মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি কি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হবে?

মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি কি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হবে?

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

বাংলাদেশে সর্বজনের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন চলছে। ২০০৮ এ নির্বাচিত হবার পর ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হবার বাসনা নিয়ে বর্তমান সরকার নির্বাচনসহ সকল প্রতিষ্ঠান চুরমার করেছে, জোরজবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতায় থাকার পথই অবলম্বন করছে। সরকারের এই অবস্থান ও জনগণের মধ্যে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা নানা আয়োজনে ব্যস্ত, যার মধ্যে ভিসানীতি অন্যতম। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সারকথা তুলে ধরে বাংলাদেশে তার সম্ভাব্য কার্যকারিতা আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে জো বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক পার্টি ২০২১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ মোটা দাগে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত তাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল্যবোধগত দুই ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন ও রাশিয়ার মতো ‘কর্তৃত্ববাদী’ বা ‘অগণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠা এবং তাদের সমর্থিত রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে মোটা দাগে পশ্চিমাবিরোধী একটা প্রভাববলয়ের উত্থানের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে তাদের ‘জাতীয় স্বার্থ’ তথা পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে ভিসা প্রদান নিষিদ্ধকরণের মতো নীতির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার দূতাবাসীয় পরিষেবা বা কনস্যুলার সার্ভিসকে দৃশ্যত এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতদের কেউ কেউ এটাকে অভিহিত করেছেন ‘ভিসা কূটনীতি’ (Visa Diplomacy) হিসেবে। ইতোমধ্যে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, লাইবেরিয়া, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, হাইতি, বেলারুশ, বাংলাদেশসহ আরও অনেক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানিষিদ্ধকরণ নীতির আওতাভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও চীন, হংকং, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, জিম্বাবুয়ে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, মালি, লাইবেরিয়া, রাশিয়া, মলদোভা, সাউথ সুদান, ইউক্রেন, ভেনিজুয়েলা, ইরাকের কতিপয় ব্যক্তিকেও ভিসা কূটনীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দুই পর্যায়ে এই নীতির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাব এবং সুনির্দিষ্টভাবে বর্তমানে কর্মরত এবং সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সঙ্গে এই সাতজনের মধ্যে আরও দুই কর্মকর্তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও একই রকম নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত করে। মার্কিন সরকারের এই দুই ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার দুই ধরনের তাৎপর্য রয়েছে। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত হওয়ার মানে হলো: কোনো ধরনের আর্থিক, পণ্যগত বা সেবাগত লেনদেন বা এই ধরনের লেনদেনের উপকারভোগী হতে পারবেনা নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থা বা সংগঠন। আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞায় আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও কার্যত যুক্ত হয়। নিষেধাজ্ঞা রাজনীতির দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহত করার সঙ্গে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যকে ভিসা প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি গ্রহণ করে এই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে।

সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা কূটনীতি বাংলাদেশের জনপরিসরে দুটি আলাপকে সামনে নিয়ে এসেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীনদলের নীতিনির্ধারক বা তাদের সমর্থকরা মনে করছে ভিসা কূটনীতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেনা। আবার সরকার বিরোধীরা ঠিক বিপরীতটাই ভাবছে। অন্য কথায়, তারা মনে করছে, মার্কিন ভিসা কূটনীতি ক্ষমতাসীন দলকে তাদের নির্বাচন সংক্রান্ত রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে কার্যকরী হবে। এই দুই ভাবনার মধ্যে কোন ভাবনাটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য হতে পারে, তাই বিশ্লেষণ করা হবে এই লেখাটিতে।

বিশ্লেষণটি মোটা দাগে চারভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে ভিসা কূটনীতির ব্যবহারের ধরন এবং এর প্রয়োগ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। ভিসা কূটনীতি সামগ্রিক অর্থে যে একদম নতুন কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার নয় এবং এর যে বহুবিধ ব্যবহার আছে, তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে। যদিও আমাদের মনোযোগ থাকবে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিভিন্ন দেশের ভিসা কূটনীতির ওপর। পরের অংশে আমরা দেখব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ভিসা কূটনীতির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষকরা আমাদের কী নির্দেশনা প্রদান করেন। এক্ষেত্রে ২০১৫ সালে বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা জার্নাল অব পিস রিসার্চে’র একটি সংখ্যায় (ভলিউম ৫২(১)) প্রকাশিত গবেষণার দ্বারস্থ হব। গবেষণাটির শিরোনাম: “Not all dictators are equal: Coups, fraudulent elections, and the selective targeting of democratic sanctions”। গবেষণাটি করেছেন ক্রিস্টিয়ান ভন সয়েস্ট ও মাইকেল ওয়াহম্যান।

সংখ্যাগত পদ্ধতিভিত্তিক ক্রিস্টিয়ান ভন সয়েস্ট ও মাইকেল ওয়াহম্যানের গবেষণাটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী একটা লম্বা সময়ের (১৯৯০-২০১০)। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, তাদের পশ্চিমা মিত্রজোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক আরোপিত ১১৯টি রাষ্ট্রকে ঘিরে মোট ৩৯টি গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার ঘটনা নিয়ে তা করা হয়েছে। তাই এ গবেষণার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণের আলোকে লেখাটির তৃতীয় অংশে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কতটুকু কার্যকর হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করব। চতুর্থ অংশে খুঁজে দেখব ভিসা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার সফল সাম্প্রতিক কোনো উদাহরণ আছে কিনা। উপসংহারের মধ্য দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানব।

ভিসা কূটনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রয়োগ

নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ক্লিংগেনডেলের কর্তৃক ২০০৬ সালে প্রকাশিত এবং কেভিন ডি স্ট্রিংগার কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ “The Visa Dimension of Diplomacy”-তে ভিসা কূটনীতির ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুটি উদ্দেশ্য সামনে আনা হয়েছে। প্রথমটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং কূটনৈতিক সহযোগিতার জন্য আর দ্বিতীয়টি হলো কোনো বিষয় নিশ্চিতকল্পে জবরদস্তি এবং আপত্তি বা অসম্মতিমূলক ভিসা কূটনীতি।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সহযোগিতামূলক প্রথম উদ্দেশ্যটি হাসিল করার জন্য সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও অথবা কোনো ব্যক্তি, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো নেতা বা সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকার পরও অতিথি গ্রহণকারী রাষ্ট্র ভিসা প্রদান করে থাকে। দুটো উদাহরণ এক্ষেত্রে সর্বজনবিদিত। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) কূটনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ নেতা সিন ফেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেদেশে ভ্রমণ এবং চাঁদা সংগ্রহের জন্য ভিসা প্রদান করেছিল। ব্রিটিশ সরকার এবং খোদ মার্কিন প্রশাসনের অনেকের বিরোধিতার পরও বিল ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে তাকে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও এর আগের ২০ বছরে সাতবার সিন ফেন-এর মার্কিন ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সিন ফেনকে ভিসা প্রদানের ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ভিসা প্রদানের ফলে আইআরএ-র যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং তাদের আলোচনার টেবিলে বসানো গিয়েছিল। সর্বোপরি তা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে শান্তি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার পথ খুলে দেয়। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লি তেং হুই-এর ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যায় ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে। ১৯৯৫ সালে মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট লি তেং হুইকে তার সাবেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করনেল ইউনিভার্সিটির পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভ্রমণ ভিসা দেয়। যদিও জিমি কার্টারের সময় ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবেই আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছিল । এতে তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে বিল ক্লিনটনের নেতৃত্বে।

আবার অন্যদিকে, জবরদস্তি বা অসম্মতিমূলক ভিসা কূটনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্রগুলো ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ আদায় সহজসাধ্য না হলে এ ধরনের বন্ধুত্বহীনমূলক কিন্তু তাদের নিজস্ব আইনসম্মত ব্যবস্থা অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর প্রতিক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো করে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর সরকারি লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাপান, ব্রিটেন তাদের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কর্মকর্তা, নেতৃস্থানীয় কতিপয় বিজ্ঞানীকে ভিসা প্রদানে বিরত থাকে। এদের অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইন্ডিয়ান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সেই সময়কার চেয়ারম্যানকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে ভিসা প্রদানের এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল শুধু ভারতের পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের ওপর। আবার রাষ্ট্র পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ইরান আর কিউবা থেকে আগত অভিবাসীদের ভিসা সহজ করেছিল।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশসহ বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাকে বৃহৎ অর্থে গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা (Democratic Sanctions) হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেছে। আবার কেউ কেউ এটাকে বলছে ‘রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ (Political Sanctions)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা, তা গণতান্ত্রিক হোক বা রাজনৈতিক, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু কার্যকরী হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজব নিচের অংশে অন্য গবেষকরা এ সংক্রান্ত বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত টানতে পেরেছেন তার ভিত্তিতে।

গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা এবং বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা

ক্রিস্টিয়ান ভন সয়েস্ট ও মাইকেল ওয়াহম্যান তাদের লজিস্টিক রিগ্রেশনভিত্তিক গবেষণা প্রবন্ধ “Not all dictators are equal: Coups, fraudulent elections, and the selective targeting of democratic sanctions”-এ সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মোটা দাগে তিনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা কতটুকু কার্যকর হতে পারে তা বোঝার জন্য সিদ্ধান্তগুলো জানা জরুরি। নিচে তাদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্র জোট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আগ্রহী হয় যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের সরকার হঠাৎ করে ক্যু-র শিকার হয়। এটা অবশ্য নির্ধারিত হয় নিষেধাজ্ঞা আরোপের আন্তর্জাতিক জোরালো চাপের উপস্থিতি দ্বারা। নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতি একমাত্র নিয়ামক–এরকম সনাতনী চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেনা। তবে বিতর্কিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় যদি এরকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেই নিষেধাজ্ঞা আরোপকামী রাষ্ট্রের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কম মূল্য দিতে হয়। রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনতা এবং ভেঙে পড়া আর্থিক অবস্থার কারণে নড়বড়ে এবং অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বেশি জোরালো হয়।

২। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় কর্তৃত্ববাদী অনাচারী সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আন্তর্জাতিক চাপ সাধারণভাবেই এখন অনেক বেশি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো রাষ্ট্র বা অর্থনৈতিক জোট নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ আনার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের ‘জাতীয় স্বার্থ’কে বিবেচনায় নেয় এবং সেক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য আনার দিকে মনোযোগ থাকে। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কোনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র যদি পশ্চিমাদের সঙ্গে একই বলয়ে বা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অবস্থান করে তাহলে নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি সেই রাষ্ট্রের জন্য আর প্রযোজ্য হয়না।

৩। গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপকামী রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক এবং আর্থিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশকে বিবেচনায় নেয়। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে তাদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ একটা শক্তিশালী নির্ধারক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য।

এখন প্রশ্ন হলো: গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তগুলো, বিশেষ করে শেষের তিনটা, বাংলাদেশের জন্য কীভাবে প্রাসঙ্গিক।

প্রথম সিদ্ধান্তটি বিবেচনা করলে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মার্কিনি অভিবাসীদের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশি নয়, যদিও গত দুই দশকে এই সংখ্যা ২৬৩ শতাংশ বেড়েছে। পিউ রিসার্চের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসী মার্কিন নাগরিকের বা বাংলাদেশি আমেরিকানদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৮০০, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র .০৬৮ শতাংশ। এদের প্রায় অর্ধেকেরই বসবাস শুধু নিউইয়র্কে। আবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসী মার্কিন নাগরিকদের একটা বড় অংশ (১৯ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করছে, যা জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্রসীমায় জীবনযাপন করা মার্কিন নাগরিকদের চেয়ে ৬শতাংশ বেশি। ইংরেজিতে দক্ষ জনসংখ্যাও বাংলাদেশি আমেরিকানদের (৫৫শতাংশ) মধ্যে অন্য এশিয়ান অভিবাসীদের (৭২শতাংশ) তুলনায় কম। পরিবারপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম। যেখানে অন্য এশিয়ান আমেরিকানদের গড় আয় ৮৫ হাজার ৮০০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশি আমেরিকানদের আয় ৫৯ হাজার ৫০০ ডলার। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশি আমেরিকানরা সেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রাজনৈতিক প্রভাববলয় তৈরি করতে এখনো সক্ষম হয়নি। তাই বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিবেচনায় খুব বেশি খেসারত দিতে হয়না। তবে স্থানীয় নির্বাচনে নিউইয়র্ক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

অন্যদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৮২ জন সচিবের মধ্যে শুধু প্রশাসনের ২৯ সচিবের ৪৩ জন সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারতে বসবাস করছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১৮ সচিবের ২৫জন সন্তান। এই হিসাব তো আরও বড় হবে যদি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সংখ্যাটা জানা যেত। এই সবকিছুর মানে হলো, মার্কিন বা পশ্চিমাদের ভিসা বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ছোট একটি গোষ্ঠীর জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এতে জবরদস্তিমূলক বা আপত্তিমূলক কূটনীতির কাছে নতিস্বীকারের সম্ভাবনাটাও তাই অনেক জোরালো।

৮২ জন সচিবের মধ্যে শুধু প্রশাসনের ২৯ সচিবের ৪৩ জন সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারতে বসবাস করছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১৮ সচিবের ২৫জন সন্তান। এই হিসাব তো আরও বড় হবে যদি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সংখ্যাটা জানা যেত।

আবার দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলে একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হলো, জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ বা এর গতিবিধি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা মোটা দাগে প্রভাবিত হয়। তাই যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি নামের দলিলটিতে নিশ্চিত করেছে যে, তারা বাছবিচারহীনভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কারে যাবেনা। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘আমরা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বাস করিনা যে, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দুনিয়ার সব সরকার, সমাজকে আমাদের মতো আদলে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।’ সেজন্যই বোধহয় তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য কর্তৃত্ববাদী সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকেনা। এমনকি থমাস ক্যারোথার্স ও বেনজামিন প্রেস অব দ্য কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস গত বছর ২০০৫ সালের পর থেকে গণতন্ত্রে পশ্চাৎপদ হিসেবে মিশর, জর্জিয়া, হাঙ্গেরি, ভারত, ফিলিপিন্স, পোল্যান্ড, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, টার্কিসহ ২৭টি রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। কেননা, ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, তানজানিয়াকে প্রয়োজন চীন ঠেকাতে, পোল্যান্ডকে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে, টার্কিকে দরকার সুইডেনের প্রতি সমর্থনের জন্য যেন তারা ন্যাটোর সদস্য হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবটা উল্টো। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ঘিরে বিশ্বরাজনীতির চীন-রাশিয়া-ভারত বনাম পশ্চিমা রাষ্ট্র মেরুকরণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের চির শত্রু চীনবিরোধী অবস্থান, রোহিঙ্গা সংকট, বাংলাদেশে রাশিয়া ও ভারতের সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎচুল্লি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে এক নতুন জটিল বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে।

‘আমরা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বিশ্বাস করিনা যে, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দুনিয়ার সব সরকার, সমাজকে আমাদের মতো আদলে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।’ সেজন্যই বোধহয় তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য কর্তৃত্ববাদী সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকেনা।

সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান পশ্চিমাদের কাছে  বাংলাদেশকে একটি সন্দেহজনক  রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সবকিছু ছাপিয়ে তো রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস) এবং চীনের প্রভাববলয় বিস্তৃতির ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’। আর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করলেও আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশ কোনো স্পষ্টতা প্রকাশ করতে পারেনি, যা পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বরাজনীতির নতুন বাস্তবতা–‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বনাম কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র’– তাতে রাষ্ট্রের বর্তমান বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বাংলাদেশ পরের দলেই পড়ে যায়। তাই গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, তানজানিয়াকে প্রয়োজন চীন ঠেকাতে, পোল্যান্ডকে রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে, টার্কিকে দরকার সুইডেনের প্রতি সমর্থনের জন্য যেন তারা ন্যাটোর সদস্য হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবটা উল্টো।

তৃতীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমাদের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের মূল বাজার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ২০২২-২৩ সালে মোট রপ্তানি আয়ের (৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার) ৭৬ শতাংশ (৪২.০৪ বিলিয়ন ডলার) এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যাডস, ভারত, জাপান, পোল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। এই সবকিছু বিবেচনা করলে তাদের ওপর আমাদের নির্ভরতা কম নয়। এই রাষ্ট্রগুলোর সবই আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কম-বেশি মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ এবং মোটা দাগে চীন বিরোধী। সেজন্যই ইউরোপিয়ান সংসদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সতর্কতা দেওয়া হয় অথবা অস্ট্রেলিয়ার সংসদে দাবি জানানো হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন মুলুকের ম্যাগনিটস্কি বা অন্য কোনো স্বতন্ত্র ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য। ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা ২০১৬ সালে গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি অ্যাক্টের আওতায় প্রচলন ঘটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিশ্বব্যাপী যে কোনো দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ আটকে রাখাসহ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারে। ইউরোপীয় সংসদে তো ‘জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স’ এবং ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশি পণ্য ইউরোপে প্রবেশে যেসব ট্যারিফবিহীন সুবিধাদি পেয়ে থাকে, তা বাতিল করার সম্ভাবনার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও কোনো সুসংবাদ দিতে পারছেনা। মুদ্রাস্ফীতির লাগামও টেনে ধরা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবানুযায়ী ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.৯৬ শতাংশ, যা ২০২৩ সাল নাগাদ পৌঁছায় গড়ে ৯.২৯ শতাংশে। ২০২১ সালে গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ সালের জুলাই-এপ্রিল নাগাদ ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি ছিল ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অ্যাকাউন্টে আমাদের উদ্বৃত্ত ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার। তবে আমদানি কমার কারণে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি কিছুটা কমেছে, যা বর্তমানে অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে হয়েছে ৩.৩৪ বিলিয়ন আর ২০২১-২২ সালে ছিল ৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ সালের অক্টোবরে ছিল ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার, যা এ বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে ২১.৭১ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদেরকে বিদেশি ঋণের কিস্তি প্রদান করতে হবে মোট ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৯ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৫.১৫ বিলিয়ন ডলারে। আবার গত একবছরে ডলারের বিনিময় হার ৮৫থেকে ১১০ টাকা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে।

অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কিংবা বিদেশে অর্থ পাচার কোনোভাবেই কমছেনা। ২০১৭থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে ৩৩টি পোশাক কারখানার ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। একইভাবে এ বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতময় পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক চাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়লে তেলের দাম বা এলপিজির দাম যেমন বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক অভিবাসনের সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। এতে একদিকে আমাদের ক্রমহ্রাসমান বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের চাপ বাড়তে পারে, আবার অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহও কমে আসতে পারে।

সবকিছু মিলিয়ে জনরোষের সবরকমের প্রেক্ষাপট উপস্থিত। পুরো পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী হওয়ার অনুকূলে, যদি সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ও সক্রিয় থাকে।

শেষ কথা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার রাজনীতির কার্যকারিতা বা প্রভাব নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। কেউ বলে এটা প্রভাব রাখতে পারে কেউ বলে প্রভাব রাখতে পারেনা। সেই বিতর্কটা যা-ই হোক না কেন, অতি সম্প্রতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে ভেনিজুয়েলায় সরকারবিরোধী জোটের একাংশ এবং মাদুরোর সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের ন্যূনতম শর্তগুলো মেনে চলা যায়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিলও করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। এ ধরনের সাফল্য পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে এবং আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও উৎসাহিত করতে পারে ভবিষ্যতে।

তাই সবকিছু বিবেচনায় এই বিতর্কটা করা যায় যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিকাশ এবং তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন জটিলতা, নতুন সমীকরণ, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটা মওকা এনে দিয়েছে বাংলাদেশের ওপর গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য। গণতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী হওয়ার সব উপাদানও কম-বেশি উপস্থিত। শেষ পর্যন্ত আমরা কোথায় পৌঁছাব, সেটা নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব–ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন–কীভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন জটিলতা বা বাস্তবতা অধ্যয়ন করছে। এটার ভুল অধ্যয়ন দেশকে আরও বিপদগ্রস্ত করবে, অন্য কিছু নয়।

(এই লেখাটির আরেকটি ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে dw.com-এ)

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয। ইমেইল: tanzim.ir@du.ac.bd

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •