তিস্তা সোলার পাওয়ার: আলোর নিচে অন্ধকার

তিস্তা সোলার পাওয়ার: আলোর নিচে অন্ধকার

শহিদুল ইসলাম সবুজ

বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে দেশি বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর অপরিমিত লোভ ও লুন্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। অনেক ভালো, সুলভ ও পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রস্তাব করা সত্ত্বেও ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর, বিদেশি কোম্পানি নির্ভর এবং প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুতের মেগা প্রকল্প করে দেশকে এক ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ফেলা হয়েছে। সারাবিশ্বেই এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখন উচ্চকিত, দেশের ভেতরেও এসবের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। এই চাপে সরকার এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের নানা প্রকল্প দেখাচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এগুলো সুলভ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের বদলে প্রতারণামূলক ভাবে কিছু লুটেরা দখলদার হিসোবে প্রমাণিত একই ধরনের গোষ্ঠীকে জমি দেয়া, উচ্চ দামের চুক্তি করে তাদের বিপুল ও নিশ্চিত উচ্চ ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার উদ্দেশ্যে পরিচালনা করা হচ্ছে। সেজন্য জোরজুলুম করে জমি নেয়া, পুলিশ হয়রানি, দুর্নীতি এবং জনগণের হয়রানি ইত্যাদি বাড়ছে। একটি ভালো মাধ্যম কীভাবে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থায় জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় সেই বিষয়টিই এই সরেজমিন অনুসন্ধানী লেখায় তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্বের ধনী দেশগুলো যখন প্রতিবছর জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে ২ হাজার ১৩০ কোটি টন বা ২১.৩ বিলিয়ন টন কার্বন উৎপাদন করে প্রকৃতি-পরিবেশে ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে, তখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ অন্ধকারে আলোর দিশা হওয়ার কথা। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনাবশ্যকভাবে যদি হাজার হাজার মানুষ উচ্ছেদের শিকার হন, নারী-শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ হামলা-মামলা, গ্রেফতারের শিকার হন, যদি স্থানীয় মানুষের চলার পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সে উদ্যোগের আলোর নিচে অন্ধকার তো অনিবার্য।

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নের লাটশালা ও চর খোর্দার বিস্তীর্ণ এলাকার সাধারণ মানুষের এক হাজার একর জমি দখল করে তেমনি এক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করছে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ বেক্সিমকো।

বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তি স্বাক্ষর: ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকার বিদ্যুৎ ভবনে বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং চীনের টিবিইএ জিনজিয়াং সানওয়েসিস কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তিস্তা সোলার লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ ক্রয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে একটি বাস্তবায়ন চুক্তি হয় একই দিনে।

২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকার বিদ্যুৎ ভবনে বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং চীনের টিবিইএ জিনজিয়াং সানওয়েসিস কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তিস্তা সোলার লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ ক্রয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তির ধারাবাহিকতায় সুন্দরগঞ্জে ২০০ মেগাওয়াটের একটি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে যাচ্ছে তিস্তা সোলার লিমিটেড। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২০ বছর এ প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতি কিলোওয়াট ১৫ সেন্ট বা ৬৩.৪৫ টাকা দরে ক্রয় করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তা সোলারের ৮০ ভাগ মালিকানা বেক্সিমকো গ্রুপের, বাকি ২০ শতাংশের মালিকানা চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিবিইএ কোম্পানির।

জমি অধিগ্রহণ: চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। কয়েকজন কৃষকের সামান্য কিছু জমি অধিগ্রহণের পর কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অধিগ্রহণের নামে কয়েকশ কৃষকের তিন ফসলি জমিতে বালু ভরাট করা শুরু হয়। জমি অধিগ্রহণের নামে বেক্সিমকো কোম্পানি রীতিমতো অসাধু পন্থা অবলম্বন করে। জমি অধিগ্রহণের সাধারণ আইনগুলো না মেনে স্থানীয় দালাল তৈরি করা হয়। কৃষকরা অভিযোগ করেন, উপজেলা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় কৃষকদের। এমনকি ভুয়া মালিক সাজিয়েও জমির দলিল তৈরি করা হয়। শুধু আবাদি জমিই নয়, এলাকাবাসীর বর্ণনামতে তিস্তা সোলার কর্তৃপক্ষ লাটশালার পার্শ্ববর্তী বিরাট বসতি এলাকা, চর খোর্দা মৌজার প্রায় ৫০০ বাস্তুভিটা, ২টি সরকারি স্কুল, ৮টি মসজিদ, ২টি ইদগাহ, ২টি কবরস্থান দখলে নেওয়ার জন্য জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হামলা-মামলার হুমকি দেওয়া শুরু করে। অথচ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চুক্তির শর্তানুযায়ী লাটশালা ও চর খোর্দা মৌজার বাইরে কৃষিজমি ও বসতি এলাকায় প্রকল্প করা যাবে না।

উপজেলা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় কৃষকদের। এমনকি ভুয়া মালিক সাজিয়েও জমির দলিল তৈরি করা হয়।

আন্দোলনের সূত্রপাত: বাপ-দাদার ফসলি জমি ও বাস্তুভিটা বেদখল হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা একসময় ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। প্রথমদিকে তারা ‘বাস্তুভিটা ও আবাদি জমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলেন।

শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন: স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মোজাফফর মণ্ডল মোজাকে আহ্বায়ক ও বীরেন শীলকে উপদেষ্টা করে গঠিত হয় কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও বাসিন্দারা সংগঠিত হতে শুরু করেন। প্রায় প্রতিদিনই গ্রুপ বৈঠক, উঠান বৈঠক, পোস্টার লাগানো, প্রচারপত্র বিলি, মাইকিং, গ্রামসভা, হাটসভা, জনসভা চলতে থাকে নিয়মিত। পাশাপাশি ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের নামে এলাকাবাসীর বাস্তুভিটা ও তিন ফসলি আবাদি জমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি প্রদান করেন। ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, সংঘবদ্ধ আন্দোলনের ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ ও তাদের ভাড়াটে মাস্তানরা। তারা আন্দোলনকারী কিষান-কিষানিদের নেতা বীরেন শীল (বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলের একজন সংগঠক) ও কৃষক মোজাফফর মণ্ডল মোজাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। 

সংঘবদ্ধ আন্দোলনের ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ ও তাদের ভাড়াটে মাস্তানরা। তারা আন্দোলনকারী কিষান-কিষানিদের নেতা বীরেন শীল (বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলের একজন সংগঠক) ও কৃষক মোজাফফর মণ্ডল মোজাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

গ্রামের অধিকাংশ কৃষক শিক্ষার অভাবে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের দালাল ও অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। দখল হয়ে যাচ্ছিল গ্রামের ভিটামাটি, স্কুল, মসজিদ ও কবরস্থান। সর্বস্বান্ত হওয়ার আতঙ্কে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তাদের। তারা আরও সংগঠিত হতে থাকেন। লাটশালা ও চর খোর্দা মৌজার সীমানা এলাকায়, স্থানীয় খোর্দা বাজার, চৈতন্য বাজার ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরে জনসভা করার পাশাপাশি ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রংপুর বিভাগীয় কমিশনার অফিসের সামনে সমাবেশ করে স্মারকলিপি প্রদান করেন তারা।

এলাকাবাসীর মতে, এসব আন্দোলনের ফলে স্থানীয় দালাল, দলীয় ক্যাডার, পুলিশ প্রশাসন, ভূমি অফিসের দালাল কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের একটা অংশ আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কোম্পানির পক্ষ থেকে তখন প্রশাসন ও পুলিশকে সরাসরি ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা শুরু হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায স্থানীয় জনতা তাদের ২৪ নেতাকে স্টিলের বাঁশি কিনে দেন। তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য ২৪ ঘণ্টাই গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে রাখতেন।

কোম্পানির পক্ষ থেকে তখন প্রশাসন ও পুলিশকে সরাসরি ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা শুরু হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায স্থানীয় জনতা তাদের ২৪ নেতাকে স্টিলের বাঁশি কিনে দেন। তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য ২৪ ঘণ্টাই গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে রাখতেন।

আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা কিষান-কিষানিরা কোম্পানির অপতৎপরতা ও ভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তসমূহের তথ্য সংগ্রহ করে আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখেন। আন্দোলনকারীরা সতর্কতার সঙ্গে গোপনে বৈঠক করা শুরু করেন। তারা আন্দোলনকারীদের নিয়ে ১২টি গ্রুপ গঠন করেন। প্রতি গ্রুপে একজনকে আহ্বায়ক, একজনকে সদস্যসচিব এবং অন্যদের সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। যাতে একজন বাঁশি বাজালেই পুরো গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে সংগঠিত হতে পারেন।

কিন্তু থেমে থাকে না কোম্পানির ষড়যন্ত্র। শুরু হয় আন্দোলনের নেতৃত্বকে লোভ দেখিয়ে কিনে ফেলার পাঁয়তারা। নেতাদের আটকাতে মোটা অঙ্কের অর্থ প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু নেতৃবৃন্দ ও আন্দোলনকারীরা এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যান। প্রায় প্রতিদিনই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কোম্পানির কর্মকর্তা ও দালালদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। সেই সুযোগে বেক্সিমকো সোলার পাওয়ার কোম্পানি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা এবার বেছে নেয় হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের পথ।

হামলা-মামলা ও গ্রেফতার: চর খোর্দা ও লাটশালার ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসী ও কৃষকদের নামে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করা হয় (মামলা নম্বর: ৯, ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৪২৭ /৪৩৫/৫০৬)। পরদিন ১০ এপ্রিল সকালে আরেকটি জিডি করা হয় (নম্বর: ৪১৩)। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা এসআই আলম বাদশার নেতৃত্বে একদল পুলিশ তিস্তা সোলার প্ল্যান্টে যায়। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ চর খোর্দা যায় ‘আসামির’ খোঁজে। পুলিশের সঙ্গে যায় তিস্তা সোলারের একদল ভাড়াটে কর্মী। গ্রামবাসী কল্পনাও করেনি যে এত তাড়াতাড়ি তাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা হবে। তাই তারা পালিয়ে যাননি। বরং যার যার বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মজিবর রহমান বলেন, 

‘পুলিশ হোক আর মাস্তান হোক, আমাদের সামনাসামনি মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ, পালিয়ে বেড়ালে আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি তিস্তা সোলারের লোকজন বিনা বাধায়, বিনা টাকায় জবরদখল করে ফেলত।’

সেদিন গ্রামের অন্যান্য কৃষকের মতো মোজাফফর মণ্ডলও মাঠে কাজ করছিলেন। এ সময় পাশের রাস্তা দিয়ে পুলিশ তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়ে কাজ ফেলে তিনি পুলিশের কাছে যান। পুলিশ তাকে বলে, ‘ওসি সাহেব আপনাকে থানায় দেখা করতে বলেছেন।’

মোজাফফর মণ্ডল বলেন, ‘আমি বলি, আমার পুরো শরীরে ধুলা-ময়লা আছে। আমি একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আমার মোটরসাইকেলে যাব। তাদের কাছে জানতে চাই আমার নামে থানায় কোনো মামলা আছে কি না। তারা বলে কোনো মামলা নেই। তবে যেতে বলছে, এখনই যেতে হবে।’

মোজাফফর মণ্ডল সেদিনের ঘটনার বিবরণ দেন এভাবে:

‘তারা আমাকে গোসলও করতে দেয় না। বলে, গোসলের দরকার নাই, এখনই আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। তখন আমার বাড়ির লোকজন এবং আশপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকে। প্রথমে আমার মেয়ে মুক্তা বেগম এবং একটু পরেই আমার স্ত্রী সেখানে আসে। তখন পুলিশ আমাকে টানা-হেঁচড়া করে গাড়িতে (মোটরসাইকেল) তুলতে চেষ্টা করে। আমার মেয়ে আমাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। এবং মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে ফেলে। তখন রেজাউলসহ অনেকেই ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশ রেজাউলকেও গাড়িতে তুলতে চেষ্টা করে। রেজাউলও উপস্থিত অন্যদের সহযোগিতায় পুলিশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় শুরু করে। মেয়েসহ অন্যদের সহযোগিতায় আমিও পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে যাই এবং দৌড়ে সরে যেতে চেষ্টা করি। পুলিশ তখন এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমার স্ত্রী সরফুন্নেছা, মেয়ে মুক্তা বেগম, প্রতিবেশী রেজাউল, আরজিনা বেগম, রুপিয়াসহ অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়।’

‘আমি পালাতে সক্ষম হই। গুলিতে আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রতিবেশী মুজিবর, ধীরেন শীলসহ সবাই এগিয়ে আসে, সহযোগিতা করে। তারা আহতদের রংপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশের সদস্যরা সবাই থানায় না গিয়ে একটি অংশ কোম্পানির আনসার ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। অপরদিকে সরফুন্নেছা, মুক্তি বেগম, আর্জিনা, রুপিয়া, রেজাউলসহ অনেকে পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের রক্তে খোর্দার মাটি লাল হয়ে যায়।’ 

‘এলাকাবাসী তাদের এই মারাত্মক আহতাবস্থায় হাসপাতালে নিতে দেখে ভেবেছিল তারা মারা গেছেন। এতে এলাকাবাসী আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে এলাকার সবাইকে সংঘবদ্ধ করে মিছিলসহকারে আনসার ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। পুলিশ আবার এলাকাবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। সেখানেও অনেক মানুষ আহত হয়। মানুষ গুলি খেয়েও অবরোধ তুলে নেয় না। তখন এসআই বাদশার নির্দেশে আনসার সদস্যরা তাদের ক্যাম্পে থাকা জিও ম্যাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা মনে করেছিল, আগুন ধরিয়ে দিলে জনতা সরে যাবে এবং পুলিশ নিরাপদে এলাকা ছেড়ে যেতে পারবে। কিন্তু আগুন দেখার পরও জনতা অবরোধ ছাড়ে না। তখন সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি সাহেব, ইউএনওসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গাইবান্ধা থেকে দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে আনসার ক্যাম্পে আসে। তারা জনতার ওপর গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত করা এবং বিচার করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসআই বাদশাসহ অন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে চলে যায়। থানায় গিয়েই তারা ১৫ মিনিটের ব্যবধানে আমাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে।’

এলাকাবাসী জানান, এর দুদিন আগে ৮ এপ্রিল আমিন বাদশা তার লোকজনসহ খোর্দা ও লাটশালা মৌজার সীমান্ত এলাকা নির্ধারণ করতে আসে। সেখানে তারা খোর্দা মৌজাকে তিন চেইন খাটো করে দেয়। খোর্দার লোকজন সেটা মানতে পারে না। তারা বাদশা আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে সালিশি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ তারিখে মতিয়ার আমিন, সাইদুল মেম্বার, শামসুল মেম্বার, শামসুল কামার, নুরুল আমিনসহ ৭-৮ জন কোম্পানির লাগানো কিছু পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। ওই সুযোগে এসআই বাদশা ঘোড়ার গাড়িতে করে সীমানা পিলার/খুঁটি নিয়ে সেখানে হাজির হয়। খোর্দা মৌজাকে তিন চেইন খাটো করেই সীমানা নির্ধারণের জন্য সে বাদশা আমিনকে নির্দেশ দেয়। জনগণ বাদশা আমিনকে বাধা দেয়। সে কারণেই এসআই বাদশা মোজা মণ্ডলকে ধরার জন্য তার বাড়িতে যায় এবং গুলি করে অনেক মানুষকে মারাত্মক আহত করে।

গ্রামের জনগণের রোষানলে পড়ার পর মৌখিকভাবে অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পুলিশের বড়কর্তারা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পরদিন ১১ এপ্রিল উল্টো গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করেন অভিযুক্ত এসআই আলম বাদশা (নম্বর: ১৩, তারিখ: ১১/০৪/১৮। ধারা: ১৪৩/৩৪১/৪৪৮/৩৩২/৩৩/৩৫৩/৪৩৬/১১৪/৩৪)। এই মামলায় কৃষক মোজাফফর মণ্ডল মোজাকে প্রধান আসামি ও ১০০ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। অর্থাৎ, গ্রামের সবাই আসামি। এদিকে নাম উল্লেখ করা ১০০ জনের প্রথম ১০ জনের চারজনই নারী। এদের মধ্যে তিনজনেরই রয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশু।

ছবি: গ্রামবাসীর ওপর এলোপাতাড়ি ছোড়া বুলেট ও খোসা।

আরেকটি মামলা: পুলিশের করা মামলার দুদিন পরই, ১৩ এপ্রিল ২০১৮, বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ইয়ার আলী গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে আরেকটি ফৌজদারি মামলা করেন। মামলায় চর খোর্দা ও লাটশালার চরের ১২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ১০০০/১২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় (মামলা নম্বর: ১৮, তারিখ: ১৩/০৪/১৮, ধারা: ১৪৪/৪৪৮/২২৩/৩৩২ /১৮৬/৪৩৬/৩৮০/৪২৭/১১৪)। পেনালকোডটিতে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। আসামি করতে গিয়ে পুলিশ বাদীপক্ষ এতটাই একরোখা ছিল যে, তারা নারীশিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু, গাইবান্ধার বাইরে অবস্থানরত মানুষ, এক ব্যক্তির নাম দুবার তালিকাভুক্ত করে। ফলে জেল খাটতে হয় চার নারী ও তাদের তিন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে।

মামলার খবর জানতে পেরে গ্রামবাসী বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে স্বেচ্ছায় কোর্টে গিয়ে জামিনের আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ৭ মে রংপুর কোর্টে হাজির হয়ে ২০ জন গ্রামবাসী জামিনের আবেদন জানান। আদালত শরফুন্নেছা (৪৮), আর্জিনা বেগম (৪০), মুক্তি বেগম (২৭) রুপিয়া বেগম (২৮), বীরেন শীল (৪৮), মোজাফফর মণ্ডল মোজা (৫০), রেজাউল (৫০)-সহ ১০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠান। শেষ পর্যন্ত জেল খাটতে হয় চার নারী ও তাদের তিন দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও। কোর্টে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা বীরেন শীলকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালতে উপস্থিত সর্বস্তরের আইনজীবীদের বিরোধিতায় বীরেন শীল রিমান্ডে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পান।

ছবি: তিন সাহসী নারী আর্জিনা বেগম, শরফুন্নেছা ও মুক্তি বেগম (বাঁ থেকে) ও তাদের শিশুসন্তান

জামিন নামঞ্জুর, গ্রেফতার ও জেল হাজতবাস

শরফুন্নেছা (৪৮) ঘটনার বিবরণ দেন এভাবে: চর খোর্দা গ্রামের এই নারী বলেন,

‘আমার স্বামীর ভিটেমাটি, আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ আশ্রয় রক্ষার দাবি করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে বসেছিলাম। আমার ডান হাত গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায়, পাঁজরেও গুলি লাগে। আমরা কোনো সন্ত্রাসী কাজ করি নাই, বরং নিজেদের ভিটেমাটি অবৈধ ভূমিদস্যু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল আমাদের বাড়ির দিকে পুলিশ আসে। তারা আমার স্বামীকে রাস্তা থেকে টেনে-হিঁচড়ে মোটরসাইকেলে তুলতে চায়। আমি, আমার মেয়ে মুক্তি বেগম দৌড়ে গিয়ে তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করি। কাছে থাকা অনেকেই আমার স্বামীকে গাড়ি তোলার বিরুদ্ধে চিৎকার, স্লোগান দেয়। তখন আমাদের বাড়িতে এলাকার অনেক লোক হাজির হয়। পাশের বাড়ির রেজাউলকেও পুলিশ আমাদের বাড়িতে ধরে নিয়ে আসে। আমার স্বামীকে ছাড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করার সময় সে পুলিশের হাত থেকে ছুটে দৌড় মারে। রেজাউলও দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। তখন এসআই আলম বাদশার নির্দেশে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। আমি, আমার স্বামী, রেজাউলসহ অনেকে গুলিতে মারাত্মক আহত হই। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে সবাই মিলে আমাদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

আমাদের ভিটেমাটি দখল করবে, আমাদের ওপর হামলা করবে আবার আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেবে, অবিচার করবে এটা কেমন কথা। আমাদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশ থানায় গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় জামিনের জন্য আমরা পরের মাসে ৭ তারিখে কোর্টে হাজির হই। আদালত আমি, আমার স্বামী, মেয়েসহ ১০ জনের জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠান। ২০ দিন জেল খেটে আমরা জামিনে ছাড়া পাই।’

আর্জিনা বেগম বলেন, 

‘সেদিন পুলিশের গোলাগুলিতে আমার ডান হাতের তালুতে গুলি লাগে। প্রতিবেশী মজিবর, বীরেন শীল, বকিয়তুল্লা খন্দকারসহ অন্যরা আমাদের রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যায়। আমরা রাত ৯টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছাই। আমাদের চিকিৎসা শুরু হয়। গুলি বের করে, সেলাই করে, ইনজেকশন দেয়। কিন্তু ব্যথা কমানোর ওধুধ দেয় না। আমরা ব্যথায় ছটফট করতে থাকি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ২টার দিকে দুজন লোক এসে আমাদের নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে আর ভয় দেখায়। বলে তোমরা হাসপাতাল থেকেই গ্রেফতার হয়ে যাবে। আমরা তখন আশপাশে পাঁচজন চিকিৎসা নিতেছিলাম। আমরা গ্রেফতারের ভয়ে ভোর না হতেই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বের হই, আমার সঙ্গে ছেলে আল আমিন ছিল। মুক্তি ও রুপিয়ার সঙ্গে তাদের শিশুসন্তান ছিল। একটু পথ গাড়িতে, আবার অনেক পথ হেঁটে বহু কষ্ট করে আমরা সুন্দরগঞ্জের চর খোর্দা পৌঁছাই। এ ঘটনার পর পুলিশ এবং তিস্তা সোলারের অফিসার গ্রামের সব মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে। সম্ভবত এর ২৫-২৬ দিন পর আমরা রংপুর কোর্টে জামিনের আবেদন করি। কিন্তু কোর্ট আমাদের জামিন না দিয়ে জেলহাজতে পাঠান। কোনো অপরাধ না করেও আমার আট মাস বয়সি শিশুসন্তান আমার সঙ্গে ২০ দিন জেল খাটে।’

মুক্তি বেগমও  ১০ই এপ্রিলের ঘটনার প্রায় একই রকম বর্ণনা দেন:

‘পরের মাসের ৭ তারিখে আমরা কোর্টে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করি। কিন্তু কোর্ট জামিন নামঞ্জুর করে আমাদের জেলহাজতে পাঠান।  মা, বাবা, আমি আমার শিশুকন্যা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেক্সিমকো কোম্পানির লাভের আলো জ্বালিয়ে রাখতে ২০ দিন জেলখানার অন্ধ কোঠায় ছিলাম।’

ছবি: রুপিয়া বেগমের সঙ্গে তার শিশুসন্তান শিমুও জেলহাজতে ছিল

অপমানজনক আপসসূত্রে মামলা নিষ্পত্তির অঙ্গীকারনামা ও গণ হয়রানি: ভুক্তভোগী স্থানীয়রা বলেন, তারা মামলা তুলে নেওয়ার চুক্তি করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের জমির ক্ষতিপূরণ না দিয়েই সোলার প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ চালু রাখা হয়েছে। বেক্সিমকো কর্তৃপক্ষ এখনো অনেক কৃষকের জমির মূল্য পরিশোধ করেনি, কিন্তু জমি দখলে নিয়েছে ঠিকই। কারো অর্ধেক, কারো তিন ভাগের এক ভাগ টাকাও পরিশোধ করেনি।

জমির ক্ষতিপূরণ না দিয়েই সোলার প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ চালু রাখা হয়েছে। বেক্সিমকো কর্তৃপক্ষ এখনো অনেক কৃষকের জমির মূল্য পরিশোধ করেনি, কিন্তু জমি দখলে নিয়েছে ঠিকই। কারো অর্ধেক, কারো তিন ভাগের এক ভাগ টাকাও পরিশোধ করেনি।

ভুক্তভোগী কৃষক মজিবর রহমানরা ৬ বোন ৩ ভাইয়ের মোট ৪ একর ৬২ শতক জমি অধিগ্রহণে চলে গেছে। তিন ফসলি জমিতে তারা প্রতিবছর দুবার ধান, একবার মসুর, খেসারি, মুগসহ বিভিন্ন প্রকার ডাল, সরিষা, গোল আলু, মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম ইত্যাদি ফসল ফলাতেন। প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকার ফসল বিক্রি করতে পারতেন তারা। এই জমির ফসল সারা বছর খেয়ে, বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি তাদের বসবাসের জন্য ঘর তুলতে জমি দিলেও অধিগ্রহণ করা ফসলি জমির মূল্য এখনো পরিশোধ করেনি।

ফসলি জমি অধিগ্রহণের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী, স্থানীয় হিসাবে প্রতি শতকের মূল্য ৫১ হাজার টাকা ধরে ৪ একর ৬২ শতকের মূল্য দাড়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কোম্পানি তাদের পরিশোধ করেছে মাত্র ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নয় ভাইবোনের পরিবার একেকজন পেয়েছেন ৫ লাখ টাকার একটু বেশি। বাকি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও কবে পরিশোধ করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ দিচ্ছে না কোম্পানি। জমির দলিলও এখন পর্যন্ত সম্পন্ন করেনি বেক্সিমকো।

চুক্তি অনুযায়ী এলাকার কিছু মানুষকে তারা প্রজেক্টের কাজে দিনমজুর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এমনকি যারা মামলার আসামি তাদেরও কেউ কেউ নির্মাণকাজের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এলাকাবাসী মনে করেন, ক্ষতিপূরণ আদায়ের আন্দোলন যেন দানা বাঁধতে না পারে এবং প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ যেন চালু থাকে, সেই উদ্দেশ্যেই এসব করা হচ্ছে।

এদিকে এখনো মামলা ঝুলে আছে। পুলিশ খেয়ালখুশিমতো এলাকাবাসীর বাড়িতে হানা দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য আন্দোলন করতে মানা করছে। এ কাজে বেক্সিমকোকে সহযোগিতা করছে স্থানীয় প্রশাসনের মেম্বার, চেয়ারম্যান, দালাল চক্র, উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পুলিশ।

জনদুর্ভোগ: লাটশালা ও চর খোর্দার বাসিন্দাদের উলিপুর খেয়াঘাটে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা দখল করেছে বেক্সিমকো

এলাকাবাসীর দাবি, আসাম খেয়াঘাট থেকে সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি ছিল তাদের যাতায়াতের একমাত্র পায়ে চলা রাস্তা। রাস্তাটি প্রজেক্টের ভেতরে চলে যাওয়ায় এলাকাবাসীকে নয় কিলোমিটার ঘুরে উলিপুর খেয়াঘাটে যেতে হয়। প্রজেক্টের কারণেই এই নয় কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো রাস্তা নেই। স্থানীয় জনসাধারণ, রোগী, বৃদ্ধ মানুষের জন্য এই পথ পাড়ি দেওয়া অমানবিক ও কষ্টসাধ্য। এ ছাড়াও চর সন্তোষ, অরিবাম, চর হোক ডাঙ্গার অধিকাংশ জমি লাটশালা ও চর খোর্দায় বসবাসকারী অধিবাসীদের। ওই জমিতে চাষাবাদ, গরু চরানোর কাজে প্রতিদিনই নয় কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। অথচ প্রজেক্ট এলাকার ভেতরে চলে যাওয়া রাস্তাটি দিয়ে যেতে সময় লাগত মাত্র ১০-১৫ মিনিট। এলাকাবাসী বিকল্প রাস্তা নির্মাণের দাবি করলেও তা উপেক্ষিতই থাকছে।

পরিশেষে

সব মিলিয়ে বলা যায়, বর্তমানে সোলার প্ল্যান্ট নির্মিত হচ্ছে সেই আগের মেগা কয়লা প্ল্যান্ট নির্মাণের কায়দায়। বড় কয়লা প্রকল্পে যেভাবে জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সোলার প্ল্যান্ট করার ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের মডেল হিসেবে না দেখে একে বড় কোম্পানির ব্যাবসায়িক স্বার্থ এবং মুনাফা করার হাতিয়ার হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যেখানে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিসেন্ট্রালাইজড (বিকেন্দ্রিক) বিদ্যুতের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব, সেখানে সৌরবিদ্যুৎ করা হচ্ছে শুধু কোম্পানির মুনাফার কথা মাথায় রেখে। অথচ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করলেই শুধু হবে না, স্থানীয় মানুষকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে, আগেকার পরিবেশদূষণকারী বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মতোই স্থানীয় জনগণ তাদের নিজস্ব সমাজ ও অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এবং এই প্রক্রিয়ায় দারিদ্রও বাড়তেই থাকবে।

বর্তমানে সোলার প্ল্যান্ট নির্মিত হচ্ছে সেই আগের মেগা কয়লা প্ল্যান্ট নির্মাণের কায়দায়। বড় কয়লা প্রকল্পে যেভাবে জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সোলার প্ল্যান্ট করার ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের মডেল হিসেবে না দেখে একে বড় কোম্পানির ব্যাবসায়িক স্বার্থ এবং মুনাফা করার হাতিয়ার হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

সবশেষে প্রশ্ন: স্থানীয় জনগণকে বাদ দিয়ে বা তাদের নিপীড়ন করে, সর্বস্বান্ত করে যে উন্নয়ন, সেটা কেন মানুষ উন্নয়ন বলে মেনে নেবে?

শহীদুল ইসলাম সবুজ: লেখক, রাজনৈতিক সংগঠক। ই-মেইল: sabuj.shahidul933@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •