সিনেমা সত্য। ঢাকার প্রামাণ্যচিত্রের হাসতর*

সিনেমা সত্য। ঢাকার প্রামাণ্যচিত্রের হাসতর*

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

“যা ঘটছে না, সিনেমার উচিত তা দেখানো”

রবি: দ্য ইমেজ বুক কি রাজনৈতিক সিনেমা?

গদার: না…। আরবদের কী করে অন্য কারও সাহায্যের আদৌ দরকার নেইসেটি দেখাতে চেয়েছিলাম আমি; কেননা নিজেদের মতো বাঁচা তাদের নিজেদের পক্ষেই যথেষ্ট সম্ভব। তারা লেখালেখি উদ্ভাবন করেছে; তারা বহু কিছুই উদ্ভাবন করেছে। তাদের তেল আছে; আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি তেল আছে। তাই আমি মনে করি, তাদের বিষয়আশয় তাদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত…। এবছর (২০১৮) এবং পূর্ববর্তী বছরগুলোতে কানে (ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল) আসা বেশির ভাগ সিনেমাই দেখিয়েছে ‘কী ঘটছে। তবে ‘কী ঘটছেনাতা দেখিয়েছে খুব অল্প কয়টি সিনেমা। আশা করি, আমার সিনেমাটি সেই মাত্রা দেখাবে। আমি মনে করি, যে কোনো মানুষের তার নিজের মাথা দিয়েই শুধু নয়, বরং হাত দিয়েও ভাবা উচিত।

জ্যঁলুক গদারের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার । প্রথম আলো। ১৬সেপ্টেম্বর২০২২। ২০১৮সালের ১২মে এটি প্রকাশ পেয়েছিল দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। সেইসাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।

সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য:

নামঃ তিন স্বপ্নচারী। ৫ মিনিট। ২০১৮।

নামঃ বিলীয়মান পেশা। ৭০ মিনিট। ২০২০।

নামঃ একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়। ৭২ মিনিট। ২০২০।

নামঃ একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার? ৪৭ মিনিট। ২০১৯।

নামঃ আমি। ৬০ মিনিট। ২০২০।

প্রস্তাবনা

অনেক ভাব-ভাবনা-প্রযুক্তি-যুক্তির মতন সিনেমার উদ্ভব এবং বিকাশ পশ্চিমে, যদিও উদ্ভব ও প্রাথমিক বিকাশ বিষয়ক ভিন্নমত প্রচলিত রয়েছে। ধীরে ধীরে সিনেমা চায়ের মত ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায়, বিচিত্র সব ভাব ও ভঙ্গি নিয়ে।  চায়ের মতই যে জায়গার যে ভাব, বিন্যাস সিনেমা গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। ফলে অনেক ধরন আর স্বাদের তৈরি হয়েছে নানা জায়গায়। কোথাও দুর্বল নকল হতে হতে সে সীমাবদ্ধ বিচারমূলক মনোভঙ্গির দুর্বলার ফলাফল সিনেমাসমূহ বিপদজনকভাবে এখন বিশাল এক জনগোষ্ঠীর বিনোদনের অংশ, এসব তাদের সপ্ন দেখায়, প্রভাবিত করে, সামাজিক সম্পর্ক, আর্থিক আচরন, যৌনাচার, নারীপুরুষ ভাবমুর্তি ও মূল্যবোধ গঠনে ভূমিকা পালন করে। ফলে সিনেমা দেখা, দেখানো, বানানো, চর্চা কোনভাবেই শুধুমাত্র বিনোদন বা নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ফলাফল হতে পারেনা। সিনেমার জনপ্রিয় বহুল চর্চিত ভূগোলে যেমন নাচগান, মারামারি আর মসলায় ভরপুর ভারতীয় সিনেমা, বিশেষত হিন্দি ও তামিল সিনেমা আছে, সাথে রয়েছে মার্কিন হলিউডের মারদাঙ্গা-পারিবারিক-সামাজিক সব সিনেমা, আরেকদিকে হংকং আর চিনের মার্শাল আর্ট কেন্দ্রিক সিনেমা। সাথে  যোগ করা যায় আরেক শক্তিশালী প্রবণতার সিনেমা, যে সিনেমাদের আবেদন, বাণিজ্য, পরিবেশনা, অনুদান, ধ্যান উৎসব কেন্দ্রিক। এসবের অধিকাংশ সিনেমা কিন্তু ফিকশনাল আর এসবের বাইরে বিভিন্ন শিল্প উৎসবে প্রদর্শিত নানাসব দৃশ্যাবলী যা ভিডিও আর্ট হিসেবে সমাদৃত, তার অনেক অংশকেই সিনেমা ধরা যায়।

এসব নানান সরল সব বিভাজনের বাইরের সিনেমার সংখ্যা আর প্রভাব কম নয়। এসব বাইরের নানান সব সিনেমার একটার ধরন হচ্ছে “পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র”। পরীক্ষামূলক সিনেমা নিয়ে ঢাকায় উল্লেখযোগ্য কোন আলোচনা বা প্রকাশনা নেই, এমন অবস্থায় “পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র” নিয়ে কিছু খুঁজে বের করা যেন খড়ের গাদায় সূচ বের করার মতোই দুরূহ এবং ফল শুণ্য । আর ঢাকায় মূলধারার সিনেমা নিয়েও খুব বেশি এবং মানসম্মত কিছু খুঁজে বের করা মুশকিল, যা আছে তা সংখ্যায় সামান্য, যেন সিনেমা যেনতেন ভাবে বানানো আর দেখা, দেখানো এসব উপরিতলের বিনোদন সম্পর্কিত কাজ ছাড়া সিনেমার বা সিনেমা নিয়ে আর কিছু করার নেই। পাশাপাশি মুখরোচক, মসলাদার যেসব প্রকাশনা ও আলাপ রয়েছে সেসব বাদ দিয়ে তত্ত্ব,ইতিহাস,উপস্থাপন,সময়ের প্রয়োজন,ব্যাখা বিষয়ক যে প্রকাশনা,বয়ান রয়েছে সেসব অধিকাংশ বিদেশি বইয়ের দুর্বল অনুবাদ, মৌলিকতাহীন নকল, অনুকৃত বক্তব্য আবার কোন কোন প্রকাশনা বিদেশি বইয়ের ঋণ স্বীকার না করে নিজেই “লেখক” হয়েছেন।এসব প্রকাশনা খুব সীমাবদ্ধ আর চর্বিত চর্বণ এবংসারা দুনিয়ার খুব মূলধারার অতিমুল্যায়িত কিছু সিনেমা আর নির্মাতাদের নিয়ে গৎবাঁধা কিছু কথার বাইরে নতুন কিছু বলেনা।

এমন বাস্তবতায় প্রামাণ্যচিত্র এবং বিশেষত“পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র” নিয়ে সৃজনশীল, ধারাবাহিক, পর্যায়ক্রমিক প্রকাশনা, স্থানীয় বয়ানের স্বল্পতা, অগভীরতা দুঃখজনক হলেও বাস্তব। এবং উল্লেখিত “তিন স্বপ্নচারী” “বিলীয়মান পেশা” “একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যাক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়” “একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার?” “আমি” সিনেমাগুলো প্রামাণ্যচিত্র বটে কিন্তু আরেকধাপ এগিয়ে এসব সিনেমা প্রচলিত প্রথাগত “প্রামাণ্যচিত্র” ধারণাকে নিয়ে পরীক্ষা করতে চায়। নির্মাণে নতুন বিন্যাস, ভাব, বিষয়। এসব সিনেমা যেমন প্রামাণ্যচিত্র সিনেমার প্রচলিত নির্মাণ কায়দা অনুসরন করেনি তেমনি বিষয়, বক্তব্য, ভাব, নির্মাণ, বিন্যাসে নেই প্রচলিত গতানুগতিক কোন ধারণা। উল্লেখিত সিনেমাগুলো অধিকাংশ সময়জুড়ে দেখাতে চায় কি ঘটছে না, গদার উল্লেখিত সেসব বয়ানসমূহ।  এসব বৈশিষ্ট্যের ফলে এসব সিনেমা যেমন হয়ে উঠেছে ঢাকা (বা বাংলাদেশের সিনেমা) শহরের “পরীক্ষামূলক সিনেমা” আবার বিষয়, ভাব আর বানানোর ঢংয়ের দিক থেকে তারা “প্রামাণ্যচিত্র” আর সব মিলে পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্রও বটে। আর এসবের ফলশ্রুতি, উল্লেখিত সিনেমাসমুহকে আমরা শংকর সিনেমা বা পরীক্ষামূলক কাহিনীচিত্র হিসেবেও উপস্থাপন করতে পারি।

“তিন স্বপ্নচারী” “বিলীয়মান পেশা” “একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যাক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়” “একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার?” “আমি” সিনেমাগুলো প্রামাণ্যচিত্র বটে কিন্তু আরেকধাপ এগিয়ে এসব সিনেমা প্রচলিত প্রথাগত “প্রামাণ্যচিত্র” ধারণাকে নিয়ে পরীক্ষা করতে চায়।

 পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র

পরীক্ষামূলক সিনেমার উদ্ভব বিকাশ শুরু থেকেই এবং নানান পরীক্ষামূলক ধাপ পেরিয়ে সিনেমা ধীরে ধীরে বর্তমান রুপে উপস্থিত হয়েছে, জনপ্রিয় হয়েছে। এবং প্রামাণ্যচিত্র আর পরীক্ষা শুরু থেকেই একে অপরের সাথে খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। খুব সফলভাবে সিনেমার গোড়ার দিকেই ওয়াল্টার রুটম্যান তৈরি করেছেন “বার্লিন: একটি মেট্রোপলিসের সিম্ফনি” (১৯২৭) নামের সিনেমা বা আরেক উদাহরন জিগা ভের্তভের “একজন মানুষ সাথে মুভি ক্যামেরা” (১৯২৯), এসব সিনেমা একইসাথে প্রামাণ্যচিত্র এবং পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র ।

এক সময়ে পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার যে নীরব শত্রুতা ছিল, ধীরে হলেও এরূপ সীমাবদ্ধ ধারণার বদল হয়েছে। ঢাকায় বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শহরে পরিশ্রমী, মেধাবী সব শিল্পীগণ দুর্দান্ত সব এরূপ সিনেমা নির্মাণ করছেন।

এখানে সফলভাবে সিনেমার নির্মাণ ও বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সফল হয়েছে। দেখানো হয়েছে মানুষের সাধারণ জীবনের চিত্রায়ন, কোনপ্রকার বাড়তি বানানো গল্পের প্লট বা অভিনেতা, অভিনেত্রী এখানে নেই। এখানে ফিকশনাল সিনেমার মত আবেগ, উত্তেজনা রয়েছে তবে তা “সত্য”ই ঘটছিল, নির্মাতা ভেবে ভেবে তৈরি করেননি কিন্তু সম্পাদনা, শব্দ, ক্যামেরা ব্যবহারের ধরণ, নির্মাণ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফলে তৈরি করেছেন এমন এক জগৎ যা সত্যি হয়েও আবার ঠিক সাধারণ সত্যর মত নয় বরং আরো গভীর ভাবের, ব্যাখ্যার প্রকাশ করে নানান সব পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যেন সে সাধারণ বাস্তবের সত্যকে বদলে ভালো সত্য তৈরি করতে চায়, প্রশ্ন করতে চায়। তাহলে প্রামাণ্যচিত্র আর পরীক্ষা শুরু থেকেই একে অন্যের সাথে জড়িয়ে আছে, নতুন কিছু নয় পরীক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র। শুধু নতুন করে একে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে, যথাযথভাবে সকল ভাব আর বিষয়কে জায়গা করে দেয়া হচ্ছে, গতানুগতিক সিনেমা পাঠের বৃত্ত থেকে বের হয়ে। এক সময়ে পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার যে নীরব শত্রুতা ছিল, ধীরে হলেও এরূপ সীমাবদ্ধ ধারণার বদল হয়েছে। ঢাকায় বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শহরে পরিশ্রমী, মেধাবী সব শিল্পীগণ দুর্দান্ত সব এরূপ সিনেমা নির্মাণ করছেন। আবিদ হোসেন খান এ ধারাবাহিকতার একজন সমসাময়িক সংযোজন।

আবিদ হোসেন খানের সিনেমার বিষয় আশয়

১। সাধারণ বিষয় ও ভাব

তিন স্বপ্নচারী। ৫ মিনিট। ২০১৮ | বিলীয়মান পেশা। ৭০ মিনিট। ২০২০।

আবিদ হোসেন খানের গোড়ার দিকের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা গুলো হচ্ছে “মেকানিজম” (১৫ মিনিট) নামলিপিতে সাল উল্লেখ নেই), “সিসিফাস”(১৩ মিনিট প্রায়) নামলিপিতে সাল উল্লেখ নেই), “স্টেপস”(৭মিনিট প্রায়) নামলিপিতে সাল উল্লেখ নেই। এসব সিনেমায় শহরায়ন, পরিবেশ দূষণ এবং প্রান্তিক বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের যাপন দেখানোয়, ধারন করায় নিজস্ব একটা দেখার ভঙ্গির খোঁজ পাওয়া যায় (নিচে উল্লেখিত ইউটিউব লিঙ্কে সিনেমাগুলো দেখতে পারেন)।

