মো. সাইফুল ইসলাম: তৃণমূলের শিক্ষক বিপ্লবী

সাক্ষাৎকার

মো. সাইফুল ইসলাম: তৃণমূলের শিক্ষক বিপ্লবী

প্রতিকৃতি এঁকেছেন দুলাল ইসলাম

হাওর অঞ্চলের মানুষ মো. সাইফুল ইসলাম। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের তৃণমূল রাজনৈতিক কর্মীদেরকে মানুষের মুক্তির লড়াইএ সচেতন ও সংগঠিত করায় তাঁর ভ’মিকা প্রবাদতুল্য। জীবনের অনেক চরাই-উৎড়াইয়ে নানা অভিজ্ঞতায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি এলাকার মানুষ ও দেশের জনগণের ভলোবাসা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৩শে নভেম্বর। গ্রাম: বালিগাঁও, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ। মাতা: হাজেরা খাতুন, পিতা: আবদুল বারী। শিক্ষা: সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (১৯৬৩), ভৈরব হাজী আসমত কলেজ থেকে এইচএসসি (১৯৬৫), কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে বিএ (১৯৬৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (১৯৭২)। পেশায় ছিলেন শিক্ষক, ২০০৭ সালে বাজিতপুর নাজিরুল ইসলাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ছাত্র ইউনিয়নে রাজনীতিতে হাতেখড়ি, ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর সদস্যপদ পান। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভ’মিকা পালন করেছেন। ১৯৭৪ সালের ২০শে এপ্রিল ক্ষমতাসীন দলের দুর্বৃত্তরা তাঁকে পথে আক্রমণ করে, অন্ধকারে জবাই করতে চেষ্টা করে এবং মৃত ভেবে ফেলে যায়। প্রবল মানসিক শক্তির কারণে তিনি বেশ কিছু পথ রক্তাক্ত অবস্থায় পাড়ি দিতে সক্ষম হন এবং গ্রামবাসীর আশ্রয়ে থাকেন, এরপরও কারাবরণ করতে হয় তাঁকে।  বর্তমানে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)-এর কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সদস্য। প্রকাশিত গ্রন্থ: গণচীনের অর্থনীতি, ভিন্নমাত্রার মেলবন্ধন, করোনার কাচে সমাজতন্ত্রের প্রতিবিম্ব। প্রকাশিতব্য: পলাতক মন, মরুভূমির রোদহীন তাপ (উপন্যাস)। সম্প্রতি সর্বজনকথার পক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁর ছাত্র ও লেখক-কবি-নাট্যকার গোলাম শফিক

গোলাম শফিক: আপনি যে গ্রামটিতে বেড়ে উঠেছেন, সেটির পূর্ব দিকেই বিস্তীর্ণ হাওর। এর প্রকৃতি ও জলবায়ু আপনার মানস গঠনে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা।

সাইফুল ইসলাম: সেটি ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। চারদিকের যে পরিবেশ তা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করবেই। আমি এর ব্যতিক্রম নই।

গোলাম শফিক: এই গ্রাম এবং সন্নিহিত গ্রামগুলোর মানুষদের দেখে এবং তাদের জীবন-যাত্রার মান অবলোকন করে আপনার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হতো কিনা।

সাইফুল ইসলাম: আমার বয়স যখন কম তখন দেখেছি- আমার গ্রামবাসী ছিল দরিদ্র কৃষক, তাদের একমাত্র পেশা ছিল কৃষি। কিছু কুমার পরিবারও ছিল। আর ছিল সুতার, কর্মকার ও ধোপা। তরুণদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তাদের ভাগ্যলিপি ছিল গরুর রাখালী করা। তখন একমাত্র রাখাল সংস্কৃতিই ছিল প্রভাবশালী। আমি তাদের সাথে নানা খেলাধুলা করতাম। পড়াশুনার সুযোগ তো ছিলই না, মুরুব্বিরা মনে করতেন টাকা-পয়সা খরচ করে লাভ কী? ছেলে সাথে থাকলে আমার একজন কামলা কম লাগবে। এটাই ছিল কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যতিক্রমও কিছু ছিল।

তখন লেখাপড়া ছিল মক্তব পদ্ধতির। মসজিদে কিংবা কারো বাংলোয় পাঠ দান করা হতো। তখন আরবি-উর্দুর ব্যাপক প্রচলন ছিল। আমার দাদা দেওবন্দ থেকে টাইটেল নিয়ে এসেছিলেন বলে আমাদের বাংলোতেই তিনি পাঠ দানের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও আমাদের বাংলোয় পড়ানো হতো এবং এখানেই তারাবির নামাজেরও ব্যবস্থা করা হতো। তখন আমাদের পাড়ায় কোনো মসজিদ, এমন কি গোরস্থানও ছিল না। সে সময় আমার দাদা জনগণকে সংগঠিত করে একটি মসজিদ এবং গোরস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। হাজী বলি মামুদ কিছু জায়গা দান করেছিলেন, বাকি মানুষদেরও প্রচেষ্টা ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিয়াউল আলমের পরিবার। তার বিপরীতে ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের মধ্যে লেখাপড়া ছিল।

তখন লেখাপড়া ছিল মক্তব পদ্ধতির। মসজিদে কিংবা কারো বাংলোয় পাঠ দান করা হতো। তখন আরবি-উর্দুর ব্যাপক প্রচলন ছিল। আমার দাদা দেওবন্দ থেকে টাইটেল নিয়ে এসেছিলেন বলে আমাদের বাংলোতেই তিনি পাঠ দানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

আমাদের গ্রামে ছিল বিখ্যাত ঘোষবাড়ি/দারোগা বাড়ি। তাদের এক ছেলের নাম ছিল রাখাল। তিনি এলএলবি পাশ ছিলেন এবং প্র্যাকটিস করতেন বাজিতপুরের চৌকি আদালতে। আর ছিল বিখ্যাত মুসলিম মিয়াবাড়ি। ১৯৪৯ সালে তাদের বাড়িতে একজন প্রবেশিকা পাশ করেছিল। এর আগে আমার এক চাচা আবদুল আমিন এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পাশ করেছিলেন। এ সনেই আমার ছোট চাচা আবদুল মমিনও এন্ট্রান্স পাশ করেন। এর বাইরে আর একজনের নাম মনে পড়ছে, জিয়াউল আলম, যার কথা আগে বলেছি, যিনি কিছুদিন লেখাপড়া করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আরো কিছু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিল। শুনেছি যে, মুসলমানদের মধ্যে আমাদের বাড়ির পশ্চিমপাড়ার একজন প্রথম প্রবেশিকা পাশ করেছিলেন। তারা ছিলেন খেলাধুলার নিয়মিত আয়োজক। কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, ব্যাডমিন্টন, পালাগান, অন্যান্য গ্রামীণ সংস্কৃতির তারা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তখন সামগ্রিকভাবে গ্রামের মানুষ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সে সময় ঘন ঘন রায়ট হতো। এ রকম কিছু কানে আসলেই ঐ গ্রামের সকল মানুষ মিলে হিন্দুদের রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত হতেন। আমার দাদা মুন্সি হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলতেন, আমাদের ধর্ম ভিন্ন হতে পারে- ইনসানিয়াৎ এক। এইসব ঘটনা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।  

গ্রামের মানুষ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সে সময় ঘন ঘন রায়ট হতো। এ রকম কিছু কানে আসলেই ঐ গ্রামের সকল মানুষ মিলে হিন্দুদের রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত হতেন। আমার দাদা মুন্সি হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলতেন, আমাদের ধর্ম ভিন্ন হতে পারে- ইনসানিয়াৎ এক। এইসব ঘটনা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।

গোলাম শফিক: তখন পারিবারিক কাঠামো ও সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল?

সাইফুল ইসলাম: পারিবারিক কাঠামো ছিল একান্নবর্তী। আমার দাদী ও মা বলতেন, আমরা বাল্যশিক্ষা পড়েছি। দাদী প্রতি ভোরে আমাদের দরজার কাছে এসে বলতেন, ভোর হলো দোর খোলো…ফুল খুকি ছোটরে। একান্নবর্তী পরিবারের সংস্কৃতি আমাকে প্রভাবিত করেছিল। মার মৃত্যুর পর চাচী আমাদের মানুষ করেছেন। তখন আমার বয়স ছিল ৫ বছর, ছোট বোনের ১০ মাস। আমাদের মা নেই, এ অভাব আমরা কোনোদিন অনুভব করিনি। পিতা আর্থিকভাবে কঠোর ছিলেন, ২ টাকা লাগলেও আগে সৎমাকে বলতে হতো। আগের দিন টাকার চাহিদার কথা জানালে পরদিন ভোরে উঠেই বাবা বলতেন, কী করবি টাকা দিয়ে …কামকাজ নাই? বড়ো চাচা বলতেন দুইটি টাকা দিয়ে দেন, যেখানেই যাক, যে ছেলের সাথে যাবে নষ্ট হবে না। তবে আমার চাচী ও সৎমা আমাকে টাকা দিতেন। এক সময় পরপর দুইবার বন্যায় ফসলহানি হওয়ায় সবাই কষ্টে পড়ে গিয়েছিল। তখন ৫ টাকা ও ৭ টাকা করে আমার চাচারা মাস্টারির বেতন পেতেন সাকুল্যে ১২টাকা।

গোলাম শফিক: সে সময়কার কোনো স্মরণীয়, রোমাঞ্চকর কিংবা বেদনাদায়ক ঘটনার কথা কি মনে পড়ে আপনার?

সাইফুল ইসলাম: ১৯৫৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। সে বছর টাইফয়েড হলে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। এক বছর পার হয়ে গেল, আমাকে ভর্তিও করা হয়নি। একদিন পিতা চলে গিয়েছেন চুয়াডাঙ্গায়, ব্যবসার কাজে। চাচারা ঠেলাঠেলি করে আর আমাকে ভর্তি করেননি। তখন আমার মনে তীব্র অভিমান জন্ম নিলো। দাদীকে বললাম, ৫টি টাকা দাও। দাদী বললেন- না, দুই টাকা নে। পরে চাচীকে বলা হলে দুইজন মিলে ৬ টাকা দেন। পরদিন সকালে ৬ আনা দিয়ে ট্রেনের টিকেট করি, ভাবছি যেদিকে চোখ যায় চলে যাবো। কিন্তু অন্য ট্রেনের দুর্ঘটনার কারণে আঠারবাড়ি গিয়ে আমাদের ট্রেন থেমে যায়। ট্রেন থেকে নেমে আমি বাজারে চলে যাই। এক লোকের সাথে দেখা হয়, তিনি বললেন- কাজ করবে? আমি রাজী হয়ে গেলাম। শর্ত ছিল এক মাস বেতন দেয়া হবে না, শুধু খাবার দেয়া হবে, পরের মাস থেকে ১০ টাকা করে বেতন দেয়া হবে। তখন সেটি ছিল অনেক টাকা, ১৯৫৬ সালে। আমার কর্মক্ষেত্র ছিল একটি ইমিটেশনের দোকান। মাস তিনেক পরে টিউবওয়েলের পানি আনতে গেলে আমার গ্রামের বাড়ির একজনের সাথে দেখা হয়ে যায়। লোকটি চিঠি লিখে বাড়িতে জানিয়ে দেন। বাড়িতে তো তিন মাস ধরেই কান্নাকাটির অবস্থা ছিল। দোকানের মালিককে জানানো হলে তিনি বললেন, তোমার আর কাজ করতে হবে না, বসে বসে  খাও। পরে বাড়ির লোকজন এসে আমাকে নিয়ে যায়, যথারীতি ভর্তিও করা হয়। তখন সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মায়, এ জন্য কবিতা পড়তাম সিলেবাসের বাইরে থেকেও। এ সময় রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ মনের মধ্যে প্রভাব ফেলে যায়। আর, সম্ভবত আ.ন.ম বজলুর রশীদের একটি কবিতা এখনও ভুলতে পারি না:

“ব্যাঘ্রের মতো বিপুল শৌর্যে বাঁচিবো একটি দিন

মেষ হয়ে কভু চাহি না বাঁচিতে প্রিয় স্বাধীনতাহীন।” 

গোলাম শফিক: কখন থেকে আপনি রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এবং রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার প্রাথমিক স্মৃতিগুলো কী?

সাইফুল ইসলাম: মনোযোগী ছাত্র মাত্রই পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন ভেবেছিলাম আরো ভালো কবিতা কী ভাবে পাওয়া যায়। তখন শেক্সপিয়রের একটি কবিতা পড়েছিলাম, Big fish eat little little fish. আমাদের বালিগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রাম জনিদপুরের বিপ্লবী ছিলেন বাবু অজিত রায়। তিনি যুগান্তর পার্টি করতেন। এই কবিতার অর্থ জিজ্ঞেস করবো বলে তাঁর কাছে যাবো মনস্থ করেছি। আমি গিয়েছিলাম পিতার সাথে। আমার পিতা বললেন- বাবু, আমার ছেলেটা খুব লাজুক, আপনার সাথে আলাপ করতে চায়। বাবু বললেন- ঠিক আছে, ওকে রেখে আপনি বাড়ি চলে যান। আমার বাবা চলে যাওয়ার পর তিনি আমাকে গোল টুলে বসতে বলেন। তখন উল্টো তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। বললেন- তোমার সরারচর শিবনাথ স্কুলের হেড মাস্টার কে? আমার হেড মাস্টার স্যারের নাম তারক চন্দ্র সাধ্য, তাকে বললাম।

বলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কে? আমি জবাব দিলাম, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াদী, তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইস্কান্দর মির্জা। তিনি বললেন- পাকিস্তানের দুই/একজন বাঙালি নেতার নাম বলো। আমি ফজলুল হক ও ভাসানীর নাম বললাম। তিনি আমাকে এলাকার কোনো নেতার নাম বলতে বলেন। আমি বললাম- অজিত রায়। তাকে তুমি চেনো?

তখন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি বা তাকে সনাক্ত করতে পারিনি বলে স্বাভাবিকভাবেই বললাম- জি না।

তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন- দিপালী, ওকে বলো তো অজিত রায় কে? তারপর আমার ভ্রান্তি মোচন হলো। তিনি বিস্কুট খাইয়ে আমাকে বিদায় করে দিয়ে বললেন- বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তারপর আসবে। পরীক্ষার পরপরই অজিত রায়ের কথা আমার মনে পড়ে যে, তিনি দেখা করতে বলেছিলেন।

আমি পরীক্ষার পর তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলে কিছুক্ষণ আলাপের পর নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ বইটি আমাকে পড়ার জন্য দিলেন। এই বইটি পড়ার পর আমার মনে বইটির কিছু কথা ব্যাপক আলোড়ন তোলে, যেমন “আমি এমন একটি সমাজ চেয়েছিলাম যে সমাজে আভিজাত্যের অহংকার নেই, মহিমার উচ্চতা নেই, প্রেস্টিজের অভিমান নেই।” এ নিয়ে ভেবে ভেবে আমার পরবর্তী পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়। মাথায় এক ধরণের একটা গ-গোল (!) দেখা দেয়। বাবুকে বললাম এটা কেমন সমাজ? তিনি ‘মৃত্যুক্ষুধা’র প্রত্যাশিত সমাজের আদ্যোপান্ত আমাকে বুঝিয়ে বলেন, বড়ো মাছ কী ভাবে ছোট মাছদের গিলে খায় তাও বলেন, সমাজে এইভাবেই বড়োলোকরা ছোটলোকদের শোষণ করে।

আমি পরীক্ষার পর তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলে কিছুক্ষণ আলাপের পর নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ বইটি আমাকে পড়ার জন্য দিলেন। এই বইটি পড়ার পর আমার মনে বইটির কিছু কথা ব্যাপক আলোড়ন তোলে, যেমন “আমি এমন একটি সমাজ চেয়েছিলাম যে সমাজে আভিজাত্যের অহংকার নেই, মহিমার উচ্চতা নেই, প্রেস্টিজের অভিমান নেই।”

রাজনৈতিক সচেতনতা থেকেই আমি ১৯৫৯ সালে ন্যাপের ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করি। পরে মেনন গ্রুপে চলে যাই। কিশোরগঞ্জে মেনন গ্রুপের কোনো উপযুক্ত কর্মী ছিল না। তখন মতিয়া গ্রুপের নেতা মিজানুর রহমান আমাদের সাথে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে আমি শরিফ কমিশন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করি। ক্রমে শিবনাথ স্কুলের স্টুডেন্ট লিডার হয়ে যাই। প্রথম পাবলিকলি বক্তৃতা করি ভৈরব হাজী আসমত কলেজে। মনে পড়ছে আমি বলেছিলাম- সীমান্তে ভারত পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। অথচ জনগণের ট্র্যাক্সের টাকায় কেনা বন্দুকগুলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে। আসলে গুরুদয়াল কলেজের ভিপি আমাকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বলেছিলেন। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর তিনি বললেন- তুমি তো একটা পিউর পলিটিক্যাল বক্তৃতা দিয়ে মাত করে ফেললে। সরারচর স্টেশনের ট্রেন থেকে নামার পর শ’ খানেক লোককে দাঁড়ানো অবস্থায় পাই, তারা আমাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ না থাকলেও নজরুলের ‘ইংরেজ এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে তোদের কিলের চোটে হাড় করিব জল’ কবিতার এই চরণটি সার্বিকভাবে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

সেই কী উন্মাদনা তখন! গুরুদয়াল কলেজে মেননপন্থী ছাত্রনেতা আবেদকে মনোনয়ন দিয়ে আমরা পাশ করিয়েছিলাম। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ২টি। সে সময় আমাদের বড়ো নেতা ছিলেন আইয়ুব রেজা চৌধুরী, নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান। ১৯৬৭ সালের ১লা অক্টোবর শমশের নগর চা বাগানে যে কংগ্রেস হয় তাতে আমি সদস্যপদ লাভ করি। ১৯৬৮-৬৯ সালের আন্দোলন গুলোতে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। পারিবারিক কারণে অবশ্য তখন খুব বেশি অগ্রসর হওয়া যায়নি। ফেমিলির চিন্তায় পিছুটান থেকে কিছুটা পেছনে পড়ে যাই। আনিস ভাই আমার হোস্টেলে ঘন ঘন আগমন করলে এখানে আসতে আমি তাঁকে নিরুৎসাহিত করি। 

সে সময় আমাদের বড়ো নেতা ছিলেন আইয়ুব রেজা চৌধুরী, নূরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান। ১৯৬৭ সালের ১লা অক্টোবর শমশের নগর চা বাগানে যে কংগ্রেস হয় তাতে আমি সদস্যপদ লাভ করি। ১৯৬৮-৬৯ সালের আন্দোলন গুলোতে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।

গোলাম শফিক: প্রত্যেক রাজনীতিবিদ অতীতের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে এবং বর্তমানের সাথে নিজকে খাপ খাইয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। এ জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চাই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় আপনি একজন বালক থাকলেও ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের সময় আপনি ১৮ বছরের যুবক। সে সময় মৌলিক গণতন্ত্রকে কী ভাবে মূল্যায়ন করতেন?

সাইফুল ইসলাম: মৌলিক গণতন্ত্র কোনো গণতন্ত্র ছিল না। তখন জনগণের কিছু করারও উপায় ছিল না। আমাদের সমস্যা ছিল আমরা বাজিতপুরবাসী, মোনায়েম খানের বাড়ির কাছে অবস্থান। গ্রামের একজন হাজীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কতো টাকা টেক্স দেন? তিনি বলেছিলেন ১০০ টাকা। অথচ একজন বিডি মেম্বার ২ টাকা টেক্স দিয়ে ভোটাধিকার পেয়েছেন। মুশকিল হলো বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে শুনি তাদেরকে কোরান স্পর্শ করে ভোট দানের অঙ্গীকার করতে হয়েছিল। তবু ফাতেমা জিন্নাহ্ মোট ১৮,০০০ ভোট পেয়েছিলেন। 

গোলাম শফিক: পাকিস্তান আমলেই আপনি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল প্রবণতা গুলো কেমন ছিল?

সাইফুল ইসলাম: তখন বিশ্ব ছিল বাইপোলার- সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ (ন্যাটোভুক্ত দেশসহ)। কমিউনিস্টদের দমনের জন্য ছিল এস.ডি.আই, মানে Strategic Defence Initiative. দুই পরাশক্তির মধ্যে ছিল ব্যাপক দ্বন্দ্ব। এরই মধ্যে সংঘটিত হয় দীর্ঘমেয়াদী ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ ও চীন বিপ্লব। তখন তো জাতিসংঘে পাঁচ পরাশক্তির একটি ছিল তাইওয়ান। চীন মোটেও প্রভাবশালী ছিল না। চীনারা তখন পূর্ব এশিয়ায় শুধু ব্যবসা করতো। পরে তারা কূটনৈতিকভাবে জয় লাভ করে ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমারা ছিল তাইওয়ান বা ফরমোজার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। কমিউনিস্ট দেশ হলেও সোভিয়েত ও চীনের নীতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। রাশিয়ায় সংশোধনবাদের উত্থান হয়। এরই মধ্যে সাংহাই ঘোষণা আসে, চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭১ সালে চীন-মার্কিন সম্পর্ক অধিকতর উন্নত হয়। চীন পঞ্চশীলা নীতির সমর্থক ছিলো বলে বাইরের কোনো নীতিতে হস্তক্ষেপ করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এ ছিল এশিয়ার ভূরাজনীতি।

পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি কাজ করার বিষয়ে সম্মতি লাভের উদ্দেশ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন গমন করে। চীনের নেতারা তাদেরকে বলেন, আমরা তা করতে পারবো না, কারণ আমরা অন্য কাজে ব্যস্ত। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো হাল ছাড়েননি, পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করে তিনি চীনের বিষয়ে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেন। তার এই মিথ্যাচারের বিষয়টি তখন কেউ জানতো না। তিনি ইয়াহিয়ার কাছে বলেন, চীনারা শীঘ্রই পাকিস্তানে আসবে। আর তার সফরসঙ্গী জেনারেল গুল হাসানকে বলেন, ইয়াহিয়ার পর তুমিই হবে সেনাপ্রধান।

গোলাম শফিক: পাকিস্তান আমলে কোন কোন আন্দোলনের সাথে আপনি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন? সেগুলোর অর্জন কী কী?

সাইফুল ইসলাম: ১৯৬২ সাল থেকে আমি রাজনীতির মাঠে কাজ করতে শুরু করি। তখন রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে অনেক হাততালি পেয়েছি। বক্তাদের প্রতি সাধারণ ছাত্ররা ছিল অনুরক্ত। আমার শিক্ষক জনাব সিরাজুল ইসলাম বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। বক্তৃতা দিয়ে আমি পুরস্কারও অর্জন করি। ইতোমধ্যেই শরিফ কমিশন বিরোধী আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। তখন শিবনাথ স্কুলের ছাত্রনেতা হিসেবে আমাকে কিশোরগঞ্জ মহকুমার ডাকবাংলোয় যেতে হয়েছিল। আমাকে অ্যাকশন কমিটির সদস্য করা হয়।

আমরা সরারচরে ঘন ঘন ধর্মঘট করলেও বাজিতপুর থানা সদরের পাইলট স্কুল ধর্মঘট করে না। নিখলি গ্রামের নূরুল্লাহ্ বললেন- চলো বাজিতপুর যাই। তখন স্কুলের ৩০০ ছাত্র নিয়ে মিছিল করে আমরা বাজিতপুর যাই। আইয়ুব বিরোধী সেন্টিমেন্ট তখন সবার মনেই পাকাপোক্ত। খবর পেয়েই মুসলিম লীগাররা পাইলট স্কুলে চলে আসেন এবং বলেন কোনো ছাত্র যেন শ্রেণীকক্ষ থেকে বের না হয়। আমরা ছাত্রদেরকে বের করার অনুমতি প্রার্থনা করি। হেড মাস্টার বললেন- আমরা পারবো না। কিছুক্ষণ অবস্থান নেয়ার পর বলা হলো- ঠিক আছে তোমরা বারান্দায় যাও, ওদের সাথে কথা হলো। ইতোমধ্যে পুলিশ ডাকার কাজ সারা। তারা এলো, অবাঙালি ওসির নাম ছিল খোরশেদ ঝা। তিনি এসেই বললেন- Why disturb, কিসের দাবি, ছাত্র নিয়ে বের হয়ে যাও!

দিন দু’এক পর আমাদের স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষক তারক চন্দ্র সাধ্যকে বলা হয়- আপনার ছাত্ররা উৎপাত শুরু করেছে। আমাকে ডাকালে আমি তখন ওসির কথাই তাকে ফিরিয়ে দিই, তার কথার রেফারেন্স দিয়ে বলি, আপনিই তো বলেছিলেন, ছাত্রদের নিয়ে বের হয়ে যাও। এখানে কথার মারপ্যাচ ছিল। ওসি বললেন- আমি বলেছি তোমার স্কুলের ছাত্র নিয়ে বের হয়ে যাও। দেখো, এইভাবে কথা বলো না, তোমার মতো ছেলে আছে আমার।

১৯৬৪ সালে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ভৈরবের এক সিনিয়র ছাত্রনেতা বলেছিলেন- ওসির মাথার উপর থেকে আইয়ুব খানের ছবিটা নামিয়ে ফেলবে। তখন পুলিশ লাঠি দিয়ে ছাত্রদেরকে বেধড়ক পিটাচ্ছিলো। এই সময় ওসি মাঠে। ইত্যবসরে আইয়ুব শাহীর ছবি নামিয়ে লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে বের হয়ে যাই। কিন্তু যে গলিটাতে ঢুকি সেখানে পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। অবাঙালি সেই পুলিশকে ডেকে খপ করে থাবা দিয়ে তার মাথা থেকে টুপি ফেলে দিই। টুপিটা পা দিয়ে চেপে ধরতেই নিরস্ত্র পুলিশ সদস্য কাতরকণ্ঠে ক্যাপটা ফেরৎ চায়। এই দলে আমাদের জবরদস্ত শামা ভাইসহ আরো কয়েকজন ছিলেন। শামা পুলিশকে পিটিয়ে চাঙারিতে তুলে ফেলেন।

ইত্যবসরে আইয়ুব শাহীর ছবি নামিয়ে লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে বের হয়ে যাই। কিন্তু যে গলিটাতে ঢুকি সেখানে পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। অবাঙালি সেই পুলিশকে ডেকে খপ করে থাবা দিয়ে তার মাথা থেকে টুপি ফেলে দিই। টুপিটা পা দিয়ে চেপে ধরতেই নিরস্ত্র পুলিশ সদস্য কাতরকণ্ঠে ক্যাপটা ফেরৎ চায়।

এর পর ১৯৬৫ সালের একটি স্মরণীয় ঘটনা আছে। নির্বাচনের ঢেউয়ে দেশ তখন উত্তাল, আমরা ফাতেমা জিন্নাহ্র সমর্থক। জানতে পারলাম গভর্নর আজম খান বাজিতপুর সফরে আসবেন। নেতা মিজান সরারচরে আজম খানকে রিসিভ করার জন্য আমাকে বলেন। সময় মতো আমি তাঁকে রিসিভ করলে দু’এক কথার পর গভর্নর বললেন- Your Monem Khan is a greater thief. বলেই ভাঙ্গা রাস্তা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বললেন- চোরকা প্রোভ (প্রমাণ)। তিনি ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটেই বসেছিলেন, আবার উঠে সামনের আসনেই আমাকে গাদাগাদি করে তোলেন। এই ঘটনার পর সাংবাদিক ইনসাফ উদ্দিনরা আমাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মোনায়েম খান একজন ব্যর্থ উকিল ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আমার ব্যাপারে চাচার কাছে তিনি বিচার দিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন। দেখা করার পর তিনি আমাকে শাসিয়ে বলেছিলেন- তুমি ন্যাপ করো?

আর রাজনীতি থেকে অর্জনের কথা বলছো? আমাদের জাতীয় জীবনের সকল অর্জন তো এসব আন্দোলন থেকেই ছিল। এর ধারাবাহিকতাতেই জাতীয় রাজনীতি পরিণতি লাভ করেছিল। ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্ররা একটা যুক্তফ্রন্ট তৈরি করেছিল। এটাই ছিল জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের মূল অনুপ্রেরণা। ভাসানী সাহেব বলেছিলেন সম্মেলন ছাড়া আমি কিছু বলতে পারবো না। তখন ছাত্ররা হক সাহেবের বাসা ঘেরাও করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট করতে রাজী হলে ছাত্ররা তাকে কাঁধে তুলে নাচতে থাকে। ভাষা আন্দোলন পুরোটাই ছিলো ছাত্র আন্দোলন। স্বাধীনতার পূর্বে ছাত্ররাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিল। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •