সমীক্ষা প্রতিবেদন: সানেম
নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকার চেষ্টা কেমন
গত ২৯ মার্চ ২০২৩ ঢাকায় সানেম বা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকনমিক মডেলিং-এর পক্ষ থেকে বলা হয়: ‘বৈশ্বিক ও জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যয় বৃদ্ধি, যাতায়াতের বর্ধিত খরচ ইত্যাদি বিষয় নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্দশা বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে স্বল্প আয়ের পরিবার বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছে।
এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষ কীভাবে মোকাবিলা করছেন এবং সামনের দিনগুলোর বিষয়ে তাদের ভাবনা কী, তা বিশদভাবে বোঝার জন্য সানেম নিম্ন আয়ের খানাগুলোর ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০২৩ সালের ৯ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে ১ হাজার ৬০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আটটি বিভাগীয় জেলা–ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।’ নীচে এই সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের সারসংক্ষেপ দেয়া হলো।
জরিপ করা পরিবারগুলোর মধ্যে ৫৩.১ শতাংশ কাঁচা বাড়িতে, ৩৪.১ শতাংশ আধাপাকা বাড়িতে এবং ১২.৮ শতাংশ পাকা বাড়িতে বসবাস করে। জরিপকৃত পরিবারপ্রধানদের ১৭.৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রিকশা/ভ্যানচালক ১০.৯ শতাংশ, অকৃষি খাতের দিনমজুর ৯.৮ শতাংশ এবং কৃষক ৮.৭ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে পরিবারের গড় আয় একই রয়ে গেছে, যদিও গড় ব্যয় বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ (চিত্র: ১)। খাদ্যসামগ্রীর গড় ব্যয় খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রীর তুলনায় ১৭.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রীর ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৫.৮ শতাংশ। খাদ্যসামগ্রীর গড় ব্যয় গ্রামীণ এলাকার (১৫.৫ শতাংশ) তুলনায় শহরাঞ্চলে বেশি বেড়েছে (১৯ শতাংশ)। বিপরীতে খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রীর গড় ব্যয় শহরাঞ্চলের (৩.১ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় (৮.৬ শতাংশ) বেশি বেড়েছে।
পরিবারগুলো কীভাবে এ ব্যয় বৃদ্ধি মোকাবিলা করছে?
মূল্যস্ফীতির চাপে পরিবারগুলোর খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ৯০.২ শতাংশ পরিবার মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে (চিত্র: ২)। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে–৯৬.৪% পরিবার ছয় মাস আগের তুলনায় তাদের মাংস খাওয়া কমিয়েছে। মাছ খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৮৮.২ শতাংশ পরিবার, তেল খাওয়ার পরিমাণ ৮১.৪ শতাংশ, ডিম খাওয়ার পরিমাণ ৭৭.১ শতাংশ এবং চাল খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৩৭.১ শতাংশ পরিবার (চিত্র: ৩)। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারগুলো নিম্নমানের খাবারের দিকে ঝুঁকছে৷ উদাহরণস্বরূপ, ৮৭ শতাংশ পরিবার আগের চেয়ে নিম্নমানের মাছ খাচ্ছে। মাংস, তেল, গম ও চালের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ৮৬.৪, ৭৬.৩, ৬০.৭ ও ৫৬.৫ শতাংশ (চিত্র: ৪)। গ্রামীণ পরিবারের তুলনায় শহুরে পরিবারে এই পরিবর্তনগুলো বেশি হচ্ছে।
প্রতি মাসে ‘বিশেষ খাদ্য’ গ্রহণের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (চিত্র: ৫)। ছয় মাস আগে একটি পরিবার গড়ে মাসে একবার গরুর মাংস খেত, এখন তারা তিন মাসে মাত্র একবার গরুর মাংস খেতে পারে। অন্যান্য ‘বিশেষ খাদ্য’ আইটেমের ক্ষেত্রে, এক মাসে কম ঘনঘন একই রকমের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ছয় মাস আগে যে পরিবারগুলো মাসে একবার গরুর মাংস খেত, তারা এখন তিন মাসে একবার মাংস খেতে পারে। ছয় মাস আগে মুরগির মাংস মাসে চারবার খেলেও বর্তমানে তা নেমেছে দুইয়ের ঘরে। ডিম ছয় মাস আগে মাসে ৮ দশমিক ১ বার খেলেও বর্তমানে তা ৫ দশমিক ৮-এ নেমে এসেছে। রুই বা কাতল মাছ ছয় মাস আগে মাসে ৬ দশমিক ৩ বার খেলেও বর্তমানে এটি ৪ দশমিক ৩-এ নেমে এসেছে।
অর্ধেকেরও বেশি পরিবার (৫৫.৯ শতাংশ) তাদের খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে। এর মধ্যে প্রায় সমস্ত পরিবার (৯২.৪ শতাংশ) পোশাকের ব্যয় হ্রাস করেছে। স্বাস্থ্যসেবায় কমিয়েছে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার, পরিষেবা ব্যয় ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার এবং সন্তানের শিক্ষা খরচ কমিয়েছে ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার (চিত্র: ৬)। এর অর্থ হলো, দরিদ্র পরিবারগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে।
ব্যয়বৃদ্ধি মোকাবিলার বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে (চিত্র: ২) একটি হলো, আগের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে তুলনামূলক সস্তা ভাড়ার বাসায় চলে যাওয়া ৬.৯ শতাংশ। ঋণ গ্রহণের পরিমাণও দ্রুত বেড়েছে, পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ৭৩.৮ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করেছে। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, ঋণগ্রহীতাদের দুই-তৃতীয়াংশই (৭১ শতাংশ) ঋণ করেছে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, সমবায় সমিতি এবং মহাজনদের কাছ থেকে, যাদের সুদের হার বেশি এবং ঋণগ্রহীতাদের দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সঞ্চয়ের সুযোগ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। দরিদ্র মানুষগুলো দ্বিতীয় একটা পেশায় যুক্ত হয়ে বা একই পেশায় ওভারটাইম করার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তবুও টিকে থাকার জন্য তাদের সম্পত্তি ও ঘরের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করতে হচ্ছে। শিশুশিক্ষার পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ১০.৪ শতাংশ পরিবার শিশুশিক্ষা বাবদ ব্যয় হ্রাস করেছে। শিশুশ্রমের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কারণ, ৬.৩ শতাংশ পরিবার শিশুদের কাজে নিয়োজিত করেছে।
মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি বোঝার জন্য, গবেষণায় খাদ্যপ্রাপ্তি বিষয়ে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার আটটি প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (চিত্র: ৭)। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ছয় মাসে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তীব্র হয়েছে। ছয় মাস আগে যেখানে দরিদ্র পরিবারগুলোর ৪১.৩ শতাংশ পর্যাপ্ত খাদ্যপ্রাপ্তি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকত, বর্তমানে এই হার ৭২.৯ শতাংশ। বাকি সাতটি প্রশ্নের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর অর্থ হলো, দরিদ্র পরিবারগুলো ছয় মাস আগের তুলনায় এখন আরও বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আটটি প্রশ্নের উত্তরের ওপর ভিত্তি করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল: নিরাপদ, হালকা অনিরাপদ, মাঝারি অনিরাপদ এবং গুরুতর অনিরাপদ পরিবার৷ দেখা যাচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এ রকম পরিবারের হার ছয় মাসের মধ্যে ২৯.১ থেকে ৮.১ শতাংশে নেমে এসেছে এবং একই সময়ে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারের হার ১২.৩ থেকে বেড়ে ২৫.৪ শতাংশ হয়েছে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় খুব কমসংখ্যক পরিবার (৪০ শতাংশ) সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ছিল আর টিসিবির সুবিধাভোগী পরিবারের হার ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ।
ভবিষ্যতে কী হবে?
মূল্যস্ফীতির এই চাপ যদি বজায় থাকে বা আরও খারাপ হয়, তাহলে ৮৪.৯ শতাংশ পরিবারকে আরও বেশি ধারদেনা করতে হবে, ৫৩.৩ শতাংশ পরিবারকে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাজে নিয়োজিত করতে হবে, মানুষের কাছে সাহায্য চাইবে ৪১.১ শতাংশ পরিবার, শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ করবে ২৪.৩ শতাংশ পরিবার, শিশুদের কাজে নিয়োজিত করবে ১৮.৯ শতাংশ পরিবার, অভিবাসন করবে ১৩.৩ শতাংশ এবং কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়ে দেবে ৬.৭ শতাংশ পরিবার (চিত্র: ৮)। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবিলার এই কৌশলগুলো দেশের আর্থসামাজিক সূচকগুলোর ওপর বেশ গুরুতর প্রভাব ফেলবে, যার মধ্যে রয়েছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের হার, ভিক্ষুক ও দেউলিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিশুশিক্ষার হার হ্রাস।
বিস্তারিত দেখুন: কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ? সানেমের জরিপের ফলাফল