বাংলাদেশে অনলাইন খ্যাপের অর্থনীতি: ডেলিভারি শ্রমিকের জীবন-২
মাহতাব উদ্দীন আহমেদ
বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতি বা অনলাইনের খ্যাপ মারার অর্থনীতির আকার হুহু করে বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতির এই উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এই অর্থনীতির চেহারাটি কেমন এবং সেটা শ্রমিকের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, সেটা নিয়েই এই প্রবন্ধ। এটি মূলত বাংলাদেশের অনলাইন ফুড ডেলিভারি খাতের শ্রমিকদের ওপর চালানো একটি অনুসন্ধানে যা উঠে এসেছে সেটার ভিত্তিতে লেখা। গবেষণাটি কেসস্টাডি নির্ভর। এর পাশাপাশি অন্যান্য দেশের প্রকাশিত কিছু গবেষণাও পর্যালোচনা করা হয়েছে। মাঠকর্ম থেকে প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরার জন্য এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতির চেহারা কেমন এবং তার উত্থান কীভাবে হলো, সেটা নিয়ে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
২.
অনলাইন ফুড ডেলিভারি শ্রমিকের জবানে তাদের জীবন
প্রবন্ধের এই অংশে যে ১৫ জন রাইডারের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল, সেসব সাক্ষাৎকারের মধ্য থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হবে। তবে পুনরাবৃত্তি এড়াতে কারো কারো পুরো সাক্ষাৎকার বাদ দেওয়া হয়েছে। রাইডারদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এখানে কারো নাম-পরিচয় দেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, অনেক রাইডারই শুরুতে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন, পরে যখন তাদের বলা হয় যে নাম বলার দরকার নেই তখন তারা সহজ হন।
‘রোজা ভাঙি হোটেলে প্রথম ঢুকি। ঢুইকা পানি খাইয়া বাইর হইয়া যাইগা’
ফুডপান্ডার এই রাইডারের বয়স ২৩ বছর। এর আগে রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের চাকরি করতেন। পড়াশোনা ক্লাস নাইন পর্যন্ত। হোটেলে বেতন পেতেন ১০-১২ হাজার টাকা। হোটেলে অন্তত ৯-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সব মিলিয়ে ২০ হাজারের মতো টাকা পেতেন। কাজ কেন ছাড়লেন জিজ্ঞেস করলে তিনি পুরো সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন সময়ে এই কথাগুলো বলেন, ‘ছাড়ছি, পেরেশানি বেশি, চাপ বেশি, ডিউটি বেশি…লোক না থাকলে আমারে প্যারা দিত আরকি, ওভার টাইম দিত কিন্তু প্যারা … জানেনই তো হোটেলের চাকরি মূল্য দেয় না কেউই।’
জানালেন রমজান মাসে কাজ কম করছেন। কত কম কাজ করছেন জিজ্ঞেস করলে জানান ৮-১০ ঘণ্টা। অন্য সময় ১০-১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। বেশি শিফট নেন। রোজার মাসে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাজ করছেন। ইফতার করেন কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ইফতারি করতে পারি না, রাস্তাঘাটে থাকি।’ রোজা রেখে কাজ করছেন, তাহলে ইফতার না করতে পারলে কীভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন কাস্টমারে এমন একটা জায়গায় ফালাইবে বেকায়দার মধ্যে। আমিও পড়ি। কাস্টমারেও পড়ে। ইফতার এমনি আরকি করা হইতেছে না। আবার বাসায় গেলে করা হয়।’ রোজা ভাঙেন কীভাবে জানতে চাইলে বলেন, ‘রোজা ভাঙি হোটেলে প্রথম ঢুকি। ঢুইকা পানি খাইয়া বাইর হইয়া যাইগা।’ তিনি জানান, রাতে বাসায় গিয়ে একবারে খেতে হয় তাকে। এই রোজার মাসে অন্তত ১০ দিন তার এমন হয়েছে যে ইফতারে কিছু খাওয়ার সময় পাননি। কারণ, অর্ডার দিতে হয়েছিল ওই সময়। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল রোজার মাসজুড়ে ইফতার নিয়ে ফেসবুকে-টিভিতে ফুডপান্ডার দেওয়া একের পর এক বিজ্ঞাপনগুলোর কথা। মানুষকে যে ইফতার পৌঁছে দিচ্ছে সে নিজেই ইফতার করার সময় পাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, সময়মতো খেতে পারার কোনো গ্যারান্টি নেই তাদের। এবং এটা শুধু রমজান মাসই না, সবসময়ই। প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ঘণ্টায় অন্তত ৩০ কিলোমিটার সাইকেল তাকে চালাতে হয়েছে এই রমজান মাসে। সাইকেলটা সেকেন্ড হ্যান্ড হওয়ার কারণে এর মেরামতের জন্য ব্যয় করা একটা নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, যেহেতু নিয়মিত সাইকেলের ওপর ধকল যায়। তিনি বলেন, ‘দুই মাসের মধ্যে ব্রেক গেছে গা, গিয়ার নতুন কইরা লাগাইছি। তারপর পিছের চেম্বার লাগাইছি…সর্বমোট ১০০০ টাকা খরচ হইছে আমার দুই মাসে সাইকেলের পিছনে।’
এই রোজার মাসে অন্তত ১০ দিন তার এমন হয়েছে যে ইফতারে কিছু খাওয়ার সময় পাননি। কারণ, অর্ডার দিতে হয়েছিল ওই সময়। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল রোজার মাসজুড়ে ইফতার নিয়ে ফেসবুকে-টিভিতে ফুডপান্ডার দেওয়া একের পর এক বিজ্ঞাপনগুলোর কথা।
শরীরের ধকল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘আল্লায় দিলে তেমন কোনো শরীরের সমস্যা এখনো হয় নাই… তবে ক্লান্তি লাগে … ক্লান্ত কাস্টমারে করে আরকি। কাস্টমারে ঠিকানা দেয় একটা তারপর ওই ঠিকানায় গিয়া দেখি কাস্টমাররে পাই না। পরে নিজের কাছেই বিরক্ত লাগে।’
তিনি জানান, প্রায়ই এমন হয় যে কাস্টমার লোকেশন দেয় একটা, কিন্তু ওই লোকেশনে গিয়ে ফোন দিলে পরে বলেন আরেক জায়গায় আসতে। এসব সমস্যা ফুডপান্ডার নিকটস্থ সেন্টারে জানিয়েও কোনো লাভ হয় না। কিন্তু ওই যে লোকেশনের বাড়তি পথটুকু তাকে সাইকেল চালাতে হলো, সেটার জন্য কোনো বাড়তি টাকা তিনি পান না। দুই মাসের ফুডপান্ডা রাইডারের জীবনে এরই মধ্যেই তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন ডেলিভারি দিতে গিয়ে। অটোরিকশা এসে সরাসরি তার সাইকেলের ওপর উঠে যায়। পড়ে গিয়ে হাত-পা ছিলে গিয়েছিল। সাইকেলের কিছু পার্টসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কাস্টমারের ওপর তার অনেক রাগ। তিনি বলতে থাকেন,
‘কাস্টমার যখন ফোন না ধরে, যখন একটা রাইডারের কষ্টটা না বুঝে তখন আমি কাস্টমারের ওপর বিরক্ত হই। কাস্টমার এমন একটা জিনিস! কাস্টমার এমন একটা খাইস্টা! কাস্টমারে বুঝে না একটা রাইডারে কী সমস্যায় পড়তেছে বা বারে বারে একটা ছেলে কেন কল দিতেছে। আমি তো চিনতেছি না। এরা কল ধরে না অনেক সময়। কল ঘুরায়। এতে আমার নিজের কাছে অনেক খারাপ লাগে।’
ফুডপান্ডা নিয়ে এমনিতে তার কোনো ‘অভিযোগ’ নেই। কারণ, তাদের ‘নিয়মকানুনগুলো’ তিনি ‘মেনে’ নিয়েছেন এই হিসেবে যে এগুলো করতেই হবে।
তার বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। এখানে কীভাবে থাকেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা এখানে আছি সৌদি আরবের মতো, ৪-৫ জন মিলা এক রুমে থাকি। একসাথেই পাক করি।’ তিনি জানান, আগে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতেন। কিন্তু হোটেলের কাজ ছেড়ে ফুডপান্ডায় রাইডার হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকে বাড়িতে আর কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি। তিনি যেখানে থাকেন মেস সিস্টেমের মতো করে, সেখানে মাসিক খাবার খরচ জনপ্রতি ৩০০০ টাকা। তিলপাপাড়ায় যে বাসায় থাকেন সেই বাসাভাড়া দিতে হয় জনপ্রতি ২৫০০ টাকা। নিয়মিত মুরগি খেতে পারেন না। তবে সপ্তাহে এক দিন খেতে পারেন মেস সিস্টেমের কারণে। অন্যথায় মুরগি খাওয়া অসম্ভব হতো। অন্য কোনো কাজ না করে যেমন রিকশা না চালিয়ে কেন ফুডপান্ডায় কম টাকায় কাজ করছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এইটাতে আসছি কারণ এইটাতে সুযোগ-সুবিধা ভালো, এনিটাইম, যেকোনো টাইমে বাড়ি যাইতে পারব।’
এখানে কীভাবে থাকেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা এখানে আছি সৌদি আরবের মতো, ৪-৫ জন মিলা এক রুমে থাকি। একসাথেই পাক করি।’ তিনি জানান, আগে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতেন।
‘আগে ওজন ছিল ৬৩ কেজি। আর সেটা এখন ৪৯ কেজির নিচে গিয়া ঠেকছে’
পাঠাওয়ের এই রাইডারের বয়স ২৭ বছর। ২০১৭ সাল থেকে ফুড ডেলিভারি রাইডার হিসেবে কাজ শুরু করেন। শুরুতে সহজে কাজ করেছিলেন। বর্তমানে কাজ করছেন পাঠাও ফুড-এ। প্রায় ৫-৬ বছর হলো কাজ করছেন। এই কাজের ওপরই তার পরিবার নির্ভরশীল। তিনি বিবাহিত। তাদের একটি ছেলে রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩৫ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয়, কখনো কখনো সেটা ৪০ কিলোমিটারেরও বেশি হয়। তিনি জানান, ১২ ঘণ্টা খাটলে এই ১২ ঘণ্টার মধ্যে কতক্ষণ সাইকেল চালাতে হয় সেটা নির্ভর করে অর্ডারের চাপের ওপর। অর্ডারের চাপ থাকলে এক ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৩-৪টা অর্ডার ডেলিভারি করতে হয়। আর যদি অর্ডারের চাপ কম থাকে, তাহলে হয়তো ১টা কি সর্বোচ্চ ২টা এক ঘণ্টায় ডেলিভারি করতে হয়। সব মিলিয়ে দেখা যায় ১২ ঘণ্টার মধ্যে ৭-৮ ঘণ্টাই তার সাইকেলে থাকতে হয়। পুরো সময়টাই যে চালাতে হয় তা নয়, এর ভেতরে সাইকেল রেখে অর্ডার পিকআপ করা ও ডেলিভারি করাও অন্তর্ভুক্ত। বাকি সময়টা স্রেফ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অর্ডারের প্রত্যাশায়।
সাইকেল মেরামতের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতি তিন বা সাড়ে তিন মাসে সাইকেল মেরামতের পেছনে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে সাইকেল মেরামতের পেছনে খরচ হয় অন্তত ১০০০ টাকা। এর পাশাপাশি মাসে এই ফুড ডেলিভারির কাজ করার জন্যই মোবাইল বিল ও ইন্টারনেট ডাটার পেছনে আরও ১০০০ টাকার মতো খরচ হয়। তিনি জানান, তাকে এখন পর্যন্ত সাইকেল চালাতে গিয়ে তেমন কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়নি। তবে রাইডার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তাকে তার সাইকেলটি হারাতে হয় একবার। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি আমার সাইকেলটাতে কাজ করাইয়া (মেরামতের কাজ) মাত্র বাইর হইছি। প্রায় ২৫০০ টাকার কাজ করাইছিলাম। সব মিলায়া ১০ হাজার টাকার মতো লস হইছিল।’ উল্লেখ্য, ফুড ডেলিভারি দিতে গিয়ে সাইকেল চুরি হলে বা কোনো দুর্ঘটনা হলে তার কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাঠাও ফুডস দেয় না। তার ভাষায়: ‘ওখানে (পাঠাও ফুডস কর্তৃপক্ষ) বলাই আছে। আপনাদের জিনিস। আপনার ইয়া (দায়িত্ব) যতটুক পারবেন, হেফাজতে রাখার চেষ্টা করবেন।’
অতীতে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি ছাড়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘গাড়ির চাকরিটাতে একটা বাই ডিফল্ট প্রবলেম মনে করেন, আমার যেকোনো একটা ফ্যামিলি প্রবলেম হইয়া গেছে, আমি মালিককে বললেও আমাকে যাইতে দিত না। বলত যে ডিউটি শেষ না করে যাইতে পারবা না। কিন্তু পাঠাওতে জাস্ট এরিয়া ম্যানেজারকে একটা মেসেজ দিয়া আমি চইলা গেলে কোনো প্রবলেম হয় না। এই কারণেই আমি এইটারে সবচেয়ে বেটার মনে করি। শরীরের ক্ষতি যেটা হইতেছে সেটা হইতেছে, কিন্তু আমি নিজের ট্রিটমেন্টের চেষ্টা করি। যেমন মনে করেন আমার ভালো লাগতেছে না, আমি ৫-৭ দিন কাজ করলাম না।’
তিনি আরও জানান, তার ওজন কমে গেছে অনেক। তিনি বর্তমানে আন্ডার ওয়েট। বলেন, ‘আগে ওজন ছিল ৬৩ কেজি। আর সেটা এখন ৪৯ কেজির নিচে গিয়া ঠেকছে।’ দুপুরে খাওয়ার জন্য আলাদা করে সময় পান না। তিনি একবারে ১২টার আগেই খেয়েদেয়ে বাসা থেকে বের হন। মাঝে ফাঁক দিয়ে হালকা নাশতা করে নেন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন। নিয়মিত মুরগি খেতে পারছেন না একেবারেই। তবে ছেলে যেহেতু ছোট তার জন্য মুরগি কিনতে হয়। সবশেষ গরুর মাংস কিনেছেন রোজা শুরু হওয়ার এক মাস আগে। নিয়মিত প্রোটিনের উৎস তাহলে কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রেগুলার বলতে শাকসবজিই খাই। আর রাতের বেলা যদি খুব বেশি টায়ার্ড লাগে, তাহলে একটা ডিম আর দুধ মারি।’
‘আগে ওজন ছিল ৬৩ কেজি। আর সেটা এখন ৪৯ কেজির নিচে গিয়া ঠেকছে।’ দুপুরে খাওয়ার জন্য আলাদা করে সময় পান না। তিনি একবারে ১২টার আগেই খেয়েদেয়ে বাসা থেকে বের হন। মাঝে ফাঁক দিয়ে হালকা নাশতা করে নেন। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি ছোটবেলা থেকেই হাঁপানীর রোগী। সেই হাঁপানী তাকে ভোগায় নিয়মিতই। মাঝে মাঝে যখন বুকে ব্যথা ওঠে তখন হাতের অর্ডারটা ডেলিভারি দিয়ে তারপর তিনি শিফট ক্যানসেল করে বাসায় চলে যান। রোজা রাখছেন না। না খেয়ে কাজ করতে পারেন না। বুকে ব্যথা তখন আরও বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত পিঠে ব্যথা বা শরীর ভেঙে যাওয়া অনুভব করছেন না। তবে তিনি জানান,
‘বাসায় বাবা বলেন এইটা এখন করতেছ কিন্তু ভবিষ্যতে কিন্তু আর শরীরে কুলাবে না। তখন বুঝবা। ভবিষ্যতে কী করব আমি নিজেও জানি না। তবে পাঠাওতে আর হয়তো এক-দেড় বছর থাকব। একটা অনলাইন বিজনেসের চিন্তা করতেছি, যদি হয়ে যায়, ফান্ড পাই, তাহলে ছেড়ে দিব।’
‘পেইন লাগে খাড়ায়া থাকতে’
এই রাইডারের বয়স ৪৪ বছর। পাঠাও ফুড ডেলিভারিতে কাজ করেন এক বছর ধরে। সারা দিনে মোট ৯-১০ ঘণ্টার শিফট নেন। তিনি কাজ শুরু করেন দুপুর ১২টা থেকে। কখনো কখনো রাত ১২টা পর্যন্ত অর্থাৎ ১২ ঘণ্টাও কাজ করেন। দুপুরে আলাদা করে খাওয়ার সময় পান না। চলতে-ফিরতে হাঁটতে হাঁটতে হালকা কিছু খেয়ে নিতে হয়। তিনি জানান, সারা মাসে তার কাজের জন্য ব্যবহৃত মোবাইল ও ইন্টারনেট বিল বাবদ খরচ হয় ৬০০ টাকার মতো। সাইকেল মেরামতের পেছনে মাসে অন্তত ৪০০ টাকা যায়। প্রতিদিন যে ন্যূনতম ১০ ঘণ্টা কাজ করেন, সেই সময়ের মধ্যে অন্তত ১২টা অর্ডার তাকে ডেলিভারি দিতে হয়। সারা দিনে অন্তত ২৫ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয়। তিনি জানান, অর্ডার ডেলিভারি করার সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় দাঁড়িয়েই থাকতে হয়। কারণ, বসার কোনো জায়গা রাস্তায় সেভাবে পাওয়া যায় না। কী কী শারীরিক ও মানসিক চাপ আছে এই কাজে সেটা জিজ্ঞেস করলে জানান, ‘একেক জনের কাছে তো এটা একেক রকম। আমার কাছে পেইন লাগে খাড়ায়া থাকতে। আবার অনেক সময় ভালো লাগে। সেটা নির্ভর করে অর্ডারের উপরে।’ ফুডপান্ডার মতোই পাঠাও ফুডসেও খাবার ডেলিভারি দেওয়ার ব্যাগটি নিজের টাকায় কিনে নিতে হয়। ব্যাগের দাম ১০০০ টাকা। এ ছাড়াও টি-শার্ট, রেইনকোটও পাঠাও ফুডসের কাছ থেকে রাইডারকে কিনে নিতে হয়। তিনি জানান, তার সাইকেলটা হিরো সাইকেল, গিয়ার ছাড়া। তাই তার মেরামতের খরচ ‘কম’। গিয়ারের সাইকেল হলে মেরামতের খরচ আরও বেশি হতো। এই বয়সে কেন ফুড ডেলিভারির এই কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি একটা অসহায় চাহনি দিয়ে নিরুত্তর থাকেন।
প্রতিদিন যে ন্যূনতম ১০ ঘণ্টা কাজ করেন, সেই সময়ের মধ্যে অন্তত ১২টা অর্ডার তাকে ডেলিভারি দিতে হয়। সারা দিনে অন্তত ২৫ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয়।
‘মাইন্ডটা খিটখিটে হইয়া গেছে’
বয়স প্রায় ৪২ বছর। প্রায় চার বছর ধরে পাঠাও ফুড ডেলিভারির কাজ করছেন। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টার শিফট করেন। ন্যূনতম ১০ ঘণ্টা তো কাজ করেনই। সারা দিনে ১৪টার মতো অর্ডার ডেলিভারি করেন। তবে রোজার মাসে অর্ডার কম থাকে। তিনি অর্ডার রিসিভ করার সময় যেখানে থাকেন সেখান থেকে রেস্টুরেন্টে যাওয়া এবং রেস্টুরেন্ট থেকে কাস্টমারের লোকেশনে খাবার ডেলিভারি করা পর্যন্ত যে দূরত্ব সাইকেলে অতিক্রম করেন, সেটা অর্ডার প্রতি গড়ে তিন কিলোমিটার হয়। জানান, সারা দিনে অন্তত ৩৬ কিলোমিটার সাইকেল তাকে চালাতে হয়। তিনি জানান, রেস্তোরাঁর সঙ্গে তাদের ঝামেলা হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় যে অনেক খাবার আইটেমই কোনো রেস্তোরাঁ আর তৈরি করছে না। অথচ ওয়েবসাইটে বা অ্যাপে সেই আইটেমের ছবি ও নাম দিয়ে রাখে। তারা যে সেই আইটেম আর বানাচ্ছে না, সেই তথ্যটি তারা অনলাইনে আপডেট করে না। ফলে কাস্টমার সেই আইটেম অর্ডার করে বসলে রাইডার হিসেবে তার সমস্যা হয়। মাঝখান থেকে হোটেল পর্যন্ত যে তিনি সাইকেল চালালেন, সেই পরিশ্রমটুকু বৃথা চলে যায়। সেটার জন্য কোনো টাকাই আর পান না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘তখন অর্ডারটা ক্যানসেল করতে হয়। ক্যানসেল করতে গেলে কাস্টমারের দুইটা কথা শুনতে হয়। তারপর দেখা যায় যখন আমরা অর্ডারটা ক্যানসেল করার প্রক্রিয়া শুরু করি সেটা অফিশিয়ালি ক্যানসেল হতে কিছু সময় লাগে। সেই সময়ে দেখা গেল একাধারে কয়েকটা অর্ডার আর আসতে পারল না আমার মোবাইলে। অথচ ওই অর্ডারগুলো কিন্তু আমি ডিজার্ভ করি। কিন্তু পাইতাছি না। এই কারণে একটা আক্ষেপ থাইকা যায়। আবার দেখা যায় কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে। ওরা ডাইনিংয়ের প্রেশার নেয়। ওদের নিজস্ব হটলাইনের প্রেশার নেওয়ার পরে তরপরে মনে করেন যে আমাদের সময় দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা খাবারে তো একটা নির্দিষ্ট টাইম থাকে। এই টাইমের ভিতরে আমার খাবারটা দিতে হবে। দেখা গেছে ওই টাইমের ভিতরেই যদি আমি আরও আগে খাবারটা দিতে পারি তাহলে আমার লাভ না? ওরা (রেস্টুরেন্ট) কী করে, ওদের বেনিফিটটা দেখতেছে, যে, অনলাইনে কমিশন দিতাছি। একটু পরে দিই। মানে যেমনেই হোক, আমারে দাবায়া রাখতেছে। বলে যে যাও তুমি বাইরে গিয়া দাঁড়াও, আমি খাবার রেডি কইরা ডাক দিমু।’
সারা দিনে অন্তত ৩৬ কিলোমিটার সাইকেল তাকে চালাতে হয়। তিনি জানান, রেস্তোরাঁর সঙ্গে তাদের ঝামেলা হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় যে অনেক খাবার আইটেমই কোনো রেস্তোরাঁ আর তৈরি করছে না। অথচ ওয়েবসাইটে বা অ্যাপে সেই আইটেমের ছবি ও নাম দিয়ে রাখে।
রেস্টুরেন্টের এসব আচরণ বিষয়ে পাঠাও কোম্পানিকে কোনো অভিযোগ কি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অসংখ্যবার দেয়া হইছে। কোনো লাভ হয় না। কোম্পানি শুধু বলে, হ্যাঁ দেখতেছি আমরা, দেখতেছি। স্টেপ নিতেছি, আমরা নোট করে রাখছি, কথা বলব। এই পর্যন্তই। কিন্তু আজকে পর্যন্ত কোনো রেস্টুরেন্টের ব্যাপারেই কোনো পদক্ষেপ কোম্পানি নেয় নাই।’ রেস্টুরেন্টের তৈরি করা এসব কারণে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যখন খাবার ডেলিভারি হয় না, তখন কাস্টমার তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। প্রায়ই এমন হয়। তিনি বলেন, ‘কাস্টমার তো নির্দিষ্ট টাইমে খাবার চায়। আপনি ধরেন একটা অর্ডার দিছেন। আপনি আপনার নির্দিষ্ট টাইমে খাবার চাইবেন না? খাবার যদি নির্দিষ্ট টাইমে না পান, কাস্টমার অবশ্যই রুড হইবে। এই ব্যাপারগুলা তখন অনেক টেকনিক্যালি আমরা হ্যান্ডেল করি। কিন্তু সবার মাইন্ড তো একরকম থাকে না। অনেক কাস্টমার তখন রাইগা গিয়া বলে যে খাবার নিব না। তখন অনেক কষ্টে ম্যানেজ কইরা দিয়া আসতে হয়। তো কাস্টমারের এইসব তো আমার শোনার কথা ছিল না।’
কাস্টমারের তরফ থেকে কী কী অসুবিধা সৃষ্টি হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘আবার কাস্টমার যারা তারা কী করে? আমরা খাবারটা তার লোকেশনে তার বিল্ডিংয়ের নিচে নিয়া গেলে পরে বলে, পাঁচতলায় আসেন, সাততলায় আসেন, আটতলায় আসেন। পা তো আমাদের অলরেডি ফুইলা আছে। যদি বলি আমরা অনেক টায়ার্ড আপনি একটু কাউকে পাঠান। একটু আমাদের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করেন। এই এতটুকু বলার জন্যও দেখা গেছে অনেক সময় আমাদের নামে কমপ্লেইন দিয়া দেয়।’
আমরা খাবারটা তার লোকেশনে তার বিল্ডিংয়ের নিচে নিয়া গেলে পরে বলে, পাঁচতলায় আসেন, সাততলায় আসেন, আটতলায় আসেন। পা তো আমাদের অলরেডি ফুইলা আছে।
উল্লেখ্য, অ্যাপের মধ্যে এসব কিছুই লেখা থাকে না যে খাবারটা কত তলায় ডেলিভারি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন,
‘আমরা এসব বিষয়ে পাঠাওকে জানানোর পর ওরা বলছে ডোর টু ডোর। মানে রেস্টুরেন্ট থেইকা খাবার নিবা আবার কাস্টমারের কাছে গিয়া খাবার দিয়া আসবা। এখন ডোর টু ডোর যেটা বলতেছে সেটা তো আমরা যাইতেছিই। রেস্টুরেন্টের কাছ থেইকা খাবার নিছি। কাস্টমারের বিল্ডিংয়ের গেটে গিয়া খাবার দিয়া আসতেছি। এখন যদি বলে ওনার বেডরুমে গিয়া দিয়া আসতে হবে এইটা কি আর ডোর টু ডোর হইল?’
প্রতিদিন ১২-১৪ ঘণ্টা খেটে, ৩৬-৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে কী কী শারীরিক ও মানসিক অসুবিধায় পড়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘মাইন্ডটা খিটখিটে হইয়া গেছে। এখন দেখতেছি যে আমাদের লেভেল রিকশাওয়ালাগো মতন হইয়া গেছে। রিকশাওয়ালারা দেখেন অনেক সময় ভালো কথা কইলেও শুনতেছে না। কাউরে বিশ্বাস করতে পারে না। আমারও সেরকম হইছে। মনে হইতেছে যে সবাই আমারে ঠকাইতেছে। সবাই আমার ওপরে জুলুম করতেছে। এ রকম একটা লেভেলে আইসা পড়ছি।’
সাইকেলের পেছনে মাসে কত খরচ হয় জানতে চাইলে বলেন,
‘সাইকেলের কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। এই তো কিছুদিন আগে ১০০০ টাকা লাগাইছি সাইকেলের পেছনে। সাইকেলে দেখা গেছে, মাসে আমারে ধইরা রাখতে হইব–হাজার, পনেরোশ টাকা খরচ আছে। আর এর ভিতরে তো আবার দেখা গেছে হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘইটা যায়।’
তিনি জানান, গত চার বছরে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায় পড়েন সাইকেল নিয়ে। কিন্তু কোনোটারই কোনো দায়ভার কোম্পানি নেয়নি। তিনি বলেন,
‘বড় দুর্ঘটনা, আসলে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা হইছিল, ব্যথা পাইছিলাম। কিন্তু আসলে ওগুলা কোম্পানি দেখবে না। একদিন অর্ডার ডেলিভারি দিতে যাওয়ার সময় একটা মোটরসাইকেল আইসা আমার ওপরে উইঠা পড়ছিল। অনেক ব্যথা পাইছিলাম। খাবারটাও নষ্ট হইয়া গেছিল। পরে অবশ্য ওই বাইকওয়ালা আমার খাবারের ড্যামারেজটা দিয়া দিছে। সে যদি ওই ড্যামারেজটা না দিত তাইলে ওই ড্যামারেজটাও আমার ওপর দিয়া যাইত।’
পাঠাও ফুড যে তাদের রাইডারদের জন্য বীমার ব্যবস্থা করেছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা বাইকওয়ালাদের জন্য। ফুড ডেলিভারির বাইসাইকেল রাইডারদের জন্য না।’ নিজেদের জন্য বীমার দাবি কেন পাঠাও কোম্পানির কাছে করছেন না–জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা করি নাই। আর এটা আসলে কোনো লাভও হবে না।’
কেন অন্য কোনো কাজ না করে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা খেটে এই কম টাকার কাজ করছেন–জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘রিকশা চালাইলে দিনে হাজারের ওপরে ইনকাম হইত সেইটা ঠিক আছে, কিন্তু সবকিছু তো সবার জন্য না। আবার সামাজিক ব্যাপারও আছে।’ কোনো চায়ের দোকান-জাতীয় কিছু কেন দিচ্ছেন না–জানতে চাইলে বলেন, ‘ওরকম তো ফান্ড নাই, ক্যাপিটাল তো থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন,
‘আগে তো ছোট মোটো কাজ করতাম। অফিস অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করতাম। ওইগুলা আসলে পোষাইত না। চার বছর আগে যখন আমি সেইসব কাজ করতাম তখন মাসে ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা পাইতাম। ওইটাও মনে করেন সকাল ৮টায় কাজে যাইতাম রাইতের ৭টা, ৮টা, ৯টা বাজত। এমনে আনুষঙ্গিক কিছু কনভেন্স থাকত। ওই টুকটাক আরকি এগুলা। সব মিলায়া দেখা যাইত মাসে ১০ হাজার আসত। ওই সময় থেকেই আমি পার্টটাইম হিসেবে পাঠাও ফুড ডেলিভারি করতেছিলাম। প্রতি ডেলিভারিতে ৬০ টাকা পাইতাম। তখন দেখা যাইত আরেকটু ফ্রিলিভাবে ডেলিভারি দেওয়া যাইত। তাই কাজ কইরা মজা পাইতাম। কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে যে অনেক ধারাবাহিকতার বাধ্যবাধকতা আছে কোম্পানির। যেমন, এই যে টাইম স্লট নিয়া কাজ করতে হইতেছে। আগে যেমন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যখন খুশি তখন নামতাম। এখন সেইটা করা সম্ভব না। আগে থেকে শিফট বুকিং দিতে হয়। শিফট বুকিং দিয়ে কাজ না করলে জরিমানা হয়। কয়েক দিনের জন্য কাজ থেকে সাসপেন্ড কইরা রাখা হয়।’
এই টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে কীভাবে চলছেন জানতে চাইলে বলেন,
‘আল্লাহ চালায়া নিতাছে। দুপুরে খাই না। ওই রাস্তার ওপরে কলা-রুটি খাইয়া থাকি। দুপুরে খাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না অর্ডার ডেলিভারি করতে থাকলে। রাতে একবারে বাসায় গিয়া খাইতে হয়। আমার নিয়মিত খাবার হইতেছে ভাত, ডাল, ডিম, আলু।’ শেষ কবে মাংস খেয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বাসায় কিছুদিন আগে মেহমান আসছিল, তখন কিনছিলাম। তবে সেটা অনেক মাস পর কেনা গরুর মাংস। মুরগিটা কেনা হইত আগে। কিন্তু ইদানীং দাম বাড়ার পর থেইকা মুরগি এহন আর খাওয়া হইতেছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অনেকটা টেকনিক্যালি বাজারঘাট করতে হয়।’ ওজন কতটুকু কমে গেছে সেটা জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা তো মাপি নাই, তবে যেই আমারে দেখে তারা তখন বলে যে আমি নাকি অনেক শুকাইয়া গেছি। অন্তত ১০ কেজি ওজন তো কমছেই।’ সারাক্ষণ দুর্বল লাগে কি না–জানতে চাইলে বলেন,
‘কাজের মধ্যে থাকলে দুর্বল লাগার কথা না। কারণ, একটা চাপ থাকলে, ফ্যামিলির ক্রাইসিস থাকলে, শরীর দুর্বল থাকলেও ওইগুলা মাথায় আনা যায় না।’
‘নিজেরে খুব অসহায় লাগে যে শালার কী করতেছি!’
ফুডপান্ডার এই রাইডারের বয়স ১৮ বছর। এক বছর ধরে কাজ করছেন। কেন ফুডপান্ডায় কাজ করছেন–জানতে চাইলে বলেন, ‘এক বছর ধরে কাজ করছি। আমি পড়াশোনা করি তো। গ্রামের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করি। ঢাকায় আসছি ড্রাইভিং শিখতে। ভাইয়ের এখানে। আপাতত কিছু একটা তো করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি টার্গেট নিয়া কাজ করি, মানে ফ্যামিলির একটু সমস্যা তো। ফ্যামিলির একটা দেনা আছে, সেইটা শোধের কাজে হাত লাগাইতে এই কাজ করতেছি।’
কী কী ধরনের মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়–জানতে চাইলে বলেন,
‘দুর্ব্যবহার করে। মানে, কিছু কাস্টমার এমন ব্যবহার করে যে নিজেরে খুব অসহায় লাগে। ধরেন এত কষ্ট কইরা এইখান থেকে (খিলগাঁও তালতলা) রামপুরা টিভি সেন্টারের পেছনে গেছি বা এইখান থেকে বাসাবো কদমতলা বা মুগদা মান্ডায় গেছি। ওইখানে কাস্টমারের লোকেশনে গিয়া ফোন দিলে বলে সাততলায় উঠতে আটতলায় উঠতে। যদি ভালোভাবে বলত যে অসুস্থ বা অন্য কোনো অসুবিধা একটু কষ্ট কইরা আসেন, একটা কথা শুইনাই শান্তি। কিন্তু এমন কাস্টমার আছে যারা মনে করেন খুব ঝাড়ি দিয়া বলে: এই ভাই আসেন! গালিগালাজ করে না, কিন্তু এমনভাবে বলে আরকি, তখন নিজেরে খুব অসহায় লাগে যে শালার কী করতেছি! হের কি চাকর আমরা? এমনভাবে বলতেছে? ফুডপান্ডায় আমরা কোনো কিছু বলতে পারি না। এখন আমরা কী করব? আমাদের তো করতেই হবে।’
তিনি জানান, তার ব্যাচ এখন ১। দুই সপ্তাহ ধরে এক নম্বর ব্যাচে আছেন। এক নম্বর ব্যাচে আসতে কী পরিমাণ কাজ করতে হয়েছে জানতে চাইলে বলেন,
‘কী পরিমাণ মানে ধরেন, কোনো অর্ডার ছাড়া যাবে না। একটা অর্ডার ছাড়লেই আপনার ব্যাচ শেষ (অর্থাৎ, ব্যাচ নেমে যাবে)। একটানা ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করি। একটা অর্ডার এর মধ্যে ছাড়লেই ব্যাচ শেষ। স্পেশাল আওয়ারে কাজ করতে হয়, শিফটের আগে-পরেও কাজ করতে হয়, এই সবকিছুতে যদি ১০০-তে ১০০ থাকে, তাইলেই আরকি ব্যাচ ১ নম্বর দেয়।’
প্রতিদিন ১০-১১ ঘণ্টা খেটে তারপর কীভাবে পড়াশোনা করার সময় পান–জানতে চাইলে বলেন,
‘পড়াশোনা মানে ধরেন, আমি এই যে রোজার মাস কাজ করব, এরপর জুন মাসে আমার পরীক্ষা। টেকনিক্যালে পড়ি তো। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। জুন মাসের পরীক্ষার জন্য এক মাস আগে ঢাকা থেকে চলে যাব গ্রামের বাড়িতে। এক মাস পড়ে পরীক্ষা দিব। আবার পরীক্ষা দিয়া আসব।’
এই কাজ করতে গিয়ে স্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদে পড়েছেন কি না–জানতে চাইলে বলেন, ‘হ্যাঁ, এ রকম তো হয়-ই। কারণ, অনেক খাটুনির কাজ। আমি যখন দুই শিফট কইরা কাজ করি, তখন শরীর ব্যথায় কষ্ট হয়।’ তিনি জানান, পিঠে ব্যথা হওয়াটা তার নিয়মিত। তবে সেটাকে তেমন পাত্তা দেওয়ার সুযোগ তার নেই। ওজন কমেছে। কীভাবে শরীরের ক্ষয় মেটাচ্ছে জানতে চাইলে বলেন,
‘আমি করি কি দুই-তিন সপ্তাহ বা এক মাস কাজ কইরা আবার বাড়ি চইলা যাই। গিয়া খাইয়া-দাইয়া শরীর ঠিক কইরা আসি। সারাক্ষণ টেনশন-অস্থিরতায় থাকতে হয় কি না–জানতে চাইলে বলেন, ‘এখন হইছে কি ফ্যামিলিতে যখন সমস্যা থাকে তখন অনেক কিছুই সহ্য কইরা নিতে হয়।’
আরও বেশি উপার্জনের কোনো কাজ কেন করছেন না–জানতে চাইলে বলেন, ‘অন্য কাজ করতেছি না ক্যান? কারণ হইল যে আমি হইলাম স্টুডেন্ট। আমার পড়াশোনা করতেই হবে।’ রিকশা চালালে তো এর থেকে অনেক বেশি আয় হবে, সে কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন,
‘না, রিকশা আবার আমার ফ্যামিলির একটু ইয়া আছে। আর রিকশা মনে করেন, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটু ইয়া আছে। এখন আমি পড়াশোনা করি। এখন ফুডপান্ডায় কাজ করতেছি। রিকশা চালালেই লোকে বলবে যে দ্যাখ রিকশা চালাইতেছে। আমি কোনো কাজই ছোট কইরা দেখি না। কিন্তু পরিবারের কথা ভাইবা… পরিবারের মানে, আমার বোন জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এখন বিয়া হইয়া গেছে। আমার আব্বু কৃষক। ছোটবেলা থেকেই আরকি এভাবে বড় হইছি।’
ফুডপান্ডার মূল সমস্যা তার কাছে কোনটা–জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানে যতটুকু খাটায়, পেমেন্টটা সেইমতো দেয় না। আমরা তো এখন ব্যাচ ১-এ। কিন্তু যারা ব্যাচ ৫-এ কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এইখান থেইকা (খিলগাঁও তালতলা) মান্ডার শেষ মাথায় পাঠাইয়া টাকা দেয় ২৮/৩০ টাকা। তাইলে বোঝেন? আবার যদি উঠতে বলে ৬/৭তলা তখন নিজেরে খুব অসহায় মনে হয় না?’
‘মূল সমস্যাটা হইল দুর্ব্যবহার’
দেড় বছর ধরে কাজ করছেন ফুডপান্ডায়। বয়স ২১। পড়াশোনা করছেন। ঢাকায় এসে ফুডপান্ডার কাজে জড়িয়ে পড়েন। গড়ে প্রতিদিন দুই শিফটে আট ঘণ্টা কাজ করেন। এখন তার ব্যাচ ২। তিনি জানান, এ বছর অর্ডার পাওয়া কমে গেছে গত বছরের তুলনায়। কী কী মানসিক চাপের মধ্যে থাকছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
‘দুর্ব্যবহার করে মানুষ। মূল সমস্যাটা হইল দুর্ব্যবহার। দুর্ব্যবহারটা করে কাস্টমার। মানে আমারে ধরেন ১ তলার জায়গায় ৫ তলায় উঠায়। মানে আমার লোকেশনটা দেখায় গ্রাউন্ডফ্লোরে। সেখানে উঠায় হইল ৭ তলায়। আমি উঠি ঠিকই। কিন্তু কিছু বললেই কাস্টমার তখন বলে আপনাকে উঠতেই হবে। উঠবেন না কেন? আপনি না উঠলে আমি আপনার নামে কমপ্লেইন দিব। তা ছাড়া যেসব জায়গায় অনলাইনেই পেমেন্ট করে সেখানে আমাদের উপর ইনস্ট্রাকশন থাকে শুধু বাসার গেটের বাইরে রেখে আসার জন্য। মানে নক করে বা বেল বাজিয়েই বাসার গেটের বাইরে খাবারটা রেখে কাস্টমারের আসার অপেক্ষা না করেই চলে আসার ইনস্ট্রাকশন আছে। কিন্তু আমরা নক কইরাই চইলা আসি না। খাবারটা হাতে দিয়া তারপর আসতে হয়। কারণ, যদি কোনো কারণে নক কইরা চইলা আসার পর ওই খাবার কাস্টমার না পায়, যদি সেটা অন্য কেউ নিয়ে যায়, তখন কাস্টমার কমপ্লেইন করলে আমার ওপর ইনস্ট্রাকশন যাই থাক, আমাকে ফুডপান্ডা সাসপেন্ড কইরা দিবে। এই জন্য আমরা বাইরে রাখি না। আমরা কাস্টমারের কাছেই পৌঁছাই। তারপরেও আমাদের কাস্টমারের কথা শুনতে হয়। এই কাস্টমারগুলা বেশিরভাগই ইয়ুথ। ইয়ং পোলাপাইন, বড়লোক বা মধ্যবিত্তের পোলাপাইন। বিশেষ করে আপনাকে আমি বলি যে বেশি সমস্যা হয় রামপুরার মহানগর প্রজেক্টে গেলে। একটু বড়লোক তো উনারা। এরা একটু বেশি ইয়া করে। আমাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অযথাই অনেক সময় বিনা কারণে আমাদের নামে কমপ্লেইন দেয়। তখন ফুডপান্ডা আমাদের ফোন দেয়।’
‘৩০ টাকার জন্য দেড় ঘণ্টা বইসা থাকতে তখন কেমন লাগে?’
বয়স ২০-২১ বছর। পাঁচ মাস ধরে কাজ করছেন ফুডপান্ডায়। রেস্টুরেন্ট কী সমস্যা করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট আছে অর্ডার রিসিভ করার পর খাবার তৈরি করতে এক-দেড় ঘণ্টা সময়ও লাগিয়ে দেয়। ওই সময়টা পুরাই লস। বসে থাকতে হয়।’ অনেক সময় যখন দেখেন যে কোনো রেস্টুরেন্ট অযথা দেরি করছে খাবার দিতে, তখন সেটা ফুডপান্ডায় অভিযোগ করেছেন কি না–জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘ফুডপান্ডার ডিসপ্যাচে কমপ্লেইন দেওয়া যায়। কিন্তু ডিসপ্যাচ মনে করেন পুরাই একটা বাইনচোদ সার্ভিস। ডিসপ্যাচ মানে অনলাইন সার্ভিস। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মানে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেল খাবার নাই। দেরি করতেছে। উনারা, মানে কত রকমের ভঙ্গি-ভাট্টা কইরা বলি যে লেট করতেছে, মানে একটা তো ওরা জাস্টিফাই করবে যে কোনো রেস্টুরেন্ট টাইম টু টাইম খাবার দিচ্ছে কি দিচ্ছে না, ওগুলা যাচাই করে না। ধরেন কোনো রেস্টুরেন্ট খাবার তৈরির টাইম দিয়া রাখছে ১৫ মিনিট পিক আপ টাইম (মানে ১৫ মিনিটের মধ্যে কাস্টমারের অর্ডার করা খাবারটি রেস্টুরেন্ট থেকে পিক আপ করতে পারবেন রাইডার), কিন্তু দেখা গেল সময় লাগাইতেছে ৪০ মিনিট ৫০ মিনিট। ওর জন্য মনে করেন যে আমরা দায়ী না। কিন্তু আমরা যখন (রেস্টুরেন্টের দেরির কারণে) ড্রপ অফ করতে (মানে কাস্টমারকে ডেলিভারি দিতে) লেট কইরা দেই তখন আমাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, জরিমানা মানে সাসপেন্ড কইরা দেয়। এ ছাড়াও একটা রেস্টুরেন্ট যখন দেড় ঘণ্টা বসায়া রাখে একটা রাইডাররে, ৩০ টাকার জন্য দেড় ঘণ্টা বইসা থাকতে তখন কেমন লাগে?’
অ্যাপে দেখানো লোকেশন ম্যাপ ও রুটের পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকে কি না–জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
‘আসলে বাংলাদেশে জিপিএস মনে করেন কোনো কিছু না। অ্যাপ তো এইটা পরের আলাপ। বাংলাদেশে জিপিএসে যেখানে রাস্তা দেখায় অনেক সময় গিয়া দেখা যায় সেখানে কোনো রাস্তা নাই, সাইকেলে যাওয়ার উপযোগী। দেখা গেছে যে জিপিএসে ঠিকই ম্যাপ আঁকা আছে রাস্তার সামনে গিয়া দেখবেন ওইখানে রাস্তা ব্লক কইরা বিল্ডিং। তখন কিচ্ছু করার থাকে না। দেরি হয়। ওইটার জন্য তখন কাস্টমারকে বারবার ফোন কইরা তখন বোঝা লাগে যে কীভাবে যাব, এতে বাড়তি মোবাইল খরচ হয়। এমনও হয় যে লোকেশনে গিয়া ম্যাপের ঝামেলার কারণে কোনো রাইডার এক ঘণ্টা ধইরা ঘোরে। কাস্টমার তখন বিরক্ত হইয়া মোবাইল বন্ধ কইরা দেয়। অথচ ওনার লোকেশনই ভুল দেখায় ম্যাপে। আবার কখনো কখনো এমন হয় যে অ্যাপের ম্যাপে দেখাচ্ছে যে কোনো বাড়ির লোকেশনে বাড়ির পেছন দিয়ে গেলে শর্টকাটে যাওয়া যায়। তো আপনে ওই শর্টকাট ধরে ওই বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখলেন যে বাড়িতে ঢোকার কোনো রাস্তা নাই। তখন আবার মূল রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার ঘুরে এসে আপনাকে বাড়ির সামনের গেটে আসতে হয়। (কারণ, সাইকেল নিয়ে তো আর দেওয়াল টপকানো বা অন্য কিছু করা যায় না)। তখন ঘুরে যাওয়া লাগে। ওইটার জন্য কোনো বাড়তি টাকা ফুডপান্ডা দেবে না। তাদের জানালে কোনো লাভ হয় না। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো সার্ভিস দিবে না।’
তিনি এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনায় পড়েননি। তবে তিনি জানান যে এটা খুবই অহরহ শোনা যায় যে রাইডাররা রাতের বেলা ডেলিভারি দিতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘থাপ্পড়-থুপ্পুড় মাইরা টাকা, সাইকেল রাইখা দেয়। কয়েক দিন আগেও আমার পাশের রুমে থাকে একটা ছেলে রাইডার অ্যাকসিডেন্ট করল। পইড়া গিয়া হাত-পাও ছুইলা গেল। কোম্পানি বলছে যে আপনাদের সবকিছু আপনারা নিজ দায়িত্বে রাখেন, কোনো কিছু হইলে আমরা দায়ী না।’
ফুডপান্ডায় কাজ করতে গিয়ে কী কী শারীরিক অসুবিধা হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন,
‘আমি আপনাকে বলি, সবচেয়ে টায়ার্ডনেসটা হচ্ছে আপনার, রিকশা আর সাইকেলে, দুইটাই সমান। এখানে কোনো পার্থক্য নাই। দুইটার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। দেখা গেছে যে, এখানে প্রতিটা পোলাপান যারা ফুডপান্ডায় অ্যাড হয়, যদি ওর ওজন থাকে ৬০ কেজি, ও ১০ কেজি অটো কইমা যায়। এইটাই স্বাভাবিক। মানে সাইকেল চালাইলে শরীর ঠিক থাকে না। এইটা অনেক পরিশ্রমের কাজ।’ তিনি বলেন, ‘আমার নিজের ওজন প্রায় ১৪ থেকে ১৫ কেজি কইমা গেছে। এখন আন্ডারওয়েট আছি। এটা তো অবশ্যই টায়ার্ড লাগে। টায়ার্ডনেসের কাজই এইটা। সাইকেল একটা মানুষ কতক্ষণ চালাইতে পারে। দিনশেষে দেখা যায় সারা শরীরে ব্যথা।’
তিনি ভাই-বোনের সঙ্গে ঢাকায় থাকছেন। তার ওপর পরিবারের কেউ নির্ভরশীল নয়। তিনি শুধু নিজের খরচ চালান। ফুডপান্ডায় কেন এলেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘এইটা স্বাধীনমতো চালানো যায়।’ কেন আরও বেশি আয় করার সুযোগ আছে যেখানে সেই রিকশা বা সিএনজি বা মোটরসাইকেল চালানোর চেষ্টা করছেন না – জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
‘এখন আপনি কি বলেন আমি ভ্যানগাড়ি চালাইতাম? কাজ তো কোনো বিষয় না। কিন্তু সবাই তো সব করতে চায় না…এইখানে মনে করেন কেউ আবার এডুকেটেড পারসন আছে, কেউ আবার ফ্যামিলির কারণে, যেহেতু ভালো ভালো ফ্যামিলির, স্টান্ডার্ড ফ্যামিলির পোলাপান এইটা করে তাই এইটায় আসা।’
সাইকেল চালাতে কি ভালো লাগে–জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এইখানে ভালো লাগার কিছু নাই। পুরাটাই কষ্ট…কিন্তু তারপরও দেখা গেছে মানুষ এই কাজটা করে। একটা রিকশাওয়ালা দুই কিলো ভাড়া মারে ৬০ টাকা। আর এইখানে দেয় ৩০ টাকা। পার্থক্যটা বোঝেন? কখনো কখনো কাস্টমারে বলে যে আটতলায় আসেন, দশতলায় আসেন কিন্তু লিফট নাই। তখন মনে করেন কেমন লাগে?’ ফুডপান্ডা নিয়ে তার পরিকল্পনা কী–জানতে চাইলে বলেন, তিনি মূলত প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরব ছিলেন। বর্তমানে ফ্রান্সে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। তবে এ মুহূর্তে ময়মনসিংহে একটি কলেজে ডিগ্রিতে পড়ছেন।
‘আমরা হইলাম কুত্তা’
‘ভাই আমাদের তো কেউ শ্রমিকও মনে করে না। আমরা হইলাম কুত্তা। আমাদেরকে সবাই মনে করে কুত্তা। কুত্তার মতো আচরণ করে আমাদের সঙ্গে। কাস্টমাররা মনে করে তারা অর্ডার করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে ডেলিভারির আগ পর্যন্ত কিনে নিছে। যা ইচ্ছা তাই আচরণ করে আমাদের সঙ্গে। আমরা যে একটা মানুষ, আমাদেরও যে একটা শরীর আছে, সেই শরীরে যে কষ্ট হতে পারে, সেটা কারো মাথায় থাকে না। অন্যদিকে ফুডপান্ডার লোকাল অফিসে যদি যাই সেখানে যারা বসে থাকে তারা এমনভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলে যেন আমরা কোনো মানুষের পর্যায়েই পড়ি না।’
কথাগুলো বলেছিল ফুডপান্ডার একজন শিশু রাইডার। খিলগাঁও পল্লীমা সংসদ থেকে তালতলার দিকে যেতে যে খাবারের রেস্তোরাঁগুলো আছে, সেগুলোর একটার সামনে যখন অন্য বড় রাইডারদের সঙ্গে ফুডপান্ডা নিয়ে কথা বলছিলাম তখন সেটা দেখতে পেয়ে নিজে থেকে এসে খুব দ্রুততার সঙ্গে চোখে-মুখে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে উপরের কথাগুলো বলে যায় ওই শিশু শ্রমিক। ওই শিশু রাইডার জানায়, সে প্রায় ছয় মাস ধরে ফুডপান্ডায় কাজ করছে। তার ব্যাচ নম্বরটি তার নিরাপত্তার খাতিরে উল্লেখ করা হলো না। সে জানায়, এই কাজ করতে গিয়ে রাতে আর পড়াশোনা করার কোনো সময় পায় না।
শিশু শ্রমিক তো ফুডপান্ডা নেয় না। তাহলে সে কীভাবে কাজ করছে – জানতে চাইলে সে জানায়, তার জন্ম নিবন্ধন জমা দিয়েই সে কাজ পেয়েছে এবং সেই জন্ম নিবন্ধনের জন্ম তারিখ অনুযায়ী পরিষ্কারভাবেই যে কারো বোঝার কথা যে তার এখনো ১৮ বছর হয়নি। ফুডপান্ডা সবকিছু দেখেই, সে যে এখনো প্রাপ্তবয়স্ক না, সেটা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে অবগত হয়েই তাকে কাজ দিয়েছে। ব্যাগ, টি-শার্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, প্রতিটি জিনিসই কিনতে হয় ফুডপান্ডার কাছ থেকে। সে আরও বলে,
‘আমাদের তো এত টাকা নেই যে তিন-চারটা টি-শার্ট কিনে রাখব। আমরা একটাই কিনেছি। এখন ধরেন আপনে দুই দিন ধরে একটা টি-শার্ট পরলেন। গরমের মধ্যে ঘামলেন। এখন পরদিন আপনি টি-শার্ট ধুয়ে দিলেন, এখন টি-শার্ট না শুকানোর কারণে আপনি টি-শার্ট ছাড়াই বের হলেন। যদি আপনাকে ফুডপান্ডা অফিসের সুপারভাইজাররা রাস্তায় ডেলিভারি করার সময় ফুডপান্ডার টি-শার্ট ছাড়া দেখে, তাহলে তারা গোপনে আপনার ছবি তুলে রাখবে। এরপর সেটা নিয়ে অফিসে জমা দেবে। তখন অফিস থেকে আপনাকে এক দিনের জন্য বা কয়েক দিনের জন্য সাসপেন্ড করে দেবে।’
সে আরও জানায়, একবার শিফট বুকিং দেওয়ার পর হঠাৎ করে তার শরীর খারাপ হয়। এরপর সে হাতের ডেলিভারিটি দিয়ে সোজা মালিবাগে ফুডপান্ডার লোকাল হাবে গিয়ে ফুডপান্ডার কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে যে আজ তার শরীর খারাপ, বিনা জরিমানায় যাতে তার শিফটটা ক্যানসেল করার ব্যবস্থা তারা করে। তখন সেখানকার কর্মকর্তারা তাকে ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে যে, শিফট নেওয়ার সময় খেয়াল ছিল না? এখন করতে হবে। নয়তো জরিমানা হবেই। ওই শিশু রাইডার এ কথা জানিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘এতটুকু মানবিকতা বোধও কি তাদের নাই?’
ফুডপান্ডার অ্যাপে ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে অর্ডার রিসিভ করা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘এই অ্যাপ তো একটা অন্ধ অ্যাপ। এই অ্যাপ আমাদের কোনো কষ্ট দেখে না। সেটা দেখে শুধু জিপিএস। কয় তলা, কীভাবে যাচ্ছি, আমি কোন পরিস্থিতিতে আছি, সেসবের কোনো কিছুই এরা বিচার করে না। এই অ্যাপ আমাদের খালি দৌড় করিয়ে বেড়ায়।’ অর্ডার কেমন পাওয়া যায় জানতে চাইলে ওই শিশু রাইডার বলে,
‘যখন প্রথম কাজ শুরু করি তখন তো প্রথম দুই সপ্তাহে অর্ডারের বন্যায় ভাসায়া দিছিল। এই একটা অর্ডার ডেলিভারি করতে-না-করতেই আবার আরেকটা, তারপর আরেকটা। তখন খুব খুশি লাগছিল। কিন্তু এর পর থেকেই দেখলাম যে অর্ডার কমে যাচ্ছে। অর্ডার পাইতে বসে থাকতে হচ্ছে অনেকক্ষণ।’ সে তার মোবাইল খুলে দেখিয়ে বলে, ‘এই যে ভাই দেখেন। আজ বিকেল চারটা থেকে কাজ শুরু করছি এখন রাত ৮টা বাজে। এখন পর্যন্ত ওয়ালেটে জমা হইছে কত দেখেন – মাত্র ১৩৯ টাকা।’
গ্রামে এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় একটি কলেজে ভর্তি করে দিয়ে গেছে বাবা-মা। বাবা-মা গ্রামে চলে গেছেন। এখন থেকে তাকে নিজের খরচ নিজেই চালাতে হবে। তাই সে ফুডপান্ডায় কাজ করে কলেজের পাশাপাশি। টিউশনি কেন করাচ্ছে না জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, ‘কী করব? ঢাকা শহরে আমার আর কোনো উপায় নাই। আমার রেজাল্ট অত ভালো না যে কেউ আমার কাছে তার সন্তানকে পড়াতে দেবে। কিন্তু আমার নিজের পড়াশোনার খরচ তো আমাকে উঠাতে হবে।’
গ্রামে এসএসসি পাস করার পর ঢাকায় একটি কলেজে ভর্তি করে দিয়ে গেছে বাবা-মা। বাবা-মা গ্রামে চলে গেছেন। এখন থেকে তাকে নিজের খরচ নিজেই চালাতে হবে। তাই সে ফুডপান্ডায় কাজ করে কলেজের পাশাপাশি।
‘ফুডপান্ডা হইল একটা সিস্টেম, আমরা হইলাম দাস’
এই শিশু রাইডারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ফুডপান্ডার আরেক শিশু রাইডার এসে উপস্থিত হয়। আগেরজনের আলাপচারিতা শুনে সে বলে ওঠে, ‘ফুডপান্ডা হইল একটা সিস্টেম। আমাদেরকে সেই সিস্টেমের মধ্যেই চলতে হয়। আমরা হইলাম দাস।’ এই শিশু রাইডারও কলেজে পড়ে। তারও বয়স ১৭ বছর। এই শিশু রাইডার নিজের মোবাইল খুলে আমাদের দেখায় যে তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলের জন্য সে ফুডপান্ডাকে তার জন্মনিবন্ধন সনদ দিলেও তার জন্মতারিখের জায়গায় ফুডপান্ডা লিখে রেখেছে ইনফরমেশন মিসিং! এই শিশু শ্রমিক আরও জিজ্ঞেস করে যে খাবার ক্যানসেল হলে তাকে কেন সেই খাবার হোটেলে ফেরত না দিয়ে ফুডপান্ডার লোকাল অফিসে দিয়ে আসতে হবে? সে আরও জিজ্ঞেস করে যে ওই খাবার তারা কী করে?
‘ভাই, আপনি ফুডপান্ডার লোক না তো?’
এই শ্রমিকের বয়স ৪০ বছর। বিবাহিত। করোনার আগে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতেন। কিন্তু করোনার সময় তার চাকরি চলে যায়। তিনি বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ১৮ হাজার টাকা বেতনে। কোনো টাকা জমছে না ওই চাকরি থেকে। ফুডপান্ডায় কাজ করছেন বাড়তি কিছু টাকা জমানোর আশায়। তিনি জানান, ফুডপান্ডা থেকে তাকে বলা হয়েছে তার স্মার্টফোনটাকে পাল্টাতে। কারণ, সেটা নাকি যথেষ্ট আপডেটেড নয়।
তিনি তার নিজের এক দিনের অভিজ্ঞতা বলেন, তিনি একবার খিলগাঁও থেকে অর্ডার পিক করে সেই খাবার ডেলিভারি দিতে যান মাদারটেক। সেখানে কাস্টমারের লোকেশনে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে কাস্টমার তার খাবার অর্ডারটি ক্যানসেল করেছেন। তিনি তখন ফুডপান্ডার অফিসে কল দিয়ে খাবার ক্যানসেল হওয়ার কথা জানান। ফুডপান্ডা অফিস থেকে তাকে খাবারটি দিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু তাকে বুঝিয়ে বলা হয়নি যে কাস্টমারের লোকেশনে থাকা অবস্থায়ই তাকে খাবার ক্যানসেল হওয়ার বিষয়টি অ্যাপের মাধ্যমে জানাতে হবে। তিনি যখন মাদারটেক থেকে মালিবাগের ফুডপান্ডার লোকাল হাবে গিয়ে খাবার জমা দিতে যান, তখন তাকে আবার বাধ্য করা হয় মাদারটেকে যেতে। যাতে কাস্টমারের লোকেশন থেকে তিনি অ্যাপ ব্যবহার করে অর্ডার ক্যানসেল হওয়ার তথ্য দিতে পারেন। যাতে অ্যাপ বুঝতে পারে যে তিনি ওই পর্যন্ত গিয়েছেন এবং খাবার ডেলিভারি দিতে গিয়েও কাস্টমারের জন্য দিতে পারেননি। তিনি আবারও সাইকেল চালিয়ে মাদারটেকে ওই বাতিল হওয়া অর্ডারের কাস্টমারের লোকেশনে গিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার ক্যানসেল মেসেজ দেন। এরপর আবার তাকে মালিবাগে ফুডপান্ডার অফিসে এসে খাবার জমা দিতে হয়। উল্লেখ্য এই যে দুই দুইবার তিনি বেগার খাটলেন এটার জন্য তিনি কোনো টাকাই পাননি।
কাস্টমারের লোকেশনে থাকা অবস্থায়ই তাকে খাবার ক্যানসেল হওয়ার বিষয়টি অ্যাপের মাধ্যমে জানাতে হবে। তিনি যখন মাদারটেক থেকে মালিবাগের ফুডপান্ডার লোকাল হাবে গিয়ে খাবার জমা দিতে যান, তখন তাকে আবার বাধ্য করা হয় মাদারটেকে যেতে।
তার সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় তার মধ্যে সারাক্ষণ একটা টেনশন তৈরি করেছে ফুডপান্ডার কাজ। তিনি সারাক্ষণই আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি ভুল হলো। এই বুঝি সাসপেন্ড হলেন। তিনি সাক্ষাৎকারের শুরুতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ভাই, আপনি ফুডপান্ডার লোক না তো?’। তিনি আরও জানান যে তার মোবাইলটা পুরোনো হওয়ায় মাঝে মাঝেই অর্ডার রিসিভ করার সময় হ্যাং হয়ে যায়। আবার খুব দ্রুত চার্জ শেষ হয়ে যায়। এসব কিছুর ফলে অর্ডার রিসিভ করতে কিংবা ডেলিভারি দিতে অনেক সময় তার সমস্যা হয়ে যায়।
তিনি তার এক দিনের মর্মান্তিক কাহিনি বলেন। তিনি তার সেশনের শেষ অর্ডারটি নেওয়ার পর, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে অর্ডারকৃত খাবার রিসিভ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন কাস্টমারের বাসাবোর নন্দীপাড়ার লোকেশনে। যেতে যেতে দেখেন তার মোবাইলে প্রায় চার্জ শেষের দিকে। এদিকে কাস্টমার নন্দীপাড়ায় যে লোকেশন দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে দেখেন ম্যাপে দেখানো রাস্তার সঙ্গে বাস্তবের রাস্তার মিল নেই। এদিকে সেই রাস্তা কাটা হওয়ার কারণে পেরেক ঢুকে তার সাইকেলের চাকাও পাংচার হয়ে যায় সেখানে গিয়ে। একপর্যায়ে তার ফোন অফ হয়ে যায়। তখন রাত প্রায় ১০টা। তিনি তখন ওই পাংচার হওয়া সাইকেল এক হাতে ঠেলতে ঠেলতে আশপাশের মানুষকে বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে করতে অবশেষে এক ঘণ্টা দেরি করে অর্ডার ডেলিভারি দেন। এবং এই পুরো ঘটনায় তার কোনো দোষ না থাকলেও এতে অ্যাপের কাছে তার পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে পড়ে। তিনি বলছিলেন, ‘তখন কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছিল। ভীষণ অসহায়ও লাগছিল।’ উল্লেখ্য, এভাবে দুর্ঘটনায় তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিন তিনি অর্ডার ডেলিভারির মেসেজও দিতে পারেননি। পুরো ব্যাপারটাকেই তার বিপক্ষে খারাপ পারফরম্যান্স হিসেবে চিহ্নিত করে অ্যাপ।
কাস্টমার নন্দীপাড়ায় যে লোকেশন দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে দেখেন ম্যাপে দেখানো রাস্তার সঙ্গে বাস্তবের রাস্তার মিল নেই। এদিকে সেই রাস্তা কাটা হওয়ার কারণে পেরেক ঢুকে তার সাইকেলের চাকাও পাংচার হয়ে যায় সেখানে গিয়ে। একপর্যায়ে তার ফোন অফ হয়ে যায়। তখন রাত প্রায় ১০টা।
বাটার একটি ‘ঈদ অফার’
উপরে অনলাইন ফুড ডেলিভারি শ্রমিকদের জবানের যে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো, সেগুলো থেকে এটা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, কোন বাস্তবতায় অনলাইন ফুড ডেলিভারির এসব গিগ বা খ্যাপ মারার কোম্পানি শ্রমিকের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করতে পারছে। এই লেখার কলেবরের কথা চিন্তা করে সেগুলোর আর কোনো সারাংশ ও বিশ্লেষণ তাই এখানে করা হলো না। সেটা করার ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো।
সে যেদিন কাজে যোগ দিল সেদিন পুরো ১১ ঘণ্টার জন্য তাকে বসতে দেয়নি বাটা। সেলসম্যানের কাজের কথা বলে জুতা বিক্রির পাশাপাশি তাকে দিয়ে কাভার্ড ভ্যান থেকে ভারী মাল টানানো, ফ্লোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে অনেক কাজই করায় বাটা।
এই লেখাটি শেষ করতে চাই নিজের পরিচিত বলয়ের এক তরুণের একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির চেহারা নিয়ে যখন অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম, তখন আমার এক কাছের পরিচিত তরুণের কাছ থেকে তার ‘পার্টটাইম’ চাকরিতে যোগদানের অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম। ওই তরুণ তিতুমীর কলেজে পড়ে অনার্সে। সে ভেবেছিল এবারের রোজার ঈদের সময়টায় রমজানে ‘পার্টটাইম’ কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করবে। তরুণটির একটা কাজ জোটে বাটা কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে। কর্মস্থল ঢাকার পান্থপথের ঝকঝকে-চকচকে বসুন্ধরা সিটি শপিং মল। তাকে বলা হয়েছিল যে তাকে কোনো বেতন দেওয়া হবে না ওই অস্থায়ী কাজের জন্য। কিন্তু তাকে লোভ দেখানো হয়েছিল যে, প্রতিদিন সে যত টাকার জুতা বিক্রি করতে পারবে, তার ২ পারসেন্ট কমিশন পাবে। তরুণটি রাজি হয়েছিল। কারণ, তার টাকার দরকার। কাজ দরকার। সে যেদিন কাজে যোগ দিল সেদিন পুরো ১১ ঘণ্টার জন্য তাকে বসতে দেয়নি বাটা। সেলসম্যানের কাজের কথা বলে জুতা বিক্রির পাশাপাশি তাকে দিয়ে কাভার্ড ভ্যান থেকে ভারী মাল টানানো, ফ্লোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে অনেক কাজই করায় বাটা। এরপরও তরুণটি ভাবছিল যে কষ্ট হলেও, ভীষণ পরিশ্রম হলেও কাজটা সে করবে। কিন্তু পরদিন কাজ শেষে তাকে বলা হলো, পরদিন থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় রিপোর্টিং করতে হবে। কাজ শুরু হবে সকাল ১০টা থেকে। কাজ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ তার মোবাইল ফোনটি বাটা শোরুমের কর্তৃপক্ষ নিজেদের কাছে রেখে দেবে। কাজ চলাকালে সে কোনো মোবাইল ব্যবহার করতে পারবে না। কাজ চলাকালীন বসা যাবে না। এবং ঈদের মার্কেট যেহেতু, তাই কাজ চলবে রাত ১২টা পর্যন্ত! এরই মাঝে ফাঁক বের করে খেয়ে নিতে হবে দ্রুত। কিন্তু ১২টায় মার্কেট বন্ধ হলেও তার ছুটি হবে না। ১২টায় ঈদের মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর তাকে ও অন্য পার্টটাইম সেলসম্যানকে দোকান গুছিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে পরিষ্কার করে তারপর বের হতে হবে। সে জন্য তাকে সেখানে থাকতে হবে রাত ২টা পর্যন্ত এবং পরদিন আবার সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে হাজির থাকতে হবে। এভাবেই এক মাস কাজ করতে হবে। এই সমস্ত শর্তই দেওয়া হয়েছে মৌখিকভাবে। কোনো লিখিত রূপে নয়। ওই তরুণ ওই কাজটি পরে আর করেনি। সে এখনো কাজ খুঁজছে। উল্লেখ্য, আমরা সবাই জানি বাটা গিগ অর্থনীতির কোম্পানি নয়। গিগ অর্থনীতি বা অনলাইনের খ্যাপ মারার অর্থনীতি কেন অনলাইনে ফুড ডেলিভারির নামে বাংলাদেশে শ্রমিকের সঙ্গে অমন করার সুযোগটা পাচ্ছে সেটা কি উপরে বর্ণিত বাটার এই অসাধারণ ‘ঈদ অফার’ থেকে পরিষ্কার নয়? (সমাপ্ত)
মাহতাব উদ্দীন আহমেদ: লেখক, গবেষক | ই-মেইল: mahtabjuniv@gmail.com