১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসন: ‘নয়া উদারীকরণে’র দিকে যাত্রা শুরু

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৯

১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসন: ‘নয়া উদারীকরণে’র দিকে যাত্রা শুরু

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যোগ আছে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থারও। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণীবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। নবম কিস্তিতে সামরিক সরকারের আমলে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণে সরকারি অবস্থান এবং তার আলোকে নীতি-পরিকল্পনার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।

Politics is in reality the truest clown show. Look at who we have on both sides of the aisle. Do you think most of these people really care about you? Their first objective is to get themselves re-elected. Secondly, it is to make sure that their campaign donors, the big money ones, get taken care of via legislation or lack of legislation. Of course, once many of them leave office, they make sure they get juicy jobs as lobbyists or working for some Think Tank… usually subsidized by the Super Rich of both political persuasions. Philip Farruggio

১৯৭৫-পরবর্তী রাষ্ট্র ও পুঁজির গতিমুখ

রাষ্ট্রীয় শিল্পপুঁজির ক্ষয়প্রাপ্তি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়ী পুঁজির আধিপত্য বৃদ্ধি তৎকালীন সময়ের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর ঐতিহাসিক কারণগুলো খুঁজলে দেখা যায় যে, অবিভক্ত পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনার সময়টিতেও ভিত্তিমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠা সরকারের কেন্দ্রীয় মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি।

‘বাংলাদেশের মতো দেশে এটি বেশি দৃশ্যমান, যেখানে শাসক শ্রেণী বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে নিজেদের ভিত্তি দাঁড় করতে ব্যর্থ এবং অনিচ্ছুকও বটে। বস্তুত আন্তর্জাতিক পুঁজির কমিশনভোগী কিংবা তাদের ক্ষমতার আড়ালে অভ্যন্তরীণ লুণ্ঠনের ভাগীদার হওয়াতেই তাদের বেশি আগ্রহ। এর ফলে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কলম্বিয়া, নাইজেরিয়ার মতো রাষ্ট্র কিংবা নব্বই দশক পর্যন্ত আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলির মতো রাষ্ট্র একদিকে জনগণের জীবন ও সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির হিংস্র থাবার নিচে নিক্ষেপ করতেই মূল ভূমিকা পালন করে। অনুন্নয়ন-দখল-লুণ্ঠন-সম্পদ পাচারের পথ তৈরিতে রাষ্ট্রই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।’

তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ধরনটি কী? এই রাষ্ট্রটির গঠনে কোন শ্রেণীর ভূমিকা মুখ্য ছিল? সেই শ্রেণী কোন প্রক্রিয়ায় ধন-সম্পত্তির মালিক হলো? রাষ্ট্র কীভাবে এই শ্রেণীর সম্প্রসারণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে? এই শ্রেণীই-বা কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিনির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে? পুঁজি এবং রাষ্ট্রের পারস্পরিক মৈত্রীবন্ধনের ফলে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে? এর ঐতিহাসিক কার্যকারণ সম্পর্ক অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ জন্য যে, এর উত্তরগুলো জানা না গেলে বর্তমান বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির নেপথ্যের মূলগত কার্যকারণ সম্পর্কটি অস্পষ্ট থেকে যাবে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা তাই ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধান করছি। প্রথমেই আসা যাক রাষ্ট্রের ধরন সম্পর্কে। উপরোক্ত বক্তব্যের জের ধরে রাষ্ট্রের ধরন প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলছেন,

‘এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নিজের ভৌগোলিক সীমানায়, আপেক্ষিক অর্থে ‘সার্বভৌম’, এটি শ্রেণীদ্বন্দ্বের অমীমাংসেয়তার ফসল এবং শাসকশ্রেণীর নিপীড়নের যন্ত্র ঠিকই। কিন্তু বৃহৎ অর্থে এই রাষ্ট্র একটি বৃহৎ রাষ্ট্র অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনার একটি যন্ত্রবিশেষ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশের রাষ্ট্র তাই দুটি চরিত্র একই সঙ্গে ধারণ করে। একদিকে তা আনুষ্ঠানিকতায় ‘সার্বভৌম’, অন্যদিকে তা সার্বভৌম পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত একটি প্রান্তিক মেশিন।’

বাংলাদেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ অনুসন্ধানের বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব যারা নিয়েছিল তারা কেউ শিল্প উৎপাদনী পুঁজির প্রতিনিধিত্ব করত না (পূর্ববর্তী পর্বগুলো দ্রষ্টব্য)। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, উৎপাদন পদ্ধতি — মার্কস যাকে বলছেন — সমাজের ভিত্তি, তর ওপর দাঁড়িয়ে সমাজের অন্যান্য উপরিকাঠামো গড়ে ওঠে। বিপরীত দিক থেকে, উপরিকাঠামোও ভিত্তির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।

ক্ষমতাবান শাসকশ্রেণীর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অর্থনীতির গতিমুখ নির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। সে সূত্র ধরে বলা যায় যে, বাংলাদেশে পেটি বুর্জোয়া অর্থনীতি অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগী ঠিকাদারি, দোকানদারি, ইনডেন্টিং, সেবা-পরিষেবা (সার্ভিস সেক্টর) বাণিজ্য, সুদী কারবারি, মহাজনি, ইজারাদারি, ভাড়াজীবী (বাড়ি, জমি, পরিবহণ), চোরাকারবারি, দখলদারি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ধরনের অর্থাৎ ‘‘কৃষিপ্রধান থেকে সার্ভিসপ্রধান এবং ‘টুকটাক’ অর্থনীতি’’র বর্তমান আধিপত্যমূলক অবস্থা তৈরি হওয়ার পেছনে শাসকশ্রেণীর ভূমিকাই মুখ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এর ঐতিহাসিক কারণ খুঁজতে তাই গঠনকালীন কাঠামোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পূর্ববর্তী সময়ের শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের পরিবর্তে অবস্থান দখল করতে থাকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।নতুন রাষ্ট্র হিসেবে চলার অল্প সময়ের পর থেকেই রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের নেপথ্যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের চাপ ক্রমান্বয়ে তৈরি হতে থাকে।

‘৭০ দশক থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কমানোর চাপ তৈরি হয় তথাকথিত ‘নয়া উদারনৈতিক’ বা কট্টর পুঁজিপন্থি সংস্কারের ধারাবাহিক চাপে। বাজার তথা পুঁজির হাতে জনগণকে ছেড়ে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকেও গ্রাস করে।’

বাংলাদেশে বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও দেশের ভিত্তিমূলক পুঁজিবাদী শিল্পায়নকে প্রধান গুরুত্বের জায়গায় বিবেচনা করা হয়নি। এর ঐতিহাসিক কারণ হিসেবে রাষ্ট্র এবং পুঁজির মালিক শ্রেণীর পারস্পরিক জৈবিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয় কোনো কোনো গবেষণায়। রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত যে শ্রেণীর মাধ্যমে গৃহীত হতো অর্থাৎ রাষ্ট্রকে যারা প্রতিনিধিত্ব করতেন, তারা কাদের দ্বারা প্রভাবিত হতেন কিংবা তাদের শ্রেণীগত পরিচয়ের স্বরূপ তা এসব গবেষণায় পাওয়া যায়। এই গবেষণানুযায়ী, তারা হলেন সরাসরি উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন সম্প্রদায়। ভিত্তিমূলক শিল্প প্রতিষ্ঠার কিংবা পুঁজিবাদী শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি সংস্কারে যাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, পাকিস্তান আমলের ধারাবাহিকতায় যুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রের গঠনকালীন বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ধনী কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা আধিপত্য করতেন। আর এই সম্প্রদায় থেকেই শহরাঞ্চলের রাজনৈতিক অভিজাত, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্প মালিক, আমলা, সামরিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। শহরে বসবাস করলেও যাদের সবসময়ই যোগ ছিল গ্রামাঞ্চলের উক্ত গোষ্ঠীর সাথে। শহরাঞ্চলের এই সম্প্রদায়টি যুদ্ধোত্তরকালে রাষ্ট্রের নীতি, পরিকল্পনা অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের শ্রেণীগত মৈত্রীর কারণে যুদ্ধোত্তর সময়ে ভূমি সংস্কারের নীতিসহ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে তাই কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি।

উঠতি ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের সামঞ্জস্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক বাংলাদেশের কথিত ‘ধ্রুপদি পুঁজিতান্ত্রিক’ সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ভিন্নভাবে বললে, পেটি বুর্জোয়া অর্থনীতি উৎপাদন সম্পর্কের প্রধান দিক হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ধনী কৃষক, ব্যবসায়ী এবং বাণিজ্যিক মধ্যস্বত্বভোগী, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পমালিক সরাসরি কিংবা গোপনে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতি, কৌশল নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে। রাষ্ট্র এবং আধিপত্যশীল উক্ত শ্রেণীসম্পর্কের কারণে বাংলাদেশে ভিত্তিমূলক শিল্পায়ন প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়নি।

কীভাবে সে পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করা হলো? প্রসঙ্গত শিল্প সম্পর্কিত নীতি, পরিকল্পনার বিষয়গুলোর উল্লেখ করা যায়। ১৯৭৫ সালের সংশোধিত বিনিয়োগ নীতিতে যে সমস্ত বিধান রাখা হয়, সে অনুযায়ী যেসব পরিত্যক্ত/দেশীয় শিল্পমালিক/শেয়ারহোল্ডারদের শিল্প, সম্পত্তি, প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল সেগুলো ক্রমান্বয়ে দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে কামরুল আলম তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, অর্থনীতির গতিমুখ পরিবর্তনের এই নীতিগত অবস্থান শিল্প উৎপাদন কিংবা শিল্পের বিকাশের কথা চিন্তা করে নেওয়া হয়নি। বরং, ঠিক তার বিপরীতে, রাষ্ট্রীয়করণের সময়কালে বিভিন্ন উপায়ে যাদের হাতে প্রচুর সম্পদ জমা হয়ে গিয়েছিল তাদেরই চাপে এই নীতি গ্রহণ করা হয়। নুরুল ইসলামের বরাত দিয়ে কামরুল আলম জানাচ্ছেন যে, নতুন বিত্তবান এই গোষ্ঠীটি হয় আধিপত্যশালী সামাজিক অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল অথবা তারা সরাসরি কিংবা নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার ছিল।

বরং, ঠিক তার বিপরীতে, রাষ্ট্রীয়করণের সময়কালে বিভিন্ন উপায়ে যাদের হাতে প্রচুর সম্পদ জমা হয়ে গিয়েছিল তাদেরই চাপে এই নীতি গ্রহণ করা হয়। নুরুল ইসলামের বরাত দিয়ে কামরুল আলম জানাচ্ছেন যে, নতুন বিত্তবান এই গোষ্ঠীটি হয় আধিপত্যশালী সামাজিক অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল অথবা তারা সরাসরি কিংবা নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার ছিল।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী কামরুল আলম দেখাচ্ছেন যে, তিন ধরনের উৎস থেকে আধিপত্যশালী এই বিত্তবান গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ জমা হয়েছিল। প্রথমত: ধনী কৃষকদের অর্থসম্পদ জমা হতো কৃষি উদ্বৃত্ত থেকে। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত আয় তারা পুনরায় কৃষি অথবা শিল্পোৎপাদনে বিনিয়োগ করত না। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মুনাফা আত্মসাৎকরণের মধ্য দিয়ে তাদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতো। ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত নতুন এই ব্যবস্থাপক সম্প্রদায় এবং সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম একটি উপায় হিসেবে দেখেছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তৃতীয়ত: পাবলিক সেক্টরের সাথে সম্পর্কিত বর্ধিত আমদানি-রপ্তানি খাত এই প্রক্রিয়ায় অন্য একটি নতুন গোষ্ঠী তৈরি করে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বৈধ এবং অবৈধ পথে প্রচুর পুঁজি/সম্পদের মালিক বনে যায়।

নতুন এই বিত্তশালী শ্রেণীর সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পুঁজির সংবর্ধনের স্বার্থে বিনিয়োগ নীতিকে সংশোধিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমদানি-রপ্তানির অভিজ্ঞতাহীন বিত্তশালী নতুন এই গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে কিংবা জমি এবং বাড়ি কেনায় তাদের অর্থ ব্যয় করার দিকে মনোযোগী হয়। যেহেতু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান খোলা বা স্থাপনের নির্দিষ্ট কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না (আইনি কঠোরতা বলতে যা বোঝায়), সে কারণে যে যত সংখ্যায় পারত সে ততটি ইউনিটের মালিক হতে পারত। ফলে নতুন এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন নামে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার সুযোগ লাভ করে। গবেষক জানাচ্ছেন যে, একদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটগুলো বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কারণ, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই কায়েমি স্বার্থবাদী চক্রের গোপন/প্রকাশ্য আস্তানা দৃঢ় অবস্থান গেড়ে বসেছিল। অন্যদিকে, সরকারও পুঁজি এবং উদ্বৃত্ত মুনাফা পুনরায় উৎপাদনী খাতে কাজে লাগানোর জন্য কার্যকর কোনো নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি কিংবা তা তাদের মনোযোগের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না।১০

১৯৭৫ সালের আগস্টে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সংহত করার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে। তারা ক্ষমতাবান বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সাথে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। আরও মিত্র হিসেবে পায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীকে–শিল্পোদ্যোক্তা, ট্রেডার, কমিশনভোগী দালাল, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং গ্রামাঞ্চলের ধনী কৃষকদের। শ্রেণীগত জৈবিক সম্পর্কের কারণে পরস্পরের সাথে এদের মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সহজ হয় এবং সামগ্রিক এই সম্প্রদায়টিকেই ব্যক্তিখাতের সমর্থক হিসেবে পাওয়া যায়।১১

এই সময়ের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক সরকার উল্লিখিত সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করে ‘সমাজতান্ত্রিক নীতি’ বর্জন করে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তার পরিবর্তে ধারাবাহিক পুনঃবিনিয়োগ বা লগ্নি করা থেকে বিরত থাকে (disinvestment policy) ও ক্রমান্বয়ে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংক (World Bank), তাদের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (IDA), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সরকারের নেওয়া এই নীতির সহযোগী হয়ে ওঠে। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সরকারের গৃহীত এই নীতি দৃষ্টিভঙ্গি মূলত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ নির্দেশিত প্রাইভেটাইজেশনের শর্তসাপেক্ষযুক্ত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির সমষ্টি।১২

কামরুল আলমের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সামরিক শাসনামলে এই নীতিকাঠামো গ্রহণের পেছনে দুটো মুখ্য কারণ ছিল। এক. (রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিকৃত) শিল্প ইউনিট, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিখাতে তুলে দেওয়া, এবং দুই. (নব্য এবং পুরাতন) ধনী বাঙালিদের পুঁজির আহরণ, কেন্দ্রীভবন, পুঞ্জীভবনে সহায়তা করা।১৩ উদাহরণ হিসেবে অধিকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গটি উল্লেখযোগ্য। সরকার যে সাবেক মালিকদের প্রতিষ্ঠান আগে রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় নিয়ে এসেছিল, তাদের ১,০০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করে। এ ছাড়াও সরকারের নতুন বিনিয়োগ নীতিতে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, যেসব ব্যক্তিমালিক ‘অবৈধ’ উপায়ে অর্থসম্পদ আহরণ করেছিল, তাদের উৎস কিংবা সেসব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের খোঁজখবর, তদন্ত কিংবা খবরদারি করা হবে না, যদি তারা রাষ্ট্রীয় বিলগ্নিকৃত/অবিনিয়োগকৃত (disinvested) ইউনিটগুলো কিনে নেয়। উপরন্তু, সরকার কোনো কোনো লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও বিরাষ্ট্রীয়করণের আওতায় নিয়ে আসে, যা তাদের ঘোষিত নীতির পরিপন্থি।১৪

সরকার যে সাবেক মালিকদের প্রতিষ্ঠান আগে রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় নিয়ে এসেছিল, তাদের ১,০০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করে। এ ছাড়াও সরকারের নতুন বিনিয়োগ নীতিতে আশ্বাস দেওয়া হয় যে, যেসব ব্যক্তিমালিক ‘অবৈধ’ উপায়ে অর্থসম্পদ আহরণ করেছিল, তাদের উৎস কিংবা সেসব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের খোঁজখবর, তদন্ত কিংবা খবরদারি করা হবে না, যদি তারা রাষ্ট্রীয় বিলগ্নিকৃত/অবিনিয়োগকৃত (disinvested) ইউনিটগুলো কিনে নেয়।

১৯৭৫ থেকে সরকার ক্রমান্বয়ে বিরাষ্ট্রীয়করণের নীতি বাস্তবায়নের পথ জোরদার করে। কোনো কোনোটি রাষ্ট্রের মালিকানায় রেখে দিয়ে বাদবাকিগুলো দেশি এবং বিদেশি ব্যক্তিপুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে। উপরন্তু, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয়করণের অনুবিধি বা বিধিব্যবস্থাও বাতিল করে দেয়। এ ছাড়াও কর অবকাশের ব্যবস্থাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে। সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের পুঁজির জোগান দেওয়ার জন্য শিল্পে বিনিয়োগকারী লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে অংশীদারত্বের সুবিধাসহ বিনিয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়।১৫

ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর পুনর্গঠন করে। ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে একত্রিত করে শিল্পে বিনিয়োগের পথে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জকে সচল করা হয়। শেয়ারবাজার (ব্যাংক, বীমা প্রভৃতি লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি) শিল্পপুঁজির প্রাথমিক জোগানের একটি ক্ষেত্র হিসেবে প্রথম দিকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হলেও পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেই ফাটকা ব্যবসার একটি অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নেয়। এর পাশাপাশি আবার ব্যক্তি বিনিয়োগের সিলিং ৩ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।১৬ বাজারের ওপর থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস করার উদ্দেশ্যে অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিকে বিনিয়ন্ত্রণ (deregulate) করার স্বার্থে জিয়া সরকার একগুচ্ছ বিলগ্নিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে Disinvestment Board প্রতিষ্ঠা করে। এই বোর্ডের দায়িত্বের মধ্যে ছিল ঘোষিত বিরাষ্ট্রীয়করণ (privatization) কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়াও ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য Investment Promotion Center (IPC), Development Finance Institutions (DFIs) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয় জেনারেল জিয়ার শাসনামলে।১৭ এসব কর্মসূচি সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে, ১৯৮২ সালের সামরিক সরকারের সময় ব্যক্তি বিনিয়োগকে আরও অধিকতর মাত্রায় উন্নীত করার তাগিদে ‘নতুন শিল্প নীতি (The New Industrial Policy – NIP)’১৮ তৈরি করা হয়।

আগে বলা হয়েছে, জেনারেল জিয়ার সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো ‘বদলে দেওয়া’র যে ঘোষণা প্রদান করে, সেটি ছিল মূলত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ নির্দেশিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির অনুসরণ। উদাহরণ হিসেবে বাজেট ঘাটতি কমানো; রাষ্ট্রীয় খাত সংস্কার (পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেটে-ছেঁটে বাদ দেওয়া) করা; খাদ্য, সার, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি খাত থেকে ‘ভর্তুকি’ তুলে দেওয়া; এবং বাণিজ্য অবাধ করা। উপরন্তু, টাকার মূল্য হ্রাস করা হয় প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিনিময় হারকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ছাড়াও কর সংস্কার, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বৃদ্ধির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল সংস্কার কাজের অন্তর্ভুক্ত।১৯

জিয়া সরকার ‘শিল্পায়নে’র উদ্দেশ্যে বিরাষ্ট্রীয়করণের পাশাপাশি আরও কিছু নীতি কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। তার সরকার রপ্তানি উদারীকরণ, আমদানি বিকল্প শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সরকারের নির্দিষ্ট যে সিলিং ছিল সেটি বস্তুতপক্ষে তুলে দিয়ে সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু এতে আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করেন কোনো কোনো গবেষক। তারা এর কারণ হিসেবে বলতে চেয়েছেন যে, শিল্পপণ্য উৎপাদনে শিল্পের কাঁচামাল এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যে প্রাচুর্য থাকা দরকার তার অভাবজনিত কারণে এই বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি। অর্থাৎ, ব্যক্তিখাতনির্ভর শিল্পায়নকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নীতি পুনর্বিন্যাস ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি। তারপরও প্রাইভেট খাত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিপুঁজিকে উৎসাহিত করার নানাবিধ উদ্যোগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘নতুন উন্নয়ন নীতি-কৌশল’ প্রবর্তন করেন। কিন্তু পুঁজির বৈশ্বিক অবস্থান থেকে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো ’৭০ দশক থেকেই ‘নয়া উদারনৈতিক বাজার’ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করে এসছে। এই ‘নয়া উদারনৈতিক’ দৃষ্টিভঙ্গি হলো পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব বাজারকে সুরক্ষিত করে তাদের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলোর বাজারকে আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য উন্মুক্ত করার যাবতীয় কর্মকাণ্ড। জেনারেল জিয়ার সময় থেকে সেই পথে অগ্রসর করানোর জন্য নীতি-পরিকল্পনা-কৌশল ইত্যাদি গ্রহণের চেষ্টা চালানো হয়। সে হিসেবে এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বে নতুন নয়। প্রকৃত অর্থে, ‘নতুন’ নীতি-পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ অর্থাৎ রপ্তানিমুখী খাতকে গুরুত্ব প্রদান এবং তা উৎপাদনের উচ্চহারকে উৎসাহিতকরণ। প্রাইভেট খাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মোট জাতীয় উৎপাদনকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করার ঘোষণা দেওয়া হয় ‘নতুন’ এই নীতিমালায়।

প্রকৃত অর্থে, ‘নতুন’ নীতি-পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ অর্থাৎ রপ্তানিমুখী খাতকে গুরুত্ব প্রদান এবং তা উৎপাদনের উচ্চহারকে উৎসাহিতকরণ।

সামরিক শাসনামলে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে (১৯৭৩-৭৮) সম্পূর্ণভাবে বদলে না দিয়ে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। আমলাতন্ত্র দ্বারা প্রণীত ১৯৭৫-৭৮ সালের জন্য ‘ত্রিবার্ষিকী হার্ড কোর পরিকল্পনা’য় (Three Year Hard Core Plan) ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণকে প্রধান গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়, বিশেষ করে জনগণের সম্পদ ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পখাতে প্রবাহিত করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় করা হয় দ্বিবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০)। এর ভিত্তি ছিল জিয়াউর রহমানের উনিশ দফা কর্মসূচি। যে কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার তুলনায় উচ্চহারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা।২০

অন্যদিকে, বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেমন: ১. প্রদত্ত কর কর্তন-পরবর্তী লভ্যাংশ বিদেশি পুঁজির মালিকরা নিজ দেশে পাঠাতে পারবে, কোনো বাধা থাকবে না। ২. বিদেশিদের বিনিয়োগকৃত প্রাথমিক পুঁজি দশ বছরের মধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরত নিতে পারবে। ৩. স্বদেশে প্রেরণ সংক্রান্ত আইন (repatriation act) অনুযায়ী, বিনিয়োগকৃত পুঁজি থেকে যে মুনাফা অর্জিত হবে সেটি পুনরায় কোনো শিল্প প্রকল্পে নিয়োজিত হলে (বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে) সে অংশকেও বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হবে। ৪. অনুমোদিত বিদেশি শিল্প-কারখানার জন্য উন্নত অঞ্চলে উৎপাদন শুরুর সময় থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কর অবকাশের সুযোগ পাবে; অনুন্নত অঞ্চল হলে নয় বছরের জন্য এ সুযোগ থাকবে। এ ছাড়াও বিদেশি নাগরিকদের জন্য স্বদেশে অর্থ প্রেরণের নানা ধরনের সুবিধা রেখে দেওয়া হয় স্বদেশে প্রেরণ সংক্রান্ত (repatriation act) আইনে।

পরবর্তী সময়ে সেটিও সংশোধন করা হয়। আরও সুবিধা বাড়ানো হয়। বলা হয়, ১. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে মানানসই শিল্পে বিনিয়োগের স্বাধীনতা থাকবে বিদেশি পুঁজির মালিকের। ২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো পুঁজির আহরণ হলে সে অংশসহ বিনিয়োগকৃত পুঁজি মালিকের নিজ দেশে প্রেরণের গ্যারান্টি দেবে সরকার। ৩. অনুমোদিত রয়্যালটি এবং টেকনিক্যাল ফি স্বদেশে প্রেরণ করতে পারবে। ৪. বিদেশি প্রকৌশলীদের জন্য কর ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়। ৫. বিদেশি নাগরিকদের পরিবারের স্বদেশে অর্থ প্রেরণের সুবিধা থাকবে। ৬. রপ্তানিমুখী এবং আমদানি বিকল্প শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শিল্পঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। ৬. শুল্ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ৭. বিদেশি বিনিয়োগকারীর দুবার দেওয়া কর থেকে মুক্ত রাখা হবে। ৮. বিদেশি ঋণের সুদ করের আওতামুক্ত থাকবে। ৯. রপ্তানির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। আরও নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয় বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।২১ এ ছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে একটি আইন করা হয়, যেখানে বলা ছিল: (১). বিদেশি বিনিয়োগকে বাজেয়াপ্ত কিংবা জাতীয়করণ করা হবে না, (২). যদি কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে জনগণের স্বার্থে জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়, তবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে সেটি করা হবে।২২

দেশি-বিদেশি ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে, যাদের হাতে বিগত সরকারের আমলে নানা উপায়ে বিরাট অঙ্কের পুঁজি পুঞ্জীভূত হয়েছিল, সেসব অল্প কিছু পারিবারিক/গোষ্ঠীগত সংস্থা এবং নতুনভাবে ‘হয়ে ওঠা’ পুঁজির মালিকদের সামনে অসামান্য সুযোগ উপস্থিত হয় পুঁজির আহরণ, সংবর্ধন, কেন্দ্রীভবন, পুঞ্জীভবন ও সম্প্রসারণের। তৎকালীন সরকারের সংস্কারধর্মী পরিকল্পনার ফলে রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ের জোটবন্ধন শক্তিশালী হয়। নীতি সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় সিটি গ্রুপ, কনকর্ড, যমুনা, মেঘনা, সানম্যান, ফ্লোরা, নাসির গ্রুপের মতো সংস্থাগুলোর সামনে। বিশেষ করে জনগণের করের অর্থ ব্যক্তিমালিকদের মধ্যে বণ্টন বৃদ্ধির রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার কারণে পুঁজির সংবর্ধনের তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।২৩

সরকারের সংস্কারধর্মী পরিকল্পনার ফলে রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ের জোটবন্ধন শক্তিশালী হয়। নীতি সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় সিটি গ্রুপ, কনকর্ড, যমুনা, মেঘনা, সানম্যান, ফ্লোরা, নাসির গ্রুপের মতো সংস্থাগুলোর সামনে।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৮০-৮৫) খসড়ায় ব্যক্তি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেখানে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি, আমদানিকৃত কাঁচামালের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা, কর ‍সুবিধা এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক ছাড় দিয়ে ব্যক্তি বিনিয়োগের সম্প্রসারণের উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়া বিশেষত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শিল্প সমবায়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যক্তি উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করার সরকারি নানা উদ্যোগে, বিশেষ করে শিল্পনীতির কারণে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেসব বিনিয়োগকারী সাড়া দেয়, সেসবের হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল অব্দি দুগ্ধ খামার এবং দুগ্ধজাতীয় পণ্য, গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার, কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, তৈরি পোশাক, ঔষধ শিল্পে (প্রায় ৩,৫০০ শিল্প ইউনিটের) অনুমোদন দেয় বিনিয়োগ বোর্ড। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১,০১২.৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৪০.৭ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কিত অংশগ্রহণ ছিল। এই বিনিয়োগে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশীয় পুঁজির তুলনায় হিসাব করলে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ যদিও বেশি ছিল না, কিন্তু বিদেশি এই বিনিয়োগের সাথে ছিল দেশি-বিদেশি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সম্পর্ক। যাই হোক, একই সময়ে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৩৮টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যার পরিমাণ ছিল ১৬.১ কোটি মার্কিন ডলার। যৌথ বিনিয়োগ ছিল এমন প্রায় ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্রিটিশ কোম্পানি (৩ কোটি মার্কিন ডলার) ছিল ১৪টি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ছিল ৩টি (৫.৩ কোটি মার্কিন ডলার)।২৪

অন্যদিকে, ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে সরকার পাঁচটির মধ্যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক (উত্তরা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক)-কে disinvestment-এর অধীন নিয়ে আসে। ব্যক্তিখাতে ব্যাংক, বীমাসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোদন দেয়। সে সুবাদে ৯টি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক, ৭টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ২টি বীমা কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমতি লাভ করে।২৫ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ব্যক্তিপুঁজিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, তার মধ্যে ব্যক্তিমালিকদের ঋণ প্রাপ্তির সুবিধা ছিল অন্যতম। যেমন, ব্যক্তিখাতে কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যাবতীয় খরচের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ঋণ সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।২৬

ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে সরকার পাঁচটির মধ্যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক (উত্তরা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক)-কে disinvestment-এর অধীন নিয়ে আসে। ব্যক্তিখাতে ব্যাংক, বীমাসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোদন দেয়। সে সুবাদে ৯টি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক, ৭টি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ২টি বীমা কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমতি লাভ করে।

আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (BSRS) এবং বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (BSB)-এর অনুমোদনকৃত এবং বিতরণকৃত ঋণের হিসাব দেওয়া যায়। বিএসআরএস থেকে ১৯৭৬-৭৭ সালে ব্যক্তিখাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে, বিএসবি থেকে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৯৭৫-৭৬ সালের ৮.৭৮ কোটি টাকার তুলনায় ১৯৭৬-৭৭ সালে কমে দাঁড়ায় প্রায় ৪.৪৫ কোটি টাকার মতো। এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৭৭-৭৮ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক হিসাবে উভয় প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩.২৪ কোটি এবং ১০.৭৬ কোটি টাকা। বিএসআরএস এবং বিএসবির অনুমোদনকৃত ঋণের পরিমাণ ১৯৭৫-৭৬ সালে যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯.১৯ কোটি ও ৫.৮৭ কোটি টাকা, পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬-৭৭ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩১.৫৪ কোটি ও ১৭.৯৪ কোটি টাকায়।২৭ একটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭৬-৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের (রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান) ঋণের শতকরা ৯০ ভাগ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ব্যক্তিখাতে, যেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই হার ছিল ১৭ শতাংশ এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল ২০ শতাংশ।২৮

ব্যক্তিখাতের উদ্যোগ বাড়ানোর তাগিদে নানাবিধ সুবিধা, ছাড় ইত্যাদি দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের আশানুরূপ বিনিয়োগ বাড়েনি। একদিকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর অন্যদিকে যে কোনো ধরনের শিল্পোদ্যোগের ঝুঁকির চেয়ে আমদানি, রপ্তানি খাতসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফার হার ছিল উচ্চমাত্রার। এ অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সরকার বিনিয়োগ করপোরেশন (Investment Corporation of Bangladesh – ICB) গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৭৬ সালে। অক্টোবর ১৯৭৬ থেকে জুন ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আইসিবি ২৮টি প্রকল্পে মোট ৫.৪১ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। আইসিবি-কে সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বীমার একটি কনসোর্টিয়াম স্থাপন করে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের অর্থলগ্নির ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য। তা সত্ত্বেও আইসিবির প্রকৃত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ জুন ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দাঁড়ায় ৭৭ লাখ টাকার মতো, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ কোটি টাকা।২৯

ব্যক্তিখাতের উদ্যোগ বাড়ানোর তাগিদে নানাবিধ সুবিধা, ছাড় ইত্যাদি দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের আশানুরূপ বিনিয়োগ বাড়েনি। একদিকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর অন্যদিকে যে কোনো ধরনের শিল্পোদ্যোগের ঝুঁকির চেয়ে আমদানি, রপ্তানি খাতসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফার হার ছিল উচ্চমাত্রার।

১৯৭৬-১৯৮২ সাল পর্যন্ত নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ৯০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি সাইজের শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এই নব্বইটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতকরা ৩২ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাভজনক ছিল। এসব ইউনিটের (তখনকার বাজারদর হিসাবে) গড় মূল্য ছিল প্রায় ৫২ লাখ টাকার মতো। অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রাইভেটাইজেশনের নিমিত্তে ১৯৭৫-৮১ সাল পর্যন্ত ২৫৫টি রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ে।৩০ বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া জোরদার করার আগেই অবশ্য জিয়া সরকার ‘অবৈধ’, চোরাই টাকাকে বৈধ করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ঘোষণাটি ছিল: ‘those who would disclose such funds would be allowed to retain the same without any questioning by the government’. যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে অর্জিত ‘অবৈধ’ সম্পদের মালিকরা কর- কর্তৃপক্ষের কাছে মোট ১৩০ কোটি টাকার মতো  হিসাব জমা দেয়।৩২

১৯৮২ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি হলে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়।৩১ পাট ও টেক্সটাইল মিলগুলোকে (disinvested) কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়া নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সাবেক মালিকরা ধার্যকৃত মূল্যের শতকরা মাত্র ১০ ভাগ টাকা প্রদান করে সেসব মিলের মালিক হন এবং সেগুলোর জন্য যে ঋণের প্রয়োজন ছিল, সেই ঋণের অর্থ জোগান দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় আনার আগে পাট ও টেক্সটাইল মিল কারখানার শতভাগ মালিকানা কোনো উদ্যোক্তা/উদ্যোক্তাদের ছিল না। মালিকানার ক্ষেত্রে সাবেক মালিকদের অংশীদারত্ব ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ। বাদবাকি ৭৬ শতাংশের ৫৮ শতাংশ রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ এবং অবশিষ্ট ১৮ শতাংশের অংশীদারত্ব জনগণের (ইকুইটি শেয়ার)। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মিল-কারখানায় উদ্যোক্তার নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত পুঁজির পরিমাণ ছিল এক-চতুর্থাংশেরও কম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা যখন সেসব মিল-কারখানার শতভাগ মালিকানা দাবি করে, তখন সরকার তাদের হাতেই পুরো প্রতিষ্ঠানটি নামমাত্র মূল্যে ফেরত দেয়। উপরন্তু, এ প্রক্রিয়ায় পাটকল মালিকরা ৩০৩ কোটি টাকা এবং টেক্সটাইল মিল মালিকরা ১৫০ কোটি টাকা নিজেদের হিসাবে নিয়ে নেয়। মিল-কারখানার সম্পদের মূল্য এবং অন্যান্য উপাদানের বাজার দর প্রকৃত মূল্যের চেয়ে যথেষ্ট পরিমাণ কম ধরার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এভাবে ৩০০টি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ধরনের শিল্প-কারখানা ব্যক্তিমালিকদের হাতে তুলে দেয় সরকার।৩৩

রাষ্ট্রীয়করণের আওতায় আনার আগে পাট ও টেক্সটাইল মিল কারখানার শতভাগ মালিকানা কোনো উদ্যোক্তা/উদ্যোক্তাদের ছিল না। মালিকানার ক্ষেত্রে সাবেক মালিকদের অংশীদারত্ব ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ। বাদবাকি ৭৬ শতাংশের ৫৮ শতাংশ রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ এবং অবশিষ্ট ১৮ শতাংশের অংশীদারত্ব জনগণের (ইকুইটি শেয়ার)। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মিল-কারখানায় উদ্যোক্তার নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত পুঁজির পরিমাণ ছিল এক-চতুর্থাংশেরও কম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা যখন সেসব মিল-কারখানার শতভাগ মালিকানা দাবি করে, তখন সরকার তাদের হাতেই পুরো প্রতিষ্ঠানটি নামমাত্র মূল্যে ফেরত দেয়।

কোনো কোনো গবেষক দেখিয়েছেন যে, বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপ হয়নি; কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যায়। নিচে একটি ছকের সাহায্যে বিষয়টি তুলে ধরা হলো– 

ছক: ২১: কারখানা উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং আউটপুট)৩৪

১৯৭৪ সালের দামস্তর অনুযায়ী (কোটি টাকা)

সাল

মোট উৎপাদন

প্রবৃদ্ধির হার

১৯৭৩-৭৪

৭৭২.৯

 —

১৯৭৪-৭৫

৮১৫.৪

৫.৫

১৯৭৫-৭৬

৯১৭.৩

১২.৫

১৯৭৬-৭৭

৯৭৯.৭

৬.৮

১৯৭৭-৭৮

১,০৯১.৪

১১.৪

১৯৭৮-৭৯

১,১২৯.৪

৪.৪

১৯৭৯-৮০

১,১৮৬.১

৪.১

১৯৮০-৮১

১,২৫৯.১

৬.২

১৯৮১-৮২

১,২৬৭.২

০.৬

১৯৮২-৮৩

১,১৮৪.৯

-৬.৫

সূত্র: World Bank Report No. 5409-BD, 2 April 1985, p.77. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p.57.

একই গবেষণার তথ্যে দেখা যায় যে, ব্যক্তিখাতের সম্প্রসারণের জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে, বিশেষ করে শিল্প ইউনিটগুলো যাদের হাতে তুলে দেয় এবং যাবতীয় আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, সেসব ব্যক্তিমালিকদের অধিকাংশই বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি কিংবা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়নি। বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত শিল্প-কারখানার দক্ষতার ওপর করা একটি অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে গবেষক জানিয়েছেন যে, বিভিন্ন খাতের মোট ৩৯টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ১৯টির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, ১১টির উৎপাদন কমে গিয়েছিল এবং ৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৪টি প্রতিষ্ঠান আউটপুটের কোনো ধরনের তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। নিচের ছকের সাহায্যে বিভিন্ন করপোরেশনের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্পাদনী দক্ষতার চিত্রটি তুলে ধরা হলো:

ছক- ২২: বিরাষ্ট্রীয়কৃত শিল্পের অবস্থা৩৫

খাত

নমুনা সংখ্যা

উত্পাদন বৃদ্ধি

পতন

লেইড অফ

এক বা একাধিক পণ্য উত্পাদনী ইউনিট বন্ধ

বিসিআইসি

১৭

বিএসএফআইসি

১০

বিএসইসি

বিজেএমসি

বিটিএমসি

মোট

৩৯

১৯ (৪৮.৭%)

১১ (২৮.২%)

৫ (১২.৮%)

১০ (৩৩.৩%)

BCIC = Bangladesh Chemical Industries Corporation BSFIC = Bangladesh Sugar and Food Industries Corporation BSEC = Bangladesh Shipbuilding and Engineering Corporation BJMC = Bangladesh Jute Mills Corporation BTMC = Bangladesh Textile Mills Corporation. সূত্র: Rehman Sobhan and Ahmad Ahsan, ‘Disinvestment and Denationalisation: Profile and Performance’, Bangladesh Journal of Political Economy, Vol. 6, no. 2 (1983), p.30. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p.58.

বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত শিল্প-কারখানার দক্ষতার ওপর করা একটি অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে গবেষক জানিয়েছেন যে, বিভিন্ন খাতের মোট ৩৯টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ১৯টির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, ১১টির উৎপাদন কমে গিয়েছিল এবং ৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৪টি প্রতিষ্ঠান আউটপুটের কোনো ধরনের তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়।

অর্থনীতিবিদ এম. এম. আকাশের উদ্ধৃতি দিয়ে কামরুল আলম দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিখাতের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মার্শাল ‘ল কমিটি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭২-৮২ সাল পর্যন্ত এই দুটি সংস্থা ১ হাজার ২৪৮টি প্রকল্পে ঋণ অনুমোদন করে, যার মধ্যে মাত্র ৪৫০টি (৩৬ শতাংশ) প্রকল্প কার্যত চালু থাকলেও বাদবাকি অধিকাংশই ছিল কাগুজে; বাস্তবে যাদের কোনো হদিস ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১১ জন ‘উদ্যোক্তা’কে ৩৮৯.৫১ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে, যার মধ্যে ২০৭.১৬ কোটি টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।  ১৯৭৫ সালের আগে বিএসবি এবং বিএসআরএস-এর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি টাকা, যা ছিল অনুমোদনকৃত ঋণের ৪ শতাংশ। ১৯৭৫-৮১ সালে যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯২১.৮ কোটি টাকায়; যা মঞ্জুরিকৃত ঋণের ৯৬ শতাংশ।৩৬ বর্তমানের খেলাপি ঋণের যে হিড়িক দেখা যায়, তার সূচনা হয়েছিল এই সময়টাতেই। জনগণের করের অর্থে প্রদত্ত ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাগত অংশেরই প্রতিফলন। এই প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। জুন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ এবং অপরিশোধিত এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮৪.২ কোটি টাকা৩৭। পরবর্তীকালে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে। অনুমান করা যায়, যারা সামরিক সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত তাদের পক্ষেই সম্ভব হতো বড় আকারের ঋণ প্রাপ্তি এবং তাদের পক্ষেই সম্ভব হতো ঋণখেলাপি হয়েও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা।

যারা সামরিক সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারত তাদের পক্ষেই সম্ভব হতো বড় আকারের ঋণ প্রাপ্তি এবং তাদের পক্ষেই সম্ভব হতো ঋণখেলাপি হয়েও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা।

কোনো কোনো গবেষক বলতে চান যে, সরকার এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জৈবিক মৈত্রীবন্ধন ব্যক্তিখাতকে ‘সুশৃঙ্খল’ একটি কার্যকর আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে সর্বজনের সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের পক্ষে খুব দ্রুত ধনী হওয়া সম্ভব হয়। ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সংগ্রহকারী অল্পসংখ্যক উদ্যোক্তা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ক্রেতাদের পক্ষে সরকারের সাথে পারস্পরিক মৈত্রীবন্ধনের কারণে সুবিধা হয় ‘willful defaulters’ হওয়ার। একই গবেষণায় বলা হয় যে, অধিকাংশ খেলাপি ঋণের মালিকরা তাদের প্রাপ্ত অর্থ অনুৎপাদনী খাতে বিনিয়োগ করেছে এবং এমনকি ‘অবৈধ’ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করে প্রচুর অপ্রদর্শিত মুনাফা অর্জন করেছে। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। জিয়া সরকারের উদ্ধৃতি দিয়ে গবেষক বলছেন যে, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এর ফলে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত সম্পদের শতকরা ৪০ ভাগ বিনষ্ট হয়।৩৮

এই প্রক্রিয়ায় অর্থনীতির আকার যত বড় হতে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কোটিপতিদের সংখ্যা। উৎপাদিত সম্পদের হাতবদল ঘটে। সর্বজনের অধিকারের প্রাণ-প্রকৃতি-মাটি-জল-উৎপাদন ক্রমান্বয়ে শোষণ-দখলীকরণের প্রক্রিয়ায় ধনীদের ভান্ডার স্ফীত হতে থাকে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে (’৭২ সালে) যেখানে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। ১৯৮০ সাল থেকে আরও বাড়ে তার সংখ্যা; ৯৮ জনে।৩৯ ধনী পরিবার/গ্রুপগুলো আরও বড় আকার ধারণ করে, যারা আবার রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে; প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে।

(চলবে)

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৮

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১০

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। mehedihassan1@gmail.com 

তথ্যসূত্র:

১. শিরোনাম: Stranger in a Strange Land, Philip Farruggio, Apr 20, 2023, https://itstheempirestupid.com/stranger-in-a-strange-land/

২. আনু মুহাম্মদ, রাষ্ট্র আছে রাষ্ট্র নাই, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ২১-২২।

৩.—পূর্বোক্ত—পৃ. ২৩।

৪. আনু মুহাম্মদ, কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি, ২০০৮, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ৬২।

৫. Naomi Hossain, Productivity and Virtue: Elite Categories of the Poor in Bangladesh, Dhaka, World Development Vol. 33, No. 6, pp. 965-977, 2005, p.-967, doi:10.1016/j.worlddev.2004.09.018, www.elsevier.com/locate/worlddev.

৬. আনু মুহাম্মদ, রাষ্ট্র আছে রাষ্ট্র নাই, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ২০।

৭. কামরুল আলমের বক্তব্যটি ছিল এ রকম: ‘This social structure has produced a state where the rich peasants, trading and marketing intermediaries and small scale industrialists directly and/or indirectly influence the economic policies and strategies through their influence on the political process. This relationship between the state and the dominant groups does not encourage the creation of a congenial environment for capitalist industrialisation.’…A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 51.

‘This change of policy direction was not designed to improve industrial production but to accommodate the political pressure of the newly created rich who accumulated a huge amount of capital during the nationalisation period. The people of this new rich class either belonged to the dominant socio-economic groups or shared state power directly or indirectly.’—Ibid—p. 53.

৯. —Ibid—

১০. —Ibid—p. 53-54.

১১. ‘As the civil and military bureaucrats originated from the affluent social groups it was easy for them to form an alliance with the groups supporting the private sector.’—Ibid—p. 54.

১২. Fahimul Quadir, ‘The political economy of pro-market reforms in Bangladesh: Regime consolidation through economic liberalization?’ Contemporary South Asia, 9:2, 197-212, DOI: 10.1080/713658731, http://dx.doi.org/10.1080/713658731, p. 200.

১৩. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 54.

১৪. —Ibid—

১৫. —Ibid— p. 54-55.

১৬. —Ibid— p. 55.

১৭. ‘In order to deregulate the economy, General Zia’s military regime embarked on a disinvestment program and set up the Disinvestment Board which was given the responsibility for implementing announced privatization. It reactivated the Dhaka Stock Exchange and established an Investment Promotion Center in Dhaka designed to foster private investment. Further, Zia’s regime directed Development Finance Institutions (DFIs) to provide fnancial support to private entrepreneurs. As a result, the DFIs emerged as the major fnancial source of private investment over the next few years.’… Fahimul Quadir, ‘The political economy of pro-market reforms in Bangladesh: Regime consolidation through economic liberalization?’ Contemporary South Asia, 9:2, 197-212, DOI: 10.1080/713658731, http://dx.doi.org/10.1080/713658731. p. 199.

১৮. ‘The New Industrial Policy (NIP) offered the following facilities for the private sector: 1. Simplification of industrial investment schedule. 2. Investment advisory services for the preparation of project profiles. 3. Simplification of sanction procedures. 4. Decentralisation of sanctioning power. 5. Simplifying the licensing procedure for importing raw materials and machines. 6. Easing the terms of debt services. 7. Introduction of ‘One Stop Service’ to provide necessary services to the investors regarding processing of projects, acquisition of land, arrangement of power and gas, issuing of ad hoc licences for raw material importation, formation of companies, authorisation from controller of capital issue etc.23 To encourage the private sector the government disinvested two nationalised banks and allowed individuals to set up banks, insurance companies and other financial institutions in the private sector.’ A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 55.

১৯. Fahimul Quadir, ‘The political economy of pro-market reforms in Bangladesh: Regime consolidation through economic liberalization?’ Contemporary South Asia, 9:2, 197-212, DOI: 10.1080/713658731, http://dx.doi.org/10.1080/713658731. p. 200.

২০. Syed Serajul Islam: Relative State Autonomy and Development Strategy in Bangladesh, 1975-1981, Pacific Affairs, Vol. 59, No. 4 (Winter, 1986-1987), pp. 563-576, University of British Columbia, URL: http://www.jstor.org/stable/2758536 . Accessed: 17/06/2014, p. 566.

২১. A.M.A. Rahim, A Review of Industrial Investment Policy in Bangladesh, 1971-1977, Source: Asian Survey, Vol. 18, No. 11 (Nov., 1978), pp. 1181-1190, Published by: University of California Press Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2643300, p. 1183-1184.

২২. An act to promote foreign investment and protect the interests of foreign investors was passed by the Jatiyo Sangsad (Parliament) in 1980, which stated: (1) ‘Foreign investment shall not be expropriated or nationalized’; (2) if any foreign enterprise is nationalized for a public purpose, ‘adequate compensation shall be paid.’’—Ibid— p. 567.

২৩. Mohammad Dulal Miah, Yasushi Suzuki: Power, Property Rights, and Economic Development; The Case of Bangladesh, Palgrave Macmillan, Singapore, 2018, p. 93.

২৪. Syed Serajul Islam: ‘Relative State Autonomy and Development Strategy in Bangladesh, 1975-1981’, Pacific Affairs, Vol. 59, No. 4 (Winter, 1986-1987), pp. 563-576, University of British Columbia, URL: http://www.jstor.org/stable/2758536 . Accessed: 17/06/2014, p.568.

২৫. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 55.

২৬. A.K.M. Masudul Haque, ‘Privatisation in Bangladesh: A case of placing the cart before the horse’, [2002] UWSLawRw 6; (2002) 6(1) University of Western Sydney Law Review 124, http://classic.austlii.edu.au/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html#Heading10

২৭. M. A. Rahim, ‘A Review of Industrial Investment Policy in Bangladesh’, 1971-1977, Asian Survey, Vol. 18, No. 11 (Nov., 1978), pp. 1181-1190, Published by: University of California Press Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2643300, p. -1188.

২৮. A.K.M. Masudul Haque, ‘Privatisation in Bangladesh: A case of placing the cart before the horse’, [2002] UWSLawRw 6; (2002) 6(1) University of Western Sydney Law Review 124, http://classic.austlii.edu.au/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html#Heading10

২৯. M. A. Rahim, ‘A Review of Industrial Investment Policy in Bangladesh, 1971-1977’, Asian Survey, Vol. 18, No. 11 (Nov., 1978), pp. 1181-1190, Published by: University of California Press Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2643300, p. 1189.

. Tanweer Akram, ‘Privatization of Public Enterprises in Bangladesh: Problems and Prospects’, Columbia University, ‍Savings and Development, Vol. 24, No. 4 (2000), pp. 439-458,http://www.jstor.ore/stable/25830742, p. 441.

. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 55.

৩২. A.K.M. Masudul Haque, ‘Privatisation in Bangladesh: A case of placing the cart before the horse’, [2002] UWSLawRw 6; (2002) 6(1) University of Western Sydney Law Review 124, http://classic.austlii.edu.au/au/journals/UWSLawRw/2002/6.html#Heading10

৩৩. A.M. Quamrul Alam (1989), ‘Privatisation policy and the problem of industrial development in Bangladesh’, South Asia: Journal of South Asian Studies, 12:2, 49-68, DOI: 10.1080/00856408908723127, http://dx.doi.org/10.1080/00856408908723127, p. 56.

৩৪. —Ibid—p.57.

৩৫. —Ibid—p. 58.

৩৬. —Ibid—

৩৭. —Ibid— p. 59.

৩৮. Fahimul Quadir, ‘The political economy of pro-market reforms in Bangladesh: Regime consolidation through economic liberalization?’ Contemporary South Asia, 9:2, 197-212, DOI: 10.1080/713658731, http://dx.doi.org/10.1080/713658731. p. 202.

৩৯. শিরোনাম: ‘৬ মাসে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩’, গোলাম মাওলা, ৮ জানুয়ারি ২০২১ https://www.banglatribune.com/national/661103/যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ও-জাপানের-চেয়েও-দেশে-কোটিপতি

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •