গ্রন্থ পর্যালোচনা
নদী খুন ও উন্নয়নের কমেডি
আলমগীর খান
লেখক-সাংবাদিক আমীন আল রশীদ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে অনেক মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন। তার লেখা বইগুলো বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র্যময়। এ বছর প্রকাশিত তার নতুন বইটি হলো ‘উন্নয়ন পাঠ: নদী ও প্রাণ’। এতে তিনি জাতীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এক মলাটে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিষয়ের ব্যাপ্তির বিবেচনায় কাজটি কিছু কঠিন বটে। তবে বইটি আপন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ দুটি গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সফলভাবে উপস্থাপন করেছে। নদী ধ্বংস ও রকেটের মতো গতিশীল আমাদের চলতি উন্নয়ন ঘিরে অনেক প্রশ্নকে বিরাট আকারে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন লেখক। শুধু প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হননি, পাঠককে উদ্বুদ্ধ করেছেন নিজ কর্তব্য পালনে, মাতৃতুল্য নদীগুলো রক্ষার দায়িত্ব পালনে এবং উন্নয়নকে রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে। বইটি প্রকাশ করেছে ঝালকাঠি পাবলিকেশন্স আর এর সুন্দর প্রচ্ছটি করেছেন মুজিব মুহাম্মদ।
‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ বইয়ের লেখক ধানসিঁড়ির শহর ঝালকাঠির সন্তান আমীন আল রশীদ এ বইতে যেন জীবনানন্দের চোখ দিয়ে দেখেছেন নদীর পর নদী হত্যার মর্মান্তিক দৃশ্য এবং কেঁপে উঠেছেন এই হত্যাকাণ্ডের গায়ে উন্নয়নের লেবেল আঁটা দেখে। আবেগতাড়িত স্বরে বলেছেন আমীন,
‘নদী যে পৃথিবীর মানুষের মতোই ক্ষুব্ধ হয়, কথা কয়, তারও যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে–জীবনানন্দের আগে এমন কথা বাংলা সাহিত্যে আর কে লিখেছেন! নদীর এই অনুভূতি বোঝার সাধ্য আর কার হয়েছে?’
জীবনানন্দের কবিতায় সবচেয়ে বেশি এসেছে যে আবেগী নদীটির নাম, সেই ‘ধানসিঁড়ি’ এখন শুকিয়ে এমন হয়েছে যে একে নদী বলার জো নেই। এটি এখন সরু খাল। শীতের দিনে এর পানি থাকে হাঁটুসমান।’ অতএব, খননের মাধ্যমে ধানসিঁড়ির ট্র্যাজিক চিকিৎসা শুরু হয়। বইয়ে দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ধানসিঁড়ি খননে ব্যয় হয়েছিল ৮৪ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯-এ দুই কিস্তিতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব অনুযায়ী এর তলদেশ খননের জন্য ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। লেখক বলেছেন, ‘এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বারবারই একধরনের রসিকতায় পরিণত হয়, যা নদীর সুরক্ষা নয়; বরং মৃত্যুই নিশ্চিত করে।’
গেল বছর লালমনিরহাটে নদী খননের নামে ২৩ কোটি টাকা পানিতে ফেলা হয়। হয়তো আবারও ফেলা হবে! নদীগুলোকে টাকার গাছ বললে ভুল হয় না–খনন, ভরাট, আবার খনন, আবার ভরাট! লেখক বলেছেন, ‘জনগণের টাকার এভাবে শ্রাদ্ধ করা হলেও এর জন্য সংশ্লিষ্টদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।’ এবং
‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে নদী খুন করা হয়, তার বড় উদাহরণ কুড়িগ্রামের চাকিরপাশার নদী। প্রথমে এই নদীর দুই পাড় স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে দখল করে সংকুচিত করে ফেলে। মাছ চাষের জন্য নদীর দখল করা জায়গায় কাটা হয় পুকুর। নদী হত্যা করে তার বুকে পুকুর কাটার এমন অদ্ভুত ঘটনা বিরল।’
লেখক প্রশ্ন করেছেন: ‘নদীর মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। সেই নদী কী করে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়?’ লিখেছেন, “উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী নদী যেহেতু এখন থেকে ‘জীবন্ত সত্তা’ এবং বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক, অর্থাৎ নদীই যে দেশের মা, সেই মায়ের সম্ভ্রম রক্ষায়, সেই মায়ের জীবন বাঁচাতে রাষ্ট্র যে এগিয়ে আসছে, সেটি খুবই আশার কথা।”
হতাশাও কম নয়! এসেছে লবণদহ, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরীসহ বিভিন্ন নদীর খুন হয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এসেছে নড়াই নদীর আত্মপরিচয় লুপ্ত করে তাকে রামপুরা খালে ও পরে একাংশকে ব্যয়বহুল প্রসাধনী মাখিয়ে হাতিরঝিল লেকে পরিণত করার কাহিনি। তাই প্রশ্ন: ‘দশ কোটি টাকা হলেই নদী বা প্রাকৃতিক জলাধার গিলে খেয়ে সেখানে একটা কারখানা গড়ে তোলা যায়। … কিন্তু যে নদী বা যে প্রাকৃতিক জলাধারটি দখল করা হলো, কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যে যে নদীটির পানি ব্যবহার অযোগ্য করা হলো, সেখানে মাছ তো দূরে থাক; সামান্য কীটপতঙ্গের জীবনও হুমকিতে ফেলা হলো, সেটি ফিরিয়ে আনতে কতশত কোটি টাকা লাগবে? … একশ কোটি টাকা খরচ করেও কি একটি নদী বানানো যায়?’
এসেছে লবণদহ, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরীসহ বিভিন্ন নদীর খুন হয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এসেছে নড়াই নদীর আত্মপরিচয় লুপ্ত করে তাকে রামপুরা খালে ও পরে একাংশকে ব্যয়বহুল প্রসাধনী মাখিয়ে হাতিরঝিল লেকে পরিণত করার কাহিনি।
আমরা সবাই জানি, যায় না। তাহলে গত অর্ধশত বছরে যেসব নদী খুন করা হয়েছে তাদের মোট মূল্য কেউ হিসাব করতে পারবেন কি? হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ, যার মানুষ নদীকে মায়ের মতো আপন মনে করে, সেই মায়ের অবস্থা এখন করুণ। আমরা তাকে প্রতিদিন গলাটিপে হত্যা করতে উঠে পড়ে লেগেছি। স্বাধীনতার কয়েক বছর যেতে-না-যেতেই শুরু হয় নদীর প্রতি অবহেলা। আমাদের যোগাযোগ পরিকল্পনার পুরোটাই সড়ককে ঘিরে শুরু হয়। সড়ক নির্মাণের ঠিকাদারি, যাতায়াতের জন্য পরিবহণ ব্যবসা, বিদেশি গাড়ির বিক্রয়, সেতু নির্মাণ ইত্যাদি মিলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অব্যর্থ মন্ত্র।
আমাদের যোগাযোগ পরিকল্পনার পুরোটাই সড়ককে ঘিরে শুরু হয়। সড়ক নির্মাণের ঠিকাদারি, যাতায়াতের জন্য পরিবহণ ব্যবসা, বিদেশি গাড়ির বিক্রয়, সেতু নির্মাণ ইত্যাদি মিলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অব্যর্থ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে যানজট, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও জিডিপি! উন্নয়নের প্রদর্শনবাদে বুঁদ হয়ে শুরু হয় রাস্তায় দামি দামি গাড়ি নামানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সড়ক হয় কলাগাছদের ফুটানি দেখানোর মঞ্চ। যানজটের কবলে আটকে শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক বিকারের শিকার দামি গাড়িওয়ালারা তাদের সম্পদের প্রদর্শনী করে ও জনগণ তা দেখে উন্নয়নের নামে হাততালি দেয়! রাস্তাজুড়ে জটের অচলাবস্থা নামিয়ে আনতে আমাদের ‘বড়লোক’ গাড়িওয়ালাদের একফোঁটা লজ্জা হয় না!
আমাদের কর্ণধারেরা এসব দেখে অহংকারের সঙ্গে বলেন, তার মানে উন্নয়ন হচ্ছে! যানজটকে তারা উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্নে ভাসেন! লেখক বলেন, ‘কোনো রাষ্ট্রে যখন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররাই নীতিনির্ধারকের আসনে বসে যান, তখন তাদের কাছে উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। যে কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় একটি পর্দার দাম ৩৭ লাখ, বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা, মোবাইল চার্জারের দাম ২৩ হাজার টাকা … উন্নয়ন প্রকল্প না হলে খোলা মাঠে পুকুর কাটা এবং সেই পুকুর ভরাট করার জন্য দুই দফায় বাজেট পাস করা যায় না। … শূন্যমাঠে পুকুর কাটা ও ভরাট করা, বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই শতকোটি টাকা খরচ কিংবা কোটি টাকা কেজির লোহার ভেতরে যে উন্নয়নদর্শন, সেটি আর যা-ই হোক, জনগণের কোনো উপকারে আসে না।’
গাছে পানি দিতে নেদারল্যান্ডসে যাত্রা, চর দেখতে কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া সফর, পুকুর খনন শিখতে বিদেশ ভ্রমণ, ঘাস চাষ শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ গমন, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে পাড়ি–এসব খবর দেশসেবার উদাহরণ! আমাদের উন্নয়নের ঢেউ লাগে সাগরপাড়ের দেশগুলোতেও–গড়ে ওঠে সাহেবপাড়া, বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম, আরও কত কী!
গাছে পানি দিতে নেদারল্যান্ডসে যাত্রা, চর দেখতে কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া সফর, পুকুর খনন শিখতে বিদেশ ভ্রমণ, ঘাস চাষ শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ গমন, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে পাড়ি–এসব খবর দেশসেবার উদাহরণ! আমাদের উন্নয়নের ঢেউ লাগে সাগরপাড়ের দেশগুলোতেও–গড়ে ওঠে সাহেবপাড়া, বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম, আরও কত কী! অবস্থা খারাপ দেখলেই এই উন্নয়নের নায়কেরা প্লেনের টিকিট কেটে খালি হাতে উড়াল দেবে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষের জন্য তারা রেখে যাবে শুকিয়ে মরে গলে পচে যাওয়া ও খালে পরিণত হওয়া তাদের একসময়কার মাতৃতুল্য নদীগুলো, যেখানে একদিন আবার ফিরে আসার আকুতি প্রকাশ করেছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ।
আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি। ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com