এর পরবর্তী পর্যায়ের কাজগুলো হচ্ছে “তিন স্বপ্নচারী” “বিলীয়মান পেশা” “একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যাক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়” “একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার?” এবং “আমি” এসব সিনেমায় যেসব বিষয়ের উপস্থাপন করা হয়েছে সেসব পর্যায়ক্রমিকভাবে আলোচনা করা হলো।

“তিন স্বপ্নচারী” সিনেমায় ঢাকা শহরের একটা পদচারী সেতু থেকে ক্যামেরার দৃষ্টি দিয়ে কোন একজন শহর-যাপন-সময় দেখছে, চারিদিকে শহরের সন্ধ্যাকালীন তুমুল ব্যস্ততা শহরের শব্দের ঝড় চারিদিকে আছড়ে পড়ছে, ধীরে ক্যামেরা বৃত্তাকারে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে ক্যামেরা একসময় পদচারী সেতুর লাগোয়া এক দোকানের উপরের কার্নিশমত এক জায়গায় থামে, শব্দ থেমে যায়, সেখানে আরো দুজন ঘুমাচ্ছেন, তাদের বসনে বোঝা যায় ঘুমানোর কোন নিয়মিত ধারাবাহিক জায়গা তাদের নেই, আর “বাড়ি” ধারনা বোধকরি তাদের গুলিয়ে গেছে, কোনক্রমে ঘুমিয়ে নিতে পারলেই আপাতত শান্তি!

তারা দুজন কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? কি স্বপ্ন দেখছে? তাদের দুজনের স্বপ্নও কি যার স্বপ্ন আমরা ক্যামেরায় দেখছি, সেরূপ ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষণ, আয় বৈষম্যে, বিচারহীনতা আর জবাবদিহির অভাবে জর্জরিত? তাদের স্বপ্ন কি আমাদের বাস্তবতার মতোই দুঃস্বপ্নের মতন? তাদের স্বপ্নের পৃথিবীতে কি আমাদের বাস্তব স্বপ্নের পৃথিবীর মতন, ভালোবাসা, সবুজ, নদী মরে যায়? ক্যামেরা ঘুরতে থাকে আমরা দেখতে থাকি দুঃস্বপ্নময় স্বপ্নভূমি! অন্তহীন এক দুঃস্বপ্নের ভূমিতে বিচরণ করতে করতে সম্প্রসারিত হয় আমাদের সিনেমার জমিন! এরপর উল্লেখ করা যায় “বিলীয়মান পেশা” নামক সিনেমার কথা যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রায় বিলীয়মান কিছু পেশা ও পেশাজীবী মানুষের অবস্থা দেখানো হয়েছে, ছোট ছোট খণ্ড করে, আমরা পাটিবুনন দেখি, বুননশিল্পীদের দেখি, এরকম করে, জামদানী শিল্প, মৃৎ শিল্প ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে থাকি একটা বেড়াতে বের হয়ে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীতে!

তাদের দুজনের স্বপ্নও কি যার স্বপ্ন আমরা ক্যামেরায় দেখছি, সেরূপ ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষণ, আয় বৈষম্যে, বিচারহীনতা আর জবাবদিহির অভাবে জর্জরিত?

২।

একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যাক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়। ৭২ মিনিট। ২০২০।

“লেখক অনেক ভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেন।”

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ। তাঁর পূর্ব পুরুষের জন্ম বাংলাদেশের পদ্মাপারে। আর এখন তিনি থাকেন নিউইয়র্কে। প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে সাহিত্যের পাশাপাশি এই লেখক বলেছেন সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম। প্রকাশ: ১৩জানুয়ারি ২০২৩।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম: আপনার লেখায় সবসময় বলার চেষ্টা থাকে, আমাদের পরিচিত এই আধুনিকতাকে যে ‘অগ্রগতিহিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, তা মূলত অগ্রগতি নয়। এই তথাকথিত অগ্রগতি আসলে নৃশংসতার উপাখ্যান। সহজে যদি ব্যাখ্যা করতেন।

অমিতাভ ঘোষ: যে সময়কে ‘আধুনিক সময়বলে আমাদের শেখানো হয়েছে, সেটাকেই ‘উন্নতিবলে পরিচিত করানো হয়েছে। কিন্তু দেখুন,  ঔপনিবেশিক আগ্রাসন মূলত পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। মানুষের ক্ষতি করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপের বাসিন্দাদের মেরে, দাস বানিয়েছিলেন ডাচ ব্যবসায়ীরা, যার মূলে ছিল একটি ফলের বাণিজ্য। এভাবে ওখানে আধিপত্য বিস্তার করা হয়। ভারতবর্ষে আফিমের চাষ আর চীনে জবরদস্তিমূলকভাবে ঢোকানো হয় আফিমের চালানদুটোইতো আসলে নৃশংসতার গল্প।

ঘটনাগুলো যে শুধু ওই সময়েই ঘটেছে, তা নয়। জীবাশ্ম জ্বালানি ও উদ্ভিদ কেন্দ্রিক রাজনীতি সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। আমাদের শেখানো হয়েছে শিল্পায়ন বা ব্যবসার মতো কেবল সম্পদ আহরণ কেন্দ্রিক ধারণাই হলো ‘অগ্রগত’। এখানে আসলে কোনো আত্মিক সংযোগ নেই। পৃথিবীর সঙ্গে মানুষ নানাভাবে নিজের আত্মিক সম্পর্ক হারিয়ে ফেলছে। ফলে তার নিজের যা কিছু অর্জন, তা থেকে সে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এটা যেমন ব্যক্তিগতভাবে হারানো, তেমনি প্রকৃতির জন্যও ঝুঁকির কারণ। ফলে সে যা করতে পারত বা পৃথিবীকে দিতে পারত, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না, বরং প্রাকৃতিক ক্ষতি বাড়ছে। আর এটাতো বহুবার বলা কথা যে প্রকৃতি নিজের পাওয়া আঘাতের কথা সবই মনে রাখে।

-অমিতাভ ঘোষ।

আবিদের “একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যাক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়” (৭২ মিনিট, ২০১৯) নামের সিনেমা, নামের মতোই ব্যক্তিগত ধরনের একটা বয়ান তৈরির চেষ্টা। যেখানে “উন্নতি” “আধুনিকতা” “পরিবেশ” “শরনার্থী” “জনপ্রিয় মতাদর্শ” “ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি” ইত্যাদির উপস্থাপনা রয়েছে তার নিজের মত করে যা একধরনের সম্পর্ক তৈরি করে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের সাথে। এই সিনেমায় একজন শ্বেতাঙ্গ জার্মান ও তার বেড়ানো, আশা-দুরাশা-সম্পর্ক-ভাব ইত্যাদি প্রকাশ করার চেষ্টা করে মেইলের মাধ্যমে।  এখানেও পর্যটকসুলভ বেড়ানো রয়েছে, আরো গভীরে রয়েছে আধুনিক মানুষের জীবন, তার দেখা এবং সে কি, কিভাবে, কখন উপস্থাপন করতে চায়। তার নিজের জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন এখানে নেই কিন্তু চারপাশের নোংরা, আবর্জনা, দূষণ, রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির ভ্রমণ(!?) ইত্যাদি নিয়ে তার মর্মপীড়া রয়েছে। সে মর্মপীড়া সে তার বন্ধু আবিদকে জানায়, জানায় বাংলাদেশের গ্রামে বেড়াতে, ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে তার ভালো লেগেছে, ইতাদি ইত্যাদি। পাখির চোখে দেখা এক চিলতে জীবন।

৩।

একজন  শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার? একক শট। ৪৭ মিনিট। ২০১৯।

একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার? সিনেমাটি টানা ৪৭ মিনিটের একক শটের একটি সিনেমা যেখানে ২০১৭ সালের মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গণহত্যার শিকার হয়ে জান নিয়ে পালিয়ে আসা কক্সবাজারের এক রোহিঙ্গা তরুণ ফয়েজের একদিনের কিছু অংশ দেখানো হয়। সে বাজারের কাজ সেরে শরনার্থী ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে নিজেদের ঝুপড়িতে যায়, গোসল সারে এবং ফিল্মমেকারের সাথের গাড়িতে করে কবরস্থানে যেয়ে কবর জিয়ারত করতে করতে কাঁদতে থাকে, সিনেমা শেষ হয়। আর তার সাথে মাথার ভিতর ভাবনা শুরু হয়, কেন একদল মানুষ শরনার্থী? কিভাবে? কতদিন এভাবে চলবে? তারা কি কখনো আবার নিজভুমি মিয়ানমারের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবে? নাকি ফিলিস্থানিদের মতো আজীবন শরনার্থী হিসেবে থেকে যেতে হবে? ইজরায়েল এবং মিয়ানমারকৃত গণহত্যার কোন বিচার হবেনা? গালভরা ক্যাম্প নামের অস্বাস্থ্যকর, অমানবিক জীবন যাপন করে যাবে তারা দিনের পর রাত? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক পর্যটন কেন্দ্রের কোল ঘেষে, সবার চোখের সামনে? বাকি আমরা ব্যস্ত থাকবো, সমুদ্র বিহার এবং ইয়াবার ব্যবসায়! আর সাদা মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন নামের সংগঠনে মোটা বেতনের চাকরিতে ক্লান্ত হয়ে নর্থ এন্ডের কফিতে চুমুক দিতে দিতে মানবতার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে থাকবে আজীবন?  

৪।

আমি। একক শট। ৬০মিনিট। ২০২০।

আমি ৬০ মিনিটের আরেকটা একক শটের সিনেমা, যেখানে বাঙ্গালী এক শিক্ষক যুবতীর একদিনের কিছু অংশ দেখানো হয়। যেখানে যুবতী তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে রিকশায় ওঠে, হাঁটে, রাস্তার পাশের চায়ের টংয়ে বসে চা খায়, বাড়িতে ফোনে কথা বলে, সিএনজি অটোরিকশায় ওঠে, এক গলিতে ঢুকে সিগারেট জ্বালায়, ধোঁয়া ছাড়ে, তাড়াতাড়ি করে সিগারেট ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ওভারব্রিজ পার হয়ে বাসে ওঠে। সে নিজের মত করে বাঁচতে চায়, এখানে নিজের মত করে বলতে, পুঁজিবাদী যাপনের নির্ধারিত ক্রয়-বিক্রয় নির্ভর স্বাধীনতায় নিজের ক্রয় এবং বিক্রয়ের পুঁজিনির্ধারিত স্বাধীনতা চায়, সে একা একা ফ্রী সময়ে একটা বিয়ার খেতে চায়, রাস্তায় সিগারেট খেতে চায়, সে কি পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজের নির্মিত “পুরুষ” হয়ে উঠতে চায় নির্মিত “নারী” না থেকে? কোন প্রকার পুরুষের পরিচয় ও অধীন না হয়ে সে তার নিজের পরিচয়ে জীবন যাপন করতে চায়। তার ব্যক্তিগত এ বদলের ফলে সমাজ কি ধাক্কা খায়? আর সামান্য হলেও কি সামাজিক “নারী-পুরুষ” এর নির্মিত সংজ্ঞা অদলবদল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়? সামান্য হলেও কি আমাদের কট্টর “নারী” এবং “পুরুষ” ভাবনায় বদলের ইশারা জানায়?

নির্মাণরীতি

‘আমার বইয়ে বর্ণিত ঘটনা গুলো প্রত্যেকেরইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের

২০২২সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফরাসি সাহিত্যিক আনি এরনো। আত্মস্মৃতিকে উপজীব্য করে লেখালেখি করেন তিনি। তাঁকে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে সুইডিশ একাডেমির ভাষ্য, সাহস ও তীক্ষ্ণতার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা ও সম্মিলিত অবদমন উন্মোচন করায় ৮২ বছর বয়সী আনি এরনোকে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারটি। ২০১৯সালে ‘দ্যগার্ডিয়ানপত্রিকায় তাঁর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এখানে নিজের ‘দ্য ইয়ার্সবইটি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মাহীন হক। প্রকাশ: প্রথম আলো, ০৬অক্টোবর ২০২২।

প্রস্নঃ আপনি এই বইটিতে (‘দ্য ইয়ার্স) ‘একজনও ‘আমরাআর কখনো কখনো ‘সেকিংবা ‘তারাসর্বনামও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ‘আমিব্যবহার করেননি। বইটা একটা নৈর্ব্যক্তিক আত্মজীবনী হলেও ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক…

উত্তরঃ আমি যখন আমার জীবনের কথা ভাবি, তখন আমি আমার শৈশব থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত গল্পটা দেখতেপাই। কিন্তু এই গল্পকে আমি আমার যাপিত দুনিয়া থেকে আলাদা করতে পারি না। আমার গল্প আমার গোটা প্রজন্মের সঙ্গে ঘটা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মিশ্রিত। আত্মজীবনী লেখার যে চিরাচরিত ঐতিহ্য, তাতে আমরা নিজেদের কথাই বেশি বলি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পড়ে থাকে। আমি এই ব্যাপারটাকে বদলে দিয়েছি। এই গল্পটা হলো একজন ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে গত ৬০ বছরে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আর চড়াইউতরাইয়ের এক বিবরণ, যা নিজেকে ‘আমরাও ‘তাদেরমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। আমার বইয়ে বর্ণিত ঘটনা গুলো প্রত্যেকেরইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের।

আবিদ হোসেন খানের সিনেমাসমূহ আমাদের প্রচলিত জনপ্রিয় সিনেমা এবং দৃশ্যসমূহের বিপরীত ভাবনা হাজির করতে থাকে নির্মানের অপেশাদার ও অজনপ্রিয় ভঙ্গির ধারাবাহিক ব্যবহারের মাধ্যমে। এসব সিনেমা দেখতে দেখতে ভুলে যাওয়ার সুযোগ আছে যে আপনি সিনেমা দেখছেন! মনে হবে আশেপাশের চলমান বাস্তবতা যা প্রতিদিন চোখে পড়েও আবার পড়েনা। এসব সিনেমায় বানানো ফেনিয়ে তোলা জমজমাট গল্প নেই, চোখ ধাঁধাঁনো লোকেশন নেই, বড় বড় নাম-ধাম বা উৎসবের লোগোর সমাহার নেই; পক্ষান্তরে রয়েছে খুব কম খরচে সহজ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ মতামতের সমাহার। যেখানে চারপাশের সাধারণ ব্যাপার যা অতিনিত্য আর আলাপের জন্য জরুরী কিন্তু কখনোই বাকিসব ফেনিয়ে তোলা, বানানো “প্রয়োজনীয়” “জরুরী” সব বিষয়ের ভিড়ে আমাদের ভাবনার ভূগোলে জায়গা করে নিতে পারেনা কারণ এসবে অনুদান বা উৎসবের ঝলমলে লালগালিচার হাতছানি নেই।

এরকম নিচুমাপের গণসংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবিদ নিজস্ব ভাব ও ভাবনার বিনিময় করতে চায়, সিনেমায় নিজস্ব ভাষা খোঁজা ও চর্চার ভিতর দিয়ে। আবিদের নির্মিত সিনেমায়, মানুষেরা নিজেরা নিজেদের নিয়ে বানানো গল্পে নিজেরাই অভিনয় করে। এখানে কোনপ্রকার অভিনেতা/নেত্রী নেই। এখানে “পরিচালক” ভূমিকা কাট এবং অ্যাকশনের অনেক বেশি, যেহেতু এসব সিনেমার ফলাফল পুঁজিকেন্দ্রিক হিসেবে “শুণ্য” কারন আর্থিক সমাগমের সম্ভাবনা এসব সিনেমায় খুব কম বা নেই বললেই চলে, ফলাফল হতে পারে সমমনা বাকি মানুষদের সাথে নিজের ভাব বিনিময় এবং অন্যান্য এমনতর সিনেমা নির্মাতাদের নির্মাণে উৎসাহ যোগানো যেন প্রাক-পুঁজিবাদী/পুঁজির বাইরের দর্শন চর্চা।

এসব সিনেমায় “আমি” অধিকাংশ সময়ে “আমাদের” ভাব প্রকাশ করে আর ধীরে ধীরে ব্যক্তির খুব “ব্যক্তিগত পরিসর” “সামাজিক পরিসর” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে এসব সাধারণ বাস্তবতা খুব সহজেই আমাদের দৃশ্যমাধ্যম অশিক্ষিত জনপ্রিয় উৎসব আর বাণিজ্যিকভাবে সফল করে তোলা কৃত্রিম সিনেমা ভাষার বাইরের বিশাল ভাষা আর জগতের অনুসন্ধান করে- “বিষয়” “নির্মানরীতি” নিজের ভূমিকা ও শিল্পের ভূমিকার অনুসন্ধানের মাধ্যমে। আবিদের সিনেমার ভাষা সরল কিন্তু চৌকস ফলে আমাদের যাপন খুব সহজেই ধরা দেয় তার সিনেমায়, আমরা যেমন পশ্চিমা ধরনের ব্যক্তি হতে হতে হইনা বা হতে পারিনা বা চাইনা তেমন আবিদের সিনেমা পশ্চিমা ধারার সিনেমার অপ্রভংশ হতে হতে না হয়ে একরকম “নিজস্ব” একটা প্রকাশ ভঙ্গির খোঁজ করে। সাধারণভাবেই এরকম ধরনের অন্যান্য এশীয় নির্মাতাদের সিনেমার নির্মাণ ঢংয়ের সাথে বা বিষয়ের সাথে বা বিষয়কে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এসব কাজের সমরূপতা ইতিবাচকভাবেই লক্ষণীয়, যেমন উল্লেখ করা যায় এরূপ ধরনের কাজের আরেক থাই মাস্টার নির্মাতা ভিরাসাথকুল আপিচাটপংয়ের সিনেমার ধরন, বিশেষত “দুপুরে রহস্যময় বস্তু” (২০০০) বা “হোটেল মেকং” (২০১২) ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিপরীতে লক্ষণীয় আবিদ হোসেন খানের সিনেমার বানানো ধারা বিবরণী বা সংলাপ যা প্রক্ষেপিত দৃশ্যসমূহের মত চৌকস এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়ে দুর্বল, একরৈখিক এবং মাঝে মাঝে সংকীর্নভাবে দৃশ্যসমূহ এবং সম্পাদনায় তৈরি মেধাবী মন্তাজকে হেয় করে দেয়! যা একধরনের উপরিতলের ভাসমান ছদ্ম দার্শনিক আলাপের জনপ্রিয় ধারার ইঙ্গিত প্রদান করে!

এমনতর ভাসমান জনপ্রিয় ছদ্ম-দার্শনিকতা এমন নির্মাণে কাম্য নয়। ছবির রঙ, শব্দ, সম্পাদনা, চিত্রগ্রহণ সব আবিদ হোসেন খান একা একাই করে যদিও প্রযুক্তিগত সুবিধার জন্য যে প্রযুক্তিগত ব্যক্তির সহযোগিতা গ্রহন করেন, সম্পাদক হিসেবে তার নাম লেখা আছে সিনেমার শিরোনাম পাতাতে বা এরূপ আরো একাধিক ক্ষেত্রে। এরূপ চর্চা শুধুমাত্র আবিদ করে থাকে এমন নয়! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জেনেছি ঢাকা শহরের অনেক নির্মাতাই এরূপ চর্চা করে থাকেন, এরূপ চর্চা সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে ক্ষতিকর, তারপরেও চলছে! দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে যারা খানিক প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ তাদের দার্শনিক পরিসর, গভীরতা ভয়ানক পর্যায়ের কম, অন্যদিকে যারা খানিক দর্শনগত পরিসর ও গভীরতা ধারণ করেন তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ক্ষতিকর পর্যায়ের কম, ফলশ্রুতি অনেক দুর্দান্ত সব ভাবনা শেষ হয় একটা সাধারন নির্মাণের ভিতর দিয়ে।

আবিদ হোসেন খানের সিনেমার ধরন বা নির্মাণরীতি এবং পরিবেশনা সাধারণ জনপ্রিয় সিনেমার ধরনের না, ফলে শ্রমবিভাজন এবং কর্মধরন স্বভাবতই ভিন্ন, ফলে জনপ্রিয় সিনেমার শ্রমবিভাজন, শিরোনাম পাতার ধরন ব্যবহার না করে নতুন ভাবনা ও চর্চার বিকাশ জরুরী। এসব সিনেমাকে জনপ্রিয় সিনেমার শ্রমবিভাজনের কাপড়/নাম পরানো/দেয়া সবদিক থেকেই ক্ষতিকর এবং মারাত্মক। এভাবেই ভুল ইতিহাসের চর্চার ধরন তৈরি হয় এবং ভুল ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।  

একক মানুষের দল

“বাংলা গানের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস নয়।”

বাংলাগানের ইতিহাস নামে নতুন বই লিখেছেন গোলাম মুরশিদ। নতুন করে কেন বাংলা গানের ইতিহাস লিখতে উৎসাহী হলেন এই সমাজনিষ্ঠ গবেষক? কেনইবা তিনি বলছেন, আদতে বাংলা গানের ইতিহাস হয়নি? প্রশ্নোত্তরে নিজের জীবনের বর্ণিল স্মৃতি সমেত সেসব তিনি জানিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজকে। প্রকাশ: প্রথম আলো, ০৪ফেব্রুয়ারি ২০২২।

গোলাম মুরশিদঃ বাংলা গানের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস নয়, খাঁটি ইতিহাস চাই। (আরও একটা কারণ) আদতে বাংলা গানের ইতিহাস হয়নি। হয়েছে বাংলা গানে রাগরাগিণীর ইতিহাস। ধরা যাক, আপনি একটা গান লিখেছেন। তাতে ইমন-কল্যাণ সুর দিচ্ছেন। কিন্তু সুরটা হয়ে গেল ইমন-ভূপালি। অথবা কোনো রাগিণীরই সুর হলো না। কিন্তু আপনার বন্ধুরা শুনে বললেন, চমৎকার লাগছে সুরটা। এই সুরটি হলো খাঁটি বাংলাগানের সুর। চর্বিত চর্বণ করিনি, আমি লিখতে চেষ্টা করেছি এই বাংলা গানের ইতিহাস, আমার মতো করে। গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইয়ের নাম লেখা আছে, সেগুলোর সঙ্গে আমার মতের মিল হবেনা। সরি!

___________________

গোলাম মুরশিদঃ বহুবছর ধরে ভাবছিলাম, গানের ইতিহাস লেখার পর লিখব বঙ্গীয় স্থাপত্যের ইতিহাস। এই স্থাপত্যের বয়স হাজার বছরের বেশি। বঙ্গের ভেজা আবহাওয়ায় বেশিরভাগ স্থাপত্যই বিলীন হয়ে গেছে। ইতিহাসকারেরা এই স্থাপত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন, একটা মসজিদ কতটা লম্বা, কতটা চওড়া, দেয়ালগুলো কতটা পুরু, কী দিয়ে তৈরি, দরজা-জানালার বিবরণ, খিলানগুলো কীরকম, কটা গম্বুজ আছে, মসজিদটাকে ভেতরেবাইরে কী দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে ইত্যাদি। বাঙালিরা বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ। সেখানে কোনো ঘাটতি পাবেননা। ঘাটতি আছে বিশ্লেষণে। যেমন, যুগে যুগে এই স্থাপত্যের স্টাইলে যে বিবর্তন হয়েছে, তার ইতিহাস কেউ লেখেননি। আমি সেই ইতিহাস লিখতে চাই।

চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীরের সাক্ষাৎকার

সবই সত্যি এবং আমাদের প্রত্যক্ষে ঘটেছে

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। প্রথম আলো, আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯। বিচিত্রা, ১ম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা, ৩ আগস্ট ১৯৭২।

জা. আ.: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে স্বল্পমাত্রায় প্রামাণ্যচিত্র উঠেছে, তা কি যথেষ্ট মনে করেন?

আ. ক.: মোটেও না। স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধের মতো ব্যাপক মর্মার্থের জাতীয় ঘটনায় আমরা কয়েকজন মাত্র যে ছবি ক্যামেরায় ধরেছি, তা নগণ্য সংখ্যক। হাতে গোনা যে কটি প্রামাণ্যচিত্র উঠেছে, তারও কাজের মান ছিল নিম্নমানের এবং অপরিকল্পিত। এমন কি চলচ্চিত্রের সংজ্ঞায় ফেলা যায় কিনা সন্দেহ। শুধু ঘটনা বলির সেলুলয়েড চিত্র জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা কিছু করার চেষ্টা মাত্র। হতে পারত বিপুল সম্ভাবনাময় কিন্তু প্রাপ্ত সুযোগসুবিধার অপ্রতুলতার কারণে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডও কোনো সুষ্ঠুভাবনাচিন্তাপ্রসূত দলিলচিত্র হয়ে ওঠেনি।

জা. আ.: আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সার্থক দলিলাকারে ধরে রাখা যায়নি?

আ. ক.: প্রথমত আর্থিক কারণে, দ্বিতীয়ত বলব কর্মকর্তাদের ধারণা ও মতামতের অস্বচ্ছতার কারণে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যে ফিল্ম ইউনিট গড়ে তোলা হয়, তার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন আবদুল জব্বার খান। তিনি মূলত ফিচার ফিল্মের নির্মাতা। তবু এই চলচ্চিত্রজন ডকুমেন্টারি সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্ব আমাদের পিছিয়েছে শুধু। তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সবকাজেই তাদের প্রাধান্য চেয়েছে। ফিল্ম ইউনিটে আমরা সবমতের লোক ছিলাম। এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা। এমন কি জহিরের স্টপ জেনোসাইডএ আওয়ামী লীগের প্রাধান্য নেই।…

সুকদেব সারা পৃথিবী ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এডওয়ার্ড কেনেডি, আঁন্দ্রে মালরোসহ বিশিষ্টজনদের মতামত সংগ্রহ করেন তাঁর ছবির জন্য। ওই ছবিটিতে ভাসানী, আবদুল জব্বার খান, জহির, আমারসহ অনেকের মতামত সন্নিবেশিত করা হয়। নাইন মান্থ অব ফ্রিডম-এর একটি কপি জাপান কিনেছে, পুরস্কার পেয়েছে রাশিয়ার তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে, একটা কপি বাংলাদেশ সরকারকে উপহার দেওয়া হয়, কিন্তু কখনো কোথাও দেখানো হয়নি। অন্য একজন নারী গীতা মেহতা তুলেছেন ডেটলাইন বাংলাদেশ তথ্যচিত্রটি। ভারত সরকার প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দেয় কাব্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি তথ্যচিত্রের পরিকল্পনা দিতে। সুভাষ রাজি হন। তিনি সাতক্ষীরার একটি গ্রামে শুটিং করতে এসে কিছু নারকীয় দৃশ্য দেখে এতই হতবুদ্ধি হন যে ছবি করার ভাবনা ত্যাগ করে ফিরে যান। তিনি ভাবতেই পারেননি ৯ মাসে বাংলাদেশে কী ব্যাপক বীভৎসতা ঘটে গেছে।

সুকদেব সারা পৃথিবী ঘুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এডওয়ার্ড কেনেডি, আঁন্দ্রে মালরোসহ বিশিষ্টজনদের মতামত সংগ্রহ করেন তাঁর ছবির জন্য। ওই ছবিটিতে ভাসানী, আবদুল জব্বার খান, জহির, আমারসহ অনেকের মতামত সন্নিবেশিত করা হয়। নাইন মান্থ অব ফ্রিডম-এর একটি কপি জাপান কিনেছে, পুরস্কার পেয়েছে রাশিয়ার তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে, একটা কপি বাংলাদেশ সরকারকে উপহার দেওয়া হয়, কিন্তু কখনো কোথাও দেখানো হয়নি। অন্য একজন নারী গীতা মেহতা তুলেছেন ডেটলাইন বাংলাদেশ তথ্যচিত্রটি।

গোলাম মুরশিদ এবং আলমগীর কবীরের মতামতের সারমর্ম, বিশ্লেষণ করে বলা যায় বাংলা সিনেমার ইতিহাস ঠিকঠাকভাবে লেখা হয়নি, উপস্থাপন করা হয়নি। সবসময় একটা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাঠামো ব্যবহার করে সে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই বাছাই করা হয়েছে সিনেমার ইতিহাস এবং ভাল-মন্দ। ফলে ক্ষতিকর রকমের সরলভাবে উপস্থাপিত মতামত সমূহ ঘোরাফেরা করে সিনেমা এবং শিল্প-সাহিত্যের ভাল-মন্দ বিচারের বেলায়। সোজা করে বললে সবকিছুর মান নির্ধারিত হয়, অর্থনৈতিক বিচারে এবং উৎসব ও বিদেশিরা আমাদের সিনেমাকে কি বলছে, আমরা নিজেরাও অন্ধভাবে সেসব মতের সাথে তাল মিলিয়ে আত্মস্লাঘায় ভুগি, রোগে ভোগার মতন। এবং মুক্তিযুদ্ধের মত আমাদের চারপাশের বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে, দেশের সমাজ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, অন্ধকার এবং প্রান্তিক মানুষেরা যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত নন আমাদের সিনেমায় এবং যথেষ্ট কাজ হয়নি। আর তাদের নিজেদের মত করে উপস্থাপিত না হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে, হচ্ছে কিভাবে করলে বিদেশিরা বুঝতে পারবে ও আর্থিক সহযোগিতা দেবে এবং কিভাবে উপস্থাপন করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে আর ক্ষমতাবানদের সুদৃষ্টিতে থেকে কিছু সুবিধা, অর্থ পাওয়া যাবে এসব ভেবে।

এসবের অনেক কিছু থেকে বের হওয়ার প্রয়াস লক্ষিত হয় আবিদ হোসেন খানের সিনেমায়। মূলত আবিদের একক প্রচেষ্টা এবং কিছু মানুষের সহযোগিতায় বাংলা সিনেমার যে নতুনতর ভূগোল তৈরি হচ্ছে সেখানে অনেক জনপ্রিয় মিথ অকেজো হয়ে যায়, যেমন “সিনেমা বানানোর জন্য অনেক টাকা দরকার।” “দেশে ঠিকঠাক সিনেমা বানানোর জন্য টেকনিক্যাল পারসন নেই।” বা “তারকা ছাড়া সিনেমা চলে না।” “সিনেমা দেখানোর কোন জায়গা নেই, বানিয়ে কি লাভ?” “এদেশের মানুষ ভালো সিনেমা বোঝেনা।” “সিনেমা বানিয়ে পেট চালানো সম্ভব না।” “মাথার ভিতর অনেক আইডিয়া কিন্তু সময় নিয়ে বসতে পারছিনা।” ইত্যাদি ইত্যাদিসহ আরো এরকম অনেক অনেক মতের উল্লেখ করা যায় কিন্তু এসকল মত উপেক্ষা করে আবিদ হোসেন খান নিজের মত করে একাধিক সিনেমা বানিয়েছে এবং বানিয়ে চলছে।

আবিদের সিনেমা সমালোচনা মুক্ত নয়। ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাঠামোর অনেক কিছুই তার কাজে পরিলক্ষিত হয় ক্ষতিকারক “প্রাচ্যবাদী” মনোভঙ্গী নিয়ে। তার রচিত ধারাবিবরণী ও চরিত্ররা অনেক সময়ে খুব সংকীর্ণ মত ও পথের দিশারী হতে চায়, মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় জনপ্রিয় বিচারমূলক (অ)রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা শেষত প্রতিক্রিয়াশীল এবং অপ্রগতিশীল, পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ থাকে। যার ফলশ্রুতিতে আবিদের সিনেমাতেও মাঝে মাঝে আমাদের চারপাশের বাস্তবতা আমাদের রচিত “হাসতর” না হয়ে বিদেশি “গল্পে”র আকারে প্লট সাজাতে চায়, চরিত্র তৈরি করতে চায় এবং শেষত একটা একরৈখিক মনোভঙ্গির পরিচয় রচিত হয়। এবং পরিবেশনার ক্ষেত্রেও সেই প্রাগ-ঐতিহাসিক ধারণা পরিলক্ষিত হয়।

উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলোর ভিতর “বিলীয়মান পেশা” ও “একজন মানুষ যে আপনার সাথে তার ব্যক্তিগত মেইল শেয়ার করতে চায়” সিনেমা দুটো ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এবং “একজন শরনার্থীর কতটা জমিন দরকার?” তুরস্কের একটা উৎসবে দেখানো হয়েছে তারপরে আর কোন খবরে নেই! এরূপ সিনেমা প্রদর্শনের এবং পরিবেশনার জন্য যদি প্রথাগত পথে হাটতে হয় তাহলে বোধকরি সিনেমার ভিতরের যে স্পৃহা আছে তা খানিকটা নষ্ট হয়ে যায় প্রদর্শনস্থল ও পরিবেশনার রাজনীতির শিকার হয়ে। ভালো সিনেমা বানানোর পরবর্তী অংশ হিসেবে পরিবেশনার রীতি যেন ভালো হয় সে বিষয়ক ভাবনা পরিলক্ষিত হয়না, যার ফলে ধীরে ধীরে সিনেমার ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার বা নীরব হয়ে যাওয়ার শিকার হতে পারে, আলোচিত সিনেমাসমূহ। ফলে বোধহয় “আমার কাজ সিনেমা বানানো, কি হবে? কোথায় দেখাবে? সেসব ভাবা আমার কাজ না।” এসবের ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে আবিদের সিনেমা!

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক।

ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com

 

*হাসতর/হাস্তর শব্দটির উদ্ভব শাসতর বা শাস্ত্র থেকে। টাঙ্গাইল জেলা ও আশেপাশের অঞ্চলে প্রচলিত “হাসতর” শব্দের অর্থ হচ্ছে, বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে তৈরি কোন বয়ান যার মাধ্যমে প্রচলিত জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো “হাসতর”-এ কোনপ্রকার শিক্ষা বা জ্ঞানের কিছু না থেকে একেবারে যুক্তিহীন শিশুতোষ সরল বা হাস্যরস প্রধান থেকে একেবারেই আদিরসাত্মক কিছু থাকতে পারে। আবার বলার স্থান ও ব্যক্তিভেদেও হাস্তরের অর্থের মানে বদলে যায়। কখনো গদ্যে, কখনো ছন্দে, কখনো একবাক্যে, কখনো একাধিক বাক্যে হাসতর বলা হয়। “হাসতর” কে অনেক সময় “গল্প” বলার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু সরলভাবে “হাসতর”-এ কখনো কখনো “গল্পে”র নানানসব বৈশিষ্ট্য থাকলেও তা ঠিক “গল্প” বা “Story” নয়। “হাসতর” এসব এলাকার মানুষের ভাব-দর্শন, জীবনযাপনের থেকে তৈরি একটা “ভাব” বা “Idea” এবং একটা “কথ্যমাধ্যম” বা “Oral Medium” যা উপনিবেশায়নের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ও বিকশিত হতে হতে ভাষা রাজনীতির শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত অর্থ ও ক্ষমতাকেন্দ্রের আক্রমণের বাইরে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এবং হাসতরের যথাযথ সংরক্ষণ ও বিকাশ হয়নি বলে ক্ষমতাকেন্দ্রের শক্তিশালী ভাব ও ভাষার আক্রমণের শিকার হয়ে ধীরে ধীরে “হাসতর” থেকে “গল্পে” পরিণত হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো শুধু “হাসতর” শব্দকে ভাব হিসেবে, বা মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার না করে গুণবাচক শব্দ হিসেবেও ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

হাসতর শব্দ ব্যবহার করে কিছু বাক্যঃ

“অনেকদিন হাসতর শোনা হয়না। তাঁর বলা হাসতর অনেক সুন্দর।”

“কথা না মনে হয় হাসতর।”

ইতিবাচক ভাবেঃ

“উনার কথা শুনলে মনে হয় হাসতর বলতেছে, কথায় কথায় কত কিছু শেখা যায়।”

নেতিবাচক ভাবেঃ

“থাক উনার হাসতর! উনার কথার কোন বিশ্বাস আছে? সব বানানো।”

হাস্তর/হাসতর বিষয়ক জানাশোনায় সাহায্য করেছেন, টাঙ্গাইল অধিবাসী আসমাউল হুসনা খান, আতাউর রহমান খান, মাহবুবুল আলম এবং কাবেরী আজাদ (তিনি টাঙ্গাইলের অধিবাসী নন।) ।

 

দোহাইঃ 

https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_film

https://en.wikipedia.org/wiki/Experimental_film

চলচ্চিত্রকথা | লেখকঃ তানভীর মোকাম্মেল | প্রকাশকঃ প্যাপিরাস । মোতাহার হোসেন। ২০০৩।

প্রামাণ্য চিত্রকথা | লেখকঃ মাহমুদুল হোসেন | প্রকাশকঃ নোকতা । ২০১৮।

https://www.prothomalo.com/onnoalo/interview/3cup25zlxi

https://en.wikipedia.org/wiki/Berlin:_Symphony_of_a_Metropolis

https://en.wikipedia.org/wiki/Man_with_a_Movie_Camera

আবিদ হোসেন খানের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজগুলো দেখতে পারেন এখানে

https://www.youtube.com/@abidhossain9407

সাহিত্যে নোবেলজয়ী আনি এরনোর সাক্ষাৎকার । ‘আমার বইয়ে বর্ণিত ঘটনাগুলো প্রত্যেকের—ইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের’। প্রকাশ: ০৬অক্টোবর২০২২।

https://www.prothomalo.com/onnoalo/interview/t643n64h8q

গোলাম মুরশিদের সাক্ষাৎকার । বাংলা গানের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস নয়।

https://www.prothomalo.com/onnoalo/interview/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%AC-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%A8%E0%A7%9F

অমিতাভ ঘোষের সাক্ষাৎকার। ‘লেখক অনেকভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক তৈরি করেন’।

https://www.prothomalo.com/onnoalo/mgvy8rn82u

চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীর। সবই সত্যি এবং আমাদের প্রত্যক্ষে ঘটেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। আপডেট: প্রথম আলো,১৪এপ্রিল২০১৯। বিচিত্রা, ১মবর্ষ, দ্বাদশসংখ্যা, ৩আগস্ট১৯৭২।

https://www.prothomalo.com/special-supplement/banglanewyear/%E0%A6%B8%E0%A6%AC%E0%A6%87-%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BF-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%87-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •