অরক্ষিত বাংলাদেশ ও নারীর পোশাক বিতর্ক

অরক্ষিত বাংলাদেশ ও নারীর পোশাক বিতর্ক

মাহাথীর মুহাম্মদ

কোনো অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যে সেখানকার মানুষের জীবন জীবিকা খাদ্যাভ্যাস আচার যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা প্রায় সবাই স্বীকার করেন। এর প্রভাব যে আরও অনেক বিস্তৃত সেটাই বর্তমান লেখায় যুক্তি প্রমাণ সহ সামনে আনা হয়েছে। বলা হচ্ছে বাংলা অঞ্চলে নদী নালা খালবিল হাজার বছর ধরে এর সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও ভিত্তি নির্মাণ করেছে, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধেও এই বিস্তৃত বিন্যাসই শত্রুদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের লড়াইএর বড় শক্তি ছিল। গত কয় দশকে নদীকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এতে গোটা দেশই অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বলে যুক্তি দিয়েছেন লেখক। একইসঙ্গে গত দুই দশকে নারীর পোশাকে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে তার সাথেও প্রাণ প্রকৃতির বর্তমান বিনাশ ধারার যোগ আছে বলে তিনি মনে করছেন। এবিষয়ে আমরা আরও মতামত আশা করি।   

বাংলাদেশ বেশকিছু ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ভারতবর্ষের অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের এই বিশেষত্বের কারণ, সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার সাপেক্ষে এর অবস্থান। আশ্চর্য এই পর্বতকে ভারতের মানুষ শত-সহস্র শতাব্দী থেকে দেখে এসেছে বিস্ময়, রহস্য আর আধ্যাত্মের আধার হিসেবে। এই পর্বতমালার সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় এক কোটি বছর আগে, ভারতীয় উপমহাদেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে এশিয়া মহাদেশের ভূখণ্ডের সংঘর্ষে। ওই সংঘর্ষে শুধু হিমালয় পর্বতমালাই নয়, আসাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে আমাদের তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়সমূহেরও সৃষ্টি। কী সেই সংঘর্ষ আর কেনই-বা তা ঘটেছিল, সেটা ভূগোলশাস্ত্রের জটিল ও সূক্ষ্ম আলোচনার বিষয়। এই প্রবন্ধের আলোচ্যে তা প্রাসঙ্গিক নয়। এখানে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার সাপেক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। হিমালয়ের পূর্বাংশের ঠিক পাদদেশেই রয়েছে নেপাল। তারপর ভারতের মেঘালয়, আসাম ও সিকিম। তারপর সমুদ্র আর ভূখণ্ডের মাঝখানের নিম্নভূমি আমাদের বাংলাদেশ।

হিমালয়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী সমুদ্রতীরের নিম্নভূমি বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই এই পর্বতশ্রেণি থেকে নেমে আসা জলধারাসমূহ বাংলাদেশ হয়ে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। আবার ভারত মহাসাগরের বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাস হিমালয় পর্বতগাত্রে ধাক্কা লেগে মেঘের রূপ ধরে বাংলাদেশের ওপর এসে সৃষ্টি করে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ বর্ষাকাল। পদ্মা, তিস্তা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা এবং এগুলোর শাখা নদীসমূহের বিপুল জলধারা, বছরব্যাপী বৃষ্টি এবং ভারি বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ বর্ষাকাল বাংলাদেশকে একদিন পরিণত করেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদু পানি সমৃদ্ধ দেশে।

পদ্মা, তিস্তা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা এবং এগুলোর শাখা নদীসমূহের বিপুল জলধারা, বছরব্যাপী বৃষ্টি এবং ভারি বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ বর্ষাকাল বাংলাদেশকে একদিন পরিণত করেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদু পানি সমৃদ্ধ দেশে।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় সব অংশই নদী দ্বারা বেষ্টিত ও বিধৌত। এ ছাড়াও প্রতিটি অঞ্চলেই রয়েছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যানুসারে খাল অথবা বিল বা হাওড় কিংবা বাওড় ইত্যাদি নানামাত্রিক ও নানান নামের জলাধার। এসব জলাধার বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই জলমগ্ন থাকত বাংলাদেশে। এর ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতির জলকেন্দ্রিক কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রকাশ দেখা যায় এ অঞ্চলের মানুষের আচার, অভ্যাস, রুচি, সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, ধর্ম, উৎসব, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, পোশাক, পেশা ও উৎসবে।

কিন্তু বিগত ষাট-সত্তর বছরে বাংলাদেশের ভূভাগ পরিবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপকভাবে এবং দ্রতগতিতে। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এর পেছনে কোনো প্রাকৃতিক কারণ নেই; বরং সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত মানবসৃষ্ট প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এই দেশে আজ মিঠা পানি টাকা দিয়ে না কিনলে পান করার উপায় থাকে না অনেক সময়ই।

বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মার উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ এবং শুধু ফারাক্কাই নয়, নদীর উপরিভাগে উজানে আরও অনেক বাঁধ নির্মাণের ফলে এখন প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে প্রায় জলশূন্য হয়ে যায় পদ্মা নদী। এর ফলে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগব্যাপী পদ্মার উপনদী ও শাখা নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে নর্দমায়। এর প্রভাবে এ অঞ্চলের বিল ও খালগুলোতে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে যে জল ও মাছের প্রাচুর্য তার প্রায় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে আর খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা ঠেকিয়ে রাখার মতো নদীর স্রোত না থাকায় সে অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে স্বাদু পানির ব্যাপক সংকট। ফলে বিল ও নদী সমৃদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখন টিকে আছে পূর্বতন সমৃদ্ধির কঙ্কাল হিসেবে।

উজানে আরও অনেক বাঁধ নির্মাণের ফলে এখন প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে প্রায় জলশূন্য হয়ে যায় পদ্মা নদী। এর ফলে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগব্যাপী পদ্মার উপনদী ও শাখা নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে নর্দমায়। এর প্রভাবে এ অঞ্চলের বিল ও খালগুলোতে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে যে জল ও মাছের প্রাচুর্য তার প্রায় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে আর খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা ঠেকিয়ে রাখার মতো নদীর স্রোত না থাকায় সে অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে স্বাদু পানির ব্যাপক সংকট। ফলে বিল ও নদী সমৃদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখন টিকে আছে পূর্বতন সমৃদ্ধির কঙ্কাল হিসেবে।

 ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারত ও চীনের অনেক বাঁধের সুবাদে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রও গেছে মরে। ওই নদীর বুকে এখন ধান চাষ হয়। নদীর ওপর নির্ভরশীল খালগুলোকে মানচিত্রেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই নদীটির অপমৃত্যুর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে তিস্তার ওপর ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের ফলে তিস্তা নদীও শুকিয়ে যায় হেমন্তেই। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বুকে গরু চরে। আর তিস্তার শাখা নদীগুলোর কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। ফলে উত্তরাঞ্চলের খাল-বিলগুলোজুড়ে জলশূন্যতা আর হাহাকার, ফসলহীনতা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম সার্থক গণবিদ্রোহ, কৈবর্ত বিদ্রোহের সুখ্যাত বরেন্দ্রভূমি থেকে কৈবর্ত (জেলে) পেশাই উঠে গেছে।

কিন্তু শুধু বিদেশিদের বাঁধই বাংলাদেশের জলাভূমির এই পরিণতির কারণ নয়; যমুনার দুই ধারে শহররক্ষা বাঁধ, দক্ষিণাঞ্চলে তথা নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য বেড়িবাঁধ, নদীর পাড়ে ভাঙনরোধী বাঁধ এবং স্লুইস গেট দিয়ে বিলগুলোকে মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং খালগুলোকে শুকিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

এই সর্বনাশের সূচনা হয়েছিল অবশ্য ব্রিটিশ আমলেই। যখন ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে এখানকার ভূপ্রকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রেললাইন নির্মাণ করে নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে সেতু স্থাপন করে, তখন থেকেই নদীর প্লাবনভূমি থেকে নদীর বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে থাকে এবং ব্রিজগুলোর পাদদেশে জমতে থাকে পলি। দুঃখের বিষয়, স্থানীয় নৌপথকে আরও আধুনিকায়ন না করে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরও সড়কপথকেই প্রাধান্য দিয়ে যেই হাজার হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, তা একদিকে তার নিচের জমা পলিতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে নদী ও খালগুলোর নাব্যতাকে, অন্যদিকে নিচু করে বানানো সেতুগুলো নৌকা চলাচলকে অনেক স্থানেই করে তুলেছে অসম্ভব।

এর ফলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভূমি, জল ও জীবনের যেই স্বাভাবিক ছন্দ কোটি বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনে সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিগত ষাট-সত্তর বছরের মানবসৃষ্ট কারণগুলোর ফলাফলে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। এই ঘটনার ফলাফল বহুমাত্রিক। এর ফলে স্থানীয় তাপমাত্রা, ভূমিরূপ, জীববৈচিত্র্য, পেশা ও অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, সংস্কৃতি, রুচি, আচার, অভ্যাস, উদ্‌যাপন, ধর্ম তথা প্রকৃতি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুগভীর ও সর্বব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তার পুরোটাকে বর্ণনা করার জন্য একটি পত্রিকার প্রবন্ধ দূরে থাক এক গ্রন্থাগারও যথেষ্ট নয়। আমি তাই এই বিপর্যয়ের ফলাফলপ্রসূত পরিবর্তনের দুটি দিকের ওপর আলোকপাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রবন্ধের শিরোনামেই এর উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভূমি, জল ও জীবনের যেই স্বাভাবিক ছন্দ কোটি বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনে সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিগত ষাট-সত্তর বছরের মানবসৃষ্ট কারণগুলোর ফলাফলে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। এই ঘটনার ফলাফল বহুমাত্রিক। এর ফলে স্থানীয় তাপমাত্রা, ভূমিরূপ, জীববৈচিত্র্য, পেশা ও অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, সংস্কৃতি, রুচি, আচার, অভ্যাস, উদ্‌যাপন, ধর্ম তথা প্রকৃতি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুগভীর ও সর্বব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

প্রথমটি সামরিক। বাংলা অঞ্চলের সামরিক ইতিহাস একটি বিরাট পর্যালোচনার বিষয়। আমি শুধু এই ইতিহাসের সেই বিজয়গুলোর ওপরই আলোকপাত করব, যা আজও বাংলাদেশের মানুষের মনে গৌরবের উদ্রেক করে। যদিও বাংলাদেশের মানুষের নৌযুদ্ধে সক্ষমতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। বঙ্গবাসীর নৌশক্তির শ্রেষ্ঠত্বের কথা জানতে পারা যায়, মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যগ্রন্থেই।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম সফল গণবিদ্রোহ অর্থাৎ কৈবর্ত বিদ্রোহের গাথা বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বিদ্রোহের সময়কাল আনুমানিক ১০৭৫ থেকে ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দ। এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল পাল রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে এবং কৈবর্তদের নেতা ও সামন্ত দিব্যের নেতৃত্বে। এই বিদ্রোহে দিব্য সফল হন এবং রাজা মহীপাল পরাজিত ও নিহত হন। উত্তর বাংলার তথা বরেন্দ্রভূমির জেলেদের বিদ্রোহী বাহিনীর আঘাতে একজন রাজার পরাজয় ও মৃত্যুর সে ঘটনায় জেলেদের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল তাদের নৌকা চালনায় দক্ষতা এবং নদীপথের উপরে অগাধ জ্ঞান ও তার যথাযথ সামরিক প্রয়োগ। কৈবর্তদের সার্বভৌম বরেন্দ্রভূমির স্বাধীনতা বেশিদিন রক্ষা করা যায়নি। দিব্যর মৃত্যুর পর, মহীপালের ছোট ভাইয়ের কাছে দিব্যের ভাতুষ্পুত্র ভীমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে কৈবর্ত বিদ্রোহের। এই বিদ্রোহ নিয়ে কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন,

‘কৈবর্তরা যদি পরাজিত না হতেন, তাহলে নগর রচনা, জীবনবৃত্ত, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুর একটি একান্ত দেশজ রূপ দেখা যেত…যে দেশজ রূপ ক্রমেই ব্যাপ্তভাবে বিকাশ হতো, তা হতো বাংলার মাটি থেকে জাত।’

কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রায় তিন শতাব্দী পরের আরেকটি ঘটনার ওপর আলোকপাত করা যাক। সাল ১৩৩৮; সুবর্ণগ্রামের (আজকের সোনারগাঁ) শাসক বাহরাম খানের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার দেহরক্ষী ফখরুদ্দিন ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং দিল্লির সম্রাটের সাম্রাজ্য থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ নাম নিয়ে স্বাধীনভাবে সুবর্ণগ্রাম শাসন করতে থাকেন। এই বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পাঠানো বাহিনী যখন কদর খানের নেতৃত্বে সপ্তগ্রামে আক্রমণ করেছিল, বাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ফখরুদ্দিন কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে, তার আগেই নির্মিত নৌবাহিনী নিয়ে মেঘনা পার হয়ে অপর পাড়ে চলে যান। দিল্লির সম্রাটের পাঠানো বাহিনীর কাছে তখন ততটা শক্তিশালী নৌবাহিনী না থাকায় তারা বিরাট মেঘনায় ফখরুদ্দিনকে আক্রমণ করতে পারেনি। মেঘনার পূর্ব পাড়ের গ্রামগুলোতে ফখরুদ্দিন অপেক্ষা করছিলেন এক বিশেষ সময়ের। সময় যখন হয় বর্ষাকাল, ফখরুদ্দিন তার বিরাট নৌবহর নিয়ে দিল্লির সম্রাটের পাঠানো বাহিনীর ওপর হামলা করেন। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে কদর খানের নেতৃত্বাধীন দিল্লির সুলতানের অনুগত বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। তাদের ভয় টের পেয়ে চতুর ফখরুদ্দিন তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করলে মৃত্যু ও পক্ষে এলে ঘুসের টোপ দিয়ে হাত করে নেন। এবং নিজের বাহিনীর হাতেই খুন হন কদর খান। এরপর থেকে আমৃত্যু সুবর্ণগ্রামের শাসক ছিলেন ফখরুদ্দিন। ফখরুদ্দিন বৃহত্তর কুমিল্লা, বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর সিলেটকেও তার সুবর্ণগ্রামের সীমারেখায় নিয়ে আসেন এবং তার নেতৃত্বে বাংলার পুরো পূর্বাঞ্চল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একীভূত হয়।

ফখরুদ্দিনের দেখানো পথেই ১৩৪১ সালে, বাংলার পশ্চিমাংশের রাজ্য সপ্তগ্রামের (বর্তমান খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণাংশ) শাসক নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নাম নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। ১৩৪২ সালে তিনি তৎকালীন লাখনৌতি (উত্তরবঙ্গ) দখল করেন এবং সেখানকার রাজধানী পাণ্ডুয়ায় নিজের রাজধানী স্থাপন করেন। তবে পূর্ব বাংলার জলমগ্ন প্রকৃতি নিয়ে ফখরুদ্দিনের সুগভীর জ্ঞান থাকায় তার সীমায় গিয়ে তাকে পরাজিত করা যে অসম্ভব এটা তিনি জানতেন। তাই তিনি ১৩৪৪ সালে পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং উড়িষ্যার চিলকা হৃদ পর্যন্ত দখল করে নেন।

১৩৫২ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মৃত্যু হলে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সুবর্ণগ্রাম আক্রমণ ও দখল করেন। এ সময় তার শাসনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পুরো বাংলা একটি রাষ্ট্রের অধীন একীভূত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় বাঙ্গালা। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এ সময় শাহ-ই-বাঙ্গালা নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৩৫৩ সালে দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাঙলার রাজধানী পাণ্ডুয়া আক্রমণ করলে বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ তার পাইক বাহিনী নিয়ে বাংলার নদী ও বন বেষ্টিত একডালা দুর্গে অবস্থান নেন। দিল্লির সম্রাট খবর পেয়ে এসে অবস্থান নেন দুর্গের কাছাকাছি। দিল্লির সম্রাটের বাহিনী কামান দেগে সেই দুর্গের দেওয়ালে ক্ষতি করতে পারলেও, নদী ও বন পার হয়ে সম্রাটের বাহিনী দুর্গের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাংলার সুলতানের সৈন্যরা তা মেরামত করে নিচ্ছিল। এ সময় দিল্লির সম্রাটের শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী বারবার আক্রমণ করলেও বাংলার বল্লমধারী পাইক সেনাদের প্রতিরোধের মুখে তারা কখনোই দুর্গের দেওয়াল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেনি।

কয়েক মাস চলে সেই সংঘর্ষ এবং এ সময় দুর্গের বাইরে থেকে দিল্লির সম্রাটের বাহিনী নানাভাবে আক্রমণ এবং কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করলেও শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার সেনাবাহিনী নিয়ে দুর্গেই অবস্থান করছিলেন। দিল্লির সম্রাট এ সময় উপলব্ধি করেন যে, বাংলার সুলতান আসলে বাংলার প্রিয় বন্ধু বর্ষাকালের অপেক্ষা করছেন। তিনি সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং জানিয়ে দেন যে বাংলা এখন থেকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহই শাসন করবেন এবং দিল্লি ও বাংলা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজ করবে এবং উভয় সালতানাত পরস্পরকে আক্রমণ করবে না। যথারীতি ইলিয়াস শাহ রাজি হন এবং এর মধ্য দিয়েই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার সূচনা ঘটে; যে স্বাধীনতায় পরবর্তী দুইশ বছরেও কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। ইতিহাসে এই সময়টি বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে।

ইশা খাঁ ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘলদের প্রতিরোধ করে সমস্ত বাংলার ভাটি অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের পর কেন তার রাজধানী কাত্রাবোয় লক্ষ্যা নদীর তীরে স্থাপন করেছিলেন তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ছোট ছোট নৌকায় সাজানো বিরাট নৌবহর ছিল ইশা খাঁ বাহিনীর বড় শক্তির জায়গা। তিনি সমস্ত বাংলার জমিদার বা ভূঁইয়াদের একীভূত করতে পেরেছিলেন, যে কারণে তার জীবদ্দশায় ভাটি বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন ছিল এবং বারবার পরাজিত হয়েছিল অজেয় মুঘল বাহিনী।

এর অনেক শতাব্দী পর, দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাংলা যখন আবার তার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত, সালটা ১৯৭১। এই লেখার আলোচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক যথারীতি ’৭১-এর বর্ষাকাল এবং মুক্তিযুদ্ধের নৌপথ। আদতে এই যুদ্ধে নৌপথ, নৌ-অভিযান ও বর্ষাকালের ফলাফল নির্ধারক ভূমিকার কথা অনেক লেখকের লেখায়ই এসেছে। আমি এখানে কয়েকটি মূল পয়েন্ট সংক্ষেপে উল্লেখ করব।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধে নদীবিধৌত বাংলাদেশের প্রকৃতি বড়ই সহায়তা করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। বিভিন্ন স্থানে বোমা মেরে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম যুদ্ধ-কৌশল। কারণ, সে সময় ব্রিজের নিচের প্রবাহিনী নদী বা খাল পার হওয়া কঠিন হয়ে পড়ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম ও জনবসতি ছিল, যেগুলো নৌপথ ছাড়া পৌঁছানো সম্ভবই নয়। ওই এলাকাগুলোই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে আক্রমণ করা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এক চমকপ্রদ কৌশল। নদীতে খালি নৌকা ছেড়ে দিয়ে, পেছনে গোপনে অগ্রসর হয়ে শত্রুকে নিশানায় এনে কুপোকাত করার ঘটনাও গেরিলা যোদ্ধাদের নিত্যদিনকার রুটিনেই ছিল। (নদী ও মুক্তিযুদ্ধ, দৈনিক সমকাল, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০)।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম ও জনবসতি ছিল, যেগুলো নৌপথ ছাড়া পৌঁছানো সম্ভবই নয়। ওই এলাকাগুলোই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে আক্রমণ করা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এক চমকপ্রদ কৌশল। নদীতে খালি নৌকা ছেড়ে দিয়ে, পেছনে গোপনে অগ্রসর হয়ে শত্রুকে নিশানায় এনে কুপোকাত করার ঘটনাও গেরিলা যোদ্ধাদের নিত্যদিনকার রুটিনেই ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জয়ন্ত কে সেন তার ‘১৯৭১ সময়ের সাহসী সন্তান’ গ্রন্থের বর্ণনায় সুনামগঞ্জের একটি যুদ্ধের দীর্ঘ বর্ণনার শেষাংশে বলেন,

‘আমাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাদের অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য আমাদের মর্টারের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ডানদিকের সৈন্যরা আমাদের অন্য কোম্পানিটির প্রায় ১০০ গজ দূরে এসে পৌঁছে; কিন্তু নদীর শাখা খালে পানি থাকায় নিচে নামতে ও খাল পার হয়ে আক্রমণ করতে ইতস্তত করে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী নদীর তীরের বাঁশঝাড়ের কভার দিয়ে সবাই প্রাণ নিয়ে দৌড়ায়।’ ব্রিগেডিয়ার সেনের ভাষায়: ‘আমাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান ছিল দেশের প্রতিটি এলাকা পরিচিত। বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, টিলা-সমতল ভূমি সব ছিল আমাদের পরিচিত। শুধু পরিচিত নয়, অতিপরিচিত ও নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা। তাই গেরিলা যুদ্ধে ভালো ফল পেতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি মোটেই।’

তিনি আরও লেখেন,

‘জুন-জুলাই মাসে প্রচণ্ড গরম ছিল, যদিও বৃষ্টি মোটামুটি ভালোই হতো। তবু পানীয়জলের কারণে অনেককে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হতো। তখন মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছিল না; তবে বিভিন্ন পাহাড়ি ঝরনা নদী ছিল মিনারেল ওয়াটার সমৃদ্ধ সুপেয় পানীয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এটা একটা আশীর্বাদ ছিল আমাদের জন্য। নদী বা পুকুরে তখনও পানি এত দূষিত ছিল না। তাই এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক দুর্লভ প্রাকৃতিক সাহায্য।’

তাঁর লেখায় সুনামগঞ্জ অঞ্চলের এবং সারি নদী-কেন্দ্রিক যুদ্ধের যে বর্ণনা এসেছে তাতে দেখা যায়,

‘পাকিস্তানি সমরনায়ক নিয়াজির পরিকল্পনা ছিল, যেভাবেই হোক ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গড়া সম্মিলিত বাহিনীকে সীমান্ত এলাকায় বাধা দিয়ে বিলম্ব ঘটানো এবং সীমান্তে সব কটি পাকা রাস্তা ও যে রাস্তাগুলো সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের ভেতরে এসেছে, সেগুলোর ওপর শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে প্রতিহত করা। এ জন্য সারি ব্রিজ, বৈঠাখাল ব্রিজ, বড়গাঙ্গ ব্রিজ, করিচ ব্রিজ, কাপনা ব্রিজ ও অন্যান্য ছোটখাটো কালভার্টের পাশে পাকিস্তানি বাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। কিন্তু এসব নদীপথের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই নদী দিয়ে এসে এসব ব্রিজ ধ্বংস করে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়।’

মি. সেন বৈঠাখাল ব্রিজ ভাঙার দুঃসাহসিক অভিযানের বিবরণ তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া সারি নদীকে পাশে রেখে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ দিগারাইল টিলা, হেমু, রাধানগর ইত্যাদি আক্রমণ করে শত্রুকে ধরাশায়ী করা এবং সেসব ক্ষেত্রে সারি, পিয়াইন, ডাউকি, কাপনা, করিচ, বড়গাঙ্গ, বৈঠাখাল, নয়াগাঙ্গ ইত্যাদি নদীর ভূমিকা তুলে ধরেছেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। (মুক্তিযুদ্ধ ও সারি নদী, দৈনিক সমকাল, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯)

১৯৭১-এ একদিকে নদী-কেন্দ্রিক যোগাযোগ এবং অন্যদিকে বর্ষাকালে বিল, হাওড়, বাওড়গুলো জলে পরিপূর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানিদের যোগাযোগের জন্য নির্ভর করতে হয়েছে জলযানের ওপর। কচুরিপানার নিচে ভেসে ভেসে অপারেশন জ্যাকপটের অধীন মুক্তিযোদ্ধারা সেসব নৌযান ধ্বংস করে আলোড়ন তুলেছেন সারা বিশ্বে। ’৭১-এর বর্ষাকালে প্রকৃতিও যেন দুই হাত পেতে সহযোগিতা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রবল বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ একাত্তরের সেই মহাকাব্যিক বর্ষায় অপারেশন জ্যাকপটের বাইরেও পাকবাহিনীর নৌযান ধ্বংস ও জলাভূমিকে ব্যবহার করে সফল অপারেশন হয়েছে অনেক। ফলে পাক বাহিনীর নৌযান ধ্বংস করা সব গেরিলা অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অগ্রসর করে দেয় এবং পাকিস্তানিদের আত্মবিশ্বাস একদম ভেঙে যায়- ‘যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বর্ষার আগেই এপ্রিল-মে মাসে বাংলার গ্রামাঞ্চলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জলের রাজা বাঙালি মুক্তিফৌজের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেই প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্য প্রতিনিয়ত মরতে থাকায় তাদের সেনাসংখ্যা কমতে থাকে। পরাজিত সৈন্যের অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হতে থাকায় কমছিল তাদের অস্ত্রভান্ডারও। বর্ষাকালে জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যদল যখন বিপর্যস্ত এবং একেবারে হাঁপিয়ে ওঠা অবস্থা, তখন নভেম্বরে এসে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের গতি আরও বাড়ে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ সূচনা করে। পরে ৩ ডিসেম্বর রাতে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর আক্রমণে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি।

যৌথ বাহিনীর কমান্ডার ভারতীয় মেজর জেনারেল (অব.) দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, ‘বর্ষার সময়টা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে থাকা বিদ্রোহীরা (মুক্তিবাহিনী) সেখানে পাকিস্তানি ফৌজের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করতে পেরেছিল। পুরো বর্ষাটা তাদের ঘিরে রাখা হলো। তারপর যখন বৃষ্টি থামল তখন চারদিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হলো। তারা তেমন প্রতিরোধ গড়তেই পারল না, খুব দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।’

বর্ষাকালে গেরিলা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাফেরা সীমিত করা হয়। মফস্বলে অবস্থা এমন হয় যে রাতে ক্যাম্প থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। গ্রামের স্কুলে স্থাপন করা ছোট ছোট সাব-ক্যাম্প গুটিয়ে থানা সদরে স্থানান্তর করা হয়। বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এতটা নাজুক অবস্থা হয় যে একপর্যায়ে জলে আক্রমণ প্রতিরোধে নিজেরাই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে মাথা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে বিভিন্ন ধরনের কসরত আয়ত্ত করার তথ্য পাওয়া যায় দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ‘একাত্তরের দিনলিপি’তে। তিনি লেখেন, ‘খবর হচ্ছে, খানসেনারা কচুরিপানা মাথায় দিয়ে সদরঘাটে রাবার বোটে চড়ে বর্ষাকালে মুক্তিফৌজের মোকাবিলার কসরত আঁটছে। বর্বরের দল এমন মজার দৃশ্যটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখাতেও সংকোচ বোধ করেনি।’ (সরদার ফজলুল করিম, ‘একুশ একাত্তর ও বঙ্গবন্ধু’, পৃষ্ঠা: ১৩৭), (একাত্তরের বর্ষাকাল, দৈনিক প্রথম আলো, ৮ আগস্ট ২০২১)

কেবল যোদ্ধারাই নয়, উদবাস্তু শরণার্থী মানুষ কী করে নৌপথ ব্যবহার করে তাদের জীবন বাঁচিয়ে পালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের এড়িয়ে, তার চিত্রায়ণ ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ চলচ্চিত্রে। শুধু চূড়ান্ত যুদ্ধে নয়; এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেও, ২৬-২৭ মার্চ, বলতে গেলে আক্রান্ত ঢাকার জন্য ত্রাতা হয়ে এসেছিল ঢাকার চারপাশের নদীগুলো। ঢাকাবাসী প্রথম সুযোগেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আমরা দেখি, হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাক্ষীও বুড়িগঙ্গা। রায়েরবাজারের যে স্থানে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেটা ছিল আদতে আদি বুড়িগঙ্গার নদীখাত। মুক্তিযুদ্ধে আরও যেসব শহিদের লাশের খোঁজ মেলেনি, আমি নিশ্চিত, তারাও মিশে আছেন তাদের প্রিয় স্বদেশের নদ-নদীতে। আর নদ-নদীর মতোই আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে তাদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। তাই আমাদের নদীগুলো নিছক পানিপ্রবাহ নয়, এর সঙ্গে মিশে রয়েছে বুকের তাজা রক্ত। (বিজয় এসেছিল নদীপথে, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯)

ফলে এটা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের জলমগ্ন অঞ্চল–নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাওড় তথা জলকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থা, যা সারা বছর তো দেশের প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা ছিলই বর্ষাকালে তা অনেক অঞ্চলেই হয়ে পড়ত একমাত্র যোগাযোগব্যবস্থা। এবং এই প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যই মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের অন্যতম প্রধান শক্তির জায়গা।

ফলে হাজার হাজার বছর ধরে বাঙলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হাতিয়ার ছিল বাঙলার নদীব্যবস্থা। আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল যেমন এর ব্রিটিশ, রুশ ও মার্কিন আধুনিক পৃথিবীর এই তিন সামরিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধের বিজয়ে প্রধান সামরিক সুবিধা হিসেবে কাজ করেছে; তেমনি বাংলাদেশও যে বারবার হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের দিল্লি-কেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোকে রুখে দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি করেছে তার সার্বভৌম অস্তিত্ব অথবা বাঙালিরা যে উপমহাদেশের একমাত্র জাতি বা ভাষাভাষী গোষ্ঠী যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে সফল হয়েছে কিংবা বাংলায়ই যে সংঘটিত হয়েছিল উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রথম সফল গণবিদ্রোহ; এর পেছনে একইভাবে আমাদের প্রধান সামরিক সুবিধা হিসেবে কাজ করেছে আমাদের নদীপথ ও জলমগ্ন বর্ষাকাল। উল্লেখ্য, বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলেও শুধু বাঙালিরাই যে করেছে তা নয়, অন্যান্য জাতির মানুষরাও এই যুদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশের অবশ্যই সবার মিলিত স্বদেশভূমি হওয়া উচিত। যাইহোক, যদি আফগানিস্তানের পর্বতগুলোকে কোনো দেশ কেটে ফেলে, তাহলে তাদের সেই কাজের পেছনে কোনো সামরিক উদ্দেশ্য নেই এ কথা কি বালকও বিশ্বাস করবে?

তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে: ভারত রাষ্ট্রের আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে ফেলার পেছনে কি আমাদের সামরিকভাবে অরক্ষিত করে ফেলার উদ্দেশ্যও ক্রিয়াশীল নেই? আজ সড়কে সংযুক্ত সমগ্র দেশে, নৌযোগাযোগ মোটামুটি বিলুপ্তপ্রায়, জলাভূমিগুলো বিশুষ্ক। ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণের না-হয় এই ব্যাখ্যা করা যায় যে, আমরা যত বেশি নিরস্ত্র হব, তত বেশি তাদের আধিপত্যের সামনে অসহায় হব। কিন্তু আমাদের যেই পরিকল্পনা প্রণয়নকারীরা কথিত উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নদীগুলোকে আরও শুকিয়ে ফেললেন, বিলগুলোকে মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করে সারা জীবনের জন্য শুকিয়ে ফেললেন; তারা সবাই কোনো বিদেশি শক্তির তাঁবেদারি করে এই কাজ করেছেন আমার তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কারণ, নিজের জন্মভূমির এত বড় সর্বনাশ সজ্ঞানে মানুষ কী করে করতে পারে! তাই মনে হয়, হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতায়, জ্ঞানের দীনতায়, সিদ্ধান্তের ভুলে এই সর্বনাশ হয়ে গেছে। সড়কে সংযুক্ত সারা দেশ আজ। সর্বোচ্চ আট থেকে দশ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে সড়কযোগে পৌঁছে যাওয়া যাবে দেশের প্রায় যেকোনো গ্রামে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী যেকোনো সেনাবাহিনীর সামনে আমরা আজ কতটা ঢালহীন, আড়ালহীন, প্রতিরোধহীন অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের হাজার হাজার বছরের জলবেষ্টনী আমরা হারিয়েছি। কত বড় সর্বনাশ আমাদের হয়েছে, তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি? আমাদের পরিকল্পনাকারীরা আর আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আমাদের যেই উন্নয়ন করেছে, ভাগ্যিস ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকেরা সেটা ঘটায়নি। ঘটালে ’৭১-এর পরাজয় নিয়ে আজীবন পাকিস্তানিদের উপনিবেশ হয়েই থাকতে হতো!

নারীর পোশাক

নদীব্যবস্থার এই অপমৃত্যুর প্রভাব তো কেবল একদিকে নয়, বরং সহস্রমাত্রিক। এমনই আরেকটি মাত্রা হচ্ছে নারীর পোশাক। বাংলাদেশের নারীরা হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু যুগ, বৌদ্ধ যুগ এবং প্রায় এক হাজার বছরের মুসলিম যুগে প্রধানত যে পোশাকটি পরে এসেছে তা হলো শাড়ি। কোনো ব্লাউজ, পেটিকোট ছাড়াই কেবল একপ্রস্থ কাপড় সারা অঙ্গে জড়ানো।

রোকেয়ার অবরোধবাসিনী পড়ে যেন কেউ পূর্ব বাংলার কৃষক-মাঝি আর জেলেকন্যার খবর নিতে না যায়। সে খবর আছে জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে, আছে জসিমউদ্‌দীনের কাব্যগ্রন্থগুলোজুড়ে; অথবা আল মাহমুদের মক্তবের খোলা চুল মেয়ে আয়েশা আক্তার; এই হলো গ্রামবাংলার নারী। সেকালে ব্লাউজ-পেটিকোটের চল শহরাঞ্চলের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু সাধারণ নারীরা নিয়মিত পোশাক হিসেবে শাড়ি ত্যাগ করতে থাকেন আশির দশক থেকেই। ওই সময় থেকে ধীরে ধীরে সালোয়ার-কামিজ, থ্রি-পিস, বোরকা, মেক্সি, হিজাব এসবের চল একটু একটু করে শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে শাড়ি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। বোরকা বাড়তে থাকে। এই সহস্রাব্দের গত দুই দশকে হিজাব ও বোরকা সর্বজনীন এবং সর্বব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করেছে। এর ফলে কিছুদিন আগে একটি মেয়ে ব্লাউজ-পেটিকোট ছাড়া শাড়ি পরে ব্যাপক কটূক্তি, ইয়ার্কি ও অপমানের শিকার হলেও ষাটের দশকের শেষে কি সত্তরের দশকের শুরুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী কবরী পূর্ব বাংলার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে অংশগ্রহণ করায় তার জনদরদি ভাবমূর্তিই প্রশংসিত হয়েছিল সে যুগে। প্রশ্ন হচ্ছে: কেন ব্যাপক এই পরিবর্তন ঘটল নারীর পোশাক সংক্রান্ত সমাজচিন্তায়। অনেকেই অনেক ব্যাখ্যা এর দিয়েছেন, কেউ বলেছেন প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে আমদানি করেছে আরবীয় সংস্কৃতি কিংবা ইউরোপ প্রবাসীরা আমদানি করেছে তাদের অস্তিত্ব সংকট। কেউ বলেছেন, ১/১১-এর পরের বিশ্ববাস্তবতায় মুসলমানদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের শত্রুতাপূর্ণ ও প্রত্যাখ্যানমূলক মনোভাব মুসলমানদের বেশি করে ঠেলে দিয়েছে তাদের ধর্মীয় অস্তিত্বের ও বিশ্বাসের দিকে আধুনিককালের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি করে। আবার কারো মতে, ব্যাপারটার কারণ বিশ্বব্যাপী মৌলবাদের উত্থান অথবা মদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ইত্যাদি। প্রতিটি মতামতের সঙ্গেই কিছু-না-কিছু বাস্তবতা হয়তো রয়েছেও।

সাধারণ নারীরা নিয়মিত পোশাক হিসেবে শাড়ি ত্যাগ করতে থাকেন আশির দশক থেকেই। ওই সময় থেকে ধীরে ধীরে সালোয়ার-কামিজ, থ্রি-পিস, বোরকা, মেক্সি, হিজাব এসবের চল একটু একটু করে শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে শাড়ি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়: আমাদের প্রবাসীরাই যে প্রথম আরবে গিয়েছে তা তো নয়। যবে থেকে দেশে ইসলাম এসেছে, তবে থেকেই লোকে হজ করতে আরবে যায়। বিমান আবিষ্কারের পূর্বের আরব যাওয়ার সড়কপথে পর্দানশীন জাতিগুলোর নারীদের এ দেশের মানুষ দেখে এসেছে হাজার বছর ধরে। ফরায়েজি আন্দোলন বা দেওবন্দ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক চিন্তার প্রসারও তো আরবে সে যুগের সদ্য প্রতিষ্ঠিত ওহাবি মতবাদের প্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল। এবং সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের বিশ্ববীক্ষা পালটে দেওয়া পাকিস্তান আন্দোলন। যে আন্দোলনের প্রভাবে মুসলমানরা তাদের নামের সঙ্গে শ্রী শব্দের ব্যবহার বাদ দেয় (ব্রিটিশ আমলের জমির দলিলে মুসলমান নামের আগে শ্রী শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়), বাংলা ভাষার মুসলমান কবিরা বাংলা শব্দ বাদ দিয়ে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন এবং বাঙালি মুসলমান পুরুষরা নিজেদের পোশাক হিসেবে চিরতরে ধুতিকে ত্যাগ করে (পাকিস্তান আন্দোলনের আগে হিন্দু-মুসলমান সবাই ধুতি পরতেন) তখনও বাংলাদেশের নারীদের ব্লাউজ পেটিকোটহীন শাড়ি অক্ষত ছিল, যার বিলোপের লক্ষ্যে কোনো সামাজিক আন্দোলন দানা বাঁধে নাই। ইসলামে পুরুষের পোশাক নিয়ে বিধিনিষেধ অতি সামান্য, প্রায় নাই। নারীর পোশাক নিয়ে কোরআনে অত কড়াকড়ি না থাকলেও অনেক কড়া হাদিস আছে। অথচ দেশের কোনো শায়খুল হাদিস কি সেই যুগে নারীর পোশাক পরিবর্তন আন্দোলনের ডাক কেন দেন নাই বা দিয়ে থাকলেও তা কেন কেবল ওই মওলানার নিজের কান ভিন্ন অন্য কোথাও সাড়া তোলে নাই?

এর কারণ সে সময় ওই জলবিধৌত বাংলায় নারীর জন্য সবচেয়ে উপযোগী পোশাক ছিল ওই ব্লাউজ-পেটিকোটহীন শাড়ি। আজ বাংলাদেশে নারীদের যত ধরনের পোশাক আমরা দেখি জিন্স-টপস-ফতুয়া-ব্লাউজ ও পেটিকোটসহ শাড়ি-জামা-লেহেঙ্গা-থ্রিপিস-মেক্সি কোনোটি পরেই সাঁতার কাটা সম্ভব নয়। কোনোটি পরেই হাঁটু বা ঊরু পর্যন্ত সহজে তুলে গিঁট দিয়ে রেখে শাক তুলে-মাছ ধরে আবার ডাঙায় ফেরা সম্ভব নয়। অথচ এই সাঁতার বা কলমিশাক তোলার কিংবা হাঁটু অব্দি শাড়ি তুলে জলাজায়গা পার হওয়াটা ছিল নারীদের জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা। আমরা লক্ষ করলে দেখব, ষাট ও সত্তরের দশক থেকেই ভারত আমাদের নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। চীনও ব্রহ্মপুত্রের উজানের বাঁধগুলো এ সময়ের আগে দেয়নি। আবার বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের আওতায় বেড়িবাঁধ, ভাঙনরোধী বাঁধ দিয়ে নদীর পাড় উঁচু করা এবং স্লুইচ গেট নির্মাণ করে খালগুলোর গলা টিপে ধরার কাজ ষাট ও সত্তর দশক থেকেই ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়। খাল-বিল শুকিয়ে যায়। আশির দশক থেকে এর ফলাফল পড়তে থাকে সমাজে। এদিকে মাছ চাষের ফলে পুকুরেও স্নান করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আজকালকার গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাঁতারই জানে না। ফলে সাঁতার ও জলমগ্ন পরিবেশের উপযোগী পোশাক হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয়।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের আওতায় বেড়িবাঁধ, ভাঙনরোধী বাঁধ দিয়ে নদীর পাড় উঁচু করা এবং স্লুইচ গেট নির্মাণ করে খালগুলোর গলা টিপে ধরার কাজ ষাট ও সত্তর দশক থেকেই ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়। খাল-বিল শুকিয়ে যায়। আশির দশক থেকে এর ফলাফল পড়তে থাকে সমাজে। এদিকে মাছ চাষের ফলে পুকুরেও স্নান করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আজকালকার গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাঁতারই জানে না। ফলে সাঁতার ও জলমগ্ন পরিবেশের উপযোগী পোশাক হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয়।

তাই ইতিহাসের সহস্র বছরের অজস্র সামাজিক পরিবর্তন মহাশক্তিমান সব ঢেউ নারীর পোশাকের যেই পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি, সেটাই ঘটেছে বিগত দু-তিন দশকের কিছু অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল ঘটনাচক্রের ধাক্কায়। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানের কয়েকটা লাইন ছিল এরকম যে,

 ‘এই পদ্মা এই মেঘনা

এই হাজারো নদীর অববাহিকায়

এখানে রমণীগুলো নদীর মতন

নদীও নারীর মতো কথা কয়’

ফলে জীবনদায়িনী অববাহিকাগুলোর এই অপমৃত্যু নারীর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে না, এমন ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই।

মাহাথীর মুহাম্মদ: ভূগোল বিভাগের স্নাতকোত্তর গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: muhammadmahathir2019@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •