সক্রেটিসের বিচার

সক্রেটিসের বিচার

ডি.ডি. কোসাম্বী

অনুবাদ: চৌধুরী মুফাদ আহমদ

দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী বা ডি.ডি.কোসাম্বী (১৯০৭–১৯৬৬) একজন বহুমুখী ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। গণিত, পরিসংখ্যান, ভাষাতত্ত্ব, জেনেটিকস ও ইতিহাস ছিল তাঁর আগ্রহের এলাকা। তিনিই প্রথম মার্কসবাদের আলোকে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় মার্কসবাদী ঘরানার তিনি গুরুস্থানীয়। বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর ওপর কোসাম্বীর প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিশ্লেষণের সময় অবধারিতরূপে গৃহীত ব্যাখ্যার বাইরে (beyond the obvious) চিন্তা করতে কোসাম্বীর রচনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কোসাম্বী ভারতের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতির ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁর দুটি প্রধান গ্রন্থ An Introduction to the Study of Indian History এবং The Culture and Civilization of India in Historical Outline ভারতে ইতিহাসচর্চায় একটি নতুন ধারা সূচনা করার জন্য উল্লেখযোগ্য। সক্রেটিস এবং তাঁর বিচার ও দণ্ডকে একটি নিরাসক্ত ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার জন্য Fergusson & Willingdon College Magazine-এর জুলাই ১৯৩৯ সংখ্যায় প্রকাশিত কোসাম্বীর On The Trial of Socrates প্রবন্ধটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এর অনুবাদের সাথে সাথে পাঠকদের সুবিধার জন্য কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির পরিচিতিমূলক টীকা সংযোজন করা হয়েছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালে ৫০০ নাগরিক নিয়ে গঠিত এথেন্সের একটি আদালত সক্রেটিস নামের একজন বয়স্ক নাগরিককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অভিযুক্তের দুজন ছাত্র ও অনুরাগী–প্লেটো ও জেনোফনের কাছ থেকে এই মামলার দুটি বিবরণ আমরা পেয়েছি। দুজনের বিবরণীর মধ্যে তুলনা করলে প্রথমজনের সাহিত্যিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। দুজনের বিবরণ থেকেই এটি পরিষ্কার যে সক্রেটিস আইনের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি, করেছিলেন, যাকে বলা যায়, মানুষের বাক্‌স্বাধীনতার অধিকার, তার ভিত্তিতে। চাঞ্চল্যকর মামলা নিয়ে লেখা যে কোনো বইতে এই মামলার আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে, এই মামলা কোনো বিখ্যাত ঐতিহাসিক মামলার তালিকায় সাধারণত প্রথমেই থাকে। একটু বিব্রতবোধ করলেও আইনজ্ঞরা এই মামলা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, সেযুগে যেসব আইন বিদ্যমান ছিল তার আলোকে মামলার রায়টি যৌক্তিক ছিল।

এই মামলাটিতে যে এত আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো সাংবিধানিক সমস্যার কারণে হয়নি, সৃষ্টি হয়েছিল সক্রেটিসের ব্যক্তিত্বের জন্য; এবং এই আগ্রহ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্লেটো তাঁকে বিবেচনা করেছেন বিজ্ঞতম, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ এবং তাঁর দেখা সকল লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হিসেবে (তাঁর লেখা Phaedon-এর শেষ বাক্য)। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে এথেন্সে বা গ্রিসের অন্যত্র জনসাধারণকে কোনো প্রকার শোক করতে দেখা যায়নি। মহানির্বোধ প্লুটার্ক প্রাচীনকালের মহান ব্যক্তিদের জীবনীতে তাঁর নাম উল্লেখ করার যোগ্য মনে করেননি (এ নয় যে এতে তেমন কিছু প্রমাণ হয়, কারণ তাঁর তালিকা থেকে ইপামিননদাসের§ নামও বাদ গেছে)। কিন্তু এই বিচারে নীতির জন্য প্রাণবলিদানের (martyrdom) একটি দিক আছে। কারণ এখানে বন্দি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জুরিকে তিনি ইচ্ছাপূর্বক উত্ত্যক্ত করেছেন এবং বিচারকদের সঙ্গে চড়াসুরে কথা বলেছেন— আসলে তিনি তাঁর শিক্ষাদান ও আলোচনা বন্ধ করার বিকল্প মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন। তাছাড়া আইনের প্রক্রিয়ার ফাঁকে তিনি পালিয়ে নির্বাসনে যাওয়ার মতো সময় পেয়েছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর বন্ধুরা তার ব্যবস্থাও করেছিলেন, কিন্তু তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পায়ে শিকল পরানো অবস্থায় কারাগারে ৩০ দিন অপেক্ষা করেন এবং অবশেষে শান্তভাবে বিষপাত্র থেকে বিষপান করেন।

        সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি তরুণদের বিপথগামী করছেন। এটি চমকপ্রদ মনে হলেও সত্য যে, যারা তাঁর কথা শুনত তাদের বেশিরভাগই ছিল তরুণ এবং তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতির জন্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চিতভাবে বিলীন হতো। মার্কসবাদীদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হবে যে তাঁর পদ্ধতি ছিল দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি—প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্ন করা, বিশ্বাসযোগ্য এমনকি গ্রহণযোগ্য কোনো বিবৃতির মধ্যে যে স্ববিরোধিতা আছে তা তুলে ধরা, ধারাবাহিকভাবে নাকচ করার মাধ্যমে একধরনের যুক্তিসিদ্ধ উপসংহারে পৌঁছানো। এর দ্বারা তিনি একটি নৈতিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতার স্থান লাভ করেন। কারণ, যে কোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সব ধরনের নৈতিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্লেটোর সংলাপগুলো থেকে যতটুকু পাওয়া যায় তা ছাড়া সক্রেটিসের আর কিছুই টিকে থাকেনি। অপরদিকে বসওয়েলের[1]¨ ন্যায় প্লেটো তাঁর নিজের মত কেবল তাঁর গুরুর মুখ দিয়েই প্রকাশ করেছেন, অবশ্য তেমন কোনোমত যদি তাঁর থেকে থাকে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সক্রেটিসের এই প্রশ্ন-করা এথেন্সের মুক্ত নাগরিকদের মন ঘিরে থাকা নানা অস্পষ্ট বিশ্বাসের কুয়াশা দূর করেছিল। এধরনের নানা অস্পষ্ট বিশ্বাসের কুয়াশা আজকের যেকোনো জায়গার মুক্ত নাগরিকদেরও ঘিরে রাখে।

যারা তাঁর কথা শুনত তাদের বেশিরভাগই ছিল তরুণ এবং তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতির জন্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চিতভাবে বিলীন হতো। মার্কসবাদীদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হবে যে তাঁর পদ্ধতি ছিল দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি—প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্ন করা, বিশ্বাসযোগ্য এমনকি গ্রহণযোগ্য কোনো বিবৃতির মধ্যে যে স্ববিরোধিতা আছে তা তুলে ধরা, ধারাবাহিকভাবে নাকচ করার মাধ্যমে একধরনের যুক্তিসিদ্ধ উপসংহারে পৌঁছানো।

        এই বিচার নিয়ে যেসব তর্ক-বিতর্ক হয় প্রায়ই তার ভিত্তি গণতন্ত্রের সংবেদনশীলতা থেকে ভীরু-মনের দুর্বলতা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এব্যাপারে অবস্থান নেন এদিক বা ওদিকে, গণতন্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে। এমনকি আমাদের জওহরলাল নেহেরুও বলেছেন যে, ‘স্পষ্টই সরকারগুলো সেই লোকদের পছন্দ করে না, যারা সবসময় নানা জিনিস খুঁজে বের করে; তারা সত্যের সন্ধান পছন্দ করে না’ (Glimpses of World History vol. I, p. 68)। সেসময় ভারতে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল তা বিবেচনা করলে এই মত খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যে বিচারটি নিয়ে আমরা কথা বলছি, আমি তার আলোকে বিষয়টি আরেকটু নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার প্রস্তাব করব।

আধুনিক ধারণা অনুযায়ী গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় এথেন্সে তা ছিল না। কারণ, তখন জনসংখ্যার বিপুল অংশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল সামান্যই। নারী, দাস এবং বিদেশি বণিক ও বিদেশি কারিগরদের (মেটিকদের©) কোনোকথা বলার অধিকার ছিল না, তবে শেষোক্ত শ্রেণি অন্য স্থানের তুলনায় এথেন্সে আইন প্রদত্ত অধিকার বেশি ভোগ করত এবং তা এথেন্সের শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। নাগরিকদের মোটামুটিভাবে তাদের আয়ের ভিত্তিতে নানাস্তরে ভাগ করা হতো, যদিও পুরোনো ট্রাইবাল বিভাজন তখনও বিদ্যমান ছিল এবং তা প্রয়োজনমতো সংশোধিত হতো। করেরও নানা স্তরবিভাগ ছিল এবং দাপ্তরিক পদ সাধারণত অতি বিত্তশালীদের জন্য সংরক্ষিত থাকত এবং এর জন্য তাদের অনেক অর্থব্যয় হতো। কারণ কোনো নির্দিষ্ট বার্ষিক উৎসবের দিনে তাদের সকল মুক্ত নাগরিককে আপ্যায়ন করতে হতো। আইনগত ক্ষমতা সম্মিলিতভাবে নাগরিকদের ওপর ন্যস্ত ছিল; কেবল তাদেরই অস্ত্র বহন করার অধিকার ছিল, প্রতিটি নাগরিককেই পালাক্রমে বেতনভুক্ত জুরির কাজ করতে হতো, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় জুরিদের ভোট বিচারকের ওপর একটি বাধ্যবাধকতা ছিল। ক্লাইসথিনিজªএর পর পুরো সংবিধান বলতে পুরুষ নাগরিকদের মধ্যে একটি উচ্চমানের সংস্কৃতিবোধ ও আইন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা বোঝাত। কারণ তখন আদালতের কাজের জন্য কোনো আইনজীবী ছিল না।এ বিষয়টি সেই সময়ের চমৎকার সাহিত্যে সমর্থিত হয়েছে, আর সবচেয়ে ভালোভাবে হয়েছে সেযুগের নাটক দ্বারা, যা জনসাধারণের বিনোদনের জন্য তৈরি হতো এবং যা পরবর্তী সকল যুগের শিল্পের একটি নমুনা হিসেবে টিকে আছে।

বিচারের সময় এই দার্শনিকের বয়স হয়েছিল সত্তর বছর এবং ‘তরুণদের বিপথগামী করার’ ‘দুর্ভাগ্যজনক’ অভ্যাস বাদ দিলে, তিনি একটি অনুকরণীয় জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি একজন ভাস্কর হিসেবে জীবন শুরু করেন, কিন্তু সেই কাজ ফাইডিয়াস*-এবং এই শ্রেণির অন্য ভাস্করদের জন্য ছেড়ে দিয়ে তিনি সমসাময়িক সম্ভব প্রতিটি বিশ্বাসের ভিত্তি বিরামহীনভাবে পরীক্ষা করার কাজে নেমে পড়েন। এতে তাঁর বৈষয়িক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। কারণ তিনি নিজে সফিস্টদের শ্রেণিভুক্ত হলেও তিনি তাদের পছন্দ করতেন না। কারণ সফিস্টরা কোনো বিষয়ে জেরা করা ও আত্মপক্ষ সমর্থন করার কৌশল শেখানোর জন্য পয়সা নিতেন এবং এথেন্সের নাগরিকদের আদালত সংক্রান্ত দায়িত্বের প্রেক্ষাপটে এসব বিষয়ে দক্ষতা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। অর্থ উপার্জনের বিষয়ে সক্রেটিসের মনোভঙ্গি নিশ্চিতভাবেই তাঁর স্ত্রীযানথিপির মেজাজ তিক্ত করে তোলে। অতি সামান্য এবং অনিয়মিত আয়ে সংসার সামলানোর জন্য ইতিহাস যানথিপির প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি।

অর্থ উপার্জনের বিষয়ে সক্রেটিসের মনোভঙ্গি নিশ্চিতভাবেই তাঁর স্ত্রীযানথিপির মেজাজ তিক্ত করে তোলে। অতি সামান্য এবং অনিয়মিত আয়ে সংসার সামলানোর জন্য ইতিহাস যানথিপির প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি।

সক্রেটিস তেজ ও সম্মানের সঙ্গে দেলিয়ামের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছেন। আরগিনুসাক (Arginusac)-এর নৌ-যুদ্ধে জয়ের পর আটজন কমান্ডার জয়ের আনন্দে মত্ত হয়ে এথেন্সের নৌবহরের বিধ্বস্ত কিছু জাহাজের নিমজ্জমান এক হাজারের বেশি নাগরিককে উদ্ধার না-করেই ফিরে আসে। একারণে তাদের বিরুদ্ধে গণ-বিচার শুরু হয়, যদিও আইনে কেবল ব্যক্তিগত বিচারের বিধান ছিল। তখন জনমতের বিপক্ষে গিয়ে মাত্র একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনের বিধানের পক্ষে কথা বলেছিলেন: তিনি সক্রেটিস। কেউ ভাবতে পারেন এর ফলে সক্রেটিস এথেন্সের সাধারণ মানুষের কাছে একজন চিহ্নিত লোক হিসেবে পরিচিত হন। আবার কিছুদিন পর যখন ক্রিটিয়াসª‘এথেন্সের ৩০ জন স্বৈরশাসক’ হিসেবে পরিচিত অভিজাতদের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তখন সক্রেটিস সেই অবৈধ ও অন্যায্য ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এখানে বলা যেতে পারে যে সক্রেটিস সারাজীবন ‘অতি উত্তম ব্যক্তিদের’ বন্ধু ছিলেন। তাই তাঁর বিচারটি আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য মনে হয় না।

তখন জনমতের বিপক্ষে গিয়ে মাত্র একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনের বিধানের পক্ষে কথা বলেছিলেন: তিনি সক্রেটিস।

একটি বিষয় আইনজ্ঞ ও দার্শনিক উভয়েই অবজ্ঞা করেন। সক্রেটিসের মৃত্যুর আগেকার সম্পূর্ণ প্রজন্ম একটি সর্বনাশা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল: পেলোপনেসিয়ার যুদ্ধ। এটি ছিল পুরোপুরি একটি সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত এবং এথেন্সের মহান রাষ্ট্রনায়ক ও মধ্যপন্থি সাম্রাজ্যবাদী পেরিক্লিস এই যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এই যুদ্ধ যে দ্বন্দ্ব নিরসন করতে চেয়েছিল তা হলো অভিজাত ভূমিমালিকদের বিপরীতে একটি বণিক শ্রেণির উত্থান এবং দেশের অভ্যন্তরে একজন ব্যক্তির সীমিত ক্ষমতা ও দেশের বাইরে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এথেন্সের নিজস্ব উদ্যোগ ছদ্ম-শিল্পপুঁজি (industrial pseudo-capital) আকারে শুরু হয়ে দ্রুত এজিয়ান অঞ্চলের পশ্চাদ্‌ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং নাগরিকরা কেবল প্রান্তবর্তী অঞ্চলে খনির মালিকই হয়নি, তারা বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করত, ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী রাখত, তাদের ছোট দুর্গ ছিল এবং কম উন্নত এলাকার, যেমন: মেসিডোনিয়ার, স্থানীয় সরকারেও প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করত।

এথেন্সের নিকটবর্তী দ্বীপগুলো পারস্যের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য একটি সামুদ্রিক মৈত্রীজোট গড়ে তুলেছিল। জোটের অন্য সদস্যদের এথেন্স নির্লজ্জভাবে শোষণ করে এবং স্থল-জোটে কর্তৃত্বকারী স্পার্টার সঙ্গে অনিবার্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আবার উভয়দলই তাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে সাহায্য করতে পারস্যকে আহ্বান জানায়। এই সাতাশ বছরব্যাপী ক্ষয়কারী যুদ্ধ এথেন্সের দুরন্ত সাধারণ নাগরিকদের শেষ করে দেয় এবং একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র থেকে এথেন্সের পতন ঘটে। এই সময় এবং এর পরপরই অভিজাতদের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুটি প্রবল চেষ্টা দেখা যায়, যার একটি ‘চারশ’ জন’ (the Four Hundred) এবং অপরটি ‘ত্রিশজন স্বৈরশাসক’ (Thirty Tyarant)-এর শাসন হিসেবে পরিচিত। প্রতিবারই গণতন্ত্রের রক্তক্ষয়ী প্রতিস্থাপন ঘটে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এসব ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠী ভুলে যায় যে তারা স্পার্টাবাসীর শত্রু এবং নিজ দেশের গণতান্ত্রিক নাগরিকদের দমন করার জন্য স্পার্টার সাহায্য কামনা করে। এতে স্পার্টা আগ্রহভরে সাড়া দেয়। কারণ, স্পার্টায় পুরাদস্তুর গোষ্ঠীশাসন (oligarchy) চালু ছিল এবং তারা স্বাভাবিকভাবেই যে কোনোধরনের গণতন্ত্র ঘৃণা করত। একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্যটির সঙ্গে লড়াই করছে আবার বিপক্ষ রাষ্ট্রের স্বৈরশাসকদের প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করছে, এটি কোনো নতুন প্রপঞ্চ নয়।

এখন সক্রেটিসের বেলা এটাই প্রত্যাশিত যে তিনি একজন ব্যক্তির পদমর্যাদা বা সম্পদ বিবেচনা না করে তাকে শিক্ষা দিতে বা তার সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী হবেন। কিন্তু আমরা যদি আমাদের তথ্যের একমাত্র উৎস প্লেটোর সংলাপগুলোর দিকে তাকাই, তবে দেখি যে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে কেবল একটি শ্রেণির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে—সেই অতি অভিজাত শ্রেণি যারা পেরিক্লিসের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদকে ভুলপথে চালিত করেছে এবং পরবর্তীকালে বারবার অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে। ক্রিটিয়াস ‘ত্রিশজন স্বৈরশাসক’-এর নেতা ছিলেন। তাঁর নাম কেবল বারবার উল্লেখ করাই হয়নি, তাঁর নিজ নামে একটি আংশিকসংলাপ থাকা ছাড়াও এথেন্সের নাগরিকদের এমন একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে যে তিনি যা করেছেন তা সক্রেটিসই তাঁকে শিখিয়েছেন।

আবার জনশ্রুতি অনুযায়ী একই শ্রেণির আরেকজন ছিলেন আলকিবিয়াদিস, অভিজাত কিমন-এর সুদর্শন ও উন্নতস্বভাব পুত্র। এই তরুণ সকল সূত্র অনুযায়ী সক্রেটিসের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল। এর সাক্ষ্য আছে প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে, কিছু অজানা কারণে অনেক সাহিত্যিকই যে বইটিকে সভ্যতার একটি সুউচ্চ নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করেন। আলকিবিয়াদিস সকল প্রশ্নই একটি ব্যক্তিগত প্রশ্নে নামিয়ে আনেন এবং এথেন্সবাসী ও স্পার্টাবাসী উভয়ের জন্যই পালাক্রমে একজন ধ্বংসাত্মক বন্ধু ভয়াবহ শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। এথেন্সবাসী তাঁকে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নির্বাসনে পাঠিয়েছিল; স্পার্টাবাসী অবশেষে তাঁকে কোনো বিচার ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। গ্রিকদের প্রশংসা অর্জন করলেও ব্যক্তিগত চরিত্রের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বাজে লোক। তাঁর সন্দেহাতীত সামরিক দক্ষতা কখনো ভালো কাজে বা বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়নি। অবশ্য প্লেটোর আলকিবিয়াদিস নামে একটি সংলাপ আছে।

প্লেটোর সংলাপের পাঠকদের পরিচিত অন্য একটি নাম হিসেবে পেরিক্লিসের উত্তরসূরি নিকিয়াস-কে নেওয়া যায়। তিনি সিসিলি অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন, যা ছিল পুরো পেলোপনেসিয়ার যুদ্ধের সবচেয়ে বিপর্যয়মূলক উদ্যোগ। এতে তিনি নিজের প্রাণ হারান, ৭০০০ লোকসহ ধরা পড়লে স্পার্টাবাসী তাঁকে হত্যা করে। এথেনীয় সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ জেনারেল (ডেমোস্থেনিস) এবং নিয়মিত নৌবাহিনীর প্রায় পুরোটা নির্মূল হয়ে যায়। অথচ এমন ধরনের একটি অভিযানের বিরুদ্ধে পেরিক্লিস আগেই পরিষ্কারভাবে সতর্ক করেছিলেন। এই অভিযান যদি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী সফল হতো, তবে তাতে এথেন্সে স্বৈরতন্ত্র বা অন্তত গোষ্ঠীশাসন শুরু হতো। এথেন্সের এই পরাজয়ে আলকিবিয়াদিসেরও হাত ছিল। কারণ, সে পক্ষত্যাগ করে তখন স্পার্টার পক্ষে চলে যায় এবং এমনভাবে যুদ্ধের নির্দেশনা দেয়, যা এথেন্সের জন্য মারাত্মক হয়েছিল। এথেন্স যখন মেলস দ্বীপ দখল করে (৪১৬ খ্রিষ্টপূর্ব) তখন আলকিবিয়াদিস ও নিকিয়াস এথেন্সের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। দ্বীপটি জয় করার পর দ্বীপটির যুদ্ধ করার বয়সী সব পুরুষকে মেরে ফেলা হয় আর নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সত্ত্বেও নিকিয়াস ও তাঁর অভিজাত সঙ্গীরা স্পার্টাবাসীর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। কিন্তু ক্লিওনের অথবা বাতি বিক্রেতার পুত্র হাইপারবলাসের মতো যাঁরা জন্ম, ঐতিহ্য, সম্মান বা ভূমির উত্তরাধিকারের জোর ছাড়াই কেবল নিজেদের প্রচেষ্টার শক্তিতে এথেন্সে বিশিষ্ট হয়েছিলেন, তাদের তাঁরা ঘৃণা করতেন।

আমি একথা বলতে চাইনা যে কেবল সক্রেটিসের শিক্ষাই এই ব্যক্তিদের এহেন আচরণের জন্য দায়ী, কিন্তু আমি মনে করি যে সক্রেটিসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অমার্জিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্য একটি বিশাল অনুপ্রেরণা ছিল এবং তা নিশ্চিতভাবেই নাগরিক সমাজের স্বার্থের বিপক্ষে শাসকগোষ্ঠী এবং ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসকদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। প্লেটোর রিপাবলিক যদি সক্রেটিসের নিজের মুখের কথার বর্ণনা হয়ে থাকে, তবে সক্রেটিসের রাষ্ট্রের আদর্শ এথেনীয় গণতন্ত্র ছিল না। সেখানে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা স্পার্টার আদর্শের কাছাকাছি এবং মূলত যুদ্ধের জন্য উপকারী। উৎপাদন পদ্ধতিতে সাধারণ মালিকানাহীন একটি জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিলে তারা পরিণামে জয়ের এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধের দিকে ঝুঁকবে, এটি কখনো ভেবে দেখা হয়নি। এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে সক্রেটিসকে তাঁর নিজের প্রজাতন্ত্রে এক সপ্তাহের বেশি সহ্য করা হতো না। কেউ কেউ এমন কথাও লিখেছেন যে তাঁর নিজের ভূমিতেই সাধারণ মানুষ সক্রেটিসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি নিয়েই সন্দিহান ছিল এবং সম্ভবত তাঁকে একজন বোকা ভাবত।

আমি আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, সক্রেটিসের প্রধান শিষ্য প্লেটোকে পরবর্তীকালে এথেন্সে শিক্ষাদান কাজ চালিয়ে যেতে দেওয়া হয় এবং তিনি বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর যৌবনকালে এথেন্সে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ক্রিটিয়াস ও ত্রিশজনের সাময়িকভাবে সফল অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তবে অভিজাত-শাসনের আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করলে গোড়ার দিকেই সরে আসেন।

তাই এটি পরিষ্কার যে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যে রায় তা কোনো নীচ জনতা নয়, তাঁর সময়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই দিয়েছিল। তখন সমাজের কাঠামোতে যে কোনো পরিবর্তন এসেছিল তা নয়, কেবল যেসব শক্তি একটি সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ চাচ্ছিল তারা একটি দীর্ঘ যুদ্ধ ও দুটি বিদ্রোহের দ্বারা মারাত্মক রকম পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। সক্রেটিসের দণ্ড অভিজাতদের মধ্যেও কোনো ক্ষোভ সৃষ্টি করেনি। কারণ, তাঁর কাছ থেকে তাদের পাওয়ার কিছু ছিল না। তবে তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর তাঁর এই মামলাটি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে তাদের কাজে লেগেছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে এখানে: সক্রেটিস যে আচরণ করেছিলেন, তা তিনি করেছিলেন, তাঁর ভাষায়, একটি ‘অন্তরের কণ্ঠস্বর’ দ্বারা পরিচালিত হয়ে। নানা চাপের সময় একটি ঐশী বা দানবীয় বার্তা তাঁর নিকট আসত এবং ভয় বা পরিণামের চিন্তা তাঁকে এই বার্তার প্রতি আনুগত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে তাঁর মতো বুদ্ধিমান, সক্ষম, ঋজু এবং সাহসী একজন লোককে তাঁর গান্ধীসুলভ অন্তরের কণ্ঠস্বর সাধারণ মানুষের অবস্থা; উৎপাদন উপায় পরিবর্তনের কথা, শ্রমিকদের (দাস) সেই ধরনের স্বাধীনতা দেওয়া যা গ্রিকদের মধ্যে অনেক শক্তিশালী পারস্য শক্তিকে প্রতিহত করার বিক্রম জুগিয়েছে–এসব সম্পর্কে কিছু বলেনি! এই অন্তর্লীন কণ্ঠস্বর তাঁকে সুদূর ভবিষ্যতের কথা বলতে পারত, বলতে পারত যে জর্জ গ্রৌট§ তাঁর সময়ের এথেন্সকে নিবিড় অধ্যয়নের ফলে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে একটি উদারতাবাদের বিকাশ ঘটবে এবং একথা যে গ্রিক ক্লাসিকসের অধ্যয়ন গণতন্ত্রী ও প্রতিক্রিয়াশীল উভয়ের জন্যই একটি রাজনৈতিক পরিসম্পদে পরিণত হবে। আমি এ-ও মনে করি যে অন্তর্লীন কণ্ঠস্বরের এটিও পরিষ্কার করা উচিত ছিল যে এক শ্রেণির লোকজন সাধারণের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের লাভের জন্য তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষা বিকৃত করবে।

যখন এই শ্রেণির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং একটি দুঃখজনকভেবে বিপর্যস্ত রাষ্ট্র তাঁকে চুপ থাকা বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলে তখন এই শ্রেণি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেই সন্তুষ্ট থাকে।

(প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে Exasperating Essays – Marxists Internet Archive থেকে।)

চৌধুরী মুফাদ আহমদ: লেখক, অনুবাদক। ইমেইল: mufad.dhaka@gmail.com

  • ইপামিননদাস- চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের থিব্‌সের একজন বিখ্যাত গ্রিক জেনারেল ও রাষ্ট্রনায়ক।

¨জেমস বসওয়েল স্কটিস লেখক। তাঁর অগ্রজ বন্ধু স্যামুয়েল জনসনের জীবনী লেখার জন্য তিনি বিখ্যাত।                                                                                   

©মেটিক- প্রাচীন গ্রিসে অন্য দ্বীপরাষ্ট্র থেকে এসে এথেন্সে বসবাসকারী লোকজন।

ªক্লাইসথিনিজ (খ্রিষ্টপুর্ব ৫৭০-৫০৮) ছিলেন এথেন্সের একজন আইনপ্রণেতা, যিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮-এএথেন্সের সংবিধান সংস্কার করে তা একটি ‘গণতান্ত্রিক’ ভিত্তিতে স্থাপন করেন।এই কাজের জন্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘এথেন্সের গণতন্ত্রের জনক’ বলে অভিহিত করেন।

*ফাইডিয়াস (৪৭০-৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ছিলেন সক্রেটিস (৪৮০-৩৯৯খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)-এরসমসাময়িক গ্রিক ভাস্কর, চিত্রকর ও স্থপতি। তাঁর নির্মিত অলিম্পিয়ায় জিউস মূর্তিটি প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম ছিল।

ª ক্রিটিয়াস (৪৬০-৪০৩) একজন প্রাচীন এথেন্সবাসী, সক্রেটিসের ছাত্র হিসেবে বর্তমানে পরিচিত। একজন লেখক এবং পেলোপনেসিয়ার যুদ্ধের পর যে ত্রিশজন স্বৈরশাসক অনেক মাসব্যাপী এথেন্স শাসন করেন তাদের নেতা।

  • জর্জ গ্রৌট (১৭৯৪-১৮৭১) – ব্রিটিশ ঐতিহাসিক। প্রাচীন গ্রিসের ওপর তাঁর কাজের জন্য বিখ্যাত।
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •