ফিলিস্তিন সংহতি সমাবেশের ঘোষণা

ফিলিস্তিন সংহতি সমাবেশের ঘোষণা

গত ২৯শে ডিসেম্বর ২০২৩ ঢাকায় ফিলিস্তিন সংহতি সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঘোষণা পাঠ করেন আনু মুহাম্মদ। ঢাকায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূতের বাণী পাঠ করেন চৌধুরী মুফাদ আহমদ। সমাবেশ পরিচালনা করেন ডা. হারুণ অর রশীদ। সমাবেশ ও মিছিলে রাজনীতিবিদ, লেখক, শিক্ষক, শিল্পীসহ হাজার হাজার মানুষ অংশ গ্রহণ করেন। মিছিলের দুপাশে অসংখ্য মানুষ সংহতি জানান। এখানে সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হলো। 

STOP GENOCIDE .  END OCCUPATION.  FREE PALESTINE

Mass Rally in Dhaka (Shahbag Square), 29th December 2023, 2.30 PM.

Palestine Solidarity Committee, Bangladesh

“‘ইসরাইলী আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ কর, ফিলিস্তিন মুক্ত কর’ এই শ্লোগান দিয়ে আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে এই সংহতি সমাবেশ ও র‌্যালী একচ্ছত্র জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের জন্য ভূমিসন্তান আরব ফিলিস্তিনিদেরকে গত ৭৫ বছর ধরে হত্যা, নির্যাতন, বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ ও তাদের ভূমি জবরদখলের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। আমরা একই সঙ্গে ‘‘জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর, ফিলিস্তিনে আসবেই স্বাধীনতার ভোর’’ এই শ্লোগান নিয়ে ফিলিস্তিনী দীর্ঘ, অসম কিন্তু অক্লান্ত মুক্তি সংগ্রামের সাথে সংহতি জানাচ্ছি। সেই সাথে যারা ইসরাইলের এসব অমানবিক, ফ্যাসিবাদী, নৃশংস ঔপনিবেশিক দখল ও হত্যাযজ্ঞকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক  পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে যাচ্ছে আমরা সেই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষমতাধর আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যেভাবে এই বর্বরতার মুখে দর্শক শ্রোতার মত ভূমিকা নিচ্ছে আমরা তার আশু পরিবর্তনের জোর আহবান জানাচ্ছি। সেই সাথে যেসব দেশ ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এই সমাবেশ থেকে আমরা তাদের প্রশংসা করি। এই সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জাতিসংঘকে অর্থপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দাবি জানাই। 

সারা বিশ্বে ধর্ম জাতি লিঙ্গ বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষের প্রতিবাদ ও সংহতি কমর্সূচি এই সময়ের বিশ্বে সবচাইতে আশাব্যন্জক ঘটনা । রাষ্ট্রের সাথে জনগণের পার্থক্যও এখানে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিলেও সেসব দেশের সর্বস্তরের মানুষ নিপীড়িত ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছেন। আমরা আরও লক্ষ্য করছি যে, একদিকে যেমন অনেক মুসলিম প্রধান দেশ ফিলিস্তিনীদের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াচ্ছে না, আবার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খ্রীষ্টান ইহুদীসহ বিভিন্ন ধর্ম ও মতাবলম্বীরা ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ইসরাইলি দখলদারিত্বের প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এগুলো এটাই স্পষ্ট করে যে, ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর ইসরাইলি জুলুম, গণহত্যা, দখলদারিত্ব আর তার বিরদ্ধে লড়াই কোনো ধর্মীয় বিরোধের বিষয় নয়, এ লড়াই সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিবাদী দখলদার জালেম অপশক্তির বিরুদ্ধে সকল ধর্ম বর্ণের মুক্তিকামী মজলুম বিশ্ব মানবতার লড়াই। আমরা এর অংশ হিসেবেই আজ এখানে সমবেত হয়েছি। 

১৯৪৮ সালে জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনবাসীকে বাস্তুচ্যূত, ১৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং ৫৩০টির মতো গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয় । ফিলিস্তিন দখল করার জন্য সম্মিলিত এ ঘটনাবলীকে ফিলিস্তিনীরা ’নাকবা’ বা ধ্বংসযজ্ঞ বলে থাকে। ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন ফিলিস্তিনী ভূখন্ডের অপর অংশ গাজায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল সেই গাজা দখল করে। বর্তমানে গাজা প্যালেস্টাইনের অংশ হলেও আক্ষরিক অর্থেই ইসরায়েল কর্তৃক অবরুদ্ধ। আন্তর্জাতিকভাবে গাজাকে এখন বলা হয় বিশ্বের “বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার”।

চলতি বছরের ৭ই অক্টোবর থেকে দখলদার ইসরায়েলের ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের নতুন পর্যায়টি নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ রূপে হাজির হয়েছে, যা আজ (২৯ ডিসেম্বর ২০২৩) ৮৪ দিন ধরে বিরামহীনভাবে অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ২১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৮ হাজারের বেশি শিশু এবং ৬ হাজারের বেশি নারী। অনুমান করা হচ্ছে আরো ৮ হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। আন্তর্জাতিক কোনো আইন বিধি ইসরাইল মান্য করছে না। প্রকৃতপক্ষে “ইসরাইল গাজাকে আন্তর্জাতিক আইনের কবরস্থানে পরিণত করেছে”। ইসরাইলে হামাসের আক্রমণকে তারা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসরাইল ফিলিস্তিন ভূখন্ডে হত্যা জুলুম করে যাচ্ছে ১৯৪৮ থেকে, আর হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৭ সালে। এই দুই সময়ের মধ্যেই দখলদারদের হাতে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনী খুন হয়েছেন। কাজেই এসব অজুহাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এই পর্বে হামলার শুরু থেকেই ইসরাইল ঘোষণা দিয়ে গাজার অধিবাসীদের জন্য খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, চিকিৎসা সামগ্রী প্রভৃতির মতো জীবনরক্ষাকারী সকল কিছুর পথ বন্ধ করে দেয়। বোমা বর্ষণে ৬০ শতাংশ বসতবাড়ি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। সুপরিকল্পিতভাবে গাজায় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ ও গির্জা, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর ও চিড়িয়াখানা, নাট্যশালা, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে সাংবাদিক, চিকিৎসক ও ত্রাণ কর্মী, উদ্ধারকর্মী, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক-গবেষক। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তুদের জন্য নিয়োজিত জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও তার কর্মকর্তাদের কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। বরং ডাক্তার ও সাংবাদিকদের মতো তাদেরও ১৪২জনকে খুন করা হয়েছে যা নজিরবিহীন। বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশুসহ অবাধ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, অবরোধ, পানি ও খাদ্যাভাব, চিকিৎসা ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন, রোগব্যাধির বিস্তার ইত্যাদি দিয়ে ইসরাইল গাজাকে পৃথিবীর বুকে নরক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

আমরা দৃঢ়কন্ঠে বলতে চাই- সাম্রাজ্যবাদ মদদপুষ্ট ইসরাইলী আগ্রাসন, দখল, গণহত্যা এবং অব্যাহত জুলুমের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতিরোধ অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ ইসরাইলী দখলদারিত্ব, গণহত্যা ও জুলুমে ক্ষুব্ধ।  বাংলাদেশের সর্বজনের পক্ষ থেকে এই সমাবেশ তাই দাবি করছে:

১. ফিলিস্তিনীদের উপর দখলদার ইসরাইলী নারকীয় আগ্রাসন ও গণহত্যা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

২. ইসরাইলী দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের পরিপূর্ণ অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের উভয় অংশের মানুষের জান-মাল, জীবনজীবিকা, নিরাপত্তা ও পরিপূর্ণ মানবাধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন চুক্তি, প্রস্তাব ও শর্ত/মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাধীন ও সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে।

  ৪. আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বরাবরই ফিলিস্তিনী জনগণের সাথে  আমাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ সম্পর্ক। অথচ আমরা দু:খের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশ সরকার ইসরাইলের প্রতি নমনীয় ভাব নিয়ে পাসপোর্ট সংশোধন করেছে। এছাড়া ইসরাইলের কাছ থেকে সরকার জননিপীড়নের প্রযুক্তি ক্রয় করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এর নিন্দা করি এবং অবিলম্বে ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় ও স্বচ্ছ ভূমিকা নেবার দাবি জানাই।

এই সমাবেশ ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের সকল প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, আগ্রাসন, দখলদারিত্ব এবং শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইএর সাথে আবারও সংহতি জানাচ্ছে। ধন্যবাদ।”  

————————–

ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি, বাংলাদেশ। শাহবাগ, ঢাকা। ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২৩

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •