং প্রাচ্যের মেহনতি মানুষদের উদ্দেশ্যে এই আহবান কি কখনো তাদের সক্রিয় করবে, করতে পারবে? পরম আত্মবিশ্বাসী ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এমনভাবে চলতে লাগলো যেন ইউরোপে তেমন কিছুই ঘটেনি। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর উত্থান এবং রাশিয়ান বিপ্লব উভয়কেই অবমূল্যায়ন করেছিল।

ইতিমধ্যেই ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী “ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অন্যান্য বাসিন্দাদের অধিকারকে প্রভাবিত না  করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে  থাকার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।” এই অজুহাতে ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইন দখল করে। ট্রান্স-জর্ডান রাজ্যটিকে পূর্ব ফিলিস্তিন থেকে আলাদা করে নামমাত্র স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনের বাকি অংশ সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে রাখা হয়েছিল যাতে সেখানে  ইহুদিদের জাতীয় রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে। ইউরোপে জায়নবাদী সংগঠনগুলি একটি বড় বিজয় অর্জন করে। এর পরপরই ফিলিস্তিনে  ইহুদিদের অভিবাসন শুরু হয়।  

ফিলিস্তিনের বাকি অংশ সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে রাখা হয়েছিল যাতে সেখানে  ইহুদিদের জাতীয় রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে। ইউরোপে জায়নবাদী সংগঠনগুলি একটি বড় বিজয় অর্জন করে। এর পরপরই ফিলিস্তিনে  ইহুদিদের অভিবাসন শুরু হয়।  

ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা তাদের আধা-উপনিবেশের কাঠামোর উপর ভিন্ন নীতিতে চলতো।  রিপাবলিকান সাম্রাজ্যবাদ সিরিয়ায় আমির ফয়সালের উপস্থিতিতে অসহ্য হয়ে তাকে দামেস্ক ছেড়ে যেতে  বলে। অন্যদিকে, ব্রিটিশরা তাকে ইরাকের রাজা পদে আসীন করে। তার ভাই আবদুল্লাহকে ট্রান্স-জর্ডানে সিংহাসন  দেওয়া হলো । দুই ভাই মক্কার শরীফ হোসেনের পুত্র, পবিত্র শহরগুলির অভিভাবক, হাশেমের বংশের প্রধান এবং সরাসরি নবীর বংশধর। হুসেন নিজেকে হিজাজের রাজা ঘোষণা করেছিলেন, ভেবেছিলেন  ব্রিটিশরা তাকে ন্যায্য স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু তিনি একজন অযোগ্য শাসক হওয়ায়  কয়েক বছর পর আরও নির্ভরযোগ্য এবং নৃশংস একজনের  কাছে ব্রিটিশরা তাদের সমর্থন হস্তান্তর করে। তিনি ছিলেন নেজদ এর  আমির আবদাল আজিজ ইবনে সৌদ। যার পূর্বপুরুষ প্রায় দুই শতাব্দী আগে ইবনে ওয়াহহাবের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ইবনে সৌদের আর কোন প্রচারকের প্রয়োজন ছিল না। সময় বদলে গিয়েছিল।

অভিশপ্ত অটোমানরা চিরতরে চলে গেল। ইংরেজরা তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছিল। ইবনে সৌদ এটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সবসময় তার গভীর ভক্ত, আরববাদী এবং ব্রিটিশ এজেন্ট  এইচ.এ.আর ফিলবির নির্দেশনা মেনে চলতেন । ফিলবি  তাকে নবীর নেতৃত্ব অনুসরণ করতে এবং উপদ্বীপের ভিন্ন উপজাতিদের একত্রিত করতে উৎসাহিত করেছিলেন।

বেলফোর এবং ফিলবি বেশীর ভাগ মানুষের কাছে ঘৃণ্য ছিলেন। এই দুটি নাম সাম্রাজ্যিক সিদ্ধান্তের মারাত্মক পরিণতির প্রতীক। বেলফোর ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি বসতি স্থাপনকারী রাষ্ট্রের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ফিলবি আরব উপদ্বীপে একটি দুর্নীতিপরায়ণ গোত্র তৈরির পৃষ্ঠপোষকতা  করেছিলেন। বেলফোর কোন শিল্পীর নজরে আসেনি।  তবে সৌদি ঔপন্যাসিক আবদেল রহমান মুনিফের সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা আমাদেরকে ফিলবির একটি তীক্ষ্ণ প্রতিকৃতি দিয়েছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং জনপ্রিয় চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে মুনিফের প্রতিভা নিহিত ছিল ।  সমস্ত স্থানীয় কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠার ক্ষমতা তার  মধ্যে  শক্তি তৈরী করেছিল। তিনি লেখক গোত্রের কুলপতি। তার রচিত সিটিস অফ সল্ট  ট্রিলজিতে পূর্ব  আরবের প্রাচীন বেদুইন দেশকে একটি হাইব্রিড তেল রাষ্ট্রে রূপান্তর চিত্রিত হয়েছে। উপদ্বীপের সঠিক  ও ব্যাপক ইতিহাসের অভাবের মধ্যে মুনিফের ট্রিলজি  অনুপ্রাণিত করে এবং স্পষ্ট করে। তার তীব্র মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি আরব বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরী করে। এই উপন্যাস লেখার জন্য তিনি  সৌদি নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত এবং নির্বাসিত হন। তিনি  এমন একজন লেখক যিনি কখনই ‘ক্ষমতামুখিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক’ হননি। কেননা, তিনি কখনো কাউকে খুশি করতে লেখেন নি, কোনো দেশের পতাকায় নিজেকে আবৃত করেন নি।

বেলফোর এবং ফিলবি বেশীর ভাগ মানুষের কাছে ঘৃণ্য ছিলেন। এই দুটি নাম সাম্রাজ্যিক সিদ্ধান্তের মারাত্মক পরিণতির প্রতীক। বেলফোর ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি বসতি স্থাপনকারী রাষ্ট্রের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। ফিলবি আরব উপদ্বীপে একটি দুর্নীতিপরায়ণ গোত্র তৈরির পৃষ্ঠপোষকতা  করেছিলেন। বেলফোর কোন শিল্পীর নজরে আসেনি।  তবে সৌদি ঔপন্যাসিক আবদেল রহমান মুনিফের সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা আমাদেরকে ফিলবির একটি তীক্ষ্ণ প্রতিকৃতি দিয়েছে।

সিটিস অফ সল্ট সিরিজের প্রথম উপন্যাসে মুনিফ মরুভূমির এক বেদুইনের গল্প বলেছেন। এই বেদুইন ওয়াদি আল-উয়ুনে বসবাস করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, কাফেলাগুলি এই এলাকার ভাল জল এবং মিষ্টি, আরামদায়ক বাতাসে পৌঁছানোর জন্য উদগ্রীব থাকতো। ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনজন মার্কিনী এখানে আধুনিকতা বয়ে আনে। তারা নদীর তীরে শিবির তৈরি  করে। তারা একটি তেল কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আসে। কিন্ত প্রচার করে, তারা আমিরের বন্ধু  এবং আরও জল খুঁজতে এসেছে। ‘শুধু ধৈর্য ধরুন এবং আপনারা সবাই ধনী হবেন,’ দোভাষীর মাধ্যমে তারা স্থানীয়দের জানায়। মরুভূমির লোকেরা মার্কিনীদের আচরণে বিস্মিত হয়: তারা হৈ চৈ করতে করতে ঘুরে বেড়ায়, তাদের ব্যাগ এবং বাক্সে অকল্পনীয় জিনিসের সংগ্রহ থাকে, গভীর রাত  অবধি তারা লিখাতে আচ্ছন্ন থাকে। তাদের ব্যাপারে জনগণের বিস্মিত হওয়াকে তারা ভ্রুক্ষেপ করে  না। এমনকি তাদের একজন চোখ বন্ধ করে তাঁবুর বাইরে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকে। শিশুরা যে তাকে খেয়াল করছে তা সে উপেক্ষা করে। এরপর থেকে স্থানীয় নারীরা আর নদীতে যেতে চায় না।    

বিস্ময়  অস্বস্তিতে পরিণত হয়। ভয় এবং শঙ্কা যোগ হয় তার সাথে। তরুণরা কাফেরদেরকে হত্যার  কথা  বলে, কিন্তু গ্রামের বড়রা তাদের অনুৎসাহিত করে । কারণ কাফেররা আমিরের অতিথি। পরে অবশ্য বড়দের মধ্যে  বিভক্তি আসে।  মিতেব  আল-হাতাল শুরু থেকেই মার্কিনীদের বিপক্ষে ছিল। ইবনে রাশেদ এর  যুক্তি হলো,  তারা এসে যেভাবেই হোক সবাইকে ধনী করে তুলবে, তাহলে শুরু থেকেই কেন  সহযোগিতা করা হবে না?  মার্কিনীদের সাথে থাকাকালীন সময়ে  তিনি  বদলে যেতে থাকেন।  বেদুইনদের ব্যঙ্গাত্মক প্রবাদ-বক্তৃতা ভুলে গিয়ে বরং দাসত্বের ভঙ্গিতে হাত কচলাতে থাকেন। সবকিছুতে  বাড়াবাড়ি ব্যবহার করেন এবং হায়েনার মতো হাসেন। ‘একমাত্র এই উপায়েই তারা  আমাদেরকে  বুঝতে পারবে, তিনি মিতেবকে ব্যাখ্যা করেন।’ বর্ণনাটি পড়লে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে মিশরের  প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও হোসনি মোবারকের আচরণের কথা মনে পড়ে যায় ।

মার্কিনীরা চলে যায়, কিন্তু তা কেবলমাত্র আরও অনেক লোক এবং মেশিন নিয়ে ফিরে আসার জন্য।  একদিন সকালে বজ্রধ্বনির শব্দে লোকেরা জেগে উঠে।  তারা দেখতে পায়, বুলডোজারগুলি হিংস্র নেকড়ে মতো  বাগানগুলিতে আক্রমণ করছে, গাছগুলিকে ছিঁড়ে  স্তূপ করে রাখছে। আর মানুষগুলিকে  ন্যাকড়া এবং খেজুরের ডাল দিয়ে তৈরি কাকতাড়ুয়ার মতো ফেলে রাখা হয়েছে। সেই ওয়াদি আল-উয়ুন আর নেই। সে এখন  কাঁটাতারে ঘেরা মার্কিনী একটি  ছাউনি।  জল পাম্পে করে  আবার গর্তে জমা হচ্ছে  যেন নিচের আগুনে জ্বলতে থাকা পিপাসায়  কাতর চিৎকাররত জ্বীন বাহিনীর তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।  

মিতেব আল-হাতাল মরুভূমিতে ছুটে যান এবং একজন কিংবদন্তি প্রতিরোধী হয়ে উঠেন।  গল্পটি তার ছেলে ফাওয়াজের  মাধ্যমে হারানের উপকূলীয় শহরে চলে যায়: ফ্রম এ মিক্সড কমিউনিটি টু এ মেইল ওয়ান।  উপন্যাসটি হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়ে, সমুদ্রের সাথে নদীর মিশে যাওয়ার মতো।  গল্পটি বিশ্বায়নের  অংশ  হয়ে ওঠে: অগণিত লক্ষ লক্ষ  মানুষ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত, বিশৃঙ্খল বছরের মধ্যে শতবর্ষ ভ্রমণ  করে ফেলে । তবে সেই ভ্রমন হয় আধুনিক পুঁজিবাদ এর  মালগাড়ীতে, কোন ইকোনমি ক্লাসে নয়।

ইবনে রাশেদ এখন মার্কিন তেল কোম্পানিতে খুবই সক্রিয়, এবং খবরদারী করা  একজন  রিক্রুটিং-অফিসার।  তেল  কোম্পানির আঁটসাঁট পোশাক পরা বেদুইন শ্রমিকরা ট্রাক্টরের গর্জনে বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত । খুব ভয়ে ভয়ে  এবং  ভুলভাবে  কাঠের তক্তা এবং ইস্পাতের গার্ডারগুলি বহন করতে গিয়ে তারা ক্রমাগত নীচে পড়ে যাচ্ছে, তাদের হাত ফসকে  জিনিসগুলি পড়ে যাচ্ছে। কাজে  সম্ভাব্য সব রকম ভুল তারা করছে। তত্ত্বাবধায়ক মার্কিনীদের ক্রোধ তাদের কাছে দুর্বোধ্য।

মুনিফের সবচেয়ে অসাধারণ বর্ণনানুযায়ী, এক রাতে আলোয় ঝলমল  বিশাল  জাহাজটি উপকূলে এসে ভীড়ে।। খুব জোরে  সঙ্গীত বাজছে।  তপ্ত আবহাওয়া। জাহাজটির ডেক পুরুষ এবং নারীতে ঠাসা। তাদের পরনে  কেবল রঙিন  কাপড়ের ছোট এক টুকরো পোশাক ।  একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে হাসছে এবং চিৎকার করছে। আরব শ্রমিকরা সমুদ্র সৈকতে বসে নীরবে তা দেখছে। তারা ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে।  বিভ্রান্ত এবং তিক্ত। একই সাথে সক্রিয় আবার উদাসীন।।  বিদেশীরা  নৌকা থেকে নেমে  তাদেরই  তৈরি বাড়িতে জায়গা নিচ্ছে।  কিন্তু সেই সব  বাড়িতে  তারা পরিত্যক্ত।  

মার্কিন সাম্রাজ্যের পূর্বে  ব্রিটিশদের  এই অঞ্চল শাসনকালের  পরিপ্রেক্ষিতে ট্রিলজির সমাপ্তি উপন্যাস,  ভ্যারিয়েশনস  অফ নাইট এন্ড ডে  রচিত হয়েছে।  অন্য রকম এক সময়।  ইংরেজ ব্যক্তিটি আরবি বলতে শিখেছে। যে মরুভূমিতে  তাকে পাঠানো হয়েছিল সেখানে প্রথম  বিশুদ্ধতম আরবী  সংস্করণে কথা বলা চালু হয়েছিল। উপদ্বীপ জয়ের জন্য ইবনে সৌদ নির্দেশিত  যুদ্ধের এই কাল্পনিক বিবরণ যে কোনো  ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব। সুলতান খুরেবিত এবং হ্যামিল্টন হল ইবনে সৌদ এবং ফিলবি’র কল্পিত চরিত্র।  

উপদ্বীপ জয়ের জন্য ইবনে সৌদ নির্দেশিত  যুদ্ধের এই কাল্পনিক বিবরণ যে কোনো  ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব। সুলতান খুরেবিত এবং হ্যামিল্টন হল ইবনে সৌদ এবং ফিলবি’র কল্পিত চরিত্র।  

সুলতানের অফিসিয়াল কাউন্সিল মিটিং চলাকালীন সময়ে ইংরেজ ব্যক্তিটি  সচেতন আছে  যে উপস্থিত  অধিকাংশই তাকে পছন্দ করে না এবং বিশ্বাসও করে না।  মুনিফ লিখেনঃ  হ্যামিলটন মিটিং এ  নীরব থাকেন।  কিন্তু   কাউন্সিল  প্রলম্বিত হলে তিনি গভীর রাতে একজন ভিন্ন ব্যক্তি হয়ে যান।

… এবং আপনি জানেন,  মহারাজ,  ব্রিটানিক মহারাজের সরকারকে অবশ্যই এই অঞ্চলের পরিস্থিতি এবং স্থানীয় প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করতে হবে। যদিও আপনাকে তার পক্ষ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া হচ্ছে। যেমন সরকারী সহায়তা এবং এখানে আমার উপস্থিতি তার উদাহরণ।  আপনি তাই  অন্যদের উসকানি দিতে  পারেন না বা তাদেরকে ব্রিটেনের শত্রুতে পরিণত করতে পারেন না। আমার সরকার ব্যক্তিগত কৌশলে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার ব্যবস্থা  নিতে সম্মত হয়েছে। এক্ষেত্রে  আমাদের যা করতে হবে তা হল একটি গোপন এবং  গ্রহণযোগ্য উপায় খুঁজে বের করা।’

 হ্যামিল্টন সময় নিয়ে  সতর্কতার সাথে এই শব্দগুলি উচ্চারণ করেছিলেন। সুলতান এই সম্মতির অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি আর সময় নষ্ট করেননি।

 হ্যামিল্টন যা বলছিলেন সুলতান তার প্রতিটি পদক্ষেপে শোনার জন্য আরও বেশি আগ্রহী হয়ে   উঠলেন: উপজাতি ও শেখদের সমৃদ্ধ করে বলপ্রয়োগের বদলে শান্তিপূর্ণভাবে এই অঞ্চলকে  বর্ধিত  করা বাঞ্ছনীয় হবে। তবে তা প্রকাশ্যে বা অন্যকে ঘাঁটাঘাটি না করে  গোপনে বা  নিঃশব্দে করতে পারলে  ভাল হবে।”

 মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তারা দুজন অভিন্ন স্বত্তা হয়ে ছিলেন । তারা যেন  ছিলেন  সংযুক্ত যমজ, দুটি মাথা বিশিষ্ট একটি দেহ। গভীর রাতে, সারা দিন এবং সন্ধ্যার  শুরুতে  সব ব্যাপারে কথা বলার জন্য  তারা যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন : ব্রিটেন কীভাবে চিন্তা করছিল এবং মরুভূমির লোকেরা কীভাবে চিন্তা করছিল। বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ব্রিটেনের কী প্রত্যাশা ছিল, এবং সুলতান কী চেয়েছিলেন…

উপদ্বীপটি নিঃশব্দ ব্যবস্থা অস্বীকার করেছিল। আল-সৌদ গোষ্ঠীর দুটি বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে কেনার জন্য  নগদ অর্থ যথেষ্ট ছিল না। তাদেরকে সামরিকভাবে আয়ত্বে আনতে  হয়েছিল। ব্রিটিশরা অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। ইবনে সৌদের যোদ্ধারা এগুলোকে ভালোভাবে ব্যবহার করেছিল। হাইল শহর জয় করার পর এবং রশিদি বংশের শক্তিশালী আমিরদের পরাজিত করার পর, ইবনে সৌদ নিজেকে নেজদ এর সুলতান ঘোষণা করেন। সমগ্র মধ্য আরব এখন তার নিয়ন্ত্রণে। তার  পূর্বপুরুষদের অনুসরণে  নতুন সুলতান তার পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্ত্রীদের জোর করে বিয়ে করেছিলেন।

হাইলের প্রাক্তন আমির মুহাম্মদ ইবনে তালালের প্রতি আচরণ  ভবিষ্যত সৌদি আরবের একটি চিত্র প্রদান  করেছে। রিয়াদে এলে ইবনে তালালকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসার পর  তাকে দুই বছর কারারুদ্ধ করা হয় এবং তারপর গৃহবন্দী করা হয়। বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর  তাকে সর্বত্র পঞ্চাশ জন লোক অনুসরণ করতো। মধ্য আরবের বিখ্যাত মৌখিক কবিদের একজন, আল  ওনি, পদচ্যুত আমিরের অনুগত ছিলেন।  কিন্তু ইবনে তালালকে তার সাথে দেখা করতে  দেওয়া হয়নি। ইবনে সৌদ আশঙ্কা করেছিলেন যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে কবির রচিত  একটি কবিতা মরুভূমিতে সমালোচনার  ঝড় তুলতে পারে। কবি এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজকুমার গোপনে দেখা করতে গিয়ে  ধরা পড়ে যান। কবিকে অন্ধ করে কারাগারে এমন খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়।  ইবনে তালালকে হত্যা করা হয়।

ইবনে সৌদ আশঙ্কা করেছিলেন যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে কবির রচিত  একটি কবিতা মরুভূমিতে সমালোচনার  ঝড় তুলতে পারে। কবি এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজকুমার গোপনে দেখা করতে গিয়ে  ধরা পড়ে যান। কবিকে অন্ধ করে কারাগারে এমন খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়।  ইবনে তালালকে হত্যা করা হয়।

বিজিত শহরগুলিতে অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিপর্যয় ঘটে।  ওয়াহাবি একনায়কতন্ত্রের ভয়ে অনেক নাগরিক ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। কিন্তু তেলের অনুসন্ধান এই অঞ্চলের সবকিছু এবং সবাইকে রূপান্তরিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে বালির নীচে ধনসম্পদের একচেটিয়া অধিকার  না দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। মার্কিন তেল অনুসন্ধানকারীরা ১৯৩০-এর দশকের  গোড়ার দিকে  এসে ইবনে সৌদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ইবনে সৌদ  তাদেরকে দামের ক্ষেত্রে  একটি  ছাড় দিতে সম্মত হয়। ১৯৩৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ৫০,০০০ পাউন্ড মূল্যের সোনা  প্রদান করে। প্রতিদ্বন্ধী ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতার ভয়ে মার্কিন সরকার স্ট্যান্ডার্ড অয়েলকে এসো (Esso), টেক্সাকো (Texaco) এবং  মবিল (Mobil)-এর সাথে  একীভূত করে অ্যারাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি (ARAMCO) গঠন করে।  ১৯৩৮ সালে তেল উৎপাদন শুরু হলো।

মার্কিন তেল অনুসন্ধানকারীরা ১৯৩০-এর দশকের  গোড়ার দিকে  এসে ইবনে সৌদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ইবনে সৌদ  তাদেরকে দামের ক্ষেত্রে  একটি  ছাড় দিতে সম্মত হয়। ১৯৩৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ৫০,০০০ পাউন্ড মূল্যের সোনা  প্রদান করে। প্রতিদ্বন্ধী ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতার ভয়ে মার্কিন সরকার স্ট্যান্ডার্ড অয়েলকে এসো (Esso), টেক্সাকো (Texaco) এবং  মবিল (Mobil)-এর সাথে  একীভূত করে অ্যারাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি (ARAMCO) গঠন করে।  ১৯৩৮ সালে তেল উৎপাদন শুরু হলো।

পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সংযোগটি শক্তিশালী হয় এবং ধাহরানে নব-প্রতিষ্ঠিত  ইউএসএএফ ঘাঁটি ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা’-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। তারা সৌদি বাদশাহকে রাজ্যের ‘উন্নয়নে’ সহায়তা করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার প্রদান করতে থাকে। বিশাল তেলের মজুদ এর কর্তৃত্ব স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছিল।  সৌদি আরব বিশ্বে কমিউনিজম এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসাবে কাজ করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সাম্রাজ্যিক স্বার্থের দিকে মনোযোগ রেখেছে। আরব রাজ্যের সীমানার মধ্যে যা ঘটছিল তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।  এবং তা  অবাক হওয়ার মত কিছু না। (চলবে) 

আগের পর্ব: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৪

ফাতেমা বেগম: লেখক শিক্ষক অনুবাদক। ইমেইল: fatemaorama@gmail.com

পাদটীকা

[1] আমি পাকিস্তানে প্রতিরোধ এবং বিজয় সম্পর্কে দীর্ঘ লিখেছি: মিলিটারী রুল অর পিপল’স পাওয়ার?,  লন্ডন এবং নিউইয়র্ক ১৯৭০।

[2] ট্রটস্কিস্টদের সাথে সাদৃশ্য খুব অসম্ভব নয়। তারাও লেনিনের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেছিল কিন্তু অতিরিক্ত ভক্তি  এবং তার ছবির  প্রদর্শন অপছন্দ করেছিল, এবং শুধুমাত্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রথম চারটি  কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাদের মতে এর পরে বিকৃতি শুরু হয়, যা পরবর্তীতে সম্পূর্ণ অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়।

[3] ইবনে ওয়াহহাবের বাবা এবং ভাই উভয়ই নতুন মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার ভাই সোলেইমান সিস ওহাবি ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে উল্লেখ করেন যে ইসলামের প্রথম দিকের নেতারা কখনোই অন্য মুসলমানদেরকে বহুজাতি ও অবিশ্বাসের পরিচায়ক হিসেবে নিন্দা করেননি।

[4] এর কারণ ছিল সমতাবাদ। জীবিত এবং মৃত  সকল মুসলমানের আল্লাহর কাছে সমান হওয়ার কথা।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •