বাংলাদেশে বিজ্ঞানশিক্ষা: সমস্যা কী ও কোথায়?

বাংলাদেশে বিজ্ঞানশিক্ষা: সমস্যা কী ও কোথায়?

আলমগীর খান

একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নামে একের পর এক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে অন্যদিকে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপরই আসছে একের পর এক আঘাত। তার কিছু দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এই লেখা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা লক্ষণীয়। অনেক ঘটনা থেকে এরকম কথা মনে হতে পারে যে, এ দেশের মানুষ বিজ্ঞানবিরোধী। যেমন, গত বছর ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের একটি স্কুলের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে আটকের ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পায় এবং এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

চলতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বহু হইচই হলো, অন্যান্য ইস্যুও ছিল। অথচ নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে বহুকাল ধরেই বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা আছে এবং খুবই ভালো আলোচনা। সে তুলনায় এবার ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে বিবর্তনবাদ নিয়ে যে আলোচনা তা ছিল খুবই দুর্বল, অপটু, কাঁচা হাতের লেখা। বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পরপর দুই পৃষ্ঠায় দুবার লেখা ছিল, মানুষ বানর থেকে আসেনি। অপ্রাসঙ্গিকভাবে দুবার এ কথা বলার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তক-প্রণেতারা নিজেদের কী পরিচয় তুলে ধরলেন?

চলতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বহু হইচই হলো, অন্যান্য ইস্যুও ছিল। অথচ নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে বহুকাল ধরেই বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা আছে এবং খুবই ভালো আলোচনা। সে তুলনায় এবার ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে বিবর্তনবাদ নিয়ে যে আলোচনা তা ছিল খুবই দুর্বল, অপটু, কাঁচা হাতের লেখা।

যদি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তাদের ছেলেমেয়েদের ডারউইনের তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু জানতে দিতে না চাইতেন তবে নবম শ্রেণির বই নিয়ে আরও বেশি হইচই হওয়ার কথা। এ ছাড়াও ডারউইনের তত্ত্বটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোনো নতুন কথা নয়। বহুকাল আগে থেকেই বিবর্তনবাদ নিয়ে বহুজনের লেখা বহু বই বাজারে বিদ্যমান ও জনপ্রিয়। এসব নিয়ে কারো গাত্রদাহ নেই। এ থেকে এই সিদ্ধান্তেই কেবল আসা যায় যে, ক্ষমতায় থাকা ও আশপাশে ঘুরঘুর করা কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এই অপচেষ্টার মূল হোতা।

২০২২-এর ২৩ ডিসেম্বর ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং ‘শিক্ষালোক’ যৌথভাবে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। যেখানে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকী এবং তাদের ‘অব্যক্ত’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বে সভাপতির ভাষণে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি অন্ধকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ, মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। হায় লজ্জা!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নশাস্ত্রের সাবেক অধ্যাপক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের কথা সত্য হলে বিজ্ঞান নিয়ে আপামর জনগণের অসহিষ্ণুতার যে ছবি ইদানীং আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, তা সত্য মনে হয় না–সত্য মনে হয় বিজ্ঞানশিক্ষায় বিদ্যমান গলদ। গলদ বিদ্যমান–এক. শিক্ষার্থী নির্বাচন; দুই. শিক্ষাদান প্রক্রিয়া; তিন. শিক্ষার বিষয়; চার. শিক্ষকের মান–সবকিছুতেই।

ধরা যাক শিক্ষার্থীদের বিষয়। আমাদের দেশে স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ খুবই দামি বলে বিবেচিত। বিজ্ঞান বিভাগে পড়া ছেলেমেয়েরাই তো চিকিৎসক-প্রকৌশলী হয়, এমনকি তারা তাদের বিভাগ পরিবর্তন করে উচ্চতর যে কোনো বিষয়ে পড়ালেখা করতে পারে। কিন্তু মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের সে সুযোগ নেই। সুযোগের এ তারতম্যের অর্থাৎ এহেন বৈষম্যের প্রকৃত কারণ আমার জানা নেই। অনুমান করি যে, সবাই ধরেই নেন যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে তারা পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় নেই যা বুঝতে অক্ষম। কিন্তু অন্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের সেই পরিমাণ জ্ঞানশক্তি নেই–এরকমই বদ্ধমূল ধারণা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো: বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান কতখানি বোঝে ও তা বুকে লালন করে? মাথায় যে তারা খুব ভালোভাবে ধারণ করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, মাথা তাদের ভালো সবার জানা। সে জন্যই তো পাড়ার লোকজন প্রতিবেশী বাবা-মাকে বলেন, ছেলে বা মেয়েটার মাথা খুব ভালো, ওকে ডাক্তারি পড়াও বা ইঞ্জিনিয়ার বানাও। মাথা যে তাদের কত ভালো, কর্মজীবনেও তারা তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর রাখে। এ দেশে কীভাবে মিনিটে ১টা করে রোগী দেখা যায় আর তা মধ্যরাতের সীমানা ছাড়িয়ে, আবার সরকারি হাসপাতালে নাইট ডিউটিতে কীভাবে নাক ডেকে ঘুমানো যায়, কী করে প্রয়োজনের বাইরেও গোটা পাঁচ-দশেক টেস্ট করানো যায়–সবই দুর্দান্ত মাথার লক্ষণ। প্রকৌশলীরাও এ দেশে প্রতিদিনই ভালো মাথার প্রমাণ দিচ্ছেন। ব্যাবসায়িক বুদ্ধিতে তাদের বিশ্বের সেরা বলাই যায়!

আসা যাক শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায়। উচ্চতর শ্রেণিতে যে কোনো বিষয়ে বিশেষত বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে পড়তে গেলেই তা ইংরেজিতে পড়তে হয়। পড়ানোও হয় সেই বিদেশি ভাষাতেই। তাহলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানচেতনা আত্মস্থ করবে কী করে? উচ্চতর শিক্ষা কেন আজও বাংলায় চালু করা সম্ভব হলো না? বাংলায় বই নেই বলে? এর চেয়ে খোঁড়া যুক্তি বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি হয় না। যে দেশ মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পাঠাতে পারে, সে দেশে উচ্চতর শিক্ষার বই বাংলায় লেখা সম্ভব হয় না! হায় সেলুকাস! কোনটা বিশ্বাস করব? আনু মুহাম্মদ লিখেছেন,

‘বাংলাদেশের জ্ঞানবিজ্ঞানে যারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তাদের অনেকে যে উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন এবং যা সবাইকে জানাবার জন্য বলেছেন লিখেছেন তা হলো এই যে, একটি জনগোষ্ঠী মাতৃভাষা ছাড়া তার সামষ্টিক জ্ঞানবিজ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণে সক্ষম হয় না।’

বাঙালির জাতীয় জীবনে জগদীশচন্দ্র বসু ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চেয়ে বড় বিজ্ঞানী তো আর আসেন নাই। তাঁরাই মনে করেছেন, প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষা কেবল মাতৃভাষায়ই হওয়া সম্ভব। সত্যেন বসু ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

‘আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে। শত শত ছাত্রের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছে এমন একজন শিক্ষক হিসেবে আমার স্থির অভিমত এই যে, যথেষ্ট সময় বাঁচানো ও ছাত্রদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ়তর ভিত্তি গাঁথা সম্ভব, যদি প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষক ও ছাত্ররা সহযোগিতা করেন, তাদের সমস্যার খোলাখুলি আলোচনা ও তার সমাধানের জন্য একযোগে কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো বিদেশি ভাষা এসে দাঁড়ালে মস্ত অসুবিধা দেখা দেবেই। কথাবার্তা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে সবসময়ই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হলে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র অনেক সময়েই ঠিকমতো মনের কথা বলতে পারে না এবং শিক্ষক নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে, ছাত্রকে যা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, সে তার সবটাই বুঝতে পেরেছে কি না।’

এখন আসি বিষয়ে। বিজ্ঞানের নামে আসলে কী পড়ানো হয় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়? পঞ্চাশ বছর আগেই জ্ঞানচর্চায় আমাদের চরম দেউলিয়াত্বের কথা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন আহমদ ছফা, বলেছিলেন বিজ্ঞানশিক্ষার কথাও: ‘আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃত লক্ষ্য কী, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানের শিক্ষকরাই শেষ পর্যন্ত অনবহিত থেকে যান।’

ছফার আমলের চেয়ে এখন বিজ্ঞানের কদর বাংলাদেশে অনেক বেশি। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর বেহাল দশা ও উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বই এখনো বিদেশি ভাষায় পড়ানো হয়, তাতে কী? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে তো বলতে গেলে দেশ ছেয়ে গেছে। কিন্তু উচ্চনম্বরধারী উচ্চমেধাসম্পন্ন বলে খ্যাতি অর্জনকারী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের যেসব বিষয় পড়তে ইঁদুর দৌড় দৌড়াচ্ছে, তাতে বিজ্ঞানচিন্তার চেয়ে অর্থলাভের সংযোগ হাজার গুণ বেশি। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বিষয় নির্বাচনে এরা হিসাবশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের চেয়েও বেশি হিসাবি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো দেখে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র বলে ভ্রম হয়! নাকি ঠিকই মনে হয়!

বিজ্ঞানচর্চার নামে এই নষ্টামি কেবল আমাদের মতো দেশেই সম্ভব, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা ছফার গাভিওয়ালা উপাচার্যের মতো। উল্লেখ্য, উপন্যাসটির মূল চরিত্রের অনেকেই বিজ্ঞানের শিক্ষক। আর এখনকার অবস্থা তখনকার চেয়ে ভালো তো নয়ই, মনে হয় আরও খারাপ।

সংকট বিজ্ঞানশিক্ষা প্রদানের প্রক্রিয়ার মধ্যেই। এর বাইরে বিজ্ঞান বিষয়ে এ দেশের মানুষের অসহিষ্ণুতা নিয়ে যে প্রচার তা কৃত্রিম, বানোয়াট। এ দেশের মানুষ বিজ্ঞানবিদ্বেষী নয়, উল্টো বিজ্ঞানবান্ধব। তাই বলে যে কিছু মানুষকে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ভাড়া সম্ভব নয়, তা তো নয়। কম বিচারবোধসম্পন্ন মানুষকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা সবসময় থাকে, সত্য। কিন্তু উসকানি দেওয়ার উপকরণ নিজেরাই কুচক্রী মহলের হাতে তুলে দেওয়ার মাঝে কোনো দায়িত্বশীলতা নেই। কোনটা বিজ্ঞানশিক্ষা ও কোনটা উসকানি, সে পার্থক্য করতে পারাটা নীতিনির্ধারকদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

এ সত্যও মানতে হবে যে, বিজ্ঞানশিক্ষা কোনো রাজনীতি-সমাজনীতিবর্জিত বিষয় নয়। যদি তা হতো তাহলে ব্রুনোকে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যেতে হতো না, গ্যালিলিওকে শাস্তি পেতে হতো না। আর কতগুলো বিষয় যেমন ডারউইনের বিবর্তনবাদ যদি অর্ধেক বিজ্ঞানের হয় তো আর অর্ধেক রাজনৈতিক-সামাজিক। কারণ, জীববৈজ্ঞানিক এই মতবাদটি রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রকেও তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছে। কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর পর তার সমাধিতে দাঁড়িয়ে ১৮৮৩ সালের ১৭ মার্চ তাই এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, মার্ক্স তেমনি মানবেতিহাসের বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন।’

এ সত্যও মানতে হবে যে, বিজ্ঞানশিক্ষা কোনো রাজনীতি-সমাজনীতিবর্জিত বিষয় নয়। যদি তা হতো তাহলে ব্রুনোকে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যেতে হতো না, গ্যালিলিওকে শাস্তি পেতে হতো না।

রাজনৈতিক-সামাজিক সংশ্লিষ্টতার জন্য বিবর্তনবাদ নিয়ে তর্কাতর্কি তাই বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান। ১৯২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি রাজ্যে স্কুলে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে যে মামলা হয়, তা নিয়ে রচিত বিখ্যাত নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এখনো মঞ্চস্থ হয়। কেউ এটি নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি।

স্পষ্টতই দ্বন্দ্বটা কখনোই জনগণের সঙ্গে বিজ্ঞানের নয়, এটি ক্ষমতাচক্রকে ঘিরে ওড়া মৌ-লোভীদের কারসাজি, চাকে ঢিল মেরে তারা অনেক ফায়দা লুটে থাকে। চার্লস ডারউইন নিজে মার্ক্সকে লেখা তার চিঠিতে বলেছেন,

‘খ্রিষ্টত্ব ও ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সরাসরি যুক্তির অবতারণা জনগণের ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। চিন্তার স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় মানুষের মনকে ধীরে আলোকিতকরণের মাধ্যমে, যা বিজ্ঞানের অগ্রগতি দ্বারা সম্ভব। আমি তাই ধর্ম বিষয়ে কিছু লিখি না; বরং বিজ্ঞানেই নিজেকে মগ্ন করেছি। …’১০

মনে রাখা দরকার যে, বিজ্ঞান তার সিদ্ধান্ত কারো ওপর চাপিয়ে দেয় না, যেহেতু সেটি বিশ্বাসের বিষয় নয়, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বোঝার ও গ্রহণ করার বিষয়। বিজ্ঞানের সত্য প্রমাণ করার জন্য কেউ যুদ্ধ বাধায় না। কারণ, বিজ্ঞানের সত্য চাপিয়ে দেওয়া সবার আগে বিজ্ঞানবিরোধী। আর বিজ্ঞান পুরোই প্রমাণনির্ভর, কিন্তু সে প্রমাণ কেবল অঙ্ক কষে ও বাস্তব ঘটনা দিয়ে করতে হয়, যুদ্ধ বাধিয়ে হয় না। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে যে ঝগড়া, তাতে বিজ্ঞানের ও সাধারণ মানুষের কারো কিছু আসে-যায় না। কিন্তু ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে ও চারপাশে থাকা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞান পুরোই প্রমাণনির্ভর, কিন্তু সে প্রমাণ কেবল অঙ্ক কষে ও বাস্তব ঘটনা দিয়ে করতে হয়, যুদ্ধ বাধিয়ে হয় না। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে যে ঝগড়া, তাতে বিজ্ঞানের ও সাধারণ মানুষের কারো কিছু আসে-যায় না। কিন্তু ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রে ও চারপাশে থাকা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের বন্ধু, তাই স্বার্থান্বেষী মহল ছাড়া কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষা ও সর্বজনের মাঝে বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার বিকাশ আবশ্যক। কেবল ব্যাবসা-, মুনাফা-, সমর- ও সন্ত্রাসবান্ধব প্রায়োগিক বিজ্ঞান নয়। প্রয়োজন মনকে আকাশের মতো উদার করার বিজ্ঞানশিক্ষা, কল্পনার ঘুড়িকে মহাশূন্যে উড়িয়ে দেওয়ার আনন্দময় বিজ্ঞান ও উন্নত মানবিক সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের বিজ্ঞানচেতনা। বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের এই ভূমিকাকে আলিঙ্গন করতে উদগ্রীব। নীতিনির্ধারকদের উচিত সঠিক উপায়ে সেই পথে অগ্রসর হওয়া।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি। ইমেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১. https://www.bbc.com/bengali/news-61050277

২. পাঠ্যবই, কান নিয়েছে চিলে?, সাতদিন, নেক্সাস টিভি 

৩. আলমগীর খান, ‘ছফার লেখার আলোকে তখনকার ও এখনকার বুদ্ধিজীবী’, দৈনিক সংবাদ, ৫ মার্চ ২০২৩

৪. আনু মুহাম্মদ, ‘বাংলাদেশে ভাষা, শ্রেণি ও রাষ্ট্র: জ্ঞানের বিচ্ছেদ’, সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ২০২৩

৫. ওই

৬. আহমদ ছফা, সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৭

৭. আহমদ ছফা, গাভী বিত্তান্ত, সন্দেশ, ঢাকা, ১৯৯৫

৮. Valentino Gerratana, ‘Marx and Darwin’, New Left Review, Nov/Dec 1973, UK

৯. রাহমান চৌধুরী, ‘মর্কট মামলা, হৃদয় মণ্ডল ও বিজ্ঞানচর্চা’, সমকাল, ১৪ এপ্রিল ২০২২

১০. http://friendsofdarwin.com/articles/marx-capital

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •