নারী বনাম চিরন্তন পুরুষত্ব

মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৪

নারী বনাম চিরন্তন পুরুষত্ব

তারিক আলি

ষাট দশকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই পাকিস্তানের মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা বই থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, বিশ্বে আগ্রাসন প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তারিক আলি লিখিত বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বিস্তৃত এবং ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিতর্কিত বিষয় তখন তাঁর বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity প্রকাশিত হয়। তারিকের এই বই অনুসন্ধান করেছে ধর্মীয় বিভিন্ন মত পথ, বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদী শক্তি, তার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং সর্বোপরি তাঁর ভাষায় ‘সবচাইতে বড় মৌলবাদী শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর সাথে এর  সম্পর্ক। সর্বজনকথার জন্য এই বই-এর ধারাবাহিক অনুবাদ করছেন লেখক অনুবাদক ফাতেমা বেগম

ইসলামে নারীর বাস্তবতা একটি পূর্বনির্ধারিত নিয়তি। কোরআন সেখানে দ্ব্যর্থহীন। নারী লিঙ্গ পরিচয়ের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে কোরআনে ‘নারী’ শিরোনামের অধ্যায়টি অবতীর্ণ হয়েছে। সেই কারণে কিছু গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ অপরিহার্যভাবে আরোপ করা হয়েছে যাতে নারীর ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচরণ নির্ধারণ করা যায়। যদিও অধ্যায়ের কিছু অংশ উদার ব্যাখ্যা বহন করতে পারে, কিন্তু মৌলিক এই আয়াতটি নারীদের বিধিনিষেধের কড়াকড়ি আরোপ সম্পর্কে নিশ্চিত করে:

নারীদের উপর পুরুষদের কর্তৃত্ব রয়েছে কারণ আল্লাহ একজনকে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং পুরুষেরা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে নারীদের জীবনযাপন বজায় রাখার জন্য। পূণ্যবতী নারীরা বাধ্য হয়ে থাকে। তারা দৃষ্টির আড়ালে থাকা তাদের অঙ্গগুলোকে হেফাজত করে  আল্লাহ যাদের হেফাজত করেন। যাদের (নারীদের) কাছ থেকে আপনি অবাধ্যতার আশঙ্কা করেন, তাদের উপদেশ দিন, তাদের বিছানা ত্যাগ করুন এবং তাদের প্রহার করুন। তারপর, যদি তারা আপনার আনুগত্য করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। (৪.৩৪) 

বোখারি সংগৃহীত একটি হাদিস (খণ্ড iv, পৃ. ৯১) মুহাম্মদকে উদ্ধৃত করে বলেছে, বেহেশতের চূড়ায় তার রাত্রিকালীন ভ্রমণের সময়, তিনি ‘লক্ষ্য করেছিলেন যে নরক সর্বোপরি নারী দ্বারা জনবহুল’। ভিন্নএকটি হাদিসে একই উদ্বৃতি পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে,’আমাকে যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো অনুগত হওয়ার আদেশ দেওয়া হত, তাইলে আমি অবশ্যই নারীদেরকে তাদের স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করার নির্দেশ দিতাম, কারণ স্ত্রীর উপর স্বামীর এত বড় অধিকার!’ এই বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই ঐতিহ্যগতভাবে অন্যের কাছ থেকে শোনা। তারপরও এই শব্দগুলি প্রকৃতপক্ষে নবীর দ্বারা উচ্চারিত হয়েছিল কিনা তা কোনো গুরুত্ব বহন করে না, তবে ধরে নেওয়া হয়, এগুলো তার দ্বারা উচ্চারিত এবং সেজন্যই এগুলোকে ইসলামী সংস্কৃতির অংশ বলে বিশ্বাস করার বিষয়টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে।

প্রাথমিক পর্বের ইসলামের ধারাভুক্ত অন্যের মুখ থেকে শোনা এই ধরনের উদ্বৃতিগুলোকে ইসলামিক মৌলবাদীরা সীমাহীনভাবে মহিমান্বিত করে। তবে সর্বস্তরে প্রতিহত হওয়ার কারণে নারীদের উপর সর্বজনীন নিপীড়ন আরোপ করতে তা অক্ষম ছিল। উপর এবং নীচ দুদিক থেকেই তা প্রতিরোধ করা হতো। পৌত্তলিক গোত্রের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌখিক এবং সামরিক সংঘর্ষে উভয় পক্ষের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৬২৫ সালে, উহুদের যুদ্ধের সময় মুসলমানরা একটি শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই যুদ্ধ চলাকালে মক্কার একজন গুরুত্বপূর্ণ পৌত্তলিক প্রধানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাহ, তার সৈন্যদের এইভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন: ‘আমরা তিরস্কার প্রত্যাখ্যান করি! তাঁর আল্লাহকে আমরা অস্বীকার করি! তাঁর ধর্মকে আমরা অতিশয় অপছন্দ করি এবং ঘৃণা করি!’ উমর, একজন ভবিষ্যত খলিফা এবং যুদ্ধে নবীর একজন নেতৃস্থানীয় সহযোদ্ধা এর জবাবে একটি স্থুল উক্তি করেছিলেন: ‘আল্লাহ, হিন্দকে অভিশাপ দিন! বড় ভগাঙ্কুর তো হিন্দের অনন্য বৈশিষ্ট, এবং তার স্বামীকেও এক সাথে অভিশাপ দিন

মুহাম্মদের জীবদ্দশায় এবং তার মৃত্যুর পর বহু দশক ধরে নারীরা তাদের অনুমিত হীনতা সত্ত্বেও পুরুষদের পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানে ছিল। তারাও তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। শিয়া ইসলামের অনুপ্রেরণাদাতা আলী-র নাতনি সুকাইনাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, যেখানে তার বোনের আচরণে কঠোরতা এবং গাম্ভীর্য থাকে সেখানে কেন সে আনন্দের সাথে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, এর কারণ হলো তার নাম রাখা হয়েছে তার প্রাক-ইসলামী সময়ের বড় দাদীর নাম অনুসারে ,আর তার বোনের নামরাখা হয়েছে তাদের মুসলিম দাদীর নামে।

জাহিলিয়া বৈশিষ্ট্যে আখ্যায়িত প্রাক ইসলাম মক্কার রাজনৈতিক ও যৌন নৈরাজ্যকে ইসলাম দমন করতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার চাইতে মুহাম্মদের রাজনৈতিক প্রতিভা বেশি কাজে লাগিয়েছে। আয়েশার সূত্রে জানা যায় যে আধ্যাত্মিকতা আসলে কৌশলগত উপকরণ হিসাবে কাজ করেছে। ধর্ম প্রচারের জন্য তার একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল। সশস্ত্র পুরুষ এবং নারী ছিল তাঁর নতুন রাষ্ট্রের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রাথমিক চেহারা। কার্যকর হওয়ার জন্য নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা পবিত্র হওয়া আবশ্যক ছিল। পৌত্তলিকতা এবং একেশ্বরবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটে যুক্তিকে নির্বাসিত করা আবশ্যক ছিল।

বিশ্বাসীরা এই ব্যাপারে একমত হোক বা না হোক, এটা অনস্বীকার্যযে,একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রেবিশ্বাসের চাইতে আচরণবিধি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আচরণবিধি আরোপ করার জন্য আধ্যাত্মিকতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু একবার তা অর্জন করা হয়ে গেলে নতুন পরিচয়টি সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের আকর্ষণকে প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। জাতি বা জাতীয়তাবাদহীন বিশ্বটিতে ইসলামী পরিচয় একটি সর্বজনীন ‘জাতীয়তা’ নির্মাণের কাছাকাছি এসেছিল। কোরানের কিছু অংশ ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের আংশিক বর্ণনা ব্যবহার করে ভিন্নতা তৈরী করে নিজস্বতা এনেছিল, অন্য অংশগুলি নতুন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিশদ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন বিষয়ে সুপারিশের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, ইসলাম যখন আটলান্টিক থেকে চীনের উপকূলভূমি পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে বিস্তৃত সাম্রাজ্য বা সম্প্রদায়গুলিকে তৈরি করেছিল, তখন এর প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতিগুলি মুসলিম পরিচয়ের এক বিরামহীন তন্তুতে বোনা হয়েছিল। এই ধারাবাহিকভা একটা নিরাপত্তার বোধ দিয়েছিল। মতবিরোধ অস্বাভাবিক ছিল না। তবে প্রথম সহস্রাব্দের পরে এটি খুব কমই বিদ্যমান রাজনৈতিক-ধর্মীয় মহাজগতের সীমানা অতিক্রম করেছিল। এর চেয়ে ভালো দুনিয়া আর ছিল না।

উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এই আত্মতুষ্টিকে ভেঙে দেয়। পতনের কারণগুলিকে কখনোই সমাধান করা যায়নি। বেয়নেট এবং গ্যাটলিং বন্দুকের মাধ্যমে প্রায়শই ইসলামিক জগতে আধুনিকতা আনা হয়েছে, ঐতিহ্যবাদীরা ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে একটি সহজ সহযোগিতায় বসতি স্থাপন করেছে। মিশরে নেপোলিয়ন যেভাবে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের মূল্যবোধকে প্রসারিত করেছিলো সেভাবে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর পরবর্তী প্রতিনিধিরা কিছু করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।

রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেস্কিউ, পেইন, ফুরিয়ার, ফয়েরবাখ বা ​​মার্কস এর কাজ ঔপনিবেশিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। ইউরোপীয় শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে সমৃদ্ধ করতে পারে এমন কিছু সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির বিশেষ প্রবেশাধিকার ছিল। এভাবে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টিকে বজায় রেখে ইসলামের ‘সাংস্কৃতিক’ ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। পুরনো ঔপনিবেশিকতা এবং নব্য পুঁজিবাদের সময়কালে নারীর অসমতা রক্ষাকারী কঠোর আইনকে গর্বভরে সংরক্ষিত করা হয়েছিল। পরিবার একটি অস্পৃশ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে: নগিব মাহফুজ এর উপন্যাসগুলিতে এর সংবেদনশীল পর্যালোচনা চিত্রিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে মুসলিম পরিচয়ের এই দিকটি রক্ষা করাই একটি মৌলিক সংগ্রামী নীতি হয়ে দাঁড়ালো। সাইয়্যেদ কুতব এবং রুহুল্লাহ খোমেনি উভয়েই পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতাকে একটি কৃত্রিম স্বাধীনতা হিসাবে ঘোষণা করলেন- যে কোনো পথচারীর দৃষ্টিতে যৌন-বস্তু হওয়ার চাইতে ইসলামী রাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত একজন নারী উত্তম !

এর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় নারীদের প্রতি পুরুষালী ভীতি, তাদের উদ্বেগ যা মনে করে নারীদের যৌন আকাঙ্ক্ষার শক্তি অপ্রতিরোধ্য এবং বিপজ্জনক। তাই কঠোর আচরণবিধির মাধ্যমে তা দমন প্রয়োজন, এর লঙ্ঘনের পরিণাম হতে হবে নারীদের জন্য নৃশংস শাস্তি। প্রারম্ভিক ইসলামের সময় এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা খলিফা আলীর বক্তব্য হিসেবে প্রচারিত: সর্বশক্তিমান আল্লাহ যৌন আকাঙ্ক্ষাকে দশ ভাগে সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর তিনি নারীদের নয়টি অংশ এবং পুরুষদের একটি অংশ দিয়েছেন।’

নারীদের এই অত্যধিক যৌনতার ধারণা খ্রিস্টান ধর্মপ্রাণতার সাথে বড় একটি পার্থক্য তৈরী করেছিল যাতে  নারীদের যৌনতা বর্জন এবং বিবাহের উপর জোর দেয়া হয়েছিল, যা সেন্টপল কর্তৃক প্রচারিত খ্রিষ্টান ধর্মের ধারায় প্রজননের একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ইসলামের এই মনোভাবের উৎস সেই পৌত্তলিক আরব সমাজ যেখানে নারীরা বাণিজ্য, গোত্রীয় রাজনীতি এবং যৌনতায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছিল।

বহুগামীতা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। ইসলাম এই চর্চাকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। তবে এখানে তার একটি স্ববিরোধী অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। একদিকে ইসলাম যৌনতার ব্যাপারে মনো-বিশ্লেষক উইলেইম রাইখের চিন্তার প্রায় কাছাকাছি, মানে যৌনতায় জীবন প্লাবিত, যৌনতা পবিত্র, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একটি সুস্থ যৌন জীবন অপরিহার্য। মুহাম্মদ প্রেম এবং একে অপরের ‘মধুর স্বাদ গ্রহণের গুরুত্বের’ উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু অন্যদিকে, নতুন আইনের মাধ্যমে, পুরুষ একাই অনুমোদিত যৌন মিলনের সামাজিক ও আইনি স্থান নির্ধারণপূর্বক তা নিয়ন্ত্রণ করবে। নারীর জন্য নিয়ন্ত্রণমুক্ত যৌন আনন্দ আর অনুমোদিত ছিল না। একজন নারী বিছানায় সবচেয়ে সাহসী উদ্যোগ নিতে পারবে, তবে তা সমগ্র সমাজে অনুমোদিত নয়। খ্রিস্টধর্মের গোঁড়া পিতৃতন্ত্রের বিপরীতে, এটি ছিল একটি ভোগবাদী পিতৃতন্ত্র। সহস্র আরব্য রজনী বা দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস এর সমাপ্তিতে সবচেয়ে গোঁড়া বিশ্বাসীদের সন্তুষ্ট করার ব্যাপারে সতর্কতা ছিল। তবে গল্পের অন্যান্য অংশে তাঁরা আনন্দের সাথে মিলিত হন, ঠিক যেমন শেহরাজাদ চরম কামুক তৃপ্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন:

আল্লাহর জন্য মহিমা যিনি সৃষ্টি করেননি

দুই সুখী প্রেমিকের চেয়ে আরও মন্ত্রমুগ্ধকর দৃশ্য। স্বেচ্ছাচারী আনন্দে মাতাল হয়ে

তারা তাদের সোফায় শুয়ে আছে

তাদের বাহুগুলি  জড়িয়ে আছে

তাদের জড়ানো বাহুগুলি তাদের হৃদয়ের সুরে স্পন্দিত। (দ্য থাউজেন্ড এন্ড ওয়ান নাইটস, ‘দ্য টেল অব ইয়ং নূর এন্ড দ্য ওয়ারিয়র গার্ল,’ খন্ড ৩)

ইসলামিক স্বর্গ হলো সব ধরনের দৈহিক আনন্দের চূড়ান্ত জাদুকরী এক ব্যবস্থা। তবে মৃত্যুর পরেও পিতৃতান্ত্রিকতার আধিপত্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে স্বর্গ হল পৃথিবীতে পরিচালিত ধনী ব্যক্তিদের জীবনের একটি তীব্র প্রতিফলন। বৃদ্ধ পুরুষদের পুরস্কৃত করা হবে: তাদের দাড়ি চেছে ফেলা হবে, তাদের সত্তরটি পোশাকের একটি ওয়ারড্রোব দেওয়া হবে। প্রতি ঘন্টায় পোশাকগুলি সত্তর বার রঙ পরিবর্তন করবে। বার্ধক্য একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়া পর্যন্ত তারা প্রতি দিন সুন্দরতর হতে থাকবে। পৃথিবীতে নির্বাচিত একজন স্ত্রী ছাড়াও প্রত্যেককে সত্তর জন হুরের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা অবশ্যই একটি আকর্ষণীয় সংমিশ্রণ তৈরি করবে। তবে এই নতুন পুনরুজ্জীবিত সুদর্শন পুরুষটি কীভাবে তাকে অর্পিত আনন্দ পেতে এত কঠিন পরিশ্রম করতে সক্ষম হবে? ধৈর্য ধরুন, ​​পাঠক। আল্লাহ সব কিছু ভেবে রেখেছেন। আল্লাহর আদেশক্রমে স্বর্গে পৃথিবীর মতোই যৌন সম্পর্ক তৈরি করা হবে। তবে সেখানে একটি ছোট পার্থক্য থাকবে। স্বর্গে চরম কামতৃপ্তি অসীম থাকবে। প্রতিটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত বর্ধিত করা হবে এবং এর ন্যূনতম সময়কাল হবে চব্বিশ বছর। বৃদ্ধ মহিলাদের ব্যাপারে কি হবে? একই বিশেষাধিকার কি তাদেরও প্রাপ্য? এই চিন্তা ধ্বংস করুন অথবা নিজেই ধ্বংস হোন!

মুসলমানদের বিজয় যতই এগোতে থাকে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন তত আরও কঠোর হতে থাকে। নিজেকে রক্ষা করার তাগিদে নতুন নিয়মকানুনকে শিথিলতর পুরনো ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কঠোরতর হতে হয়েছিল। সর্বজনীন স্থানে প্রয়োগ করার কোন সুযোগ না থাকার ফলে নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সমসাময়িক সৌদি আরবে ব্যক্তিগত সম্পদের প্রায় ৪০ শতাংশ সেখানকার নারীদের দখলে রয়েছে, যার মধ্যে জিদ্দা শহরের প্রায় ৫০ শতাংশ রিয়েল এস্টেট অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এত সম্পদের মালিক হলেও নারীরা পুরুষ আত্মীয়ের লিখিত অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, তারা গাড়ি চালাতে বা জনসমক্ষে নিজেদের চেহারা উন্মোচিত করতে পারবেন না। যাইহোক, যখন তারা বিদেশ ভ্রমণ করে্ন তখন তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী তাদের সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন। পছন্দমত পোশাক পরিধান করতে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন। ব্যাপারটি অবশ্যই পরস্পর বিরোধী হলো। তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে রাজতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও এই স্ববিরোধিতার বিস্ফোরণ ঘটতে খুব বেশী দেরী নেই।

স্বামী এবং নির্ধারিত নিকটাত্মীয় ব্যতীত আর সকল পুরুষের সম্মুখে তাদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ছিল। শহরের বাড়ি ও রাজপ্রাসাদে এই বন্দীত্ব একইরকম ছিল, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ হারাম। পরবর্তীতে, শহুরে দরিদ্রদের বসতিতে কাপড়ের বেড়া দিয়ে পুরুষ দর্শনার্থীদের থেকে নারীদের আলাদা রাখা হতো। জীবিকার তাগিদে, ইসলামী দেশগুলিতে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ এই বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থা এড়াতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্ম নেয়া মৌলবাদ ইসলামী বিশ্বের কিছু অংশে এই নিষিদ্ধকরণ চাপিয়ে দিয়েছিল। আফগানিস্তান তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

নারীরা কীভাবে এই বিধিনিষেধ মোকাবেলা করেছে? ব্যক্তিগত অঙ্গনে তারা এই বিধিনিষেধ সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে। ইসলাম গ্রহণ করা সংস্কৃতি উদ্ভূত বিভিন্ন সাহিত্যসহ অসংখ্য বিবরণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শহরের মুসলিম নারীরা তাদের স্থানিক এবং সামাজিক বন্দিদশা অতিক্রম করার জন্য বিস্তৃত পদ্ধতি তৈরি করেছিল। সেনেগালে তারা কখনই বোরখা পছন্দ করত না; বাংলা অঞ্চলে  তারা মাথা ঢেকেছে কিন্তু পেট আবৃত করেনি; জাভাতে তারা মাথা আর পেট উভয়ই প্রদর্শন করেছে। সাধারণত স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের অগোচরে গোপন যৌন জীবনযাপন করেছে। হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ আত্মীয়রা যে নির্দোষ ছিল তা কিন্তু নয়।

সমকামিতা বিষয়ে ইসলাম ভীষণ কঠোর। একে অপ্রাকৃতিক বলা হয় কারণ এটি বিষমকামীতার মধ্যে বৈপরীত্যের সম্প্রীতিকে লঙ্ঘন করে। মেয়েলী পুরুষ এবং পুরুষালী নারী উভয়ই ঈশ্বরের আইন বিচ্যুত বিদ্রোহ হিসাবে নিন্দিত হয়। অন্তত এই ক্ষেত্রে তিন একেশ্বরবাদ একমত। হাদিস অনুযায়ী আল্লাহ চারটি বিচ্যুতিতে রাগান্বিত হন: ‘পুরুষ যারা নিজেদেরকে নারী হিসেবে সাজায় এবং নারীরা যারা পূরুষের পোশাক পরে, যারা পশুদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে এবং যে সকল পুরুষেরা পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে।’ এদের মধ্যে পুরুষ সমকামিতায় সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়: নির্যাতন এবং মৃত্যু। বিপরীতে, লেসবিয়ানিজম, নেক্রোফিলিয়া, হস্তমৈথুন এবং পশুগমনকে কম কঠোর বিবেচনা করা হয়। এগুলির জন্য শাস্তি হলো: কঠিন তিরস্কার এবং একটি সতর্কবাণী।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সোডোমি নিকৃষ্টের নিকৃষ্টতম, সমস্ত বিকৃতির জননী, সমস্ত হীনতার জনক এবং মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হিসাবে বিবেচিত হয় (যেমনটা খোমেনি ইরানে বিপ্লবের পরে দেখিয়েছিলেন)। কেউ হয়তো ধরে নিতে পারে যে ইসলামী সংস্কৃতির অল্পসংখ্যকের মধ্যে যৌনতার এই বিশেষ রূপ দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটি ইসলামিক বিশ্বের পুরুষ এবং নারী উভয়ের মধ্যে একটি সাধারণ অভ্যাস ছিল, যেখানে এটি পুরুষ-মহিলা সম্পর্কের উপর সাধারণত আরোপিত বিধিনিষেধ দ্বারা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও এগুলি দেশ থেকে দেশে পরিবর্তিত হয়, লিঙ্গের পৃথকীকরণ দৈনন্দিন জীবনের দৈনন্দিন রুটিনের একটি অংশ। বিষমকামীতার তাত্ত্বিক আনন্দ অনুশীলনে কঠোর আইনী বিধিনিষেধ সমকামী নয় এমন লোকদেরকেও  সমকামীতার চর্চার দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে সমাজ যৌন নিপীড়ন এবং ভন্ডামীতে নিমজ্জিত হয়।

কর্ডোবার ইবনে রুশদ প্রথম মুসলিম দার্শনিক যিনি নারী সম্পর্কে ইসলামের কাঠামোগত ত্রুটিগুলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তাঁর সাথে আমরা ইতিপূর্বে পরিচিত হয়েছি।  প্রায়শই জিন্দিক বা ধর্মদ্রোহী হিসাবে নিন্দিত ইবনে রুশদ কখনও নারী প্রশ্নে পিছপা হননি। ইউরোপের চর্চার আগেই তার মুক্ত চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই এই চিন্তাধারার উৎপত্তি ইউরোপ থেকে নয়। বরঞ্চ সময়ের সাথে সাথে, তা রেনেসাঁ সৃষ্ট ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

কর্ডোবার ইবনে রুশদ প্রথম মুসলিম দার্শনিক যিনি নারী সম্পর্কে ইসলামের কাঠামোগত ত্রুটিগুলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তাঁর সাথে আমরা ইতিপূর্বে পরিচিত হয়েছি।  প্রায়শই জিন্দিক বা ধর্মদ্রোহী হিসাবে নিন্দিত ইবনে রুশদ কখনও নারী প্রশ্নে পিছপা হননি। ইউরোপের চর্চার আগেই তার মুক্ত চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই এই চিন্তাধারার উৎপত্তি ইউরোপ থেকে নয়। বরঞ্চ সময়ের সাথে সাথে, তা রেনেসাঁ সৃষ্ট ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

ইবনে রুশদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে পাঁচশ বছর যাবত নারীদের অদৃশ্য রাখার ফলে তাদের মর্যাদা সবজির মর্যাদার পর্যায়ে চলে গেছেঃ

 তবে এই (আমাদের) রাজ্যগুলিতে নারীদের ক্ষমতা জানা যায় নাকারণ তারা কেবল প্রজননের জন্য ব্যবহৃত হ। তাদেরকে  স্বামীর সেবা, প্রজনন, সন্তান লালন-পালন এবং স্তন্যপান করানোর কাজে নিযুক্ত করা হয়। তারা মানবিক গুণাবলীর জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ফলে এই রাজ্যের নারীরা অন্যান্য কার্যকলাপ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে বাধ্য হয়। ফলে তারা প্রায়শই উদ্ভিদের মত হয়ে যায়। এই রাজ্যগুলির দারিদ্র্যের একটি কারণ হল পুরুষদের উপর নারীদের আর্থিক নির্ভরশীলতা। (উদ্ধৃতি: ইআই জে: পলিটিক্যাল থট ইন মেডিয়াভাল ইসলাম, কেমব্রিজ, পৃ.১৯০)

আরো ছয় শতাব্দী পর প্রশ্নটি পূনরায় উত্থাপিত হয়। নারী অধিকারের প্রশ্নে নতুন প্রবক্তা হিসাবে আবিভূর্ত হন একজন মিশরীয় তরুণ, রিফাতআল-তাহতাউই (১৮০১-৭৩)। তিনি মোহাম্মদ আলীর মিশর রাজ্যে বেড়ে ওঠেন। একজন অটোমান অফিসার, এবং আধা-স্বাধীন আল-তাহতাউই  দেশটিকে আধুনিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলীর ফ্রান্সে পাঠানো ছাত্র মিশনে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই তরুণ পণ্ডিত সেখানে ফরাসি শিখেছেন, আলোকিত দার্শনিকদের অধ্যয়ন করেছেন এবং ফরাসি নারীদের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফিরে এসে তিনি মিশরের নারীদের অবস্থা নিয়ে দুটি বই প্রকাশ করেন। তার আগে ইবনে রুশদের মতো, তিনি দাবি করেছিলেন যে মুসলিম নারীদেরকে পুরুষদের সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতার অনুমতি দেওয়া হোক। তিনি হেরেমকে একটি কারাগার হিসেবে নিন্দা করেছিলেন এবং তার ধ্বংস কামনা করেছিলেন। বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং সকল নারীর শিক্ষাগ্রহণের সুযোগের পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন।  

অর্ধশতাব্দী পরে মিশরীয় বিচারক কাসেম আমিন আল-তাহতাউই এর চিন্তা শক্তি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর রচিত দ্য লিবারেশন অফ উইমেন (১৮৯৯) এবং দ্য নিউ ওম্যান (১৯০১) বইগুলি আরব নারীবাদের মূল গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ তখনও কয়েক দশক দূরে। ইসলামের স্থানীয় অবস্থানের সাথে আপস না করে ইউরোপীয় অগ্রগতির অনুকরণ করা তখনো সম্ভব ছিল।

বিংশ শতাব্দীতে আরব বিশ্বের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অধিকারের আন্দোলনের জন্ম ও বিকাশ দেখা যায়। আন্দোলনগুলি ক্রমবর্ধমান উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক -উভয় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ধারার সাথে মিলিত হয়। তবে নারী আন্দোলনে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিল।

বিংশ শতাব্দীতে আরব বিশ্বের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় নারী অধিকারের আন্দোলনের জন্ম ও বিকাশ দেখা যায়। আন্দোলনগুলি ক্রমবর্ধমান উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক -উভয় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ধারার সাথে মিলিত হয়। তবে নারী আন্দোলনে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ধর্মীয় বিধান নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক আইনকে চ্যালেঞ্জ না করেই সমান রাজনৈতিক অধিকার দাবি করেছিল।

পরবর্তীতে, উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্যায়ে, নারীদের সামাজিক সমতার পাশাপাশি ভোটের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মোস্তফা কামালবাদী তুরস্ক এবং তিউনিসিয়া ছাড়া আর কোথাও শরিয়া, ইসলামী আইন, কে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। নারীরা পড়ালেখা, কাজ এবং ভোটের অধিকার দাবি করেছিল। মিশর, ইরাক এবং সিরিয়ায় প্রথম দুটি দাবী মঞ্জুর করা হয়েছিল। কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্র হওয়ার কারণে এই সব দেশে পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই ভোট প্রযোজ্য ছিল না। নারীরা যদিও পুরুষের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, কিন্তু স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর সিভিল কোড নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক কাঠামো সংস্কারের জন্য তাদের দাবিগুলি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল। উপনিবেশ-উত্তর যুগে এই পশ্চাদগামী পদক্ষেপগুলিকে সংরক্ষণ করা ইসলামী পরিচয়ের কেন্দ্রীয় একটি স্তম্ভ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপার থাকলেও তারা তখনও সেই আইনের অধীনেই ছিল যা তাদেরকে নিকৃষ্ট নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেকুলার, আধুনিকতাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক চেষ্টার পরাজয়ের সাথে সাথে, বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদের ঢেউ বয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, রাশিয়া এবং সাবেক পূর্ব জার্মানিতে নারীদের কিছু অর্জিত অধিকার হুমকির মুখে পড়ে। ইরানে ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিজয়, আফগানিস্তানে বামপন্থীদের পরাজয়, সৌদি আরবে ওয়াহাবি শাসনের অব্যাহত ধারা, মিশর ও আলজেরিয়ায় কট্টরপন্থী মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান, উত্তর-আধুনিকতাবাদী আপেক্ষিকতার যুক্তি প্রভৃতি আবারো নারীদের প্রত্যাশাকে আপাতদৃষ্টিতে কবর দিয়েছিল। বৈশ্বিক যুগে এরকম ধারণা হতে পারে যে নিজের ধর্মীয় পরিচয় রক্ষা করাই একমাত্র পার্থক্য অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু কার পরিচয় রক্ষা করা হচ্ছে, আর তা কার স্বার্থে?

মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতৃস্থানীয় নারীবাদী, যারা একসময় সাহসের সাথে ধর্মীয় নেতা এবং সামরিক স্বৈরশাসকদের মোকাবিলা করেছিলেন, তারা মৌলবাদী ঝড়ের মুখে নত হয়েছেন। মাঝে মাঝে আমাদেরকে বলা হয় যে, আয়োজিত বিবাহ এবং পর্দা প্রথা পশ্চিমা বিবাহ এবং ব্যভিচারের চেয়ে উত্তম, যেন মুসলিম বিশ্বের সমস্ত বিবাহ আয়োজিত এবং ব্যভিচার তাদের কাছে অজানা ব্যাপার। যদি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গের কারণে অটোম্যান বা উসমানীয় শাসন অধিকতর গ্রহণযোগ্য হতো, তাহলে আরবরা কেন অটোম্যানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল?

তবুও ইতিহাস আমাদের অবাক করতে সক্ষম। ইরান ও সৌদি আরবের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক নতুন তরঙ্গ দেখা দিতে পারে। অভিজ্ঞতা এখনও সেরা শিক্ষক।

আগের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৩

পরের পর্ব: মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৫

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •