শ্রমজীবী মানুষের দিনলিপি
জীবন যেখানে যেমন
মওদুদ রহমান
উন্নয়নের হট্টগোলের আড়ালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিদিনের জীবন কিংবা লড়াইএর কিছু খন্ডচিত্র…
‘আমরা হইলাম ফাও মানুষ’
ঘোমটা টানা হালিমা বেগমের স্বাস্থ্য একেবারে রোগা লিকলিকে। স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা দৈহিক গড়নের কারণে হয়তো ওনার হালকা-পাতলা গড়ন আরও বেশি করে চোখে পড়ে। মাথায় পাতলা হয়ে আসা চুলে কাঁচা অংশের চেয়ে পাকা অংশের পরিমাণ বেশি। পরনে সালোয়ার-কামিজ। বেশ কয়েকটা দাঁত পড়ে যাওয়ায় হয়তো গালদুটো চোয়ালের গর্তে ঢোকানো। উনি কথা বলেন কম, শোনেন বেশি। কিন্তু ওনার বলা প্রতিটা শব্দের উচ্চারণ স্পষ্ট ও উঁচু।
কথা বলতে বলতে জানতে চাই, ‘কত বছর ধরে ডাব বিক্রি করছেন?’
জবাব আসে, ‘ত্রিশ বছর।’
‘এই এলাকাতেই ত্রিশ বছর ধরে আছেন? নাকি আগে অন্য জায়গায় ছিলেন?’
‘না, এইহানেই ত্রিশ বছর। আগে এলাকার দোকানে দোকানে সরকারি কল থিইক্যা পানির সাপ্লাইও
দিতাম। অহন সরকারি কলও নাই। পানির সাপ্লাইও বন্ধ।’
হালিমা বেগম ডাব বিক্রি করেন বড় রাস্তার ধারে একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় বিল্ডিংয়ে ঢোকার ঠিক সামনে ছোটমতো একটা জায়গায়। উনি বসেন মেঝেতে। সামনে প্লাস্টিকের একটা উলটো করে রাখা বাক্সের ওপর ৮-১০টা ডাব। আর ঠিক ওনার পেছনে ৩০-৪০টা ডাব রাখা। ডাবগুলোর ওপরে একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা।
‘এই বসার জায়গার ভাড়া দেন কত?’
হাসতে হাসতে জবাব আসে, ‘আমার কোনো ভাড়া দেওয়া লাগে না। এই বিল্ডিং আমার চোখের সামনে হইছে। মালিক অনেক আগের পরিচিত।’
‘দোকানের অন্য কোনো খরচ আছে? কারেন্ট বিল? চাঁদা?’
‘না, অন্য কোনো খরচ নাই। আমার কাছে কে আর চান্দা চাইবো! সবাই আমারে চেনে। আমিও চিনি সবাইরে।’
‘বেচাবিক্রি শুরু করেন কখন?’
‘সকাল ৭টা টু রাইত ১০টা’
‘সকাল ৭টা! এত সকালে?’
‘হ। তহন মানুষ যারা হাঁটতে বাইর হয়, হেরা অনেকে ডাব খায়।’
‘আপনি ঘুম থেকে ওঠেন কখন?’
‘ভোর সাড়ে ৪টা থিইকা ৫টার মধ্যে উঠি। মুখ-হাত ধুই। নামাজ-কালাম পইড়া রানতে বহি। এরপর খাইয়া বাইর হইতে হইতে ৬টা, সাড়ে ৬টা। এরপর আড়তে যাই। দেইখ্যা ডাব কিনি। ডাব লইয়া আইতে আইতে ৭টা বাজে।’
‘আপনার পরিবারে কে কে আছে?’
‘আমি আর আমার মা।’
‘আপনার স্বামী-সন্তান?’
‘আমার স্বামী মইরা গেছে অনেক বছর। কোনো পোলাপান নাই।’
‘আপনার মায়ের বয়স কত?’
‘আশি-নব্বই হইবো।’
‘উনি হাঁটাচলা করতে পারেন?’
‘হ। করতে পারে। হেই তো বাজার করে। আমি প্রতি সকালে বাইর হওনের আগে হের লিইগ্যা দুপুরের খানা রান্দি। আর নিজে সকালে খাই।’
‘কী কী বাজার করেন আপনার মা?’
‘চাইল-ডাইল, তেল, শাক এইগুলা’
‘মাছ-মাংস?’
‘মাছ-মাংস কই থেইকা খামু? ব্রয়লারের কেজি ২৫০! পাঙাশ ১৮০! আগে দাম কম থাকতে হপ্তায় এক দিন, দুই দিন খাইতাম। ওহন ওইগুলি হইছে বড়লোকগো খাওন।’
‘আপনার রেশন কার্ড নাই?’
‘না, নাই। এলাকার চেয়ারম্যান, কাউন্সিলরের লগে খাতির না থাকলে এই কার্ড হয় না।’
‘অনেকেই তো কার্ড পাইছে।’
‘হ। পাইছে তো। অনেকের ডাবল ডাবল আছে। সব হইলো হেরা হেরা। ভাই-বেরাদার। আমরা হইলাম ফাও মানুষ।’
‘আপনার তো অনেক পরিচিত। কোনোভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন নাই?’
‘আমার এই দৌড়াদৌড়ির টাইম নাই। দুই কেজি চাইল, দুই কেজি ডাইল নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়ায় থাকতে হয়। আমি ডাব বেচুম! নাকি লাইনে খাড়ামু!’
‘কয়টার মতো ডাব বিক্রি হয় দিনে?’
‘টার্গেট থাকে ৫০টা। তয় কহনো ৩০টাও বেচা হয়, আবার কহনো ৬০টা।’
‘লাভ কেমন থাকে?’
‘লাভ হয়। কিন্তু হাতে তো কিছু থাহে না। আগে আড়ত থিইক্যা এইহানে আইতে রিকশা ভাড়া হাসিমুখে নিতো ২০ টেকা। আর অহন ৫০ টেকা দিলেও আইতে চায় না। মুখ কালাকালি করে।’
‘দুপুরে কোথায় খান?’
‘এইহানেই খাই। হোটেল থিইক্যা চা আনি। বিস্কুট দিয়া খাই।’
‘ভাত খান না?’
‘দোকান একলা চালাই। ভাত খাওনের টাইম নাই। দোকানে কেউ না থাকলে কাস্টমার আইয়া ফেরত গেলে দোকানের নাম খারাপ অয়। আর হোটেলে ভাত-তরকারির যেই দাম। খাইয়া পোষায় না।’
‘আপনার মা সরকারি কোনো ভাতা পায়? বা সরকারি কোনো সাহায্য?’
‘না। কিচ্ছু পায় না। এই কয়দিন আগেও শীতের সময় এমপি সাবের নামে কম্বল দিতে দেখলাম। আশপাশের সবাই কইলো তুই যা, গেলে পাবি। গেলাম। যাইয়া দেহি শ্যাষ। সব দোকানদার পাইছে। আমি পাইলাম না। আমিই বড়লোক। আর দোকান মালিকরা আমার থিইক্যা গরিব। নইলে আমি পামু না ক্যান, কন তো!’
‘আপনার দোকানের কোনো বন্ধ নাই?’
‘না। আল্লায় চাইলে আমার মরণের দিনে দোকান বন্দ। দোকান না খুললে খামু কী! মাস গেলে সাড়ে তিন হাজার টেকা ঘরভাড়া, ৫০০ টেকা কারেন্টের বিল। ডেইলি বাজারের খরচ ২০০ টেকা! এক দিন দোকান না খুললে পুঁঞ্জিতে টান পড়ে। দোকান বন্দ করনের টাইম নাই।’
‘বৃষ্টির দিনে বিক্রি কি কম হয়?’
‘হ। তহন ইট্টু কম অয়। তয় হয়। কম-বেশি মিলাইয়াই তো ব্যাবসা।’
‘ত্রিশ বছরের ব্যবসায় কোনো পরিবর্তন দেখেন?’
‘হ। ডাবের দাম তো বাড়ছে। আগে ১৫, ২০ টেকায় ডাব বেচছি। অহন তো ৬০ টেকা, ৮০ টেকায় ডাব বেচি। তয় খরচও বাড়ছে। আগে ঘরভাড়া দিতাম ৫০০ টেকা। অহন দেই সাড়ে তিন হাজার টেকা।’
জিজ্ঞেস করি, ‘আগে ভালো ছিল বেশি? নাকি এখন বেশি ভালো?’
জবাব আসে, ‘আমাগো আর ভালো-মন্দ। যদ্দিন কর্ম করতে পারুম, ততদিন খানা আছে। কর্ম শ্যাষ, খানা শ্যাষ। আমরাও শ্যাষ।’
‘যতদিন শরীর চলব, কাম করুম। এরপর জানি না’
হালকা জলপাই রঙের জামা, প্যান্ট গায়ে আর পায়ে বুটজুতা পরা জামাল উদ্দিনের ডিউটি এক এটিএম বুথের গার্ড হিসেবে। ওনার বাড়ি ফরিদপুর। প্রায় ২০ বছর ধরে আছেন নিরাপত্তাপ্রহরীর পেশায়। পাঁচ বছর আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে কাজ নিয়েছেন এটিএম বুথের গার্ডের চাকরি। তার আগে বিভিন্ন অফিস, বাসাবাড়িতে প্রহরীর কাজ করতেন।
জানতে চাইলাম, ‘বাসাবাড়ির কাজের সঙ্গে এটিএম বুথে কাজের পার্থক্য কী?’
‘বাসাবাড়িতে, অফিসে গার্ডের চাকরিতে ছোটাছুটি আছে। বাসার আলগা কাজ করা লাগে, অফিসে এইটা-ওইটা করা লাগে। এটিএমের কাজে এসব নাই। এইটা যেমন আরামের। আবার সমস্যাও আছে। এটিএমের গার্ডের উপরি কামাই নাই। বাসাবাড়িতে স্যার-ম্যাডামরা খুশি হইয়া টাকা-পয়সা দেয়। এটিএমে এসব নাই।’
‘এখানে সুযোগ-সুবিধা কেমন?’
‘সুযোগ-সুবিধা বলতে শিফটের ওপর আপনার ইনকাম। দিনে এক শিফট আট ঘণ্টা, দুই শিফট ষোলো ঘণ্টা। মাসে ত্রিশ দিন এক শিফট ডিউটি করলে আট হাজার টাকা, দুই শিফট করলে ষোলো হাজার।’
শিফটের ওপর আপনার ইনকাম। দিনে এক শিফট আট ঘণ্টা, দুই শিফট ষোলো ঘণ্টা। মাসে ত্রিশ দিন এক শিফট ডিউটি করলে আট হাজার টাকা, দুই শিফট করলে ষোলো হাজার।’
সাপ্তাহিক ছুটি আছে?
‘না। এই কামে কোনো ছুটি নাই। ডিউটি করলে বেতন খাড়া, ডিউটি নাই, বেতনও নাই।’
‘আপনি কয় শিফটে কাজ করেন?’
‘আমি ডেইলি দুই শিফটে থাকি। ভোরে শুরু করি, রাইতে যাই। বাসায় যাইয়া মনে করেন খাই আর ঘুমাই। ভোরে এই বুথে আইসা ভিতরের দিকে একটা জায়গা আছে। ফ্লোরে চাদর বিছাইয়া ওই জায়গায় দুই ঘণ্টা ঘুম দিয়া উঠি। এরপর পাশের বুথের গার্ডরে দায়িত্ব দিয়া হোটেলে গিয়া নাশতা খাই। এরপর সারা দিন এমনে এমনেই যায়।’
‘প্রতিদিন ষোলো ঘণ্টা করে কাজ করেন? কখনো শরীর খারাপ লাগে না?’
‘খারাপ তো লাগেই। আমি স্ট্রোকের রোগী। গরমে মাথা ঝিমঝিম করে। বাসায় রেস্ট নিলে তো মনে করেন আমার লস। এক দিন ডিউটি না করলে ওই দিনের টাকা কাটা। এই কয়টা টাকাই তো পাই। এর ভিতরেও কাটাকাটি করলে সংসার আর চলে না, ভাই।’
‘আপনার পরিবারে কে কে আছে?’
‘আছে আমার বউ আর আমার মেয়ে। মেয়েটা পড়ে ক্লাস এইটে।’
‘ওনারা কি আপনার সঙ্গেই থাকেন?’
‘না। পরিবার থাকে ফরিদপুর। আমি এইখানে মেসে থাকি।’
‘বাড়ি যান কয়দিন পরপর?’
‘বাড়ি যাইতে পারি না, ভাই। বিকাশে টাকা পাঠায় দেই। বাড়ি আর যামু কখন! এই এটিএমই আমার ঘরবাড়ি।’
‘মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয় প্রতিদিন?’
‘ডেইলি হয় না। মোবাইলে কথা কইতেও তো টাকা লাগে। মাঝে মাঝে হয়। আমার মাইয়াডা এই কয়দিন আগপর্যন্তও মনে করত যে ওর বাপে বুঝি বিদেশ থাকে। অহন একটু বড় হইছে। অহন বুঝে যে বাপে শহরে কাম করে।’
‘আপনার স্ত্রী-মেয়ে কখনো আসে আপনার সঙ্গে থাকতে, বেড়াতে?’
‘না। আইলে রাখুম কই। আমি থাকি মেসে। দুই বছর আগে একবার আইছিলো। ডাক্তার দেখাইতে। সকালে আইছে। সন্ধ্যার ফিরতি গাড়িতে তুইলা দিছি।’
‘আপনার বা আপনার পরিবারের কারো রেশন কার্ড আছে?’
‘না, নাই। আমি এই এলাকায় আছি পাঁচ বছর হইলো। এলাকার কাউন্সিলর আমার বন্ধুমানুষ। কিন্তু ওর কাছে গিয়া কার্ড চাইতে লজ্জা লাগে। ও কিন্তু জানে যে আমি গার্ডের কাম করি। কিন্তু আমারে ডাক দিয়া যে দিবো হেইডা দেয় না। তয় পাইলেও লাভ হইতো না। গাড়ির সামনে-পিছে যে পরিমাণ লাইন হয়, আমার ডিউটি বাদ দিয়া লাইনে খাড়াইলে লাভের চেয়ে লস হইবো বেশি।’
‘নতুন বছরে বেতন বাড়ার কথা কিছু জানাইছে অফিস থেকে?’
‘বেতন বাড়ানোর কথা তো বহুত আগের। দিবো-দিচ্ছি কইয়া কইয়া সময় নিতাছে। আর আমি যেই কোম্পানির কাম করি, ওইডাও ভালো না। ব্যাংক আমগোরে দেয় মনে করেন প্রতি শিফটে বারো হাজার। কোম্পানি কাইটা রাখে চার হাজার। ড্রেসের ভাড়া, কোম্পানির কমিশন বাদ দিয়া আমরা হাতে পাই আট হাজার। এইভাবেই চলতাছে।’
ব্যাংক আমগোরে দেয় মনে করেন প্রতি শিফটে বারো হাজার। কোম্পানি কাইটা রাখে চার হাজার। ড্রেসের ভাড়া, কোম্পানির কমিশন বাদ দিয়া আমরা হাতে পাই আট হাজার। এইভাবেই চলতাছে।’
‘আপনাদের দাবি-দাওয়া তোলার কোনো জায়গা নাই?’
‘থাকতে পারে। আমি জানি না। কথা কইলেই তো কইবো যে ডিউটি বন্ধ। সব তো তাগো হাতে। তাই কিছু কই না। দেহি কবে বাড়ে বেতন!’
‘আশপাশের অন্যান্য এটিএম বুথ গার্ডদের কী অবস্থা?’
‘হেরা আরও কষ্টে আছে। আমার কোম্পানিই সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। অন্য সব বুথে মাসে এত টাকা কেউ পায় না। আবার মনে করেন যে, যেসব কোম্পানি ঘণ্টা হিসাবে টাকা দেয়, ওই রেট অনেক ভালো। কিন্তু আপনে যে ডেইলি ডিউটি পাইবেন এর কোনো গ্যারান্টি নাই।’
‘কোনো বোনাস নাই?’
‘না। কোনো বোনাস নাই। আলগা ইনকাম বলতে ধরেন ঈদের সময় কেউ কেউ টাকা তোলার পর হয়তো দুইশ, পাঁচশ বকশিশ দিলো–এইডাই। আর কোনো ইনকাম নাই।’
জানতে চাই জামাল উদ্দিনের মনের অবস্থা। উনি এই চাকরি নিয়ে কতটা খুশি, কতটা আশাবাদী।
জবাব আসে, ‘এই জীবন হইলো কচুরিপানার মতন। এই জীবনে খুশি-অখুশির বিষয় নাই। চাকরি আছে, বেতন আছে। বউ, মাইয়া বাঁইচা আছে। আমি খাইতাছি, বাঁইচা আছি। এইডাই বহুত। যতদিন শরীর চলব, কাম করুম। এরপর জানি না।’
‘কোনো কাজে আমার লজ্জা নাই’
সুমন আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় বইমেলা থেকে ফেরার পথে। রিকশা চালাতে চালাতে উনি আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলা শুরু করেন। মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে বিশাল জ্যামে আটকা পড়ায় আমাদের টুকটাক কথা রূপ নেয় খোশ গল্পে। কথায় কথায় জানা হয় ওনার জীবন, পরিবার, ভবিষ্যৎ আর স্বপ্ন সম্পর্কে।
সুমন আলীর বাড়ি নীলফামারী। উনি সেখানে এক কলেজে পড়ছেন। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। মাসের বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকেন। যখন পরীক্ষা থাকে বা কোনো কাজ থাকে তখন যান বাড়িতে।
জিজ্ঞেস করি, ‘ক্লাস নিয়মিত করা লাগে না?’
সুমন আলী বলেন, ‘না, ক্লাস না করলেও চলে। কলেজে শুধু পরীক্ষা দিতে যাই।’
‘পড়াশোনা কোথায় করেন?’
‘এইখানে তো পড়াশোনা হয় না। সারা দিন রিকশা চালাই। গ্যারেজে গিয়া খাইয়াই ঘুম। পড়াশোনা করার সময় পাই না। বাড়িতে গিয়ে পরীক্ষার আগে পড়ি।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘বাবা, মা আর বড় ভাই আছে।’
জানতে চাইলাম কে কী করে।
‘বাবা খেতে চাষবাস করে। আমাদের নিজেদের খেত আছে। মা সংসার দেখে। বড় ভাই এলাকায় অটো চালায়।’
‘কী চাষ হয় জমিতে?’
‘ধান চাষ করে।’
জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে তো আর আপনাদের চাল কিনে খেতে হয় না?’
হাসিমুখে জবাব আসে, ‘না। চাল কিনতে হয় না। বছরের খোরাকির চাল রাইখ্যা কয়েক মন ধান বিক্রিও করতে পারি।’
‘আপনি ঢাকা আছেন কতদিন?’
‘করোনার সময় হইতে শুরু। এর আগে ঢাকা কখনো আসি নাই। করোনার সময় স্কুল-কলেজ যখন সব বন্ধ দিয়া দিলো, তখন আসলাম ঢাকা। তখন কয়দিন ঘুইরা গাজীপুরে একটা গার্মেন্টসে কাজে ঢুকছিলাম।’
‘গার্মেন্টসে কাজ কতদিন করলেন?’
‘এক বছরের মতো।’
‘ওই কাজ ছাইড়া দিলেন কেন?’
‘গার্মেন্টসে কাজে তো ছুটি নেওয়ার সুযোগ নাই। এরপর আমার কলেজ শুরু হইল। পরীক্ষা শুরু হইল। বাড়ি যাওয়া লাগত প্রায়ই। তাই ওই কাজ ছাইড়া দিলাম।’
বেতন কেমন ছিল?
‘এন্ট্রি লেভেলের বেতন ছিল, ওভারটাইমসহ সাড়ে ছয় হাজার টাকা পাইতাম।’
‘বাড়িতে পাঠাইতে পারতেন কিছু?’
‘অল্প কিছু। খাওয়া খরচ দেওয়ার পর তেমন কিছু হাতে থাকত না। গার্মেন্টসে যারা জামাই-বউ দুজনে কাজ করে, তাগোর অনেক সুবিধা। কয়েক বছর কাজ করলে দশ-বারো হাজার টাকা বেতন হইলে দুজনে মিইল্যা বিশ-বাইশ হাজার টাকা হয়। ওইডা সুবিধা।’
জানতে চাইলাম, ‘রিকশা চালিয়ে আয়-রোজগার কেমন?’
‘আয়-রোজগার খারাপ না। খরচা বাদ দিয়া পাঁচশ টাকার মতো থাকে।’
‘খাওয়াদাওয়া করেন কোথায়?’
‘সকালে আর রাতে খাই গ্যারেজে। ১২০ টাকা রোজ। দুপুরে বাইরে কোনো একটা হোটেলে খাই। যখন যেখানে সুবিধা।’
‘কী কী থাকে খাবারে?’
‘সকালে ভাত-ডাল আর সবজি। রাতে মাছের তরকারি আর ডাল। সপ্তাহে এক দিন মুরগির মাংস দিত আগে। কয়েক সপ্তাহ থেকে দিচ্ছে না। ডিম দেয় এখন।’
‘ঘুমান কোথায়?’
‘গ্যারেজে।’
‘ভাড়া দেওয়া লাগে না?’
‘না। মহাজনের গ্যারেজ। খালি রিকশার জমা একশ টাকা দিলেই চলে। আর কোনো খরচ নাই।’
‘সামনে কী করার প্ল্যান আপনার?’
‘পড়াশোনা শেষ করি আগে। দেখি কী করা যায়। ইচ্ছা আছে এনজিওতে চাকরি নিব। আমি সুপারভাইজারের কাজও জানি।’
‘কীভাবে জানেন? কোথাও সুপারভাইজার হিসেবে কাজে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। নীলফামারীতে কিছুদিন রুটি-বিস্কুট কোম্পানির সাপ্লাই সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছি।’
‘বাহ্! আপনি তো দেখি অলরাউন্ডার!’
‘হইতে পারে। কোনো কাজে আমার লজ্জা নাই। যখন যা করা লাগে করি।’
‘কামের কষ্ট আমার অভ্যাস হইয়া গেছে’
শিউলীর দিন শুরু হয় ভোর ছয়টায়। ঘুম থেকে উঠে ভাই-বোন, স্বামী-সন্তানদের জন্য রান্না চড়াতে হয়। শিউলীর এক ভাই কাজ করেন নিউমার্কেটে এক পোশাকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে। আর বোন কাজ করেন গার্মেন্টসে। বোনের ডিউটি শুরু হয় সকাল ৮টায়। ভাইয়ের সকাল ১০টায়। শিউলীর স্বামী অসুস্থ। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আলাদা সংসারে থাকে। ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে, সেখানেই থাকে।
জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কাজে বের হন কখন?’
‘সাড়ে আটটায়’
‘কয় বাসায় কাজ করেন?’
‘দুই বাসা। এক বাসায় বান্দা কাম। আরেক বাসায় লাগলে ফোন দেয়।’
‘কী কী কাজ করেন?’
‘আমি সব কাম করি। নাশতা বানাই। থালা-বাটি ধুই। কাপড় ধুই। ঘর পরিষ্কার করি। মাছ-মাংস কাটি–যা যা কাম আছে সব করি।’
‘কতক্ষণ কাজ করা লাগে?’
‘টাইমের কোনো ইস্টিশন নাই। কাম বেশি থাকলে বিকাল হয়, সন্ধ্যা হয়। কাম কম থাকলে ধরেন তিনটা, চারটা বাজে।’
‘বেতন কত?’
‘বান্দা বাসায় দেয় সাড়ে ছয় হাজার। আর প্রতিদিন গাড়ি ভাড়া বিশ টাকা। আর ছুটা কামের বাসায় কাম অনুযায়ী টাকা দেয়। কোনোদিন একশ, কোনোদিন দেড়শ।’
‘দুপুরের খাবার খান কোথায়?’
‘যেই বাসায় কাম করি। ওনারা যা খায়, আমারে সাধে। আমি বেশিরভাগই খাই না। ভরা পেটে কাম করন যায় না। ঝিমানি ধরে।’
‘আপনার স্বামী কী করে?’
‘আগে রিকশা চালাইতো। তিন মাস ধইরা ঘরে। শরীর ফুইল্যা গেছে। পানি আইছে শরীরে। এহন ঘরে। কোনো কাম করতে পারে না।’
‘আগে কেমন ইনকাম ছিল?’
‘যহন রিকশা চালাইতো, তহন দিনে পাঁচশ টেকা কইরা আমারে দিতো। মনে করলাম, ভাড়া রিকশার চেয়ে নিজের রিকশায় লাভ বেশি হইবো। কিস্তি থিইক্যা টেকা উঠাইয়া পঁয়ত্রিশ হাজার টেকা দিয়া মোটরের রিকশা কিইন্যা দিলাম। রিকশা কিনার দুই মাসের মইধ্যে শরীর খারাপ। অহন রিকশা গ্যারেজে আর আমার মাথার ওপরে কিস্তির দেনা।’
‘যহন রিকশা চালাইতো, তহন দিনে পাঁচশ টেকা কইরা আমারে দিতো। মনে করলাম, ভাড়া রিকশার চেয়ে নিজের রিকশায় লাভ বেশি হইবো। কিস্তি থিইক্যা টেকা উঠাইয়া পঁয়ত্রিশ হাজার টেকা দিয়া মোটরের রিকশা কিইন্যা দিলাম। রিকশা কিনার দুই মাসের মইধ্যে শরীর খারাপ। অহন রিকশা গ্যারেজে আর আমার মাথার ওপরে কিস্তির দেনা।’
‘ব্যাটারি রিকশা অন্য কাউকে দিয়ে ভাড়ায় চালানো যাবে না?’
‘যাইবো। তয় পরিচিত না হইলে রিস্ক আছে। রিকশা লইয়্যা পলায় যাওনের চান্স আছে। তাই গ্যারেজে থুইয়্যা দিছি।’
‘গ্যারেজের ভাড়া কত?’
‘দিনে দশ টেকা।’
‘আপনার বাসাভাড়া কত?’
‘সাড়ে নয় হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিল আলাদা।’
‘আপনার ভাই-বোন সংসার খরচ কত দেয়?’
‘ভাই বেতন পায় নয় হাজার টাকা। আমারে সপ্তাহে দেয় বারোশ টাকা। বইনে একটা ঘরের ভাড়া দেয় চাইর হাজার আর বাজার খরচ হিসাবে দেয় দেড় হাজার।’
‘বাকি বাজার খরচ কে দেয়?’
‘আমিই দেই। আর কে দিবো। আমার মায় যহন বাইচ্চা আছিলো, তহন পুরা সংসার একলা টানছে। অহন মায় নাই। আমি বড় বইন। আমারই তো করন লাগবো।’
‘খরচে টান পড়ে না কখনো?’
‘পড়ে। কারো অসুখ-বিসুখ হইলেই বাড়তি খরচ। তহন টান পড়ে। তহন কিস্তিওলাগো থিইক্যা কিস্তি উঠাই।’
‘আপনার রেশন কার্ড আছে?’
‘না।’
‘কখনো কার্ড নেওয়ার চেষ্টা করেন নাই?’
‘না। শুনছি অনেক দৌড়াদৌড়ি করা লাগে। চেয়ারম্যানের অফিসে যাওয়া লাগে। আমার তো কামে ছুটি নাই। আমি ক্যামনে দৌড়ামু। আর আমার ভাই-বইনও তো চাকরি করে। সময় কই!’
বললাম যে, ‘এত দৌড়াদৌড়ি করে উঠায় নেওয়ার পর তো অনেক সুবিধা। কম দামে চাল, ডাল, তেল পাওয়া যায়।’
জবাব আসে, ‘কই সুবিধা! আমগো এলাকায় যাগো কার্ড আছে, কেউ কি শান্তিতে জিনিস আনতে পারে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়ায় থাকে। এক দিন দেয় তো আরেক দিন নাই। এমনও আছে, লাইনে সারা দিন দাঁড়ানির পর কইয়া দিলো যে আইজ আর মাল নাই। আমগো কি আর অত টাইম আছে!’
‘আপনি বাজারে যান?’
‘হ। বাড়ি ফিরনের সময় বাজারে যাই। যা যা লাগে কিনি।’
‘বাসায় রান্না করে কে?’
‘আমিই করি। তয় হেইডা তো আরেক কাহিনি।’
‘কি কাহিনি?’ জানতে চাইলাম।
‘গ্যাসের চুলার গ্যাস আহে রাইত ১২টার পর। হেই পর্যন্ত যাইগা থাকি। এরপর রান্দি। এরপর খাই।’
‘গ্যাসের চুলার গ্যাস আহে রাইত ১২টার পর। হেই পর্যন্ত যাইগা থাকি। এরপর রান্দি। এরপর খাই।’
‘প্রতিদিন এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন?’
‘হ। সিলিন্ডারের যেই দাম। একটা সিলিন্ডার কিনছি। ওইডা সবসময় জ্বালাই না। যহন গ্যাস একদমই আহে না, তহন সিলিন্ডারের চুলায় রান্দি।’
‘আপনার কাজে কোনো ছুটি নাই?’
‘না। কোনো ছুটি নাই। বছরের প্রত্যেক দিন কাম।’
‘ঈদের দিন?’
‘হ। ঈদের দিনও কামে যাই। রোজার ঈদের দিন আগে আগে ছুটি পাই। তয় কোরবানির ঈদের দিন কাম তো অনেক। হেইদিন বাসায় আইতে আইতে রাইত ১১টা, ১২টা বাজে।’
‘এই যে প্রতিদিন কাজে যান। কোনো ছুটি নাই। পরিবারে সময় দিতে পারেন না। খারাপ লাগে না?’
‘লাগে। কিন্তু কিছু তো করনের নাই। আমি এই কাম করি আইজ সতেরো বৎসর। কামের কষ্ট আমার অভ্যাস হইয়া গেছে।’
মন্তব্য
আমাদের যে উন্নয়ন দেখানো হয়, যা কিছু উন্নয়ন বলে বোঝানো হয়, তা আসলে কাদের উন্নয়ন সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন বটে। এমন তো নয় যে, বিত্তশালীদের অর্থকড়ির বাড়বাড়ন্ত দেখে হালিমা বেগমদের চোখ টাটায়! তবে সত্যিটাও তো অস্বীকারের উপায় নেই। জামাল উদ্দিনের ষোলো হাজার টাকা অনিয়মিত বেতনে তিনজনের সংসার চালানোর জীবন যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি কেবল এক বছরের ব্যবধানে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় গড়ে ওঠার তথ্যটাও সত্যি (যুগান্তর, জুন, ২০২২)। ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তার জ্যামে আটকে থাকা রিকশাচালক সুমন আলীর সংসারের দায়িত্ব পালন আর কলেজের ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখা জীবনের গল্পটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি ২০১৮ সাল থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে নতুন গাড়ির আমদানি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার তথ্যটাও সত্যি (প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
অর্থনীতির হিসাবের মারপ্যাঁচের জটলা খুলে ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নেওয়া তো দূর, জীবন টিকিয়ে রাখার ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত থাকা জামাল উদ্দিন, হালিমা বেগম, আর সুমন আলীদের জীবনে ধনী বনাম গরিবের বাড়তে থাকা অসমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। হয়তো এ কারণেই জানা হয় না, যে দেশে বাণিজ্যের আড়ালে বছরপ্রতি পাচার হয় গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা (প্রথম আলো, মার্চ-২০২০), সেই ১৭ কোটি মানুষের দেশে কী কারণে মাত্র ৯টি সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় রেডিওথেরাপির মেশিন থাকে মাত্র ২০টি, যেগুলোর মধ্যে আবার ১১টিই নষ্ট! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত তিন লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়। আর বছরে এক লাখের বেশি রোগী মারা যায় (বণিক বার্তা, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
যে দেশে বাণিজ্যের আড়ালে বছরপ্রতি পাচার হয় গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা (প্রথম আলো, মার্চ-২০২০), সেই ১৭ কোটি মানুষের দেশে কী কারণে মাত্র ৯টি সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় রেডিওথেরাপির মেশিন থাকে মাত্র ২০টি, যেগুলোর মধ্যে আবার ১১টিই নষ্ট! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত তিন লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়। আর বছরে এক লাখের বেশি রোগী মারা যায়।
বিজ্ঞাপনের রঙিন চশমা চোখে বায়োস্কোপের খোপে চোখ রাখলে দেখা যায়, মেট্রোরেলের সর্পিল লাইন, হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ খরুচে উন্নয়নের স্লোগান সংবলিত ডিজিটাল সাইনবোর্ড, চকচকে দামি সব গাড়ি, বাহারি জিনিসপত্রে ঠাসা সুপার শপ, শপিং মল, কফিশপ, ফাস্টফুডের দোকান। আর সেই খোপ থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে এলেই দমবন্ধ হয়ে আসে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত নগরী ঢাকার দূষিত বাতাসে। ধার করে ঘি খাওয়া স্বভাবের বরাতে একের পর এক মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন হচ্ছে, আর অন্যদিকে আমাদের প্রত্যেকের মাথার ওপর রয়েছে ৯৬ হাজার টাকা ঋণের বোঝা, যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে (যুগান্তর, জুন-২০২২)।
যে উন্নয়নের আয়োজনে সুমন আলী বাদ পড়ে যায়, সে উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। যে হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশে খরচ বাঁচাতে হালিমা বেগমের দুপুরের খাওয়া বাদ দিতে হয়, সে দেশের শানশওকত কাদের রক্ত পানি করা শ্রমে তৈরি হয়, আর কাদের পকেটে গিয়ে জমা হয়, তা খুঁজে দেখার দরকার আছে।
পুনশ্চ:
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে আলাপচারিতায় অংশ নেওয়া সবার কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
মওদুদ রহমান: প্রকৌশলী, লেখক | ইমেইল: mowdudur@gmail.com