আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন-২
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়
গত পর্বে সুন্দরবনের ইতিহাস, নদী, লতাগুল্ম ও বৃক্ষরাজি নিয়ে আলোচনার পর এই পর্বে সুন্দরবনের মৎস্য ও জলজ সম্পদ, সুন্দরবনে প্রাণী সম্পদ এবং বন্যপ্রাণী বিলুপ্তিসহ সুন্দরবনের বিপদের কারণসমূহ তুলে ধরা হয়েছে।
সুন্দরবনের মৎস্য ও জলজ সম্পদ
আগেই বলেছি ছোটবড় মিলিয়ে সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় সাড়ে চার শত নদ নদী। এইসব নদ-নদী ছাড়াও বহু স্থায়ী জলাশয় রয়েছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে। ছোটবড় হাওড় বাওড়ের মতো এই জলাশয়গুলোতে বারো মাস জল জমে থাকে। তবে প্রতিদিন জোয়ার ভাটা হয় বিধায় প্রতিদিনই জল কমে এবং বাড়ে। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে খরা মৌসুমে অর্থাৎ অগ্রহায়ণ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত জলের স্বাভাবিক মাত্রা থাকে অনেক কম। এই সকল নদী এবং খাল ও জলাশয়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপ, ব্যাঙ, কামট, হাঙর, কুমির, সোম, সোমগুঁই, কুঁচে সাপ, প্রভৃতি জন্মে। এগুলি সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ। এর অনেকগুলি অর্থকরী প্রাণী আবার অনেক আছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী। অর্থকরীর মধ্যে মাছ হচ্ছে সর্বপ্রধান। সুন্দরবনের নদী জলাশয়গুলিতে প্রচুর প্রজাতি ও প্রচুর সংখ্যায় মাছ পাওয়া যায়। কচ্ছপ ব্যাঙ এবং কুঁচে সাপ এখন ধরা এবং বিক্রি করা নিষিদ্ধ। কুমির, সোম, সোমগুঁই, হাঙর প্রভৃতিও সংরক্ষিত প্রাণী। তাই আমরা এখানে শুধু মাছ ও চিংড়ি নিয়ে আলাপ করব।
সুন্দরবনের নদ নদীতে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মাছের মধ্যে ইলিশ, ভেটকি, পাতারি, দাঁতনে, তপসে, রূপচাঁদা, বেলে, পোয়া, ভাঙ্গাল, শৈল, কৈ, মাগুর, টাকি, ফ্যাসা, কইরোল, পাঙ্গাস, শালপাতা, চ্যাপিলা, সাগর কৈ, গুলি, শুড়ি, বাঁশপাতা, পোয়া ভাঙন, শিং প্রভৃতি প্রধান। এইসব মাছ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সব নদী খালে এইসব মাছ ধরে উপকূলীয় অসংখ্য মানুষ জীবিকা অর্জন করে।
মাছ ছাড়াও অন্যান্য জলজ প্রাণী রয়েছে যারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। জীবনচক্র খাদ্য চক্র রক্ষা করে প্রতিবেশ সুন্দর রাখে। এছাড়া সকল জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপন্ন হয় যা জলজ সকল প্রাণীর অক্সিজেন জোগায়। এসব কিছুই সুন্দরবনের মহামূল্য সম্পদ। বাংলাদেশে যত রকমের চিংড়ি পাওয়া যায় তার সব ধরনের চিংড়ি সুন্দরবনে সুলভ। অনেক প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে সুন্দরবনে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গলদা, বাগদা, চাকা, চামলী, কুঁচো, নোয়া, হরিণাখুটো, কাঁঠালী ও গোদা প্রভৃতি। এর মধ্যে মাত্র ২টি প্রজাতির চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। তা হল গলদা ও বাগদা। গলদা মিষ্টি জলের এবং বাগদা হল লোনা জলের মাছ। এই দুই প্রজাতির চিংড়ি সুন্দরবনের নদীগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
মাছ ছাড়াও অন্যান্য জলজ প্রাণী রয়েছে যারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। জীবনচক্র খাদ্য চক্র রক্ষা করে প্রতিবেশ সুন্দর রাখে। এছাড়া সকল জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপন্ন হয় যা জলজ সকল প্রাণীর অক্সিজেন জোগায়। এসব কিছুই সুন্দরবনের মহামূল্য সম্পদ।
কাঁকড়া সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয় যায়। কাঁকড়া উভচর প্রাণী হওয়ার কারণে নদীতে খালে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ডাঙ্গায় বিভিন্ন জঙ্গলের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কাঁকড়াও বিদেশে রপ্তানি হয়।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতি সময়ে অতিলোভী কিছু মানুষ বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরছে। এতে প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মাছ মরার সাথে সাথে প্রচুর ডিম রেনু এবং জলজ অন্যান্য প্রাণী মারা যাচ্ছে। তাছাড়াও উদ্ভিদকুলেরও ক্ষতি হচ্ছে বিষক্রিয়ার ফলে।
সুন্দরবনে প্রাণী সম্পদ
প্রাণবৈচিত্রে ভরা মহাপ্রাণ এই সুন্দরবনে বহুবিচিত্র প্রাণীসম্পদে ভরপুর। স্থলভাগে রয়েছে পৃথিবীর সবথেকে হিংস্র বাঘ আর জলে রয়েছে বিশালাকারের কুমির। অসাধারণ রূপশ্রী মন্ডিত চিতল হরিণ কেবল এই সুন্দরবনেই পাওয়া যায়। সুন্দরবনের অসংখ্য বৃক্ষরাজির সাথে হাজার রকমের জানা অজানা অজস্র প্রাণীকুল সুন্দরবনকে করেছে সমৃদ্ধ এবং দৃষ্টিনন্দন। সর্বমোট ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে সুন্দরবনে। বাংলাদেশে সুন্দরবনই হল বন্যপ্রাণীর সর্ববৃহৎ আবাসস্থল। ১৯৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষনা করা হয়েছিল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণার্থে তাদের বিচরণ, বংশ বিস্তার এবং নিরাপদ জীবন যাপন, জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য সুন্দরবনে তিনটি অভ্যয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেগুলি হচ্ছে কটকা কচিখালী, নীলকমল পশ্চিম সুন্দরবন। এই তিনটি অভয়ারণ্যে মোট আয়তন হচ্ছে ১৩৯৭০০ হেক্টর। ১৯৯৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশনের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি তার ৭৯৮ তম অধিবেশনে সুন্দরবনের এই তিনটি অভয়ারণ্যকে পৃথিবীর ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষনা দিয়েছে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী বিশ্ববাসীর কাছে বিনোদনের এক অমূল্য সামগ্রী, সাথে সাথে তা বাংলাদেশের এক মহামূল্য সম্পদ। পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণে এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখে চলেছে। এদের অর্থনৈতিক গুরুত্বও বিশেষভাবে বিবেচনাযোগ্য। অবৈধ শিকারী ও শত্রুর হাত থেকে সুন্দরবনের বহু বন্যপ্রাণী এর বনজ ও জলজ সম্পদ রক্ষা করে। তাই এদেরকে আমরা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক জাগ্রত প্রহরী হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এর সকল প্রাণী প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে অমূল্য অবদান রেখে চলেছে। এখন আমরা সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য প্রাণীগুলির সংখ্যা উল্লেখ করছি।
সর্বমোট ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে সুন্দরবনে। বাংলাদেশে সুন্দরবনই হল বন্যপ্রাণীর সর্ববৃহৎ আবাসস্থল।
বাঘের সংখ্যা: ৩৫০-৪০০। হরিণ: ১ লক্ষ থেকে ১.৫ লক্ষ। বানর: ৪০-৫০ হাজার। বন্যশুকর: ২০-২৫ হাজার। কুমির: ১০০-১৫০ শত। উদবিড়াল: ২০-২৫ হাজার। প্রজাতিভিত্তিক প্রাণীর সংখ্যা- স্তন্যপায়ী: ৩২ প্রজাতি। সরীসৃপ: ৩৫ প্রজাতি। উভচর: ৮ প্রজাতি। পাখি: ৩০০ প্রজাতি।১
সরকারী এই হিসাবের বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষণায় যা উঠে এসেছে সেগুলি হল, এখানে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ বসবাস করে। এখন সংক্ষেপে আমরা যেসব বন্যপ্রাণীগুলি নিয়ে আলোচনা করব সেগুলি হল বাঘ, হরিণ, বানর, শুকর, সরীসৃপ, পাখি প্রভৃতি। তারপর কতগুলি বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের নিয়ে কথা বলব। অতঃপর বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির কারণ এবং এবং সংরক্ষণের উপায় নিয়ে কিছু কথা বলব।
বাঘ: সুন্দরবনের অরণ্যের বিরাটত্ব এবং নদীসংখ্যার বিশালতা আর এই বাঘের ভয়ংকরতা সুন্দরবনকে অনন্য করে রেখেছে। অরণ্যে বাঘ আর নদীতে কুমির এমন বৈচিত্র পৃথিবীতে মেলা ভার। বিশেষ করে সুন্দরবনের বাঘের কোন জোড়া মেলা দুষ্কর। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ৫শত বাঘ রয়েছে। তারমধ্যে ভারতে আছে ৪৭১৫টি এবং বাংলাদেশে ৩৬২টি। কোন কোন সংস্থা বাংলাদেশে ৪০০ বাঘ আছে বলে মনে করে। সকলপ্রকার বাঘের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ চালচলনে রাজকীয়। শিকারে ভীমসদৃশ। আচার আচরণে রাজসিকতার কারণে ইউরোপিয়রা একে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নামে অভিহিত করেছে। এর সৌন্দর্যও অদৃষ্টপূর্ব। কমলা-হলুদ রংয়ের শরীরে লম্বা লম্বা কালো ডোরা কাটা দাগ। এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ লম্বায় ১০ ফুট আর উচ্চতায় ৩ ফুট। সামনের পা দুখানা বেশ মোটা। একটি পুরুষ বাঘের ওজন ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোগ্রাম। মেয়ে বাঘের ওজন ১১০ থেকে ১৫০ কিলোগ্রাম। দেহে এত শক্তি ধরে যে অতি সহজেই একটি গরু বা মহিষকে শিকার করে কাঁধে ফেলে ছুটে যেতে পারে। এদের মাথা বড় এবং গোলাকার চোখ দুটো অনেক বড় এবং উজ্জ্বল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার অত্যন্ত রক্তপিপাসু এবং হিং¯্র। তারা শিকার ধরে প্রথমেই তার ঘাড় ভেঙ্গে রক্তপান করে। শিকারের সন্ধানে তারা দীর্ঘক্ষণ অল্প জায়গায় ওত পেতে বসে থাকতে পারে। বাঘিনী একসময়ে ২ থেকে ৪টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা প্রসবের পরে বাঘিনী বাঘের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। কারণ বাঘ বাঘিনীর বাচ্চা খেয়ে ফেলতে পারে। মাংস বাঘের প্রধান খাদ্য। একসময় দেশের বহুস্থানে বাঘ দেখা যেত কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের এখন শেষ আশ্রয়স্থল হয়েছে সুন্দরবন।
হরিণ: সুন্দরবনে সবথেকে অধিক পরিমাণে যে প্রাণী পাওয়া যায় তা হল এই হরিণ। এখানে মোট হরিণের সংখ্যা প্রায় দেড়লক্ষ। বনের যেখানে যাওয়া যায় হরিণ চোখে পড়বেই। সুন্দরবনের জীবজন্তুর গমনাগমনের যে পথ সেখানে হরিণের পদচিহ্ন দেখা যাবেই। হরিণ খুব সামাজিক জীব। এরা কখনোই একা বাস করে না। দল বেঁধে বা পাল ধরে বসবাস করে। হরিণ আরামপ্রিয় প্রাণী। একটু উঁচু ছায়াযুক্ত স্থান দেখলেই হরিণ সেখানে আস্তানা গাড়বে। পায়ে যদি একটু কাদা লাগে মহা বিরক্ত হয়ে পা ঝাড়তে থাকবে যতক্ষণ না কাদা পা থেকে দূর হচ্ছে। যাদের সৌন্দর্য আছে তা রক্ষা করবার প্রবৃত্তিও প্রকৃতি তাদের দিয়েছে। হরিণ অত্যন্ত চঞ্চল, অস্থির। আকর্ণ চোখদুটি এবং সরু সরু পা চারখানি প্রকৃতি যে সৃষ্টি করেছে তার চঞ্চলতার উপযোগী করে। হরিণের গায়ের রং অনেকটা বাঘের মতোই হলুদাভ প্রকৃতির। বাঘের গায়ে কালো ডোরা কাটা আর হরিণের গায়ে সাদা ফোঁটা ফোঁটা দেয়া।
সুন্দরবনে দুই জাতীয় হরিণ পাওয়া যায়। ডোরা বা চিত্রল হরিণই অধিক। ডোরা হরিণের গলা, পেট ও লেজের নিচে সাদা, উরুর নিচের অংশ, কানের ভিতরাংশ সাদা, মুখখানা কালো, মাথার উপর পাটল বর্ণ (ইটের মতো রং)। হরিণের আকৃতি, বড়গুলি ৪/৫ ফুট দীর্ঘ এবং প্রায় ৩ ফুট উচ্চ। এছাড়া আর এক জাতীয় হরিণ আছে তাকে বলে কুকুরে হরিণ। কুকুরে হরিণের গায়ে কোন ডোরা বা ফোঁটা নেই। এর রং হলুদাভ। হলুদ রংয়ের একটা বড় ছাগলের মতই।
হরিণের প্রধান খাদ্য গাছের পাতা। প্রায় সব রকমের পাতা খায় বটে কিন্তু কেওড়ার ফল ও পাতা হরিণের সব থেকে প্রিয় খাদ্য। কেওড়া গাছে বানরের বাসা। বানর দলে দলে কেওড়া গাছে বসে পাতা মাটিতে ফেলে আর হরিণ পালে পালে মাটি থেকে সেই পাতা খুটে খায়। তাই বানরকে হরিণের বন্ধু বলা হয়। এক একটা হরিণের ওজন প্রায় এক থেকে দেড় মণ হয়ে থাকে।
বানর: দ্বিতীয় সংখ্যাধিক্য প্রাণী এই বানর। সংখ্যায় এরা প্রায় ৫০ হাজার। বানর দলবদ্ধভাবে বাস করে। এরা সাধারণত নদী তীরভূমি অঞ্চলে বাস করে। এর কারণ হল এখানে অধিক পরিমাণে কেওড়া জন্মে। নদীর তীরে লাইন দিয়ে কেওড়া গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। থরে থরে ফল ঝুলতে থাকে। কেওড়ার পাতা ও ফল বানরের অতিপ্রিয় খাদ্য। সুন্দরবনের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অধিক পরিমাণে বানরের বসবাস। বানরের বাঁদরামির শেষ নাই। সারা অঞ্চল তারা মাতোয়ারা করে রাখে। হরিণের পরম বন্ধু এই বানর জাতি। বানর কেওড়াগাছে বসে কেওড়া ফল আর পাতা খায় আর ডাল ভেঙে নিচে মাটিতে ফেলে। হরিণ সেই পাতা ও ফল খুটে খুটে খায়। বানর সেজন্য হরিণদের আমন্ত্রণ করে। গাছে বসে কু কু কু করে ডাকতে থাকে। আর হরিণ দল বেঁধে চলে আসে। আর কোন শিকারী বা বাঘ দেখলে প্রথমে অঙ্গভঙ্গি করে পরে চিৎকার করে ওঠে। হরিণ তখন বিপদ বুঝতে পারে এবং দৌড়ে পালিয়ে যায়। বানর প্রায়শই হরিণের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়।
শুকর: সুন্দরবনে শুকরের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এগুলি ভয়ানক হিং¯্র হয়ে থাকে। বাঘের প্রিয় খাদ্য শুকর আর হরিণ। হরিণের সাথে দৌড়ে বাঘ পেরে ওঠে না শিকার ধরতে তাই শুকরই তার প্রিয় খাদ্য। কিন্ত শুকর অত্যন্ত বলশালী এবং হিং¯্র। এরা গভীর বনে বসবাস করে। খরগোশ আর ইঁদুর এদের প্রধান খাদ্য। শুকর প্রায় ৫ ফুট লম্বা আর লেজ ১ ফুট। এদের গায়ের রং ঈষৎ লালচে কালো। ঘাড়ের, বুকের, পেটের লোম গোড়ায় কালো, আগায় সাদা। এদের মুখে বড় বড় দুটি দাঁত প্রায় ৭ ইঞ্চি লম্বা হয়।
কুমির: কুমির মূলত জলজ প্রাণী কিন্তু একে উভচর প্রাণী বলা হয়। মিঠা জলের কুমির প্রায় বিলুপ্তির পথে কিন্তু লোনা জলের কুমির প্রচুর পরিমাণে সুন্দরবনের নদীগুলোতে এখনো বিদ্যমান। এরা অত্যন্ত বলশালী এবং হিংস্র। কুমির সাধারণত ১৫ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রায় সময়, বিশেষ করে শীতকালে নদীর চরে বালুকাবেলায় শুয়ে কুমির রৌদ্র পোহায়। মরা গরু বা অন্য কোন প্রাণীর মৃতদেহ নদী দিয়ে ভেসে গেলে তার সাথে একাধিক কুমির ভাসতে ভাসতে মাংস খেতে থাকে। কুমিরের লেজ অত্যন্ত শক্ত। লেজের বাড়ি দিয়ে সে বাঘকে জব্দ করতে পারে। লেজের আঘাতে ছোট নৌকা থেকে মানুষকে নদীতে ফেলে দিয়ে শিকার করে। প্রায় ২০০ কুমির এখন সুন্দরবনাঞ্চলে বসবাস করে।
সরীসৃপ: সুন্দরবনে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ আছে। সাপ ২ প্রকার। বিষধর আর বিষহীন। বিষধর সাপকে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। (১) চৌসাপা (২) বোড়া আর (৩) বীজজড়ী। কেউটে, গোখরো, আইরাজ ও কামড় এই ৪ প্রকার সাপ হল চৌসাপা গোত্রভুক্ত। এদের মধ্যে আবার প্রকারভেদ রয়েছে। কেউটের মাথায় গোলাকার চিহ্ন (ঙ) থাকে আর গোখরোর মাই ইউ (ট) চিহ্ন থাকে। কেউটে, গোখরো, আইরাজ ফনাযুক্ত আর কামড় ফনাহীন। এই ৪ ধরনের সাপের বিষ রয়েছে তীব্র। কেউটে ও গোখরো প্রধানত লোকালয়েও দেখা যায় কিন্তু আইরাজ কেবলমাত্র সুন্দরবনেই বাস করে। আর একটি বিষধর সাপ বোড়া তবে সে বিষ তেমন তীব্র নহে। এই সাপ আকারে অনেক বড় হয়। বৃহদায়তন সাপ অজগর। এই সাপ সমুদ্রতীরবর্তী চরাঞ্চলে দেখা যায়। এরা এত বড় যে হরিণ, খরগোশ, ইঁদুর, বন্য শুকরের বাচ্চা প্রভৃতি ধরে খেতে পারে।
পাখি: সুন্দরবনের সৌন্দর্যের আর একটি বড় উপাদান হল পাখি। বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র রূপের, বিচিত্র আকারের অসংখ্য পাখি রয়েছে সুন্দরবনে। লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচিত্র পক্ষীকুল যখন বিশাল নদীর বুকের উপর দিয়া বনের গহীনে হারিয়ে যায় তখন তা হয় এক নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। সুন্দরবনে মোট ৩১৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে মাছরাঙা রয়েছে ৯ প্রজাতির। চিল, বক, কাক, মাছরাঙা এবং মাছাল প্রভৃতি পাখিগুলি নদীর কূলে, খালের পাড়ে এবং জলাশয়ের ধারে চুপটি মেরে বসে থাকে। কারণ এরা সবাই আমিষভোজী। মাছ তাদের প্রিয় খাদ্য। এদের অধিকাংশের লম্বা বাঁকানো ঠোঁট, সরু পা, গলা লম্বা হয়ে থাকে। এরূপ আকৃতি তাদের জলজপ্রাণী বিশেষত মাছ শিকারের পক্ষে অনুকুল। এখানে স্থানীয় পাখি যেমন প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান ঠিক তেমনি প্রতি শীতকালে নানা বর্ণের, নানা জাতের নানাকৃতির অসংখ্য পরিব্রাজক পাখি সুন্দরবনে উড়ে আসে। ৩ মাস এখানে বসবাস করে। আবার গ্রীষ্মের আগমনে স্বদেশে ফিরে যায়। সুন্দরবন তথা বাংলাদেশে যে সব পাখি সবসময় এখানে দেখা যায় তার মধ্যে দোয়েল, শালিক, পেঁচা, সারস, টুনটুনি, কাঠঠোকরা, শামখোল, বিল বাচ্চু, পানকৌড়ি, চিল, মদনটাক, মানিক, গয়াল, বুনোহাঁস, বালি হাঁস, টিয়া, সাদা কাক, হলদে পাখি, মধুপায়ী, বেনেবৌ, হাঁড়িচাচা, ফুলঝুড়ি, মনুয়া, বনমোরগ, হাড়গিলা, কানি বক প্রভৃতি। এসব ছাড়া আরও যেসব পাখি সুন্দরবনের স্থায়ী বাসিন্দা তারা হল: বাটাং, হটটিটিটি, শামুকভাঙ্গা, মানিকজোড়, কাস্তেচোরা, কোদালী বক, ভুবন চিল, শঙ্খচিল, বাজপাখি, সাদা ঈগল, শকুন, লক্ষীপেঁচা, কালিম, পাস্তামুখী, ভূতিহাঁস, গয়াল, চাতক, দুধরাজ প্রভৃতি।
সুন্দরবনে মোট ৩১৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে মাছরাঙা রয়েছে ৯ প্রজাতির।
বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী: নানাবিধ কারণে সুন্দরবনের বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। বহু প্রাণী বিলুপ্ত হতে চলেছে। আর অনেক প্রাণী অনেক বিপন্ন অবস্থায় কালযাপন করছে। যেগুলো বিলুপ্ত হয়েছে সেগুলো হল: ১ প্রজাতির বন্য মহিষ, ২ প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার, ১ প্রজাতির মিষ্টি জলের কুমিরসহ সর্বমোট ১২ প্রজাতির প্রাণী। এছাড়া গত ১০০ বছরের সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ৩ প্রজাতির গন্ডার, ৩ প্রজাতির বন্য মহিষ, নীল গাই, ও নেকড়ে বাঘ। সুন্দরবনের সৌন্দর্য – বিরাটাকৃতির সারস পাখি হারিয়ে গেছে বন থেকে। আলেকজান্ডার হ্যামিলটন বলেছেন, ১৯২৭ সালেও সুন্দরবনে প্রচুর গন্ডার ছিল। রাজ প্রতাপাদিত্য যৌবনকালে প্রচুর গন্ডার শিকার করতেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও সুন্দরবনে যথেষ্ট পরিমাণে বন্য মহিষ ও বাইসন ছিল। লর্ড কার্জন নিজে বন্য মহিষ শিকার করেছিলেন। মোঘল স¤্রাট আকবরের সময়কালে সুন্দরবনে প্রচুর হাতি বাস করত। তার বিবরণ পাওয়া যায় আবুল ফজলের আইন-ই-আকবর গ্রন্থ থেকে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, নি¤œবর্ণিত প্রাণীগুলি সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন: বাঘরোল, চিতা বিড়াল, ভোঁদড়, শুশুক, গুইসাপ, কাঠা, চিরুনী কচ্ছপ, ময়াল, দৈত্য বক, সমুদ্র ঈগল, মেছোবাঘ, সাগর কাঁকড়া, সাগর কুসুম, সাগর শসা, শকুন, পেঁচা, রক্তক, মেছো শামুক প্রভৃতি।
বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির কারণসমূহ
বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি শুধু নয় সমগ্র সুন্দরবন ধ্বংসের পিছনে অপরিণামদর্শী মানবসমাজ প্রধানত দায়ী। বৃক্ষরাজি, বন্যপ্রাণী, জলজ সম্পদ সব কিছু ক্ষতিগ্রস্তের পিছনে মানুষের ভূমিকাই প্রধান। স্বার্থপর অতিলোভী মানুষ যথেচ্ছা পশু শিকার করছে দুহাতে বৃক্ষ নিধন করছে। বিষ দিয়ে মাছ মারছে, বন্দুক দিয়ে নির্বিচারে পাখি শিকার করছে। এমনকি চুরি করে গর্ভবতী হরিণ হত্য করে তার মাংস খাচ্ছে। তামাশা করে বানর গুলি করে মেরে ফেলছে। মানুষের এই অপরাধী প্রবণতা সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করছে। বন উজাড় করে কৃষিজমি বানানো হচ্ছে। রাস্তা নির্মাণ, গৃহ নির্মাণসহ নানা কাজে অজ¯্র গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। ব্যাপকভাবে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে তা পানিবাহিত হয়ে সুন্দরবনের নদীখালগুলিতে প্রবেশ করছে। সেখানে মাছ মারা যাচ্ছে। মাছ না পেয়ে শিয়াল ও বনবিড়াল প্রভৃতির খাদ্যের অভাব ঘটছে। এগুলি আবার বাঘের খাদ্য – তা বিনষ্ট হচ্ছে। এইভাবে খাদ্যচক্র বিঘিœত হচ্ছে। অন্য দিকে বিভিন্ন পাখি, শকুন, চিল, মাছরাঙা প্রভৃতি ওই বিষাক্ত মাছ ও তার পোনা খেয়ে মৃত্যুবরণ করছে।
এসব কিছুর পরিণতিতে আরও যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলি হল: বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর হার বাড়ছে। জন্মহার কমছে। বন্ধ্যাত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাচ্চা পালন এবং ডিমে তা দেয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অধিকাংশ প্রাণীকূলের আবাস এবং পক্ষীকূলের বাসা বাঁধার মতো বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করার হচ্ছে আর ডিম চুরি করে খাওয়া হচ্ছে। অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে এসব কিছু ঘটছে। জলযানের বর্জ্য নদীপথে বনভূমিতে গিয়ে বনের ক্ষতি করে। তেলবাহী ট্যাংকার মাঝে মাঝে সুন্দরবনের ভেতরে নদীতে ডুবে গিয়ে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে, তাতে প্রাণীকুলের ক্ষতি হয়। উচ্চস্বরে মাইক বাজায় টুরিস্ট এবং পিকনিক পার্টিরা, তারা উজ্জ্বল পোশাক এবং সুগন্ধী মেখে বনে যায়, এতে বন্যপ্রাণীরা বিব্রতবোধ করে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি বন্যপ্রাণীর জীবন প্রবাহে হুমকির সৃষ্টি করছে। তাছাড়া বড় বড় ঘুর্নিঝড় যেমন সিডর, আইলা, আম্ফান প্রভৃতি বন্যপ্রাণীর জীবন নাশ করে।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সরকারের বন সম্পর্কিত নীতিমালা যা বনের ব্যাপারে তাদের চরম অবহেলা আর অজ্ঞতারই বহিপ্রকাশ। সেই ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু হয়েছে। প্রথমত বনকে কেবল রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র হিসাবেই বিবেচনা করা। তাছাড়া বন উজার করে চাষের জমি, লোকালয় এবং নগর গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের কিছুমাত্র ভিন্ন চিন্তা ছিল না এ ব্যাপারে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের নতুন কোন চিন্তা আছে বলে বাস্তবে প্রমাণিত হচ্ছে না। সুন্দরবনের সন্নিকটে বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে তোলা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং স্বার্থে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলেছে, এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা ব্যবহার করা হবে। প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি জল মাটির নিচ থেকে তুলে আনতে হবে। এর ফলে নানারকমের রাসায়নিক গ্যাস, কয়লার ছাই প্রভৃতির উদগীরণ ঘটবে। এলাকায় জলশূন্যতার সৃষ্টি হবে। বহু প্রকারের বর্জ্য পদার্থ নদীতে ভূমিতে ফেলা হবে। ফলে জল দূষণ, ভূমি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ঘটতে থাকবে। আর এর সব কিছুই সুন্দরবনের জীবম-লের উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বৃক্ষলতা থেকে বন্য জন্তু এবং মৎস্যকূল সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসব ধরনের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ এবং অবিবেচক দুর্বুদ্ধি সুন্দরবন এলার মানুষকে বিপর্যস্ত করবে এবং অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। আর তার ফলে শুধু উপকূলীয় এলাকা নয়, সমগ্র বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হবে।
আগের কিস্তি: আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন-১
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। অবস্থান-বাগেরহাট।
টীকা:
১) বনবিভাগের সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৬-৯৭ সালে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর উপর সমীক্ষার ফলাফল।