আমরা কেন সুখী নই

আমরা কেন সুখী নই

ফেরদৌস আরা রুমী

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির তুলনামূলক অবস্থান নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই জরীপ প্রকাশ করে। এসব জরীপ সবসময় যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভিত্তিক হয় তা নয়। কেননা তথ্যের জন্য তারাও সরকারের ওপরই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতিরও প্রভাব থাকে। তারপরও এগুলো থেকে তুলনামূলক অবস্থান আন্দাজ করা যায়। এরকম বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে এই লেখায়।    

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর ২০২৩ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩। [১] ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২। [২] ২০২০ সালে ছিল ১৫১। [৩] ২০১৬ সাল থেকে এই বার্ষিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আর এগোয়নি। বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলে প্রতিবছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এই সূচক তৈরি করা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ভারত (১৬১), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা (১৩৫), আফগানিস্তান (১৫২), নেপাল (৯৫) ও ভুটান (৯০)।

বাংলাদেশের আইনের শাসনের পরিস্থিতিও বিশ্ব সূচকে উজ্জ্বল নয়। গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট-এর আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এক বছর আগের ১২৪তম স্থান থেকে ১২৭তম স্থানে নেমে এসেছে। [৪] এখন দক্ষিণ এশিয়ার ৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সূচকটি ৮টি বিষয়ের ওপর তথ্য পর্যালোচনা করে আইনের শাসন ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেগুলো হলো: সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, রেগুলেটরি এনফোর্সমেন্ট এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা।

বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকেও বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম (২০২২)। [৫] ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম। [৬]

উপরের তিন ধরনের সূচক থেকে যে চিত্র পাওয়া যায় তা একই সঙ্গে করুণ এবং লজ্জার। কোনোটাতেই আমরা ভালো অবস্থানে নেই। উপরন্তু বছর বছর আরও নিচের অবস্থানে যাচ্ছি। এরমধ্যে সবচেয়ে করুণ দশা ফ্রিডম অব প্রেস সূচকে। ২০২১ সালে যেখানে ১৫২ ধাপে ছিল মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তা ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় কী? দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়েছে নিঃসন্দেহে।

এবার একটু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার শুরুর দিকে নজর দিই। ১৭৬০-এর দশকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। সুইডেনের একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ অ্যানডার্স চিডেনিয়াস গোপনীয়তা এবং জবাবদিহিবিহীন সরকারের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংবাদপত্র/তথ্যের স্বাধীনতা এবং সরকারি নথিপত্রে সাধারণ মানুষের অধিকারের আহ্বান জানান। এই সুইডিশ পার্লামেন্ট সদস্য (১৭৬৫) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলেন, আংশিক স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে না, আংশিক বাধা মানেই চূড়ান্ত বাধা। তিনি তার স্মৃতিকথায় বলেন, “আমি লেখা ও মুদ্রণের স্বাধীনতার জন্য যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে লড়েছি, এতটা নিষ্ঠার সঙ্গে সংসদের অন্য দায়িত্বও পালন করিনি।” তার এক দশকের সংগ্রামের পর সুইডেনের রাজা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে আইন করতে সম্মত হন। সুইডিশ পার্লামেন্টে ১৭৬৬ সালের ২ ডিসেম্বর এ আইন প্রণীত হয়, যা বিশ্বে প্রথম। [৭] আইনটি পুস্তক এবং সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ বাতিল করে এবং জনগণের সরকারি নথিপত্রে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। [৮]

সুইডিশ আইনের অনেক আগে, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ১৬৯৫ সালে রাজনৈতিক সেন্সরশিপ বাতিল আইন করে। [৯] কিন্তু এটি ইতিবাচক ধারণা সংবলিত একটি নতুন আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়নি। যার ফলে নতুনভাবে সেন্সরশিপ আরোপ হতে থাকে। যে কারণে, সুইডিশ আইনটি প্রথম মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আইন হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সুইডিশ আইনের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের গোপনীয়তার সংস্কৃতি অথবা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাল, মিথ্যা, বিকৃত তথ্যসমূহ জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার বিপরীতে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরা। সুইডিশ উদাহরণ বিশ্বকে পরিবর্তন করতে শুরু করে। ১৭৬৬ সাল থেকে ৯০টিরও বেশি দেশ এধরনের বিধান গ্রহণ করেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের তরঙ্গ বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। [১০]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৭৮৯ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনে যেখানে বলা হয়, কংগ্রেস কখনো সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। [১১] পরবর্তী সময়ে তারা ১৯৬৬ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করে। [১২] এখন ইউরোপের সব দেশে এমন আইন আছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় পদক্ষেপ ছিল ২০০০ সালে প্রণীত ‘মৌলিক অধিকার সনদ’।[১৩] এই সনদে সরকারি নথিপত্র জনগণের জন্য উন্মুক্ত এবং মতপ্রকাশে স্বাধীনতার কথা বলা হয়। এমন ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ২০০৯ সালে ‘তথ্য অধিকার আইন’ প্রণয়ন করা হয়; যেখানে সরকারি নথিপত্র সবার জন্য উন্মুক্ত করা এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি মূল উপজীব্য। [১৪]

একথা ঠিক যে, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হলে বা সরকারি নথিপত্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলে কোথাও কোনো অসংগতি পেলে সরকারকে/প্রতিষ্ঠানকে তার জন্য প্রশ্ন করা যাবে। সরকারও তার কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। এককভাবে যেকোনো নীতি, পরিকল্পনা, প্রণয়ন-বাস্তবায়ন ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সরকার নিজে জবাবদিহির বাইরে নয়, তার সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারির এখতিয়ার জনগণের আছে–এই সত্যটি তার বিবেচনায় সবসময় থাকবে। এটাই একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম সৌন্দর্য।

কালের পরিক্রমায় আমরা পেলাম ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইন, যেখানে ৫৭ ধারা নামক অত্যন্ত ন্যক্কারজনক একটি ধারা রাখা হয়। [১৫] এই ধারায় মানহানি, ব্যক্তি/রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি হলে নির্বিচারে মামলা এবং পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরপর অনেক সাংবাদিককে এই ধারায় ফেলে গ্রেফতার করতে দেখা যায়। দেশ-বিদেশে এই ধারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। এমনকি খোদ সরকারের লোকজনও এই ধারার সংশোধনের তাগিদ দেন তখন। পরিণতিতে ২০১৮ সালে সাইবার মাধ্যমে অপরাধ দমনের যুক্তিতে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ করা হয় যার মাধ্যমে ৫৭ ধারা বাতিল করা হয়। কিন্তু এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারার সন্নিবেশ ঘটানো হয়, যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৫৭ ধারাকে অতিক্রম করে যায়। এই আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারার সব অপরাধ জামিন অযোগ্য। [১৬] শুরুতেই এ আইনটি তাই আরও সমালোচনার মুখে পড়ে। রাষ্ট্রের/ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, রাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টি, সম্মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদির নামে একে একে ব্যক্তি/গণমাধ্যম বা প্রতিষ্ঠানের কাজ করার জায়গাকে সংকুচিত করতে থাকে। ভিন্ন মতকে দমন করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং জামিন অযোগ্য ধারায় সেগুলো ফেলা হয়। আগে যেখানে আমরা দেখেছিলাম তথ্য পাওয়ার অধিকারের মতো যুগান্তকারী আইন আমাদেরও আছে, বাস্তবতা হলো তার কোনো সুফল আমরা ভোগ করতে পারছি না। উপরন্তু কোনো তথ্য প্রকাশ করার পর যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয় বা ব্যক্তি/রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। একে একে আমরা দেখছি গণমাধ্যমগুলো নানামুখী চাপে কিংবা সংবাদ প্রকাশের কারণে তাদের কর্মীদের নামে মামলা হওয়া ঠেকাতে একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ পথে হাঁটছে। কার্টুনিস্ট, কবি, লেখক সমাজের অনেক প্রতিবাদী মুখ সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে ঢুকে গেছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক দৈনিক প্রথম আলোতে (১ এপ্রিল ২০২৩) এক লেখায় বলছিলেন, “বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশে কোথাও ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ নামে কোনো অপরাধ নেই। গণতন্ত্রহীন ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এধরনের অভিযোগ এনে নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন চালায়।”[১৭] গত কয়েক বছরের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ দেখলে মানুষের কণ্ঠরোধের বিষয়টিই দেখতে পাই কেবল। সাইবার অপরাধ দমনের নামে মূলত বিপরীত বা ভিন্ন মতের যেকোনো কথা, লেখা, ছবি ইত্যাদির দমন সুস্পষ্ট।

সরকার গত ৭ আগস্ট ২০২৩ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন(ডিএসএ), ২০১৮ রহিত করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ (সিএসএ), ২০২৩ নামে নতুন আরেকটি আইন প্রস্তুত করে।[১৮] প্রস্তাবিত এ আইন নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে নাগরিক সমাজের কেনো ধরনের মতামত না নিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ আইনটি পাস করা হয়। নতুন আইনে সাইবার অপরাধের বিষয়বস্তু এবং সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে। সিএসএ-র ধারাগুলোয় শাস্তিও মাত্রাতিরিক্ত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন ধরা যাক, ডিজিটাল প্লাটফর্মে মানহানিকর তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা রাখা হয়েছে। অনাদায়ে তিন থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের পার্থক্য হলো শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থাপনা কমানো এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো পর্যন্ত। এখন ৬টি অজামিনযোগ্য ধারা প্রস্তাব করা হয়েছে যেখানে আগের আইনে ছিল ১৪টি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, কাউকে আটকাতে চাইলে এবং জামিন দিতে না চাইলে তাকে সেই ৬টি অজামিনযোগ্য ধারায় মামলা করার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং, আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখা এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন না আনায় এ আইনের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। একই কারণে লেখার কারণে গ্রেফতারের ভয়, মানহানি, চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে মামলা/বিচারব্যবস্থা আগের মতো বহাল থাকছে।

আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখা এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন না আনায় এ আইনের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। একই কারণে লেখার কারণে গ্রেফতারের ভয়, মানহানি, চেতনায় আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে মামলা/বিচারব্যবস্থা আগের মতো বহাল থাকছে।

এই লেখার শুরু করেছিলাম বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন তা নিয়ে। এবার আবার সূচকে ফিরে যাই। ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় কী দেখায়? চলতি বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১১৮। [১৯] ২০২২ সালে যেখানে অবস্থান ছিল ৯৪। [২০]প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নেপাল (৭৮), পাকিস্তান (১০৮), ভারত (১২৬), মিয়ানমার (১১৭) এবং শ্রীলংকা (১১২)। এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে সুখী দেশ নির্ধারণের জন্য ৬টি সূচক যাচাই করা হয়। এই সূচকগুলো হলো: মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক নিরাপত্তা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, উদারতা, দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব ও ডিসটোপিয়া। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় টানা ৬ বছর শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। শীর্ষ ১০ দেশ হলো: ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ ও নিউজিল্যান্ড। এখন আমরা তুলনামূলক চিত্র দেখি কিছু:

শীর্ষ ৫

প্রেস ফ্রিডম

আইনের শাসন

সুখী দেশ

সবচেয়ে কম দুর্নীতি

নরওয়ে

ডেনমার্ক

ফিনল্যান্ড

ডেনমার্ক

ডেনমার্ক

নরওয়ে

ডেনমার্ক

ফিনল্যান্ড

সুইডেন

ফিনল্যান্ড

আইসল্যান্ড

নিউজিল্যান্ড

এস্তোনিয়া

সুইডেন

ইসরায়েল

নরওয়ে

ফিনল্যান্ড

নেদারল্যান্ডস

নেদারল্যান্ডস

সিঙ্গাপুর

সর্বনিম্ন ৫

প্রেস ফ্রিডম

আইনের শাসন

সুখী দেশ

সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি

উত্তর কোরিয়া

ভেনেজুয়েলা

আফগানিস্তান

সোমালিয়া

এরিত্রিয়া

কম্বোডিয়া

লেবানন

সিরিয়া

ইরান

আফগানিস্তান

সিয়েরা লিয়ন

দক্ষিণ সুদান

তুর্কমেনিস্তান

কঙ্গো

জিম্বাবুয়ে

ভেনেজুয়েলা

মিয়ানমার

হাইতি

কঙ্গো

ইয়েমেন

বাংলাদেশের অবস্থান

প্রেস ফ্রিডম

১৬৩

আইনের শাসন

১২৭

সুখী দেশ

১১৮

দুর্নীতি

১৪৭

রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান এবং তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ জবাবদিহিতার বাইরে নয়। তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন দায় আছে, তেমনি তাদের কাজ যদি জনসাধারণের দৃষ্টিতে অপরাধমূলক হয় তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। জোর করে পদ বা ক্ষমতা ধরে রাখার সুযোগ নেই।

মুক্ত গণমাধ্যম, আইনের শাসন, সুখী দেশ এবং কম দুর্নীতি ৪টি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সুখকর অবস্থানে নেই। অন্যদিকে যেসব দেশ শীর্ষস্থানগুলোতে অবস্থান করছে সেসব দেশে মানবাধিকার, জীবনযাত্রার মান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ইত্যাদির চর্চা হয় অর্থাৎ তারা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান এবং তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ জবাবদিহিতার বাইরে নয়। তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন দায় আছে, তেমনি তাদের কাজ যদি জনসাধারণের দৃষ্টিতে অপরাধমূলক হয় তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। জোর করে পদ বা ক্ষমতা ধরে রাখার সুযোগ নেই। অপরদিকে যে দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী সরকার রয়েছে সেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, বাক্‌স্বাধীনতা ইত্যাদি অবরুদ্ধ হয় আরও। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন। তারা নিজেরা স্বাধীনভাবে কাজ না করে বরং সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের আজ্ঞার জন্য অপেক্ষা করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকার কারণে মানুষ মতপ্রকাশে ভীত থাকে; সে নিজেকে দুর্বল ভাবে অথবা মনে করে তার মতামতের কোনো মূল্য নেই। সুতরাং, তার কিছু বলার দরকার নেই। দুর্নীতিতে ভরে যায় দেশ আরও। বিগত বছরগুলোতে দেশের দিকে ফিরে তাকালে এসবের প্রতিটির প্রতিফলনই দেখা যায়।

ফেরদৌস আরা রুমী: কবি ও অধিকার কর্মী | ই-মেইল:farumee@gmail.com

তথ্যসূত্র:

[১] ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স–২০২৩, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ২০২৩; 

[২]  ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স–২০২২, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ২০২২;

[৩] ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স–২০২০, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ২০২০;

[৪] রুল অব ল ইনডেক্স–২০২২, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট, ২০২০;

[৫] করাপশন পার্সেপশন ইনডেক্স–২০২২, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ২০২২;

[৬]  করাপশন পার্সেপশন ইনডেক্স–২০২১,ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ২০২১;

[৭]  সুইডিশ প্রেস অ্যাক্ট–১৭৬৬, সুইডিশ সরকার, ২০১৬;

[৮]  সুইডেনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ২০টি মাইলফলক, সুইডিশ সরকার, ২০২০;

[৯]  The Renewal of the Licensing Act in 1693 and its Lapse in 1695,রেমন্ড অ্যাস্টবারি, ১৯৭৮; 

[১০] সুইডেনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ২০টি মাইলফলক, সুইডিশ সরকার, ২০২০;

[১১]  যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, ১৭৯১; 

[১২] যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অধিকার আইন–১৯৬৬, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, ১৯৬৬; 

[১৩] ইইউ মৌলিক অধিকার সনদ–২০০০,  ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ২০০০;

[১৪] তথ্য অধিকার আইন–২০০৯, বাংলাদেশ সরকার, ২০০৯;

[১৫] তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন–২০০৬, বাংলাদেশ সরকার, ২০০৬; 

[১৬] ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮, বাংলাদেশ সরকার, ২০১৮;

[১৭] “গণতন্ত্রে ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ বলে অপরাধ নেই”, শাহদীন মালিক, প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০২৩;

[১৮] Cyber Security Act to replace DSA, দ্য ডেইলি স্টার, ৮ আগস্ট ২০২৩;

[১৯] ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২৩, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক, ২০২৩;

[২০] ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট-২০২২, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক, ২০২২;

*** সূত্র [১] [২] ও [৩]-এ উল্লিখিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ওয়েবসাইটে বর্তমানে বাংলাদেশি আইপি অ্যাড্রেস থেকে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। ইচ্ছুক পাঠকরা ভিপিএন-এর সাহায্যে ওয়েবসাইটটিতে যেতে পারেন।

***সূত্র [৮] ও [১০]-এ উল্লিখিত সুইডিশ সরকারের পেজটি সক্রিয় না থাকায় আর্কাইভ ভার্সন দেওয়া হয়েছে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •