গাজায় জায়নবাদী গণহত্যা: ইসরায়েল-ভারত মাখামাখি রহস্য

গাজায় জায়নবাদী গণহত্যা: ইসরায়েল-ভারত মাখামাখি রহস্য

আলমগীর খান

গত ৭ই অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর নতুন আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। এবারও ইসরাইলের প্রধান মদদদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই ইসরাইলকে সমর্থন ও অস্ত্রযোগান দিয়ে যাচ্ছে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল দেশের মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ভারত ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনী জনগণের বন্ধু হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মোদী সরকারের সময় থেকে তারা ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ দখল ও নৃশংস গণহত্যার পরও ভারতের এই অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। এই লেখায় এই সম্পর্কের অতীত বর্তমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ দেখে যে কারো মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আধুনিক বিশ্বে এ বর্ণবাদী রাষ্ট্রটি গণহত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েলের সরকার গাজায় পানি, খাবার, বিদ্যুৎ, ওষুধ ইত্যাদি সব জরুরি পণ্য ও সেবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়—উদ্দেশ্য গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ২৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ হ্যাপি ক্রিসমাসের আগের দিন পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি বোমায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ হাজার ৪২৪ জন, যার মধ্যে শিশু প্রায় অর্ধেক (কমপক্ষে ৮ হাজার ২০০ জন) এবং পশ্চিম তীরে মৃত ৩০০-র বেশি, যার মধ্যে শিশু প্রায় ১০০। আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।

ডেমোক্রেসি ওয়াচে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ রশিদ খালিদি বলেছেন, এ পর্যন্ত ৯০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন গাজা আক্রমণে। এ ছাড়া ২৮৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, ১৩৫ জন জাতিসংঘ কর্মী নিহত হয়েছেন, যা জাতিসংঘের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০ হাজার নিহতের তথ্যটি বাস্তবের চেয়ে কম। কারণ, অনেকে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে এবং অনেকের খোঁজ নেই। ২০ লাখের বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন এই আক্রমণে। তিনি ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে চিহ্নিত করেন একটি ইউরোপিয়ান দখলদারি ঔপনিবেশিক প্রকল্প হিসেবে।

স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সৃষ্টি একরকম অপরাধবোধ থেকে—পশ্চিমাদের উপহার। দ্য হিন্দুর ফ্রন্টলাইনে প্রকাশিত Vivek Katju-র কথায়: “ঠিক, অনেক ইহুদি ঈশ্বর প্রদত্ত ভূমির প্রতি সবসময় একটা আত্মিক টান অনুভব করেছেন। ঠিক, থিয়োডর হার্জেল প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বাসভূমির রাজনৈতিক প্রকল্পের কথা ভেবেছিলেন ও ১৮৯৭ সালে জায়নবাদী কংগ্রেস আয়োজন করেছিলেন। তারপরও এমনকি ১৯১৭ সালে বেলফুর ঘোষণায় ব্রিটিশের নিশ্চয়তা সত্ত্বেও, হলোকস্ট না ঘটলে প্যালেস্টাইন টুকরা করে ইসরায়েল সৃষ্টি করার কথা ভাবাও সম্ভব হতো না।

প্যালেস্টাইনের নিরস্ত্র মানুষের ওপর এই বর্বরোচিত হামলা হচ্ছে জাতিগত নির্মূলীকরণের এক জায়নবাদী নীলনকশা। পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এই হত্যাযজ্ঞে মদত জোগাচ্ছে। আর পরিকল্পিতভাবে একটি সুবিধাজনক গল্প বা বয়ান তৈরি করছে। মিথ্যার ওপর মিথ্যা দিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো হচ্ছে তাদের অদ্ভুত বয়ান, যা ভবিষ্যতের জন্য আরও বিপদের বার্তা বহন করছে। ইসরায়েলি প্রচারযন্ত্রের জাদুতে মনে হয়, বিশ্ব ইতিহাসের শুরু এই ৭ অক্টোবর থেকে। অথচ এ ঘটনার শিকড় অনেক পেছনের ইতিহাসে নিহিত।

ইহুদি বংশোদ্ভূত ইতিহাসবিদ ইলান পাপের কথায়, “১৮৮০-র দশকে কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপে জাতীয় পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন হিসেবে জায়নবাদের উৎপত্তি হয় ওইসব এলাকায় প্রচলিত সমাজে ইহুদিদের একাত্ম হয়ে যাওয়ার অথবা ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার লক্ষ্যে। (যদিও আমরা জানি, প্রচলিত সমাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্মতাও নাজি জার্মানি কর্তৃক তাদের নির্মূলীকরণ ঠেকানোর রক্ষাকবচ হয়নি।) বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বেশিরভাগ জায়নবাদী নেতা জাতিগত পুনরুজ্জীবনকে যুক্ত করেছেন প্যালেস্টাইনের উপনিবেশীকরণের সঙ্গে।”

নূর মাসালহা ফিলিস্তিন ইতিহাসের চার হাজার বছর নিয়ে লেখা বইতে লিখেছেন, “জায়নবাদী দখলদারি ঔপনিবেশিকতার শিকড় ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদের গভীরে নিহিত। … ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে যখন সব ইহুদিকে জড়ো করে প্যালেস্টাইনে দখলদার-উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্য ঠিক হলো, প্যালেস্টাইনে যে কোনোরকম মানুষ বাস করে তা বেমালুম ভুলে গেল তারা। ১৮৯৭ সালে রাজনৈতিক জায়নবাদের যাত্রা শুরুর সময় প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে গৃহীত বাসেল কর্মসূচিতে প্যালেস্টাইনের মাটিতে বসবাসকারী প্যালেস্টিনিয়ানদের কোনো উল্লেখই করা হয় না। জায়নবাদী মিশনের লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়: ইহুদি জনগণের জন্য প্যালেস্টাইনে একটি আইনি ও জনস্বীকৃত বসতি প্রতিষ্ঠা।”

জায়নবাদী বয়ান

জায়নবাদীরা গল্প ফাঁদতে ওস্তাদ। এখনকার মিথ্যা গল্পের প্রথম লাইন হলো হামাস কর্তৃক ৭ অক্টোবরের হামলা ইসরায়েলের ৯/১১। আমেরিকা তখন ধুয়া তুলেছিল যে, সাদ্দামের হাতে রয়েছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র, অতএব ইরাককে ধ্বংস করে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে। এখন ধুয়া তোলা হচ্ছে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’—যেন ইসরায়েল নয়, উল্টো প্যালেস্টিনিয়ানরাই ইসরায়েল দখল করে রেখেছে ও তাদের উচ্ছেদ করছে, যেন প্যালেস্টাইনবাসীই দখলদার।

অথচ এই সংকটের শিকড় প্রোথিত ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েলি দখলদারদের হাতে উচ্ছেদ হয় প্রায় ১০ লাখ প্যালেস্টাইনবাসী। ট্রিবিউনের সাংবাদিক তাজ আলী লিখেছেন, “পৃথিবীতে প্যালেস্টিনিয়ানদের মতো জনগোষ্ঠী অল্পই যারা এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এত বেশি বঞ্চনার ও উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ৭ লাখের বেশি প্যালেস্টাইনবাসী দেশছাড়া হয় এবং ৫০০-র বেশি গ্রাম ধ্বংস হয় সেই মহাদুর্যোগ বা ‘নাকবা’য়।

হামাসের হামলার পর ৮ অক্টোবর বার্লিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ভারাওফ্যাকিস ইসরায়েল-প্যালেস্টাইনজুড়ে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য হামাস বা ইসরায়েলি দখলদার কাউকে নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি লিখেছেন, “এর বদলে আমি নিন্দা জানাই আমাদেরকে, ইউরোপিয়ানদের ও আমেরিকানদের, যারা সত্যিকার ভিলেন, যারা দশকের পর দশক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছি যখন এই নির্যাতনের মূল কারণ বর্ণবাদ পোক্ত হয়ে বসেছে।”

জায়নবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ঘৃণা ও শ্রমিকদের প্রতিরোধ

ইসরায়েলি গণহত্যা ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ঢেউ উঠছে চারদিকে। নাৎসিবাদের মতো জায়নবাদেরও ঘৃণ্য রূপ পরিষ্কার হচ্ছে সবার কাছে। প্যালেস্টাইনের মানুষের মুক্তির দাবি আরও জোরে ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে-বাতাসে। প্যালেস্টাইনের পক্ষে এই মুক্তি আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যে, ইসরায়েলি জায়নবাদের বিরুদ্ধে ও প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে দেশে দেশে বহু মানবতাবাদী ইহুদিও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্যালেস্টাইনের পক্ষে এ মুক্তি আন্দোলন সংকীর্ণ বর্ণবাদ, জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় ইত্যাদি সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এক অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে।

ইসরায়েলি জায়নবাদের বিরুদ্ধে ও প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষে দেশে দেশে বহু মানবতাবাদী ইহুদিও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্যালেস্টাইনের পক্ষে এ মুক্তি আন্দোলন সংকীর্ণ বর্ণবাদ, জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় ইত্যাদি সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এক অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে।

জানা গেছে, ভারত থেকে কানাডা হয়ে বেলজিয়ামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা প্যালেস্টাইনের জনগণের সঙ্গে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তারা গাজায় ধ্বংসাত্মক আক্রমণে ইসরায়েলকে অস্ত্র পাঠানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বৈশ্বিক ঐক্যের জন্য প্যালেস্টিনিয়ান ইউনিয়নের আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে ইতালি, কানাডা, ভারত, বেলজিয়াম, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের শ্রমিকদের কাছ থেকে।

জানা গেছে, ভারত থেকে কানাডা হয়ে বেলজিয়ামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা প্যালেস্টাইনের জনগণের সঙ্গে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

ইসরায়েলে অবস্থিত প্যালেস্টিনিয়ান শ্রমিকদের ছাঁটাই করে ভারত থেকে এক লাখ নির্মাণ শ্রমিক পাঠানোর আলোচনায় প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে ১০ কোটি শ্রমিকের প্রতিনিধিত্বকারী ভারতের ১২টি ইউনিয়নের শ্রমিক সদস্যরা। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “ভারত যে এ সময় শ্রমিক রপ্তানির কথা ভাবছে এ থেকে বোঝা যায় ভারতীয় শ্রমিকদের কীভাবে অমানবিক ও পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে।” বলা হয়, “এরকম একটি পদক্ষেপ প্যালেস্টিনিয়ানদের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যায় ভারতের যোগসাজশের সমতুল্য।”

ইসরায়েল প্রশ্নে ভারতের মৌলিক অবস্থান

ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতালাভ ও ব্রিটিশ-মার্কিন মদতে জাতিসংঘ কর্তৃক ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একই বছর—১৯৪৭ সালে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে দুই হাজার বছর ধরে ইউরোপিয়ানদের ইহুদি নির্যাতন ও সর্বশেষ বিংশ শতাব্দীতে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক নির্মূলীকরণের অভিযান থেকে নিজেদের দায়মুক্তির জন্য উপহার, যা আবার ইউরোপিয়ান দখলদারি ঔপনিবেশিকরণেরই ধারাবাহিকতা। স্বাভাবিকভাবেই ভারত শুরু থেকেই এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জোর বিরোধিতা করে এসেছে।

‘টাইম’ সাময়িকীতে নিকোলাস ব্লারেল লিখেছেন, “ঐতিহাসিকভাবে, ইসরায়েলি ও প্যালেস্টিনিয়ানদের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্তির জন্য ভারতীয় সংগ্রামের সময়, ভারতের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন প্যালেস্টিনিয়ান জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেছে এবং প্যালেস্টাইনে একটি স্বাধীন ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য (সংখ্যালঘু ইহুদিদের জন্য সাংবিধানিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ) ১৯৪৭-এ ভারত একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। পেছনের যৌক্তিকতা জটিল, যার উৎপত্তি মূলত উপনিবেশোত্তর ভারতীয় নেতৃত্বের সন্দেহ থেকে যে, ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত প্যালেস্টাইনে একটি দখলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ। স্বাভাবিকভাবে, ১৯৪৭-এ যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলি ও প্যালেস্টিনিয়ানদের জন্য পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তাব পাস হয়, ভারত তখন অল্প কিছু অমুসলিম দেশের মধ্যে একটি যে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।”১০

ইহুদি প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধী জোর দিয়ে বলেছেন, “তারা কেন যেসব দেশে তাদের জন্ম ও যেখানে তারা আয়-রোজগার করে সেসব দেশকেই নিজের দেশ বলে মনে করতে পারছে না? প্যালেস্টাইন তো আরবদের যে অর্থে ইংল্যান্ড ইংরেজদের অথবা ফ্রান্স ফ্রেঞ্চদের। আরবদের ঘাড়ের ওপর ইহুদিদের চাপিয়ে দেওয়া তো অন্যায় ও অমানবিক।”১১ এই ধারাবাহিকতায় ভারত গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ রাখলেও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান পর্যন্ত প্রকাশ্যে প্যালেস্টাইনের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে।

১৯৭৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে Weinraub লিখেছেন, “রাজধানী নতুন দিল্লিতে মিশন স্থাপনে ইসরায়েলিদের বাধা দেওয়া হয়েছে। আর দেশের ব্যবসাকেন্দ্র বোম্বেতে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিন্ন করে রাখা হয়েছে। … প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইসরায়েলকে বলেছেন ‘আক্রমণকারী জাতিরাষ্ট্র’ ও তাদের ‘দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দেওয়ার’ দাবি করেছেন।”১২

ভারত-ইসরায়েল বর্তমান সখ্যর রহস্য

গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার শুরু থেকে সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, বর্ণ ও জাতি-পরিচয়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ-সমাবেশ করলেও ভারতে তা নির্বিঘ্নে সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে ‘ভারতীয় আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিলে’র গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিভাগের সহযোগী পরিচালক সাফা আহমেদ ‘জ্যাকোবিন’ সাময়িকীতে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ভারতীয় মুসলিমরা ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার, পুলিশের হাতে আটক ও ভারতবিদ্বেষী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।১৩

উক্ত প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “প্রতিপক্ষকে দমন করতে হিন্দুত্ববাদও জায়নবাদের খেলার কৌশল আয়ত্ত করতে শুরু করেছে, তা হলো: গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রচারণা দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া, বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী রাজনীতিকে যারাই রুখে দাঁড়ান তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।”১৪

এই সখ্যর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় ১৯৯৯ সালে যখন ভারত বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং ইসরায়েল ভারতকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করতে উৎসাহ দেখায়। সাম্প্রতিক কালে ভারত ইসরায়েল থেকে প্রতিবছর ২০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র কিনেছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে ড্রোন, মিসাইল, বোমা, সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের যন্ত্রপাতি, এভাবে এখন সে ইসরায়েলি সামরিক শিল্পের সবচেয়ে বড় বিদেশি খদ্দের।১৫

ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক বিষয়ে হোস্টাইল হোমল্যান্ড বই নিয়ে প্লুটো প্রেস আয়োজিত পডকাস্টের সূচনায় বলা হয়েছে: “২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনের পর থেকে ভারত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। … ভারত একসময় প্রকাশ্যে বর্ণবাদ হিসেবে জায়নবাদের বিরোধিতা করলেও সময় বদলে গেছে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশকে। নীতিতে ও কর্মে ইসরায়েলকে অনুকরণ করে ভারতের সাম্প্রতিক কাশ্মীর-সংযুক্তি বেশি বেশি করে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলবাদী ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অনুকরণ। এ দুই রাষ্ট্রের এই আদর্শিক ও রাজনৈতিক সংযোগ আশঙ্কাজনক, তাদের জাতিরাষ্ট্রীয় আদর্শিক মিল গভীরভাবে সংযুক্ত।”১৬

আজাদ এশার বই: হোস্টাইল হোমল্যান্ডস

লন্ডনের প্লুটো প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত আজাদ এশার সাম্প্রতিক বই Hostile Homelands: The New Alliance Between India and Israel ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের এই দীর্ঘমেয়াদি মেরুকরণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। এশা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক Middle East Eye পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি বর্তমান আলোচ্য বইটি ছাড়াও The Moslems Are Coming ও Zuma’s Bastard বইয়ের লেখক।

শত্রুভাবাপন্ন স্বদেশ বা Hostile Homelands বইটি ভারত ও ইসরায়েলের আদর্শিক নৈকট্য লাভের নাটকীয় ছবি তুলে ধরেছে, যা বর্তমান বিশ্বে যে কোনো দুটি দেশের ক্ষেত্রে বেশ লক্ষণীয় হতে পারে। এ দুটি দেশই আপন ভূরাজনৈতিক সীমানায় নিজেদের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। অথচ তারা দুই-ই আবার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বর্ণবাদী ও জাতিগত নিপীড়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আদর্শিকভাবে তাদের এ কাছাকাছি আসা বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

দুটি দেশেই সামরিক শক্তির দ্বারা পিষ্ট হচ্ছে নিজ ভূখণ্ডের মুসলিম জনগোষ্ঠী। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দুটি ভূখণ্ড—কাশ্মীর ও প্যালেস্টাইন। বিরাট পৃথিবীর বুকে এ দুটি ছোট্ট ভূখণ্ড আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে ঔপনিবেশিক ভাগ্যের কারণে। এ দুটি ভূখণ্ডে দুটি পুরোনো ধর্মবিশ্বাসের উগ্র বিকৃতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সফল প্রয়োগ চালাচ্ছে হিন্দুধর্মের নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ও ইহুদিধর্মের নামে উগ্র জায়নবাদীরা। যার শিকার এখানকার অধিবাসীরা।

যদিও এ দুটি দেশ বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রার শুরুতে আদর্শিক দিক থেকে বিপরীত মেরুর ছিল, বর্তমানে তারা মোদি আর নেতানিয়াহুর মতোই ঘনিষ্ঠ। এশার কথা অনুযায়ী, এ দুই নেতা “একে অপরের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন মনের ঐক্য—একটি সংস্কৃতি, একটি বর্ণ ও একটি জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলার দৃঢ়তা।”১৭

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে নৃতত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়নরত অরবিন্দন লিখেছেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায় ‘ভারত ঢুকিয়ে’ কাশ্মীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে। বিচার-বহির্ভূত হত্যা থেকে শুরু করে বাড়িঘর ধ্বংস ও ভারতীয় দখল পর্যন্ত সবই ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের প্যালেস্টাইন দখলের অনুরূপ চেহারা লাভ করছে। ভারতীয় নেতারা অনেকে নিজেরাই এ তুলনা করেছেন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে কাশ্মীরে দখল ও অবৈধ বসতি স্থাপন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় কনসাল জেনারেল সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘যদি ইসরায়েলের মানুষ এটা পারে, আমরাও পারব।’ চক্রবর্তীর মন্তব্যটিতে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে গড়ে ওঠা আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।”১৮

১৯২৩-এ Essentials of Hindutva বইয়ের লেখক বিনায়ক দামোদর সাভারকার হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জনক। একই বছর জায়নবাদী জেভ জাবোতিনস্কি প্যালেস্টিনিয়ানদের ওপর বলপ্রয়োগের ওকালতি করে Iron Wall শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখেন। এশা দেখিয়েছেন ভারত ও ইসরায়েলের এখনকার মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে সাভারকারের বড় ভূমিকা রয়েছে। জ্যাকোবিনের প্রবন্ধে সাফা লিখেছেন, “উল্লেখযোগ্য হলো, বিনায়ক সাভারকার ও এমএস গোলওয়ালকারের মতো মতান্ধসহ হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতারা প্রকাশ্যে হলোকস্টের সময় ইহুদি গণহত্যার ও নাৎসিবাদের প্রশংসা করেছে।”১৯

১৯২৩-এ Essentials of Hindutva বইয়ের লেখক বিনায়ক দামোদর সাভারকার হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জনক। একই বছর জায়নবাদী জেভ জাবোতিনস্কি প্যালেস্টিনিয়ানদের ওপর বলপ্রয়োগের ওকালতি করে Iron Wall শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখেন। এশা দেখিয়েছেন ভারত ও ইসরায়েলের এখনকার মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে সাভারকারের বড় ভূমিকা রয়েছে।

সাভারকার দ্বিজাতি তত্ত্বেরও আবিষ্কর্তা যার পরিণতিতে ভারত দুটি সংঘর্ষমূলক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। অমর্ত্য সেন জানিয়েছেন, সে এই মতো চালু করে জিন্নাহর এ প্রসঙ্গ তোলার পনেরো বছরেরও বেশি আগে আর “তৎকালীন হিন্দু রাজনীতির পক্ষে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার জন্য মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে যে নাথুরাম গডসে সে ছিল সাভারকারের শিষ্য।”২০ আর ভারতীয় রাজনীতির এই উদ্ভট পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে আজাদ এশার হোস্টাইল হোমল্যান্ডস বইটিতে।

প্যালেস্টাইন কেবল স্থানীয় রাজনৈতিক সমস্যা নয়। ‘গ্লোবাল প্যালেস্টাইন’ বইয়ের লেখক জন কলিন্সের কথার জের টেনে Magid Shihade লিখেছেন, “প্যালেস্টাইনের সঙ্গে বৈশ্বিক একাত্মতা হলো সুবিচার, অধিকার, প্রতিবেশ, অবদমন, বর্ণবাদ, বৈষম্য প্রভৃতি সম্পর্কে বিশ্বমানবের উদ্বেগ থেকে উৎপন্ন প্রতিক্রিয়া।”২১

প্যালেস্টাইন সমস্যার উৎপত্তি যে পশ্চিমা দখলবাদী ঔপনিবেশিক প্রকৃতি থেকে তা বিশ্বের বহু স্থানে ধর্মীয়, জাতিগত ও বর্ণের আবরণে ক্রিয়াশীল। যার শিকার হয়ে উচ্ছেদ ও নিজভূমে পরবাসী হচ্ছে পৃথিবীর বহু নিরীহ মানুষ। ইসরায়েলের সঙ্গে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, একনায়কত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধোন্মাদ ইত্যাদি শক্তির সখ্য, তাই বিশ্বমানবের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

প্যালেস্টাইন সমস্যার উৎপত্তি যে পশ্চিমা দখলবাদী ঔপনিবেশিক প্রকৃতি থেকে তা বিশ্বের বহু স্থানে ধর্মীয়, জাতিগত ও বর্ণের আবরণে ক্রিয়াশীল। যার শিকার হয়ে উচ্ছেদ ও নিজভূমে পরবাসী হচ্ছে পৃথিবীর বহু নিরীহ মানুষ। ইসরায়েলের সঙ্গে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, একনায়কত্ববাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধোন্মাদ ইত্যাদি শক্তির সখ্য, তাই বিশ্বমানবের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দেয়। গাজা ও পশ্চিম তীরের স্বভূমি হারানো মানুষের সঙ্গে এক হয়ে যায় আরও বহু মানুষ—প্যালেস্টাইনের মানুষের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা তাদের ভাগ্যও।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. https://www.aljazeera.com/news/liveblog/2023/12/24/israel-hamas-war-live-israeli-bombardments-hunger-spread-in-gaza

২. https://www.youtube.com/watch?v=uSug7Vgz48U

৩. Vivek Katju, India’s partnership with Israel: A tightrope between justice and self-interest, ফ্রন্টলাইন, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

৪. Ilan Pappe, The Ethnic Cleansing of Palestine, Oneworld Publications, ইংল্যান্ড, ২০০৬, পৃ. ২৯

৫. Nur Masalha, Palestine: A Four Thousand Year History, Zed, যুক্তরাজ্য, ২০১৮, পৃ. ৩০৭-৮

৬. তাজ আলী, Thousands of Palestinian Workers Have Gone Missing in Israel, জ্যাকোবিন, ২৯ অক্টোবর ২০২৩

৭. ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, Why I refuse to condemn Hamas or the Israeli settlers but insist that we, Europeans & Americans, are the culprits for the atrocities in Israel-Palestine, yanisvaroufakis.eu, ১৫ অক্টোবর ২০২৩

৮. Rafeef Ziadah ও Katy Fox-Hodess, A Global Movement for Union Solidarity With Palestine Is Underway, জ্যাকোবিন সাময়িকী, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩

৯. ওই

১০. Nicolas Blarel, How India Became Pro-Israel, টাইম, নভেম্বর ১৭, ২০২৩

১১. মহাত্মা গান্ধী, The Jews, ১৯৩৮, Jewish Virtual Library

১২. Bernard Weinraub, Israel and India: Long‐Unhealed Rift, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭৪

১৩. সাফা আহমেদ, Why Far-Right Hindus Love Demonizing Palestinians, জ্যাকোবিন, ১৫ নভেম্বর ২০২৩

১৪. ওই

১৫. Blarel, পূর্বোক্ত

১৬. Podcast: Hostile Homelands, plutobooks.com

১৭. প্রিয়া অরবিন্দন, বই-আলোচনা, Washington Report on Middle East Affairs, জুন/জুলাই ২০২৩

১৮. ওই

১৯. সাফা আহমেদ, পূর্বোক্ত

২০. অমর্ত্য সেন, The Argumentative Indian, Farrar, Straus and Giroux, পৃ. ৫১, নিউ ইয়র্ক

২১. Magid Shihade, Settler Colonialism in Palestine: Connections and Ruptures, Ahmad H. Sa’di & Nur Masalha (eds), Decolonizing the Study of Paestine, ২০২৩, যুক্তরাজ্য

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •