টমাস পিকেটি ও আইএমএফ- অসমতার বিতর্ক

টমাস পিকেটি ও আইএমএফ- অসমতার বিতর্ক

চৌধুরী মুজাদ্দিদ আহমদ

গত কয়েক বছরে টমাস পিকেটি তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বিশ্বজুড়ে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও বৈষম্য নিয়ে বিপুল তথ্যসম্ভারসহ আলোচনা বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন। তাঁর বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে আলোচনা বিতর্কও হচ্ছে। পিকেটি কয়েকশো বছরের তথ্য উপাত্তকে ভিত্তি করে বৈষম্য সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে আইএমএফও  প্রশ্ন তুলেছে, পিকেটি তার জবাব দিয়েছেন। এই লেখায় এই বিতর্কের সারকথা তুলে ধরা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-কে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়া দেশগুলোর ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপনের একটি প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু আইএমএফের ঋণ গ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রকৃত অভিজ্ঞতা থেকে এর বিপরীত চিত্রই পাওয়া যায়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আগে, শ্রীলঙ্কা আরও ১৬ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে। আইএমএফের নীতিমালা বাস্তবায়ন চলমান অবস্থায় তাদের সংকট বরং জটিল হয়েছে। আবার দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান সবচেয়ে বেশিবার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে, ২২ বার। অথচ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও বেশি। জন হপকিন্স ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে আইএমএফের ঋণ নেওয়া অর্থনীতিগুলোতে বেকারত্ব আরও বেড়েছে। (সূত্র: আনু মুহাম্মদ, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ: সংকটের মিল-অমিল, প্রথম আলো, ৯ মে ২০২৩)।

টমাস পিকেটি বর্তমান সময়ের একজন প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ। পিকেটি মূলত তার অর্থনৈতিক ইতিহাস ও অসমতা-তত্ত্ব নিয়ে তথ্যনির্ভর গবেষণার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। ২০১৩ সালে তাঁর প্রকাশিত বই ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বইটি প্রকাশের পরই ২০১৬ সালে, বৈশ্বিক বৈষম্যের কারণ নিয়ে পিকেটির সঙ্গে আইএমএফের একটি বিতর্ক হয়েছিল। এই বিতর্ক থেকে বোঝা যায়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এবং বর্তমান নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আইএমএফ কী সূক্ষ্মভাবে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে শুভংকরের ফাঁকির খেলায় নিয়োজিত আছে।

বৈশ্বিক বৈষম্যের কারণ নিয়ে পিকেটির সঙ্গে আইএমএফের একটি বিতর্ক হয়েছিল। এই বিতর্ক থেকে বোঝা যায়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এবং বর্তমান নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আইএমএফ কী সূক্ষ্মভাবে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে শুভংকরের ফাঁকির খেলায় নিয়োজিত আছে।

বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং চীন কর্তৃক বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান হারে উন্নয়ন ঋণ প্রদান আইএমএফের ঋণের ব্যবহার ও গুরুত্বকে কতটুকু প্রভাবিত করছে এবং করবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। তা ছাড়া আইএমএফ সম্প্রতি বাংলাদেশকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করতে রাজি হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশকে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে। আইএমএফের এই ঋণের শর্ত নিয়ে বাংলাদেশে নানা মহলে নানা আলোচনা-কৌতূহলের জন্ম হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অসমতা নিয়ে পিকেটি-আইএমএফ বিতর্কটি নিয়ে আলোচনা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

টমাস পিকেটি তাঁর ‘ক্যাপিটালে’ প্রায় ২৫০ বছরের ঐতিহাসিক উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখান যে পুঁজিবাদী বিশ্বে বিনিয়োগকৃত মূলধন থেকে যে হারে আয় হয় সেই হারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। তিনি নির্ভরণ বিশ্লেষণের (regression analysis) মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে বিনিয়োগকৃত পুঁজির ওপর আয়ের হার বা রেট অব ক্যাপিটাল রিটার্ন (r) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বা রেট অব ইকনমিক গ্রোথ (g) সমানুপাতিক নয়। বিশ্বে বিনিয়োগ হতে আয়ের হার যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কারণ ব্যাখ্যায় তিনি দাবি করেন, নানা গোষ্ঠীর হাতে বংশানুক্রমিকভাবে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত থাকার ফলেই r-g gap অর্থাৎ পুঁজির আয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং এটি বিভিন্ন দেশের সম্পদ অব্যবস্থাপনা, সম্পদের অসম বণ্টনের এবং সামগ্রিক অসমতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।

পিকেটির এই মতকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) “Testing Piketty’s Hypothesis on the Drivers of Income Inequality: Evidence from Panel VARs with Heterogeneous Dynamics” নামে একটি ওয়ার্কিং পেপার প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কার্লস গোস এই ওয়ার্কিং পেপারটি প্রণয়ন করেন। এই ওয়ার্কিং পেপারে আইএমএফ মন্তব্য করে যে টমাস পিকেটির ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের ধরন পরিবর্তনের কারণসমূহের যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তুলে ধরলেও এবং বইটি তথ্য সমৃদ্ধ হলেও, এতে তাত্ত্বিক ‘কার্যকারণ শৃঙ্খলের’ (casual chain) জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা দেখা যায়নি। গোস প্যানেল SVAR মডেলের একটি সেট তৈরি করেন যাতে r-g ব্যবধান বাড়ার সাথে সাথে জাতীয় আয়ে বৈষম্য এবং মূলধনের ভাগ বাড়ে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তার দাবি অনুযায়ী, তিনি ৩০ বছর সময়কাল ভিত্তি ধরে ১৯টি উন্নত অর্থনীতিকে নমুনা হিসেবে ব্যাখ্যা করে দেখেছেন এবং অসমতার গতিবিধি নির্ধারণে পিকেটির r-g gap মডেলের কোনো প্রাসঙ্গিকতা তিনি খুঁজে পাননি।

কার্লস গোস তথা আইএমএফ-কে পিকেটি ২০১৬ সালেই জবাব দিয়েছিলেন, জবাবটি পিকেটির সাম্প্রতিক গ্রন্থ Time for Socialism-এ পাওয়া যায়। কার্লস গোসের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে প্রথমেই পিকেটি তার বই অসমতা বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ ও আলোচনা উসকে দিয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে তিনি জাবাব দেওয়ার আগেই দাবি করেন, আইএমএফের গবেষণাটি তার মতে দুর্বল ও কোনো কাজের নয়। পিকেটির মতে, আইএমএফের গবেষণাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল এটি দেখানো যে ‘r-g gap’ অর্থাৎ পুঁজি থেকে আয়ের হারের বৃদ্ধি সাথে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বৃদ্ধি পাওয়া না-পাওয়ার বা অসমতার কোনো পদ্ধতিগত সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার প্রশ্ন: কীসের ভিত্তিতে আইএমএফ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল? তিনি মনে করেন, অসমতার পরিমাপ ও r-g gap-এর পরিমাপের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য আইএমএফ সঠিকভাবেই পরিসংখ্যানগত রিগ্রেশন প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এ রকম ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত রিগ্রেশন প্রয়োগ করার জন্য যে ধরনের, যে মানের এবং যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা প্রয়োজন, আইএমএফ তা করেনি। আইএমএফের গবেষণায়, r-g gap ও অসমতার পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য, শুধু কতিপয় উন্নত অর্থনীতির ১৯৮০ থেকে ২০১২ সালের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করছে। তা ছাড়া তার মতে, আইএমএফের ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্ত যথাযথ বা সঠিক নয়। তাই পিকেটির মতে আইএমএফের এই বিশ্লেষণ থেকে শেখার কিছু নেই।

আইএমএফ-কে পিকেটি ২০১৬ সালেই জবাব দিয়েছিলেন, জবাবটি পিকেটির সাম্প্রতিক গ্রন্থ Time for Socialism-এ পাওয়া যায়।

অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে আইএমএফের একটি বড় ফাঁকি ধরেছেন পিকেটি। আইএমএফ, বৈষম্য পরিমাপের জন্য সম্পদের অসমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে বিনিয়োগ হতে আয়ের অসমতাকে বিবেচনায় নিয়েছে। যার ফলে একটি বড় শুভংকরের ফাঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ, আয়ের অসমতার নির্ধারক হলো labour – শ্রম বা শ্রমমূল্য। শ্রমমূল্য বলতে বোঝানো হয় সম্পূর্ণ শ্রমলব্ধ অর্থ, যা কোনোভাবেই কোনো মূলধন বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত অর্থ নয়। তাই আয়ের অসমতা এবং বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে আয়ের হারের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারের পার্থক্যের (r-g gap) মধ্যে একটি রিগ্রেশন বিশ্লেষণ করা কোনো অর্থ বহন করে না। এভাবে সম্পদের বৈষম্যের বদলে আয়ের বৈষম্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আইএমএফ প্রকারান্তরে সম্পদের বণ্টনের বৈষম্যের প্রকৃত চিত্রকে আড়াল করেছে।

আবার আইএমএফের গবেষণায় ব্যবহৃত আয় উপাত্ত আকারে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা যে সময়কাল এবং যেসব দেশের আয় নিয়ে গবেষণা করেছে, কিছু পার্থক্য থাকলেও, প্রায় সব সময় ও প্রায় প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই, শ্রমলব্ধ আয়কারীর সংখ্যা ও পুঁজি বিনিয়োগ থেকে আয়কারীর সংখ্যার অনুপাত, ৭০:৩০। পিকেটির মতে, শ্রমবাজারের বাস্তবতা শুধু কর্মসংস্থানের হারের ওপর নির্ভরশীল নয়। বেশ কিছু শর্ত, যেমন: শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সমন্বয়ের সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতা, ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা, করপোরেট সুশাসন এবং ব্যবস্থাপকের বেতন-সুবিধাদি ইত্যাদি শ্রমবাজার ও শ্রমলব্ধ আয়ের পরিমাণকে প্রভাবিত করে। অথচ আইএমএফের গবেষণার r-g gap ও অসমতার নির্ভরণ বিশ্লেষণে এসব নিয়ামকের ব্যবহার দেখা যায়নি। আছে কেবল মূলধন বিনিয়োগ থেকে আয়ের উপাত্ত। তাই আইএমএফের গবেষণাটি কয়েকটি উন্নত দেশের কিছু নির্দিষ্ট সময়কালে মূলধন বিনিয়োগ থেকে আয়কারী ৩০ শতাংশের r-g gap ও অসমতার প্রতিচ্ছবি, যা কোনোভাবেই প্রকৃত বৈশ্বিক চিত্রকে প্রতিফলিত করে না।

পিকেটির মতে, শ্রমবাজারের বাস্তবতা শুধু কর্মসংস্থানের হারের ওপর নির্ভরশীল নয়। বেশ কিছু শর্ত, যেমন: শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সমন্বয়ের সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতা, ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা, করপোরেট সুশাসন এবং ব্যবস্থাপকের বেতন-সুবিধাদি ইত্যাদি শ্রমবাজার ও শ্রমলব্ধ আয়ের পরিমাণকে প্রভাবিত করে।

পিকেটির মতে, আইএমএফ-এর গবেষণা পদ্ধতি কাজে দিত যদি তারা অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে আয়ের অসমতাকে বিবেচনা না করে সম্পদের অসমতাকে বিবেচনা করত। এর ফলে সম্পদ বণ্টনের চলমান গুণনীয়ক প্রভাব (dynamic multiplier effect) পর্যালোচনা করা যেত, তবে তাতেও শর্ত থাকবে যে, বিদ্যমান কোনো শর্ত পরিবর্তন হবে না, বিশেষ করে সরকার গৃহীত ঋণের বিপরীতে, সুদের হার।

আর আইএমএফের এই গবেষণা পরিচালনার জন্য যে সময়কাল ও যে প্রকৃতির তথ্য প্রয়োজন তা ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের মতো হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্রের কাছে আছে। আইএমএফের পছন্দের পদ্ধতিতে রিগ্রেশন ব্যবহারের জন্য এই তথ্য নিতান্তই অপ্রতুল। তবে পিকেটি মনে করেন, এই তথ্যের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও, পরিষ্কার বোঝা যায়, উচ্চ বিনিয়োগ থেকে আয়ের হারের তুলনায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার বৃদ্ধি না পাওয়াই অসমতা বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তাই পিকেটি আইএমএফ-কে উপদেশ দিয়েছেন এ রকম মানহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নির্ভরণ বিশ্লেষণ পরিচালনা না করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও অসমতার সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে মনোনিবেশ করতে।

পিকেটি আইএমএফ-কে উপদেশ দিয়েছেন এ রকম মানহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নির্ভরণ বিশ্লেষণ পরিচালনা না করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও অসমতার সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে মনোনিবেশ করতে।

আবার পিকেটি দেখিয়েছেন যে, r-g gap বা বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে আয়ের হার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারের ব্যবধান পরিমাপ করার জন্য আইএমএফ বিনিয়োগ থেকে আয়ের হারের নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করেছে সরকারি ঋণের সুদের হারকে। কিন্তু আইএমএফ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে তা হলো বিশাল পুঁজি ও বড় অঙ্কের চলতি মূলধন সরকারি ট্রেজারিতে সচরাচর খাটানোই হয় না। অর্থাৎ, বিশাল অঙ্কের পুঁজির হিসাব এখানে কৌশলে গণনার বাইরে রাখা হয়েছে। পিকেটি তার ক্যাপিটালে উল্লেখ করেছেন, এই গণনা সঠিকভাবে ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ-না এটি মেনে নেয়া হবে যে ‘সবরকম বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার এক নয়’। পিকেটির মতে, যার কাছে সম্পদের পরিমাণ যত বেশি বিনিয়োগ থেকে তার আয়ের হার বা সম্পদ বৃদ্ধির হার তত বেশি। যেমন: ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয়কারীর বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার ও বড় পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার সমান নয়।

পিকেটি গ্লোবাল ফরচুনের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সম্পদ যার যত বেশি, বিনিয়োগ থেকে আয় বৃদ্ধির হার তার তত বেশি। ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৃহৎ পুঁজিপতিদের (৩০০ বিলিয়ন আয়কারীর ১ শতাংশ বা মাত্র ৩০ জনের) বিনিয়োগ থেকে আয়ের হার বা সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.৮ শতাংশ অন্যদিকে বাকিদের বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.১ শতাংশ।

ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ নিয়ে পিকেটির একটি মজার গবেষণা আছে, পিকেটি আগেই বলেছেন, বিশাল পুঁজি ও বড় অঙ্কের চলতি মূলধন সরকারি ট্রেজারিতে বিনিয়োগের পরিমাণ নগণ্য। তিনি দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সব নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের প্রাপ্ত অনুদান সরকারি ট্রেজারিতে বিনিয়োগ করে না। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাদের বড় বিনিয়োগ থেকে আয়ের বড় অংশ এসেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনির্ভরশীল করপোরেট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে। আর যত বড় বিনিয়োগ তত বড় আয়ের হার। খেয়াল রাখা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে, তাদের চাহিদা বিশাল পোর্টফোলিওর বিনিয়োগ, সাধারণ বিনিয়োগকারীর এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সব নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের প্রাপ্ত অনুদান সরকারি ট্রেজারিতে বিনিয়োগ করে না। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাদের বড় বিনিয়োগ থেকে আয়ের বড় অংশ এসেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনির্ভরশীল করপোরেট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে। আর যত বড় বিনিয়োগ তত বড় আয়ের হার।

আরও দেখা গেছে যে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সম্পদ একটি নির্দিষ্ট আয় রেখার ওপর যাওয়ার পরও ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু অন্যদের যারা নির্দিষ্ট আয়রেখার ওপরে নেই তাদের আয়ের হার সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অনেকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তি কোম্পানির উদ্ভাবনী দূরদর্শিতাকে এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চান। পিকেটিও এই বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেন, তবে তিনি এই প্রশ্নও করেন:

‘তেল, প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজের সাথে তো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সম্পর্ক খুবই কম, তাহলে রাশিয়ান বিলিয়নিয়াররা কেন শুধু এই সম্পদ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মাধ্যমে, তাদের মূলধনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করেছে এবং অন্য রাশিয়ানদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না?’

অর্থাৎ, এটি মোটামুটি পরিষ্কার যে নিয়ন্ত্রিত সম্পদের পরিমাণ ও আয় বৃদ্ধির হার সমানুপাতিক।

পরিশেষে পিকেটি বলছেন, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানে কোনো কিছু চূড়ান্ত নয়। সময়ের সাথে সাথে তা নানা রূপ ধারণ করে। অসমতার তত্ত্বও পরিবর্তনশীল, এবং এর গবেষণা নিয়ে গণতান্ত্রিক বিতর্ক সব সময় গ্রহণযোগ্য। সবশেষে অসমতার বিতর্ক নিয়ে যদি কিছু বলতে হয় পিকেটির গবেষণা ও আইএমএফ-কে তার জবাব, তার একটি বিশেষ উক্তির দিকে নির্দেশ করে:

‘ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে অসমতার পেছনে মূল কারণ অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত নয়, বরং তা আদর্শিক ও রাজনৈতিক।’

চৌধুরী মুজাদ্দিদ আহমদ: প্রভাষক, মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

Email:  mujaddid.rudro@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •