লবিস্ট, কনসালট্যান্ট কিংবা ইকোনমিক হিটম্যান

লবিস্ট, কনসালট্যান্ট কিংবা ইকোনমিক হিটম্যান

আনিস রায়হান

পুঁজিবাদী বিশ্বে এডাম স্মীথের ‘অদৃশ্য হস্ত’ দিয়ে অর্থনীতি চলে না। বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তি, উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ, প্রকল্প ও কোম্পানি বাছাই সবই চলে দৃশ্যমান নানা শক্তির জোরে ও তৎপরতায়। এদের মধ্যে থাকে লবিস্ট, কনসালট্যান্ট কিংবা ইকোনোমিক হিটম্যান। কখনও একই লোক এই তিনের মধ্যে বাস করে। এরা টাকার বিনিময়ে করতে পারে না এমন কাজ নাই। তাই কর্পোরেট বিশ্বের নির্ভরতা এদের ওপরই। বাংলাদেশে এরকম দেশি বিদেশিদেরই আমরা চিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এই লেখায় নমুনা হিসাবে এরকম একজনের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান করা হয়েছে। অন্যদের ওপরও নজর রাখতে হবে।

বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফরেস্ট ই. কুকসন। ১৯৬১ সালে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষকতাও করেন।  অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) ও অ্যামেরিকান বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরাম (এবিইএফ)-এর সভাপতি ছিলেন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। কিছুদিন বাংলাদেশের বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতাও করেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ডেভেলপমেন্ট ইন ডেমোক্রেসি ইনকর্পোরেটেড’-এর অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। পাশাপাশি ঢাকার বনানীতে অবস্থিত ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ (আরডিসি) নামক প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ হিসেবেও পরিচয় মেলে তার। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এসেছে তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একজন পরামর্শক। অর্থনীতিবিদ পরিচয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মতামত লেখার পাশাপাশি কুকসন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে গবেষণাপত্র তৈরি, আলোচনায় অংশগ্রহণের কাজও করে থাকেন। লেখালেখি করেন অর্থনীতি, জ্বালানি, বাণিজ্য, রাজনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি প্রসঙ্গে।

বাংলাদেশে কুকসন অ্যামচেমের প্রথম সভাপতি ছিলেন এবং তাও প্রায় টানা এক দশক। প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিনিয়োগকারী ও বণিকদের। কিন্তু ফরেস্ট কুকসন হলেন অর্থনীতিবিদ। তার কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে বলে জানা যায় না। ধারণা করা যায়, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ যখন সেনাশাসন থেকে বেরিয়ে এসে ভোটভিত্তিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর পথে অগ্রসরমান, সে সময় বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি চেম্বারে ঢুকেছিলেন। বাংলাদেশে চেম্বারে তার এক দশকের সভাপতিত্ব এবং এখন অবধি তাদের সঙ্গে তার সংযুক্ততা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, তিনি বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অন্যতম প্রতিনিধি।

কুকসন যখন অ্যামচেমের সভাপতি, তখন তার সংযুক্তি মেলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও। ১৯৯৪ সালের ১৭ মার্চ তারা প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ: স্থিতিশীলতা থেকে প্রবৃদ্ধি’ (বাংলাদেশ: ফ্রম স্টাবিলাইজেশন টু গ্রোথ) শীর্ষক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন রচয়িতাদের মধ্যে সে সময় বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত অনেকের নামের পাশাপাশি ফরেস্ট কুকসনের নামও পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাংকের কাজের ধারা হচ্ছে, অনুন্নত দেশগুলোতে ধনী দেশের বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার বাজার খুলে দেয়া। এই কাজ করতে গিয়ে কৌশলে শক্তিপ্রয়োগ, লবিস্ট নিয়োগ অর্থাৎ নরম-গরম সব পন্থাই অবলম্বন করে তারা। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের নয়াদিল্লিতে ‘ইন্ডিয়ান পিপলস ট্রাইব্যুনাল’ (আইপিটি) নামক গণ আদালত সে দেশে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর উন্মুক্ত শুনানি করে। এক বছর বাদে ওই আদালতের রায়ে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ, তাদের নীতির ফলে কৃষকরা আত্মহত্যা করেছে ও ক্ষুধা বেড়েছে, তাদের চালিত বিরাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি অনেক মৌলিক অধিকারকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে। তাদের জ্বালানি সংস্কার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কয়লাখনি প্রকল্প আদিবাসীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশ্বব্যাংক পূর্ব নির্ধারিত অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নে পক্ষপাতদুষ্ট খন্ডিত জ্ঞান তৈরি করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

বাংলাদেশেও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কার্যক্রম নিয়ে গণআদালতে শুনানি হয়। ওই আদালত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ঘুষ, প্রতারণা, দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা, চাপ, হস্তক্ষেপ, লবিং, জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিলোপ, নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি ও জাতীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষতিসাধনের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার ঘোষণা দেয়। অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসন বাংলাদেশে তার কার্যক্রমের গোড়া থেকেই বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

কুকসন নিজেকে যে দুটি প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দেন, সেগুলো সম্বন্ধে ইন্টারনেটে খুব সামান্যই তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। বর্তমান শতকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একজন অর্থনীতিবিদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের কোন ওয়েবসাইট থাকবে না, তা মেনে নেয়া দুষ্কর বটে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডেভেলপমেন্ট ইন ডেমোক্রেসি ইনকর্পোরেটেড-এর নেই কোন ওয়েবসাইট। তবে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধনের তথ্যে এটিকে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের যেখানটায় দেখানো হয়, তা একটি আবাসিক এলাকার ঠিকানা। প্রতিষ্ঠানটির নাম ধরে অনুসন্ধান করতে থাকলে এর সঙ্গে কেবল দুজন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলে। তারা দুজনেই কুকসনের নিকটাত্মীয়—আপন ভাই চার্লস রিচার্ড কুকসন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র রিকার্ডো কুকসন। রিকার্ডো তার লিংকডইন প্রোফাইলে তথ্য দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির হয়ে তিনি ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে দায়িত্বশীল পদে বাংলাদেশের ভোটার আইডি কার্ড প্রকল্পে কাজ করেছেন, যখন কিনা কুকসন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন অ্যামচেম পরিচালনা করছেন। ডেভেলপমেন্ট ইন ডেমোক্রেসি ইনকর্পোরেটেড সম্পর্কে ইন্টারনেটে এর বেশি তথ্য মেলে না। ধারণা করা যায় যে, এটি কুকসনদের একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটির নাম ধরে অনুসন্ধান করতে থাকলে এর সঙ্গে কেবল দুজন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলে। তারা দুজনেই কুকসনের নিকটাত্মীয়—আপন ভাই চার্লস রিচার্ড কুকসন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র রিকার্ডো কুকসন। রিকার্ডো তার লিংকডইন প্রোফাইলে তথ্য দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির হয়ে তিনি ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে দায়িত্বশীল পদে বাংলাদেশের ভোটার আইডি কার্ড প্রকল্পে কাজ করেছেন

বাংলাদেশে আরডিসি নামের যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তিনি যুক্ত, তার একটি ওয়েবসাইট ছিল, কিন্তু তা কয়েক বছর ধরে বন্ধ। ২০১৪ সালে এই ওয়েবসাইটে তাকে পরিচালক হিসেবে দেখানো হয় এবং এর ঠিকানা উল্লেখ করা হয়, বনানীর ২৫ নং সড়কে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কয়েকদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে আলোচনায় আসে। ওই জরিপে আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরাট জয়ের পূর্বাভাস প্রদান করে আরডিসি। জরিপের ফলাফল প্রকাশকারী হিসেবে আসে ফরেস্ট কুকসনের নাম এবং তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় আরডিসির অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরামর্শক হিসেবে।এরপর আর আরডিসির কোন হদিস এখন অবধি নেই, যা কিনা এটিকে মৌসুমী, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিপন্ন করে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কয়েকদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে আলোচনায় আসে। ওই জরিপে আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরাট জয়ের পূর্বাভাস প্রদান করে আরডিসি। জরিপের ফলাফল প্রকাশকারী হিসেবে আসে ফরেস্ট কুকসনের নাম এবং তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় আরডিসির অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরামর্শক হিসেবে।এরপর আর আরডিসির কোন হদিস এখন অবধি নেই

বাংলাদেশে কুকসন আসলে কী করছেন, সে বিষয়ে তার দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের দুটি সংবাদ উল্লেখ করা যায়। ২৭ জানুয়ারি ১৯৯৬ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি খবরে (ইকোনমিক সার্জ ইন বাংলাদেশ আন্ডারকাট বাই পলিটিকাল টার্মঅয়েল) বলা হয়, ‘তিনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) সংস্কারের কাজে যুক্ত রয়েছেন, যা কিনা দেশটির মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বৃহত্তর রূপান্তরের একটি অংশ।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন ২০০০ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন, গোপনে হলেও বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির এজেন্ডাটি ছিল তখন তার প্রধান ইস্যু। এ নিয়ে ২০ মার্চ ২০০০ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক খবরে (শ্যার্ডস অব মিজারি, নট ফার ফ্রম ক্লিনটন স্টপ ইন বাংলাদেশ) বলা হয়, ‘এখানে অনেকেই আতঙ্কিত যে, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ঢাকায় কেবল একটি সফরই করছেন না, বরং এখান থেকে বেশ কিছু নিয়েও যাচ্ছেন! এটা ধারণা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ গ্যাসের সাগরে ভাসছে। “আমরা এটাকে প্রাচ্যের পারস্য উপসাগর বলে অভিহিত করছি” এমন বক্তব্য মার্কিন অর্থনীতিক ও পরামর্শক ফরেস্ট কুকসনের, যিনি বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন খাতকে লাভজনক করা নিয়ে গবেষণা করছেন।’ খবর দুটিতে বাংলাদেশে কুকসনের লবিস্ট ভূমিকা সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশে কুকসনের কর্মজীবনে বিভিন্ন সরকার এসেছে, গিয়েছে। সব সময়ই তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা বলেছেন এবং সেইসঙ্গে মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করেছেন। ফলে সরকারগুলো তার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ তৈরি হয়নি। ক্ষমতাবান অনেকেরই খুব ঘনিষ্ঠ তিনি। বাংলাদেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাবান সব মহলেই কুকসন বন্ধু তৈরি করে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর এদেশে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব লুকোনোর অভিযোগ উঠলে আদালতে গিয়ে বন্ধুর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ দিয়েছেন বন্ধুর পক্ষে দাঁড়িয়ে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর এদেশে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব লুকোনোর অভিযোগ উঠলে আদালতে গিয়ে বন্ধুর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ দিয়েছেন বন্ধুর পক্ষে দাঁড়িয়ে।

মহীউদ্দীন খান আলমগীর ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখা এবং পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশিত তার ‘নোটস ফ্রম এ প্রিজন’ শীর্ষক আত্মকথায় লিখেছেন, ‘মি. কুকসন বাংলাদেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কনসালটেন্ট হিসেবে। তিনি আমেরিকান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ড. আলমগীরকে চেনেন। তার বিবেচনায় ড. আলমগীর দারিদ্র্যবিমোচনে নিবেদিত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন সৎ, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি।… কুকসন বলেন, ড. আলমগীরের জ্ঞাত ও বৈধ ভাড়া, বেতন এবং সহায়ক ও আকস্মিক আয়ের ভিত্তিতে সঞ্চয়/বিনিয়োগযোগ্য অর্থের যে হিসাব ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার অধীনে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কম্পিউটার প্রিন্ট আউট হিসেবে জবানবন্দির সঙ্গে সংযুক্ত করে কোর্টে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘গুড অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিসের’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সঠিক।’ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের আরেক নেতা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও কুকসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কুকসন নিয়মিতভাবেই উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সংলাপগুলোতে থাকেন। ঋণদাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শক হিসেবে তার নাম থাকায় এনজিওগুলো প্রায়ই এ ধরনের কর্মসূচিতে তাকে সংযুক্ত করে। ২৮ মার্চ ২০০৫ তারিখে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি খবর (আমেরিকান এলামনাই এসোস এজিএম হেল্ড) অনুসরণ করলে এদেশে কুকসনের সামাজিক পরিধি সম্পর্কে ধারণা মেলে। আমেরিকান চেম্বারের সাবেক নেতা হওয়ার কল্যাণে দেশের শীর্ষস্থানীয় আমলা, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও শিক্ষকদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একইসূত্রে তিনি নিয়মিত মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে সংযোগ রাখেন। রাজনৈতিক নানা আলোচনায় হাজির হন। ২১ মে ২০১৩ তারিখে রাইজিংবিডি ডটকমের এক খবরে (কূটনীতিতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে মজীনার) বলা হয়, ‘সকালে দেড় ঘণ্টাব্যাপী গুলশানের আমেরিকান ক্লাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন মজীনা। এ সময় আরও ছিলেন ইউএসএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশরাত জাহান ও আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম) সাবেক সভাপতি ফরেস্ট কুকসন।’১০

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের আরেক নেতা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও কুকসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কুকসন নিয়মিতভাবেই উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সংলাপগুলোতে থাকেন।

এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেশে যখন প্রায় অচলাবস্থা চলমান, তখন গভীর রাতে জামায়াতের ধনকুবের নেতাদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেছেন কুকসন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটা তাকে সেক্ষেত্রে বাধা দেয়নি। ৭ মে ২০১৩ তারিখের এক খবরে (একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বৈঠক) বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়,

‘রাত পৌনে আটটায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় মার্কিন চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ফরেস্ট কুকসন। রাজধানীর অভিজাত এলাকার একটি ক্লাবে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠান হয়। এখানে সোয়া ঘণ্টা তারা বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলে সূত্র দাবি করেছে।’১১

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন অর্থনীতিবিদ কুকসনের এমন সংশ্লিষ্টতা বিস্ময়কর এবং সন্দেহজনক।

লবিংয়ের পাশাপাশি ফরেস্ট কুকসন মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিকে লেখালেখি করেন। বেশ কিছু বিষয়ে লেখালেখি করলেও তার লেখালেখির মূল উপজীব্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাত ও পশ্চিমা কাঠামোয় নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির অগ্রগতি। দেশের বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিক—ডেইলি স্টার, ইন্ডিপেনডেন্ট, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা ট্রিবিউন, নিউ এইজে বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে নানা ধরনের প্রবন্ধ লিখেছেন। এসব লেখায় তিনি নিজেকে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দেয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন যে, তার সমস্ত মতামত ও বিশ্লেষণ বাংলাদেশের ওপর একান্তই প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা। কিন্তু তার লেখালেখি অনুসন্ধান ও অন্যান্য তথ্য জানান দেয়, তিনি আসলে অর্থের বিনিময়ে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে লিখে থাকেন।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করার পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলছেন কুকসন। সেখানে খনি করতে চাওয়া বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জির (বর্তমান নাম জিসিএম) সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। এশিয়া এনার্জি তাদের ২০০৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্দেশনা ও চাহিদা মোতাবেক ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের ওপর একটি ‘অর্থনৈতিক লাভের প্রতিবেদন: ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’ তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসনকে যুক্ত করেছি।’১২ এশিয়া এনার্জির এই বয়ান থেকে প্রমাণ হয় যে, কুকসন যে এখন অবধি উন্মুক্ত খননে বাংলাদেশের লাভ হবে বলে প্রচার চালাচ্ছেন, এটা ছিল তার নিয়োগকর্তাদেরই চাওয়া।

এশিয়া এনার্জি তাদের ২০০৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্দেশনা ও চাহিদা মোতাবেক ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের ওপর একটি ‘অর্থনৈতিক লাভের প্রতিবেদন: ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’ তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদ ফরেস্ট কুকসনকে যুক্ত করেছি।’১২ এশিয়া এনার্জির এই বয়ান থেকে প্রমাণ হয় যে, কুকসন যে এখন অবধি উন্মুক্ত খননে বাংলাদেশের লাভ হবে বলে প্রচার চালাচ্ছেন, এটা ছিল তার নিয়োগকর্তাদেরই চাওয়া।

কুকসন শুধু লেখার মাধ্যমেই নন, বরং এশিয়া এনার্জির পক্ষে কাজে লাগিয়েছেন তার ইতোপূর্বে উল্লেখিত ক্ষমতাধর বন্ধুদেরও। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহীউদ্দিন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে বন্ধুত্বের প্রতিদান দেন। এলাকায় জরিপকার্য পরিচালনার নামে এশিয়া এনার্জির প্রবেশের সুবিধার্থে তিনি ফুলবাড়ী খনি এলাকায় কয়েক থানার পুলিশ পাঠান, ১৪৪ ধারা জারি করান। কিন্তু জনপ্রতিরোধে এই অপচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। উল্লেখ্য, এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন (বর্তমান জিসিএম) খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের নিমিত্তে বাংলাদেশে একটি শাখা অফিস খোলার জন্য ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি লাভ করে। তারা অসম এক চুক্তির মাধ্যমে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা আহরণের প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলে সারা দেশে এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। পরবর্তীকালে ফুলবাড়ীসহ ছয় থানার জনগণ ২৬ আগস্ট ২০০৬ তারিখে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এশিয়া এনার্জিকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে।

এশিয়া এনার্জি তাদের ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাতে, খনি উন্নয়ন ও প্রকল্প সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের বোঝাতে, খনি উন্নয়ন হলে স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কী লাভ হবে সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বছরজুড়ে জিসিএম কাজ করে গেছে। এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে জরিপ কার্যক্রম। খনি উন্নয়ন সম্পর্কে প্রকল্প এলাকার ভেতরে ও বাইরের জনগণের মনোভাব বুঝতে প্রায় ২০০০ নারী-পুরুষের ওপর একজন স্বাধীন পরামর্শকের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধভাবে জরিপ চালানো হয়েছে। আমরা সেই গবেষণালব্ধ মতামত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করছি। জরিপটি এই সিদ্ধান্ত টানে যে, একটি বিশাল গোষ্ঠী প্রকল্পের উন্নতি কামনা করলেও তারা চিন্তিত যে, কি উপায়ে পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।’১৩ কথিত এই স্বাধীন পরামর্শক যে ফরেস্ট কুকসন ছাড়া কেউ নন, এটা মহীউদ্দিন খান আলমগীরের তৎপরতায় স্পষ্ট।

এই জরিপটি এশিয়া এনার্জির খুব প্রয়োজন ছিল। মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে জিসিএমের বিরুদ্ধে দুটো আন্তর্জাতিক এনজিও অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্য সরকারের এ বিষয়ক বিশেষ ফোরাম ন্যাশনাল কন্টাক্ট পয়েন্ট (এনসিপি) এর তদন্ত করে। ওই অভিযোগ থেকে বের হতে এশিয়া এনার্জি জরিপটি সম্পন্ন এবং নিজেদের সপক্ষে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। এই জরিপটি কার্যত চালানো হয়েছিল ভিন্ন নামে, খনি এলাকা থেকে বেশ দূরে এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সহযোগিতায়। অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ফোন নম্বর এতে যুক্ত করা হয়েছিল, যে কারণে এনসিপির কাছে এটি বিশ্বাসযোগ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কুকসনের প্রতিষ্ঠান আরডিসি যে এসব কাজ পরিচালনা করে থাকে তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা ক্ষমতাসীন দলের বিরাট জয়ের পূর্বাভাস তুলে ধরে ছায়া ভোটের জরিপ করেছিল।

ফুলবাড়ীর ওই তথাকথিত জরিপের ফলাফলে দাবি করা হয় যে, ‘বিশাল গোষ্ঠী’ ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি প্রকল্পের পক্ষে আছে। শুনানিতে এনসিপি এশিয়া এনার্জির এই জরিপকার্য দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেই জরিপে কী আছে, তা বলেনি। এশিয়া এনার্জির দেয়া যুক্তিরই পুনরাবৃত্তি করেছে এভাবে— ‘জিসিএমের সরবরাহকৃত তথ্যগুলো কোম্পানি ব্যবসায়িকভাবে বেশ স্পর্শকাতর বলে মনে করে। এগুলো তখনই সরবরাহ করা হবে যদি প্রকাশ না করার নিশ্চয়তা মেলে। ২০১২ সালের ‘জরিপ’ এবং কোম্পানির পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।১৪

কুকসন যদিও অর্থনীতিবিদ, কিন্তু ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে তার লেখালেখি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন, এখানে কোন গবেষণা নেই। এগুলো এশিয়া এনার্জির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিমাত্র। তুলনা করলে দেখা যাবে কুকসন আলাদা কেউ নন, অন্নদাতা এশিয়া এনার্জির প্রধান গ্যারি লাইয়ের প্রতিমূর্তি কেবল। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের বিরুদ্ধে দুজনে ঠিক একই ভাষায় কটূক্তি, গালমন্দ করেন। ৮ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে ডেইলি সান-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে গ্যারি লাই আন্দোলনকারীদের একটি ‘গ্যাং’ হিসেবে অভিহিত করেন। শুধু বামপন্থিরাই এই আন্দোলন করছে বলে অভিযোগ করেন। এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বেক্সিমকো গ্রুপের দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টে প্রকাশিত তিন পর্বের এক লেখায় কুকসনও একই কাজ করেন। তিনি লেখেন, ফুলবাড়ীতে কেজিবি স্টাইলে বিদেশি কোম্পানির ওপর হামলা হয়েছিল। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, এই আন্দোলন বাংলাদেশে দারিদ্র্য বাড়াচ্ছে।

ওই তিন পর্বের সিরিজ কুকসন ও এশিয়া এনার্জির প্রধান নির্বাহী গ্যারি লাইকে বুঝতে বেশ সাহায্য করে। লেখাটির প্রথম পর্ব (দ্য এনার্জি সিনারিও অল্টারনেটিভস) ছাপা হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে। কুকসন তাতে লেখেন, ‘সরকারের অনেক সমালোচনা করা যায়, কিন্তু রেন্টাল প্রকল্পটাই ছিল একমাত্র সঠিক পথ, যে পথ ধরে এগুনো যায়। এছাড়া বর্ধিত বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসতো?’।১৫ কুকসন তার ওই লেখার শেষাংশে জ্বালানি সমস্যার জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করে লেখেন, এরাই ‘জ্বালানি খাতের বর্তমান সঙ্কটের কারণ’। সুশীল সমাজ এ নিয়ে কিছু বলছে না দেখে তিনি লেখাটিতে উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে একই পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধটির দ্বিতীয় পর্বে (দ্য এনার্জি সিন—প্রোমোটিং পভার্টি) কুকসন লেখেন, ‘এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা ও তাদের অনুসারীগণ কেজিবি হ্যান্ডবুক থেকে শেখা এজিটপ্রপ টেকনিক বেশ দক্ষতার সঙ্গেই কাজে লাগিয়েছে।… সরকার চুপচাপ দেখে গেল। এ ছিল অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট পারফরমেন্স। কেজিবির ভূতেরা এখন হয়ত খুশিতে আত্মহারা। ভাববার বিষয় এদের খরচ জোগায় কে? টকশোর আলোচকরা এদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। অভিজাতেরা কৃষকের মেয়েকে ঠেলে দিচ্ছেন পুরোনো দাসত্বের পথে। নারীবাদী সৈনিকেরা কোথায় এখন?’১৬

কুকসনের লেখার এমন ভাষা নিয়ে তেমন কোন কথা হয়নি। ফলে লেখাটির তৃতীয় পর্বে গিয়ে তিনি আরও কড়া আলাপ করেন। ১ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে তিনি লেখেন, ‘এলাকার ভূ-প্রকৃতি কী বলে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি কিছু বলতে হয় না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার কোন বিকল্প নেই। এ বিষয়ে দ্বিমতেরও সুযোগ নেই।… উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে না দেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার বাংলাদেশের আছে। কিন্তু এ নিয়ে কোন আইনগত পরিবর্তন আনলে যদি এশিয়া এনার্জির প্রকল্প বাতিল হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে।… অঙ্কটা হলো ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন… খনি প্রকল্পের রেট অফ রিটার্নের হার ধরতে হবে ৩৫ বছরের জন্য ১৫% করে। ৭% ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর হিসাব করে এর বর্তমান মূল্য দাঁড়ায় ২০০-২২০ মিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগকারীরা এই এক্সপেকটেড রেট অফ রিটার্নকে বাস্তবসম্মত বলেই মত দেবেন।’

এভাবেই খুব খোলামেলাভাবে নিজেকে গবেষক পরিচয় দিয়ে গ্যারি লাইয়ের প্রেস রিলিজগুলো তিনি পত্রিকায় ছেপেছেন। আদতে কুকসন কার স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করেন, তার লেখাগুলোই এর পরিষ্কার প্রমাণ। এর আগে ১৪ জুলাই ২০০৭ তারিখে ডেইলি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে প্রকাশিত ‘অন দ্য ড্রাফট কোল পলিসি’ শীর্ষক নিবন্ধে কুকসন লিখেছিলেন, ‘যদি বাংলাদেশ তার কয়লাখনিগুলো উন্নয়ন করতে চায়, তাহলে রয়্যালটির হার বৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই।… রয়্যালটি পরিবর্তন, শুল্ক আরোপ ও অন্য যেকোনো অর্থনৈতিক তৎপরতাই খনি উন্নয়নের কার্যক্রমকে ধীর করে দেবে। এটা একটা বিপজ্জনক পথ।… রয়্যালটির হার ১৬ শতাংশ, ২০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি করার ধারণাটা অর্থনৈতিক মূর্খতা!’

১৫ জুন, ২০০৮ তারিখে দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্টে অপর একটি মতামত-প্রবন্ধ লেখেন কুকসন। এটা লেখা হয় ঠিক তখনই, যখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ফুলবাড়ী কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছিল। তখন এশিয়া এনার্জির হয়ে কুকসন এডিবিকে বোঝাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি লেখেন, ‘এখানে উন্মুক্ত খননের বাইরে কোন বিকল্প নেই। প্রযুক্তিগত যেসব সমস্যা হবে, তা এশিয়া এনার্জি কর্তৃক নিয়োগকৃত বিশ্ব মানের খনি প্রকৌশলীদের দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব।’

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, জ্বালানি সঙ্কট নিয়ে কুকসন বেশ বড় একটি পলিসি প্রেসক্রিপশন তৈরি করেন, যা ২৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় একটি নিবন্ধ হিসেবে ছাপা হয়। সালমান এফ রহমান এবং কুকসন দুজনে মিলে এটি তৈরি করেন। তাতে তারা লেখেন, ‘ফুলবাড়ী এবং বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবে… এখন প্রয়োজন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে মাল্টি-বিলিয়ন ডলার প্রোগ্রাম হাতে নেয়া।’

কুকসন এখনো তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। গত বছরও ‘অ্যামচেম বাংলাদেশ জার্নাল’ সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যায় এ নিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন এক দীর্ঘ নিবন্ধে (‘এনার্জি অ্যান্ড দ্যা বাংলাদেশ ইকোনমি—হোয়াট দ্য ফিউচার হোল্ডস’)। লিখেছেন আগের মতোই একপাক্ষিক অবস্থান থেকে— ‘বাংলাদেশ তার কয়লা সম্পদের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত হাল্কা প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং তা কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে খুবই দুর্বল পরামর্শ পেয়েছে। কিন্তু এই সময়ে বাংলাদেশের একমাত্র চিহ্নিত এবং পরিমাপকৃত জ্বালানি সম্পদ হল ফুলবাড়ীর কয়লা।… জলাধারের ক্ষতির বিভিন্ন গল্প এবং স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা রয়েছে। এগুলো হলো প্রকল্পের বিরোধীদের ছড়ানো মিথ।…’১৭

কুকসনের এসব লেখায় ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনি সম্বন্ধে স্বাধীন গবেষকদের নানা উদ্বেগ সম্বন্ধে কোন আলোকপাত পাওয়া যায় না। কোন অর্থনৈতিক সমীক্ষা না থাকলেও তিনি দাবি করেন এই প্রকল্প সব ধরনের ক্ষতিপূরণ সমেতই অত্যন্ত লাভজনক১৮। উন্মুক্ত খনির বিকল্প থাকলেও তিনি মরিয়া হয়ে লেখেন যে, এর কোন বিকল্প নেই। এভাবেই কুকসন সরকার, গবেষক, বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তার নিয়োগকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে তার সামগ্রিক অবস্থান এখানকার জনগণের স্বার্থবিরোধী। এটার পরিষ্কার প্রমাণ হল গ্যাস রপ্তানি, উন্মুক্ত খনি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে তার শক্ত অবস্থান। এটা এখন সকলেরই জানা যে, কিভাবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা তৈরি করেছে এবং গোটা অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলেছে, ক্ষতি হয়েছে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা।

কুকসন বাংলাদেশে প্রথম কার্যক্রম শুরু করেছিলেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। এরপর তিনি বনে যান ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা। কাল পরম্পরায় তার আবির্ভাব ঘটে জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এরপর কখনো অর্থনীতিবিদ, কখনো রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কখনো শিক্ষক, কখনো বা ভোটের জরিপ পরিচালনাকারী—নানা ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাকে। বারবার রং বদলেছেন তিনি।

ইকোনমিক হিটম্যান বা অর্থনৈতিক ঘাতকরা হলো অর্থনীতি জগতের এক বিশেষ ধরনের আততায়ী। তারা নিয়োগপ্রাপ্তদের হয়ে কাজ করে নিজেদের মূল পরিচয় আড়ালে রেখে। জনমত তৈরি করার জন্য নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করে, নির্দোষ মতামতদাতা হিসেবে তুলে ধরে। এভাবে নিজে সম্পদ লাভের জন্য এরা ক্ষতিগ্রস্ত করে কোন ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং একটি সমগ্র জাতির অথবা বিশাল জনগোষ্ঠীর।

ইকোনমিক হিটম্যান বা অর্থনৈতিক ঘাতকরা হলো অর্থনীতি জগতের এক বিশেষ ধরনের আততায়ী। তারা নিয়োগপ্রাপ্তদের হয়ে কাজ করে নিজেদের মূল পরিচয় আড়ালে রেখে। জনমত তৈরি করার জন্য নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করে, নির্দোষ মতামতদাতা হিসেবে তুলে ধরে। এভাবে নিজে সম্পদ লাভের জন্য এরা ক্ষতিগ্রস্ত করে কোন ব্যক্তিবিশেষের নয়, বরং একটি সমগ্র জাতির অথবা বিশাল জনগোষ্ঠীর। বহুরূপী কুকসনকে কেবল এই ভূমিকাতেই সনাক্ত করা যায়।

লেখক: রিসার্চ ফেলো, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ইমেইল: raihananis87@gmail.com

তথ্যসূত্র

1.‘AmCham Office Premises Inauguration Ceremony, 07 September 2019’.

2.Bangladesh: From Stabilization to Growth, March 17, 1994, World Bank, South asia region, Page 8

3.‘Findings of the Jury, Independent people’s tribunal on the World bank in India,’ 11September 2008.

4.‘গণআদালতে বিশ্বব্যাংক–আইএমএফ–এডিবি: যে প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি’, আনু মুহাম্মদ, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, প্রথম আলো।

5.Profile Data, Ricardo Cookson, Linkedin.

6.‘আরডিসির ছায়া ভোট ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে আ. লীগের পক্ষে’, নিজস্ব প্রতিবেদক, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো।

7.‘Economic Surge in Bangladesh Undercut by Political Turmoil’, John F. Burns 27 January 1996, New York Times.

8.‘Shards of Misery Not Far From Clinton Stop in Bangladesh’, Barry Bearak, 20 March 2000, New York Times.

9.‘American Alumni Assoc AGM held’, Staff Correspondent, 28March 2005,The Daily Star.

10.‘কূটনীতিতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে মজীনার’, কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ২১ মে ২০১৩ রাইজিংবিডি ডটকম।

11.‘একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বৈঠক’, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ,৭ মে ২০১৩, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

12.‘Interim Report 2006, GCM Plc’, Page 7.

13. ‘Annual Report 2014, GCM Pl ‘, Page 3.

14. ‘UK-NCP final report’, paragraph-22b, Page 8

15.‘The energy scenario alternatives’, 30 December 2012, Forrest Cookson, Daily Independent.

16.‘The energy scene—promoting poverty’, 31 December 2012, Forrest Cookson, Daily Independent.

17. ‘Energy and the Bangladesh Economy—What the future holds?’ Forrest Cookson, AmCham Bangladesh Journal, September issue-2022, P 39-40.

18. ‘Energy and the Bangladesh Economy—What the future holds?’ Forrest Cookson, AmCham Bangladesh Journal, September issue-2022, P 39-40.

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •